নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বৃষ্টিতে আমার হাটঁতে ভাল লাগে কারন কেউ দেখেনা আমার চোখের জল।

আশিক হাসান

বৃষ্টিতে হাঁটতে ভাল লাগে আমার কারন কেউ দেখেনা দুচোখের জল ধুয়ে যায় বৃষ্টিধারায়

আশিক হাসান › বিস্তারিত পোস্টঃ

জাতিগত বৈচিত্র্য: অভিশাপ না আশীর্বাদ

২৭ শে মার্চ, ২০১৯ রাত ১২:০৩



চিত্র: মালির তোয়ারেগ গোত্রের দুইজন পথিকের রাত্রিযাপন সাহারা মরুভূমিতে ।

"তোমরা বাংলাদেশীরা মানুষকে মানুষ হিসেবে সম্মান কর । তাদের গাায়ের রং দেখে নয়। তোমরা খুব ভালো , মানুষকে মানুষ হিসেবে ভালোবাসো , যদি কোন দিন সম্ভব হয়, হয়ত তোমাদের দেশ দেখতে যাবো"। সাহারার প্রখর রৌদ্রে পিপাসায় যখন ছাতি ফেটে যাবার জোগাড় , তখন পাশের হাঁটতে থাকা সংগীর দিকে তাকিয়ে যেন কোথায় কিছুক্ষনের জন্য হারিয়ে গেলাম। দূর্গম সাহারার এক প্রত্যন্ত অন্চলে যাযাবর তোয়ারেগ কিছু গোত্রের সাথে যোগাযোগ করে তথ্য সংগ্রহ ছিল আমার আজকের মিশনের মূল উদ্দেশ্য। আমাকে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সহায়তা দেয়ার জন্য সেনেগালের একটি স্বশস্ত্র টহল দলের অধিনায়ক সংগী লেফটেনেন্ট জারা তখন ও মাথা কিছুটা নিচু করে আমার পাশে পাশে হেঁটে যাচ্ছে আর আপনমনে তখনও বলে যাচ্ছে " আচ্ছা শুনেছি তোমাদের দেশ নাকি অনেক সবুজ আর অসংখ্য নদীতে ভরা। অনেক পানি সেখানে, অথচ দেখো এখানে কোন পানি নেই" বলেই ফিক করে হেসে দিয়ে আবার পরক্ষনেই নিজেকে কিছুটা সামলে নিলো জারা। কিন্ত সেই কয়েক মূহূর্তে মধ্যে আমি আবিষ্কার করলাম আমার সংগী সেনেগালের লেফটেনেন্ট জারার বুলেট প্রুফ জ্যাকেটের ঠিক পেছনে এক শিশু হৃদয়ের সারল্যতাকে , দেখতে পেলাম ভারী হেলমেটের নিচে এক শিশুর অনেক কিছুর জানার ব্যাকুলতাকে। বয়স কত হবে জারার? হয়ত খুব বেশী হলে ২০ থেকে ২২ বছর। যৌবনের শুরুতেই ও এখন কয়েক কেজি ওজনের বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট আর হেলমেট পড়ে এই ধূসর সাহারার দেশ মালিতে শান্তিরক্ষার জন্য লড়াই করছে একজন ব্লু হেলমেটের সদস্য হিসেবে। জীবনের অনেক আনন্দময় দৃশ্যর এখন ওর দেখার বাকী আছে । অথচ সেগুলো না দেখে ও এখন দেখছে জীবনের সবচাইতে ভয়াবহ সব দৃশ্য আর নৃসংশতা । হয়ত মালির এসব হিংস্রতা দেখে দেখে একদিন বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট আর হেলমেটের নীচে উঁকি দেয়া কয়েক মূহূর্তের সেই আমার দেখা শিশু জারার মুখ হারিয়ে যাবে। তার জায়গায় দখল নিবে পোড় খাওয়া বুলেটপ্রুফ হৃদয়ের এক আফ্রিকান যুবক। হয়ত হারিয়ে যাবে সেই শিশুর সারল্যতা অথবা কিশোর চোখের ব্যাকুলতা।



