নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

চলো আমরা পাখিদের কাছ থেকে ইউক্লিডের নতুন পাঠ নেই জীবনানন্দের পাঠ নেই নিউটনের আপেল গাছটি থেকে।

জসীম অসীম

লেখা হলো কেতকীফুল। ভালোবাসি তাই।

জসীম অসীম › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্প: অদ্ভুত মৃত্যুর ডাক

১০ ই অক্টোবর, ২০১৮ রাত ৩:৪১

অলংকরণ: জসীম অসীম।

[নোট: আমি এই গল্পটি লিখেছিলাম ১৯৯০ সালে। তখনও ছোটগল্প বিষয়ে আমার কোনো ধারনাই তৈরি হয়নি। তবু এ গল্পটি আমি একসময় কুমিল্লার `দৈনিক রূপসী বাংলা' পত্রিকার সাহিত্য পাতা'য় ছাপাতে দিয়েছিলাম। এই গল্পটিও ওই পত্রিকায় বেশ গুরুত্বসহ ছাপা হয়। `রূপসী বাংলা'র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক অধ্যাপক আবদুল ওহাব ওই পত্রিকার সাহিত্য পাতায় আমার অনেক গল্পই ছাপানোর ব্যবস্থা করেন। সেটা ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ২০০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়ে। সময়ের আবর্তনে এবং আমার জীবনের একাধিক দুর্ঘটনায় প্রকাশিত তারিখসহ সেসব লেখার অধিকাংশই হারিয়েছি। আজ অনেক বছর পর আমার স্ত্রী সাদিয়া অসীম পলি আমারই পুরনো কাগজপত্রের সঙ্গে এ লেখাটি পেয়ে তাৎক্ষণিক কম্পোজ করে দেয়।]
==============================
ভোর রাতের আরও অনেকটা সময় বাকী। চারদিক স্তব্ধতায় বন্দী। আমি মোহন। ব্রিগেডিয়ার মোহন। ঊনিশশ' একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। কিন্তু বাংলাদেশের একজন দেশপতির হত্যা মামলায় আমিও জড়িয়ে গেছি কিংবা আমাকে জড়ানো হয়েছে। ওই হত্যার জন্য আমি কোনোভাবেই দায়ী কিনা, সে আলোচনা জটিল। তাই অন্তিম মুহূর্তে আর সে দিকে যাচ্ছিনা আমি। শুধু বলে রাখছি যে, একটু পরই আমার ফাঁসি হবে। ফাঁসি। মৃতু্যদন্ড কার্যকর করা হবে। জীবনের এই শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আমি এখন ইচ্ছে করেই আমার মৃত্যুকে ভুলে আছি। মরতে যখন হবেই, তখন মৃত্যুকে আর ভয় করে কী লাভ। বরং একটু সুখে শান্তিতেই মরণ হোক আমার। তাই এখন আপনাদের আমার জীবনের স্মরণীয় এক সন্ধ্যামাখা বিকেলের কথা বলি।
তখন আমি কিশোর। সেদিন সঙ্গীদের সঙ্গে খেলাধুলো ভুলে গিয়ে বসেছিলাম কুমিল্লার গোমতি নদীর তীরে, যে গোমতি মিশে গেছে আমার রক্তের সঙ্গে। তখন ছিলো শরৎকাল। নদীর পাড় সবুজ সবুজ ঘাসে ঢেকে ছিলো। ঘাসের চাদরে হেঁটে হেঁটে কৃষকদের গরু-ছাগলগুলো তখন ঘাস খাচ্ছিলো। গরু-ছাগল কোনো কোনোটির পিঠে আবার ফিঙে পাখি বসে বসে ডাকছিলো। নানান রকমের ডাক। নদী দিয়ে ভেসে যাচ্ছিলো নানা রকমের কচুরিপানা। তাঁর কোনো কোনোটির মধ্যে আবার ছিলো বেগুনি রঙের ফুলও। আশেপাশের কৃষকেরা তখন বর্ষার উজানের জল নেমে যাওয়া চরগুলোতে চাষাবাদও করছিলো। দূরে এক চরে আমার বয়সী অনেক ছেলেদের ফুটবল খেলতেও দেখলাম। অন্যদিন হলে দৌড়ে যেতাম আমি। কিন্তু সেদিন খেলতেও ভালো লাগেনি আমার। ভালো লেগেছিল শুধু বসে বসে গোমতি নদীর এপার-ওপার দেখতে। খুব দূরে অবস্থিত একটা বাড়ীর ঘন গাছপালাকে বনের মতো মনে হচ্ছিল আমার। সবুজ সবুজ গাঢ় সবুজ। শুধু সবুজের সমারোহ। সেই সবুজের কথা কখনোই আমি ভুলে যেতে পারবো না। নদীর একপাশে মাছ ধরছিলো কয়েকজন জেলে। এক সময় একটি বড় মাছ পেয়ে তারা