নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

চলো আমরা পাখিদের কাছ থেকে ইউক্লিডের নতুন পাঠ নেই জীবনানন্দের পাঠ নেই নিউটনের আপেল গাছটি থেকে।

জসীম অসীম

লেখা হলো কেতকীফুল। ভালোবাসি তাই।

জসীম অসীম › বিস্তারিত পোস্টঃ

ডায়েরি : ১৯৯১-১৯৯২---জসীম অসীম

১৬ ই জুলাই, ২০১৪ রাত ২:২৩

জসীম অসীম

২২ জুলাই ১৯৯১ কুমিল্লা

আজ কুমিল্লার সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘আমোদ’-এর সম্পাদক মোহাম্মদ ফজলে রাব্বীর সঙ্গে দেখা করি। তার সঙ্গে কবিতা লেখালেখির বিষয় নিয়ে অনেক আলাপ হয়।



২৩ জুলাই ১৯৯১ ঢাকা

আজ কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আসি। আসার সময় ছোটভাই পিয়াস খুব কান্নাকাটি করে। আসতেই দিতে চায়নি। বাসে উঠে তাই আমিও আর না কেঁদে থাকতে পারিনি। আমার জন্য এত ভালোবাসা তার...।



২৪ জুলাই ১৯৯১ ঢাকা

আজ বিকেলে শনিআখড়া হয়ে চিটাগাং রোড পর্যন্ত হাঁটতে হাঁটতে যাই। রাস্তার পাশে ট্রাক থামিয়ে থামিয়ে পুলিশকে ঘুষ নিতে দেখি।



২৫ জুলাই ১৯৯১ ঢাকা

আজ আমার ঘড়িটি নষ্ট হয়ে গেলে শনিআখড়ার এক মেকারের কাছে নেই। টাকা ছিল না বলে ঘড়িটি নিয়ে আসতে পারিনি। টাকার খুবই অভাব যাচ্ছে। সারাদিন টিউশনি খুঁজি , পাইনি।



২৭ জুলাই ১৯৯১ ঢাকা

সারাদিন ছিল হরতাল। মানুষ এর পক্ষে বিপক্ষে অনেক কথা বলেছে। আমি দেখলাম , পকেটে পয়সা না থাকলে মানুষের কোনো মূল্যই থাকে না।



২৭ জুলাই ১৯৯১ ঢাকা

আজকের হরতালের সময় আমি সকালবেলা নাস্তা করে পায়ে হেঁটে শনিরআখড়া থেকে সায়েদাবাদ যাই। সায়েদাবাদ থেকে হেঁটে যাই সদরঘাট। সদরঘাট থেকে হেঁটে যাই আজিমপুর পলাশীব্যারাক বড় দুলাভাইয়ের কাছে। দুলাভাই তিনটার দিকে ভাত খাওয়ান। তারপর সেখান থেকে যাই শাহবাগে এবং শাহবাগ থেকে হাঁটতে হাঁটতে আবার শনিরআখড়া দিয়ে বাসায় আসি। আমার ছাত্র সালাহউদ্দিন বলে , কাকা আপনি তো রোদে পুড়ে একদম কুচকুচে কালো হয়ে ফিরেছেন।



২ আগষ্ট ১৯৯১ ঢাকা

একটি কলম কেনার মতো পয়সাও আমার কাছে নেই। গত কিছুদিন ধরে টিউশনির খোঁজ করছি , পাচ্ছি না। টাকা পয়সা না থাকার কারণে মর্মান্তিক কষ্ট পাচ্ছি। বিশেষ করে বিকেলের নাস্তা করার সময় পেটে ভীষণ ক্ষুধা হয়। বাইরে এক কাপ চা-দুটি বিস্কুট খাওয়ারও ব্যবস্থা হয় না।



৩ আগষ্ট ১৯৯১

ইদানীং মুখে গোঁফ-দাড়ি উঁকি দিয়েছে। রেজরটা ভেঙ্গে গেলো , আর কেনার ব্যবস্থা হয়নি। এ অবস্থায় খোলা ব্লেড দিয়ে সেভ করতে গিয়ে আজ মুখই কেটে ফেললাম। জীবনটা আসলে সহজকিছু নয়।



৫ আগষ্ট ১৯৯১ ঢাকা

ঢাকায় থাকি রাজ্জাক ভাইয়ের বাসায়। আমাদের গ্রামেরই লোক। তার এক চাচাতো ভাই খালেক। তার কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে আজ কলম কিনি। খালেক ভাই ঢাকায় শহর সার্ভিস বাসের হেলপার।

টাকার অভাবে আর ঘড়ি মেরামত হলো না। অন্যদিকে শরীরে প্রচন্ড জ্বর। ওষুধের ব্যবস্থা নেই। সারাদিন টিউশনি খুঁজেছি , পেলাম না।



৮ আগষ্ট ১৯৯১ ঢাকা

আজ থেকে ঠিক ৭ বছর আগে ১৯৮৪ সালের ৮ আগষ্ট তারিখে আমি আমার বড় ভাইয়ের সঙ্গে কুমিল্লা শহরের দীপিকা সিনেমা হলে প্রথম ছবি দেখি। ছবির নাম ছিল ‘রাজিয়া সুলতানা’।

অর্থাভাব প্রকট আমার। রাজ্জাক ভাইয়ের স্ত্রী সকালে ৫০০/=[পাঁচশত] টাকা দিয়ে বাজারে পাঠিয়েছিলেন। এত অভাবেও একটি টাকাও মারতে পারিনি। এ যে আমার মায়ের শিক্ষা। এ শিক্ষা কি বাতিল হতে পারে?



১৯ আগষ্ট ১৯৯১ ঢাকা

আজ অনেক দিন হলো হাতে একটি পয়সাও নেই। টিউশনি আর চাকুরি খোঁজ করছি। ফরাশগঞ্জের পুথিঘর+মুক্তধারা লাইব্রেরীতে যাওয়ার জন্য জসীম নামের এক ছেলের কাছে ১০টি টাকা ধার চেয়েও পাইনি। মাতুয়াইল পশ্চিমপাড়া থেকে শনিআখড়া হয়ে হেঁটে হেঁটে সদরঘাট-ফরাশগঞ্জ যাই। সদরঘাট থেকে হেঁটে যাই পলাশী ব্যারাক। কিন্তু ওখানে দুলাভাইকে না পেয়ে কুমিল্লা বার্ডের গেস্ট হাউজে যাই , শাহবাগে। হেঁটেই। সেখানে গিয়ে দেখি বড় ভাই আলী আশ্রাফ গেস্ট হাউসের এনামুল ভাইয়ের কাছে আমার জন্য ১৫০/= টাকা পাঠিয়েছেন। টাকাটা পেয়ে মনে হলো দম ফিরে পেয়েছি আমি।



১১ আগষ্ট ১৯৯১

ঢাকা

আজ মাতুয়াইলের মৃধাবাড়ি বাসষ্ট্যান্ড [ডেমরা-গুলিস্তান সড়ক] থেকে হাঁটতে হাঁটতে বুড়িগঙ্গা ব্রীজে যাই। তারপর সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে পুরনো ঢাকার ফরাশগঞ্জে এসে মুক্তধারা প্রকাশনীর কার্যালয়ে চাকুরির জন্য দরখাস্ত জমা দেই। বাসায় এসে টিউশনি খুঁজি।

এই যে আমার এত অভাব , কিছু মানুষ কিন্তু আমার চেয়েও অভাবী। আবার কিছু মানুষ বেনারসী-ডালিম-টিভি-ফ্রিজ বেমালুম কিনে নিচ্ছে। আমি ছাত্র। হাতে অর্থ নেই। অর্থহীন জীবনই অকেজো , কোনো কাজেই লাগে না। নিরর্থক। নিরর্থক জীবনে সবকিছুকেই নিরর্থক মনে হয়।



১২ আগষ্ট ১৯৯১-ঢাকা

আজ মুক্তধারা প্রকাশনী সংস্থায় একটি সাধারণ চাকুরি হয়। ১৯৮৯ সালে এই প্রতিষ্ঠানে আমি প্রথম এসেছিলাম একটি চাকুরির সন্ধানে। সেদিন ফরাশগঞ্জের মুক্তধারা প্রকাশনীর এ বাড়িটার সামনে অবস্থান নেয়া নারকেল গাছটির দিকে তাকিয়ে আমি মনে মনে বলেছিলাম , আবার আসবো আমি এ প্রতিষ্ঠানে। আবার। ঠিকই আবার আসা হলো এ প্রতিষ্ঠানে আমার।



১৩ আগষ্ট ১৯৯১-ঢাকা

আজ সকালে মুক্তধারা প্রকাশনীতে কাজের জন্য বাসা ছেড়ে যাই। তাই ছাত্রছাত্রীদের সকাল বেলা পড়াতে পারিনি। পকেটে টাকা নেই। দুপুরেও খাইনি। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরি খুবই কর্মকান্ত হয়ে।

জীবনের এত জটিলতা দেখলে মাঝে-মধ্যে মনে হয় ছেলেবেলায় মামারবাড়ির কাছাকাছি উটখাড়া দিঘি কিংবা হাড়েষারের দিঘিতে দেখা ডুব দিয়ে মাছ শিকারী পানকৌড়ি হওয়াও যেন খুব ভালো ছিল। অবশ্য আমি নিশ্চিত যে কোনো একদিন আর এসব দিঘিও থাকবে না , পানকৌড়িরাও বাঁচবে না। এই আমি যেমন এখন খুবই পরীক্ষাধীন আছি।



১৪ আগষ্ট ১৯৯১ ঢাকা

খুব সকালে পানতাভাত খেয়ে মাতুয়াইল থেকে দৌড়ের মত হেঁটে ঠিক ৮টায় মুক্তধারা প্রকাশনী সংস্থার কার্যালয়ে হাজির হই। ফরাশগঞ্জের এ কার্যালয়েই আমাকে কাজ করতে হচ্ছে। দুপুরে কিছু খাওয়ার মতো কোনো পয়সাই ছিল না। জীবনের ঠিক এ রকম বাস্তবতায় আমি কোনোদিনই আগে পড়িনি।

সাপের ভয়ে একদা মানুষ সাপের দেবী মনসার কীর্তন করতো। সেই কীর্তনের কতো কাহিনী নিয়ে তখন কবিতাও রচিত হয়েছে। অথচ আমার কাছে সাপ হলো অভাব। অভাবের হাত থেকে রক্ষা পেতে আমি সর্বদা পূজা করতে চাই , কিন্তু কোন দেবীর পূজা করবো আমি। আমার কবিতাগুলোর বেশিরভাগই অভাবের বিরুদ্ধে রচিত।



১৫ আগষ্ট ১৯৯১-ঢাকা

মুক্তধারা লাইব্রেরীতে কাজ করা আমার সহকর্মি বরিশালের সবুর ও ছিদ্দিকের আজ চাকুরি চলে যায় কিংবা ওরাই চাকুরি ছেড়ে দেয়। একটি পয়সাও ওদের কাছে ছিল না। না খেয়ে খুবই কষ্ট করেছে , আমার চেয়েও শতগুণ বেশি।

সকালে মুড়ি খেয়ে মুক্তধারা লাইব্রেরীর কাজে যাই। দুপুরে খাওয়ার পয়সা ছিল না। হেঁটে যাই , হেঁটে আসি। রাতে এসে লজিং বাসায় ভাত খাই।



১৬ আগষ্ট ১৯৯১-ঢাকা

আমি যখন ঢাকায় আসি পড়তে , তখন আমার বড় ভাই আলী আশ্রাফ আমাকে কুমিল্লার কোটবাড়ি বার্ড-এর ঢাকার গেষ্ট হাউসে কর্মরত তাহের ভাইয়ের নিকট লজিং এর জন্য পাঠান। গেষ্ট হাউস অবস্থিত শাহবাগে। তাহের ভাইয়ের বাড়িও কুমিল্লায়। কিন্তু ৪ বার কুমিল্লা থেকে এসে তাহের ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করেও লজিং এর ব্যবস্থা হয়নি। অবশেষে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা এক জায়গায় হলেও অর্থ সঙ্কট দূর হয়নি। তাই এভাবে মুক্তধারা লাইব্রেরীতে চাকুরি নেয়া আমার।



