নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইতিহাসের পাঠশালায়

আসিফ আযহার

শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়।

আসিফ আযহার › বিস্তারিত পোস্টঃ

ইতিহাসের পাঠশালায়: পর্ব-১২ | রোমান গৃহযুদ্ধ: এন্টনি বনাম অক্টেভিয়ান

১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ৯:২২


৪৪ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে আততায়ীদের আঘাতে জুলিয়াস সিজারের মৃত্যুর পর নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে রোমান রিপাবলিকে পুনরায় ত্রয়ী শাসনের আবির্ভাব ঘটে। সিজারের মনোনীত পোষ্যপুত্র অক্টেভিয়ান, সহকারী মার্ক এন্টনি এবং ধনী বণিক ও সেনানায়ক লেপিডাসের মধ্যে রোমান সাম্রাজ্য ভাগাভাগি হয়ে যায়। সিনেট বাধ্য হয়ে ত্রয়ী শাসনব্যবস্থা মেনে নিয়ে পাঁচ বছরের জন্য পূর্ণ ক্ষমতা তাঁদের হাতে ন্যস্ত করেছিল। ৪২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ত্রয়ী শাসকদের অন্যতম অক্টেভিয়ান মেসিডোনিয়ায় পালিয়ে যাওয়া সিজারের হত্যাকারীদের সৈন্যবাহিনীকে সম্পূর্ণ পরাজিত করেন। অপর ত্রয়ী শাসকদের অন্যতম লেপিডাসকে পম্পেইর পুত্রের সাথে যোগসাজশের সন্দেহে করায় অন্য দুজন তাকে আফ্রিকা এলাকার শাসনভার দিয়ে নিজেরা মূল সাম্রাজ্যের শাসনভার গ্রহণ করেন।


চিত্র: জুলিয়াস সিজারের মৃতদেহের পাশে মার্ক এন্টনি

অক্টেভিয়ান রোমসহ সাম্রাজ্যের সমগ্র পশ্চিমাঞ্চল এবং মার্ক এন্টনি সমগ্র পুর্বাঞ্চলের শাসনভার গ্রহণ করেন। এ ভাগাভাগির পরে মিসরের ক্লিওপেট্রার যোগসূত্র স্থাপিত হয় মার্ক এন্টনির সঙ্গে। এন্টনির সঙ্গেও তাঁর মিলন হয় এবং এন্টনির সন্তানও জন্ম নিয়েছিলো ক্লিওপেট্রার গর্ভে। ৪১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ক্লিওপেট্রা তুরস্কে গিয়ে এন্টনির সঙ্গে দেখা করেন। ৪০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের গোড়ার দিকে পার্থিয়ানরা সিরিয়া দখল করে নেয়। ৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এন্টনি সাময়িকভাবে এথেন্সে তার রাজধানী স্থাপন করেন। এ বছরের শেষ দিকে তিনি পার্থিয়ানদের হাত থেকে তুরস্ক, সিরিয়া ও জুডিয়া উদ্ধারের জন্য সৈন্য প্রেরণ করেন। তারা সফল হয়েছিলো।

খ্রিস্টপূর্ব ৩৮ ও ৩৭ সালে অক্টেভিয়ান পর পর দুইবার পম্পেইর ছেলের সাথে নৌ-যুদ্ধে পরাজিত হলে এন্টনি তাঁর আহ্বানে জাহাজ নিয়ে ইতালিতে পৌঁছান। ১২০টি জাহাজ দিয়ে তাঁকে সাহায্য করতে এন্টনি রাজি হন। এর বিনিময়ে পার্থিয়া দখলের জন্য অক্টোভিয়ানের ২০০০০ সৈন্য দিয়ে এন্টনিকে সাহায্য করার কথা ছিলো। এন্টনি এ সাহায্য পাননি। খ্রিস্টপূর্ব ৩৬ সালে অক্টেভিয়ান আরও একটি নৌ-যুদ্ধে হেরে যান। কিন্তু এন্টনি এর চেয়েও বহুগুণ বেশি বিপর্যয়ের মুখোমুখি হলেন পার্থিয়া আক্রমণ করতে যেয়ে। এ অভিযানে তিনি ভয়ানকভাবে পর্যদুস্ত হয়েছিলেন। এন্টনির এ পরাজয়ের কারণে আরও দেড়শ’ বছর পার্থিয়ান সাম্রাজ্য অপরাজেয় ছিলো।

