নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইতিহাসের পাঠশালায়

আসিফ আযহার

শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়।

আসিফ আযহার › বিস্তারিত পোস্টঃ

ইতিহাসের পাঠশালায়: পর্ব-৮ | রোমান রিপাবলিকের অভ্যুদয়

১২ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ৮:০৯


ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় চলচ্চিত্র Ben Hur যারা দেখেছেন তাদের নিশ্চয়ই মনে পড়বে জেরুজালেমের রাজপথে রোমান সৈন্যদের কুচকাওয়াজের দৃশ্যের কথা। অত্যাচারী রোমান শাসনের দাপটের কাছে কী অসহায়ভাবে বন্দী ছিলো জেরুজালেমের জীবন! এই বন্দী জীবনে সান্তনা ও আশার বার্তা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন সেমেটিক ধর্মগুরু যিসাস। কিন্তু ইতিহাসের নির্মম সত্য হলো যিসাসকে সেমেটিক ইহুদি সমাজের ধর্ম নেতারা গ্রহণ করেননি।

ইহুদি ধর্মযাজক ও ফরীশীদের প্ররোচনায় ইহুদি জনসাধারণ এহুদিয়ার রোমান শাসনকর্তা পিলাতের কাছে যিসাসের মৃত্যুদন্ডের দাবি জানায়। এই দাবির মূখে পিলাত যিসাসকে ক্রশবিদ্ধ করার আদেশ দান করেন। এসব ঘটনার কারণে, সেমেটিক ধর্মগুলোর ইতিহাসের সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস। রোমানরাই সেমেটিক ধর্মকে সারা ইউরোপে ছড়িয়ে দেয়। ধর্মীয় ইতিহাস এবং সভ্যতার ইতিহাস- দু’ক্ষেত্রেই রোমান সাম্রাজ্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।

আলেকজান্ডারের পরে এবং আরব খিলাফতের অভ্যুদয়ের পূর্বে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য ছিলো রোমান সাম্রাজ্য। রোমানদের সংস্কৃতি ছিলো গ্রিক ও মেসিডোনীয় সংস্কৃতি থেকে কিছুটা ভিন্ন। গ্রিকদের তুলনায় রোমানরা ছিলো অনেক বেশি অত্যাচারী। গ্রিক ও মেসিডোনীয়রা তাদের পশ্চিমের রোমান প্রজাতন্ত্রের প্রতি তেমন উৎসাহী ছিলো না যদিও সেখানকার সভ্যতার সূচনা বেশ আগে থেকেই। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, বিশ্ববিজেতা আলেকজান্ডার তাঁর দেশের পশ্চিমের সমৃদ্ধ ইতালির দিকে কোন মনোযোগ দেননি। পশ্চিমের ইতালির এক ফালি ভূখন্ডের চেয়ে তাকে আকর্ষণ করেছিল পূর্বদিকের বিশাল পারস্য সাম্রাজ্য ও সমৃদ্ধ এশীয় অঞ্চল।

তাই তিন মহাদেশ জুড়ে আলেকজান্ডারের সাম্রাজ্য বিস্তৃত হলেও অনতিদূরের ইতালি দেশটা স্বাধীন থেকে গিয়েছিল। আকস্মিক মৃত্যু না হলে হয়ত তিনি এ দেশটার দিকে মনযোগ দিতে পারতেন। তবে পৃথিবীর ম্যাপ দেখে তিনি তার বিজয়ের বাকী উল্লেখযোগ্য দেশের অভাবে যেভাবে হতাশা ব্যক্ত করেছিলেন তাতে মনে হয় এ দেশটাকে তিনি মোটেও আমলে নেননি। তাঁর উত্তরসূরীরাও কখনও এ দেশ দখল করেনি। কিন্তু রোমানদের উত্থানের সময়ে আলেকজান্ডারের পুরো সাম্রাজ্যই দখল করে নিয়েছিলো তারা।