১৮ আগষ্ট ১৯৯১-ঢাকা

ঢাকায় এসে টিউশনি খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে যাই। যার বাসায় থাকি , তার পরিচয় দিয়ে আমি টিউশনি খুঁজি না বলে কেউ আমার নিজ পরিচয়ে টিউশনিও দিতে চায় না। নাজমা নামের নবম শ্রেণীর এক মেয়েকে কিছুদিন পড়িয়েছিলাম। কিছুদিন। চরমতম বেয়াদব। পড়তেই চায় না। বসে থাকে। প্যানপ্যান করে। বিড়বিড় করে। উপরের মাড়ির সামনের দুটো দাঁতের মাথা ভাঙ্গা। হাসলে বদ লাগে। পড়ালেখায় মন নেই , বদ নেশায় মন। নিজের বোন এমন হলে খুনই করে ফেলতাম। আবার বলে কী না বাঙালির ইংরেজি পড়ে কী লাভ হবে ? বীজগণিত শিখে কি ভাত রান্না হবে ? শেষে পড়ানোই ছেড়ে দিলাম। নামলাম চাকুরির সন্ধানে। তারপর...।

১৯ আগষ্ট ১৯৯১-ঢাকা

প্রায় এক সপ্তাহ সময় ধরে মুক্তধারা লাইব্রেরীতে না খেয়ে কাজ করলাম। কিন্তু কোনো টাকা পয়সা দেয়না বলে অবশেষে আজ চাকুরিটা ছেড়েই দিলাম। কর্তৃপক্ষ বলছে , টাকা দেবে মাস শেষ হলে। আমি বললাম , সাপ্তাহিক হিসেবে আমাকে কিছু টাকা দিন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কথা রাখেননি। কী করবো। শুধু শিশুতোষ প্রকাশনার ছবি দেখলেই কি আর পেট ভরবে? আমারতো বেঁচেও থাকতে হবে।

২০ আগষ্ট ১৯৯১-ঢাকা

আজ সকালে টিউশনির সন্ধানে বের হয়েছিলাম। কিন্তু কোথাও পাইনি।

আমি যার বাসায় থাকি-তার নাম রাজ্জাক। আমাদের গ্রামের বাড়িতেই তার বাড়ি। একদা তিনি আমার বাবার কাছ থেকেও সহায়তা পেয়েছিলেন। রাজ্জাক ভাই নিজেই তা সময়ে সময়ে আমাকে বলেন। তারপরও আমি তার বসায় তার সন্তানদের পড়ানোর বিনিময়েই থাকি। আজ রাজ্জাক ভাইয়ের মাধ্যমে বড় ভাই আলী আশ্রাফ তার এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার মূল সার্টিফিকেট আমার কাছে পাঠান , তার পরীক্ষার বিষয়ে।

২১ আগষ্ট ১৯৯১-ঢাকা

ঢাকায় না এলে অনেক অভিজ্ঞতাই হতো না , যদিও ঢাকা শহরে কদম ফুলের ঘ্রাণে প্রাণ ভরে না আমার। বলা যে হয় তিলোত্তমা ঢাকা , ঢাকার সৌন্দর্য আসলে কোথায়? বেকার মানুষের পরিহাসে-উর্ধ্বশ্বাসে-সর্বনাশে ঢাকা শহর যেন সব সময়ই থাকে তাতানো , আমার তো এমনই মনে হয়।

আজ আশ্রাফ ভাইয়ের বি.এ পরীক্ষার আবেদনপত্র জমা দিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই , কিন্তু অফিসারদের পূর্ণদিবস কর্মবিরতির কারণে তা আর জমা দিতে পারিনি।

২২ আগষ্ট ১৯৯১-ঢাকা

আমি যে বাসায় থাকি , এ বাসার নাম আলাউদ্দিন ভিলা। তার পাশের বাসা হলো গোলাম আলীর। গোলাম আলীর একটি ওষুধের দোকান রয়েছে , আলী ফার্মেসী। তার কাছেই বাবু নামের আরেকজনের দোকান। বাবুকে আমি টিউশনির বিষয়ে অনেক অনুরোধ করি। বাবুর কাছ থেকে টিউশনি পাওয়ার আশায় আজ সন্ধ্যায় বৃষ্টিতে ভিজে মাতুয়াইল থেকে শেখদী স্কুলের কাছ থেকে রেফ্রিজারেটরে রাখা ঠান্ডা দুটো মেরিন্ডা এনে খাওয়াই।

২৩ আগষ্ট ১৯৯১-ঢাকা

আজ অনেক ঠেলাঠেলি করে ডেমরার লোকাল বাস ‘মুড়ির টিন’-এ করে মাতুয়াইল থেকে গুলিস্তান যাই। তারপর শাহবাগ। বাসায় ফিরে বাড়ির জন্য খুবই মন খারাপ হয় আমার। মনের ভিতর ঝড়ো বাতাস বয়ে যায় , বিশেষ করে মায়ের জন্য শুধু।

২৪ আগষ্ট ১৯৯১-ঢাকা

আমার বাবা ও ভাই সংসারে যেটুকু উপার্জন করেন , তাতে আমাদের সংসারের সব প্রয়োজন মিটে না। কারণ তাদের আয় অল্প , সংসারে আমরা ভাইবোন বেশি। আমার জন্য তাই আলাদা খরচ পাঠানোর বা দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। এদিকে আমি যেখানে থাকি , সেখানে সকালে ও রাতে পড়ানোর সময় বাদে যে সময় পাই , সে সময়ের মধ্যে টিউশনি পাওয়াই কঠিন। সারাদিন টিউশনির খোঁজ করি কিন্তু ফায়দা হয়নি। স্বাস্থ্যটাও ভালো নেই। আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি খুবই চিন্তিত।

২৬ আগষ্ট ১৯৯১-ঢাকা

আজকে আর লেখার কলমও নেই। কেনার পয়সাও নেই। পথে পাওয়া একটি লালকালির বলপেন দিয়ে লেখার কাজ চালাই। এ সমাজে কোনো ভারসাম্য নেই। কারোর কতো কলম , কিন্তু লিখছে না কিংবা এত কলম তাদের দরকার নেই। অন্যদিকে অনেকের কলম দরকার খুব কিন্তু কলম পাচ্ছে না। আজ আশ্রাফ ভাইয়ের বিএস [পাস] পরীক্ষার ফরম উঠিয়ে কুমিল্লায় পাঠাই।

২৮ আগষ্ট ১৯৯১ ঢাকা

আজ যাত্রাবাড়িতে একটি টিউশনি হওয়ার কথা ছিল , কিন্তু হয়নি। যে মেয়েকে পড়ানোর কথা ছিল , বলা ছিল মেয়েটি বোরকা পড়ে আমার কাছে পড়তে আসবে। অথচ সে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। অবশেষে তার বাবা কোনো ছেলেকে দিয়ে পড়ানোর সিদ্ধান্তই বাদ দিয়েছেন। কিন্তু মেয়েটির মা চেয়েছিলেন আমি পড়াই। কিন্তু মা তো আর সংসারের নিয়ন্ত্রক নন। মেয়েটির বাবার রয়েছে জুতার দোকান।

৩১ আগষ্ট ১৯৯১ ঢাকা

আমার ঢাকার জীবন ভালো যাচ্ছে না। অর্থাভাবে কোনো চাহিদাই পূরণ হচ্ছে না , আমি আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে খুবই চিন্তিত। যদি লেখালেখি না করতাম , তাহলে এখনি টাকার জন্য যা ইচ্ছে তা-ই করতাম।

অতীতটা আমার ভালো গেল না। যদি ভবিষ্যৎ দেখার দূরবীক্ষণ পেতাম , ভালো হতো। তবে মনে হচ্ছে দুর্গতি দূর হবে না। কারণ অর্থই যেখানে সবকিছু , সেখানে মানুষের কি কিছু মূল্য আছে?

১ সেপ্টেম্বর ১৯৯১ ঢাকা

শৈশবে ডায়েরি রাখতাম আমি। বছর বছর। পরে সেসব হারিয়েছি। নতুন করে ডায়েরি রাখার আজ এক বছর পূর্ণ হলো। টিউশনি আর পার্টটাইম চাকুরির খোঁজে বের হই। কুমিল্লার সঙ্গে যোগাযোগ নেই , মন খারাপ। খুবই।

২ সেপ্টেম্বর ১৯৯১ ঢাকা

আজ ঢাকা শহরে জীবনের প্রথম দোতলা বাসে চড়ি। এর আগে দোতলা বাসে চড়া হয়নি বিভিন্ন কারণে।

মানুষ এতটা স্বার্থপর , ভাবলে কষ্ট হয়। বড় ভাই আলী আশ্রাফ চাকুরি করেন কুমিল্লা বার্ডে। বার্ড-এর একটি ঢাকা অফিস রয়েছে শাহবাগে। ওখানে বড় ভাইয়ের পরিচিত কিছু লোক রয়েছেন। তাদের কাছে বড় ভাইয়ের বিএ পরীক্ষার ফরম দিয়ে এসেছিলাম গত ২৬ আগষ্ট। অথচ এর মধ্যে কয়েকবার কুমিল্লা থেকে লোক এবং গাড়ি আসা-যাওয়া করলেও বড় ভাইয়ের পরীক্ষার ফরমটি অফিসের জনৈক ক্রিমিনাল বিদ্বেষবশত: পাঠায়নি।

৩ সেপ্টেম্বর ১৯৯১-ঢাকা

আজ মাতুয়াইলে একটি টিউশনি হয়। শাহ আলম নামক এক লোকের বাড়ি নোয়াখালীতে। বিদেশ থেকে তিনি মাতুয়াইলে সে দোতলা বাড়ি করেছেন। নিজের চেহারা ভূতের মতো কালো , আর বউটি যেন ঠিক পরী। শাহ আলমের ছোট দুই ভাইকেই পড়ানোর দায়িত্ব পেয়েছি আমি। আজ সন্ধ্যায় শাহবাগ থেকে মাসিক ‘শিশু’ পত্রিকা আনি , যা পড়তে বড় আনন্দ পাচ্ছি। কুমিল্লায় থাকতেও এই পত্রিকাটির পুরনো সংখ্যা সংগ্রহ করে পড়তাম।

৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯১ ঢাকা

মায়ের জন্য মনটা ভীষণই খারাপ। নীতির প্রশ্নে আমার মায়ের দৃঢ়তা অকল্পনীয়। তাই আমরা খারাপ হতে পারছি না। আমার মায়ের দূরদৃষ্টি রয়েছে।

গত ২৩ জুলাই আমি কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আসি। কিন্তু ভাড়ার অভাবে এখন কুমিল্লায়ও যেতে পারছি না। মাকে ছেড়ে এভাবে কোথাও থাকিনি আমি। বাবা যেহেতু চাকুরি করেন , তাকে ছেড়ে থাকার কিছুটা অভ্যাস আমাদের ছিল। কিন্তু মাকে ছেড়ে থাকিনি। দূরে এসে বুঝি , মা যে কতো আপন।

৭ সেপ্টেম্বর রোববার ১৯৯১ ঢাকা

আজ শাহবাগ বার্ডের গেষ্ট হাউস ও পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম আশ্রাফ ভাইয়ের ফরম ফিলাপের ব্যাপারে। কিন্তু অর্থ সঙ্কটের কারণে এ কাজ শেষ করতে পারিনি। আজ আসার পথে শনিআখড়ায় বাস দুর্ঘটনায় আমার প্যান্ট ছিঁড়ে যায় ও পা কেটে যায়। আজ শারীরিক অবস্থাও ভালো নেই। কোষ্ঠকাঠিন্যের ভাবও রয়েছে।

