নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইতিহাসের পাঠশালায়

আসিফ আযহার

শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়।

আসিফ আযহার › বিস্তারিত পোস্টঃ

ইতিহাসের পাঠশালায়: পর্ব-১০ | বিশ্বজয়ের পথে রোম

১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ১১:৪১


৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তাঁর সেনাপতিরা নিজ নিজ এলাকার শাসনভার গ্রহণ করেছিলেন। অনিবার্য গৃহযুদ্ধের পর সেনাপতিরা নিজ নিজ এলাকায় রাজা হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেন। সিরিয়া অঞ্চলের দখল নেন সেলুকাস নিকাটোর। সেলুকাসের অধীনে সিরিয়া একটি স্বাধীন রাজ্যে পরিণত হয়। এন্টিয়ক ছিলো রাজধানী। সেলুকাসের বংশধরদের বলা হয় সেলুসিড। তাই তাদের রাজ্যকে বলা হয় সেলুসিড রাজ্য। সিরিয়া ও আশপাশের কিছু অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত ছিলো সেলুসিড রাজ্য। এর পাশাপাশি শক্তিশালী রাজ্যের মধ্যে ছিলো টলেমিদের মিসর ও পার্থিয়া (পারস্য)। বর্তমান ইরান অঞ্চলে ছিলো তখনকার পার্থিয়া রাজ্য। জেরুজালেমকেন্দ্রিক ইহুদিদের জুডিয়া রাজ্য ছিলো কখনও টলেমিদের অধীনে আবার কখনও ছিলো সেলুসিডদের অধীনে ।

আলেকজান্ডারের মেসিডোনিয়ান সেনাপতি প্রথম টলেমি মিসরের রাজা হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বংশধরদেরকেও টলেমি নামে ডাকা হয়। তবে তাদের একেকজনের নামের সাথে একেকটি আলাদা উপাধি যুক্ত আছে। প্রথম টলেমি থেকে শুরু করে দ্বাদশ টলেমি আউলেটসের কন্যা সপ্তম ক্লিওপেট্রার সময় পর্যন্ত প্রায় ৩০০ বছর মিসর একটি স্বতন্ত্র রাজ্য ছিলো। প্রথম টলেমি সটার লিবিয়ার পূর্বাঞ্চল, দক্ষিণ সিরিয়া ও সাইপ্রাস দখল করে টলেমি রাজ্যের অর্ন্তভূক্ত করেছিলেন। এমনকি ইজিয়ান সাগরের দ্বীপগুলিও দখল করে গ্রিসের মল ভূখন্ডে সেনাঘাঁটি স্থাপন করেছিলেন।

দ্বিতীয় টলেমি ফিলাডেলফাসের (২৮২-২৪৬ খ্রি.পূ.) সময়ে টলেমি রাজ্য সর্বাধিক বিস্তার লাভ করে। তাঁর আমলেই আলেকজান্দ্রিয়ার কাছে ফারোজ দ্বীপের ঐতিহাসিক বাঁতিঘরটি নির্মাণ করা হয়েছিলো। প্রাচীন সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম এই আলেকজান্দ্রিয়ার বাঁতিঘর। তৃতীয় টলেমি ইউয়েরগেটস (২৪৬-২২১ খ্রি.পূ.) মিসরের প্রতিদ্বন্দ্বী সেলুসিড রাজ্যের কেন্দ্রীয় অঞ্চল সাময়িকভাবে দখল করতে পেরেছিলেন। চতুর্থ টলেমি ফিলোপেটর (২২১-২০৫ খ্রি.পূ.) সেলুসিডদের শক্তিশালী প্রতিআক্রমণ ব্যাহত করতে সমর্থ হন। তাঁর পুত্র পঞ্চম টলেমি ইপিফেইনস (২০৫-১৮০ খ্রি.পূ.) সাবালক হওয়ার আগেই সিংহাসনে বসেন।