চিত্র: পৌরাণিক বীর ইনিড

রোমের ইতিহাসের গোড়াটা খুঁজে পাওয়া যায় রোমান মহাকাব্য ভার্জিলের ইনিডের মধ্যে। গ্রিসের হোমারীয় মহাকাব্য ইলিয়াডে অজানা দেশের উদ্দেশ্যে হারিয়ে যাওয়া যে ট্রোজান বীর ইনিসের কথা বলা হয়েছে, তাঁর কাহিনী নিয়ে রচিত হয়েছে ইনিড। ট্রয় নগরী যখন ধ্বংশ হয়ে যায় তখন ইনিস নতুন জায়গার সন্ধানে ঘুরতে এসে পৌঁছায় ইতালির টাইবার নদীর তীরে। সেখানকার রাজকন্যা লেভিনিয়ার সাথে বিয়ে হয় তার। তাদের সন্তান রেমুলাসই একদিন সাত পাহাড়ের কোলে গড়ে তোলে নতুন নগরী রোমা। এর অধিবাসীরা হলো রোমান। এ সবই অবশ্য গল্পের কথা।

ইতিহাসের পথ ধরে হাঁটলে দেখা যায় ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে এক দল ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাভাষী (আর্যভাষী) ইতালির উত্তরে বসতি গড়ে তোলে। তাদের বলা হয় ল্যাটিন। তাদের ভাষা ল্যাটিন ভাষা। তাদের রাজা রেমুলাস রোম নগরীর গোড়াপত্তন করেন। ১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে আরেকটি গোষ্ঠী - ইট্রুস্কানরা রোম ও এর আশপাশের অঞ্চল দখল করে নেয়। রোমের জীবন ও শিল্পকলার সর্বত্র এদের প্রভাব দেখা যায়। ৫১০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আগেই রোমানদের হাতে পরাজিত হয় তারা। এটা সেই সময়ের কথা যখন পারস্য সাম্রাজ্যের ক্ষমতায় ছিলেন সম্রাট দারায়ুস এবং গ্রিসে এথেন্স একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠেছে।


চিত্র: ইট্রুস্কান যোদ্ধা

৫০৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমের ইতিহাস বাঁক নিলো রাজতন্ত্র থেকে প্রজাতন্ত্রের দিকে। টারকুইন নামক অত্যাচারী রাজাকে বিতাড়িত করলো রোমের সাধারণ জনতা - প্লেবিয়ানরা। রাজার বদলে জনগণ প্রতি বছরের জন্য দুজন শাসক নির্বাচনের ব্যবস্থা করলো। এদের বলা হতো কনসাল। কনসালরা চলত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত ৩০০ সদস্য বিশিষ্ট সিনেটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী। রোমানরা এই শাসন ব্যবস্থার নাম দিয়েছিলো ‘Republic’ অর্থাৎ প্রজাতন্ত্র।

তবে এই প্রজাতন্ত্র প্লেবিয়ান শ্রেণিভুক্ত ক্ষুদ্র কৃষক, কারিগর ও বণিকদের ভাগ্যে কোন পরিবর্তন আনতে পারলো না। অভিজাত প্যাট্রেসিয়ানদের (ভূমি ও দাস মালিক) দ্বারা তারা সবক্ষেত্রে শোষিত ও বঞ্চিত ছিলো। রোমান কাউন্সিল ও সিনেটের সদস্য নির্বাচিত হতো এই প্যাট্রেসিয়ানদের মধ্য থেকেই। ফলে ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে প্লেবিয়ানরা প্যাট্রেসিয়ানদের বিরুদ্ধে অধিকার আদায়ের আন্দোলন শুরু করে। তারা খাজনা প্রদান বন্ধ করে দেয়। এমনকি সেনাবাহিনী ছেড়ে চলে যাবে বলেও হুমকি দেয়। এতে তারা কিছু কিছু অধিকার লাভ করতে পারলো। এটা ইতিহাসের অন্যতম পুরনো রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের আন্দোলন।