১০ আগষ্ট ১৯৯১ ঢাকা

আজ মাতুয়াইল ভূঁইয়া বাড়িতে আরেকটি টিউশনি হয়। ক্লাস এইটের একটি ছাত্র পড়াচ্ছি , নাম ফাইজুল ইসলাম। তার বোন পড়বে অন্য শিক্ষকের কাছে। এ এলাকার টিউশনি শিক্ষকগণ নাকি মেয়ে দেখলেই প্রেম করে ফেলে। তাই যুবতী মেয়েদের সহজে যুবক শিক্ষকের কাছে পড়তে দেয় না। আজ বড় ভাইয়ের পাঠানো দু’টি চিঠি পাই ডাকে। রাজ্জাক ভাই তার পরিবারের সকল সদস্য নিয়ে তার এক আত্মীয়ের বাসায় দাওয়াত খেতে যায়। আমি বাসায় একা থেকে গান শুনি। রবীন্দ্রসংগীত। এ গান আবার এখানে কেউ শুনে না।

১১ সেপ্টেম্বর ১৯৯১ ঢাকা

আজ আশ্রাফ ভাইয়ের বিএ পরীক্ষার ফরম পূরণ করে জমা দিয়ে আসি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে। আসার পথে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি থেকে প্রকাশিত শিশু সাহিত্য পত্রিকা মাসিক ‘শিশু’ এর সম্পাদক গোলাম কিবরিয়া ও বিপ্রদাস বড়–য়ার সঙ্গে দেখা করি। তারা আমাকে লেখালেখি বিষয়ে পরামর্শমূলক অনেক কথাই বলেন।

১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৯১ ঢাকা

আজ রফিকুল ইসলাম বাচ্চু দুলাভাই এসেছিলেন। আব্বার পাঠানো কিছু টাকা দিয়ে যান। আজ রাতে ‘ভাঙ্গাপ্রেস’ নামক এক জায়গা থেকে মাছ কিনে আনি। প্রায় প্রতি রাতেই এখান থেকে মাছ কিনে আনি আমি রাজ্জাক ভাইয়ের পরিবারের জন্য।

১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৯১ ঢাকা

নাটক ক্রমাগত আমার প্রাণ হয়ে উঠছে। আজ সেলিম আল দীন রচিত ‘গ্রন্থিকগণ কহে’ নাটকটি বিটিভি-তে দেখে খুবই মুগ্ধ হই।

এই যে আমার নাট্যপ্রীতি , এ জন্য সমাজ আমাকে বেশি দাম দেয় না। যদি টিউশনি করে টাকা জমিয়ে আমি একটু জায়গা কিনতে পারতাম , তবে আমার দাম হতো। অথচ এই ঢাকা শহরের পথে কোথাও যদি আমি দূর্বাঘাস দেখি , বসে পড়ি শৈশবের ঘ্রাণ নিতে।

২০ সেপ্টেম্বর ১৯৯১ ঢাকা

আজ বিটিভি-প্রচারিত বাংলা পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি ‘লাল মেমসাহেব’ দেখি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’ উপন্যাসটি আমার পাঠ্য ছিল। সেখানে যে কুবের ছিল , সে ছিল খুব গরীব এক মাঝি। অথচ কুবের হলো ধনের দেবতা। আমাদের এ রকম নামকরণের বিশেষত্ব কী! এক মেয়ের নাম রূপসী , এই এলাকার , কিন্তু চেহারার দিকে চাওয়া যায় না।

২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৯১ ঢাকা

আজ সারাদিন খুবই বৃষ্টি ছিল। এমন বৃষ্টির দিন , যখন গ্রামে ছিলাম , মা কতো যে কষ্ট করতেন। মাস শেষ না হলে বাবা টাকা পাঠাতে পারতেন না। অথচ টাকার অভাবে মা সুদের টাকার জন্য দ্বারে দ্বারেও ঘুরতেন। বাবা কুমিল্লা আসাতে মায়ের সেই কষ্ট কিছুটা দূর হয়েছে।

২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৯১ ঢাকা

আজ কয়েকদিন ধরে টানা বৃষ্টি হচ্ছে। গ্রামের বাড়িতে হয়তো বড় আপা আমেনা তার সন্তানদের নিয়ে খুবই কষ্ট পাচ্ছেন। দুলাভাই ঢাকায় চাকুরি করেন। বেতন যা পান , তা দিয়ে পুরো পরিবার ঢাকায় আনা অসম্ভব। টাকার খুবই অভাব , কাগজকলমও কেনার অবস্থা নেই।

২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৯১ ঢাকা

হাতে কোনো টাকাই নেই। একটি টাকা বইয়ের ভিতর পেয়ে ফকিরকে দান করে ফেলেছি।

১ অক্টোবর ১৯৯১ ঢাকা

ফাইজুল নামের এক ছেলেকে প্রায় এক মাস পড়ালাম কিন্তু টাকা দিচ্ছে না। শুনেছি ওরা নাকি শিক্ষকের বেতন এভাবে বকেয়া রাখে। তারপর টাকা না পেয়ে সেই শিক্ষক চলে গেলে আবার নতুন শিক্ষক রাখে। যদি এমন কৌশল অবলম্বন করে নিজেদের চালাক মনে কওে , তাহলে কি তাদের সত্যি লেখাপড়া হবে?

২ অক্টোবর ১৯৯১ ঢাকা

আজ বাড়ির কথা খুব মনে পড়ে। ছোট ভাইবোনগুলোকেও কতোদিন দেখি না। বিকেলে খুব মন খারাপ ছিল। তাই শনিরআখড়া থেকে হাঁটতে হাঁটতে চিটাগাং রোড পর্যন্ত যাই , তারপর সন্ধ্যায় বিষন্ন মনে আবার ফিরে আসি।

৩ অক্টোবর ১৯৯১ ঢাকা

আজ শাহ আলমের বাসার টিউশনির বেতন বাবদ ৪ শত টাকা পাই। টাকা পেয়ে পল্টন থেকে কাদেরী কিবরিয়ার গাওয়া একটি রবীন্দ্র সংগীতের অডিও ক্যাসেট কিনি। তারপর কুমিল্লার পথে রওয়ানা হই , কিন্তু পথ থেকে রাজ্জাক ভাই ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। তাতে আমার মন খুবই খারাপ হয়। আমাকে ফিরিয়ে আনার কারণ ৬ অক্টোবর রাজ্জাক ভাই সৌদি আরব চলে যাবেন।

৪ অক্টোবর ১৯৯১ ঢাকা

আজ রাজ্জাক ভাইয়ের বিদেশ যাওয়া উপলক্ষে মিলাদ শরীফের আয়োজন করা হয়। এতে তার অনেক আত্মীয় স্বজনও উপস্থিত ছিলেন। নিজের সম্পর্কে ক্রমাগত প্রশ্ন জাগছে মনে , আমি কি আসলেই দামি কোনো অলঙ্কার , নাকি ইমিটেশন? কারণ কেউ তো ঠিক আমাকে বুঝে না। ঘরে-বাইরে-সর্বত্র। এ সমাজে আমার চেয়ে সুখে আছে কোনো আড়তের কর্মচারী।

৫ অক্টোবর ১৯৯১ ঢাকা

আজ রাজ্জাক ভাইয়ের বাসায় তার অনেক আত্মীয়স্বজন আসেন , কারণ তিনি আগামীকাল বিদেশ চলে যাবেন। এ দিকে আমার মন কুমিল্লার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে।

৬ অক্টোবর ১৯৯১ ঢাকা

আজ রাজ্জাক ভাই বিদেশ চলে যান। তার বড় ছেলে আলাউদ্দিনসহ তার অনেক আত্মীয়ের সঙ্গে বিমানবন্দরেও যাই আমি। এই প্রথম আমি জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দেখলাম।

৭ অক্টোবর ১৯৯১ কুমিল্লা

প্রায় আড়াই মাস পর আজ কুমিল্লায় এসেছি। আমি যেন আজ জলে জলে উড়ে বেড়ানো জলপিপি পাখি। ভাইবোন-বাবা মা-মামা-মামী ও মামাতো ভাইবোনদের কাছে পেয়ে খুবই ভালো লাগছে। আমাদের বাসাটা গাছ ও লতাপাতা দিয়ে ঘেরা একটি বাগান যেন। ফিঙে পাখিরা উড়াউড়ি কওে , কখনো পুরনো গোমতি নদী থেকে উড়ে এসে মাছরাঙাও বসে। ছোট ভাই বোন দামাল-মনি-কথা ও মামাতো ভাই ইকবালের সাথে আড্ডা জমে উঠে। ঠিক করি আগামীদিন বিকেলে গোমতি নদীর পাড়ে যাবো , নদী দেখতে।

১০ অক্টোবর ১৯৯১ কুমিল্লা

গত ২ দিন গোমতি নদীসহ বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াই। আজ বিকেলে মামাতো ভাই ইকবালকে নিয়ে ধর্মসাগরের পূর্বপাড়ে অবস্থিত স্টেডিয়ামের গ্যালারীতে বসে কুমিল্লা শহরের প্রকৃতি দেখি। এই শহরে হাজার হাজার নারকেল গাছ রয়েছে।

১১ অক্টোবর ১৯৯১ ঢাকা

আজ কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আসি। মনে খুব কষ্ট। মন ভালো হওয়ার বিশেষ কোনো ওষুধ নেই আমার এই ঢাকা শহরে। তাই কুমিল্লা শহর থেকে ঢাকা শহরের বিশাল পার্থক্য আমি অনুভব করি।

রোজ রোজ বদলে যায় ঢাকা শহর। এ শহরের মতো আমি নিজেকে বদলাতে পারিনা। আমার মাঝে মাঝেই মনে হয় , মানুষ না হয়ে আমার বিহঙ্গ হলেই ভালো ছিল।

১২ অক্টোবর ১৯৯১ ঢাকা

পলাশ ফুল দেখলেই আমার পলাশীর যুদ্ধের কথা মনে পড়ে কিংবা পলাশীর যুদ্ধের ইতিহাস পড়তে গেলেই আমার পলাশ ফুলের কথা মনে পড়ে যায়। কেন ? জানি না।

তেমনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি-র সামনে দাঁড়ালেই আমার নাটকের কথা খুব মনে পড়ে। মনে পড়ে মমতাজউদ্দিন আহমদ স্যার ও নাট্যকার সেলিম আল দীন-এর কথা। ব্যাখ্যা জানা নেই।

আজ আশ্রাফ ভাইয়ের বিএ পরীক্ষার তারিখ জানতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই। তারপর টিএসসি-এর দোতলায় গিয়ে প্রেক্ষাপট নাট্যালয়ের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলি। তাদের জানাই আমার নাট্যপ্রীতির কথা।

১৩ অক্টোবর ১৯৯১ ঢাকা

আজ সকালে বৃষ্টিতে ভিজে লজিং বাসার বাজার করি। তারপর আবারও বৃষ্টি উপেক্ষা করে সায়েদাবাদ যাই ছবি তোলার জন্য। ছবি প্রয়োজন নাটকের কাজে। প্রেক্ষাপট নাট্যালয়ের ফরম নিয়ে এসেছি। তাই স্টুডিও আম্বালায় ছবি তুলেছি। আগের ছবি কাজে আসবে না। সদ্য তোলা নতুন ছবি জমা দিতে হবে। ইচ্ছে হয় নাটকের জন্য নিজেকে একেবারে উৎসর্গ করে দেই।