আনন্দে হৈ-হল্লা শুরু করলো। অন্যদিন হলে তাদের কাছে দৌড়ে যেতাম আমি। মাছের চোখ দেখতাম, লেজ দেখতাম। কেন ঠিক জানি না, সেদিন আমার দৌড়াদৌড়িতে একেবারেই মন ছিল না। আর গোমতি নদী বয়ে যাচ্ছিল ঠিক ওই আশ্বিনের নদীর মতোই। বুঝাই যাচ্ছিল না এ নদী আষাঢ়ে এতো ভীষণ উত্তেজিত হয়। নদী দিয়ে দু'পাড়ের যাত্রী নিয়ে এপার-ওপার করছিলো মাঝি। যাত্রীদের অধিকাংশেরই পরনে ছিল লুঙ্গি। অনেকের গায়ে আবার পাঞ্জাবী বা গেঞ্জিও ছিলো। কেউবা ছিল আবার খালি গায়েই। টুপি ছিল আরো অনেকের মাথায়। একই মাঝি সব বয়সী, সব ধর্মীয়, সব চেতনার, সব পেশার মানুষকে পাড় করে দিচ্ছিল। আমি সেদিনই প্রথম এতো গভীর করে এই ব্যাপারটি দেখেছিলাম। নদীর ওপারে ছিলো বাজার। বাজার থেকে সন্ধ্যামাখা বিকেলে খরচের ব্যাগ-পোটলা নিয়ে বাড়ি ফিরছিলো লোকজন। কেউবা ধীরে, কেউ বা দ্রুত লয়ে। কিন্তু বাড়ি ফিরছিলো সব্বাই-ই। ওপারে যে বাজার ছিল, তারই নীচে ছিল একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সে বিদ্যালয়েই পড়তাম আমরা। স্কুল প্রাঙ্গণে শীতকালে বছরে একবার মেলা হতো। মেলার সময় মাঝি খেয়া নৌকো খুব খুব যাত্রী বোঝাই করেই এপার-ওপার করতো। একবার এই মেলার সময়েই নৌকোডুবিতে আমার চাচাত ভাই রবিন মারা গিয়েছিলো। সে দুঃখের স্মৃতি আমি কোনোদিনই ভুলবোনা। ভুলে যেতে পারবো না। নদীর পাড় দিয়ে সেদিনই যাচ্ছিল এক ফেরিওয়ালা। স্বাস্থ্য বেশি ভালো ছিল না তাঁর। পরনে ছিল নীল রঙের লুঙ্গি। ঠিক শরতের আকাশটারই মতো। তাঁর এ দ্রুত বাড়ির দিকে হাঁটার মধ্যে এক ধরনের সুখ দেখেছিলাম আমি। ঠিক তখনই হঠাৎ রেলগাড়ির ডাক শুনলাম আমি। রেলগাড়িটা আসলো এবং গেলো।পশ্চিমের নদীর ওপরের লাল ব্রীজটা দিয়েই। শব্দ করলো নানা রকমের শব্দ। ওর দৌড়ের দাপটে মাটি এবং নদীর পানিও কেঁপেছিলো সেদিন। দেখেছিলাম খুব কাছ থেকেই। কিশোর একজন রাখাল বাড়ি ফিরছিলো বিড়ি খেতে খেতে। তারই পেছন দিক থেকে আমাদের ওসমান স্যার আসছিলেন কালো সাইকেল চেপে। বোধ হয় শ্বশুরবাড়ী থেকেই। কারণ সেদিন ছিল রবিবার, স্কুল ছুটির দিন। ছুটির দিনে কতো খেলা খেলতাম আমরা। কিন্তু কেন যে সেদিন সব খেলা বাদ দিয়ে শুধু দেখার খেলাই খেলছিলাম আমি। দেখা-দেখা শুধুই দেখা। এ দেখার যেন আর শেষই ছিল না। হঠাৎ একজন মহিলাকে একটি শিশু কোলে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে যেতে দেখেছিলাম। শিশুটির হাত পা ও পেট দেখে বুঝেছিলাম শিশুটি ভীষণই অপুষ্টির শিকার। মহিলার পরনের শাড়িতে অনেকগুলো তালিও দেখেছিলাম। শাড়ির একদিকের ছিঁড়ে জায়গা দিয়ে মহিলাটির হাঁটু পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিলো। এতোই দরিদ্র ছিলো সেই মহিলা। রাগে- ঘৃণায়- দুঃখে আমার কান্না এসেছিলো। জানিনা এ কিসের রাগ... কিসের ঘৃণা কিংবা কিসের দুঃখ। হয়তো মহিলার কষ্ট দেখেই এমন হয়েছিলো। হঠাৎ সামনে দেখেছিলাম মশার ঝাঁক। ততক্ষণে নিজ বাড়ির দিকে ফিরবো বলে ওঠে দাঁড়ালাম আমি। আকাশে তখন অনেক অনেক ঘুরন্ত উড়ন্ত বাদুর। মেঘগুলোও আর নীল আকাশের সাদা মেঘের ভেলা ছিল না তখন। অস্ত যাওয়া সূর্যের রঙে রক্তের মতো লাগছিলো। আর তখনই আমার ভয় লেগে গেলো। সাদা সাদা মেঘগুলো এভাবে রক্তে ছেয়ে গেলো কেনো। রক্ত মেঘে ভেসে ভেসে আমি বাড়ি ফিরতে লাগলাম।