চিত্র: শিল্পীর তুলিতে রোমান ফোরাম। এটি ছিল একটি মার্কেট প্লেস

এ আন্দোলনের ফলে প্লেবিয়ানদের দশজন প্রতিনিধি সিনেটের সদস্য হয়। এদের বলা হতো ট্রিবিউন বা ম্যাজিস্ট্রেট। এরা সাধারন প্লেবিয়ানদের দাবির সমর্থনে আইন প্রণয়ন করতে থাকে। ১২টি ব্রোঞ্জপাতে এই আইন লেখা হয়। জনকল্যাণমুখী এই আইনকে বলা হতো হোবিয়াস কর্পাস। হাম্বুরাবি ও ড্রাকোর পরে এটা আইন প্রণয়নের তৃতীয় বিখ্যাত দৃষ্টান্ত। প্লেবিয়ানদের এই অধিকার আদায়ের সংগ্রাম চলেছিল প্রায় ২০০ বছর ধরে। অধিকার আদায়ের এক পর্যায়ে এসে দু’জন কনসালের একজন প্লেবিয়ানদের মধ্য থেকে নেয়ারও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এভাবে রোমান প্রজাতন্ত্রের চেহারা কিছুটা গ্রিকদের গণতন্ত্রের মতো হয়ে যায়।

কিন্তু এই রাজনৈতিক অধিকার পেয়ে প্লেবিয়ানদের খুব একটা লাভ হলো না। কারণ শাসন পরিচালনার পদ গুলো ছিলো অবৈতনিক। ফলে যারা গরীব, তাদের কাজ ফেলে সিনেটে এসে সময় দেয়ার সুযোগ ছিলো না। এজন্য জমি, ধন, দাস প্রভৃতির মালিক প্যাট্রেসিয়ানরাই কাউন্সিল ও সিনেটের কাজ করতেন অধিকাংশ সময়। আর্থিক মালিকানার পদ্ধতি পরিবর্তন না করে শুধু গণতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্র দিয়েই যে বৈষম্য দূর হয় না, তার সবচেয়ে প্রাচীন দৃষ্টান্ত এটি। আসল ব্যাপার হলো অর্থনৈতিক মালিকানা ও বন্টনের পদ্ধতি। অর্থব্যবস্থায় পরিবর্তন না এনে শুধু শাসন ক্ষমতায় জনগণের অংশগ্রহণ দিয়ে তেমন কিছু হয় না। আজকের যুগেও গণতন্ত্রের ব্যর্থতার প্রধান কারণ এটি। তৃতীয় বিশ্বের অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রথম বিশ্বের হাতে থেকে যাওয়ার কারণে তৃতীয় বিশ্বের গণতন্ত্র কোন কাজে আসছে না।


চিত্র: কলোসিয়াম ও রোম নগরী

রোমের রাজতন্ত্রের পতনের পরবর্তী ইতিহাস মূলত প্যাট্রেসিয়ান ও প্লেবিয়ানের সংঘর্ষের ইতিহাস। কিন্তু এতে রোমান প্রজাতন্ত্র গ্রিকদের মতো যথেষ্ট উদার গণতন্ত্রে পরিণত হতে পারেনি। সেনাবাহিনী ও সিনেটে ছিলো অভিজাত প্যাট্রেসিয়ানদের নিরংকুশ প্রাধান্য। এই সেনাবাহিনীর সহায়তায় রোমান রিপাবলিক সমস্ত ল্যাটিন জাতিগুলিকে পদানত করে দক্ষিণ ইতালিতে একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করেছিল। খ্রিস্টপূর্ব ২৬৬ সালের দিকে সমগ্র ইতালি রোমানদের পদানত হয়। বিজয়ী রোমানরা পদানত জাতিগুলির ওপর নানারকম করের বোঝা চাপিয়ে দিতো।

