নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইতিহাসের পাঠশালায়

আসিফ আযহার

শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়।

আসিফ আযহার › বিস্তারিত পোস্টঃ

ইতিহাসের পাঠশালায়: ৭ম অধ্যায়: ইতিহাসের পথে রোম (১ম অংশ)

২৮ শে জুলাই, ২০১৫ দুপুর ১২:৫৩


ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় চলচ্চিত্র Ben Hur যারা দেখেছেন তাদের নিশ্চয়ই মনে পড়বে জেরুজালেমের রাজপথে রোমান সৈন্যদের কুচকাওয়াজের দৃশ্যের কথা। অত্যাচারি রোমান শাসনের দাপটের কাছে কী অসহায়ভাবে বন্দী ছিল জেরুজালেমের জীবন ! এই বন্দী জীবনে সান্তনা ও আশার বার্তা নিয়ে এসেছিলেন নবী যিসাস। কিন্তু ইতিহাসের নির্মম সত্য হল ইহুদিরা তাকে গ্রহণ করা তো দূরের কথা, উল্টো তাকে প্রাণে মারার চেষ্টায় প্রবৃত্ত হল। এই অপকর্মে নেতৃত্ব দিয়েছে ধর্ম ব্যবসায়ী ইহুদি ধর্ম যাজক ও ফরীশীরা। তাদের উস্কানীতে ইহুদি জনসাধারণ এহুদিয়ার রোমান শাসনকর্তা পিলাতের কাছে যিসাসের মৃত্যুদন্ডের দাবি জানায়। এই দাবির মূখে পিলাত অনিচ্ছাসত্ত্বেও যিসাসকে ক্রশবিদ্ধ করার আদেশ দান করেন। এসব কারণে, খ্রিস্টধর্মের ইতিহাসের সাথে গোঁড়া থেকেই জড়িয়ে গেছে রোমান সামাজ্য। রোমানরাই খ্রিস্টধর্মকে সারা ইউরোপে ছড়িয়ে দেয়। ধর্মীয় ইতিহাস এবং সভ্যতার ইতিহাস-দুক্ষেত্রেই রোমান সাম্রাজ্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।

জেরুজালেম এবং খ্রিস্টধর্মের ইতিহাসের সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে যাওয়ার কারণে রোমান সাম্রাজ্যের প্রাসঙ্গিকতা বারবার ফিরে আসে। খ্রিস্টধর্মের ইতিহাসে রোমান সাম্রাজ্যের কথা প্রথমে আসে ভয়াবহ অত্যাচারীর ভূমিকায়, তার পরে আসে পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকায়। পারস্য সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতা যেভাবে ঈসরাইলী ধর্মে সুবিধাবাদ ও যাজকতন্ত্রের জন্ম দেয়, ঠিক একইভাবে রোমান সম্রাটদের অত্যাচারী ভূমিকা থেকে পৃষ্টপোষকের ভূমিকায় বদলে যাওয়ার ফলে ত্যাগ ও করুণার প্রতিমূর্তি খ্রিস্টধর্মেও জন্ম হয় একটি সুবিধাভোগী শক্তিশালী যাজকতন্ত্রের। রোমান সাম্রাজ্যের আলাদা আলাদা কেন্দ্রিভবনের কারণে খ্রিস্টধর্মেরও আলাদা আলাদা কেন্দ্রিভবন ঘটেছে। একসময় খ্রিস্টধর্মের কেন্দ্র স্থানান্তর হয়েছে রোমে। অথচ জেরুজালেম এ কেন্দ্র হওয়ার কথা। রাষ্ট্রক্ষমতার সাথে জড়িয়ে যাওয়ার কারণে রাজনৈতিক মেরুকরণের সাথে খ্রিষ্টধর্মেও মেরুকরণ ঘটেছে। ফলে ক্ষমতা যে পথ ধরে অগ্রসর হয়েছে, খ্রিষ্টধর্মও সে পথে এগিয়েছে।

ইতিহাসে রোমান সাম্রাজ্যের প্রাসঙ্গিকতার অন্য দিকটি হল আলেকজান্ডারের পরে এবং ইসলামী খিলাফতের আগের সময়ের সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য ছিল রোমান সাম্রাজ্য। রোমানদের সংস্কৃতি ছিল গ্রিক ও মেসিডোনীয় সংস্কৃতি থেকে কিছুটা ভিন্ন। গ্রিকদের তুলনায় রোমানরা ছিল অনেক বেশি অত্যাচারী। রোমান শাসন যেন অত্যাচার ও স্বৈরাচারের প্রতিশব্দ। গ্রিক ও মেসিডোনীয়রা তাদের পশ্চিমের এ দেশটির দিকে কখনও মনযোগ দেয়নি। পশ্চিমের ইতালির এক ফালি ভূখন্ডের চেয়ে তাদেরকে আকর্ষণ করেছিল পূর্বদিকের বিশাল ও সমৃদ্ধ এশীয় সভ্যতা। তাই তিন মহাদেশ জুড়ে আলেকজান্ডারের সাম্রাজ্য বিস্তৃত হলেও অনতিদূরের ইতালি দেশটা স্বাধীন থেকে গিয়েছিল। আকস্মিক মৃত্যু না হলে হয়ত তিনি এ দেশটার দিকে মনযোগ দিতে পারতেন। তবে পৃথিবীর ম্যাপ দেখে তিনি তার বিজয়ের বাকী উল্লেখযোগ্য দেশের অভাবে যেভাবে হতাশা ব্যক্ত করেছিলেন তাতে মনে হয় এ দেশটাকে তিনি মোটেও আমলে নেননি। তার উত্তরসূরিরাও কখনও এ দেশ দখল করেনি। কিন্তু রোমানদের উত্থানের সময়ে আলেকজান্ডারের পুরো সাম্রাজ্যই দখল করে নিয়েছিল তারা।