১৪ অক্টোবর ১৯৯১ ঢাকা

আজ আমাদের গ্রামের দক্ষিণপাড়ার মোহাম্মদ আলী বিদেশ যায়। কিন্তু তার মা তার জন্য রীতিমত বিলাপ করেন। আমার ভীষণ কষ্ট লাগে। আমার মা-ও কি আমাকে ছেড়ে কুমিল্লায় এমন কান্নাকাটি করে? আসলে জননী-জন্মদাত্রী মা , তার প্রেম কোনোদিনও ফুটো হবে না। বিকেলে প্রেক্ষাপট নাট্যালয়ের রিহার্সাল দেখি। রিহার্সালে অংশ নেয়ার মতো সময় আমার হাতে ছিল না । তাই মনে ভীষণ দু:খ আমার।





১৮ অক্টোবর ১৯৯১ ঢাকা

আজ টিউশনির জন্য প্রেক্ষাপট নাট্যালয়ের রিহার্সালে যেতে পারিনি। বিকেলে বিটিভি-তে ‘আনাড়ী’ ছবি দেখি । শাবানা-নাদিমের অভিনয় ভালো লেগেছে। আশ্রাফ ভাইয়ের একটি চিঠি পেলাম। লিখেছেন , পারলে আমি যেন একটি পার্টটাইম চাকুরির ব্যবস্থা করি। কারণ আমাদের সংসারের ব্যয় ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাতে রবীন্দ্রনাথের ‘খেয়া’ কাব্যগ্রন্থ থেকে অনেক কবিতা পড়ি ‘তুমি এপার-ওপার করো কে গো ওগো খেয়ার নেয়ে...’। এসব লাইন পড়লেই আমার কুমিল্লার গোমতি নদীর রতœাবতী খেয়াঘাটের কথা খুবই মনে পড়ে যায়।

২৩ অক্টোবর ১৯৯১ ঢাকা

টাকার অভাবে প্রেক্ষাপট নাট্যালয়ের রিহার্সালে যাওয়া বন্ধ রয়েছে। বাংলা বাজারের ইনকিলাব পাবলিকেশন্স থেকে সাংবাদিক রুহুল আমীন খানের ‘শ্লোগান একটাই’ শীর্ষক ছড়ার বইটি আনি। ছাত্রশিবির করাকালীন তার সঙ্গে আমার পত্র যোগাযোগ ছিল।

২৭ অক্টোবর ১৯৯১ ঢাকা

ঢাকাতে আমার অনেক কিছুই করার আছে , কিন্তু টাকার অভাবে করা হচ্ছে না। শিশু একাডেমিতে যাই কিন্তু বই কিনতে পারিনি। রাতে চিত্রনায়িকা রোজিনা উপস্থাপিত ‘ছায়াছন্দ’ দেখি বিটিভি-তে ।

৩১ অক্টোবর ১৯৯১ ঢাকা

আজ ফাইজুলের কাছ থেকে টিউশনির টাকা বাবদ ১৫০ টাকা পাই। অনেক কষ্টে এ টাকাটা আদায় করি। ওরা নাকি শিক্ষকের টাকা মেরে দেয়। লোকে বললো। অন্যদিকে মনির নামক এক লজিং মাস্টারকে ৫০ টাকা দিয়ে আরেকটি টিউশনি কিনি। বিকেলে মায়ের জন্য মন খারাপ হলে শনিআখড়া দিয়ে বিশ্বরোডে উঠে কুমিল্লার যাত্রীবাহী বাস ‘পিপলস’ এবং ‘উইনার’ দেখে মনের জ্বালা দূর করি।

৫ নভেম্বর ১৯৯১ ঢাকা

আজ মায়ের কথা খুবই মনে পড়েছে। তাই আরেকজন লজিং মাস্টার মোস্তফাকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শনিআখড়া থেকে চিটাগাংরোড পর্যন্ত যাই। মোস্তফা স্যারের বাড়ি কুমিল্লার হোমনায়।

৭ নভেম্বর ১৯৯১ ঢাকা

আজ কুমিল্লা বোর্ডের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। আজ শাহআলম ভাইয়ের কাছ থেকে টিউশনির ৪০০/-টাকা পাই। টিউশনি করলে নাটক হয় না , নাটক করলে টিউশনি হয় না। এসব নিয়ে আমি উভয়সঙ্কটে আছি।

৯ নভেম্বর ১৯৯১ ঢাকা

আজ দৈনিক ইত্তেফাকের সাহিত্য সম্পাদক আল মুজাহিদীর সঙ্গে দেখা করি। ইত্তেফাক ভবনের পাঁচতলায় তার কার্যালয়ে গিয়ে। কথা হয় তার সঙ্গে কবিতা বিষয়েও। তিনি বলেন , কবিতা হলো প্রজাপতি-কাজী নজরুলের বাবরি চুল-ধানকুটুনির মুখের গান...ইত্যাদি।

আজ বিকেলে বুয়েটের ছাত্র মুজিবের সঙ্গে দেখা করে টিউশনি চাই।

১৪ নভেম্বর ১৯৯১ ঢাকা

আজ রাজ্জাক ভাইয়ের বাবা আসেন ঢাকায়। শুনেছি আজ আমাদের গ্রামের ছাত্তার খলিফা মারা গেছেন। বিকেলে মাতুয়াইল মাদ্রাসা বাজারের ভিতর দিয়ে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে শনিআখড়া যাই। একদিন এ দৃশ্যও হয়তো মুছে যাবে ঢাকা শহর থেকে। আমি ঢাকায় থাকলেও মনে পড়ে আমাদের গ্রামের পশ্চিমে অবস্থিত বটবৃক্ষটির কথা। আমার গ্রামের বাড়িতে ফুলের বাগান ছিল , তাতে বিশেষভাবে ছিল সন্ধামালতীর অবস্থান। মানুষ আজকাল প্রকৃতিকে খুব একটা বড় করে দেখে না আর । শুধু টাকা আর টাকা । এই হলো মানুষের এখনকার নেশা যেন।

১৬ নভেম্বর ১৯৯১ ঢাকা

আজ আমার ছাত্র বুলবুল ও বাবুকে অংক না পারার জন্য খুবই মারি। বাসায় এসেও তাই মন খারাপ হয়। কারণ কুমিল্লাতে এ বয়সের ভাইবোন আমারও রয়েছে। আজ আমার ছাত্র সালাহউদ্দিন বল খেলতে গিয়ে তার পা ভাঙ্গে।

১৮ নভেম্বর ১৯৯১ ঢাকা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিলেও শেষ পর্যন্ত বাংলায় পড়বো বলে ভর্তি হই পুরনো ঢাকার সরকারী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে। আমাদের সিলেবাস , পাঠ্যসূচি ও পরীক্ষাগুলোর নিয়ন্ত্রক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এই জগন্নাথ কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন প্রখ্যাত প্রগতিশীল ব্যক্তিত্ব কুমিল্লার সন্তান অজিত কুমার গুহ। দু:খজনক তার নামে কুমিল্লায় প্রতিষ্ঠিত কলেজটি এখন নকলের জন্য বিখ্যাত।

একটি সন্ত্রাসী গোলাগুলির ঘটনায় জগন্নাথ কলেজের দু’জন ছাত্র মারা গেলে দীর্ঘ ৫ মাস কলেজ বন্ধ থাকে। আজই কলেজ খুলে। নতুন বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে পরিচিত হই। তাদের মধ্যে আবিদ হোসেন ও শ্রাবন্তী রায়কে আমার বেশিই ভালো লাগে। প্রথম দিন হিসেবে উপস্থিতি ছিল কম। আজ কবি শামসুর রাহমানের ‘বিধ্বস্ত নীলিমা’ ও নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘কবিতার ক্লাশ’ বই দু’টি কিনি।

২২ নভেম্বর ১৯৯১ ঢাকা

আজ শনিআখড়ায় এক জনসভায় ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। তার বক্তব্য আমার ভালোই লাগেনি। সকালে মতিঝিল জনতা ব্যাঙ্কে যাই রাজ্জাক ভাইয়ের গ্যাসবিল জমা দিতে। সায়েদাবাদের স্টুডিও আম্বালা থেকে ছবি আনি কলেজের পরিচয়পত্রের জন্য।

২৫ নভেম্বর ১৯৯১ ঢাকা

আজ হরতাল ছিল। তবু কষ্ট করে কলেজে যাই। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে লেখাপড়ার ভীষণ ইচ্ছে ছিল। তাই পাঠ্য প্রতিটি বইকেই পরম আত্মীয় মনে হয়। অভাব না থাকলে সম্ভবত: আমি লেখাপড়ায় খুব ভালো করতে পারতাম। আজ আমার সহপাঠি আবিদ হোসেনের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘যে জ্বলে সে জ্বলে’র কপি পেয়ে সত্যিই অবাক হই। আজ কলেজে মামাদের গ্রাম সিংহারীখোলা’র মোস্তফা ও আমাদের গ্রাম খয়রাবাদ দক্ষিণপাড়ার আমির ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়। আজ আমি কলেজ থেকে পরিচয়পত্র পাই ও লাইব্রেরী কার্ড করি।

৩ ডিসেম্বর ১৯৯১ ঢাকা

আজ আমাদের কলেজ ৫ মাসের জন্য বন্ধ দিয়ে দেয়। কলেজ থেকে আসার সময় গুলিস্তান থেকে নরসিংদীর বাসে জোর করে উঠলে বাসের কন্ট্রাক্টর আমাকে শনিআখড়ায় না নামিয়ে চিটাগাংরোড নামিয়ে দেয়।

১১ ডিসেম্বর ১৯৯১ ঢাকা

আশ্রাফ ভাই আজ ঢাকা আসেন। তার কাজ শেষ হলে দু’ভাই একসঙ্গে ‘পিপলস’ বাসে করে কুমিল্লায় আসি।

১২ ডিসেম্বর ১৯৯১ কুমিল্লা

আজ সকালে ছোট ভাই দামালকে সঙ্গে নিয়ে প্রথমে সাপ্তাহিক ‘আমোদ’ অফিসে যাই। তারপর কুমিল্লা ফাউন্ডেশনে যাই। টাউনহলে যাই বিজয়মেলায় , দেখি মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য বীরত্বপূর্ণ ও ত্যাগের মূর্ত ছবি [চঐঙঞঙএজঅচঐ].