চিত্র: সেলুসিড সৈন্য

এ সময়ে কার্থেজের সংগে দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধে রোমানরা জয়লাভ করে। যুদ্ধজয়ী রোম প্রথমেই নাক গলায় মিসরের ব্যাপারে। ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমান সিনেট একটি পুরনো চুক্তির দোহাই দিয়ে নাবালক রাজা পঞ্চম টলেমির অভিভাবক হিসেবে একজন রোমান অভিজাতকে পাঠায় মিসরে। পঞ্চম টলেমির সময়ে মূল মিসরের বাইরের অধীনস্ত অঞ্চলগুলি হাতছাড়া হয়ে যায়। এর মধ্যে অন্যতম ছিলো ইহুদি রাজ্য জুডিয়া। ১৯৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পঞ্চম টলেমি জুডিয়ার কর্তৃত্ব সেলুসিডদের হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।

সিরিয়ার সেলুসিড রাজারা অবশ্য জুডিয়াকে বাগে আনতে যথেষ্ট প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিলেন। এর কারণ ইহুদি বিদ্রোহ। ১৬৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সেলুসিড বংশীয় চতুর্থ রাজা অ্যান্টিওসাস ইপিফানি জেরুজালেমের ধর্মগৃহে সংরক্ষিত ধনরত্ন লুট করায় এবং এ ধর্মগৃহকে গ্রিক দেবরাজ জিউসের মন্দিরে পরিণত করায় ইহুদি বিদ্রোহ শুরু হয়। ম্যাকাবিস পরিবারের নেতৃত্বে ইহুদিরা প্রচন্ড প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং অ্যান্টিওসাসের বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। ইহুদিরা ধর্মগৃহ পুননির্মাণ করে।

রোমানরাও জুডিয়া কব্জা করতে যেয়ে ভয়াবহ প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিলো। শক্তিশালী মিসরকে করদ রাজ্যে পরিণত করতে সফল হলেও ক্ষুদ্র জুডিয়া রোমান সাম্রাজ্যের গলার কাঁটায় পরিণত হয়। ৬৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পম্পেই সেলুসিড রাজ্য জয় করে সিরিয়ান প্রদেশ প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর পম্পেই নজর দেন জুডিয়ার দিকে। জুডিয়াকে রোমের অধীনস্ত দেশের পর্যায়ে নিয়ে আসতে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন। এর ফলে রোমান সাম্রাজ্য মিসরের সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত হলো।

পম্পেই প্রোকনসাল আউলাস গেবিনিয়াসকে সিরিয়ার গর্ভনর নিযুক্ত করে রোমে ফিরে যান এবং জুলিয়াস সিজারের সাথে যৌথভাবে কনসাল নিযুক্ত হন। এ সময়ে মিসরের অজনপ্রিয় ও বিলাসী রাজা দ্বাদশ টলেমি আউলেটস গদি রক্ষার জন্য পম্পেই ও সিজারের দ্বারস্ত হন। ক্ষমতায় রাখার বিনিময়ে পম্পেই ও সিজার আউলেটসের কাছ থেকে মিসরের পুরো বছরের রাজস্ব আয়ের সমপরমাণ অর্থ আদায় করেন। কিন্তু এতে রক্ষা হয় না। কারণ এত বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় করতে গিয়ে আউলেটস কৃষক প্রজাদের উপর করের বোঝা আরও বাড়িয়ে দেন।


চিত্র: রোমান সেনানায়ক পম্পেইর নৌ-সেনাদের ওপর ডাকাত আক্রমণ

পম্পেই ও সিজার ঘরে বসেই যে রাজস্বের অর্থে ভেসে গিয়েছিলেন তার দায় গিয়ে পড়ল মিসরের গরীব প্রজা ও কৃষকদের ওপর। এমনিতেই কর দিতে দিতে তাদের নিজেদের ফলানো ফসলের প্রায় সবটাই চলে যেতো রাজা আর ধর্মীয় পুরোহিতের ভাঁড়ারে। এর ওপর আরও কর চাপিয়ে দিলে তাঁরা বাঁচবে কী খেয়ে? তাই রাজার ক্ষমতা আর পুরোহিতের ধর্মীয় চোখ রাঙ্গানী উপেক্ষা করে তারা বিদ্রোহে নামতে বাধ্য হয়। আলেকজান্দ্রিয়ার নাগরিকরাও আউলেটসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। উপায়ান্তর না দেখে আউলেটস দেশ ত্যাগ করে রোমে পৌঁছেন।