৪০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে অক্টেভিয়ান ও মার্ক এন্টনির মধ্যকার সন্ধিকে আরও স্থায়ী ও শক্তিশালী করার জন্য অক্টেভিয়ানের বিধবা বোন অক্টেভিয়ার পূণর্বিবাহ হয় মার্ক এন্টনির সাথে। অক্টোভিয়ার গর্ভে এন্টনির একটি কন্যা সন্তানেরও জন্ম হয়েছিলো। কিন্তু এন্টনি ক্লিওপেট্রার সঙ্গে তাঁর বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক অব্যাহত রেখেছিলেন। ৩৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এন্টনি অক্টেভিয়ানের বাহিনীকে জাহাজ প্রদান শেষে ইতালি থেকে ফেরার সময় অক্টোভিয়াকে ইতালিতে রেখেই সিরিয়ায় ফিরে আসেন। এতে অক্টেভিয়ান অপমানিত বোধ করেন। এন্টনি সিরিয়ায় পৌঁছেই ক্লিওপেট্রাকে আসতে খবর পাঠান।

কিন্তু অক্টেভিয়ানের প্রতিশ্রুত সৈন্য পাঠাবার কোন লক্ষণ না দেখে তিনি নিজেই আলেকজান্দ্রিয়ায় চলে যান। উদ্দেশ্য ক্লিওপেট্রার সাথে মিলিত হওয়া ও সামরিক সাহায্য আদায় করা। পুরো শীতকাল তিনি সেখানে ক্লিওপেট্রার সঙ্গে কাটান। ক্রমশ এন্টনির সঙ্গেই ক্লিওপেট্রার ভাগ্য জড়িয়ে যায়। এন্টনির জন্য সামরিক ও আর্থিক সাহায্যের প্রতিদানে তিনি রাজ্যসীমাকে বহুদুর বিস্তৃত করে ফেললেন। বহু নতুন অঞ্চল ও শহর তাঁর শাসনাধীনে চলে আসলো। এককালে মিসরের অধীনস্ত জুডিয়াকে তিনি আবারও হস্তগত করার চেষ্টা করলেন। হেরোদ শাসিত জুডিয়ার অনেক অংশ তিনি এন্টনির বদান্যতায় মিসরের অন্তর্গত করতে পেরেছিলেন। কিন্তু পার্থিয়ায় এন্টনির পরাজয়ে ক্লিওপেট্রার সকল স্বপ্ন বৃথা গেলো। এন্টনির পরাজয় ক্লিওপেট্রার জন্যও ছিলো একটি মহাবিপর্যয়।

এন্টনির ব্যর্থতা অক্টেভিয়ানের রোমান সাম্রাজ্যের একক অধিপতি হওয়ার সম্ভাবনাকে জোরদার করে তোলে। ক্লিওপেট্রা এন্টনির উপপত্নী হিসেবে অক্টেভিয়ানের সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেলেন। এন্টনির সাথে অক্টেভিয়ানের সম্পর্কের অবনতির অন্যতম কারণ ছিলো অক্টেভিয়ানের বোনকে অপমান ও অপদস্ত করে ক্লিওপেট্রার সাথে সম্পর্কে চালিয়ে যাওয়া। এন্টনি পার্থিয়া থেকে সিরিয়ায় ফেরার পরে তাঁর স্ত্রী রোম থেকে এথেন্সে ফিরে আসলেন। কিন্তু তাঁর ভাইয়ের প্রতিশ্রতি ভঙ্গের ঘটনায় ক্ষিপ্ত এন্টনি স্ত্রীকে চিঠি পাঠিয়ে রোমে ফিরে যেতে বলে অপমানের চূড়ান্ত করলেন।

পরবর্তী তিন বছর এন্টনি তার রাজধানী কখনও আলেকজান্দ্রিয়ায় কখনও সিরিয়ার এন্টিয়কে স্থাপন করেছিলেন। এ সময় তিনি ক্লিওপেট্রার সঙ্গ ছাড়েননি। এ সময়ে এন্টনি আর্মেনিয়ায় সফল অভিযান চালিয়েছিলেন এবং মিডিয়ার আনুগত্য লাভ করেছিলেন। ৩৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আর্মেনিয়া থেকে আলেকজান্দ্রিয়ায় ফিরে বিজয় উৎসব পালন করতে গিয়ে এন্টনি রোমানদের ধর্মীয় রীতি ভঙ্গ করেন। কিছু দিন পরে আরেকটি অনুষ্ঠানে এন্টনি, ক্লিওপেট্রা ও তাঁর সন্তানদের জন্য রোমান সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা দান করলেন। এসব খবর রোমে পৌঁছলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ক্লিওপেট্রা রোমের শত্রুতে পরিণত হন।

