নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইতিহাসের পাঠশালায়

আসিফ আযহার

শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়।

আসিফ আযহার › বিস্তারিত পোস্টঃ

ইতিহাসের পাঠশালায়: তৃতীয় অধ্যায়: হিব্রুভাষী দেশে দেশে

১৭ ই জুলাই, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:০৪



ইতিহাসের প্রসঙ্গ আসলেই আর্যভাষীদের মতই আরেকটি ভাষা ভাষীরা আমাদের দৃষ্টি কাঁড়ে। এরা হল হিব্রুভাষী । হিব্রুভাষী ইহুদীদের ইতিহাসটি এতই পুরনো যে এর সাথে অনিবার্যভাবে প্রাচীন সভ্যতাগুলোর ইতিহাসও জড়িয়ে গিয়েছে। ইহুদী জীবনধারাকে সরাসরিভাবে স্পর্শ করেছে প্রাচীন সভ্যতার প্রধান ধারাগুলো। সেজন্য ইহুদী ইতিহাস যেন আসলে প্রাচীন মিসরীয়, মেসোপটেমীয়, মেসিডোনীয়, রোমান ও মুসলিম খিলাফতের ইতিহাসেরই অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়। ইহুদী ইতিহাসের পথ ধরে হাটলে সামনে এসে দাঁড়ায় হারিয়ে যাওয়া কত সভ্যতার ইতিহাস। মনে পড়ে যায় হারিয়ে দিনের কত গল্প কত কথা কত কাহিনী। এই ইতিহাসের সাথে এসে পড়ে হারিয়ে যাওয়া পৃথিবীর গল্প।

গল্পের শুরুটা হয় ইহুদীদের আদি পিতা ইব্রাহিমকে দিয়ে। গল্পের গোড়ায় এসে যায় প্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতার কথা। কারণ ইব্রাহিম বসবাস করতেন এখানেই, উত্তর-পশ্চিম মেসোপটেমিয়ায়। সময়কালটা ছিল ২১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি। সে সময় সুমেরীয় সভ্যতার চলছে পড়ন্ত দশা। ইব্রাহিম থাকতেন সুমেরীয় শহর উর শহরে। তাঁর পূর্ব পুরুষদের আদি বাস ছিল আরব মরুভূমিতে। এখানে যে বিষয়টি গুরুত্বের দাবী রাখে তা হল, ইহুদী ইতিহাসের গোড়াটা ফিলিস্তিনে নয় বরং সুমেরীয় সভ্যতায় অর্থাৎ বর্তমান ইরাক অঞ্চলে খুজে পাওয়া যায়। উর শহরটির অবস্থান ছিল বর্তমান ইরাকে। এখান থেকেই এক সময় ইব্রাহিম তাঁর বংশের লোকজন নিয়ে চলে যান ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী ফিলিস্তিন অঞ্চলে। ফিলিস্তিন ভূখন্ডের সাথে ইহুদী ইতিহাসের যোগসূত্র স্থাপিত হয় এখান থেকেই। ইব্রাহিমের নাতি ইয়াকুবের নেতৃত্বে তারা সেখানকার কেনানে বসতি স্থাপন করে। ইয়াকুবের আরেক নাম ইসরাইল। এ নাম থেকেই ইহুদীদের পরিচয় হয় ইসরাইলী বলে।

ইয়াকুবের পুত্র ইউসুফকে তাঁর সৎ ভাইরা ফেলে দেয় পানির কূপে। সেখান থেকে একজন মিশরীয় ব্যবসায়ী তাঁকে উদ্ধার করে ফারাওয়ের রাজ কর্মচারীর কাছে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়। এই বালক দাসই একদিন হয়ে যান ফারাওয়ের মন্ত্রী। ভাগ্যের কী পরিহাস ! একদিন এই ইউসুফই তাঁর হিংসুক ভাইদের প্রাণ বাঁচিয়ে আশ্রয় দিলেন মিশরে।



