নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

চলো আমরা পাখিদের কাছ থেকে ইউক্লিডের নতুন পাঠ নেই জীবনানন্দের পাঠ নেই নিউটনের আপেল গাছটি থেকে।

জসীম অসীম

লেখা হলো কেতকীফুল। ভালোবাসি তাই।

জসীম অসীম › বিস্তারিত পোস্টঃ

মুক্তিযুদ্ধের গল্প: শিকারি বাঘ

১১ ই আগস্ট, ২০১৪ রাত ৮:৫৬

রচনা: সেপ্টেম্বর ১৯৯১, পশ্চিম চানপুর, কুমিল্লা।

ডিসেম্বরের প্রথম দিক। শনিবার। সন ১৯৭১। রাজাকার গণি মোল্লার গ্রামের এক জঙ্গলেই ধরা খায় গণি। লোকে এখন বলে, গইন্না রাজাকার। গনি মোল্লা ওরফে গইন্না রাজাকার কখনো ভাবেনি এমন ইঁদুরের কলে পড়ে মরবে সে। রাজাকার হয়েছিল ইসলাম ধর্মের প্রেমে পড়ে নয়, সে মনে করেছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রটি টিকবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হলোটা কী। পাকিস্তানীদের ক্যাম্প উঠে গেল, ঝাঁক ঝাঁক গুলি করা হাত পিছু হটলো, মর্টারের গোলাও গেল বন্ধ হয়ে। খাকি পোশাকের পাকিস্তানী সেনারা দল বেঁধে চলে গেল অন্যদিকে। ‘পাকিস্তানি মেজর সাহেব’ যাকে গনি মোল্লা তিন তিনটি যুবতী হিন্দু মেয়ে ধর্ষণ করতে দিয়ে পাকিস্তান অথবা ইসলাম রক্ষা চেয়েছিল, যাকে বরাবর দেখিয়ে দিয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘর পুড়ে দিতে কিংবা মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করতে, সেই মেজর যাওয়ার সময় গনি মোল্লাকে বলে গেছে- মোল্লা শুধু আত্মরক্ষা করো। তারপর গণি মোল্লা নিজের সঙ্গে রাখা পাকিস্তানের পতাকা ছিঁড়ে পালায়। কিন্তু পালাবে সে কোথায়, যেখানে তার কপাল এত খারাপ। খারাপ না হলে কি সে মুক্তিযোদ্ধা হাসান শরীফের হাতে পড়ে যায় !

মুক্তিযোদ্ধা হাসান শরীফের সাহস তখন আকাশ ছোঁয়া। তিনি একটি বুলেট গনি মোল্লার হাতে দিয়ে বলেন, গনি- এই বুলেটটা ক্যাপসুলের মতো গিলে ফেল। তা না করলে এটাকে বন্দুকে ঢুকিয়েই তোর ঠিক পেটে ঢুকাতে হবে। একথা শুনে দপ করে হাসান শরীফের পায়ে পড়ে গনি মোল্লা। বলে, হাসান ভাই, আমাকে মাফ করে দাও। আমি আর ভুল করবো না। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা হাসান শরীফের দিলে দয়া হয় না। তাই গনি মোল্লাকে বলেন, নরেশ দেবের মেয়ে জোছনাকে তুই মাফ করেছিলি? তুই কি আমার চাচা বাকের আলীকে বাঁচতে দিয়েছিলি? তবে কেন আজ তোকে মাফ করবো আমি? গনি মোল্লা চিৎকার করে হাসান শরীফের পা ধরে মাফ চায়। হাসান শরীফ বলেন, মাফ করতে পারি, যদি তুই ঐ বটগাছে উঠে লুকিয়ে যাস। গনি মোল্লা দৌড়ে গিয়ে প্রাণের ভয়ে বটগাছে উঠে। উঠতে উঠতে একেবারেই মগডালে। মুক্তিযোদ্ধা হাসান শরীফ বলেন, আরও উপরে। গনি মোল্লা বলে, আর উপরে তো যাওয়ার জায়গা নাই ভাই। হাসান শরীফ বলেন, জায়গা আছে পাতার উপরে। গণি মোল্লা চিৎকার করে বলে, এটা আপনি কী বলেন হাসান ভাই, আমাকে মাফ করে দেন। হাসান শরীফ বলেন, ওখান থেকে কি পাকিস্তান দেখা যায়? দেখা গেলে এক লাফে পাকিস্তান চলে যা। গনি মোল্লা ভেউ ভেউ করে কাঁদতে থাকে। ভাই, হাসান ভাই, আপনি আমার ধর্মের ভাই, আমাকে মাফ করে দেন। হাসান শরীফ বন্দুক তাক করেন গনি মোল্লার দিকে। তার সঙ্গে আছেন আরও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। গনি মোল্লা ঝরঝর করে প্রস্রাব করে দেয়। তার চোখের জল আর প্রস্রাবের জল বৃষ্টির মতো ঝরঝর করে নিচের মাটিতে পড়তে থাকে। হাসান শরীফ বলেন, পাকিস্তানী যেই মেজরের হাতে জোছনাকে তুলে দিয়েছিলি, ডাক সেই মেজরকে। গনি মোল্লা বটগাছের একটি শক্ত ডালকে সজোরে আকড়ে ধরে। কিন্তু তার শরীরে এমনই কাঁপুনি তখন, মনে হয় গুলি না করলেও ছিটকে পড়ে তখনই মরে যাবে। তারপরও গুলি করে হাসান শরীফ। গুলি রাজাকার গণি মোল্লার বুকেই বিদ্ধ হয়। ধপাস করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে গনি মোল্লা। আরও লোকের ভিড় থেকে তখন একটি কিশোরের চিৎকার সবার কানে ধাক্কা খায়। আব্বা... বলেই কিশোরটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। গনি রাজাকার তোমার আব্বা- এতক্ষণ বলোনি কেন? কিশোর চিৎকার করে উত্তর দেয়, ভয়ে। এই কিশোরের কান্না দেখে মুক্তিযোদ্ধাদেরও চোখে জল চলে আসে।