রোমের ইতিহাসের গোড়াটা খুঁজে পাওয়া যায় রোমান মহাকাব্য ভার্জিলের ইনিডের মধ্যে। গ্রিসের হোমারীয় মহাকাব্য ইলিয়াডে অজানা দেশের উদ্দেশ্যে হারিয়ে যাওয়া যে ট্রোজান বীর ইনিসের কথা বলা হয়েছে, তার কাহিনী নিয়ে রচিত হয়েছে ইনিড। ট্রয় নগরী যখন ধ্বংশ হয়ে যায় তখন ইনিস নতুন জায়গার সন্ধানে ঘুরতে এসে পৌঁছায় ইতালির টাইবার নদীর তীরে। সেখানকার রাজকন্য লেভিনিয়ার সাথে বিয়ে হয় তার। তাদের সন্তান রেমুলাসই একদিন সাত পাহাড়ের কোলে গড়ে তোলে নতুন নগরী রোমা। এর অধিবাসীরা হল রোমান। এ সবই অবশ্য গল্পের কথা।

ইতিহাসের পথ ধরে হাঁটলে দেখা যায় ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে ইন্দো-ইউরোপীয় একদল আর্য ইতালির উত্তরে বসতি গড়ে তোলে। তাদের বলা হত ল্যাটিন। তাদের ভাষা ল্যাটিন ভাষা। তাদের রাজা রেমুলাস রোম নগরীর পত্তন করেন। ১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে আরেকটি গোষ্ঠী-ইট্রুস্কানরা রোম ও এর আশপাশের অঞ্চল দখল করে নেয়। রোমের জীবন ও শিল্পকলার সর্বত্র এদের প্রভাব দেখা যায়। ৫১০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আগেই রোমানদের হাতে পরাজিত হয় তারা। এটা সেই সময়ের কথা যখন পারস্য সাম্রাজ্যের ক্ষমতায় ছিলেন সম্রাট দারায়ুস এবং গ্রিসে এথেন্স একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠেছে।

৫০৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমের ইতিহাস বাঁক নিল রাজতন্ত্র থেকে প্রজাতন্ত্রের দিকে। টারকুইন নামক অত্যাচারি রাজাকে বিতাড়িত করল রোমের সাধারণ জনতা - প্লেবিয়ানরা। রাজার বদলে জনগণ প্রতি বছরের জন্য দুজন শাসক নির্বাচনের ব্যবস্থা করল। এদের বলা হত কনসাল। কনসালরা চলত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত ৩০০ সদস্য বিশিষ্ট সিনেটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী। রোমানরা এই শাসন ব্যবস্থার নাম দিয়েছিল Republica অর্থাৎ প্রজাতন্ত্র। তবে এই প্রজাতন্ত্র প্লেবিয়ান শ্রেণিভুক্ত ক্ষুদ্র কৃষক কারিগর ও বণিকদের ভাগ্যে কোন পরিবর্তন আনতে পারল না। অভিজাত (ভূমি ও দাস মালিক) প্যাট্রেসিয়ানদের দ্বারা তারা সবক্ষেত্রে শোষিত ও বঞ্চিত ছিল। কাউন্সিল ও সিনেটের সদস্য নির্বাচিত হত এই প্যাট্রেসিয়ানদের মধ্য থেকেই। ফলে ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে প্লেবিয়ানরা প্যাট্রেসিয়ানদের বিরুদ্ধে অধিকার আদায়ের আন্দোলন শুরু করে। তারা খাজনা প্রদান বন্ধ করে দেয়। এমনকি সেনাবাহিনী ছেড়ে চলে যাবে বলেও হুমকি দেয়। এতে তারা কিছু কিছু অধিকার লাভ করতে পারল। এটাই ইতিহাসে সর্বপ্রথম রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন। এ আন্দোলনের ফলে প্লেবিয়ানদের দশজন প্রতিনিধি সিনেটের সদস্য হয়। এদের বলা হত ট্রিবিউন বা ম্যাজিস্ট্রেট। এরা সাধারন প্লেবিয়ানদের দাবির সমর্থনে আইন প্রণয়ন করতে থাকে। ১২টি ব্রোঞ্জপাতে এই আইন লেখা হয়। জনকল্যাণমুখী এই আইনকে বলা হত হেবিয়াস কর্পাস। হাম্বুরাবি ও ড্রাকোর পরে এটা আইন প্রণয়নের তৃতীয় বিখ্যাত দৃষ্টান্ত। প্লেবিয়ানদের এই অধিকার আদায়ের সংগ্রাম চলেছিল প্রায় ২০০ বছর ধরে। অধিকার আদায়ের এক পর্যায়ে এসে দুজন কনসালের একজন প্লেবিয়ানদের মধ্য থেকে নেয়ারও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এভাবে রোমান প্রজাতন্ত্রের চেহারা কিছুটা গ্রিকদের গণতন্ত্রের মত হয়ে যায়।

কিন্তু এই রাজনৈতিক অধিকার পেয়ে প্লেবিয়ানদের খুব একটা লাভ হল না। কারণ শাসন পরিচালনার পদ গুলো ছিল অবৈতনিক। ফলে যারা গরীব, তাদের কাজ ফেলে সিনেটে এসে সময় দেয়ার সুযোগ ছিল না। এজন্য জমি, ধন, দাস প্রভৃতির মালিক প্যাট্রেসিয়ানরাই কাউন্সিল ও সিনেটের কাজ করতেন অধিকাংশ সময়। আর্থিক মালিকানার পদ্ধতি পরিবর্তন না করে গণতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্র দিয়ে যে কিছুই হয় না, তার সবচেয়ে প্রাচীন দৃষ্টান্ত এটি। আসল ব্যাপার হল অর্থনৈতিক মালিকানা ও বন্টনের পদ্ধতি। অর্থ ব্যবস্থায় পরিবর্তন না এনে শুধু শাসন ক্ষমতায় জনগণের অংশগ্রহণ দিয়ে কিছুই হয় না। আজকের যুগেও গণতন্ত্রের ব্যর্থতার প্রধান কারণ এটি। তৃতীয় বিশ্বের অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রথম বিশ্বের হাতে থেকে যাওয়ার কারণে তৃতীয় বিশ্বের গণতন্ত্র কোন কাজে আসছে না। তবে গণতন্ত্রের শ্রেষ্টত্বের দিকটি হল, শোষণের কৌশল হিসেবে এটি দৈব বিধানের চেয়ে কম প্রতারণামূলক।