এ সময় সিজার বেরিয়েছেন ইউরোপ জুড়ে লুন্ঠনের উদ্দেশ্যে। পম্পেই আউলেটসকে রোমে অতিথি হিসেবে অভ্যর্থনা জানালেন। আউলেটসের অনুপস্থিতির সুযোগে মিসরের অধিবাসীরা তার জ্যোষ্ঠ কন্যাকে শাসনভার অর্পণ করে। রোমান সিনেট মিসরের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের পক্ষপাতী ছিলো না। ৫৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আউলেটস মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন রোমের সিদ্ধান্তের জন্য। অবশেষে ৫৬-৫৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে সিরিয়ার রোমান গভর্নর প্রোকসনাল গেবিনিয়াস জুডিয়া থেকে আক্রমণ চালিয়ে মিসর দখল করেন ও রোমান পুতুল আউলেটসকে সিংহাসন বসান। এই অভিযানে গেবিনিয়াসের অশ্বারোহী বাহিনীর প্রধান ছিলেন মার্ক এন্টনি। গেবিনিয়াসও মিসরের রাজকোষ থেকে বিপুল অর্থ লুট করেন।

মিসর তখন নামে মাত্র স্বাধীন। রোমানদের চাপিয়ে দেওয়া মাত্রাতিরিক্ত করের অর্থ যোগাতে গিয়ে প্রজাদের জীবন অত্যন্ত দুঃসহ হয়ে ওঠে। ফলে তীব্র জনঅসন্তোষের মুখে গেবিনিয়াস মিসর ত্যাগে বাধ্য হন। আউলেটস তাঁর প্রভুদের হাতে যে অর্থ তুলে দিয়েছিলেন তার ঋণ শোধ করার জন্য প্রজাদের মাথায় দুঃসহ শোষণের বোঝা চাপিয়ে দেন। সকল পুতুল শাসকেরই বৈশিষ্ট্য হলো তারা প্রভুকে সন্তুষ্ট করার জন্য জনগণের মাথায় চাপিয়ে দেয় সকল দুঃখের বোঝা।


চিত্র: নীলনদের মোহনায় আলেকজান্দ্রিয়া নগরী

হাজার হাজার বছরের পুরনো কৃষি জমিতে পরিপূর্ণ মিসর সে সময়ে যথেষ্ট সম্পদশালী ছিলো। অতীতে আলেকজান্ডারের সৈন্যবাহিনী ফিনিশীয়দের বাণিজ্য কেন্দ্র টায়ার ধ্বংশ করার ফলে আলেকজান্দ্রিয়া সেই বাণিজ্যের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিলো। প্রথম ও দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধে রোমানরা কার্থেজকে পরাজিত করলে আলেকজান্দ্রিয়া ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মধ্যসাগরীয় অঞ্চলে অপ্রতিদ্বন্ধী শক্তিতে পরিণত হয়। নীল নদ থেকে খাল কেটে লোহিত সাগরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে পণ্যদ্রব্য সমুদ্রপথে ইথিওপিয়া ও সোমালিয়ায় রপ্তানীর ব্যবস্থাও হয়েছিলো। তাই কৃষির পাশাপাশি মিসরের রাজস্বের অন্যতম উৎস ছিলো ব্যবসা-বাণিজ্য। সেই আমলে ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী দেশগুলির মধ্যে সর্বোচ্চ পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপন্ন হতো মিসরে। রাজস্ব আয়ের বিশাল উৎস ছিলো মিসর।