শেষ কথা: আমি মোহন। ব্রিগেডিয়ার মোহন। ঊনিশশ' একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। কিন্তু বাংলাদেশের একজন দেশপতির হত্যা মামলায় আমিও জড়িয়ে গেছি কিংবা আমাকে জড়ানো হয়েছে। ওই হত্যার জন্য আমি কোনোভাবেই দায়ী কিনা, সে আলোচনা জটিল। এবার আমিও উঠি বন্ধু। ডাক এসেছে। ফাঁসির ডাক। অস্ত যাওয়া রক্তবর্ণের সূর্যের মতো করুন রঙা ডাক। এ ডাক অদ্ভুত এক মৃত্যুর ডাক। এ ডাক ছেলেবেলার সেই নদীতে দেখা কচুরিপানার শোনা ডাক। কেবলই ভেসে চলা। উজানের দিকে আর ফেরার উপায় নেই কিংবা যেন রবিনের মতো নৌকাডুবিতে মরার ডাক: যে ডাক থেকে ফেরার উপায় কক্ষনোই থাকে না। কোনোদিন না। মানুষকে কেন এমন মৃত্যু এসে ডাকে? কেনো?
[নোট: আমি এই গল্পটি লিখেছিলাম ১৯৯০ সালে। তখনও ছোটগল্প বিষয়ে আমার কোনো ধারনাই তৈরি হয়নি। তবু এ গল্পটি আমি একসময় কুমিল্লার `দৈনিক রূপসী বাংলা' পত্রিকার সাহিত্য পাতা'য় ছাপাতে দিয়েছিলাম। এই গল্পটিও ওই পত্রিকায় বেশ গুরুত্বসহ ছাপা হয়। `রূপসী বাংলা'র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক অধ্যাপক আবদুল ওহাব ওই পত্রিকার সাহিত্য পাতায় আমার অনেক গল্পই ছাপানোর ব্যবস্থা করেন। সেটা ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ২০০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়ে। সময়ের আবর্তনে এবং আমার জীবনের একাধিক দুর্ঘটনায় প্রকাশিত তারিখসহ সেসব লেখার অধিকাংশই হারিয়েছি। আজ অনেক বছর পর আমার স্ত্রী সাদিয়া অসীম পলি আমারই পুরনো কাগজপত্রের সঙ্গে এ লেখাটি পেয়ে তাৎক্ষণিক কম্পোজ করে দেয়।]
==============================
ভোর রাতের আরও অনেকটা সময় বাকী। চারদিক স্তব্ধতায় বন্দী। আমি মোহন। ব্রিগেডিয়ার মোহন। ঊনিশশ' একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। কিন্তু বাংলাদেশের একজন দেশপতির হত্যা মামলায় আমিও জড়িয়ে গেছি কিংবা আমাকে জড়ানো হয়েছে। ওই হত্যার জন্য আমি কোনোভাবেই দায়ী কিনা, সে আলোচনা জটিল। তাই অন্তিম মুহূর্তে আর সে দিকে যাচ্ছিনা আমি। শুধু বলে রাখছি যে, একটু পরই আমার ফাঁসি হবে। ফাঁসি। মৃতু্যদন্ড কার্যকর করা হবে। জীবনের এই শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আমি এখন ইচ্ছে করেই আমার মৃত্যুকে ভুলে আছি। মরতে যখন হবেই, তখন মৃত্যুকে আর ভয় করে কী লাভ। বরং একটু সুখে শান্তিতেই মরণ হোক আমার। তাই এখন আপনাদের আমার জীবনের স্মরণীয় এক সন্ধ্যামাখা বিকেলের কথা বলি।