পরদেশ দখলের যুদ্ধে রোমানরা যেসব যুদ্ধবন্দীদের ধরে আনতো তারা পরিণত হতো রোমানদের দাসে। বিজিত দেশগুলি হতে তাদেরকে রোমে চালান দেওয়া হতো। এদের একটি বড় অংশ পরিণত হতো সরকারী সম্পত্তিতে। এদেরকে খনিতে, নির্মাণ কাজে ও জাহাজ চালনায় বেগার খাটানো হতো। উদ্ধৃত্ত দাসদের বাজারে নিয়ে নিলামে বিক্রয় করে দেওয়া হতো। প্যাট্রেসিয়ান ও ধনী প্লেবিয়ানরা তাদেরকে কিনে নিতো। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে রোমের সমস্ত উৎপাদন দাস শ্রমের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।


চিত্র: তিউনিসিয়ার উপকূল ঘেঁষে গড়া ওঠা কার্থেজ নগরী

দাস শ্রেণিকে নিংড়ে গ্রিক সভ্যতার মতো রোমান সভ্যতাও এগিয়ে যায় সমৃদ্ধির দিকে। তাদের দখলে আসতে থাকে একের পর এক গ্রিক রাষ্ট্র। রোমানদের এ আধিপত্য দেখে শংকিত হয়ে পড়ে ভূমধ্যসাগরের অপর পারের কার্থেজিয়ানরা। তখন রোমান আধিপত্যের একমাত্র শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দী ছিলো কার্থেজ। বর্তমান তিউনিসিয়ায় ছিলো কার্থেজের অবস্থান। ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী দেশগুলোতে কার্থেজিয়ানদের একচেটিয়া বাণিজ্য ছিলো।

রোমানরা টেরেন্ট আক্রমণ করলে কার্থেজ টেরেন্টবাসিদের সহায়তায় একটি নৌবহর পাঠায়। ২৬৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোম ও কার্থেজের মধ্যে প্রত্যক্ষ যুদ্ধ শুরু হয়। রোমানরা এ যুদ্ধকে পিউনিক যুদ্ধ বলতো। পিউনিক যুদ্ধ চলে শতবর্ষব্যাপী। এ যুদ্ধকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। প্রথম পিউনিক যুদ্ধ শেষ হয় ২৪১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। এ যুদ্ধে কার্থেজিয়ানরা রোমানদের সাথে সন্ধিচুক্তিতে আসতে বাধ্য হয়। সন্ধির শর্ত অনুসারে সার্ডিনিয়া ও সিসিলি উপদ্বীপ কার্থেজিয়ানদের হাত থেকে রোমানদের অধিকারে চলে যায়।


চিত্র: পড়াশুনায় মগ্ন আর্কিমিডিস

এ সিসিলির সিরাকিউজ শহরে জন্মেছিলেন তৎকালীন পৃথিবীর সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি আর্কিমিডিস। গল্পে আছে, অদ্ভুত অদ্ভুত আবিষ্কার দিয়ে আর্কিমিডিস বার বার রোমান বাহিনীর হাত থেকে তাঁর শহরকে রক্ষা করেছিলেন। অতসী কাচের সাহায্যে তিনি রোমানদের জাহাজে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন। অভিনব কৌশল ব্যবহার করে তিনি রোমানদের জাহাজ শূণ্যে তুলে মোক্ষম আছাড় দিতে পারতেন। আর্কিমিডিস পড়াশুনা করেছিলেন টলেমিদের আলেকজান্দ্রিয়ার শিক্ষাকেন্দ্রে। ইউক্লিডের কাজের ওপর ভিত্তি করে আর্কিমিডিস জ্যামিতির বহু সমস্যার সমাধান দিতে পেরেছিলেন। পৃথিবী থেকে বিভিন্ন গ্রহের দুরত্ব নির্ণয়ের পদ্ধতি তাঁর আবিষ্কার। তাঁর আবিষ্কৃত পদার্থবিদ্যার একটি মৌলিক সূত্রের নাম হয়েছে আর্কিমিডিসের সূত্র। পানি তোলার প্যাঁচালো স্ক্রু, পাখি মারার গুলতি, কপিকল প্রভৃতি তাঁর আবিষ্কার। আর্কিমিডিস মারা যান রোমান সৈন্যদের হাতে ২১২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে।


