নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

চলো আমরা পাখিদের কাছ থেকে ইউক্লিডের নতুন পাঠ নেই জীবনানন্দের পাঠ নেই নিউটনের আপেল গাছটি থেকে।

জসীম অসীম

লেখা হলো কেতকীফুল। ভালোবাসি তাই।

জসীম অসীম › বিস্তারিত পোস্টঃ

কুমিল্লার নিরীক্ষণ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মোহাম্মদ উল্লাহ কথা

১৮ ই জুলাই, ২০১৪ ভোর ৬:৩৭



আবদুল আজিজ মাসুদ

কুমিল্লার সাপ্তাহিক নিরীক্ষণ পত্রিকা সম্পাদক মোহাম্মদ উল্লাহ’র সাথে আমার প্রথম পরিচয় আশির দশকের প্রথম দিকে অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক “সমাজকণ্ঠ” কার্যালয়ে। দেলোয়ার জাহিদ সম্পাদিত “সমাজ কণ্ঠ” তখন প্রকাশিত হতো টমছমব্রীজ থেকে। “সমাজকণ্ঠ” কার্যালয়ই ছিল তখন বিভক্ত কুমিল্লা প্রেসক্লাবের একাংশের প্রাণকেন্দ্র। “সমাজকণ্ঠ” কার্যালয়ের অতি সন্নিকটেই ছিল নিভৃতচারী সমাজকর্মী মোহাম্মদ উল্লাহ’র নিজস্ব বাসভবন। দামী কার্পেট মোড়ানো ড্রইং রুম, ফ্রিজ, টিভি, রুচিসম্মত আসবাবপত্র। ছেলেমেয়েরা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। সব মিলিয়ে সুখী সংসার। এর মাঝেও ছিল বিপর্যয়ের অশনী সংকতে। মিল্ক ভিটা কোম্পানীর চাকুরী নিয়ে ষড়যন্ত্র, মামলা মোকদ্দমা, শেষ পর্যন্ত মামলায় জয় লাভের পরও রায় বাস্তবায়নে গড়িমসি। শেষ আশ্রয়স্থলে পত্রিকা। সেই সুবাদে মোহাম্মদ উল্লাহর সাথে পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠতা। তখন আমি সাপ্তাহিক “সমাজকণ্ঠের” স্টাফ রিপোর্টার এবং ঢাকার একটি দৈনিকে নিজস্ব সংবাদদাতা হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্তির জন্য সংবাদ প্রেরণ করছি। বঞ্চনার শিকার মোহাম্মদ উল্লাহর সংবাদটি দৈনিকটিতে মানবিক প্রতিবেদন হিসেবে ছাপা হয়েছিল এবং কাজও হয়েছিল। এরপর দীর্ঘদিন মোহাম্মদ উল্লাহর সাথে তেমন একটা যোগাযোগ ছিল না। ইতিমধ্যে মোহাম্মদ উল্লাহ টমছম ব্রীজের বাড়ি বিক্রি করেছেন, দেখা দিয়েছে পারিবারিক বিপর্যয়। আবার নতুন সংসার গড়েন, নিরীক্ষণ পত্রিকা বের করেন। এই পত্রিকাকে কেন্দ্র করে আড্ডা, সভা, সমাবেশ। এই পত্রিকায় কুমিল্লায় এখন সুপ্রতিষ্ঠিত অনেক সংবাদকর্মীর সাংবাদিকতার হাতেখড়ি ঘটে। অনেকে আসেন অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য, আবার চলে যান বিভিন্ন কারণে, মোহাম্মদ উল্লাহ এতে বিরূপ হন না। নতুন নিয়ে আবার সূচনা করেন। নিরীক্ষণের প্রকাশনা একেবারে থেমে থাকেনি। এমনি এক পরিস্থিতিতে ১৯৯২ সনের ডিসেম্বর মাসে নিরীক্ষণে আমি যোগদান করি। রেজাউল করিম শামীম, সৈয়দ নুরুর রহমান তখন নিরীক্ষণ ছেড়ে চলে গেছেন। আমার সহযোগী হিসেবে পেলাম সম্পূর্ণ আনকোড়া ওমর ফারুকী তাপসকে। পৌর নির্বাচনকে কেন্দ্র পরিবেশিত এক সংবাদে এক কমিশনার পদপ্রার্থী ক্ষুব্ধ হয়ে আমার বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকী দিয়ে এক উকিল নোটিশ প্রেরণ করেন। এতে আমি প্রথমে ঘাবড়ে গেলেও মোহাম্মদ উল্লাহ আমাকে অভয় দিয়ে বল্লেন,ঘাবড়াবার কিছু নেই। সব সমস্যার মোকাবেলা আমি করবো , তুমি তোমার মত করে কাজ করে যাও। আমরা কোন সাংবাদিকতার নীতিমালা ভঙ্গ করিনি। প্রয়োজনে কোর্টে জবাব দেব। আমি দ্বিগুন উৎসাহে কাজ করতে শুরু করলাম।