রোমের রাজতন্ত্রের পতনের পরবর্তী ৫০০ বছরের ইতিহাস মূলত প্যাট্রেসিয়ান ও প্লেবিয়ানের সংঘর্ষের ইতিহাস। কিন্তু এতে রোমান প্রজাতন্ত্র গ্রিকদের মত যথেষ্ট উদার গণতন্ত্রে পরিণত হতে পারে নাই। সেনাবাহিনী ও সিনেটে ছিল অভিজাত প্যাট্রেসিয়ানদের নিরংকুশ প্রাধান্য। এই সেনাবাহিনীর সহায়তায় রোমান রিপাবলিক সমস্ত ল্যাটিন জাতিগুলিকে পদানত করে দক্ষিণ ইতালিতে একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করেছিল।

খ্রিস্টপূর্ব ২৬৬ সালের দিকে সমগ্র ইতালি রোমান রাজ্যে পরিণত হয়। বিজয়ী রোমানরা পদানত জাতিগুলির ওপর নানারকম করের বোঝা চাপিয়ে দিত। দেশ দখলের যুদ্ধে রোমানরা যেসব যুদ্ধবন্দীদের ধরে আনত তারা পরিণত হয় রোমানদের দাসে। বিজিত দেশ গুলি হতে তাদের রোমে চালান দেওয়া হত। এদের একটি বড় অংশ পরিণত হয় সরকারি সম্পত্তিতে। এদের খনিতে, নির্মাণ কাজে ও জাহাজ চালনায় বেগার খাটতে হত। উদ্ধৃত্ত দাসদের বাজারে নিয়ে নিলামে বিক্রয় করে দেওয়া হত। প্যাট্রেসিয়ান ও ধনী প্লেবিয়ানরা তাদের কিনে নিত। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে রোমের সমস্ত উৎপাদন নির্ভরশীল হয়ে পড়ে দাস শ্রমের ওপর।
দাস শ্রেণিকে নিংড়ে গ্রিক সভ্যতার মত রোমান সভ্যতাও এগিয়ে যায় সমৃদ্ধির দিকে। তাদের দখলে আসতে থাকে একের পর এক গ্রিক রাষ্ট্র।

রোমানদের এ আধিপত্য দেখে শংকিত হয়ে পড়ে ভূমধ্যসাগরের অপর পারের কার্থেজিয়ানরা। তখন রোমান আধিপত্যের একমাত্র শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দী ছিল কার্থেজ। বর্তমান তিউনিসিয়ায় ছিল কার্থেজের অবস্থান। ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী দেশগুলোতে কার্থেজিয়ানদের একচেটিয়া বাণিজ্য ছিল। রোমানরা টেরেন্ট আক্রমণ করলে কার্থেজ টেরেন্টবাসিদের সহায়তায় একটি নৌবহর পাঠায়। ২৬৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোম ও কার্থেজের মধ্যে প্রত্যক্ষ যুদ্ধ শুরু হয়। রোমানরা এ যুদ্ধকে পিউনিক যুদ্ধ বলত। পিউনিক যুদ্ধ চলে শতবর্ষব্যাপী। এ যুদ্ধকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। প্রথম পিউনিক যুদ্ধ শেষ হয় ২৪১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। এ যুদ্ধে কার্থেজিয়ানরা রোমানদের সাথে সন্ধিচুক্তিতে আসতে বাধ্য হয়। সন্ধির শর্ত অনুসারে সার্ডিনিয়া ও সিসিলি উপদ্বীপ কার্থেজিয়ানদের হাত থেকে রোমানদের অধিকারে চলে যায়।

এ সিসিলির সিরাকিউজ শহরে জন্মেছিলেন তৎকালীন পৃথিবীর সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি আর্কিমিডিস। গল্পে আছে, অদ্ভুত অদ্ভুত আবিষ্কার দিয়ে আর্কিমিডিস বারবার রোমান বাহিনীর হাত থেকে তার শহরকে রক্ষা করেছিলেন। আতসী কাচের সাহায্যে তিনি রোমানদের জাহাজে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন। অভিনব কৌশল ব্যবহার করে তিনি রোমানদের জাহাজ শূণ্যে তুলে মোক্ষম আছাড় দিতে পারতেন। আর্কিমিডিস পড়াশুনা করেছিলেন টলেমিদের আলেকজান্দ্রিয়ার শিক্ষাকেন্দ্রে। ইউক্লিডের কাজের ওপর ভিত্তি করে আর্কিমিডিস জ্যামিতির বহু সমস্যার সমাধান দিতে পেরেছিলেন। পৃথিবী থেকে বিভিন্ন গ্রহের দুরত্ব নির্ণয়ের পদ্ধতি তাঁর আবিষ্কার। তাঁর আবিষ্কৃত পদার্থবিদ্যার একটি মৌলিক সূত্রের নাম হয়েছে আর্কিমিডিসের সূত্র। পানি তোলার প্যাঁচালো স্ক্র, পাখি মারার গুলতি, কপিকল পভৃতি তাঁর আবিষ্কার। আর্কিমিডিস মারা যান রোমান সৈন্যদের হাতে ২১২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে।