তখন আমি কিশোর। সেদিন সঙ্গীদের সঙ্গে খেলাধুলো ভুলে গিয়ে বসেছিলাম কুমিল্লার গোমতি নদীর তীরে, যে গোমতি মিশে গেছে আমার রক্তের সঙ্গে। তখন ছিলো শরৎকাল। নদীর পাড় সবুজ সবুজ ঘাসে ঢেকে ছিলো। ঘাসের চাদরে হেঁটে হেঁটে কৃষকদের গরু-ছাগলগুলো তখন ঘাস খাচ্ছিলো। গরু-ছাগল কোনো কোনোটির পিঠে আবার ফিঙে পাখি বসে বসে ডাকছিলো। নানান রকমের ডাক। নদী দিয়ে ভেসে যাচ্ছিলো নানা রকমের কচুরিপানা। তাঁর কোনো কোনোটির মধ্যে আবার ছিলো বেগুনি রঙের ফুলও। আশেপাশের কৃষকেরা তখন বর্ষার উজানের জল নেমে যাওয়া চরগুলোতে চাষাবাদও করছিলো। দূরে এক চরে আমার বয়সী অনেক ছেলেদের ফুটবল খেলতেও দেখলাম। অন্যদিন হলে দৌড়ে যেতাম আমি। কিন্তু সেদিন খেলতেও ভালো লাগেনি আমার। ভালো লেগেছিল শুধু বসে বসে গোমতি নদীর এপার-ওপার দেখতে। খুব দূরে অবস্থিত একটা বাড়ীর ঘন গাছপালাকে বনের মতো মনে হচ্ছিল আমার। সবুজ সবুজ গাঢ় সবুজ। শুধু সবুজের সমারোহ। সেই সবুজের কথা কখনোই আমি ভুলে যেতে পারবো না। নদীর একপাশে মাছ ধরছিলো কয়েকজন জেলে। এক সময় একটি বড় মাছ পেয়ে তারা আনন্দে হৈ-হল্লা শুরু করলো। অন্যদিন হলে তাদের কাছে দৌড়ে যেতাম আমি। মাছের চোখ দেখতাম, লেজ দেখতাম। কেন ঠিক জানি না, সেদিন আমার দৌড়াদৌড়িতে একেবারেই মন ছিল না। আর গোমতি নদী বয়ে যাচ্ছিল ঠিক ওই আশ্বিনের নদীর মতোই। বুঝাই যাচ্ছিল না এ নদী আষাঢ়ে এতো ভীষণ উত্তেজিত হয়। নদী দিয়ে দু'পাড়ের যাত্রী নিয়ে এপার-ওপার করছিলো মাঝি। যাত্রীদের অধিকাংশেরই পরনে ছিল লুঙ্গি। অনেকের গায়ে আবার পাঞ্জাবী বা গেঞ্জিও ছিলো। কেউবা ছিল আবার খালি গায়েই। টুপি ছিল আরো অনেকের মাথায়। একই মাঝি সব বয়সী, সব ধর্মীয়, সব চেতনার, সব পেশার মানুষকে পাড় করে দিচ্ছিল। আমি সেদিনই প্রথম এতো গভীর করে এই ব্যাপারটি দেখেছিলাম। নদীর ওপারে ছিলো বাজার। বাজার থেকে সন্ধ্যামাখা বিকেলে খরচের ব্যাগ-পোটলা নিয়ে বাড়ি ফিরছিলো লোকজন। কেউবা ধীরে, কেউ বা দ্রুত লয়ে। কিন্তু বাড়ি ফিরছিলো সব্বাই-ই। ওপারে যে বাজার ছিল, তারই নীচে ছিল একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সে বিদ্যালয়েই পড়তাম আমরা। স্কুল প্রাঙ্গণে শীতকালে বছরে একবার মেলা হতো। মেলার সময় মাঝি খেয়া নৌকো খুব খুব যাত্রী বোঝাই করেই এপার-ওপার করতো। একবার এই মেলার সময়েই নৌকোডুবিতে আমার চাচাত ভাই রবিন মারা গিয়েছিলো। সে দুঃখের স্মৃতি আমি কোনোদিনই ভুলবোনা। ভুলে যেতে পারবো না। নদীর পাড় দিয়ে সেদিনই যাচ্ছিল এক ফেরিওয়ালা। স্বাস্থ্য বেশি ভালো ছিল না তাঁর। পরনে ছিল নীল রঙের লুঙ্গি। ঠিক শরতের আকাশটারই মতো। তাঁর এ দ্রুত বাড়ির দিকে হাঁটার মধ্যে এক ধরনের সুখ দেখেছিলাম আমি। ঠিক তখনই হঠাৎ রেলগাড়ির ডাক শুনলাম আমি। রেলগাড়িটা আসলো এবং গেলো।পশ্চিমের নদীর ওপরের লাল ব্রীজটা দিয়েই। শব্দ করলো নানা রকমের শব্দ। ওর দৌড়ের দাপটে মাটি এবং নদীর পানিও কেঁপেছিলো সেদিন। দেখেছিলাম খুব কাছ থেকেই। কিশোর একজন রাখাল বাড়ি ফিরছিলো বিড়ি খেতে খেতে। তারই পেছন দিক থেকে আমাদের ওসমান স্যার আসছিলেন কালো সাইকেল চেপে। বোধ হয় শ্বশুরবাড়ী থেকেই। কারণ সেদিন ছিল রবিবার, স্কুল ছুটির দিন। ছুটির দিনে কতো খেলা খেলতাম আমরা। কিন্তু কেন যে সেদিন সব খেলা বাদ দিয়ে শুধু দেখার খেলাই খেলছিলাম আমি। দেখা-দেখা শুধুই দেখা। এ দেখার যেন আর শেষই ছিল না। হঠাৎ একজন মহিলাকে একটি শিশু কোলে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে যেতে দেখেছিলাম। শিশুটির হাত পা ও পেট দেখে বুঝেছিলাম শিশুটি ভীষণই অপুষ্টির শিকার। মহিলার পরনের শাড়িতে অনেকগুলো তালিও দেখেছিলাম। শাড়ির একদিকের ছিঁড়ে জায়গা দিয়ে মহিলাটির হাঁটু পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিলো। এতোই দরিদ্র ছিলো সেই মহিলা। রাগে- ঘৃণায়- দুঃখে আমার কান্না এসেছিলো। জানিনা এ কিসের রাগ... কিসের ঘৃণা কিংবা কিসের দুঃখ। হয়তো মহিলার কষ্ট দেখেই এমন হয়েছিলো। হঠাৎ সামনে দেখেছিলাম মশার ঝাঁক। ততক্ষণে নিজ বাড়ির দিকে ফিরবো বলে ওঠে দাঁড়ালাম আমি। আকাশে তখন অনেক অনেক ঘুরন্ত উড়ন্ত বাদুর। মেঘগুলোও আর নীল আকাশের সাদা মেঘের ভেলা ছিল না তখন। অস্ত যাওয়া সূর্যের রঙে রক্তের মতো লাগছিলো। আর তখনই আমার ভয় লেগে গেলো। সাদা সাদা মেঘগুলো এভাবে রক্তে ছেয়ে গেলো কেনো। রক্ত মেঘে ভেসে ভেসে আমি বাড়ি ফিরতে লাগলাম।