কেনান দেশে তখন প্রচন্ড দূর্ভিক্ষ চলছে। অন্যান্য কেনানীয়দের সাথে ইউসুফের ভাইরাও খাদ্য ভিক্ষা করার জন্য গেল মিশরে ইউসুফের কাছে। ভাইয়ে ভাইয়ে পরিচয় হল। কিন্তু ইউসুফ প্রতিশোধ নিলেন না। বরং তাদের জন্য খাদ্যশস্যের ব্যবস্থা করলেন। এমনকি তাদেরকে তিনি অনুর্বর কেনান থেকে নিয়ে আসলেন মিসরে। গোশেন নামে মিসরের একটি উর্বর এলাকা দান করলেন তাদেরকে যেখানে প্রচুর পরিমাণে খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়। এ ঘটনার তাৎপর্য দুটো। প্রথমত প্রতিশোধ না নেয়ার বিষয়টি। সেই যুগে চাষযোগ্য ভূমির তুলনায় শ্রম ছিল অপর্যাপ্ত। তাই চাষবাসের জন্য শ্রম দানে সমর্থ মানুষকে হত্যা না করে কাজে লাগানো ছিল কল্যাণকর। কারণ চাষ করে যে ফসল অর্জিত হবে তার একটি অংশ কর হিসেবে রাজকোষকে করবে সমৃদ্ধ। বহুদিন পরে এরকমই একটি উদ্যোগ নিতে দেখা যায় মুসলিম বীর সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে। তিনি জঘণ্য অপরাধী ৬০,০০০ ক্রুসেডারকে মৃত্যুদন্ড না দিয়ে চাষের উপযোগী জমি প্রদান করেছিলেন। যা ছিল ইতিহাসের একটি অসাধারণ বিচক্ষণ দৃষ্টান্ত।

দ্বিতীয় তাৎপর্যটি হলো ইসরাইলীদের ফিলিস্তিনের কেনান অঞ্চল ছেড়ে মিসরে পুনর্বাসিত হওয়ার ঘটনা। ইরাক অঞ্চল ছেড়ে ফিলিস্তিনে এসে আবার মিসরে চলে যাওয়া থেকে প্রমাণ পায় যে ফিলিস্তিনের ওপর বর্তমানের ইহুদী যায়নবাদীদের ঐশ্বরিক দাবিটি ভিত্তিহীন। যায়নবাদ দাবি করে যে, যিহোবার সাথে ইহুদীদের একটি চুক্তি আছে। আর সেই চুক্তি অনুযায়ী ফিলিস্তিন ইহুদীদের জন্য যিহোবার প্রতিশ্রুত ভূমি (promised land) এবং এর বিরুদ্ধে কোন ইহলৌকিক যুক্তি খাটবে না বা অন্য কোন ধর্মের যুক্তিও খাটবেনা। মজার ব্যাপার হলো মিসরে ইউসুফের বদৌলতে উর্বর জমি পেয়ে ইসরাইলীরা তাদের এই প্রতিশ্র“তি ভূমি ছেড়ে সেখানেই চলে যেতে শুরু করল। ১৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে দূর্ভিক্ষ পীড়িত ফিলিস্তিন ছেড়ে প্রায় সকল ইহুদীই গিয়ে ভিড় করল মিসরে। সেখানে তারা ক্রমে ফারাওদের দাসে পরিণত হল।

ইহুদীরা প্রায় চারশ বছর মিসরে থাকল। কালক্রমে সেখানে অত্যাচারী শাসকের আবির্ভাব ঘটল। ১৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মিসরে রামেসেস নামে এক রাজা এল। সেই ফারাও ইহুদীদের হত্যা করার আদেশ দিল। অবশেষে ১৩০০-১২৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে ইহুদীদের নতুন নেতা মুসা তাদেরকে মুক্ত করে লোহিত সাগর পেরিয়ে নিয়ে আসেন এশিয়া ও আফ্রিকার সংযোগস্থল সিনাই উপদ্বীপে। মিসরের ফারাওদের হাত থেকে পালিয়ে এসে ইহুদীরা কিন্তু কেনানে অর্থাৎ তাদের বর্তমানের ‘প্রতিশ্র“ত ভূমি’-তে ফিরে গেলনা। তারা থেকে গেল এশিয়া ও আফ্রিকার সংযোগস্থল সিনাই উপদ্বীপেই। সেখানে তারা থাকল প্রায় ২৫০ বছর। ইহুদী কিংবদন্তী হল মুসা যিহোবার সাথে দেখা করার জন্য সিনাই পাহাড়ে আরোহন করেন। সেখানে ৪০ দিন অবস্থান করে যিহোবার কাছ থেকে ১০টি নির্দেশ নিয়ে ফিরে আসেন। মুসার মৃত্যুর পর ইহুদীরা যাযাবর হয়ে ঘুরে বেড়ায়।