প্রথম পিউনিক যুদ্ধে রোমানদের সাথে হেরে গিয়ে কার্থেজিয়ানরা মোটেও দমে গেলনা। স্থলপথে রোম আক্রমণের এক দুঃসাহসিক পরিকল্পনা রচনা করলেন কার্থেজিয়ান সেনা নায়ক হানিবল। স্পেন, ফ্রান্স হয়ে উত্তরদিকের আল্পস পর্বতমালা পেরিয়ে ইতালিতে ঢুকে রোম আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। রোমানরা কখনও ভাবতেই পারেনি আকাশছোঁয়া আল্পস পেরিয়ে এসে উত্তরদিক হতে কেউ আক্রমণ করতে পারে। এ অসম্ভবকে সম্ভব করলেন হানিবল।

২১৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দের বসন্তকালে, আল্পস পর্বতমালা পেরিয়ে গেলেন হানিবল। এক লক্ষ চল্লিশ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী নিয়ে এসেছিলেন হানিবল। তার অর্ধেক পরিমাণ সেন্য, ঘোড়া আর হাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় আল্পস পেরুনোর সময়, ঠান্ডায় জমে গিয়ে। হানিবল ক্রমান্বয়ে চারটি রোমান সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে এগিয়ে আসলেন রোমের দিকে। তখন সিপিও নামক একজন রোমান সেনানায়ক আত্মরক্ষার অভিনব উপায় বের করলেন। তিনি প্রতিরক্ষায় গুরুত্ব না দিয়ে উল্টো দিকে কার্থেজ আক্রমণের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। ফলে বাধ্য হয়ে হানিবল ফিরে এলেন স্বদেশ রক্ষার জন্য। কার্থেজের অদূরে রোমানদের সাথে যুদ্ধে কার্থেজিয়ানরা পরাজিত হল। এটা ছিল দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধ। এ যুদ্ধ শেষ হয় ২০২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে।

তৃতীয় ও শেষ পিউনিক যুদ্ধ হয় ১৪৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। এ যুদ্ধেও পরাজিত হয় কার্থেজ। রোমানরা সিদ্ধান্ত নিল কার্থেজ নগরীকে সম্পূর্ণ ধ্বংশ করার। কার্থেজের রাস্তায় নারী-পুরুষ-শিশু সকলকেই হত্যা করল নির্বিচারে। শহরে আগুন ধরিয়ে দিল। শস্যভূমিতে ছড়িয়ে দিল লবণ, যাতে আর কোন শস্য জন্মাতে না পারে। এভাবে কার্থেজ নগরী সত্যি সত্যিই চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যায়।

এই সময়ে সমগ্র ইতালিতে দাস শ্রমের নিয়োগ ব্যাপক আকার ধারণ করে। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের মধ্য ভাগে শুধু গ্রিস হতেই সংগ্রহ করা হয় দেড় লক্ষ দাস। এসব দাসরা মনিবের মুনাফার জন্য সারাদিন খাটত বড় বড় কৃষি খামারে। এর নাম ল্যাটিফান্ডিয়া। কয়েকশো হতে কয়েক হাজার দাস এক একটি ল্যাটিফান্ডিয়ায় খাটত। হাড়ভাঙ্গা খাটুনির বিনিময়ে তারা পেত শুধু মালিকের অত্যাচার ও শাস্তি। চাবুকের ঘায়ে তাদের পিঠের চামড়া শক্ত হয়ে যেত। আগুনে উত্তপ্ত লোহার সাহায্যে তাদের গায়ে দাগ দেয়া একটা সাধারণ রীতি ছিল। দাসদের কোন নাম ছিল না। গালাগালি করেই তাদেরকে ডাকা হত। গ্রীষ্মকালে তাদের দৈনিক ১৮ ঘন্টা কাজ করতে হত। কাজ করতে করতে ক্ষুধার্ত দাস যেন ক্ষেতের শস্যদানা খেয়ে ফেলতে না পারে সেজন্য তার ঘাড়ে কাঠের চাকা পরিয়ে দেয়া হত। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে একজন দাস পঙ্গু ও বিকলাঙ্গ হয়ে যেত। তাকে নির্জন দ্বীপে ফেলে আসা হত। অনাহারে সেখানে সে মারা যেত কিংবা হিংস্র পশুর খাদ্যে পরিণত হত।

কৃষির চেয়ে খনির কাজে দাসদের অবস্থা ছিল আরো করুণ। রুক্ষ পাথরের গুহায় পাথরের দেয়াল কাটতে কাটতে একসময় তারা সেখানেই মরে পড়ে থাকত। তাদের কঙ্কালের পাশে বসে কাজ করে যেত নতুন দাসেরা। অল্প দিনের মধ্যে এরাও মারা পড়ত। পলাতক দাসদের নিক্ষেপ করা হত ক্ষুধার্ত সিংহের মুখে। এমনসব বিভৎস কায়দায় দাসদের নিপীড়ন করা হত, যা শুনলে আজকের যুগের মানুষ চমকে উঠবে। দাসদের ওপর বর্বরতায় রোমান সভ্যতা ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল।

এ সভ্যতার গৌরবের আড়ালে লুকিয়ে আছে মানবতার পরাজয়ের এক করুন ইতিহাস। দাস নিপীড়নের কলঙ্ক সভ্যতার গৌরবকে ছাপিয়ে যায়। গৌরবের পেছনে লুকিয়ে আছে কলঙ্কের ক্রুর হাসি। ক্রীতদাসের জীবন মালিকের কাছে হালের বলদ কিংবা লাঙ্গলের চেয়ে মোটেও বেশি মূল্যবান ছিল না। কারণ বিভিন্ন দেশ দখলের যুদ্ধ হতে রোমানরা পেত অগণিত যুদ্ধবন্ধী ক্রীতদাস। তাই বাজারে সস্তায় দাস পাওয়া যেত। কার্থেজের সাথে যুদ্ধের ফাঁকে ফাঁকে রোম একটার পর একটা দেশ জয় করে চলেছিল। আর যত যুদ্ধ তত দাস। আর যত বেশি দাস তত সস্তা তাদের জীবনের দাম। ক্রীতদাসের পাঁজরের গাঁথুনি দিয়ে গড়ে উঠেছে সভ্যতার ইমারত।