শেষ কথা: আমি মোহন। ব্রিগেডিয়ার মোহন। ঊনিশশ' একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। কিন্তু বাংলাদেশের একজন দেশপতির হত্যা মামলায় আমিও জড়িয়ে গেছি কিংবা আমাকে জড়ানো হয়েছে। ওই হত্যার জন্য আমি কোনোভাবেই দায়ী কিনা, সে আলোচনা জটিল। এবার আমিও উঠি বন্ধু। ডাক এসেছে। ফাঁসির ডাক। অস্ত যাওয়া রক্তবর্ণের সূর্যের মতো করুন রঙা ডাক। এ ডাক অদ্ভুত এক মৃত্যুর ডাক। এ ডাক ছেলেবেলার সেই নদীতে দেখা কচুরিপানার শোনা ডাক। কেবলই ভেসে চলা। উজানের দিকে আর ফেরার উপায় নেই কিংবা যেন রবিনের মতো নৌকাডুবিতে মরার ডাক: যে ডাক থেকে ফেরার উপায় কক্ষনোই থাকে না। কোনোদিন না। মানুষকে কেন এমন মৃত্যু এসে ডাকে? কেনো?

মন্তব্য ১০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১০) মন্তব্য লিখুন

১| ১০ ই অক্টোবর, ২০১৮ সকাল ৮:২৮

মোঃ ফখরুল ইসলাম ফখরুল বলেছেন: ভাল ছিল :)

১০ ই অক্টোবর, ২০১৮ দুপুর ১:৩২

জসীম অসীম বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ। লেখাটি কতোবার যে হারিয়েছি। হলো কী, এগুলো নিজের লেখা .. । এ জন্যই মায়া। আসলে লেখা বা গল্প হিসেবে এগুলোর কোনো বিশেষত্বই নেই। শুধু সংরক্ষণ অথবা শেয়ার করা। আর নতুন করে হাত লাগালে যাবে বদলে। তাই সে কাজ থেকেও নিজেকে বিরত রাখছি।

২| ১০ ই অক্টোবর, ২০১৮ সকাল ৮:৫০

আকিব হাসান জাভেদ বলেছেন: গল্পে প্রকট মন ভাবের আত্মপ্রকাশ । মানুষের কষ্ট আর একা থাকার চেতনা এমনেতেই মানুষকে যন্ত্রনা দেয় । তার উপর অন্যায় চেপে দেওয়া হয়েছে । সুন্দর গল্প।

১০ ই অক্টোবর, ২০১৮ দুপুর ১:৩৮

জসীম অসীম বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ। আপনার মতামত আমার খুবই ভালো লেগেছে। আসলে আমার ব্যস্ততার ফাঁকে আপনাদের ব্লগে আসাই হয় না। জীবন-সংগ্রামের ব্যস্ততা। এটা অত্যন্ত অমার্জনীয় অপরাধই। তবু সময় করে আপনাদের ব্লগ পরিদর্শনের কথা দিচ্ছি। লেখাটির মূল সুরটি কিন্তু আপনি অনুধাবন করেছেন। নিরন্তর শুভ কামনা রইলো।

৩| ১০ ই অক্টোবর, ২০১৮ সকাল ৯:২৪

রাজীব নুর বলেছেন: সত্য গল্প নাকি?