ক্লিওপেট্রা বিরোধী নানা গুজব ও কাহিনীও রোমে ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন অমূলক ও অসত্য কাহিনীও পল্লবীত হয়ে ওঠে রোমবাসীদের মুখে মুখে। ৩৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে অক্টেভিয়ানের সাথে এন্টনির সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটে। খ্রিস্টপূর্ব ৩২ সালের মে অথবা জুন মাসে এন্টনি অক্টেভিয়ানের বোন অক্টেভিয়াকে ডিভোর্স করেন। এ বছরেও এন্টনি ও ক্লিওপেট্রা একসাথে সময় কাটিয়েছেন তুরস্ক ও এথেন্সে। এন্টনির রাজত্বে ক্লিওপেট্রা রাণীর মতই আচরণ করতেন; বিদেশী অতিথির মত নয়। এ বছরের শেষ দিকে অক্টেভিয়ান ক্লিওপেট্রাকে পরিত্যাগ করার শেষ অনুরোধ জানান এন্টনিকে। এন্টনি এ প্রস্তাবকে পাত্তাই দিলেন না।

ফলে শীঘ্রই অক্টেভিয়ান আনুষ্ঠানিকভাবে ক্লিওপেট্রাকে রোমের শত্রু ঘোষণা দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। আর শত্রুর সাথে মিত্রতার কারণে আইনিভাবে এন্টনিও শত্রুতে পরিণত হলেন। ক্লিওপেট্রার গর্ভে সিজার ও এন্টনির সন্তান জন্ম নেওয়ায় ভবিষ্যতে এরা রোমান সাম্রাজ্যের কর্তৃত্বের দাবিদার হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছিলো। এন্টনির সাথে যেভাবে ক্লিওপেট্রা একীভূত হয়ে গিয়েছিলেন তাতে এন্টনি শাসিত রোমান সাম্রাজ্য ও মিসরের যৌথ নেতৃত্ব ক্লিওপেট্রা ও তাঁর সন্তানদের হাতে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিলো।

এমনকি এন্টনি নাকি রোমান রীতি ভঙ্গ করে আলেকজান্দ্রিয়ায় সমাহিত হওয়ার ইচ্ছাও তাঁর দলিলে ব্যক্ত করেছিলেন। এতে আলেকজান্দ্রিয়া রোমের শক্তিশালী প্রতিদ্বন্ধীতে পরিণত হয়। এমনকি ভবিষ্যতে রোমান সাম্রাজ্য আলেকজান্দ্রিয়ার অধীনে চলে যাওয়ারও আশংকা দেখা দিয়েছিলো। অক্টেভিয়ান রোমবাসীদের অনেককেই বোঝাতে সফল হয়েছিলেন যে আলেকজান্দ্রিয়া রোমের জন্য হুমকিতে পরিণত হচ্ছে। তাই ক্লিওপেট্রাকে সিনেটের মাধ্যমে শত্রু ঘোষণা করা তাঁর জন্য সহজ হয়েছিলো।

তখনও পর্যন্ত সিনেটে প্রতি বছর দুজন কনসাল ও দশ জন করে ট্রিবিউন নিযুক্ত হচ্ছিলেন। পাঁচ বছরের ত্রয়ী শাসনের বৈধতার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় ইতোমধ্যে অক্টেভিয়ান ও এন্টনি কনসালদের অধীন সেনানায়কে পরিণত হয়েছিলেন। কিন্তু রোমান সিনেটের ক্ষমতা খুবই সংকুচিত হয়ে পড়েছিলো সেনানায়কদের দাপটের কাছে। কনসালদের কেউ এন্টনির পক্ষে, আবার কেউ অক্টেভিয়ানের পক্ষে সমর্থন ব্যক্ত করতেন।