দাস নিপীড়নের কলঙ্কে রোমানরা শীর্ষে পৌঁছে যায় গ্লাডিয়েটর প্রথার জন্ম দিয়ে। গ্রিকরা অবসর সময়ে বসে থিয়েটার দেখত। রোমানরা তাদের অবসর বিনোদনের জন্য এরকম শিল্পসম্মত পদ্ধতির ধারে কাছেও গেল না। নারকীয় নৃশংসতাই হয়ে উঠল অভিজাতদের শিল্প। বিনোদনের জন্য তারা সিংহের খাঁচায় ক্রীতদাসকে পুরে দিয়ে মজা দেখত, সিংহ কেমন করে মানুষ ছিঁড়ে খায়। অভিজাতদের বিকারগ্রস্থ রুচিচর্চার সবচেয়ে কুখ্যাত জায়গা ছিল এরেনাগুলো। এরেনার ভেতর তারা শক্তিশালী ক্রীতদাসদের বাধ্য করত পরষ্পরের সাথে যুদ্ধ করতে। এদের বলা হয় গ্লাডিয়েটর। যুদ্ধের নিয়ম ছিল দুজন গ্লাভিয়েটরের মাঝে যুদ্ধে একজন মরতে হবে এবং একজন বেঁচে থাকতে পারবে। তাই দুজনেই চাইত অপর জনকে হত্যা করে বেঁচে থাকতে। এই ভয়ংকর নির্মমতায় তারা রাজি না হলে দুজনকেই হত্যা করা হত। বিজয়ী গ্লাডিয়েটরে যখন পরাজিত গ্লাডিয়েটরের মাথা কেটে তুলে ধরত এরেনার গ্যালারিতে বসা দর্শকদের উদ্দেশ্যে, তখন তারা আনন্দে উঠে দাঁড়িয়ে হাত তালি দিত। এটা ছিল অনেকটা আজকের দিনের ফুটবল খেলায় গোল হওয়ার দৃশ্যের মত। গ্লাডিয়েটরদের সিংহের সাথেও লড়াইয়ে বাধ্য করা হত। এ ধরনের নারকীয় জীবন থেকে মুক্তির জন্য ক্রীতদাসরা সুযোগ পেলেই বিদ্রোহ করত। মানুষের ইতিহাস শুধু শোষণ আর কলঙ্কের নয়, সংগ্রামেরও। এ সংগ্রামের মহান কীর্তি দাসবিদ্রোহ কিংবা সেমেটিক নবীদের তাওহীদ।

ক্রীতদাসের ওপর মেহনতের সবটুকু দায় চাপিয়ে দিয়ে গ্রিকরা মন দিয়েছিল শিল্প, সাহিত্য, দর্শন আর বিজ্ঞানের দিকে। কিন্তু রোমানরা মনযোগ দিয়েছিল শুধুই ডাকাতি করার দিকে। পরের দেশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে লুটতরাজের দিকে। রোমানদের ইতিহাস তাই একের পর এক যুদ্ধের ইতিহাস; লেখাপড়া বা জ্ঞানচর্চার নয়। তাই রোমে কখনও জন্ম হয়নি সক্রেটিস, ডেমোক্রিটাস, এস্কাইলাস, পিথাগোরাস কিংবা পেরিক্লিস-সলোনের মত ব্যক্তিদের। এ সভ্যতার অন্দরমহলে ক্রীতদাসের বুকফাঁটা কান্না আর সদর মহলে ডাকাত দলের উল্লাস। এ উল্লাসে মাঝে মাঝে ভাটার টান দেখা যায় যখন দাস বিদ্রোহে শোষণের স্বর্গ হাতছাড়া হওয়ার উপক্রম হয়েছে। দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধের পর হতেই রোমান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় ছোট খাটো দাস বিদ্রোহ দেখা যায়। ১৪০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ হতে বিদ্রোহ ব্যাপক আকার ধারণ করে। রোমে শত শত বিদ্রোহীকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। এটিকার রৌপখনির দাসেরা বিদ্রোহ করে। ডিলবো শহর দাসদের দখলে চলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। একবার তুরস্ক অঞ্চলের এক ল্যাটিফান্ডিয়ার দাস বিদ্রোহীরা কয়েকটি শহর কেড়ে নিয়ে একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। এ রাজ্য পূণর্দখলে রোমান কনসালের সেনাবাহিনী প্রথমে পরাজিত ও পরে সফল হয়েছিল।

ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দাসবিদ্রোহের ঘটনা ঘটে খ্রিস্টপূর্ব ৭০ দশকে। এ বিদ্রোহের সূচনা ঘটে কাপুয়া শহরের একটি এরেনা থেকে। এর নেতা একজন গ্লাডিয়েটর। তার নাম স্পার্টাকাস। রোমানরা তাকে বন্দী হিসেবে এনেছিল তুরস্ক থেকে। স্পার্টাকাস তার অনুসারিদের নিয়ে পালিয়ে ভিসুভিয়াস পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখান থেকে রোমান সেনাদের অবরোধ ভেঙে বেরিয়ে এসে, তাদের ধ্বংশ করে দেন। স্পার্টাকাসের বিজয়ের সংবাদ চর্তুদিকে ছড়িয়ে পড়লে আশে পাশের শহরের হাজার হাজার বিদ্রোহী ক্রীতদাস তার বাহিনীতে যোগ দিতে থাকে। তিন মাসের মধ্যে প্রায় ৭০ হাজার ক্রীতদাস এই বিদ্রোহে শামিল হয়। রোমান সিনেট বিদ্রোহ দমনে বারবার সেনাবাহিনী পাঠিয়ে পরাজিত হয়।