তাই সম্পদে ভরপুর মিসরের ক্ষমতা নিয়ে অভ্যন্তরীণ মারামারি ছিলো শাসক মহলের স্বাভাবিক চিত্র। এ মারামারিতে যিনি ক্ষমতা থেকে ছিটকে যেতেন বা ছিটকে যাওয়ার মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হতেন, তিনি ভীনদেশী রোমান পরাশক্তির সহায়তা নিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা করতে মোটেও দ্বিধা করতেন না। এজন্য দেশের সার্বভৌমত্ব ভীনদেশী শেকলে বাঁধা পড়লেও তাদের কোন মাথাব্যাথা ছিলো না। কারণ প্রজাদের ঘাড় ভেঙে ঐশ্বর্য্যরে পাহাড়ে বসে লুটেপুটে খাওয়ায় যে আনন্দ তা থেকে বঞ্চিত হওয়ার দুর্ভাগ্যের কাছে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব নিতান্ত তুচ্ছ বিষয় ছিলো তাদের কাছে। তাই রোমান শক্তির সহায়তা নেওয়ার ক্ষেত্রে টলেমি রাজারা সমানে নির্লজ্জ ছিলেন।

অষ্টম টলেমি ইউয়েরগেটস ১৬২ ও ১৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বিদ্রোহী আত্মীয় স্বজনদের সামলানোর জন্য রোমের সহায়তা গ্রহণ করেন। দশম টলেমি আলেকজান্ডার রোমান বিত্তবানদের কাছ থেকে টাকা পয়সা ধার করেন ক্ষমতা পূণর্দখলের জন্য। ৮১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমান কনসাল সূল্লা একাদশ টলেমিকে মিসরের গদিতে বসান। দ্বাদশ টলেমি আউলেটসের কথা তো আগেই বলা হয়েছে। আউলেটস যখন মিসরের ক্ষমতায়, রোম তখন দাস ও প্রলেতারিয়ান বিদ্রোহ এবং ভীনদেশী অর্ধসভ্য যাযাবর জাতিগুলোর আক্রমণের ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে আনতে অনেকটাই সমর্থ হয়েছে। একনায়করা ক্ষমতায় এসে নতুন নতুন দেশ দখলে ঝাপিয়ে পড়েছে। পম্পেই সেলুসিড রাজ্য ও জুডিয়া জয় করে মিসরের সীমানায় পৌঁছে যান। এ অবস্থায় আউলেটস পম্পেইর সেনাবাহিনীর জন্য টাকা পয়সা ঘুষ দিয়ে কোনমতে রাজ্য রক্ষা করেন।

কিন্তু মিসর ছিলো রাজস্ব আয়ে ভরপুর ও বিত্তবান। তাই মিসর দখল করা ছিলো রোমান একনায়কদের জন্য কর্তব্য। ক্রাসাস, পম্পেই ও সিজার তিনজনই মিসর দখল করা কর্তব্য মনে করতেন। কিন্তু এমন সময়ে আউলেটস নিজেই এসে এমন ধরা দিলেন যে তার আর দরকার হলো না। অভ্যন্তরীণ কাড়াকাড়িতে নিজের গদি রক্ষার জন্য সাহায্য চেয়ে আউলেটস পম্পেই ও জুলিয়াস সিজারের সামনে টাকার বস্তা খুলে দিলেন। এই বিপূল পরিমাণ অর্থ সিজার ও পম্পেই ঘুষ নিয়েছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ৫৮ সালে।


চিত্র: ক্লিওপেট্রাকে নিয়ে ইংরেজ চিত্রশিল্পী উইলিয়াম এটির একটি বিখ্যাত চিত্রকর্ম

সিরিয়ার গভর্নর প্রোকনসাল গেবিনিয়াস পরের দফায় ঘুষ নেন এর চেয়েও বেশী। জুলিয়াস সিজার, পম্পেই ও গেবিনিয়াস মিসরের রাজকোষ হতে যে পরিমাণ অর্থ লুন্ঠন করেন তা যে কোনো দেশ দখল হতেও পাওয়া যেতো না। এই লুণ্ঠনের ধারাবাহিকতা আউলেটসের কন্যা সপ্তম ক্লিওপেট্রার সময়েও চলতে থাকে। আউলেটস তাঁর কন্যা সপ্তম ক্লিওপেট্রা ও ত্রয়োদশ টলেমিকে মিসরের সিংহাসনের জন্য উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যান। ক্লিওপেট্রা তাঁর নাবালক ভাইকে বঞ্চিত করে নিজেই ক্ষমতায় জুড়ে বসেন।