এই গ্রাম থেকে চারগ্রাম দূরে পঙ্খিসোনাপুরে মুক্তিযোদ্ধা হাসান শরীফের বাড়ি। ওখান পর্যন্ত হাসান শরীফের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধারা একই সঙ্গে প্রথমে যাবেন। তারপর অন্যপথে।

কল্পিত কোনো এক গ্রাম যেন পঙ্খিসোনাপুর। কমলদের গ্রাম। নদীর বাঁকের পাশের কূলবতী গ্রাম। নির্মলসলিলা এ গ্রামে যখন ভোরের বেলায় সূর্যের আলো নেমে ঝলমল করে-আহ রূপ-রূপের প্রজ্বলনে চোখ ঝলসে যায়।

এ গ্রামের পথ ধরে গেয়ে যায় বাউল। গান কি বাউল গায়? না বাউলের কণ্ঠ থেকে গান নিঃসৃত হয়। চুইয়ে চুইয়ে পড়ে। গ্রামের ঝোপঝাড় ডিঙ্গিয়ে ছড়িয়ে পড়ে বাউলের সুর। তার সঙ্গী হয় অনেক শিশু-কিশোর। সঙ্গে কমলও থাকে। বাঁশবন পার হওয়ার পর যখন বাউলের সঙ্গী আর কেউ থাকে না-তখনও সঙ্গে কমল থেকেই যায়।

চোরকাঁটায়-তেলাকুচোর লতায়-কাশতৃণে-ঘাসফুলে পঙ্খিসোনাপুর অপূর্ব এক গ্রাম। উলুখাগড়া-নলখাগড়া-কাঠশোলা-ধানক্ষেতে গ্রামটি যেন এক নন্দনকানন। তবে গ্রামের বনবাদারে-ঝোপঝাটে বুনোফুল আর বুনোপাখির মেলায় একটি প্রাণীর উপদ্রব খুব বেশি। সেটি বনবিড়াল। পাখিখেকো। গভীর রাতেও জোরগলায় ‘ম্যাওম্যাও’ করে ডাকে। শেয়ালও কিছু আছে-খেঁকশিয়াল। তবে রাতে শিয়ালের হুক্কাহুয়ার চেয়ে ‘ম্যাওম্যাও’ ডাকই বেশি শোনা যায়।

একদিন সকালবেলা কমলদের সবুজ গ্রামে এক আইসক্রীমওয়ালা আসে। এ গ্রামে আগে সে আর আসেনি। গ্রামে ঢোকার পথেই গ্রামের এক বুড়ো তার পরিচয় জানতে চায়।

বাড়ি কোথায় তোমার? আগে তো কখনো দেখিনি!

: বাড়ি চার গ্রাম দূরে। দোকান ছিল আগে। আগুনে সব গেছে। এখন নিঃস্ব। পথের ফকির চাচা।

-সংসারে কে আছে?

: একটি ছেলে ছিল। অসুখে মরে গেছে।

-কষ্টের কপাল তোমার। শুনে আমার মনটাও খারাপ হয়ে গেল।

: আপনাদের এ গ্রামটা চাচা শিশুর মতো সুন্দর।

-এ গ্রামের শিশুদের দিকে খেয়াল রাখবে। কেবল ব্যবসা দেখলে হবে না। না হয় বাপ-মা’র টাকা পয়সাতেও হাত দেবে ওরা।

: দোয়া করবেন চাচা। আমিও এ ব্যবসায় নতুন।

আইসক্রীমওয়ালা তার বাকশো কাঁধে নিয়ে পঙ্খিসোনাপুরের কমলদের পাড়ায় দিকে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে হাজির হয় কমলদের বাড়ির ভিতর। কমলদের এ গ্রামটির নাম যেমন পঙ্খিসোনাপুর, তেমনি কমলও খুব পঙ্খিপাগল এক কিশোর। মুক্তিযুদ্ধের পরেই তার জন্ম। বয়স-১৪-১৫। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হাসান শরীফ তার পিতা।

কমল এক স্বপ্নবিভোর ছেলে। ক্লাস সিক্সে পড়ে। লেখাপড়ায় ভীষণ ভালো। তবে বই নিয়েই সারাদিন পড়ে থাকে না। সময় পেলেই পঙ্খিসোনাপুর গ্রাম ঘুরে দেখে। ধনেশ পাখি খোঁজে। কাঠবিড়ালী দেখে। বড় বড় গাছের ছায়া দিয়ে দূরে হেঁটে যায়। দেখে পাখির বাসা। খবর নেয়-কোন কোন পাখি ডিম পেড়েছে বাসায়। পাখির প্রতি তার অনেক মায়া। সবুজ সবুজ বৃক্ষের বুকে সে হারিয়ে থাকতে চায়। যখন কেউ বড় কোনো গাছ কেটে ফেলে-তখন তার বুক ভেঙ্গে যায়।

কমলের জীবন এগিয়ে চলে তার গ্রামের প্রতিটি পাখির মতোই। বিরাট বিরাট অশ্বথ বৃক্ষের মতোই। চিরসবুজ পাতায় ছাওয়া তার গ্রামকে সে খুবই ভালোবাসে।

কমলের সঙ্গে পরিচয় হয় আইসক্রীমওয়ালার। কমলকে দেখে আইসক্রীমওয়ালা ভীষণ খুশি হয়। তার বাকশো থেকে বের করে একটি রঙিন আইসক্রীম খেতে দেয়। কমলও তাকে পছন্দ করে। আইসক্রীমওয়ালা বলে-এত সুন্দর গ্রাম আগে আমি আর দেখিনি। সারাটা গ্রাম গাছের ছায়ায় ছাওয়া। ইচ্ছে হয় আমি আমার গ্রাম ছেড়ে এ গ্রামে চলে আসি। এ গ্রামের ছেলেমেয়েরাতো পাখির মতোই সুন্দর।