১৩ ডিসেম্বর ১৯৯১ কুমিল্লা

প্রায় ৭ মাস পর আজ গ্রামের বাড়িতে যাই। কিন্তু কবি সাবেরুল ইসলাম [ডা. মাহাম্মদ আলী] জ্যাঠার সঙ্গে দেখা হয়নি বলে মন খারাপ হয়।

১৪ ডিসেম্বর ১৯৯১ কুমিল্লা

আজ ছোটভাই দামালকে নিয়ে গোমতি নদীর টিক্কারচর খেয়াঘাট পার হয়ে বড়জ্বালা বিডিআর ফাঁড়ি দিয়ে ভারতের সীমায় পৌঁছে এক পাহাড়ে উঠি। পাহাড়ের গাছে উঠে লিখি একাধিক কবিতা। এক বুড়ি শেষে বিএসএফ-এর গুলির ভয় দেখালে দু’ভাই দৌড়ে ফিরে আসি। আমরা যে হাঁটতে হাঁটতে ভারতের এত ভিতরে ঢুকে গিয়েছিলাম , তা ভাবতেও পারিনি।

১৫ ডিসেম্বর ১৯৯১ কুমিল্লা

আজ সকালে দামালকে নিয়ে প্রথমে কুমিল্লা ফাউন্ডেশনে যাই। বিকেলে রানীর দিঘির দক্ষিণপাড়ের ‘বৈশাখী’ বাসায় যাই , সাহিত্য পত্রিকা ‘অলক্ত’ সম্পাদক তিতাশ চৌধুরীর বাসায়।

১৭ ডিসেম্বর কুমিল্লা

গতকাল দামালকে নিয়ে কুমিল্লা স্টেডিয়ামে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান দেখি। আজ দেখি সাইকেল প্রতিযোগিতা।

২০ ডিসেম্বর ১৯৯১ ঢাকা

আজ কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আসি বলে মন খুবই খারাপ হয়। আজ বাংলাবাজার থেকে শামসুর রাহমানের ‘ধান ভানলে কুড়ো দেব’ বইটি কিনে আনি। আজ কুমিল্লা বোর্ডের এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়। পাসের হার ৫৭ দশমিক ৪৩।

২৪ ডিসেম্বর ১৯৯১ ঢাকা

আজ জীবনের প্রথম বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবনে প্রবেশ করি। তারপর ৩৬১ ডিআইটি রোড পূর্ব রামপুরায় প্রতিষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ব্রডকাস্টিং আর্ট’-এ যাই।

২৬ ডিসেম্বর ১৯৯১ ঢাকা

আজ জগন্নাথ কলেজের বাংলা বিভাগের বনভোজন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রচন্ড শৈত্যপ্রবাহের কারণে সে কর্মসূচি বাতিল হয়।

২৭ ডিসেম্বর ১৯৯১ ঢাকা

আজ রাজ্জাক ভাইয়ের ছোটভাই দিলু মিয়া বাড়িতে যান। তিনি এসেছেন বিদেশ থেকে। তার ভারী লাগেজটা বাসা থেকে শনিআখড়া বিশ্বরোডে নেওয়ার পথে লাগেজের চাকা লেগে আমার পা কেটে প্রচুর রক্ত ঝরে।

২৯ ডিসেম্বর ১৯৯১ ঢাকা

আজ মোস্তফা স্যারের ছাত্রী লাকীর ৫ম শ্রেণীর বৃত্তি পরীক্ষার অনুষ্ঠানে যাই। সেখান থেকে ধোলাইরপাড় হয়ে যাত্রাবাড়ি দিয়ে পলাশী যাই দুলাভাইয়ের কাছে।

৩০ ডিসেম্বর ১৯৯১ ঢাকা

সকালে আজ আজিমপুর কমিউনিটি সেন্টারে যাই। সেখান থেকে পিকনিকে যাওয়ার কথা ছিল।

৩০ ডিসেম্বর ১৯৯১ ঢাকা

আমাদের সঙ্গে পিকনিকে যাওয়ার কথা ছিল নাট্যকার ও অভিনেতা মমতাজ উদ্দিন আহমদ স্যারের। কিন্তু তার ব্যস্ততার কারণে তিনি আর সঙ্গে যেতে পারেননি। পরে আমরা মীরপুর চিড়িয়াখানা ও বোটানিক্যাল গার্ডেনে যাই। আজ কবি ‘রবার্ট ফ্রস্টের নির্বাচিত কবিতা’ বইটি কিনি।

৩১ ডিসেম্বর ১৯৯১ ঢাকা

আমার সাহিত্যপ্রীতি , বিশেষ করে নাট্যপ্রীতির কারণে ৪০০ টাকার একটি টিউশনি হাতছাড়া হয়। শাহআলমের ছোটভাই আমার ছাত্র মীর হোসেন আমাকে বলে , স্যার এখনতো বছর শেষ , তাছাড়া কে যেন বড় ভাইয়ের কাছে অভিযোগ করেছে , আপনি শুধু ‘নাটক নাটক’ করেন। তাই ভাই বলেছেন , এমন নাটকপাগলা শিক্ষকের আমাদের দরকার নেই , দেখা যাবে পরীক্ষার সময়ও আপনি নাটকের জন্য আমাদের পড়া ফেলে চলে গেলেন। মীর হোসেনের এ কথা শুনে আমি খুবই কষ্ট পাই।

১ জানুয়ারি ১৯৯২ ঢাকা

আজ ইংরেজি নববর্ষ। পত্রিকা কেনার টাকা নেই। এক জায়গায় পত্রিকা দেখতে গেলে লুকিয়ে রেখে বলে পত্রিকা নেই। মন খারাপ। বছর ঘুরে গেল , আমার ভাগ্য ঘুরলো না বলে।

২ জানুয়ারি ১৯৯২ ঢাকা

আজ আমার ছাত্র আলাউদ্দিন তার মাকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে যায়। আমি সকালে বাজার করার পর আলাউদ্দিনের ছোটভাই সাইফুদ্দিনকে কোলে করে শনিআখড়া বিশ্বরোডে নিয়ে বাসে তুলে দিয়ে আসি। আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই একটি কাজে। দেখা হয় মামাতো বোন রোকেয়া আপার স্বামী শাহজাহান দুলাভাইয়ের সঙ্গে।

৬ জানুয়ারি ১৯৯২ ঢাকা

টিউশনির খোঁজ করতে করতে পাগল হতে বসেছি। পাচ্ছি না। লজিং বাসার ছাত্রছাত্রী ৫ জন। আলাউদ্দিন-রিনা-সালাউদ্দিন-শ্যামলী-সাইফুদ্দিন...। তাদের পড়ানোর পর নিজের পড়াও পড়তে হয়। তারপর টিউশনি। তাও আবার পাওয়া যায় না।

৭ জানুয়ারি ১৯৯২ ঢাকা

টিউশনি খুঁজে পাগল হয়ে যাচ্ছি। পত্রিকার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে সেলসম্যানের চাকুরির জন্য বিভিন্ন অফিসে যাই , কিন্তু জামানত ছাড়া চাকুরি হচ্ছে না। আজ আমার বাসায় সহপাঠি জালাল ও শান্তনু সাহা এসেছিল।

৮ জানুয়ারি ১৯৯২ ঢাকা

আজ রামপুরায় যাই ‘ইনষ্টিটিউট অব ব্রডকাস্টিং আর্ট’-এ। অনেকক্ষণ কথা হয় নাট্যাভিনেতা খায়রুল আলম সবুজের সঙ্গে। টাকার অভাবে রামপুরা থেকে হেঁটে যাত্রাবাড়িতে আসি।

১২ জানুয়ারি ১৯৯২ ঢাকা

আজ সকালে লজিং বাসার ভাবীকে ৭ পৃষ্ঠার একটি চিঠি লিখে দেই তার স্বামী রাজ্জাক ভাইকে সৌদি আরবে পাঠাবো বলে। তারপর বাসার বাজার করি। গ্যাসবিল দেয়ার বই আনি যাত্রাবাড়ি থেকে। ছোট ছাত্রী শ্যামলীকে ও তার সহপাঠি রাসেলকে স্কুলে নিয়ে যাই ভর্তি করাতে।

১৩ জানুয়ারি ১৯৯২ ঢাকা

সকালে মতিঝিল যাই গ্যাসবিল দিতে। রামপুরা ‘বিবা’তে আজ প্রথম অভিনয় বিষয়ক ক্লাশ করি। একজন শিক্ষক অভিনয় পড়াতে গিয়ে অ্যানথ্রপোলজি [অঘঞঐজঙচঙখঙএণ] বিষয়েও অনেক কথা বলেন। কোনোদিন ভাবিনি অভিনেতার নৃতত্ত্ব বিদ্যাও শিখতে হয়।

১৭ জানুয়ারি ১৯৯২ ঢাকা

আজ বিটিভি-তে অভিনেতা জাফর ইকবাল অভিনীত ‘নয়নের আলো’ ছবিটি দেখি। প্রায় এক সপ্তাহ আগে জাফর ইকবাল মারা গেছেন।

২০ জানুয়ারি ১৯৯১ ঢাকা

একটি টুথ পাউডার কোম্পানীর টুথ পাউডার ও অন্যান্য সামগ্রী বিক্রির চেষ্টা করছি কিছুদিন। পারছি না। নতুন কোম্পানীর পণ্য। কেউ নেয় না। সকালে এগুলো নিয়ে ডেমরায় যাই। সেখান থেকে হেঁটে চিটাগাং রোড...হাঁটতে হাঁটতে দিন শেষ। দুপুরে কোম্পানীর অফিসে যাই পশ্চিম ধোলাইরপাড়ে। মালিককে বলি হবে না এ কাজ আমার দ্বারা।

২১ জানুয়ারি ১৯৯২ ঢাকা

আজ রামপুরা ‘বিবা’তে যাই বিকেলে। ক্লাস নেন বিটিভি প্রযোজক ও অভিনেতা সালেক খান। বেঁচে থাকাটা এত কষ্টের , আগে বুঝিনি।

২৯ জানুয়ারি ১৯৯২ ঢাকা

আজ বাড়ি থেকে চিঠি আসে। দামাল তার লেখা চিঠির ভিতরে করে ৫টি টাকাও পাঠায়। এ টাকা তার জমানো টাকা।

৩০ জানুয়ারি ১৯৯২ ঢাকা

‘বিবা’-তে অভিনয়ের ক্লাস সাড়ে তিনটায়। অথচ বাসায় ২টার সময়ও ভাত রান্না হয়নি বলে না খেয়েই চলে যাই রামপুরায়। ওদিকে যানজট আর গাড়ির যান্ত্রিক গোলযোগে ক্লাসে লেট হয় বলে টি.ভি প্রযোজক সালেক খান আমাকে ক্লাস থেকে বের করে দেন। আমি অপমানে কেঁদেই দেই।

৩১ জানুয়ারি ১৯৯২ ঢাকা

মোস্তফা স্যারের কাছ থেকে ২০টি টাকা ধার করি। কারণ খাওয়ার কষ্ট সহ্য হয় , কিন্তু অল্প কিছু পয়সার জন্য রাস্তায় রাস্তায় কতো হাঁটা যায়! আজ আরও দুটি টিউশনি পাই , কিন্তু টাকার পরিমাণ খুবই কম। আসলে টাকা নেই বলে আমার কোনো কাজই হতে চায় না। অথচ আবার টাকার দিকেও ছুটতে হয়। লোকে বলে আমি নাকি আকাশপাতাল চিন্তা করতে অভ্যস্ত। আসলে আমার নাট্যপ্রেমকেই লোকে আকাশপাতাল চিন্তা বলে প্রমাণ করতে চায়।

৪ ফেব্র“য়ারি ১৯৯২ ঢাকা

সকালে প্রথমে বাজার করি। তারপর ছাত্র সালাউদ্দিনকে সঙ্গে নিয়ে শনিআখড়া বাজার থেকে বড় একটি বাঁশ আনি। টিউশনিতে যেতে লেট হয় বলে ছাত্রদের মা অনেক জ্ঞান দেয়।

৭ ফেব্র“য়ারি ১৯৯২ ঢাকা

আমার দরকার টাকা কামাই করা। কারণ আমরা খুবই গরীব। কিন্তু কবিতা লেখালেখি-অভিনয়...এসব বিষয় আমাকে খুবই টানে। পয়সার অভাবে খাতা-কলম কেনাও বন্ধ। ছাত্রের কলম দিয়ে লেখার কাজ চলছে। রামপুরা ‘বিবা’-তে যাই। ক্লাস নেন মোহন আবেদীন ও খায়রুল আলম সবুজ। একজন শিক্ষার্থী আমার ছেঁড়া জুতা আরেকজন শিক্ষার্থীকে দেখিয়ে বলে , তিনি নাকি অভিনেতা হবেন। আমার খুবই খারাপ লাগে। আমার কমদামী জামাকাপড় বদলাতে বলেছেন একজন প্রশিক্ষক। আমি তো বিপদেই পড়ে গেলাম। ক্লাসে আসবো কিভাবে? ক্লাসে না এলে তো ভর্তির ৮২০ টাকাও বাতিল হয়ে যাবে।

৮ ফেব্র“য়ারি ১৯৯২ ঢাকা

আজ সকালে আশ্রাফ ভাই এসেছিলেন। হরতাল ছিল বলে বড় ভাইয়ের সঙ্গে হেঁটে গুলিস্তান পর্যন্ত যাই। তিনি আমাকে গুলিস্তান থেকে ১০০ টাকায় একজোড়া জুতো কিনে দিলে তা নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাসায় ফিরে আসি।

