নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

চলো আমরা পাখিদের কাছ থেকে ইউক্লিডের নতুন পাঠ নেই জীবনানন্দের পাঠ নেই নিউটনের আপেল গাছটি থেকে।

জসীম অসীম

লেখা হলো কেতকীফুল। ভালোবাসি তাই।

জসীম অসীম › বিস্তারিত পোস্টঃ

‘ অসংখ্য বেগুনী ফুল ফেলে ভারতে পালানো সম্ভব হবে না আমার’

২৭ শে আগস্ট, ২০১৪ বিকাল ৩:৩৯


ইতালীর বামপন্থী চিন্তানায়ক আন্তোনিয়ো গ্রামসী বলেছিলেন, ‘সব মানুষের অভিজ্ঞতাই খুব মূল্যবান।’ সেই কথাটি আমি আজও খুবই বিশ্বাস করি। সে রকম ধারনা থেকেই ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে আমি একদিন মনীন্দ্র চন্দ্র ভট্টাচার্যের ছেলের সঙ্গে তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা শহরের উপকন্ঠে ঝাঁকুনিপাড়াতে যাই। মনীন্দ্র বাবুর ছেলের সঙ্গে তার সাইকেলে করে যেতে যেতে শুনি তার বাবা শ্রী মনীন্দ্র চন্দ্র ভট্টাচার্যের নানা কথা। অবশ্য এর আগেও মনীন্দ্র ভট্টাচার্যের সঙ্গে আমার কথা হয়, যখন মনীন্দ্র বাবুদের ডেইরী ফার্মের বড় গো-শেডটিকে কে বা কারা রাতের অন্ধকারে পুড়িয়ে দেয়,তখন। সে সময়ে দুর্বৃত্তদের আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া গো-শেডটি নিয়ে কুমিল্লার দৈনিক রূপসী বাংলা পত্রিকায় একটি রিপোর্টও করেছিলাম আমি।
শ্রী মনীন্দ্র চন্দ্র ভট্টাচার্য বৃটিশ রাজ্য দেখেছেন। পাকিস্তানী আমলে পূর্ব পাকিস্তান কেমন ছিল , তাও দেখেছেন ভালো করে। আর স^াধীন বাংলাদেশের দিনগুলো নিয়ে তো তার অভিজ্ঞতার কোনো কমতিই নেই। কথা বলেন, ঠিক যেন ধানিলঙ্কার মতো। এক কড়া অভিজ্ঞতার মানুষ তিনি। তার কথাগুলোতে খুব ঝাল ঝাল স^াদ পেয়েছিলাম। ২০০০ সালেই তার সঙ্গে কথা বলে এসে লিখে রেখেছিলাম কথোপকথনের এ বিষয়টি। তবে তার সবগুলো কথা এ লেখায় উঠে আসেনি। কথায় কথায় তিনি আমাকে বলেছিলেন, ধুতুরা গাছে ধুন্দুল হয় না। কথাটি শুনে আমি তখন খুবই অবাক হয়েছিলাম। তবে দিন যতই যাচ্ছে, এখন প্রায়ই আমার মনে পড়ে মনীন্দ্র বাবুর সেই কথা: ধুতুরা গাছে ধুন্দুল হয় না। ধুতুরা হলো বিষ, আর ধুন্দুল হলো সবজি। এ কথার সত্যি সত্যি তাৎপর্য রয়েছে। প্রথমে আমি শ্রী মনীন্দ্র ভট্টাচার্যকে বললাম, আপনার নাম কী ?
এ প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গেই উওর দিলেন ‘বিদ্যাশুন্য ভট্টাচার্য’।‘বিদ্যাশুন্য ভট্টাচার্য’? রসিকতা করছেন ? বললেন, আমার প্রকৃত নাম মনীন্দ্র চন্দ্র ভট্টাচার্য হলেও ‘বিদ্যাশুন্য ভট্টাচার্য’ বলতেই আমার ভালো লাগে। কুমিল্লা শহরের পূর্বপ্রান্তের গ্রাম ঝাকুনিপাড়ায় আমার জন্ম। গোমতি নদীর দক্ষিণপাড়ে।