-তুমিও খুব ভালো -ঠিক আমার বাবার মতোই।

কমলের এ কথা শুনে আইসক্রীমওয়ালার চোখ ছলছল করে। মুষড়েও পড়ে কিছুটা। স্মৃতি হাতড়ে কী যেন এক হারানো অতীত আবছা আবছা খুঁজে। হতবিহবল হয়ে কমলের দিকে তাকিয়ে থাকে। ক্ষীণকণ্ঠে বলে-তোমার মতো দেখতে একটি ছেলে ছিল আমার। ঠিক তোমারই মতো। বলেই সে কান্না শুরু করে। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্র“। পরক্ষণেই গামছা দিয়ে চোখ মুছে নেয়। কমলের খুব খারাপ লাগে এই কান্না দেখে।

-কেমনে মারা গেল তোমার ছেলে? অসুখে?

: হ্যাঁ। বুকের ধন মানিক আমার অসুখে মারা গেছে। মরার আগে টাকার অভাবে ভালো চিকিৎসাও হয়নি।

-তোমার মানিক খুব কষ্ট পেয়েছে?

:হ্যাঁ। আমার মানিক প্রায়ই নিঃশ্বাস নিতে পারতো না। একদিন রাতের বেলা ঘরে ফিরে দেখি-আমার বউ কেবল অঝোরে কাঁদছে। আমিও তখন না কেঁদে থাকতে পারিনি। হঠাৎ দেখি মানিক আমার নেই।

আইসক্রীমওয়ালা চলে গেলে কমল আইসক্রীমওয়ালার মরে যাওয়া ছেলের কথা ভাবে। দুঃখে তার ইচ্ছে হয় নিজেকে সে আইসক্রীমওয়ালার হাতে তুলে দেয়। কমল ভাবে-আইসক্রীওয়ালার এত কষ্ট। সেই কষ্ট দেখতে পেলে পাখির চোখ দিয়েও জল ঝরে পড়বে। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ দেখে বনের পথের পাশে পুকুরপাড়ে দারুন একটি পাখি। একটি বড় পানকৌড়ি। পানকৌড়িটি আবার উড়ে যায়। তারপর কমলও এক দৌড়ে নিজ বাড়ির ভিতরে চলে যায়।

পরদিন আইসক্রীমওয়ালা এলে কমল দৌড়ে তার কাছে যায়। খুব কাছে গিয়ে বলে-তোমার মানিক কোন ক্লাসে পড়তো? আইসক্রীমওয়ালা বলে-হ্যাঁ। তোমার মতো ক্লাস সিক্সেই। খুব ভালো ছিল। আমার কাছ থেকে পয়সা নিয়ে ফকির মিসকিনদের দিতো। দোকান থেকে গরীব বন্ধুদের নানা রকম খাবার কিনে দিতো। -কোরান শরীফ পড়তে পারতো?

: কোরআন শরীফ পড়া তখনও শিখেনি।

-সে কি গান গাইতে পারতো?

: হ্যাঁ বাবা-গাইতে পারতো। আমাদের গ্রামে একটি শানবাঁধানো পুকুরপাড় আছে। সেখানে বসে প্রায়ই সে গান গাইতো। বেলি ফুল পছন্দ করতো খুব। তার অনেক বেলী ফুল গাছ এখনও আছে। বেলি ফুলের গন্ধে আমি আর মানিকের মা প্রায় রাতেই ঘুমোতে পারি না। মানিকের কথা মনে পড়ে যায়।

-সেই বেলি গাছ আর শানবাঁধানো পুকুরঘাট দেখাতে একদিন তুমি আমাকে তোমাদের গ্রামে নিয়ে যাবে?

: অবশ্যই নেব। মানিকের মা তোমাকে দেখলে খুব খুশি হবে। খুঁশিতে ঠিক কেঁদে দেবে। সে খুব ভালো রাধুনিও। তার হাতের রান্না খেলে ভুলতে পারবে না আর।

-কমল বলে, আমি একদিন তোমার বাড়িতে অবশ্যই যাবো। তবে আমার মাকে নিয়ে একা যাবো না।

কমল তার মায়ের সঙ্গে যাবে বলাতে আইসক্রীমওয়ালা বলে, আমাকে বিশ্বাস করো না বুঝি? একা যেতে ভয় করে?

কমল বলে, বিশ্বাস করি। তবে মাকে ছাড়া আমি কোথাও থাকতে পারি না- তাই।

কমলের শেষ কথাটি শুনে আইসক্রীমওয়ালা হাসি দেয়। ছেলেবেলায় আমিও এমন ছিলাম। মাকে ছাড়া কোথাও গিয়ে একটুও থাকতে পারতাম না। মা ছিলেন জীবনের শ্রেষ্ঠ মানুষ আমার। বাবা কমল-মায়ের সঙ্গে কখনো খারাপ ব্যবহার করবে না। কেমন?