১০ ফেব্র“য়ারি ১৯৯২ ঢাকা

আজ আশ্রাফ ভাইয়ের বিএ পরীক্ষা কিন্তু পরিবহন ধর্মঘট ও পয়সার অভাবে যেতে পারিনি।

১৩ ফেব্র“য়ারি ১৯৯২ ঢাকা

আজ পরিবহন ধর্মঘট শেষ হয়েছে। রামপুরায় গিয়েছিলাম অভিনয়ের ক্লাসে। আমার কমদামী নতুন জুতো দেখে এক শিক্ষার্থী আমাকে বলে , এই লেবাস ছাড়েন না কেন? শার্ট-প্যান্ট-জুতো একটু বেশি দাম দিয়েই কেনেন। না হয়...।

১৫ ফেব্র“য়ারি ১৯৯২ ঢাকা

আজ বাংলা একাডেমির বইমেলায় ঘুরে বেড়াই কিন্তু টাকার অভাবে বই কেনা হয়নি। একুশ উপলক্ষে এলাকায় ‘সৈকত’ নামে একটি দেয়ালিকা প্রকাশ করার উদ্যোগ গ্রহণ করি।

২১ ফেব্র“য়ারি ১৯৯২ ঢাকা

আজ সারারাত জেগে দেয়াল পত্রিকা ‘সৈকত’ এর কাজ করি। সম্পাদক থাকি আমি নিজেই। খুব ভোরে বাংলা একাডেমি মঞ্চে আমার লেখা কবিতা ‘আমরা আবার রফিক হবো-রক্ত দেবো আরেকবার’ পাঠ করি। শিশু একাডেমি প্রকাশিত ‘শিশু’ পত্রিকায় ছোট ভাই পিয়াসের ‘জি.এম গিয়াস উদ্দিন’ নামে কবিতা ছাপা হয়।

২৭ ফেব্র“য়ারি ১৯৯২ ঢাকা

আজ ইনষ্টিটিউট অব ব্রডকাস্টিং আর্ট-এ ক্লাস নেন বিটিভি প্রযোজক কাজী আবু জাফর সিদ্দিকী। তিনি আমার একটি কবিতারও খুব প্রশংসা করেন। আমি তাকে তার বিটিভি-র নাটক ‘মৃত্যুক্ষুধা’ নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করি। কাজী নজরুলের

‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসটি আমি প্রথম পড়ি ১৯৮৯ সালে।

২৯ফেব্র“য়ারি ১৯৯২ ঢাকা

আজ একটি টিউশনি থেকে ১০০ টাকা পাই। টাকা পেয়েই জাতীয় পার্টি ও বিএনপি-র চরম সংঘর্ষ উপেক্ষা করেই বাংলা একাডেমির বইমেলায় গিয়ে একাডেমির নিজস্ব স্টল থেকে নরেন বিশ্বাসের ‘উচ্চারণ অভিধান’টি কিনি।

২ মার্চ ১৯৯২ কুমিল্লা

আজ সকালে যাত্রাবাড়ি যাই লজিং মালিকের বিদ্যুৎবিল এবং মতিঝিল যাই গ্যাসবিল দিতে। টিউশনির টাকা সংগ্রহ করে কুমিল্লায় আসি। পথে দাউদকান্দি ফেরীতে অনেক দেরী হয়।

৩ মার্চ ১৯৯২ কুমিল্লা

আজ সকালে গ্রামের বাড়িতে যাই। কথা হয় আমাদের বাড়ির ডা. মাহাম্মদ আলী জ্যাঠার সঙ্গে। অনেক বিষয়েই। তিনি কবি ফররুখ আহমদ ও কবি গোলাম মোস্তফা , প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী আঙ্গুর বালা এবং খান মুহম্মদ মঈনউদ্দীন বিষয়ে অনেক কথা বলেন। নারঙ্গি যে কমলালেবু , তা জানলাম তার কাছে। প্রমথ চৌধুরীর রচনা থেকেও কিছু শোনান। বলেন , প্রমথ চৌধুরীই তার রচনায় বই বাজারে কাটা আর পোকায় কাটার পার্থক্য দেখিয়েছেন। আমার এমন নান্দনিক জ্যাঠা বাড়িতে নি:সঙ্গতায় সময় কাটান। নি:সঙ্গ এজন্য বলছি যে , সাহিত্য বুঝে এমন লোক তার আশেপাশে খুবই কম। তিনি মূলত কবি নজরুলভক্ত। কবি নজরুলের প্রথম স্ত্রী নার্গিস বিষয়েও অনেক কথা বলেন।

১৩ মার্চ ১৯৯২ কুমিল্লা

আজ বাবা-মায়ের মধ্যে সারাদিন তর্কাতর্কি হয়। বিকেলে দামাল ও মামাতো ভাই ইকবালকে নিয়ে চানপুর খেয়া সংলগ্ন স্থানে সেতু নির্মাণ প্রক্রিয়া দেখতে যাই।

১৪ মার্চ ১৯৯২ কুমিল্লা

লেখালেখি বাবার পছন্দ নয়। অভিনয় শিখি , তাও নয়। অতীতে ফিল্মে অভিনয়ের কথা বলেও বাবার গাল খেয়েছি ১৯৮৭ সালে। কলামিস্ট ও চলচ্চিত্র বিষয়ক লেখক লিয়াকত হোসেন খোকনের সঙ্গে তখন আমার পত্র যোগাযোগ ছিল। ৩২/ডি আজিমপুর কলোনীতে থাকতেন তিনি।

যখন ইসলামী ছাত্র শিবির করতে গেলাম , তখনও বাবা বাধা দিলেন। এত বাধা থাকলে সামনে এগুবো কিভাবে? এখনও আমার রাজনীতি করার ইচ্ছে। আসলে দেশ-সমাজের জন্য আমি কিছু একটা করতেই চাই। বাবা বলেন , টাকা ছাড়া এখন কিচ্ছু হয় না। কিন্তু জগতের সব বিখ্যাত লোকই কি টাকাওয়ালা ছিলেন?

২৪ মার্চ ১৯৯২ কুমিল্লা

এগিয়ে যেতে হলে বই পড়তে হবে। বই পড়তে হলে বই কিনতে হবে , তার জন্য চাই টাকা। কিন্তু এত টাকা তো নেই...করবো কী! ২৬ মার্চ কুমিল্লা টাউনহলে স্বরচিত কবিতা পাঠ করতে যেতে চাইলে বাবা বাধা দিয়ে বসলেন। বললেন , গোলাম আজমকে নিয়ে পরিস্থিতি এখন খুবই উত্তপ্ত...।

২৫ মার্চ ১৯৯২ কুমিল্লা

টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করতে উৎসাহী আমি , অথচ টেলিভিশন নাটক দেখারই ব্যবস্থা আমাদের নেই। নিজেদের নেই একটি সাদাকালো টেলিভিশন সেটও।

৫ টাকায় একটি ইত্তেফাক পত্রিকাও কিনতে পারিনি আজ। বাবা-মায়ের কাছে টাকা চাইতেও লজ্জা লাগে। শরীরে জলবসন্ত দেখা দিয়েছে। রোজা রাখছি তবু।

৫ এপ্রিল ১৯৯২ কুমিল্লা

আজ ঈদ। ঈদের নামাজ শেষে দামালকে সঙ্গে নিয়ে গোমতি নদীর ওপারে ঘুরে বেড়াই।

৯ এপ্রিল ১৯৯২ ঢাকা

ভাইবোনের মায়া ত্যাগ করে আজ ঢাকায় চলে আসি। এমন কষ্ট পাচ্ছি যে , মনে হচ্ছে কে যেন বুকের ভিতর খঞ্জর ঢুকিয়ে দিয়েছে। খুব হতাশও আমি নিজেকে নিয়ে। চতুর্দিকে মানুষ যখন টাকা-রিয়াল-ডলার কামাইয়ে ব্যস্ত , তখন আমি অভিধান থেকে শব্দ খুঁজে বেড়াই কবিতা লিখবো বলে। আমি বুঝতে পারছি , আমার পরিণতি ভিক্ষুকের চেয়েও খারাপ হবে।

১৪ এপ্রিল ১৯৯২ ঢাকা

আজ শুভ বাংলা নববর্ষ। আকাশ ঝরঝরে। বাসা থেকে যখন বের হলাম , নিজেকে রীতিমত মহাকাশচারী ইউরি গ্যাগারিন মনে হলো , যিনি বিশ্বের প্রথম মহাকাশচারী।

শিশু একাডেমি-বাংলা একাডেমি ও শিল্পকলা একাডেমিতে যাই অনুষ্ঠান দেখতে। সরাসরি দেখি কবি শামসুর রাহমান-কণ্ঠশিল্পী নিলুফার ইয়াসমিন-সাদিয়া আফরিন মল্লিক-রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও রথীন্দ্রনাথ রায়কে। বন্যার সাথে একটু কথাও হয়।

১৬ এপ্রিল ১৯৯২ ঢাকা

কুমিল্লা জেলার ১৯৭১ সালের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও কুখ্যাত রাজাকারদের তালিকা সংগ্রহের জন্য ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির কার্যালয়ে গিয়ে সাড়া পাইনি। পরে ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে যাই কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ অফিসে , সাড়া পাইনি। তারপর গেলাম মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টে [স্বাধীনতা ভবন]। কল্যান ট্রাস্টের একজন কর্মকর্তা বলেন , কী হবে ওই তালিকা পেলে? আমি বললাম , লেখালেখি করবো। তিনি আমাকে ধমক দিয়ে বলেন , বাড়িতে যাও। লেখাপড়া করো।

২০ এপ্রিল ১৯৯২ ঢাকা

আজ কলেজ খুলেছে কিন্তু ক্লাস হয়নি। পাঠ্য বইপত্রের অভাবে লেখাপড়া বিঘিœত হচ্ছে। পকেটে পয়সা নেই। সকাল সাড়ে আটটায় বের হই। ফিরি সন্ধ্যায়। দুপুরে আমাদের গ্রামের দক্ষিণপাড়ার খোকন , যে একটি সংবাদপত্র বিক্রয়কেন্দ্রের বিক্রেতা , সে এক গ্লাস আখের রস খাওয়ায়। আবিদ নাস্তা করায় ক্যাফেটেরিয়ায়।

২৯ এপ্রিল ১৯৯২ ঢাকা

আজ সকাল সাড়ে আটটায় কলেজে যাই। বিকেল সাড়ে তিনটায় সহপাঠি আবিদ নাস্তা করায় ও রিকশা ভাড়া দেয়। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র টিএসসি-তে যাই দুর্বার নাট্যগোষ্ঠির কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে পরিচিত হতে।

৬ মে ১৯৯২ ঢাকা

সকালে মাতুয়াইল থেকে ডেমরা সড়কে যেসব মুড়ির টিন [লোকাল বাস] গুলিস্তান যায় , ওসবে প্রচন্ড ভীড় থাকে। প্রতিদিনই ওসবে প্রচন্ড ভীড় থাকে। প্রতিদিন ক্লাস করতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাদুরঝোলা হয়ে যাই এসব মুড়িরটিন দিয়ে । যাতায়াতে যানজটে অনেক সময় নষ্ট হয়। আজ আমাদের বাংলা বিভাগের কুমিল্লারই এক ছেলে মতিন সৈকতের সঙ্গে দৈনিক মিল্লাত অফিসে যাই। আবিদ বলেছে , এ পত্রিকাটি কুড়ালমার্কা ফ্রিডম পার্টির পত্রিকা।