স্পার্টাকাস তার বিশাল বাহিনী নিয়ে সিসিলির দিকে অগ্রসর হন। তখন রোমান কনসালের সহযোগিতায় আশপাশের রাষ্ট্র থেকে সেনাবাহিনী এসে পৌঁছে গেছে। এই সম্মিলিত বাহিনী, বিদ্রোহী বাহিনীর পিছু ধাওয়া করে। খ্রিস্টপূর্ব ৭১ সালে এই সম্মিলিত বাহিনীর কাছে ঝড়ের প্রকোপে বিশৃঙ্খল হয়ে যাওয়া স্পার্টাকাসের বাহিনী পরাজিত হয়। বিদ্রোহীরা দুই বছর ধরে কনসালের সেনাবাহিনীদের ঠেকিয়ে রেখেছিল। মোট পাঁচবার-রোমান বাহিনী পরাজিত হয়েছিল তাদের কাছে। শেষ ও চূড়ান্ত যুদ্ধে দাসেরা পরাজিত হলে রোমান সিনেট নারকীয় উল্লাসে বিদ্রোহীদের শাস্তি প্রদান করে। কাপুয়া থেকে রোম শহর পর্যন্ত রাস্তার দুইপাশে হাজার হাজার ক্রীতদাসকে ক্রশবিদ্ধ করে ঝুলিয়ে রাখা হয়। রক্তের বন্যায় এই বিদ্রোহকে ডুবিয়ে দেয়া হল বটে। কিন্তু এটা সভ্যতার আসল চেহারাই ফুটিয়ে তুলল এবং রেখে গেল মহান সংগ্রামের উত্তরাধিকার। সভ্যতার ভেতরের কদর্য চেহারাটা বেরিয়ে এল এই বিদ্রোহে। দাস প্রথার বিরুদ্ধে কোন রোমান দার্শনিকই প্রতিবাদ জানাননি। গ্রিকদের মধ্যে থেকে একমাত্র সেনেকা দাসদের পূর্ণ মানুষের মর্যাদায় বিশ্বাস করতেন।

স্পার্টাকাসের বিদ্রোহ রোমান সাম্রাজ্যের ভিত কাঁপিয়ে দেয়। ভূস্বামী অভিজাত প্যাট্রেসিয়ানদের একক আধিপত্য হ্রাস পায়। সিনেট-অভিজাততন্ত্র ধসে পড়ে। সামরিক একনায়কত্ব প্রতিষ্টা পায়। ক্রীতদাস ছাড়াও আরেকটি শ্রেণি অভিজাত শ্রেণির স্বার্থের বলী হয়েছিল রোমান সাম্রাজ্যে। এরা হল প্রলেতারিয়ান। সারা দেশের জমি অভিজাতদের ল্যাটিফান্ডিয়ার ভেতরে চলে গেলে প্লেবিয়ানদের একটি বিশাল অংশ পরিণত হয় ভূমিহীন প্রলেতারিয়েতে। কৃষি উৎপাদনে শ্রমের চাহিদা ল্যাটিফান্ডিয়ার দাসদের দিয়ে পূরণ হয়ে যাওয়ায় এরা চুড়ান্তভাবে দেউলিয়া হয়ে পড়ে। তবে ট্রিবিউন নির্বাচনে তাদের সমর্থনের প্রয়োজন হত।

রোমান নাগরিকদের আরেকটি উল্লেখযোগ্য শ্রেণি হল ব্যবসায়ী-বণিক-সুদখোর শ্রেণি। সিনেট ক্ষমতায় অভিজাতদের নিরংকুশ প্রাধান্য থাকায় এরা ছিল ক্ষমতা বঞ্চিত। তাই ক্ষমতা লাভের উদ্দেশ্যে তারা প্রলেতারিয়ান সমর্থন আদায়ে সচেষ্ট হল। এজন্য টিবেরিয়াস গ্রেকাস নামে একজন অভিজাতকে হাত করল। ১৩৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি ট্রিবিউন নির্বাচিত হয়ে ভূমিহীনদের ভূমি প্রদানের জন্য সিনেট আইন পাশের প্রস্তাব করেন। কিন্তু অভিজাতদের হাতে তিনি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে নিহত হন। ১২১ খ্রিস্টপূবাব্দে তাঁর ভাই গেইয়াস গ্রেকাস ট্রিবিউন নির্বাচিত হয়ে ভূমিহীনদের সমস্যা সমাধানে সচেষ্ট হন। বণিকরা তাকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছিল। তিনি ক্ষমতা থেকে বিদায় হওয়ার পরে টিবেরিয়াসের ভূমি আইন রদ হয়ে যায় এবং সিনেট পুরনো ক্ষমতা ফিরে পায়। তবে এ সময় রোম সাম্রাজ্য নতুন সঙ্কটে পতিত হয়। টিবেরিয়াস ও গেইয়াসের মত প্রলেতারিয়ান প্রতিনিধিদের আবিভার্ব অভিজাতদের নিরংকুশ প্রভাবে ফাটলই ইঙ্গিত করে।