-আচ্ছা। মাথা নেড়ে জবাব দেয় কমল।

কমলের বাবা আছেন। পঙ্গু মানুষ। লোকে বলে, পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধা হাসান শরীফ। দেশ স্বাধীন হওয়ার সামান্য আগে একটি অপারেশনে গিয়ে গুলি লাগে তার পায়ে। সেই থেকে শারীরিকভাবে পঙ্গু হয়ে যান। কমলের মা গরু-ছাগল আর হাঁস-মুরগী পালে। তবে এসব কাজ দিয়ে কমলের মা কমলকে ব্যস্ত রাখে না। ওর কাজ লেখাপড়া আর খেলা।

কমলের বাবা পোড়খাওয়া এক কৃষক ছিলেন। যুদ্ধের পর বসে গেছেন। যুদ্ধের পর অনেকে যখন লুণ্ঠনে ব্যস্ত-তখনও তিনি লুণ্ঠন-কিংবা ভিক্ষের চাল-কোনটাই হাতে নিতে পারেননি। সময় অনেক বয়ে গেলেও হাল ছাড়েননি তিনি। কমলের বাবা স্বপ্ন দেখেন কমলকে মুক্তপ্রাণ এক মানুষ হিসেবে গড়ার।

পাখি দেখার নেশাটা কমল তার বাবার কাছ থেকেই পেয়েছে। বাবাও এককালে পাখি দেখতে বের হতেন। এখনো দেখেন। এখনো কমলদের উঠোন দিয়ে উড়ে যায় ঝাঁক ঝাঁক নানা পাখি। ওসব পাখি সব বুঝে- সব দেখে। মুক্তিযুদ্ধের সময় মধুপুর-শালবনের পাখিদের বুকেও তিনি দেশের সংকট দেখেছেন। কমলও এখন পাখিদের কাছে স্বদেশ খুঁজে বেড়ায়-অথবা স্বদেশের কাছে পাখি।

প্রায়ই গ্রামের পথে ঘুরে বেড়ায় কমল। নিজ গ্রাম পঙ্খিসোনাপুর তার খুবই প্রিয় গ্রাম। অপরূপ এক গ্রাম। সে ভাবে এ গ্রামকে ভালো না বেসে কেউ পারবে না। এ গ্রামকে নিয়ে কমল কতো কবিতা লিখে। তার কাছে গ্রামটিকেই এক দেশ মনে হয়। সোনার বাংলাদেশ। তার বাবা মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য বিশেষ কোনো পুরস্কার না পেলেও তেমন কোনো দুঃখ নেই তার মানে। কেননা নিজ গ্রামের মতো এমন সুন্দর দেশটা তো তার বাবার মতো মানুষদের জন্য স্বাধীন হয়েছে।

বহুবর্ণিল পাতাবাহারে সাজানো কমলদের বাড়ির প্রবেশপথ। নানা রঙের ফুল ফোটে এ বাড়িতে। লাল-সাদা-কমলা। টাকা-পয়সা ধন-সম্পদের এত অভাবের মাঝেও কমলের মায়ের গাঢ় সবুজ মন কোমল আনন্দে থাকে। পাতাবাহারে সাজানো এ বাড়ির বাসিন্দা কমলের মায়ের সংসারও যেন এক বাগান। বাগান ছাড়া এত রঙ আর কোথায় পাওয়া যায়?

কমলের বাবা রাতের বেলা খালি চোখে তারা দেখতে পছন্দ করেন। ঘরের আঙ্গিনায় বসে কমলও বাবার সঙ্গে সে দেখায় শরিক হয়। মা-তার কণ্ঠশিল্পী যেন। প্রতি রাতে ঘুমের বিছানায় শুয়ে মনের আনন্দে একটি-দুটি গান গায়। তার মামা খুব ভালো সুরে বাঁশি বাজাতে পারে। সে যখন কমলদের বাড়িতে বেড়াতে আসে, তখন কমলের আনন্দ শত গুণ বেড়ে যায়। রাতের আকাশে তার বাবার সঙ্গে তারা দেখার মধুর আনন্দের মতো।

কমলের মনে অনেক রঙ। মাকে সে ডাকে পাখির মতো করেই। পাখিদের কাছে থেকে থেকে যেন সে এক পাখিই হয়ে গিয়েছে। পঙ্খিসোনাপুর গ্রামে তার অনেক পাখি-কমলাবউ-বালিহাঁস-পানকৌড়ি-ডাহুক-তিতির-হরিয়াল-টিয়া-কোঁচবক-কালীবক-সারস-মাছরাঙা-বুনোহাঁস...কতো রকম পাখি। ধান ক্ষেতের ভিতর থেকে সারাদিন পাখির ডাক ভেসে আসে। আছে অনেক কোড়া পাখিও-যে পাখিটি কমলের সবচেয়ে প্রিয়।

কমল এখনও সব পাখিদের নাম জানে না। জানে না পরিচয়। তবু কান পেতে পাখির ডাক শোনে। দেখে পাখির উড়াউড়ি, নাচ-গান, পাখির ছানা, পাখির সংসার। পাখি দেখলে খাওয়া-দাওয়া ভুলে যায় যেন সে। তার মা তাকে সাপের ভয় দেখায়। বলে, পাখির বাসায় সাপ থাকে। হিংস্র বিষধর সাপ। কেউটে-গোখরো-কালনাগ-শঙ্খচূড়-কতো রকম সাপ! সুযোগ পেলেই ওরা ছোবল মারে।

কমল শোনে না। সকাল হলেই ঘরের জানালা খুলে। বাড়ির সামনের বুড়ো আমগাছটির দিকে তাকায়। গাছে বেড়ানো পাখিরা যেন দিনের শুরুতেই তাকে প্রকৃতির রাজ্যে মগ্ন হতে ডাকে। তার বাবার কাছে সে ব্যবিলনের ঝুলন্ত উদ্যানের গল্প শুনেছে। তার কাছে প্রায়ই মনে হয় তাদের সমস্ত গ্রামটিকে নিয়েই যেন এই ব্যবিলন উদ্যান। ব্যবিলনের উদ্যান আর নেই। সে কথা তার কল্পনায় স্থান পায় না।

কিন্তু আজকাল কমলের পাখিদের চেয়েও বেশি করে আইসক্রীমওয়ালার কথা মনে পড়ে। ভাবে, সেও হয়তো এ গ্রামের প্রেমেই পড়েছে। তা না হলে এ গ্রামের ছেলেমেয়েদের সে এত ভালোবাসে কেন? সারাদিন আইসক্রিম বিক্রি করে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরে আইসক্রীমওয়ালা। বাড়ি অনেক দূর। তার জন্য খারাপ লাগে কমলের। ইচ্ছে হয় তাকে এ গ্রামে রেখে দেয়। সম্ভব হয় না। আইসক্রীমওয়ালা যখন দিনের শেষে নিজের বাড়ি যেতে যেতে কমলদের বাড়ির দিকে বারবার পেছন ফিরে তাকায়, তখন কমলের ভীষণ কান্না পায়।