ইহুদীদের কোন রাজা ছিলনা। ধর্মযাজকরাই তাদের শাসন করত। এদেরকে বলা হত জজ। এক পর্যায়ে ইহুদীরা তাদের একজন রাজা ঠিক করল। তাঁর নাম সউল। তিনি ইহুদীদের প্রথম রাজা। কিন্তু তাঁর কোন স্থায়ী আবাস ছিল না। তিনি তাঁবুতে থাকতেন। খুব সাদাসিদে জীবন যাপন করতেন। সউলের পর রাজা হলেন ডেভিড। যাকে আমরা হযরত দাউদ বলে চিনি। ইহুদী কিংবদন্তীতে ডেভিডের অনেক বীরত্বগাথা আছে। গোলিয়াথ নামের এক দৈত্যকে তিনি বধ করেন। রাজা সউলের মেয়ে এতে খুশি হয়ে তাকে বিয়ে করেন। এভাবে তিনি ইহুদীদের রাজায় পরিণত হন। এই রাজা দাউদ ইহুদীদের জন্য একটি স্থায়ী আবাসভূমির কথা ভাবলেন। ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে তিনি ইহুদীদের নিয়ে অগ্রসর হলেন জেরুজালেমের দিকে। যিবুসাইটসদের হাত থেকে দখল করলেন জেরুজালেম। দাউদের জেরুজালেম দখলের সময়ে মেসোপটেমিয়ায় চলছে অন্ধকার যুগ। সুমেরীয় সভ্যতার পরবর্তী সময়কার প্রাচীন ব্যবলনীয় সভ্যতা হারিয়ে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ছিল কিছু ছোট ছোট রাজ্যের অস্তিত্ব। এদের কেউ একক আধিপত্য বিস্তার করতে পারেনি। কোন শক্তিশালী সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল না। ফিলিস্তিন অঞ্চল জুড়ে ছিল অনেকগুলো জাতির বসবাস। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-



কেনানীয়: তাওরাতে বর্ণিত নবী নোয়ার পুত্র ছিল হাম। হামের পুত্র কেনান। কেনানের বংশধররাই হলো কেনানীয়। ইব্রাহিম তাদের দেশে আসার বহু আগেই তারা সে অঞ্চলে বসবাস শুর” করে। তাদের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে পড়েছিল সমগ্র ফিলিস্তিনে (তাওরাত: ১০: ১৫-২০)।

সিডনীয়: কেনানের বড় ছেলে সিডন। ফিনিশীয় বাণিজ্য কেন্দ্র সিডন শহর ছিল তার বংশধরদের।

যিবুসীয় ও আমোরীয়: এরা কেনানের বংশের শাখা। ইংরেজিতে এদের বলা হয় যিবুসাইট ও আমোরাইট। ব্যাবিলনীয়রা ছিল আমোরীয় জাতির লোক। যিবুসীয়দের কাছ থেকে দাউদ জেরুজালেম দখল করেছিলেন। কেনানীয়দের অন্যান্য শাখা হল- গির্গাশীয়, হিব্বীয়, অর্কীয়, সীনীয়, অর্বদীয়, সমারীয় এবং হমাতীয়রা। সিডন থেকে গাজার দক্ষিণ এলাকা পর্যন্ত ছিল এদের দেশ।

ফিলিস্তিনী: হামের আরেক পুত্র মিসরের বংশধর হল লিডীয়, অলমীয়, লহাবীয়, নপ্তুহীয়, পথ্রোষীয়, কসলূহীয় ও ক্রীট দ্বীপের অধিবাসী ক্রীটীয়রা। এদের মধ্যে কসলূহীয়রা ছিল ফিলিস্তিনীদের পূর্বপুরুষ (তাওরাত: পয়দাদেশ: ১০: ১৩-১৪)।