নিরীক্ষণের দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে মোহাম্মদ উল্লাহ আমাকে বিপুল স্বাধীনতা দিয়েছিলেন, পেয়েছিলাম সীমাহীন স্বস্তিও। মূলতঃ তখন ওমর ফারুকী তাপস আর আমিই নিরীক্ষণ চালাতাম। তখন নিরীক্ষণের কম্পিউটার কম্পোজ, ছবি প্রসেস হতো ঢাকায় আর পেষ্টিং হতো নজরুল এভিনিউস্থ নিরীক্ষণ কার্যালয়ে। সংবাদ সংগ্রহ থেকে শুরু করে রাত জেগে পেষ্টিং আমরা দু’জনেই করতাম। মোহাম্মদ উল্লাহ সম্পাদকীয় কলাম লেখাসহ তার নিয়মিত আর্টিকেল লিখে যেতেন আর অর্থের যোগানও দিতেন। অনেক সময় আমাদেরকেও বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করতে হতো।

মোহাম্মদ উল্লাহর সাথে আমার মতাদর্শগত মতপার্থক্য থাকলেও এ নিয়ে কোন বিরোধ বা বিসম্বাদ দেখা দেয়নি। তিনি বরং আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। তিনি আমাকে প্রায়ই বলতেন “ভাতিজা পল্লীর শিশু কিশোরদের সংগঠিত করে তাদেরকে নিয়ে কিছু করা দরকার। তারা আজ মিসগাইড হয়ে উচ্ছন্নে যাচ্ছে। আমি তোমাদের সহযোগিতা চাই। তুমি একটা কনসেপ্ট পেপার তৈরি করো। আমরা প্রথমে কুমিল্লা শহরতলী থেকে কাজ শুরু করবো। আসলে তিনি ছিলেন একজন দক্ষ সমাজকর্মী, সংগঠক, তিনি আজীবন কাজ করেছেন পল্লীর গরীব, দুঃখী মানুষদের জন্য, সুদখোর মহাজনদের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন, কৃষক, মুচি, মেথর, কসাই রাজমিস্ত্রী, রিক্সা শ্রমিকসহ খেটে খাওয়া মেহনতী মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য মোহাম্মদ উল্লাহ পথে প্রান্তরের ‘ধূসর স্মৃতি’ শীর্ষক এক গ্রন্থে লিখেছেন, “আমি দায়িত্ব পালনের জন্য সুজাসুজি উঠে গেলাম এক কসাইয়ের বাড়িতে। রাত্রির অন্ধকার ছিল আমার কাজের মৌলিক সময়। আমি যে বাড়িতে অবস্থান করতাম , তার পার্শ্বে ছিল নিষিদ্ধ এলাকা। নিষিদ্ধ এলাকার পাশেই বসতো আমার নিষিদ্ধ রাজনীতির বিশুদ্ধ কাজকারবার। দিনের পর দিন কলেজ পড়–য়া এক বিদ্রোহী যুবকের মূল আকর্ষণ ছিল অন্ধকারে নিমজ্জিত কসাই মেথরদের জীবন কাহিনী শুনে যাওয়া এবং ঝোপ বুঝে কোপ মেরে কর্মী বাছাই করে দলে ভেড়ানো। কোপ মেরেছিলাম একটা, যে কোপে বেরিয়ে এলো কক্ষচ্যুত বিনষ্ট কসাইয়ের একনিষ্ঠ পুত্র। সে ছিল শহর যুবলীগের সম্পাদক। সবাই বলতে লাগলো আমি গোবরে পদ্ম ফুল খুঁজে বের করেছি।”

ভাষা সৈনিক মোহাম্মদ উল্লাহ ১৯৩০ সনে লক্ষ্মীপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করলেও তার ছাত্র জীবন কেটেছে চাঁদপুর, কুমিল্লায়। তিনি পঞ্চাশের দশকে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র ছিলেন। কুমিল্লার মাটি ও মানুষের সঙ্গে ছিল তার আত্মার সম্পর্ক। তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হয়েই সা¤প্রদায়িকতা,অপসংস্কৃতি ও তৎকালিন শাসক গোষ্ঠীর দালালদের বিরুদ্ধে ছাত্রদের সংগঠিত করতে থাকেন। তিনি ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রদের নিয়ে “ডেমোক্রিটিক ষ্টুডেন্ট ফ্রন্ট” গঠনের অন্যতম সংগঠক। ১৯৫১ সনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের কুমিল্লা শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি রাজনৈতিক কারণে জেল খেটেছেন বহুবার। দ্বি-স্তর ভিত্তিক সমবায় পদ্ধতির উদ্ভাবক বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী (বার্ড)-এর প্রতিষ্ঠাতা ড. আখতার হামিদ খানের ভাবশিষ্য ও একান্ত সহচর মোহাম্মদ উল্লাহ ১৯৬৩ সনে কুমিল্লা প্রকল্পে যোগদানের মাধ্যমে সমবায় আন্দোলনের সাথে নিজেকে জড়িত করেন। তিনি বিশেষ সমবায় ফেডারেশনের পরিচালক পদেও অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি কেটিসিসিএ লিঃ-এর মুখপত্র “সমযাত্রা” পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৬১ সনে বার্ড পরিচালিত মহিলা কর্মসূচি, মসজিদের ইমাম কর্তৃক বয়স্ক শিক্ষা ও সবুজ কর্মসূচির দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করেন। ১৯৭৮ সনে সমবায় মন্ত্রণালয় মোহাম্মদ উল্লাহকে মিল্কভিটা সমিতি ও বাজারজাতকরণ বিভাগের উপদেষ্টা হিসেবে ২ বৎসরের চুক্তিভিত্তিক দায়িত্ব অর্পণ করে । পরে উপমহাব্যবস্থাপক হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছিলেন। শেষ জীবনে চুক্তিভিত্তিক দায়িত্ব অর্পণ করে পরে উপমহাব্যবস্থাপক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। শেষ জীবনে তিনি তার অভিজ্ঞতার আলোকে গ্রন্থ প্রণয়নে মনোযোগী হন। ১৯৯৬ সনে প্রকাশ করেন “ধূসর স্মৃতি’ গ্রন্থ এবং ২০০০ সনে তার ভাবগুরু ড. আখতার হামিদ খানের ১ম মৃত্যুবার্ষিকীতে “আখতার হামিদ খান স্মারকগ্রন্থ ’প্রকাশ করেন। প্রকাশের জন্য পান্ডুলিপি প্রস্তুত করেছিলেন “দেশ দেশান্তরে”।

মোহাম্মদ উল্লাহর সাথে আমার শেষ দেখা হয় ২৫ জানুয়ারি ২০০২ সনে তার কুমিল্লা শহরতলী চানপুরের ভাড়া করা বাসায় ঐ বৎসরই ১ অক্টোবর আকস্মিক মৃত্যুবরণ করেন তিনি । সাথে ছিলেন ইত্তেফাকের সাংবাদিক খায়রুল আহসান মানিক। অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি কক্ষের চৌকিতে শুয়ে আছেন, স্বল্প আসবাবপত্রের করুন অবস্থা, আমাদেরকে দেখে তিনি যেন প্রাণোচ্ছল হয়ে উঠলেন। চাওয়া মাত্র নিরীক্ষণের কাজের একটি অভিজ্ঞতাপত্র প্রদান করেন এবং ড. আখতার হামিদ খানের উপর লিখিত স্মারকগ্রন্থটির এককপি তার অটোগ্রাফসহ দিলেন। (পূর্বে তার ‘ধূসর স্মৃতি’ গ্রন্থটিও স্বাক্ষর যুক্ত এক কপি দিয়েছিলেন) কথা প্রসঙ্গে বললেন, আমি ইতিমধ্যে “ইসলাম ও মানবাধিকার” শিরোনামে একটি অনুবাদ গ্রন্থে হাত দিয়েছি। পরে গ্রন্থটি আর আলোর মুখ দেখেনি। প্রকাশিত হয়নি ‘বিচিত্ররূপ বিচিত্র ভাবনা’, ‘বিদেশী বিভুইয়ে’, ‘বেদুইনের বিচিত্র দেখা’। তার সর্বশেষ আকাঙ্খা ছিল ‘দেশদেশান্তরে’ গ্রন্থটি প্রকাশ করা। এই গ্রন্থটির পান্ডুলিপি এখন তার শেষ জীবনের সুখ দুঃখের সাথী কাজী ফাতেমা বেগমের নিকট সংরক্ষিত আছে বলে জানা যায়। মোহাম্মদ উল্লাহর আজীবনের স্বপ্ন ছিল নিরীক্ষণকে বাঁচিয়ে রাখা। তার জীবদ্দশায় শত অভাব অনটনের মাঝেও প্রাণান্তকর চেষ্টা ছিল নিরীক্ষণ’ যাতে নিয়মিত প্রকাশিত হয়। মোহাম্মদ উল্লাহর আকস্মিক মৃত্যুতে পত্রিকাটির যেন অপমৃত্যু ঘটেছিল। কিন্তু না, নিরীক্ষণ এখনো বেঁচে আছে ও প্রকাশিত হচ্ছে। তার মেয়ের জামাতা জসীম উদ্দিন অসীম এখন পত্রিকাটির হাল ধরেছেন। সকলের সহযোগিতা পেলে নিশ্চয়ই পত্রিকাটির নিয়মিত প্রকাশনা অব্যাহত থাকবে। আর নিরীক্ষণের মাঝে মোহাম্মদ উল্লাহ পাঠকদের হৃদয়ে তথা কুমিল্লাবাসীর নিকট বেঁচে থাকবেন এবং নিরীক্ষণে তার অপ্রকাশিত গ্রন্থ সমূহের ধারাবাহিক প্রকাশনা , তার স্বপ্ন কিছুটা হলেও পূরণ করবে।



মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.