১০ ই অক্টোবর, ২০১৮ দুপুর ২:২৮

জসীম অসীম বলেছেন: রাজীব ভাই, সময়ই বের করতে পারছি না। কী করা যায় বলুন তো। আরও লজ্জার কথা হলো সময় করে কারো ব্লগে এসে লেখা পড়ে মতবিনিময়ও করা হয়ে উঠছে না। এমনকি আপনার ব্লগেও না। এটা তো চরমতম অসৌজন্যতা।
অথচ কখনো কখনো নিজের ব্লগে এসে নিজেরই একটি প্রস্তুত লেখা পোস্ট দিয়েই চলে যাই।
অনেক সময় কয়েকদিন পরে এসে দেখি আপনাদের অনেকেরই মতামত লেখা রয়েছে অথচ আমার কোনো খবরই নেই। নিজেই মানতে পারছি না নিজের এমন অভদ্রতা।
একটা বিষয় ভেবে পাই না আপনি কিভাবে এই ব্লগে এতোটা দায়িত্বশীল? সব লেখা, সব্বার লেখা নজরে রাখা, মত বিনিময় করা এবং দেবী দুর্গার মতো আবার দশ হাতে নিজেও নিজের ব্লগে কলম চালানো (অস্ত্রের বদলে) সে কি সহজ কথা? আমি ঠিক জানি না কী পরিমাণ ত্যাগ স্বীকার করেই না হয়তো আপনাকে এমন দায়িত্বশীল থাকতে হয়। তবে আপনার যত্নের কাছে অনেক কিছুই আমাদের শেখার রয়েছে।
বলছিলেন এ গল্পটি সত্য গল্প নাকি? আসলে তখন, সেই 1990 সালে আমি একজনের কাছে কর্নেল নওয়াজেশের ফাঁসির ঘটনাটা শুনেছিলাম। কর্নেল নওয়াজেশকে প্রেসিডেন্ট জিয়া হত্যার জন্য দায়িদের একজন হিসেবে ফাঁসি দেওয়া হয়।
কর্নেল নওয়াজেশের বাড়ি কুমিল্লা শহরের গোয়ালপট্টিতে। তাঁর ভিটায় এখন গড়ে উঠছে ‘‘কর্নেল নওয়াজেশ টাওয়ার’’। এখানেই এখন কুমিল্লার অনেক সাহিত্যিক রাতের বেলা আড্ডা দেয়।
আমার লেখক বন্ধু কুমিল্লার গল্পকার কাজী মোহাম্মদ আলমগীর নাকি তাঁর শৈশবে কর্নেল নওয়াজেশের ‘ডেডবডি’ও দেখেছিলেন। পোস্টমর্টেম করা ডেডবডি।
কিন্তু আমার লেখায় এসব কিছু নেই।
অনেকেই বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, নওয়াজেশ ষড়যন্ত্রের শিকার। আমি ওদিকে যাইনি। আমি গল্পটি জানার পর চরিত্রের নাম বদলে রাখি ব্রিগেডিয়ার মোহন। আর গল্পটি তো আসলে কোনো গল্পই হয়নি। তবু ওই যে মনে ঘটনাটির রেখাপাত ঘটলো! তারই বর্হিপ্রকাশ যেন এ লেখা।
আর আমি যখন কুমিল্লার ‘দৈনিক রূপসী বাংলা’ পত্রিকায় চাকুরি করি 2000 খ্রিস্টাব্দেরও আগে, তখন পত্রিকাটির সম্পাদক (প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক) ছিলেন কুমিল্লা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক আবদুল ওহাব। তিনিই তাঁর পত্রিকার সাহিত্য পাতা ‘রূপসী বাংলা সাহিত্য’ দেখতেন। সেই সাহিত্য পাতায় একদিন তিনি এ লেখাটিকে গল্প হিসেবেই ছাপেন। সেটা আমার মনে হয় ১৯৯৭ সালে।
অধ্যাপক আবদুল ওহাব কখনোই কোনো ঝুঁকিপূর্ণ লেখা তাঁর পত্রিকায় ছাপাতেন না। ভয়ে থাকতেন আমাকে নিয়েও। কারণ আমি তখন বাম রাজনীতি করতাম আর লেখা দিয়ে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতাম। মার্কসীয় নন্দনতত্ত্ব অথবা ট্রটস্কীর মতবাদ ... ইত্যাদি নিয়ে তখন আমার নিত্য আড্ডা চলতো। এটা আমার তখনকার সহকর্মী আবুল কাশেম হৃদয়ও (বর্তমানে ‘দৈনিক কুমিল্লার কাগজ’ সম্পাদক) ভালোভাবে জানেন।
সম্পাদক ওহাব স্যার যদি জানতেন যে কর্নেল নওয়াজেশের আত্মা এই লেখার ব্রিগেডিয়ার মোহনের ভেতরেই বাস করছে, তাহলে জীবনেও এ লেখা তিনি তাঁর পত্রিকায় ছাপাতেন না।
আসলে এ লেখার ঘটনা বাস্তব না হলেও লেখার নেপথ্য অনেকটা এ রকমই। ধন্যবাদ। শুভেচ্ছা রইলো রাজীব ভাই।