ঊললাম, আপনার স্ত্রীর নাম কী?
বললেন, স্ত্রীর নাম হেললতা, কিন্তু মায়ের নাম দেবী গোমতী। গোমতী নদী। যে নদী আমার মন খারাপের সকল কারণ জানে। পিতৃদেব হলেন আকাশের ধ্র“বতারা, যে তারাটি মধ্যরাতে মিটমিট করে জ্বলে।
আপনি তো পরাধীন বৃটিশ রাজ্যে বড় হয়েছেন। স^াধীন বাংলাদেশে আপনার অনুভূতি কেমন?
মনীন্দ্র চন্দ্র বলেন, স^াধীনতার কাছে শেষ পর্যন্ত কী পেলাম আমরা,যেখানে এখনও প্রাণভয়ে দেশের মায়া বুকে নেয়ার অবস্থা আজও নেই। পায়ের তলার মাটি আমাদের ভীষণতর আলগা। তাই এখনও কিছু লোক রাতের বেলা আমাদের বাড়িতে আগুন দিতে সাহস করে। ঘর পুড়ে ছারখার হলেও কেউ গ্রেফতার হয় না। চারদিকের এত চক্রান্তের মাঝে স^াধীনতার স^াদ পাওয়া যায় ? অভিশপ্ত এক জীবন নিয়ে কোনো রকমে এ প্রাণটিকে বাঁচিয়ে রেখেছি।
কেন এভাবে গ্রামে পড়ে আছেন? শহর এলাকায় আপনার ছেলেরা থাকেন। ওখানে গিয়ে থাকেন না কেন? আমার এ প্রশ্নের জবাবে মনীন্দ্র ভট্টাচার্য বলেন, বাড়িতে থাকলে আমি উদাস দুপুরে অতীত নিয়ে ভাবতে পারি। অতীত আমার কাছে অনেক সুন্দর,ভবিষ্যৎ বড় অন্ধকার। আমি ভীষণ আবেগপ্রবণ মানুষ। শহরে সারাক্ষণ থাকলে প্রাণে বাচাঁবো না। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে দৃষ্টি দিয়েও প্রায়ই আমি এ কথাটি ভাবি।
স^াধীন এদেশটাকে কেমন লাগে? আমি তাকে বললাম। তিনি বলেন, বাংলাদেশের রূপ-রস আমার প্রাণে মিশে আছে। কিন্তু এদেশে অনেক ভেজালও আছে। মানুষগুলো পরিশুদ্ধ হলে ভেজাল দূর হবে। আমার আত্মীয়স^জন সব ভারতে চলে গেছে। আমি কোনদিনও যাবো না। ভারত ভেঙ্গে পাকিস্তান হওয়ার পর বুক ভেঙ্গে গিয়েছিল। আবার দেশ স^াধীন হওয়াতে অনেক আনন্দও পেয়েছিলাম। কিন্তু অখন্ড ভারতের আনন্দ এখন আর নেই। তারপরও বাংলার রূপ-রস প্রতিদিন যে চোখে এসে লেগেছে, তাকে ফেলে ভারতে যাওয়ার ইচ্ছে আমার একদমই নেই। আমি বললাম, তারপরও হয়তো দেখা যাবে একদিন না বলেই ভারতে পালিয়ে গেছেন। আমার এ কথায় খুব চোট পান তিনি। স্থির হয়ে বলেন, হ্যাঁ অনেকেই এভাবে চলে যায়। কিন্তু আমি কিভাবে যাই ভারতে ? আমার বাড়ির কাছে যে বুড়ো বটগাছটি রয়েছে, সে বৃক্ষ যেতে বারণ করে। আমার শৈশবের পরম সঙ্গী এ বৃক্ষ। বাড়ির পাশের ঘন জঙ্গলের অসংখ্য বেগুনী ফুল ফেলে ভারতে পালানো কখনোই সম্ভব হবে না আমার। এই যে নদী, গোমতি নদী, যে নদীর মাঝখানে শৈশবে অনেক সাঁতার কেটেছি, তাকে ফেলে কিভাবে যাবো আমি? শৈশবের সেই রাঙা সব দিন আর না থাক, সেই অসাধারণ অনুভুতিমাখা নদীটি তো আছে। এখনও আছে বাড়ির সবদিকে গভীর গাঢ় সবুজ নীরব শান্ত প্রকৃতি। এ বাড়িতে কতো শত লোকের স্মৃতি। রাতে তাদের সাথে আড্ডাতে আড্ডাতে কেটে যেত রাত। এসব মনে হলে আর ইন্ডিয়া যাওয়ার কথা মনে পড়ে না আমার। তবে খারাপও লাগে, যখন দেখি এখানকার অনেক মানুষ আমাদের বুঝেও না, বিশ্বাসও করে না,তখন। তবে ইন্ডিয়ায় গেলে যে ওখানকার মানুষও আমাদের দুঃখ বুঝবে, তার কী নিশ্চয়তা আছে? ইন্ডিয়ায় গিয়ে যদি দেখি শান্তি ওখানেও নেই, তখন কি আর ফেরার উপায় আছে? সুতরাং, না যাওয়াই আমার বিবেচনায় উত্তম। আসলে দরকার ভালো মানুষ হওয়া। সেটা তো চিরকালই কঠিন ছিল। সব মানুষ কি আর খারাপ পন্থা ছাড়বে? আমি বললাম, মণিবাবু আপনার তো এখন বয়স অনেক। আপনার জীবনের অভিজ্ঞতার বিষয়ে কিছু কি বলবেন? এ প্রশ্নের উওরে মনীন্দ্র চন্দ্র ভট্টাচার্য বলেন, বয়স হলে চোখের রঙিন চশমা ক্রমশ খসে যায়। দুশ্চিন্তায় প্রায় রাতেই হাত-পা বরফ হয়ে যায়। কেউ কেউ হয়তো আবেগশুন্যও হয়ে পড়ে। কিন্তু আমি কোন আবেগশূন্য মানুষ নই। আপনার উত্তরসূরিরা কখনো কি ইন্ডিয়ায় যাবে না ? কী মনে হয় আপনার? উত্তরে মনীন্দ্র বলেন, জানি না। আমি যাবো না কিংবা যেতে পারলাম না বলে যে আমার বংশধরও এ দেশে থেকে যাবে, তা তো বলতে পারি না। কারণ এদেশে বাস করতে হলে এখানকার মানুষের হƒদয়টাকে আরও সুন্দর করতে হবে। এ দেশের প্রকৃতি বড়ই সুন্দর। কিন্তু শুধু প্রকৃতি নিয়েই তো আর মানুষ বেঁচে থাকতে পারেনা। মানুষের সঙ্গী যে মানুষ, সে মানুষকেও তো প্রকৃতির মতো সুন্দর হতে হবে। আমি বললাম, আপনার জীবন নিয়ে আপনার শেষ বক্তব্য কী?
শ্রী মনীন্দ্র চন্দ্র ভট্টাচার্য বলেন, আমার জীবনটার কথা তো এক মুহূর্তে বলে শেষ করা যাবে না। আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন এ অঞ্চলে একবার মহাতœা গান্ধী এসেছিলেন। গান্ধীভক্ত আমি তখন ১২ বছরের কিশোর। হাফপ্যান্ট পরে গান্ধীকে দেখতে গিয়েছিলাম। গান্ধীকে দেখার আনন্দে সেদিন আমি কেঁদেছিলাম। নেতা তো ছিলেন তারাই।
তখন জিনিসপত্রের দামও অনেক কম ছিল। এক ‘কানি' জমি বেচাকেনা হতো ২৫/৩০ টাকায়। বাছুরসহ গাভী পাওয়া যেতো ১০/১৫ টাকায়। চাউলের মণ ছিল দেড় টাকা। সেটা অবশ্যই বৃটিশ রাজ্যের কথা বলছি। এ দেশকে তখন সকল লোকেই ‘বৃটিশরাজ্য’ বলতো।