আইসক্রীমওয়ালার সমস্ত কথা কমল তার বাবা-মাকে খুলে বলে। সব শুনে তার বাবা-মা’রও অনেক দুঃখ হয়। আরেকদিন সকালে আইসক্রীমওয়ালা এলে কমলের বাবা তাকে খবর দেয়। আইসক্রীমওয়ালা ঘরে এলে কমলের মা তাকে চা-মুরি খেতে দেয়। কমলের বাবা আইসক্রীমওলার সঙ্গে আলাপ শুরু করে এবং কথার ফাঁকে ধীরে ধীরে নিজের শরীরে হাতপাখাটি চালায়।

কমলের বাবা বলে, আপনার ছেলের কথা শুনেছি। মনটাতে খুব কষ্ট পেয়েছি। সবই আল্লাহর ইচ্ছা। কী করবেন। তবু সাহস নিয়ে বাঁচতে তো হবে।

আইসক্রীমওয়ালা কোনো কথাই বলতে পারে না। কেবল তার ঠোঁট কাঁপতে থাকে। হঠাৎ সে কমলের বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। কান্না আর থামে না। সে কান্না দেখে কমল ও তার মায়ের চোখের অশ্র“ও গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে। ততক্ষণে আইসক্রীমওয়ালা কিছুটা শান্ত হয়ে তার টাকার থলির ভিতর থেকে ছোট্ট একটি বাঁধানো ছবি বের করে। তারপর তা কমলদের ঘরের সবাইকে দেখায়। কমলের বাবা বলে, তোমার ছেলের ছবি? আইসক্রীমওয়ালা মাথা নেড়ে ‘হ্যা’ বলে। দুঃখে তখন সে আর কথাই বলতে পারে না।

কমলের বাবা বলে, ঠিক আমাদের কমলের মতোই। দেখ দেখ কমলের মা, ছবিটা দেখতে আমাদের কমলের মতো না?

কমলের মা কিছুই বলে না। ‘মরা ছেলে’র সঙ্গে নিজের ছেলের তুলনা করতেই তার বুকটা কেমন ধক করে উঠে। মনে মনে ভাবে, আমার কমল কমলের মতোই। নিজের মতো আলাদা। কারো মতো নয়। কমলের বাবা আইসক্রীমওয়ালাকে বলে, আল্লাহর দুনিয়া বড় বেশি নিষ্ঠুর। ছেলের কথা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করবেন। মনে করবেন-কমলও আপনার ছেলে। আপনার ছেলেকে আল্লাহ ছিনিয়ে নিয়েছে। এ ব্যাপারে তো কিছুই করার নেই। যদি ছেলেধরা নিয়ে যেতো-তবে হয়তো পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কী করবেন। সবই তার মর্জি।

দিন যায়-মাস যায়। আইসক্রীমওয়ালার প্রেমে পড়ে যায় কমল। তার মা একটু সাবধান করে বলে, এত মাখামাখি ভালো না। লেখাপড়াটা যাবে। কিন্তু মায়ের কথায় কান দেয় না কমল।

আইসক্রীমওয়ালা কমলকে আইসক্রীম খাওয়ায়। কিন্তু পয়সা নেয় না। কমলের অনেক জমানো পয়সা আছে। কিন্তু কিছুতেই তা থেকে দিতে পারে না। বরং একটি আইসক্রীম খাওয়ানোর পরপর বলে, আরেকটা দেব বাবা? কমল মাথা নেড়ে ‘না’ বলে। খেতে মনে চাইলেও পয়সা ছাড়া খেতে হয় বলে দ্বিতীয়টা আর খায় না। আইসক্রীমওয়ালা কমলকে বলে আইসক্রীমের জন্য পয়সা লাগবে না মানে আবার ভিক্ষে দেয়াও নয়। নিজের সন্তানকে কেউ ভিক্ষে দেয় না বাবা। কমল প্রায়ই বলে, পয়সা না নিলে খাবো না। তাছাড়া এভাবে পয়সা ছাড়া আইসক্রীম খেলে আপনার ব্যবসার ক্ষতি হবে। আইসক্রীমওয়ালা বলে, সবাইকে তো আমি বিনা পয়সায় আইসক্রীম খাওয়াই না। তোমাকে দিনে দু’তিনটি খাওয়ালে ব্যবসার কোন ক্ষতি হবে না। কমল বলে, মা জানলে রাগ করবে। আইসক্রীমওয়ালা বলে, আপাতত: বলার দরকার নেই। একদিন তোমার বাবা-মা’কে আমিই সব কথা বলবো।

আইসক্রীমওয়ালাকে এখন কমল ‘মামা’ বলেই ডাকে। তার আইসক্রীমওয়ালা মামা তাকে বলে, কমল একদিন তোমাকে খুব বড় হয়ে প্রমাণ করতে হবে-তুমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। তোমার বাবা পঙ্গু মানুষ হলেও প্রতিদিন ১০-১৫ জন প্রাইমারী স্কুলের ছাত্র পড়ায়। তবু ভিক্ষা করে না। তোমার এই মামাকেও দেখ, আইসক্রীমের বাকশো কাঁধে নিয়ে সারাদিন গ্রামে গ্রামে ঘুরে। তবু চুরি করে না। এসব থেকে তোমাকে শিক্ষা নিতে হবে।