খ্রিস্টপূর্ব ৫১ সালে ক্লিওপেট্রা মিসরের সিংহাসনে বসেন। তাঁর সময়েও মিসর রাজস্ব আয়ে পরিপূর্ণ ছিলো। তাঁর আমলে ফেলাহিন নামে মিসরীয় কৃষকের সংখ্যা ছিলো ৭০ থেকে ৯০ লক্ষের মধ্যে। এদের কাছ থেকে যে রাজস্ব আদায় হতো তা লুটে খাওয়ার জন্য রাজমহলে ক্ষমতা নিয়ে কাড়াকাড়ি হওয়াটাই স্বাভাবিক। এ কাড়াকাড়িতে ক্লিওপেট্রা প্রথমে উত্রে যান। টলেমিদের প্রথা ছিলো রাজা ও রাণী মুক্তভাবে সিংহাসনে বসবেন এবং রাজাই হবেন প্রধান ব্যক্তি। এজন্য সিংহাসনের দাবীদার ভাই-বোন কিংবা ছেলে ও মায়ের মাঝে প্রতীকীভাবে বিয়ে হতো রাজা-রানী সম্পর্ক স্থাপন করে যৌথভাবে ক্ষমতা ভোগ করার জন্য।

ক্লিওপেট্রা ১৮ বছর বয়সে সিংহাসনে আরোহন করেন তাঁর ১০ বছর বয়সী ভাইকে বিবাহের মাধ্যমে। কিন্তু তিনি ভাইকে সিংহাসনে আরোহনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেন। ক্লিওপেট্রাও তাঁর বাবার মতই রোমান শাসনের অনুগত ছিলেন। রোম সাম্রাজ্য তখন দেশ জয়ে বিপুল বেগে এগিয়ে যাচ্ছিল। তবে রোমানরা কিছু সংকটের মুখোমুখিও হয়। ৫৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিরিয়ার গর্ভনর থাকাকালীন প্রোকনসাল ক্রাসাস এশিয়া মাইনরের বিথিনিয়া অঞ্চল লুট করতে গিয়ে নিহত হন। সিরিয়ার পূর্বাঞ্চলে পার্থিয়ান (পারসীয়) সাম্রাজ্যের যৌথবাহিনীর আক্রমণে রোমান বাহিনী পরাজিত হয়। ক্রাসাসের পরে সিরিয়ার গর্ভনর নিযুক্ত হন বিবুলাস। সিরিয়ার সীমানার ভেতর থেকে পার্থিয়ান সৈন্যদের উৎখাতে বিবুলাসকে সহায়তা করতে ক্লিওপেট্রা সম্মত হয়েছিলেন।


চিত্র: রোমানদের ব্রিটেন আক্রমণ

ইতোমধ্যে রোমান সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে অন্তর্দ্বন্দ্ব ক্রমেই জোরালো হয়ে উঠছিলো। ত্রয়ী শাসকদের মধ্যে ক্রাসাস মারা গেলে সিজার ও পম্পেই দুজনেই একক আধিপত্য বিস্তারের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেন। রোম, সিরিয়া ও মিসরে পম্পেই প্রভাবশালী ছিলেন। আর জুলিয়াস সিজার ইউরোপ জয় করে বিপুল শক্তির অধিকারী হয়ে উঠেন। গল দেশ অর্থাৎ ফ্রান্স ও জার্মানি থেকে যাযাবর অর্ধসভ্য জাতিগুলোকে বিতাড়িত করে তিনি ইউরোপের মূল ভূখন্ডকে নিরংকুশভাবে রোমান শাসনের অধীনে নিয়ে আসেন। এমনকি ইউরোপের উত্তরের ব্রিটেন উপদ্বীপও তিনি দখলে নিয়ে আসেন। স্পেন তো কার্থেজের সংগে যুদ্ধের সময়েই রোমানদের হস্তগত হয়েছিলো। ফলে দক্ষিণের সিসিলি দ্বীপপুঞ্জ থেকে শুরু করে উত্তরের ব্রিটেন পর্যন্ত ইউরোপের মূল ভূখন্ডজুড়ে রোমান সাম্রাজ্যও বিস্তৃত হলো।