১০ মে ১৯৯২ ঢাকা

আজকাল শুধু ভাত নয় , দুপুরে কিছু না খেয়েই থাকি। তারপরও আবিদের সঙ্গে দেখা হয়েছে বলে সে দুপুরে কলেজে নাস্তা করিয়েছে। অথচ তাকে আমি আজ পর্যন্ত কোনদিন নাস্তা করাতে পারিনি। আজ দৈনিক সমাচার পত্রিকায় [পুরানা পল্টন] আমার কবিতা ছাপা হয়।

১১ মে ১৯৯২ ঢাকা

সকালে লজিং বাসার বাজার করি। বাজার করার সময় ৫০০ টাকা দিলেও ১টি টাকাও মারতে পারিনি। এ আমার মায়ের ও বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্র শিবিরের প্রদত্ত শিক্ষা। অথচ প্রতিদিন দুপুরে না খেয়েই থাকি। লজিং মালিকের গ্যাসবিল দেই মতিঝিলের একটি ব্যাঙ্কে। দুপুরে খেতে বাসায় ফিরলে এবং আবার বের হলে পয়সা এবং সময়ের অভাব হয়। তাই দুপুরে না খেয়ে থাকাটা এখন রুটিনই হয়ে গেছে আমার। আজ আমার টিউশনির ছাত্র হিমেলদের কাছ থেকে টাকা পাওয়ার কথা ছিল , কিন্তু পাইনি।

২১ মে ১৯৯২ ঢাকা

টাকার অভাবে নষ্ট হওয়ার বাকি। বড় ভাই কুমিল্লা থেকে শাহবাগের এক অফিসের ঠিকানায় ১০০ টাকা পাঠান। টাকাটি সহজে ভাঙ্গাবো না ভেবেছিলাম। কিন্তু সহপাঠি পরাগ আরমান ভয়ংকর পাজি ছেলে। টিএসসি-তে দুর্বার নাট্যগোষ্ঠির রিহার্সালে গেলে তার সঙ্গে দেখা। তার সঙ্গে ছিল তার আরেক বন্ধু। পরাগ হঠাৎ করে বলে বসলো , দোস্ত আজ কিছু খাওয়া ,যা-ই পারিস। অবশেষে ১৫টি টাকা খরচ হয়ে গেল , যা আমার এখনকার প্রায় ২/৩ দিনের খরচ। কারণ সকালে মাতুয়াইল থেকে মুড়ির টিন-এ গুলিস্তান আসি ৭৫ পয়সা হাফভাড়া দিয়ে। গুলিস্তান থেকে রামপুরার মুড়ির টিন-এ ৫০ পয়সা হাফ ভাড়া দেই। আর শাহবাগে নাটকের রিহার্সালে গেলে বাড়তি ২/৩ টাকা খরচ হয়। অবশ্য খাওয়ানোর পর পরাগ আবার বলে , দোস্ত ক্ষমা করিস , তোর যথেষ্ট ক্ষতিই করে ফেললাম।

২৪ মে ১৯৯২ ঢাকা

আগামীকাল আমাদের দুর্বার নাট্যগোষ্ঠীর শো-বেইলী রোডের গাইড হাউস মঞ্চে। নাটক ‘যা ইচ্ছে তা-ই’। নাটকের সেট নিয়ে গাইড হাউসে গিয়ে দেখি ঢাকা থিয়েটারের নাটক চলছে। নাটক শেষে কথা হলো চলচ্চিত্রাভিনেত্রী আনোয়ারা , মঞ্চাভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা ও শমী কায়সারের সঙ্গে। অভিনেতা জহিরুল পিয়ারীর ‘ভূত’ নাটকে অভিনয় ছিল দারুণ।

২৫ মে ১৯৯২ ঢাকা

আজ ‘কবির নাম’ শীর্ষক আমার একটি ছড়া দৈনিক সমাচারে ছাপা হয়। আমার থিয়েটারের নেশা গরীবের ঘোড়ারোগের সমান। না খেয়ে ছিলাম সারাদিন , অথচ আজ আমি গাইড হাউস মঞ্চে জীবনের প্রথম অভিনয় করি এস এম সিরাজী সৌরভ রচিত ‘যা ইচ্ছে তা-ই’ নাটকে। আমার চরিত্রটি ছিল ভিক্ষুকের। বাস্তব জীবনেও আমি একজন ভিক্ষুকের কাতারে নেমে গেলাম।

আমাদের দুর্বার নাট্যগোষ্ঠির এক কর্তাব্যক্তির ডার্লিং-কে দুইবার খাওয়া এনে খাওয়াই কর্তাব্যক্তিটির টাকায় এবং নির্দেশে। কিন্তু নিজের পেট ছিল শূন্য। রাতে বাসায় ফিরি ১১টায়। গেট বন্ধ ছিল বলে বাউন্ডারী দেয়াল টপকাই। গেটে তালা ছিল , ছাত্র আলাউদ্দিন ডাকাডাকিতে খুলে দেয়। সবাই তখন ঘুমে ছিল , ডেকে আর খাওয়াই হয়নি। কারণ আজ লজিং বাসায় একবেলাও পড়াতে পারিনি। তাছাড়া তারা আমার থিয়েটার চর্চাকেও তেমন পছন্দ করেন না। এভাবে কতোদিন ফাইট করবো আমি?

২৭ মে ১৯৯২ ঢাকা

পকেটে গাড়িভাড়া ছাড়া কোনো টাকা পয়সা ছিল না। প্রচুর বৃষ্টিপাত ও যানজটে মারাত্মক কষ্ট পাই। ওদিকে পরীক্ষা এসে গেছে , কেনা হয়নি বইপত্র। অবশ্য বিকেলে কচিকাঁচার আসরে যাই , পল্টনে। তাদের দেয়া কলা-বিস্কুটে ক্ষুধার কষ্ট দূর হয়।

২৯ মে ১৯৯২ ঢাকা

আজ ‘শাপলা কুড়ির আসর’ শীর্ষক সাহিত্যসভায় নিমন্ত্রণ ছিল , কিন্তু গাড়ি ভাড়ার অভাবে যেতে পারিনি। আগামী ১ জুন আমার অনার্স ফাস্ট ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা। বইপত্র নেই। আবিদ কিছু বই দিয়ে সাহায্য করে।

২ জুন ১৯৯২ ঢাকা

আজ মাতুয়াইলের ‘হোসেন স্টোরে’র হোসেন ভাইয়ের কাছ থেকে ৫০টি টাকা ধার করি। কিন্তু মুড়িরটিন এর ভিড়ে পকেট থেকে পকেটমার ৩০টি টাকা নিয়ে যায়। মায়ের দেয়া পরামর্শমত টাকা দু’জায়গায় রেখেছিলাম বলেই প্যান্টের পকেটের ২০ টাকা বেঁচে যায়। আজ প্রথম মতিঝিলের ‘ভারতীয় দূতাবাস কেন্দ্র গ্রন্থাগারে’ যাই পড়াশোনার জন্য। পড়েছি ফটোগ্রাফির কিছু বইপত্র। পড়ে নোটও করেছি এ বিষয়ে।

৬ জুন ১৯৯২ ঢাকা

নাট্যকার মমতাজ উদ্দিন আহমদ আমাদের বাংলা বিভাগের প্রধান। তার অবসরগ্রহণ ও সংবর্ধনা বিষয়ে ডিপার্টমেন্টের ছাত্র-শিক্ষকদের মিটিংয়ে উপস্থিত থাকি।

৮ জুন ১৯৯২ কুমিল্লা

গতকাল কুমিল্লায় আসি। মন ভালো নেই। মাকে নিয়ে কুমিল্লার বাদুরতলার ডা.রফিক উদ্দিনের কাছে যাই। আজ দৈনিক ‘বাংলার বাণী’ পত্রিকায় আমার একটি ছড়া ছাপা হয়েছে।

৯ জুন ১৯৯২ কুমিল্লা

আজ মায়ের স্বাস্থ্য খুবই খারাপ ছিল। মাকে নিয়ে কুমিল্লার কান্দিরপাড় রেজ্জাক ম্যানশন-রেইসকোর্সের মুক্তি প্যাথ-এ যাই বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য। তারপর পরীক্ষার রিপোর্টগুলো নিয়ে বাদুরতলায় আসি ডা. রফিক উদ্দিনের চেম্বার ‘আরোগ্য নিকেতন’-এ।

১২ জুন ১৯৯২ কুমিল্লা

আজ কুরবানির ঈদ। আমরা গরু কুরবানি দিচ্ছি শেয়ারে। সারাদিন বাসায় ছিলাম। প্রতিবেশি নাট্যকর্মী মনির হোসেন সংকেত এর কাছ থেকে ফ্রস্টের কবিতার বই এনে পড়ি।

১৬ জুন ১৯৯২ কুমিল্লা

সাংসারিক অভাব দূর হচ্ছে না। আমরা ভাইবোন বেশি। আমার ইচ্ছে ছিল শিল্প-সাহিত্যের চর্চায় কিছু একটা করবো। কিন্তু লক্ষণ খারাপ। শুধুই অভাব। তারপরও বাবা তার নীতি বদলাতে পারছেন না। আজ বাবা-মা গ্রামের বাড়িতে যান বাড়ি বিক্রির বিষয়ে আলাপ করার জন্য।

১৮ জুন ১৯৯২ ঢাকা

আজ কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আসি। আমার বড় ছাত্র আলাউদ্দিন বিকেলে তার মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে কীটনাশক পান করে। আমি এবং তার খালু তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগে নিয়ে যাই। কিন্তু রাত ২টা ৩০ মিনিটে সে চোখের সামনে মারা যায়।

১৯ জুন ১৯৯২ ঢাকা

কল্পনাও করিনি আলাউদ্দিন এভাবে মারা যাবে। এ ঘটনা প্রকাশ করতে পারছি না। এক বিছানায় ঘুমোতাম আমরা। মৃত্যুবরণে সে এত পটু , আগে বুঝিনি। অনেকে বলছে পাপিষ্ঠ সে। আমি বুঝি , কে যে কিভাবে বিদায় নেবে , সেতো সে নিজেই জানে না। ইদানিং ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই আমার। তবু যদি তিনি থেকে থাকেন , তার আত্মার মঙ্গল করুক , এই কামনা করি।

পুলিশকে কতো ঘুষ দিতে হয়েছে , টাকার অঙ্কটা জানতে পারিনি। পোস্টমর্টেম করা আলাউদ্দিনের লাশ বাসায় আনার পর আলাউদ্দিনের মা বুক চাপড়ে কাঁদে। বলে , আব্বাগো এই আগুনের ভার আমি সইতে পারবো না। তুমি তো আব্বা মরলা না গো , আমারে মাইরা গেলা।

আলাউদ্দিনের লাশ নিয়ে সবাই বাড়িতে যায়। আমি একা বাসা পাহারার কাজে ঢাকায় থাকি।

২২ জুন ১৯৯২ ঢাকা

আজ হরতাল ছিল। আলাউদ্দিনের মৃত্যুর খবর পেয়ে বড় দুলাভাই বাচ্চু রাজ্জাক ভাইয়ের বাসায় এসেছিলেন।

২৯ জুন ১৯৯২ ঢাকা

আজ অনেকদিন পর বাসা থেকে বের হই। শিশু একাডেমীতে আয়োজিত ‘শাপলা কুড়ির আসরে’ যাই। আজই প্রথম কথা বলার সুযোগ পাই কবি শামসুর রাহমান ও অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদারের সঙ্গে...কী যে ভালো লাগে।

১জুলাই ১৯৯২ ঢাকা

আমাদের বাংলা বিভাগে যে কয়েকজন সুন্দরী মেয়ে আছে , শেলী তাদের একজন। পাঠ্য বিষয় ও নোট-সিলেবাস-পরীক্ষা নিয়ে শেলীর সঙ্গে অনেক আলাপ হয়। আজই প্রথম শেলী আমাকে নাস্তা করায়। আমার পকেটে না আছে টাকা , না আছে কোনো সুন্দরীর চুলের বেনী। শেলী আমাকে নিয়ে বাংলাবাজারে যায় বই কিনতে...অত:পর বিদায়। আজ জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র পাঠাগার ও দৈনিক বাংলার বাণী অফিসেও যাই।