৪| ১০ ই অক্টোবর, ২০১৮ দুপুর ১২:১৮

কাজী আবু ইউসুফ (রিফাত) বলেছেন: জসীম ভাই -আপনি শওকত হায়াত খান (কুমিল্লা পলিটেকনিকে পড়তো) কে চিনতেন- তাঁর মুখে আপনার অনেক কথা শুনেছিলাম। এখন কেমন আছেন। কোথায় আছেন।

১০ ই অক্টোবর, ২০১৮ বিকাল ৩:২৬

জসীম অসীম বলেছেন: ভাই, আমি এখনও কুমিল্লায় থাকি। শওকত হায়াত খান নামে কারোর কথা এখন কেন যে একেবারেই মনে পড়ছে না। দুঃখিত। তিনি এখন কী করছেন? কোথায় থাকছেন? কবে যে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল, তাও খেয়াল নেই। আপনি লেখালেখি ছাড়া আর কী করছেন? ব্লগে আসার জন্য ধন্যবাদ। সময় করে আপনার ব্লগ পরিদর্শন করবো। শুভেচ্ছা রইলো।

৫| ১১ ই অক্টোবর, ২০১৮ সকাল ৮:০৭

নজসু বলেছেন: দিনগুলো বেদনার। স্মৃতিগুলো কষ্টের।
যারা দেশের জন্য জীবন দিলেন।, কতজনে কত স্বার্থ ত্যাগ করলেন তা তো লিখে প্রকাশ করা যাবে না।
আমাদের উচিত হবে তাদের কোনদিন হৃদয় থেকে মুছে না ফেলা।
শুধু দিন নির্ধারন করে তাদের স্মরণ করা আমাদের কর্তব্য নয়।

মোহনের মৃত্যুর ডাককে মনে করছি একজন মুক্তিযোদ্ধার অপমানের জ্বালা হতে মুক্তির ডাক।

২০ শে অক্টোবর, ২০১৮ ভোর ৪:১৮

জসীম অসীম বলেছেন: ব্রিগেডিয়ার মোহনের মৃত্যুর পূর্বক্ষণের গল্প এটি অথবা তাঁর মৃত্যুদন্ড কার্যকরের পূর্বক্ষণের গল্প।
সত্যি বলেছেন, মোহনের মৃত্যুর ডাক আসলে একজন মুক্তিযোদ্ধার অপমানের জ্বালা থেকে মুক্তিরই ডাক। যদিও এখানে ব্রিগেডিয়ার পদবীর কথা বলা হয়েছে, বাস্তব গল্পটি একজন কর্নেলের। তিনিও একজন মুক্তিযোদ্ধাই ছিলেন এবং তাঁর তখন ফাঁসি হয়েছিলো।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্রিগেডিয়ার পদটি ব্যবহৃত হয়। আমাদের দেশেও হয়। কিন্তু জার্মানীতে আগে নাকি এ পদের বদলে কর্ণেল জেনারেল পদটি ব্যবহৃত হতো। যাই হোক এ লেখায় মোহনের পদবীর বিষয়টি বড় নয়, বিষয় হলো ব্রিগেডিয়ার মোহন সত্যিই কোনো মৃত্যুদন্ডযোগ্য অপরাধ আসলেই করেছে কী না।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.