চিত্র: অ্যাকটিয়ামের যুদ্ধ

খ্রিস্টপূর্ব ৩১ সালের বসন্তকালে অক্টেভিয়ানের নৌবাহিনী এন্টনির নৌবাহিনীকে আক্রমণ করে। এতে এন্টনির নৌবহরের বিরাট একটি অংশ ধ্বংস হয়। ইউরোপের উপকূলবর্তী এন্টনির শক্তিশালী নৌঘাঁটিগুলো একে একে পরাজিত হয় অক্টেভিয়ানের নৌবাহিনীর শক্তিশালী আক্রমণের কাছে। খ্রিস্টপূর্ব ৩১ সালের ২ সেপ্টেম্বর অ্যাকটিয়াসের নৌঘাঁটির যুদ্ধে এন্টনি ও ক্লিওপেট্রার যৌথ নৌবহর শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। এন্টনি ও ক্লিওপেট্রা ২৩০টি জাহাজের মধ্যে মাত্র ৬০টি জাহাজ নিয়ে মিসরে পালিয়ে যেতে সমর্থ হন।

গ্রিস অক্টেভিয়ানের বশ্যতা স্বীকার করে। ক্লিওপেট্রা ও এন্টনির স্থলবাহিনী উত্তর গ্রিসে আত্মসর্মপণ করে। ক্লিওপেট্রা আলেকজান্দ্রিয়ায় পৌঁছে নতুন সৈন্যবাহিনী সংগ্রহের জন্য ধনসম্পদ কাজে লাগান। তিনি বুঝতে পারেন, তাঁর গর্ভজাত কথিত সিজারের পুত্র সিজারিয়ন ও এন্টনির পুত্র এন্টিলাসকে অক্টেভিয়ান ভবিষ্যতের বিপদ হিসেবে গণ্য করেন। এ দুজনের বয়স ছিলো যথাক্রমে ১৬ ও ১৪ বছর। এ দুজনকে নিরাপদ করার জন্য তিনি ভারতে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। ভারতের সঙ্গে তখন মিসরের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিলো।


চিত্র: ক্লিওপেট্রার মৃত্যু

খ্রিস্টপূর্ব ৩০ সালে সিরিয়ার রোমান গভর্নর অক্টেভিয়ানের পক্ষে যোগদান করেন। এমনকি জুডিয়ার রাজা হেরোদও অক্টেভিয়ানের সাথে আপস করেন। ক্লিওপেট্রা ও হেরোদ মনেপ্রাণে শত্রুতে পরিণত হয়েছিলেন। ক্লিওপেট্রা তাঁর পূর্ব পুরুষদের দ্বারা শাসিত জুডিয়াকে মিসরের অংশ বলে বিশ্বাস করতেন। জুডিয়াকে আবারও মিসরের অংশে পরিণত করার জন্য এন্টনিকে রাজি করাতে তিনি হেন কোন প্রচেষ্টা বাকি রাখেননি।

কিন্তু এন্টনি বারবার সামরিক সাহায্যের জন্য হেরোদের কাছে কৃতজ্ঞ ছিলেন। তারপরেও ক্লিওপেট্রা এন্টনির ঘাড়ে ভর করে হেরোদকে শায়েস্তা করার ক্ষেত্রে প্রচেষ্টায় কোন ত্রুটি রাখেননি। হেরোদকে জুডিয়ার স্বাধীন রাজা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন পম্পেই ও সিজার। হেরোদের সহায়তায় অক্টেভিয়ান নীল নদের ব-দ্বীপ এলাকার মিসরীয় শহর পেলুসিয়াম জয় করে আলেকজান্দ্রিয়ার দিকে এগিয়ে যান।

খ্রিস্টপূর্ব ৩০ সালের ১১ আগস্ট আলেকজান্দ্রিয়ার উপকণ্ঠে অক্টেভিয়ানের বাহিনীর কাছে এন্টনির নৌ ও অশ্বারোহী বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। পদাতিক বাহিনীও যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়ে যায়। বিনা বাধায় অক্টেভিয়ান আলেকজান্দ্রিয়া দখল করে নেন। এরপরে এন্টনি ও ক্লিওপেট্রার জীবনাবসানের করুণ ইতিহাস নিয়ে নানা কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। তবে সকল কাহিনী থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় তাঁরা উভয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন।