গেইয়াস গ্রেকাসের পতনের পর রোম শাসনের বিরুদ্ধে আফ্রিকায় বিদ্রোহ দেখা দেয়, স্পেনে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, ইতালিজুড়েও দাস বিদ্রোহের প্রকোপ দেখা দেয়। এর ওপর যাযাবর জার্মান, ডাচ ও স্কেন্ডিনেভিয়ান টিউটন জাতির লোক ইতালিতে এসে ঢুকে যায়। এই গভীর সঙ্কটের মুখে পড়ে রাষ্ট্র রক্ষার জন্য অভিজাতরা প্রলেতারিয়ানদের সাথে আপষে বাধ্য হয় এবং নিরংকুশ অভিজাততন্ত্রে একটি স্থায়ী ফাটল দেখা দেয়। সিপিয়োর প্রাক্তন সেনাপতি মেরিয়াস প্রলেতারিয়ানদের নিয়ে রাষ্ট্র রক্ষার জন্য একটি নতুন সেনাবাহিনী গঠনের অনুমতি পেলেন। প্রলেতারিয়ান সেনাবাহিনী গঠনে বণিকরাও সমর্থন দিয়ে গেল। মেরিয়াস এবার আর ট্রিবিউন নয়, বণিকদের সহায়তায় একেবারে কনসাল পদে নির্বাচিত হলেন। তিনি পাঁচ বছরের মধ্যে রাষ্ট্রের সুরক্ষা ফিরিয়ে আনলেন। কিন্তু অভিজাতদের সাথে বণিক ও প্রলেতারিয়ানদের শ্রেণি সংঘর্ষ চাপা থাকল না। ট্রিবিউনদের পরিষদ ও সিনেটের মধ্যে যে রাজনৈতিক টানাপোড়েন সবসময় লেগে ছিল তা এবার প্রাকাশ্য রূপ ধারন করল।

রোম সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ শ্রেণি বিরোধ অনেক সময়েই মিটমাট হয়ে যেত ডাকাতির ধন ভাগাভাগি করে। অন্যদেশ দখল ও লুণ্ঠন করে যে জমি ও সম্পত্তি পাওয়া যেত তা দিয়ে বঞ্চিতদের তুষ্ট করা যেত অনেক ক্ষেত্রে। ডাকাতিতে অভিজাতরা নেতৃত্বে দিলেও সেনাবাহিনীতে প্রলেতারিয়ান বা প্লেবিয়ানরা অংশ নিয়ে লুটপাটের অংশীদার হতে পারত। পরের ঘরের ধন লুট করে নিজের ঘরের বিরোধ মেটানো যেত। ডাকাতি ও লুণ্ঠন ছিল রোমান সমৃদ্ধির মূল চাবিকাটি। জমি, দাস ও সম্পদ সবই আসত অন্যদেশ দখল ও লুণ্ঠন থেকে। রোমানদের সমৃদ্ধি ও উত্থানের মূল ছিল লাগাতার দেশ দখল ও লাগামহীন লুণ্ঠন। এ লুণ্ঠনে যেসব প্লেবিয়ান- প্রলেতারিয়ান সৈন্য অংশ নেবে তারা লুণ্ঠনলদ্ধ অর্থ পেয়েই সুখী থাকবে। উপরি লাভ হবে অভিজাত প্যাট্রেসিয়ানদের। জমি ও দাস দুটোই হাতে আসবে অগনিত ভাবে। তাই সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব নিজের হাতে রাখলেও অন্যদের অংশ নেয়ার সুযোগ দেওয়াটা অভিজাতদের জন্য ক্ষতিকর ছিল না বরং অত্যন্ত লাভজনকই ছিল।

মেরিয়াস তার অনুগত প্রলেতারিয়ান সৈন্যদের, বিজিত দেশ স্পেন, আফ্রিকা ও তুরষ্ক হতে ২৫ হেক্টর করে জমি দিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। এদের নিয়ে গলদেশ অর্থাৎ ফ্রান্স দখলেরও প্রস্তাব করলেন। আর দখল মানেই তা অভিজাতদের হাতে আরও দাস, আরও ল্যাটিফান্ডিয়া স্থাপনের সুযোগ। আবার বণিকদেরও অবাধ লুন্ঠনের সুযোগ, সেনাবাহিনীরও পোয়াবারো। অতএব দুটি সিদ্ধান্তেই কেউ আপত্তি তুলল না। সবাই সানন্দে রাজী ছিল। কিন্তু বাঁধ সাধল সেনাবাহিনী বহির্ভূত প্রলেতারিয়ানরা। তারা দেখল ভবিষ্যৎ অন্ধকারে। তাই তারা টিবেরিয়াস ও গেইয়াসের ভূমি আইন বাস্তবায়নের দাবি তুলল। এ আইন বাস্তবায়ন হলে অভিজাতদের ল্যাটিফান্ডিয়ার জমিতে হাত পড়বে।

বিজিত দেশের জমি প্রলেতারিয়ানদের মাঝে বিতরণে অভিজাতদের আপত্তি নেই, কারণ, এতে তাদের ল্যাটিফান্ডিয়ায় হাত পড়ে না। তাই তারা গ্রেকাস ভাইদের আইন বাস্তবায়ন যেকোন মূল্যে ঠেকিয়ে রাখতে প্রস্তুত। তাই মেরিয়াস বঞ্চিত প্রলেতারিয়ানদের কথায় কান দিলেন না। কিন্তু তারা সংখ্যায় ছিল বিপুল। তারা অচিরেই সংগঠিত শক্তিতে আত্মপ্রকাশ করল। ট্রিবিউন সেটারনিনাস তাদের নেতা হিসেবে অবির্ভূত হলেন। সমস্ত ইতালির প্রলেতারিয়ানদের তিনি রোমে আসতে আহ্বান জানালেন। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১১০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মেরিয়াসকে হটিয়ে দিয়ে প্রলেতারিয়ানরা রোম দখল করল। কারাগার ভেঙে তারা দাসদের মুক্ত করল। তাদের হাতেও তুলে দিল অস্ত্র এবং সিনেট ভবন দখল করে নিল।