৫ জুলাই ১৯৯২ ঢাকা

গাজীপুর থেকে আসে আমাদের সহপাঠিনী মুনা। পরীক্ষায় কিভাবে ভালো রেজাল্ট করা যায় , এ নিয়ে সে আলাপ করে। আমি তাকে থিয়েটারের গল্প শোনাই। মুনা বলে , তোমার কিছুই হবে না। না লেখাপড়া , না থিয়েটার। আমার বন্ধু আবিদ হলে এভাবে কথা বলে আমাকে হতাশ করতো না। সে বরাবরই বলে , ফাইট করে যাও অলওয়েজ ফাইট-ফাইট ইজ রাইট ডিসিশন। পরে মুনার সঙ্গে মতিঝিল পর্যন্ত এক সঙ্গে আসি। তারপর দু’জনের পথ দু’দিকে হয়ে যায়।

৬ জুলাই ১৯৯২ ঢাকা

ছবি তুলবো বলে সিলেট যাচ্ছি আজ। কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ে রাতে। আবিদ অবশ্য এ ভরা বর্ষায় সিলেট আসতে বারণ করেছিল।

৭ জুলাই ১৯৯২ সিলেট

ঢাকা থেকে সকালে সিলেটে নামি। বন্ধু প্রশান্ত রায়ের ওখানে যাবো ভেবেছিলাম , শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে । এসে সিদ্ধান্ত বাদ দিলাম , কারণ পকেটের অবস্থা ভালো না। হযরত শাহজালাল ও শাহপরানের মাজারে গিয়ে ছবি তুলি। সবচেয়ে বেশি ছবি তুলেছি সুরমা নদীর। ভরা বর্ষায় ভয়ংকর তার চেহারা।

৮ জুলাই ১৯৯২ কুমিল্লা

লজিং বাসা থেকে ধার করা ক্যামেরায় ফটোগ্রাফির চর্চা চলছে। আজ বাবা-মাকে একত্রে বসিয়ে কিছু ছবি তুলি। ছোটবোন মনি ও ছোটভাই দামালকে সঙ্গে নিয়ে রতœাবতী খেয়াঘাটে যাই ছবি তুলবো বলে। অনেক ছবি তুলি।

১৫ জুলাই ১৯৯২ ঢাকা

আজ অনেক কষ্টে টাকা সংগ্রহ করে বিএ সাবসিডিয়ারী পরীক্ষার ফরম ফিলাপ করে আসি।

১৯ জুলাই ১৯৯২ ঢাকা

আমার ছাত্র আলাউদ্দিনের বাবা কয়েকমাস আগে সৌদি আরব গিয়েছিলেন। তিনি আজ এসেছেন। রাজ্জাক ভাই বিমান বন্দরে নেমেই কান্নাকাটি আর বিলাপ শুরু করেন। নিজের ছেলে জন্য এভাবে কাঁদতে কখনো দেখিনি কোনো বাবাকে। জিয়া বিমানবন্দরে আমিও গিয়েছিলাম। বিদীর্ণ হয়েছে বুক , এই শুধু বলতে পারবো আমি।

২৫ জুলাই ১৯৯২ ঢাকা

আজ রাজ্জাক ভাইয়ের চাচাতো ভাই খালেক ভাইয়ের নিকট থেকে ৫০ টাকা ধার করি। ছবির ডেভেলপ ও প্রিন্ট বাবদ খরচ হয় ৪০ টাকা। নিজের জন্য ১০ টাকা বরাদ্ধ রাখি। বাবা-মা- দামাল-মনি’র ছবি প্রিন্ট করার আনন্দ ওদের বুঝাতে পারবো না। ফটোগ্রাফির জন্যও তো অনেক টাকা দরকার। তবে কি শুধু কবিতাই লিখতে হবে?

২৯ জুলাই ১৯৯২ ঢাকা

আজ টাকার অভাবে বই কিনতে পারিনি বলে ক্লাসে এক ম্যাডামের বকা খাই। মন খারাপ হয়। ক্লাস শেষে বাংলাবাজারের ফুটপাথ থেকে কলকাতার সাহিত্য পত্রিকা ‘দেশ’এর একটি সংখ্যা কিনে পড়তে পড়তে মন ভালো হয়ে যায়।

৩১ জুলাই ১৯৯২ ঢাকা

আজ আলাউদ্দিনের মৃত্যুর ধর্মীয় অনুষ্ঠান ‘চল্লিশা’ অনুষ্ঠিত হয়। বাসায় ব্যস্ত ছিলাম।

৮ আগষ্ট ১৯৯২ ঢাকা

ফটোগ্রাফির নেশায় পেয়েছে আমাকে। ঢাকার পথে হেঁটে বায়তুল মোকাররম মসজিদ , জাতীয় যাদুঘর , শহীদ মিনার , কবি নজরুলের মাজার , বাংলা একাডেমির বটগাছ...এসবে ছবি তুলছি। এ যেন কেতকী ফুল সংগ্রহের এক নেশা। অনুমতি নিয়ে ভারতীয় দূতাবাস কেন্দ্র পাঠগারের বই থেকে দ্বারকনাথ ঠাকুরের ছবি তুলি লেখার সঙ্গে দিতে।

২৭ আগষ্ট ১৯৯২ ঢাকা

বিকেলে টিএসসি-তে ফিল্ম ডেভেলপের বিল দিতে গিয়ে পকেট শূন্য। রাতে বিটিভি-তে কবি নজরুলের নাটক ‘অগ্নিগিরি’ দেখতে গিয়ে বাসার কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে মনোমালিন্য হয়। শিল্পের নেশা মনে হয় পথেই নামাবে আমাকে।

৭ সেপ্টেম্বর ১৯৯২ কুমিল্লা

গতকাল রাতে কুমিল্লায় এসেছি। বিকেলে দামালকে নিয়ে বজ্রপুর ইউসুফ স্কুল রোডের গাজী লাইব্রেরীতে যাই।

৯ সেপ্টেম্বর ১৯৯২ ঢাকা

আজ কুমিল্লা থেকে ঢাকায় এসে কলেজে গিয়ে শুনি ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর আমিই পেয়েছি। বিকেলে টিএসসি-তে আবিদ পরিচালিত ‘স্বকল্পধারা’ চলচ্চিত্র অধ্যয়নচক্রে উপস্থিত ছিলাম।

১১ সেপ্টেম্বর ১৯৯২ ঢাকা

আজ দুর্বার নাট্যচক্রের নাট্যনির্দেশক এসএম সিরাজী সৌরভ আমাদের সংগঠন ছেড়ে চলে যান। মিটিং-এ আমিও উপস্থিত ছিলাম। বিকেলে পাবলিক লাইব্রেরীতে যাই ফটোগ্রাফির বইয়ের খোঁজে।

১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৯২ ঢাকা

আমাদের কলেজে প্রতীচী সাংস্কৃতিক সংগঠন আয়োজিত অনুষ্ঠানে নির্মুলেন্দু গুণ-এর কবিতা ‘আমরা যাবো না’ আবৃত্তি করি।

১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৯২ ঢাকা

আজ বিএ পরীক্ষার রেজাল্ট দেয়। কিন্তু উত্তীর্ণদের তালিকায় বড় ভাই আলী আশ্রাফের রোল নম্বর না দেখে হতাশ হই।

১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯২ ঢাকা

ছাত্র ইউনিয়ন আয়োজিত একটি মিছিলে সেদিন অংশগ্রহণ করি আবিদের অনুরোধে। অথচ একদা ছাত্র শিবিরই করতাম। আজ ছাত্র ইউনিয়ন কলেজ শাখা কর্তৃক আয়োজিত শিক্ষা দিবসের অনুষ্ঠানে আমি একটি শোষণবিরোধী কবিতা আবৃত্তি করি। এ অনুষ্ঠানের জন্য এতদিন ধরে রিহার্সাল করাচ্ছিল আবিদ ও জসিম।

২১ সেপ্টেম্বর ১৯৯২ ঢাকা

আজ পাবলিক লাইব্রেরী এলাকায় আমার বন্ধু পরাগ আরমান নাস্তা করায়। ‘নতুন সফর’ পত্রিকার সহ-সম্পাদক মুহাম্মদ আবদুল বাতেনের অফিসে যাই। আবিদের সঙ্গে ড. সেলিমা সাঈদের ক্লাশ নিয়ে কথা হয়।

৩ অক্টোবর ১৯৯২ কুমিল্লা

কুমিল্লায় এসেছি গতকাল। সিরিয়াসলি আবার পড়ছি বিভূতি-র ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাস। এসব পড়া দেখে আমার বাবা তো হতাশ , ছেলের ভবিষ্যৎ কী হবে , যার টাকার নেশার বদলে কেবল পড়ার নেশা। মা বলছেন , আমিও নাকি কাজে লাগবো একদিন। রাতে কলকাতার ‘দেশ’ পত্রিকা থেকে ‘যুধিষ্ঠিরের আয়না’ শীর্ষক একটি গল্প পড়ে শোনালে বাবা দারুন মুগ্ধ হোন।

১৯ অক্টোবর ১৯৯২ ঢাকা

আজ রামপুরা টিভি ভবনে যাই অভিনয় বিভাগে অডিশন দিতে। ওখানে গিয়ে দেখা হয় ‘ইনষ্টিটিউট অব ব্রডকাস্টিং আর্ট ’এর বন্ধু জকি-বন্যা-জহির-লিটন ও অন্যান্যদের সঙ্গে। সুরকার লোকমান হাকিমের সঙ্গেও কথা বলি। অডিশন শেষে জকি তার নিজের গাড়িতে করে আমাকে টিএসসি-তে নামিয়ে দিয়ে যান। আজ টিএসসি-তে কিছু গুন্ডাপান্ডা আমাদের আগের নাট্যনির্দেশক এসএম সিরাজী সৌরভকে পেটায়।

২০ অক্টোবর ১৯৯২ ঢাকা

আজ আমাদের দুর্বার নাট্যচক্রের নাটক ‘যা ইচ্ছে তাই’ গাইড হাউস মঞ্চে। এ নাটকে আমিও একটি চরিত্রে অভিনয় করবো। কিন্তু নাটক মঞ্চস্থের পরে এত রাতে কোথায় যাবো , ঠিক হয়নি এখনও।

২১ অক্টোবর ১৯৯২ ঢাকা

গতকাল নাটক শো-এর পর দুর্বার নাট্যচক্রের বন্ধু উৎপল-এর বাসায় থেকেছিলাম ফার্মগেট এলাকায়। ওরা এত ধনী , কল্পনাও করিনি। উৎপল পড়ে ঢাকা কলেজে। তার মা আমাকে অনেক আদর করে খাওয়ান। আগামী ৩০ অক্টোবর দুর্বারের মিটিং। নতুন নাটক নির্বাচন করা হবে সেদিন , শফিক ভাইয়ের নাটক ‘ওরা কারা’। এসএম সিরাজী সৌরভের নাটক বাদ দেয়া হবে।

২৮ অক্টোবর ১৯৯২ ঢাকা

বিকেলে আবিদ পরিচালিত ‘স্বকল্প ধারা’ চলচ্চিত্র অধ্যয়ন চক্রের পাঠচক্রে উপস্থিত ছিলাম-টিএসসি-তে। নাস্তা করায় আবিদ। উপস্থিত হয়েছিলাম আমি-আবিদ ছাড়াও পরাগ-মিন্টু-শাহিন-টুকু এবং আরও অনেকে। ফিল্ম নিয়ে আমরা একটি সিদ্ধান্তে আসি আজ , কোনোক্রমেই বাজারী ছবি দেখে সময় নষ্ট করবো না।



মন্তব্য ০ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.