চিত্র: হাতির পিঠে হানিবল

প্রথম পিউনিক যুদ্ধে রোমানদের সাথে হেরে গিয়ে কার্থেজিয়ানরা মোটেও দমে গেলো না। স্থলপথে রোম আক্রমণের এক দুঃসাহসিক পরিকল্পনা রচনা করলেন কার্থেজিয়ান সেনা নায়ক হানিবল। স্পেন, ফ্রান্স হয়ে উত্তরদিকের আল্পস পর্বতমালা পেরিয়ে ইতালিতে ঢুকে রোম আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। রোমানরা কখনও ভাবতেই পারেনি আকাশছোঁয়া আল্পস পেরিয়ে এসে উত্তরদিক হতে কেউ আক্রমণ করতে পারে। এ অসম্ভবকে সম্ভব করলেন হানিবল। ২১৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দের বসন্তকালে, আল্পস পর্বতমালা পেরিয়ে গেলেন হানিবল। এক লক্ষ চল্লিশ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী নিয়ে এসেছিলেন হানিবল। তার অর্ধেক পরিমাণ সেন্য, ঘোড়া আর হাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় আল্পস পেরুনোর সময় ঠান্ডায় জমে গিয়ে। হানিবল ক্রমান্বয়ে চারটি রোমান সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে এগিয়ে আসলেন রোমের দিকে।

তখন সিপিও নামক একজন রোমান সেনানায়ক আত্মরক্ষার অভিনব উপায় বের করলেন। তিনি প্রতিরক্ষায় গুরুত্ব না দিয়ে উল্টো দিকে কার্থেজ আক্রমণের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। ফলে বাধ্য হয়ে হানিবল ফিরে এলেন স্বদেশ রক্ষার জন্য। কার্থেজের অদূরে রোমানদের সাথে যুদ্ধে কার্থেজিয়ানরা পরাজিত হলো। এটা ছিলো দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধ। এ যুদ্ধ শেষ হয় ২০২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। তৃতীয় ও শেষ পিউনিক যুদ্ধ হয় ১৪৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। এ যুদ্ধেও পরাজিত হয় কার্থেজ। রোমানরা সিদ্ধান্ত নিলো কার্থেজ নগরীকে সম্পূর্ণ ধ্বংশ করে ফেলার। কার্থেজের রাস্তায় তারা নারী-পুরুষ-শিশু সকলকেই হত্যা করলো নির্বিচারে। শহরে আগুন ধরিয়ে দিলো। শস্যভূমিতে ছড়িয়ে দিলো লবণ, যাতে আর কোন শস্য জন্মাতে না পারে। এভাবে কার্থেজ নগরী সত্যি সত্যিই চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যায়।


চিত্র: রোমান-কার্থেজিয়ান যুদ্ধ

এই সময়ে সমগ্র ইতালিতে দাস শ্রমের নিয়োগ ব্যাপক আকার ধারণ করে। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের মধ্য ভাগে শুধু গ্রিস হতেই সংগ্রহ করা হয় দেড় লক্ষ দাস। এসব দাসেরা মনিবের মুনাফার জন্য সারাদিন খেটে যেতো বড় বড় কৃষি খামারে। এসব কৃষি খামারের নাম ল্যাটিফান্ডিয়া। কয়েকশো হতে কয়েক হাজার দাস একেকটি ল্যাটিফান্ডিয়ায় খাটতো। হাড়ভাঙ্গা খাটুনির বিনিময়ে তারা পেতো শুধু মালিকের অত্যাচার ও শাস্তি। চাবুকের ঘায়ে তাদের পিঠের চামড়া শক্ত হয়ে যেতো।