প্রলেতারিয়ানদের এই আকম্মিক উত্থানে ভঁড়কে গেল বণিকরা। তারা এই বিপ্লবে তাদের কোন স্বার্থ খুঁজে পেল না। কিন্তু তারা এতদিন প্রলেতারিয়ানদের ভূমি প্রদানের পক্ষে ছিল কারণ এতে তাদের কোন ক্ষতি হত না, হত ল্যাটিফান্ডিয়ার মালিকদের এবং এতে প্রলেতারিয়ানদের সমর্থন নিয়ে, তাদের ক্ষমতায় বসার পথও প্রশস্ত হত। কিন্তু এখন অবস্থা এমন পর্যায়ে চলে গেল যে শুধু অভিজাত নয়, তাদেরও অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার আশংকা দেখা দিল। তাই বিরোধ ভূলে অভিজাতদের সাথে তারা হাত মেলাল এবং উভয়ে মিলে মেরিয়াসের অধীনে পূণর্গঠিত করল সেনাবাহিনীকে।

১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মেরিয়াস ও সেটারনিনাসের বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধে সেটারনিনাস নিহত হন ও তার বাহিনী আত্মসমর্পনে করতে বাধ্য হয়। কিন্তু এ বিজয়ে শ্রেণি বিরোধের অবসান হল না। রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে এ বিরোধ চলেছিল আরও ৭০ বছর ধরে। এক সময়ের একমাত্র অভিজাতদের স্থলে এখন বণিক ও প্রলেতারিয়ানরা সংগঠিত শ্রেণি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। সমাজের রাজনৈতিক শক্তিও তিনটি শক্তিকেন্দ্রে ভাগ হয়ে গেল। বণিক ও প্রলেতারিয়ানরা ততদিনে সমাজে স্বতন্ত্রভাবে সংগঠিত রাজনৈতিক সত্ত্বা অর্জন করে ফেলেছে। প্রলেতারিয়ানদের পরাজিত করে বণিক ও অভিজাতরা মিলে উভয় পক্ষ হতে দুজন করে কনসাল নিযুক্ত করতে থাকে রোমে। নতুন কনসালরা প্রলেতারিয়ানদের বিদ্রোহ প্রশমিত করার জন্য তাদেরকে ব্যাপক হারে সেনাবাহিনীতে ভর্তি করে বিদেশে নিয়ে যায় দখল-লুণ্ঠন অভিযানে।

প্রলেতারিয়ানদের বিরোধ আপাতত নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও বণিক ও অভিজাতদের বিরোধ চাপা থাকল না আর। নতুন কনসাল সুল্লা ও বণিক ভজা সেনানায়ক প্রোকনসাল মেরিয়াস উভয়েই যখন রোমের বাইরে বিভিন্ন জায়গায় বিদ্রোহ দমন ও লুণ্ঠনে বেরিয়েছেন, তখন হঠাৎ করে মেরিয়াস অপর কনসাল সিন্নাকে নিয়ে রোম দখল করে ফেললেন। অভিজাত ও বণিকদের পক্ষ থেকে তখন সুল্লা ও সিন্নাকে কনসাল নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। মেরিয়াস পাঁচদিন ধরে অভিজাতদের হত্যা করতে থাকেন এবং তাদের সম্পত্তি বণিকদের মাঝে বিতরণ করেন। ভালো ভালো ল্যাটিফান্ডিয়া নাম মাত্র মূল্যের বণিকরা কিনে নিল।

সুল্লা দেশে ফিরে এসে পুনরায় রোম দখল করে নেন। মেরিয়াসের সৈন্য ও সমর্থকদের হত্যার জন্য তিনি রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের ব্যবস্থা করলেন। জমিও আবার হাত বদল হল। এটাই অভিজাতদের শেষ বিজয়। রোম তখন নামে মাত্র বিপাবলিক। সিনেটের কার্যকারিতা লোপ পেয়ে গেছে ততদিনে। সুযোগসন্ধানী সেনানায়করা চাইলেই অভিজাত ও বণিকদের সমর্থন নিয়ে একনায়কের ভূমিকায় আবির্ভূত হচ্ছে। এতদিন সেনানায়করা ১ বছরের কনসাল নির্বাচিত হতে পারত। ১ বছর পরে প্রোকনসাল হয়ে কোন বিজিত প্রদেশের ক্ষমতায় অবাধ লুণ্ঠনের সুযোগ পেত। রিপাবলিক ব্যবস্থায় স্থায়ীভাবে কনসাল বা একনায়ক হওয়ার সুযোগ আগে ছিল না। কিন্তু এই অবস্থায় এসে অভিজাত ও বণিকদের মধ্যে সৃষ্ট গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতিতে কোন এক পক্ষকে স্থায়ীভাবে স্বার্থ রক্ষার প্রতিশ্রু দিয়ে একনায়ক হিসেবে ক্ষমতায় বসার সুযোগ সেনানায়কদের হাতে ধরা দিচ্ছিল। কিন্তু এমন সময় স্পার্টাকাসের নেতৃত্বে দাস বিদ্রোহে তাদের সে উৎসাহে ভাটার টান ধরে যায়।

(পরবর্তী পোস্টে বাকী অংশ পড়ুন)

লেখক: আসিফ আযহার, শিক্ষার্থি, ইংরেজি বিভাগ, শা.বি.প্র.বি.

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ২৮ শে জুলাই, ২০১৫ দুপুর ১:১২

চাঁদগাজী বলেছেন:


ভালো লেখা

২| ২৮ শে জুলাই, ২০১৫ দুপুর ২:০০

ক্যাটম্যান বলেছেন: তথ্যবহুল পোস্ট। অনেক কিছু জানলাম।

৩| ৩১ শে জুলাই, ২০১৫ রাত ৯:৫৯

রাতুল_শাহ বলেছেন: গ্ল্যাডিয়েটর, স্পার্টাকাস এদের সম্পর্কে জানলাম।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.