ক্লিওপেট্রা ও এন্টনির আত্মহত্যার করুণ ঘটনাটি ইতিহাসের অন্যতম নাটকীয় অধ্যায়। শোনা যায়, এন্টনির মৃত্যু সংবাদ পেয়ে অক্টেভিয়ান কেঁদেছিলেন। ক্ষমতা নিয়ে হাজারও সংঘাতের পরেও হয়ত অক্টেভিয়ান ভুলতে পারেননি এন্টনি ছিলেন তাঁর পালক পিতা জুলিয়াস সিজারের অকৃত্রিম বন্ধু ও সহকর্মী এবং ত্রয়ী শাসক হিসেবে অনেক ক্ষেত্রে তাঁর নিজেরও সহকর্মী। এছাড়াও বিচ্ছেদ হলেও তো তিনি একসময়ে ছিলেন বোনের স্বামী।

এন্টনির মৃত্যুর কয়েকদিন পর ১২ আগস্ট ক্লিওপেট্রা আত্মহত্যা করেছিলেন। জানা যায়, অক্টেভিয়ান নাকি ক্লিওপেট্রার করুণ মৃত্যু চাননি। তিনি ক্লিওপেট্রার সঙ্গেঁ সাক্ষাৎ করে তাঁকে সান্তনাও দিয়েছিলেন। সাক্ষাৎকালে ক্লিওপেট্রা অক্টেভিয়ানের স্ত্রী ও বোনের জন্য নাকি উপহার পাঠাবার আগ্রহও প্রকাশ করেছিলেন। অক্টেভিয়ানের বোনকে তিনি একদা এন্টনির কাছ থেকে বঞ্চিত করেছিলেন। ক্লিওপেট্রা এন্টনির শোক ভুলতে পারেননি। তাই শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করেন।


চিত্র: অগাস্টাস সিজারের ভাস্কর্য

অক্টোভিয়ানের উদারতার কারণ হয়ত তিনি আশংকা করেছিলেন ক্লিওপেট্রা আত্মহত্যার সাথে সাথে তাঁর মূল্যবান ধনসম্পদ আগুনে পুড়িয়ে ফেলবেন। ক্লিওপেট্রার ধনসম্পদ হস্তগত করার উদ্দেশ্যেই তিনি মিসর দখল করেছিলেন। তাঁর উদারতার ঘটনার ঐতিহাসিক সত্যতা নিশ্চিত হওয়া যায় না। প্রাচীন কাহিনীকার ডিয়ো ক্যাসিয়াস জানান, ক্লিওপেট্রা কিভাবে মারা যান তা কেউ জানে না। ক্লিওপেট্রার মৃত্যুর ৭৫ বছর পর জন্মগ্রহণকারী গ্রিক ইতিহাসবিদ প্লুতার্ক বিভিন্ন কাহিনীর কথা উল্লেখ করেন। ক্লিওপেট্রার মৃত্যুর কারণ সম্বন্ধে তিনিও কোন সঠিক সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারেননি।

ক্লিওপেট্রা তাঁর পুত্রদেরকে তাদের শিক্ষকদের সাথে ভারতের পথে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। পুত্র সিজারিয়ন তাঁর শিক্ষক রোডেনের পরামর্শে কিছুদুর যাওয়ার পরে আবার আলেকজান্দ্রিয়ায় ফিরে আসে। অপর পূত্র এন্টিলাসের শিক্ষক থিওডোরাস তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন। অক্টোভিয়ানের নির্দেশে দুই পুত্রকেই ধরে এনে হত্যা করা হয়। এন্টিলাস ছাড়া এন্টনির অন্যান্য তিন স্ত্রীর গর্ভে জন্ম নেওয়া ৭ সন্তানকে অক্টেভিয়ান রোমে নিয়ে তাঁর পরিবারের সদস্যদের মতই লালন পালন করেছিলেন।

ক্লিওপেট্রার মৃত্যুর আগেই অক্টেভিয়ান আলেকজান্দ্রিয়ায় নিজেকে মিসরের অধীশ্বর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। এভাবে টলেমি বংশের শাসনের প্রায় তিনশ বছর শেষে মিসর তার স্বাধীন সত্ত্বা সম্পূর্ণভাবে হারালো। অক্টেভিয়ান মিসরকে একটি রোমান প্রদেশে পরিণত করেন। অক্টেভিয়ান রোমের প্রচলিত রীতি অনুযায়ী মিসরকে সিনেটের শাসনাধীনে না রেখে সরাসরি নিজের শাসনাধীনে রাখেন। অক্টেভিয়ান ছিলেন জুলিয়াস সিজারের বোন প্রথম জুলিয়ার পৌত্র। সিজার পোষ্যপুত্র হিসবে তাকেই উত্তরাধিকারী মনোনীত করেছিলেন।