চিত্র: পাহাড়ের খাঁজে পাহাড়ের গা কেটে ডোগোনদের ঐতিহ্যময় বাসভবন।



চিত্র: ডোগোনদের সংগ্রহে আছে বিচিত্র ধরনের অসংখ্য মুখোশ।

জারার সাথে অনেকক্ষন গল্প হল আফ্রিকার কদার্য গোত্র সহিংসতা নিয়ে যদিও মালির মত সেনেগালে সেরকম পরিবেশ নেই। কিন্ত একজন আফ্রিকান হওয়ায় জারার তরুন মনে অনেক কষ্ট এই গোত্রে গোত্রে ভয়াবহ সংঘর্ষ আর হিংস্রতা নিয়ে । মালির মোট জনসংখ্যা বাংলাদেশর তুলনায় অনেক কম, ১ কোটি ৮৫ লক্ষের একটু বেশি, অথচ এই জনসংখ্যা বিভক্ত অসংখ্য গোত্র এবং উপগোত্রে। অসংখ‌্য গোত্রের মধ্যে তামাশেক, বামবারা, আরব, তোয়ারেগ সোংগয় ডোগোন এবং ফুলানী গোত্রগুলোর মধ্যে সারা বছর ছোটখাট সংঘাত লেগেই থাকে। তবে মাঝে মাঝে তা রূপ নেয় মারাত্মক আকারে। তবে এই গোত্রগুলোর মাঝে ভাষা, সামাজিক রীতিনীতি ও সাংষ্কৃতিক ভিন্নতা থাকলেও মজার বিষয় হচ্ছে কিছু গোত্র বাদে জনসংখ্যার শতকরা ৯৯ জন হচ্ছে মুসলিম। কিন্ত মালির এই বৈচিত্র্যময় ভিন্নতা ধর্মীয় পরিচয়ের মাধ্যমে একীভূত এক জাতিতে পরিনত হতে কখনোই পারেনি । বরং জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের তীব্র অহংকার, রাজনৈতিক প্রভাব, জলবায়ুজনিত কারন এবং প্রাকৃতিক সম্পদের অপ্রতুলতা সব মিলিয়ে এই গোত্রগুলো একে অপরের সাথে সেই প্রাচীনকাল থেকে জড়িয়ে আছে সংঘাতে। অন্যদিকে ঔপেনিবেশক শক্তির জন্য তাদের এই সংঘাত বয়ে এনেছে আশীর্বাদ স্বরুপ। ফলে মানসা মুসার মালি সাম্রাজ্য যখন ভেংগে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে এবং যখন ফরাসীরা সেনেগাল হয়ে পশ্চিম মালি হয়ে একের পর এক বিভক্ত রাজ্যগুলোকে সীমিত শক্তি দিয়ে জয় করছিলো, তখন পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলো তাদের শত্রুগোত্রের পতন দেখে তৃপ্তির ঢেকুঁর তুলছিল । কিন্ত তারা যদি শত্রুতা ভুলে এক হয়ে এই ফরাসী ঔপেনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে একজোট হয়ে রুখে দাড়াত তাহলে আজকের মালির ইতিহাস হয়ত ভিন্নভাবে লেখা হত। ডাইভারসিটি বা বৈচিত্র্য যেমন হতে পারে একটি দেশের জন্য শক্তি তেমনি অপরদিকে এই বৈচিত্র্য হতে পারে অভিশাপ। মালির ক্ষেত্রে এই অসংখ্য গোত্রবৈচিত্র্য বয়ে এনেছে শুধুই অভিশাপ। এমনকি গত ২০১৯ এর ২৩ শে মার্চ মধ্য মালিতে এরকমই এক ঘটনা ঘটেছে যেখানে ধারনা করা হচ্ছে যে ডোগোন গোত্রের মিলিশিয়ারা ফুলানী গোত্রের দুটি গ্রামে প্রায় ১৩০ এর বেশী নিরীহ গ্রামবাসীদের নির্বিচারে হত্যা করেছে পূর্ব শত্রুতার জের ধরে।