বিভিন্ন ইবরানী জাতি: নোয়ার বড় ছেলে সাম। সামের বংশেই জন্ম ইব্রাহিমের। ইব্রাহিমের বংশধরদের বলা হয় ইবরানী। ইবরানীদের মধ্যে আছে ইব্রাহিম পুত্র ইসমাঈলের বংশধর আরবরা। অপর পুত্র ইসহাকের পুত্ররা হল ইয়াকুব (ইসরাঈল) ও ইস। ইস এর বংশধররা হল ইদোমীয় (পয়দাদেশ: ২৫:৩০)। ইসরাইলের বংশধররাই হল ইহুদীরা। ইসরাইলের ১২ সন্তানের ঔরশজাত ১২টি শাখায় তারা বিভক্ত ছিল। দাউদ তাদের সবার নেতা। ইসরাইলের ছেলে এহুদার বংশধর ছিলেন দাউদ। আরব ইদোমীয়রা ফিলিস্তিনের বাইরে বাস করত।

মোয়াবীয় ও আমোনীয়: ইব্রাহিমের ভাই হারন। হারনের ছেলে লুত। লুতের দুই পুত্র মেয়াব ও বিন-আমি। এদের বংশধররা হল মেয়াবীয় ও আমোনীয় (পয়দাদেশ: ১৯: ৩৭-৩৮)। এরা ফিলিস্তিন এলাকায় সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে ইহুদীদের শক্তিশালী প্রতিদ্বন্ধীতে পরিণত হয়। তাই তাওরাত তথা ওল্ড টেস্টামেন্ট রচনার সময় ইহুদীরা এদের বংশপরিচয়ের গোড়ায় কুৎসিত কলংক ও মিথ্যাচার আরোপ করেছে। তাওরাতের ঊনবিংশ অধ্যায়ের ৩১ থেকে ৩৬ তম আয়াত ইহুদি মিথ্যাচারের ফসল।

হিট্টীয়: আর্যদের যে শাখা তুরস্কে ছড়িয়ে পড়েছিল তাদেরকে বলা হয় হিট্টীয়। ইংরেজিতে হিট্টাইট। খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ শতকের পরে এরা আর্যদের অন্য গোষ্ঠীর কাছে পরাজিত হয়ে ফিলিস্তিন ও সিরিয়া অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।

কেনানীয় গোত্রের শাখা যিবুসাইটসদের হাত থেকে জেরুজালেম দখল করে রাজা দাউদ প্রথমবারের মত ইহুদী রাজ্যের একটি ভিত্তি গড়লেন। এটা তাঁর দ্বারা সম্ভব হয়েছিল একমাত্র একারণেই যে তখন আশেপাশে কোন শক্তিশালী সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব ছিলনা। দাউদ তাবুর জীবন ছেড়ে উঠে এলেন অট্টালিকায়। জেরুজালেমকে করলেন প্রাচীর বেষ্টিত। এই প্রাচীরের একটি ক্ষুদ্র অংশ আজও টিকে আছে যা wailling wall বা ‘অশ্রুর প্রাচীর’ নামে পরিচিত। এর নিচে দাঁড়িয়ে ইহুদীরা এখনও অশ্রু বিসর্জন দেয়। এটি ইহুদীদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় পবিত্রতার প্রতীক।