কমল বলে, আমার জন্য আপনি দোয়া করবেন মামা।

মামা বলে, অবশ্যই।

পাখির প্রতি কমলের যে নেশাটা ছিল, তা এসে স্থির হয় তার এ আইসক্রীমওয়ালা মামার ওপর। এখন সে আর আগের মতো অবসর পেলে গাছের কাছে, পাখির কাছে দৌঁড়ে বেড়ায় না। তার গ্রামে অনেক পাখি। দোয়েল, শ্যামা, নীলটুনি, বক। এমনকি অনেক ফুলঝুরি পাখিও সারাদিন উড়ে। কিন্তু কমলের এখন যেন নিজের দিকেও তাকাবার সময় নেই। কেবলই তার সেই মামা। যার মুখটি দেখলে জানালা দিয়ে দখিনা বায়ু প্রবেশের কথা মনে পড়ে না। মনে পড়ে না পূর্ণিমার চাঁদের কথা। মনে হয় কেবল একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে ক্রমাগত কাঁদতে থাকা একজন আইসক্রীমওয়ালার শূন্য শুষ্ক ফিকে বুক। যে সর্বদা সন্তান হারানোর আগুনে ধিকিধিকি জ্বলে। কমলের মামা তাকে নিজের শৈশবের গল্প শোনায়। মেলার কথা বলে। বলে এক বুড়ো বটগাছের নিচে বসা দরবেশের গল্প। সেসব শুনে কমল কেবল কল্পনায় উড়তে থাকে।

একদিন কমলের আইসক্রীমওয়ালা মামা কমলকে বলে, কমল আমার কাছে একটি পাখির মূর্তি আছে। সোনার তৈরি পাখি। আমার বাবা চোরের ভয়ে এটাকে কখনো মাটির নিচে, কখনোবা চোরা কুঠুরিতে লুকিয়ে রাখতেন। লাখ টাকার সম্পদ কী-না। আমি এটা তোমাকে দিয়ে যাবো। আমার ছেলে তো মরে গেল... বলেই সে আবার কাঁদতে থাকে। কমলের মনে আইসক্রীমওয়ালার কাছে থাকা সোনার পাখিটি পাওয়ার আশা জাগে। কিন্তু মুখে কিছুই বলে না। এ বিষয়ে সে তার মাকেও কিছু বলে না। আইসক্রীমওয়ালা মামা আপাতত কাউকে বলতেও বারণ করেছে।

একদিন সকালবেলা কমলের আইসক্রীমওয়ালা মামা তার জন্য সুন্দর একটি পাখির ছবিওয়ালা ক্যালেন্ডার নিয়ে আসে। এসেই বলে, এই নাও তোমার জন্য সামান্য উপহার। কমল বার পাতার ক্যালেন্ডারে পাখিদের সব রঙিন ছবি দেখে ভীষণ খুশি হয়। আইসক্রীমওয়ালা বলে, কমল আমাদের গ্রামে শীতকালীন মেলা বসেছে। সেখানে এসেছে দারুন এক সার্কাস পার্টি। ইন্দ্রজাল সার্কাস। অপূর্ব। ওখানে শিকারী বাঘ, সিংহ, হাতি, কুকুর... কতো কিছুর খেলা দেখায়। তুমি দেখতে যাবে? কমল বলে, অবশ্যই যাবো। কমলের আইসক্রীমওয়ালা মামা বলে, তবে তোমার বাবা-মাকে বলে নাও। তাড়াতাড়ি করো।

বাড়ির ভিতর গিয়ে কমল তার মাকে সব খুলে বললে, তার মা বলে-না। ওসব সার্কাসটার্কাস দেখে লাভ নেই। বড় হয়ে অনেক দেখতে পারবে।

কিন্তু কবে বড় হবে কমল? তার এত দেরী সহ্য হয় না। তাই সে কষ্টে কেঁদে ফেলে। কেঁদে কেঁদে বলে, যদি আমি বড় না হই? আইসক্রীমওয়ালা মামার ঐ ছেলের মতো মরেই যাই।

না। না তুই মরবি না। অনেক বড় হবি। বলেই কমলকে বুকে টেনে নেয় তার মা। কমল কাঁদতে থাকে। কমলের বাবা বলে, যাক না কমলের মা। স্কুল যখন ক’দিন বন্ধ, লেখাপড়ার তো ক্ষতি হবে না। কমলের মা বলে, না। ওর শরীরটা কয়েকদিন ধরে ভালো নেই। এখন কোথাও যাওয়ার দরকার নেই।

মায়ের মুখে এ কথা শুনে তাদের আদরের কমল আরও কাঁদতে থাকে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, শরীর আমার ভালোই আছে। শরীর ভালো না থাকলে তোমরা এতদিন আমাকে ডাক্তার দেখাওনি কেন?

কমলের মা এ কথার আর উত্তর দিতে পারে না। কমল আরও জোড়শব্দে কাঁদতে থাকে। আইসক্রীমওয়ালা কমলের মায়ের কাছে এসে অপরাধীর মতো ভঙ্গিতে বলে-আমার খুব অন্যায় হয়ে গেছে বোন। বাচ্চা ছেলেকে সার্কাসের কথা বলাটাই আমার ঠিক হয়নি। আসলে প্রত্যেকবার নিজের ছেলেটাকে নিয়ে মেলায় যেতাম-তো...। তাই ভুল করে ফেলেছি।

বলেই আইসক্রীমওয়ালা একটু কেঁদে দেয়। কমলের বাবা আইসক্রীমওয়ালাকে বলে, আচ্ছা আপনি এ সকাল বেলা কমলকে নিয়ে গেলে বিকেলের আগেই ফেরৎ নিয়ে আসতে পারবেন তো?