চিত্র: প্রাচীন মালির বানিজ্যপথ ।

প্রাচীনকালে সাব সাহারান অন্চলের বানিজ্যরুট ছিলো মূলত উত্তর মালি কেন্দ্রিক বিশেষ করে সাহারার একমাত্র প্রানশক্তি নাইজার নদীর নাব্যতাকে কেন্দ্র করে । গাও, তিম্বাকতু এবং সেগুই এর মত যে শহর অথবা জনপদগুলো মূলত মধ্য এবং উত্তর মালির নাইজার নদীর ধারে গড়ে উঠেছিলো , সেখানে দিয়েই বানিজ্য এবং লেনদেন চলত। মালি সম্রাট মানসা মুসার যুগ থেকে উত্তর মালির উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বিকশিত হয়েছিল, বিশেষ করে তিম্বাকতুর লবণ এবং সোনার জন্য বিখ্যাত ছিল এবং পরবর্তীতে এটি ইসলামী জ্ঞান অর্জনের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। এবং গাও সেই সময়ে একইভাবে একটি বিখ্যাত বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে, এভাবেই বানিজ্যর প্রানচান্চল্য কে ঘিরে দক্ষিন মালির তুলনায় উত্তর মালি হয়ে উঠে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন । কিন্তু পনের শতকের মরোক্কানদের আক্রমণের পর মালির ভু-রাজনৈতিক ক্ষমতা উত্তর থেকে দক্ষিণে হাতবদল হয়।



চিত্র: প্রাচীন মালির সময় থেকে আজও সেই তিম্বাকতু শহরে, উত্তর আফ্রিকার সাহারা মরুভুমি থেকে উঠের পিঠে করে বয়ে আনা হয় বিশাল লবনের চাকগুলো কেনাবেচার উদ্দেশ্যে ।

কিন্ত সময়ে সাথে সাথে একদিকে যেমন নাইজার নদী হারায় তার নাব‌্যতা , অন্যদিকে আঠার শতকের দিকে ফরাসীদের আগমন ঘটে মালির পশ্চিমে এবং ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসনের সময় শাসনযন্ত্রের হাতবদল হয় উত্তর মালি থেকে দক্ষিন মালির দিকে এবং দক্ষিণ মালি রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। সময়ের সাথে সাথে ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসন অবসানের মধ্যে দিয়ে মালির স্বাধীনতা পরবর্তী বামবারা গোত্রভিত্তিক একটি ক্ষমতাশালী গ্রুপ দক্ষিণ মালি কে কেন্দ্র করে গঠিত হয়। এবং এই বামবারার ক্ষমতাশালী গ্রুপ মালির উত্তর অংশকে এবং একইসাথে সেখানে বসবাসরত তোয়ারেগ সহ অন্যান্য গোত্রসমূকে প্রান্তিককরণ শুরু করে। এই প্রান্তিককরণ প্রক্রিয়াটি দক্ষিণ ও উত্তর মালি মধ্যে অবিশ্বাস আর হানাহানি বৃদ্ধি করে। অপরদিকে, দুর্নীতি ও একের পর এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মালির এই ক্ষমতাশালী দলটি তাদের সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে একইসাথে মালির শাসনক্ষমতাকে নিজেদের হাতে কুক্ষিগত করে রাখে। এভাবে বামবারা ক্ষমতাশালী দলটি তাদের জাতিগত আধিপত্য এবং রাষ্ট্র ক্ষমতার একচ্ছত্র আধিপত্যর মাধ্যমে উত্তর মালির জনগনকে তাদের মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত করে। এবং পরবর্তীতে এই উত্তর মালির বৃহত্তম গোত্র তোয়ারেগ জাতি এই প্রান্তিকীকরনের প্রতিবাদে একপর্যায়ে মালি সরকারের বিরুদ্ধে একের পর এক বিদ্রোহ করতে থাকে কিন্ত এই সমস্ত বিদ্রোহ অত্যন্ত নিষ্ঠুরতা সঙ্গে নিয়ন্ত্রন করা হয়। এবং এই বিদ্রোহ দমনের ধারাবাহিকতায় যখন এক পর্যায়ে ২০১৩ সালে মালির ক্ষমতাসীন দল কোণঠাসা হয়ে পড়ে , তখন ফ্রান্স তার তাবেদারী সরকারকে রক্ষার জন্য রক্ষাকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় । এবং নির্বিচারে বিদ্রোহীদের দমন করতে গিয়ে অনেক নিরীহ মানুষদের তারা হত্যা করে বিনা বিচারে। অথচ এই গণহত্যার বিষয়টি আজও চাপা পড়ে আছে সাহারার মরুভূমির বালুরাশির নিচে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.