সিজারের দখলের আগে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানিতে কোন সভ্য রাষ্ট্র ছিলো না। ছিলো অর্ধসভ্য শিকারি টিউটন জাতিগুলোর রাজত্ব। দুর্ধর্ষ টিউটনরা সিজারের বাহিনীর সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়। ফলে ইউরোপে নিরংকুশভাবে সভ্যতা বিস্তার লাভ করে। এর আগে বার বার টিউটনরা রোমানদের সভ্য এলাকায় ঢুকে লুটপাট চালাত। এদের ভয়ে রোমানরা সবসময় ভীত থাকতো। দুর্ধর্ষ শিকারি যোদ্ধা জাতি অধ্যূষিত ইউরোপ পুরোপুরি সভ্যতায় প্রবেশ করে সিজারের অভিযানে বিজয়ের মাধ্যমে।

আজকের ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, সুইটজারল্যান্ডে সভ্য জীবনের সুত্রপাত ঘটায় রোমানরা। পুরো ইউরোপকে সভ্যতার বাঁধনে বাঁধেন জুলিয়াস সিজার। অবশ্য রাশিয়া ছাড়া। সভ্যতা বলতে শিকার ও সংগ্রহ অর্থনীতির স্থলে উৎপাদন অর্থনীতিকে বোঝায়। সভ্যতা মানেই যে মানুষের মুক্তির ব্যবস্থা তা নয়; বরং সভ্যতার মানে হলো যাযাবর আদিম শিকারী জীবন ছেড়ে উৎপাদনমূলক অর্থনৈতিক জীবনে প্রবেশ। প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ নয় বরং প্রকৃতিকে নিজের প্রয়োজন মেটাবার কাজে ব্যবহার করাই হলো সভ্যতার মূলমন্ত্র।

তবে মানুষের মুক্তির নিশ্চয়তা সভ্যতা দিতে পারে না। মানুষের এক দলের ওপর আরেক দলের শোষণ-নিপীড়ন সভ্যতার দীর্ঘ ইতিহাসেরই অনিবার্য অংশ। তবুও সভ্যতা এ অর্থে গৌরবের যে তা মানুষকে যাযাবর জীবন থেকে মুক্তি দিয়েছে। জুলিয়াস সিজার ইউরোপ জুড়ে সভ্যতাকে বিস্তৃত করেন। তাঁর প্রভাবে অর্ধসভ্য যাযাবর জাতির অনেকেই সভ্য জীবনে প্রবেশ করেছে। তবে তা মূলত যুদ্ধবন্দী ক্রীতদাস হিসেবে।

ইউরোপ জুড়ে শোষণ ও লুণ্ঠন চালিয়ে সিজার যেভাবে ফুলে ফেঁপে ওঠেন তাতে তাঁর একনায়ক হওয়ার বাসনাটা আরও প্রকট হয়ে ওঠে। অতএব সিনেটের ক্ষমতায় তাঁর একচ্ছত্র প্রতিপত্তি চাই। এক্ষেত্রে তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্ধী অপর কনসাল পম্পেই। তাই সিনেট ক্ষমতায় নিরংকুশ আধিপত্য পেতে হলে পম্পেইকে হটানো প্রয়োজন। পম্পেই নিজেও সিজারকে হটিয়ে একনায়ক হিসেবে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে প্রস্তুত। তাই গৃহযুদ্ধ আবারও অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। সিজারের সমর্থনে আছে রোমান বণিক শ্রেণি আর পম্পেইর সমর্থনে আছে অভিজাত ভূস্বামী শ্রেণি।

লেখক: আসিফ আযহার
শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, শাবিপ্রবি
ই-মেইল: [email protected]
ওয়েবসাইট: http://www.asifajhar.wordpress.com
ফেসবুক: Asif Ajhar, যোগাযোগ: 01785 066 880

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ সকাল ১০:৩২

রাজীব নুর বলেছেন: মিরজাফর পবিত্র কুরআন স্পর্শ করে অঙ্গীকার করেছিলেন যে, তিনি শরীরের একবিন্দু রক্ত থাকতেও বাংলার স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন হতে দেবেন না।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.