জেরুজালেমে ইহুদীদের অধিকার এটাই প্রথম। এর আগে প্রায় ৮০০ বছর তারা জেরুজালেমের অধিকার ছাড়াই ইহুদী পরিচয়ে কাটিয়েছে। আবার জেরুজালেমে তাদের কর্তৃত্বও খুব বেশী দিন স্থায়ী হয়নি। এক সময় তারা জেরুজালেমের কর্তৃত্ব হারায়। এর পরে পেরিয়ে গেছে হাজার হাজার বছর। তারা আর জেরুজালেমের কর্তৃত্ব ফিরে পায়নি। পাওয়ার কথাও নয়। কারণ সভ্য দুনিয়ার সকল জায়গা চলে যায় বিভিন্ন সাম্রাজ্য বা রাষ্ট্রের অধীনে। আর এসব সাম্রাজ্য গড়ে ওঠেছে বৃহৎ অর্থনৈতিক জীবনকে কেন্দ্র করে। বিশাল আয়তনের ভূখন্ডের অর্থনীতি একটি অভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থার আওতায় কেন্দ্রীভূত হয়ে এক একটি সাম্রাজ্যের আকার ধারণ করে যা তার আর্থ-রাজনৈতিক পরিধিকে আরও ব্যাপকতার দিকে নিয়ে যেতে চায়। এসব সাম্রাজ্যের জাতীয়তার ভিত্তি ইহুদীদের মত নয়। ইহুদীরা একটি সংকীর্ণ ধর্মীয় গন্ডিবদ্ধ জাতীয়তায় আবদ্ধ। এটার ভিত্তিতে স্বাভাবিক রাষ্ট্র বা সাম্রাজ্য গড়ে উঠতে পারেনা। সাম্রাজ্যগুলোর জাতীয়তার ভিত্তি ছিল সুবিশাল এলাকা বা ভূখন্ডের অধিবাসীদের জাতীয়তা। যেমন- পারসীয়, রোমান বা মুসলিম সাম্রাজ্য কোন ক্ষুদ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীকেন্দ্রিক ছিলনা। বরং বিশাল অঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠীর জাতীয় পরিচয়ই এসব সাম্রাজ্যের জাতীয়তার ভিত্তি নির্ধারণ করেছে।

ইহুদীরা সভ্যতার দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসে স্বতন্ত্র রাষ্ট্রীয় পরিচয়ে অস্তিত্বশীল হয়ে উঠতে পারেনি একারণেই যে একটি সংকীর্ণ ধর্মীয় গোষ্ঠীতন্ত্রের ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র রচনা করা চলেনা। এজন্য প্রায় তিন হাজার বছর ধরে ইহুদীরা শুধু তাদের ধর্মীয় সংকীর্ণতাকেই আঁকড়ে থেকেছে। কখনও রাষ্ট্রীয় ভিত্তি অর্জন করতে পারেনি। তিন হাজার বছর পরে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সহায়তায় যে ইহুদী রাষ্ট্রটি জন্ম নিয়েছে তা রাষ্ট্র গঠনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হয়নি। ইহুদীরা ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে মিশে গিয়েছিল। যেভাবে অনেক জাতির লোকেরাই বিভিন্ন রাষ্ট্রের সাথে মিশে গিয়েছে। সেই ইহুদীদেরকে বিভিন্ন দেশ থেকে টেনে এনে ইসরাইল রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে। মূলত জার্মানির ইহুদী নাগরিকরাই ইসরাইলের জনসংখ্যার বড় অংশ। পৃথিবীর বহু জাতির মানুষেরই আলাদা রাষ্ট্রীয় ভিত্তি নেই এবং তার কোন প্রয়োজনও নেই। কারণ জাতি মানেই যে রাষ্ট্রীয়ভাবে ভিত্তিশীল হতে হবে এমন কোন কথা নেই।

তাই স্বাভাবিকভাবেই ইহুদীরাও সভ্যতার দীর্ঘ ইতিহাস জুড়ে স্বাধীন রাষ্ট্রবিহীন অবস্থায়ই কাটিয়েছে। প্রতিষ্ঠিত বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর অধীনতাকেই তাদের মেনে নিতে হয়েছে। যে ফিলিস্তিনে তারা বসতি গড়ে সেটাও এমন একটি জায়গা যে বিভিন্ন সাম্রাজ্যের অধীনে এর চলে যাওয়াই স্বাভাবিক। কারণ এটা তিনটি মহাদেশের সংযোগস্থল এবং মহাদেশগুলোর মধ্যে সামুদ্রিক যোগাযোগের কেন্দ্র। বিভিন্ন প্রাচীন সাম্রাজ্যের মধ্যবর্তী উপকুলীয় এই অঞ্চলে ইহুদীদের স্বাধীন রাজ্যের একমাত্র দৃষ্টান্ত হল দাউদের জেরুজালেম দখলের পরবর্তী সময়টুকু। জেরুজালেম দখলের পর দাউদ রাজ্য সীমানার বিস্তার ঘটালেন। ফিলিস্তিনের প্রায় সবটাই চলে আসে তার অধীনে। এ সময়ে অনেক ছোট ছোট জাতি ও অঞ্চল স্বাধীন ছিল।