হ্যাঁ পারবো। জবাব দেয় আইসক্রীমওয়ালা।

কমলের বাবা বলে, কমলের মা-তুমি আর বাধা দিয়ো না। আমি পঙ্গু মানুষ। শখ থাকলেও ছেলেকে নিয়ে তেমন বেড়াতে পারি না। দাও, কমলকে যেতে দাও।

কমলের মা আর বাধা দিতে পারে না। আলমারি খুলে কমলকে অনেকটা জোর করেই নতুন প্যান্ট শার্ট পরিয়ে দেয়। মায়ের হাতে এক গ্লাস গরুর গরম দুধ খাওয়ার পর কমল তার আইসক্রীমওয়ালা মামার সঙ্গে সার্কাস দেখতে চলে যায়। যাওয়ার সময় আইসক্রীমওয়ালা কমলের বাবা-মাকে বলে, আপনারা কোনো চিন্তাই করবেন না। দুপুরের পরেই আমরা চলে আসবো। কমলের বাবা তার ছেলেকে কিছু কিনে দিতে বিশটি টাকা আইসক্রীমওয়ালার হাতে দিতে চায়। বিনীতভাবে আইসক্রীমওয়ালা বলে, লজ্জা দিবেন না ভাই, আমার কাছে টাকা আছে। আমি আজ কমলকে কিছু দেই। আইসক্রীমওয়ালার মধুর ব্যবহারে কমলের বাবার চোখ ছলছল করে।

দুপুরের খাওয়া না খেয়েই কমলের বাবা-মা দুপুর থেকেই কমলের অপেক্ষায় থাকে। সিদ্ধান্ত নেয়, ফেরার পর আজ তারা আইসক্রীমওয়ালাকেও দুটো ডালভাত খাওয়াবে। কিন্তু হায় দুপুর! হায় কাল দুপুর! দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়-সন্ধ্যা থেকে রাত। সারাটা গ্রাম অন্ধকারে ডুবে যায়। খবর নেয়-আইসক্রীমওয়ালার বাড়ি কোথায়। কোথায় বাড়ি? কেউ জানে না-কেউ চিনে না। কান্নায় কান্নায় খোঁজ খোঁজ করে আরও একটি দিন গড়িয়ে যায়। কমল আর ফিরে আসেনা। কমলের মা সারা গ্রামে খবর দেয়। অনেক রাত পর্যন্ত কাঁদে-ঘন ঘন চোখ মুছে। আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে। কিন্তু কমল আসে না আর। কমলের বাবা শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েই থানা পুলিশ করেন। থানার ওসি খোঁজখবর নিয়ে পরে কমলের বাবাকে বলেন, শিয়ালের কাছে কেউ মুরগী পাহারায় রাখে? আর সে তো শেয়ালও নয়-শিকারী বাঘ। একাত্তরের গইন্না রাজাকারের কুখ্যাত ছেলে। পনের বছর আগে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধারা যাকে গুলি করে মেরেছিল।

এ কথা শুনে কমলের মায়ের হাত থেকে কমলের বাঁধাই করা ছবিটা খসে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গেই লুটিয়ে পড়ে সেও।

!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!

(১৯৯১ সালের সেপ্টেম্বরে যখন আমি এ গল্প প্রথম লিখি-তখন আমার ২১ বছর বয়স। গল্পটির সারবস্তু আমার মায়ের কাছ তেকে নেয়া। আমি স্বপ্ন দেখছি শুধুমাত্র একজন লেখক হওয়ার। তখন আমরা কুমিল্লা শহরতলীর পশ্চিম চানপুর এলাকার গয়ামবাগিচা রাস্তার পাশের একটি বাসায় থাকি। যখন আমি এ গল্প লিখি-এখনও মনে আছে-আমার মা একটু পর পর চা-বিস্কুট-চানাচুর-শেমাই ইত্যাদি খাওয়াচ্ছিলেন। কয়েকদিন লেগেছিল এ গল্প দাঁড় করাতে। আমাকে এভাবে লেখায় মগ্ন দেখলে বাবা ক্ষেপে যেতেন কখনো কখনো-বলতেন, ওর পরীক্ষা শেষ। এত কী লেখালেখি ওর। মা বলতেন-অনেকের ছেলেমেয়ের বাজে বাজে নেশা থাকে-আমার ছেলের লেখার নেশা। ক্ষতি কী। লিখুক। বাবা শুধু আমার পেশার চিন্তায় দুশ্চিন্তা করতেন। আজ এত বছর পর যখন বাবা-মা আর কেউই বেঁচে নেই, আমার মনে হচ্ছে-আমার মা ছিলেন লেখক হতে গেলে যেমন মা হওয়া দরকার ঠিক তেমন মা । আর বাবা কেন যে লেখার পেশাতে আস্থা রাখতেন না, তাতো আমার নিজের জীবন দিয়েই পদে পদে উপলব্ধি করছি।

শুরুতে এ গল্পের নাম ছিল ‘আইসক্রীমওয়ালা’। নামটি ছিল আমার মায়ের দেয়া। পরে ১৯৯৬ সালে এ গল্পের নাম দেই ‘সার্কাস’। এ নামটি আমার বাবার পছন্দের ছিল। বাবা বললেন-একজন রাজাকারের ছেলে আইসক্রিমওয়ালা হয়ে মুক্তিযোদ্ধার শিশু সন্তানকে সার্কাস দেখানোর কথা বলে চিরতরে অপহরণ করে। সে তো আসলে শিশুটিকে সার্কাস দেখায় না। সার্কাস দেখায় সবাইকে। তাই এ নামই থাকা উচিত।

যেসব মেয়েদের সঙ্গে আমার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তাদের একজনের নাম ছিল ঈশিতা। পরিচয় ১৯৯৩ সালে এবং প্রেম হয় ১৯৯৮ সালে। ২০০০ সালে আমার সঙ্গে যখন কুমিল্লার সংরাইশের ফারজানা কবির ঈশিতার বিয়ে হয়-তখন সে এ গল্প পড়ে দারুন মুগ্ধ হয়।