রোমান ক্রীতদাসের জীবন মালিকের কাছে হালের বলদ কিংবা লাঙ্গলের চেয়ে মোটেও বেশি মূল্যবান ছিলো না। কারণ বিভিন্ন দেশ দখলের যুদ্ধ হতে রোমানরা পেতো অগণিত যুদ্ধবন্দী ক্রীতদাস। তাই বাজারে সস্তায় দাস পাওয়া যেতো। কার্থেজের সাথে যুদ্ধের ফাঁকে ফাঁকে রোম একটার পর একটা দেশ জয় করে চলছিলো। আর যত যুদ্ধ তত দাস। আর যত বেশি দাস তত সস্তা তাদের জীবনের দাম। এসব ক্রীতদাসের পাঁজরের গাঁথুনি দিয়ে গড়ে উঠেছে সভ্যতার ইমারত।


চিত্র: রোমের বাজারে দাস বেঁচা-কেনার দৃশ্য

আগুনে উত্তপ্ত লোহার সাহায্যে ক্রীতদাসদের গায়ে দাগ দেয়া একটা সাধারণ রোমান রীতি ছিলো। দাসদের কোন নাম ছিলো না। গালাগালি করেই তাদেরকে ডাকা হতো। গ্রীষ্মকালে তাদেরকে দৈনিক ১৮ ঘন্টা কাজ করতে হতো। কাজ করতে করতে ক্ষুধার্ত দাস যাতে ক্ষেতের শস্যদানা খেয়ে ফেলতে না পারে সেজন্য তার ঘাড়ে কাঠের চাকা পরিয়ে দেওয়া হতো। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে একজন দাস পঙ্গু ও বিকলাঙ্গ হয়ে যেতো। তাকে নির্জন দ্বীপে ফেলে আসা হতো। সেখানে সে অনাহারে মারা যেতো কিংবা হিংস্র পশুর খাদ্যে পরিণত হতো।

কৃষির চেয়ে খনির কাজে দাসদের অবস্থা ছিলো আরো করুণ। রুক্ষ পাথরের গুহায় পাথরের দেয়াল কাটতে কাটতে একসময় তারা সেখানেই মরে পড়ে থাকতো। তাদের কঙ্কালের পাশে বসে কাজ করে যেতো নতুন দাসেরা। অল্প দিনের মধ্যে এরাও মারা পড়ত। পলাতক দাসদের নিক্ষেপ করা হতো ক্ষুধার্ত সিংহের মুখে। এমনসব বিভৎস কায়দায় দাসদের নিপীড়ন করা হতো যা শুনলে আজকের যুগের মানুষ চমকে উঠবে। দাসদের ওপর বর্বরতায় রোমান সভ্যতা ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। এ সভ্যতার গৌরবের আড়ালে লুকিয়ে আছে মানবতার পরাজয়ের এক করুন ইতিহাস।


চিত্র: রোমান গ্লাডিয়েটরের যুদ্ধ

দাস নিপীড়নের কলঙ্ক এ সভ্যতার গৌরবকে ম্লান করে দেয়। সভ্যতার গৌরবের পেছনে লুকিয়ে আছে কলঙ্কের ক্রুর হাসি। দাস নিপীড়নের কলঙ্কে রোমানরা শীর্ষে পৌঁছে যায় গ্লাডিয়েটর প্রথার জন্ম দিয়ে। গ্রিকরা অবসর সময়ে বসে থিয়েটার দেখতো। রোমানরা তাদের অবসর বিনোদনের জন্য এরকম শিল্পসম্মত পদ্ধতির ধারে কাছেও গেলো না। নারকীয় নৃশংসতাই হয়ে উঠল রোমান অভিজাতদের শিল্প। বিনোদনের জন্য তারা সিংহের খাঁচায় ক্রীতদাসকে পুরে দিয়ে মজা দেখতো; দেখতো সিংহ কেমন করে মানুষ ছিঁড়ে খায়।