দাউদ ফিলিস্তিন দখল করে ইহুদী রাজ্য স্থাপন করতে পেরেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে সভ্যতার বিকাশের স্বাভাবিক ধারাতেই বড় বড় সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে এবং ইহুদী রাজ্য হারিয়ে যায় সেগুলোর মাঝে। এমনকি অন্য সব ছোট রাজ্যগুলোও। ৯৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দাউদের মৃত্যুর পরে ইহুদীদের রাজা হন তাঁর পুত্র সলোমন । এই সলোমন ছিলেন একাধারে ইহুদীদের রাজা ও ধর্মীয়ভাবে শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি। এই সলোমনই জেরুজালেমে নির্মাণ করেন ইহুদীদের অতি পবিত্র ধর্মগৃহ। সলোমনের সময়কালটাই ইহুদী ইতিহাসের স্বর্ণযুগ। এ সময়েই তারা সমৃদ্ধির শীর্ষে পৌছে গিয়েছিল। নিজেদের রাজ্য, নিজেদের রাজধানী এবং নিজেদের ধর্মীয় উপাসনালয় নিয়ে তারা সুখী জীবন কাটিয়েছে।সলোমনের মৃত্যুর পর ইহুদী জাতি দুইভাগে ভাগ হয়ে গেল। একটি ইসরাইল রাজ্য অপরটি জুডা রাজ্য। ইসরাইলের রাজধানী হয় সামারিয়া আর জুডার রাজধানী হয় জেরুজালেম।

মেসোপটেমিয়ায় সে সময়ে অন্ধকার যুগ কাটিয়ে ধীরে ধীরে জেগে উঠছে উত্তরের অ্যাসিরিয়া। ক্রমে অ্যাসিরিয়রা সমগ্র মেসোপটেমিয়া অঞ্চলের অধিপতি হয়ে ওঠে। আশপাশের দেশগুলোও তাদের আগ্রাসনের শিকার হতে থাকে। ইহুদীরাও বাদ গেলনা। অ্যাসিরিয়রা এক সময় জুড়ার উত্তরের ইসরাইল রাজ্য কেড়ে নিল । ৭২২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে অ্যাসিরিয়রা ইসরাঈলের রাজধানী সামারিয়া দখল করে ইহুদীদের দশটি গোত্রকে বন্দী করে নিয়ে যায় এবং মানব জাতির ইতিহাস থেকে ইসরাইল নামক এই রাষ্ট্রটি হারিয়ে যায় চিরতরে। থেকে যায় জুডা। জুডা থেকেই ইহুদীদের ধর্মের নাম হয় ‘জুডাইজম’ বা ‘জুডাবাদ’। দাউদ ও সলোমনের সময় থেকে শুরু করে জুডা রাজ্য যতদিন স্বাধীন ছিল সেটাই ছিল ইহুদী জাতির চার হাজার বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে সোনালী সময়। এই সময়েই তারা উপভোগ করতে পেরেছিল নিজেদের রাজ্যে স্বাধীন জীবন। কিন্তু এক সময়ে তাদের এই স্বাধীনতা মধ্যপ্রাচ্যে নতুনভাবে জেগে ওঠা শক্তিশালী ক্যালদীয় সাম্রাজ্যের কাছে শেকলবন্দী হয়ে যায়। এর শুরুটা করেন ক্যালদীয় সাম্রাজ্যের অধিপতি সম্রাট নেবুচাদনেজার। তাঁর রাজত্বকাল ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৬০৪ থেকে ৫৬১ অব্দ পর্যন্ত। অ্যাসিরিয়দের পতনের পরে তিনি সমগ্র মেসোপটেমিয়া অঞ্চলকে তাঁর পদানত করেন। ইতিহাসে তাঁর সকল বিজয় অভিযান অন্য আরও দশজন সাম্রাজ্যের অধিপতির মতই বৈচিত্রহীন। কিন্তু একটি নিষ্ঠুর অভিযান তাকে ইতিহাসে তাৎপর্যমন্ডিত করে তুলেছে। এটা হল ইহুদীদের জুডা রাজ্য ও জেরুজালেম ধ্বংসের অভিযান।

খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৬ সাল! ইহুদী ইতিহাসের এক করুণ অধ্যায় সূচিত হল এ বছর। জুডার হিব্র“ রাজ্যে নেমে এল ধ্বংস আর প্রলয়ের বিভীষিকা। সম্রাট নেবুচাদনেজারের সৈন্যরা ধ্বংস করে দিল ইহুদী রাজ্য। ধ্বংস হল জেরুজালেম। দাউদের প্রাচীর আর সলোমনের ধর্মগৃহ গুড়িয়ে দেয়া হল। প্রায় ৪০/৪৫ হাজার ইহুদী নর-নারীকে শেকলবন্দি করে নিয়ে যাওয়া হল ব্যাবিলনে। সেখানে তারা ভূমিদাসে পরিণত হল। এটাই ইহুদীদের শেকলপরা ইতিহাস। ইতিহাসে এই বন্দিদশার নাম Babylonian Captivity বা ‘ব্যাবিলনীয় বন্দিদশা’।

জুডার ইহুদীরা নানাভাবে নেবুচাদনেজারের শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে যাচ্ছিল। মিসরীয়দের প্ররোচনায় এক পর্যায়ে তারা কর দেওয়া বন্ধ করে দেয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে নেবুচাদনেজার জেরুজালেম ধ্বংসের জন্য সৈন্য পাঠান। ইহুদীদের অবাধ্যতাকে চিরতরে নির্মূল করার উদ্দেশ্যে হাজার হাজার ইহুদীকে বন্দী করে নিয়ে আসলেন ব্যাবিলনে। ইহুদীদের এই করুণ ইতিহাসকে নিয়ে ‘অভিশপ্ত নগরী’ নামে এক অসাধারণ উপন্যাস রচনা করেছেন প্রয়াত লেখক এবং সাংবাদিক সত্যেন সেন। ব্যাবিলনে তাদের বন্দীজীবন এবং সেখান থেকে তাদের জেরুজালেমে প্রত্যাবর্তনের ঘটনা নিয়ে তিনি আরেকটি অসাধারণ উপন্যাস রচনা করেন ‘পাপের সন্তান’ নামে।

৫৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পারস্য সম্রাট সাইরাস দখল করে নিলেন ক্যালদিয়ার রাজধানী ব্যাবিলন। এতদিন পরে ব্যাবিলনের বন্দি ইহুদীরা কিছুটা স্বস্তি ফিরে পেল। সম্রাট সাইরাস কিছুসংখ্যক ইহুদীকে জেরুজালেমে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। ৪৮ বছর পর ক্যালদীয় নিপীড়নে জীবনী শক্তিহীন ইহুদীরা জেরুজালেমে ফিরে এসে একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মযজ্ঞের সূচনা করল। সেটা হল মুসার বাণী লিপিবদ্ধ করার কাজে হাত দেয়া। আর এর মধ্য দিয়েই ইহুদী ইতিহাসে সূচিত হল এক নতুন অধ্যায়। পারস্য সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতায় ফুলে ফেপে ওঠা ইহুদি যাজকতন্ত্র তখন চেপে বসতে শুরু করে ইহুদীদের ঘাড়ে। ঢালাওভাবে মিথ্যা যুক্ত করে রচিত হয় ওল্ড টেস্টামেন্ট। একসময় ইহুদীদের ওপর নিরংকুশ আধিপত্য বিস্তারের জন্য যাজকতন্ত্র ওল্ড টেস্টামেন্টে যুক্ত করে জাতিত্বের বিশুদ্ধবাদী অনুশাসন। আধিপত্য ও ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার জন্য ইবরানী ও ইসরাঈলী নবীদের শিক্ষাকে পায়ে মাড়িয়ে ইহুদীদের ঘাড়ে চাপানো হয় বিশুদ্ধবাদী অনুশাসন।