ঈশিতা এ গল্প পড়ে এ রকম আরও কিছু গল্প নিয়ে ২০০১ সালে কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড় কলেজরোডের ‘অন্বেষা বাণিজ্যিক সংস্থা’র কম্পিউটারে কম্পোজ করতে দেয় আমার গল্পের বই ছাপাবে বলে। বই ছাপানোর টাকা দেবে কোন গৌরীসেন? ঈশিতা বলে, তার বাবা তাকে যে কিছু আসবাবপত্র গিফট করেছিল-সেসব বিক্রি করবে। আমি রাজি হইনি। তারপর থেমে যায় বই ছাপানোর প্রক্রিয়া। ২০০১ সালে কুমিল্লার গল্পকার কাজী মোহাম্মদ আলমগীর আমাকে বলেন, আইসক্রিমওয়ালা কেন আহত একজন মুক্তিযোদ্ধার একমাত্র শিশু সন্তানকে অপহরণ করে, তার স্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকা উচিত। তারপরই এ গল্পে রাজাকার গণি মোল্লার চরিত্রটি স্পষ্ট করি। এ গল্পের চিত্রনাট্যরূপও আমি দিয়েছিলাম। কিন্তু মতান্তর-পথান্তরের কারণে ঈশিতার সঙ্গে আমার ২০০২ সালে সংসার ভাঙ্গনের সময় সেটা হারিয়েছি। চিত্রনাট্যের রূপদানে আমি কুমিল্লার সংগীতশিল্পী দীপা সিনহাকে ‘কমলের মা’র’ মুখাবয়ব কল্পনা করেছিলাম। চিত্রনাট্যরূপ দিয়েছিলাম গল্প লেখার ৮ বছর পর ১৯৯৯ সালে। তাই চিত্রনাট্যরূপটি অসাধারণ হয়। এ গল্পের মূল চরিত্র শিশু ‘কমল’ আকাশে যখন ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি উড়ে, তখন সেই ঝাঁকের দিকে তাকিয়ে আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে উড়ন্ত পাখির মতোই ঝাঁকের পিছু পিছু দৌঁড়ায়। কাঁটা কম্পাস নিয়ে জ্যামিতির চিত্র আঁকছিল কমল। হঠাৎ খোলা জানালা দিয়ে চোখ চলে যায় জানালার পাশের ডালিম গাছে। ডালিম গাছের এপাশ ওপাশ উড়ে বেড়ায় একটি হলদে পাখি। জ্যামিতির চিত্র আঁকা ভুলে পাখির দিকে তাকিয়ে থাকে কমল। তারপর পাখি উড়ে গেলে সাদা কাগজে একটি পাখির ছবি আঁকায় মনোযোগ দেয় কমল। এমন অসংখ্য সিকোয়েন্সে ভরপুর ছিল সেই চিত্রনাট্য। গল্পটি আমার বর্তমান স্ত্রী সাদিয়া পলি’রও অসম্ভব প্রিয়।)



মন্তব্য ৬ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ১২ ই আগস্ট, ২০১৪ রাত ১২:৫২

আরজু মুন জারিন বলেছেন: এত অসাধারণ একটা গল্প লিখলেন জসিম ভাই। আমি ভীষণ রকমের টাচড আপ্লুত যাকে বলে। জানেন আপনার এই গল্প টা পড়ে মনে হল আমার আর ও দশ বছর লিখতে হবে যদি বই ছাপাতে চাই। তুলনা করলে আমার লেখা কিছু ই না আপনার লিখাটার পাশে। মনে অনেক অনুভূতি জাগিয়ে দিলেন গল্প টি লিখে। এ কি ৯১ এ লিখেছেন ? আশ্চর্য্য !!! কালকে ও ভাবছিলাম বই ছাপানোর কথা। ...আপনার লেখায় কমেন্টস করতে আমি লগ ইন হয়েছি। ভীষণ ব্যস্ত কিছু কাজ নিয়ে। .

অনেক অনেক দোয়া শুভকামনা এই প্রিয় ভাইটির জন্য। লিখে যান। দোয়া করি একদিন যেন সন্মানজনক অবস্থানে যেতে পারেন লিখালিখি দিয়ে। গৌরবের মুকুট কেও যেন পরিয়ে দেয় অবশ্য ই আপনার মাথায়।

ভাল থাকুন সবসময়।

১২ ই আগস্ট, ২০১৪ দুপুর ১২:০০

জসীম অসীম বলেছেন: আপনার মতামত আমাকে খুব এগিয়ে নেবে। তবে লজ্জাবোধ করছি , যখন দেখলাম লেখাটা পোস্ট করার পরেও কিছু বানান ভুল রয়ে গেছে। ভালো থাকবেন। আকাশের বিস্তৃতির সমান অনেক অনেক ভালো। কখনোই মনে একবিন্দুও দু:খ পোষবেন না। কক্ষনোই না। ভুলেও না। তা হলে আমাদের লেখালেখির অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে।অনেক শুভকামনা। ধন্যবাদ

২| ১২ ই আগস্ট, ২০১৪ রাত ১:২৭

মুনতাসির নাসিফ (দ্যা অ্যানোনিমাস) বলেছেন: বেশ লেখাটা ...
একটু বড় পরিসরে তুলনামূলক গড়পড়তা থেকে...

লিখে যান ...

১২ ই আগস্ট, ২০১৪ দুপুর ১২:০২

জসীম অসীম বলেছেন: ভাই অনেক ভালো লেগেছে আপনার মতামত। প্রেরণা হয়ে আছেন সব সময় । ধন্যবাদ।

৩| ১২ ই আগস্ট, ২০১৪ সকাল ১১:০৫

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: ভালো লিখেছেন। লেখাটি বেশ বড় হলেও পড়তে ক্লান্তি লাগেনি।

ধন্যবাদ, ভাই জসীম অসীম।

১২ ই আগস্ট, ২০১৪ দুপুর ১২:০৩

জসীম অসীম বলেছেন: ভাই , চমৎকার মতামত পেলাম আপনার কাছ থেকে। ভালো থাকবেন। সব সময়। আপনার জন্য অনেক শুভকামনা। ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.