অভিজাতদের বিকারগ্রস্থ রুচি চর্চার সবচেয়ে কুখ্যাত জায়গা ছিলো এরেনাগুলো। এরেনার ভেতরে তারা শক্তিশালী ক্রীতদাসদেরকে বাধ্য করতো পরস্পরের সাথে যুদ্ধ করতে। এদের বলা হয় গ্লাডিয়েটর। যুদ্ধের নিয়ম ছিলো দুজন গ্লাডিয়েটরের মধ্যে একজনকে মরতে হবে। যুদ্ধে যে বিজয়ী হবে সে-ই বেঁচে থাকবে। তাই দুজনেই চাইত অপর জনকে হত্যা করে বেঁচে থাকতে। এই ভয়ংকর নির্মমতায় তারা রাজি না হলে দুজনকেই হত্যা করা হতো।

যুদ্ধে বিজয়ী গ্লাডিয়েটর যখন এরেনার গ্যালারিতে বসা দর্শকদের উদ্দেশ্যে পরাজিত গ্লাডিয়েটরের মাথা কেটে তুলে ধরতো তখন দর্শকরা আনন্দে উঠে দাঁড়িয়ে করতালি দিতো। এটা ছিলো অনেকটা আজকের দিনের ফুটবল খেলায় গোল হওয়ার দৃশ্যের মতো। গ্লাডিয়েটরদেরকে সিংহের সাথেও লড়াইয়ে বাধ্য করা হতো। এ ধরনের নারকীয় জীবন থেকে মুক্তির জন্য ক্রীতদাসেরা সুযোগ পেলেই বিদ্রোহ করতো। মানুষের ইতিহাস শুধু শোষণ আর কলঙ্কের নয়, সংগ্রামেরও। এ সংগ্রামের মহান কীর্তি দাসবিদ্রোহ।


চিত্র: রোমান স্থাপত্যরীতি ছিল পৃথিবীর মধ্যে সেরা

ক্রীতদাসের ওপর মেহনতের সবটুকু দায় চাপিয়ে দিয়ে গ্রিকরা মন দিয়েছিলো শিল্প, সাহিত্য, দর্শন আর বিজ্ঞানের দিকে। কিন্তু রোমানরা মনযোগ দিয়েছিলো শুধুই লুন্ঠনের দিকে; পরের দেশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে লুটতরাজের দিকে। রোমানদের ইতিহাস তাই একের পর এক যুদ্ধের ইতিহাস; লেখাপড়া বা জ্ঞানচর্চার নয়। তাই রোমে কখনও জন্ম হয় নি সক্রেটিস, ডেমোক্রিটাস, এস্কাইলাস, পিথাগোরাস কিংবা পেরিক্লিস-সলোনের মতো ব্যক্তিদের। এ সভ্যতার অন্দরমহলে ক্রীতদাসের বুকফাঁটা কান্না আর সদর মহলে লুটেরাদের উল্লাস। এ উল্লাসে মাঝে মাঝে ভাটার টান দেখা দিতো দাস বিদ্রোহের কারণে।

দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধের পর হতেই রোমান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় ছোট খাটো দাস বিদ্রোহ দেখা দেয়। ১৪০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ হতে বিদ্রোহ ব্যাপক আকার ধারণ করে। রোমে শত শত বিদ্রোহীকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। এটিকার রৌপখনির দাসেরা বিদ্রোহ করে। ডিলবো শহর দাসদের দখলে চলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিলো। একবার তুরস্ক অঞ্চলের এক ল্যাটিফান্ডিয়ার দাস বিদ্রোহীরা কয়েকটি শহর কেড়ে নিয়ে একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। এ রাজ্য পূণর্দখলে রোমান কনসালের সেনাবাহিনী প্রথমে পরাজিত ও পরে সফল হয়েছিলো।

লেখক: আসিফ আযহার
শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, শাবিপ্রবি
ই-মেইল: [email protected]
ওয়েবসাইট: http://www.asifajhar.wordpress.com
ফেসবুক: Asif Ajhar, যোগাযোগ: 01785 066 880

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১২ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ৮:৪১

রাজীব নুর বলেছেন: ভালো পোষ্ট।
প্রতিটা পোষ্ট আগ্রহ নিয়ে পড়ছি।

২| ১২ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ১০:২১

মাহমুদুর রহমান বলেছেন: পোষ্টে ভালো লাগা।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.