পারস্য সম্রাট সাইরাসের সময় থেকে আর্তাজারেক্সেসের সময় পর্যন্ত ব্যাবিলনের বন্দীদশা থেকে জেরুজালেম ও এহুদায় ফিরে এসেছিল ৪২৩৬০ জন ইহুদি (ওল্ড টেস্টামেন্ট, নবীদের কিতাব, ইষ্রা ২:৬৪)। এ সময়েই ইহুদিদের ধর্ম বিশ্বাসে ভর করে গোঁড়ামী ও রক্ষণশীলতা। মিসর ও মেসোপটেমীয় সাম্রাজ্যগুলোর হাতে ইহুদীরা বারবার পর্যদুস্ত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও আর্য উত্তরসূরি পারসীয়রা তাদেরকে দেয় মুক্তি ও পৃষ্ঠপোষকতা। পারস্য সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতাই ইসরাইলী ধর্মীয় ধারায় জন্ম দেয় যাজকতন্দ্রের যা ভিত্তি স্থাপন করেছিল আজকের যায়নবাদের।

এবার আমরা যাব সে ইতিহাসের কথায়।

লেখক: আসিফ আযহার
শিক্ষার্থি, ইংরেজি বিভাগ, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।

মন্তব্য ৭ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৭) মন্তব্য লিখুন

১| ১৭ ই জুলাই, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৪৫

চাঁদগাজী বলেছেন:


আপনি অনেক কিছু দেখেছেন!

২| ১৮ ই জুলাই, ২০১৫ রাত ১২:৪৭

শার্লক_ বলেছেন: যিহোবা মানে কি?

৩| ১৮ ই জুলাই, ২০১৫ দুপুর ২:১৬

চুক্কা বাঙ্গী বলেছেন: দারুন! জানতে ভাল লাগে।

৪| ১৯ শে জুলাই, ২০১৫ রাত ৮:১৮

ইমরান আশফাক বলেছেন: মারাত্নক পোস্ট।

৫| ২১ শে জুলাই, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:০৩

শাশ্বত স্বপন বলেছেন: লেখাটার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। অাপনি বেশ যৌক্তিক। তাই একটু ভাবুন, আপনার লেখা--ইয়াকুবের পুত্র ইউসুফকে তাঁর সৎ ভাইরা ফেলে দেয় পানির কূপে। সেখান থেকে একজন মিশরীয় ব্যবসায়ী তাঁকে উদ্ধার করে ফারাওয়ের রাজ কর্মচারীর কাছে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়।
পরের লেখা--কেনানীয়দের সাথে ইউসুফের ভাইরাও খাদ্য ভিক্ষা করার জন্য গেল মিশরে ইউসুফের কাছে। ভাইয়ে ভাইয়ে পরিচয় হল। কিন্তু ইউসুফ প্রতিশোধ নিলেন না। বরং তাদের জন্য খাদ্যশস্যের ব্যবস্থা করলেন। এমনকি তাদেরকে তিনি অনুর্বর কেনান থেকে নিয়ে আসলেন মিসরে।
সৎ ভাইরা কি আসলেই মেরে ফেলতে চেয়েছিল, নাকি আঘাত করেছিল বা ফেলে দিয়ে দড়িও ফেলেছিল। একবার ভাবুন তো ভাই, আপনি আমার সৎভাই, একদিন মেরে ফেলেছিলেন, তাই অাপনার জানতেন, আজ আমি মিসরের মন্ত্রি বলে কিভাবে আমার সামনে হাজির হবেন, অভাব মিটাতে মিশর ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না? কুপে ফেলে দিয়েছিল , এই কাহিনী সবাই জানে, কিন্তু অাপনি জ্ঞানী মানুষ, আপনি যদি মুসার জন্য বলেন, (পালিয়ে যায়নি) বরং যিশু খ্রীস্ট দেহ ও আত্না হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিল এবং আবার আসবে।

৬| ২১ শে জুলাই, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:০৫

শাশ্বত স্বপন বলেছেন: সরি, মুসা নয় ঈসা হবে

৭| ০৬ ই মে, ২০১৬ দুপুর ২:৩৯

আততায়ী আলতাইয়ার বলেছেন: কিন্তু যবুর তো দাউদ (আঃ) উপর নাজিল হয়েছিল যা প্রধান চার আসমানী কিতাবের দ্বিতীয় সিরিয়ালে আছে। তাহলে দাউদ (আঃ} সুলাইমান(আঃ) তাওরাতের অনুসারি হবার কথা নয়

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.