আমি বললাম, আপনি তো একজন প্রবীণ মানুষ, প্রাচীণ বৃক্ষ। আপনার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কিছু বলবেন? মণি বাবু বলেন, আমার বাবা মারা গিয়েছিলেন যখন আমার মাত্র ৬ মাস বয়স। সয়সম্পত্তি তাই অনেক থাকলেও বড় কষ্টেই বড় হয়েছি। দেশকে খুবই ভালোবাসতাম। বড় হয়ে অনেকদিন পর্যন্ত দেশাত্ববোধক গানবাজনা করেছি। রামায়ণ কীর্তনে মগ্ন থেকেছি। গান গাইতে গাইতে কখনো বা সীমান্তের কাছে অরণ্যপুরে, বিবিরবাজারে গোমতি নদীর ভাঙ্গা বাঁধ বাঁধার কাজে অংশ নিয়েছি। মুখে ছিল তখন ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনি। একটি গান তখন খুবই গাইতাম আমরা,মনে পড়ে....
‘মোটা ভাত মোটা কাপড়
মায় বলে পুত আমার, রাজার চাকর
চরকার সুতা কাটিয়া তোরা,পেটের যোগাড় কর,
তোরা ভাতের যোগাড় কর...’
এই যে গানের সুর, বর্ষীয়ান মনীন্দ্র চন্দ্র ভট্টাচার্যের কন্ঠে দারুণ,লেগেছিল। কিন্তু আমার কাছে তখন কোনো টেপরেকর্ডার কিংবা কোনো ক্যামেরাও ছিল না যে তার সুর কিংবা ছবি তুলে রাখি... যদিও এখনও মনে হয় আমার কানে যেন সেই সুর গভীরভাবে বাজে। যেন মনীন্দ্র চন্দ্র ভট্টাচার্য এখনো আমার কানের কাছে বলছেন, কিন্তু আমি কিভাবে যাই ভারতে ? আমার বাড়ির কাছে যে বুড়ো বটগাছটি রয়েছে, সে বৃক্ষ যেতে বারণ করে। বাড়ির পাশের ঘন জঙ্গলের অসংখ্য বেগুনী ফুল ফেলে ভারতে পালানো কখনোই সম্ভব হবে না আমার। এই যে নদী, গোমতি নদী, যে নদীর মাঝখানে শৈশবে অনেক সাঁতার কেটেছি, তাকে ফেলে কিভাবে যাবো আমি? এখনও আছে বাড়ির সবদিকে গভীর গাঢ় সবুজ নীরব শান্ত প্রকৃতি। এ বাড়িতে কতো শত লোকের স্মৃতি। রাতে তাদের সাথে আড্ডাতে আড্ডাতে কেটে যেত রাত। এসব মনে হলে আর ইন্ডিয়া যাওয়ার কথা মনে পড়ে না আমার।
রচনা: সেপ্টেম্বর ২০০০ খিস্টাব্দ, সংরাইশ, কুমিল্লা।
নোট: অনেকদিন পর মণিবাবুর ছেলের কাছে জানলাম,মণিবাবু আর নেই। তিনি ভারতে যাননি। গোমতি নদীর পারেই প্রয়াত হয়েছেন। তবে মণিবাবুর এক নাতি বর্তমানে ভারতে লেখাপড়া করছেন।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৭ শে আগস্ট, ২০১৪ বিকাল ৪:২২

অতনু অর্ঘ বলেছেন: প্রাণভয়ে দেশের মায়া বুকে নেয়ার অবস্থা আজও নেই। পায়ের তলার মাটি আমাদের ভীষণতর আলগা। ... চারদিকের এত চক্রান্তের মাঝে স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়া যায়?...

সত্যিই, এ কেমন আকাশ দেখালে তুমি? এ কেমন স্বদেশ জন্মভূমি?...

২৭ শে আগস্ট, ২০১৪ বিকাল ৪:৩৫

জসীম অসীম বলেছেন: শ্রী মনীন্দ্র বাবু আরও কিছু কথা আমাকে বলেছিলেন , যা এ লেখায় নেই। যেমন, তিনি বলেছিলেন, হিন্দুরা হলো বাংলাদেশের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। ...এসব কথা আমি এড়িয়ে গিয়েছি। বলেছিলেন ,নির্য়াতন সহ্য করার কিছু কথা। ওসব কথা আমার অন্য লেখায় রয়েছে। ভালো থাকবেন। ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.