ক্লিওপেট্রার গর্ভজাত সিজারিয়ন জুলিয়াস সিজারের পুত্র হওয়া সত্ত্বেও সে বিদেশী হওয়ায় রোমান আইন অনুযায়ী তাকে সিজার উত্তরাধিকারী হিসেবে ঘোষণা করতে পারেননি। সিজারিয়নকে হত্যা করে অক্টেভিয়ান আরও নিশ্চিন্ত হন। অক্টেভিয়ান রোমান সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। ১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রলেতারিয়ানদের নেতা ট্রিবিউন সেটারনিনাসের পরাজিত হওয়ার পর শুরু হওয়া রোমান গৃহযুদ্ধ টানা ৭০ বছর ধরে চলার পর অক্টেভিয়ানের একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সাময়িকভাবে বন্ধ হয়। প্রায় পাঁচশ বছরের পুরোনো রোমান প্রজাতন্ত্রও বিলুপ্ত হয় স্থায়ী সামরিক একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে।


চিত্র: অগাস্টাস সিজারের আমলের মুদ্রা

খ্রিস্টপূর্ব ২৭ সালে রোমান সিনেট অক্টেভিয়ানকে ‘অগাস্টাস’ অর্থাৎ ‘পবিত্র ব্যক্তি’ উপাধিতে ভূষিত করে। তখন থেকে তিনি অগাস্টাস সিজার হিসেবে পরিচিত হন। গেইয়ান অক্টোভিয়ান থেকে অগাস্টাস সিজারে পরিণত হওয়ার পর তিনি রোমান সম্রাটের ভূমিকায় আবির্ভূত হন। ৫০৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমান রাজতন্ত্রের পতনের পরে অগাস্টাস সিজারই প্রথম রোমান সম্রাট হয়ে দেখা দেন। সিনেট প্রজাতন্ত্রের কার্যকারিতা চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যায়। রাজতন্ত্রী শাসনে আবারও বাঁধা পড়ে রোমান সাম্রাজ্য। থেকে যায় পাঁচশ বছরের প্রজাতন্ত্রী সিনেট শাসনের ইতিহাস।

ল্যাটিন ভাষার বিখ্যাত কবি ভার্জিল ও হোরেসের আবির্ভাব ঘটেছিলো অগাস্টাসের সময়েই। তাই সাহিত্যের ইতিহাসে এই যুগকে অগাস্টীয় যুগ বলা হয়। ভার্জিল ট্রয় যুদ্ধের অন্যতম বীর ইনিয়াসের কাহিনী নিয়ে লিখেছিলেন বিখ্যাত মহাকাব্য- ইনিড। অগাস্টাসের মৃত্যু হয় ১৪ সালে। দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে তাঁর শাসনে রোমান সামাজ্য মোটামোটি স্থিতিশীল অবস্থায় পৌছায়। খ্রিস্টীয় ক্যালেন্ডারের ১ সাল অতিক্রম করছে তাঁর শাসন কাল। ক্যালেন্ডারে তাঁর নামে অগাস্ট মাসের নামকরণ হয়েছে।

অন্যান্য মাসের নামকরণ করা হয়েছে বিভিন্ন রোমান দেব-দেবীর নাম ও সংখ্যা থেকে। মিসরীয় ক্যালেন্ডার সংস্কার করে উন্নত বার্ষিক ক্যালেন্ডার প্রবর্তন করেছিলেন জুলিয়াস সিজার। জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারেই খ্রিস্টীয় ক্যালেন্ডারের উদ্ভব। খ্রিস্টীয় ক্যালেন্ডারে ১২ মাসের নাম এসেছে নিম্নোক্ত উৎস থেকে :

জানুয়ারি: রোমান দেবরাজ জুপিটারের স্ত্রী জুনোর নামে।
ফেব্রুয়ারি: পবিত্রতার প্রতীক ফেব্রুয়ারিয়াসের নামে।
মার্চ: যুদ্ধের দেবতা মারসের নামে।
এপ্রিল: ল্যাটিন ভাষায় এপ্রিলাস মানে ফুল-ফুটা। এ মাসে ফুল ফুটত।
মে: প্রধান দেবতা মাইয়াস জুপিটারের নামে।
জুন: জুনিয়াসের নামে।
জুলাই: জুলিয়াস সিজারের নামে।
অগাস্ট: অগাস্টাস সিজারের নামে।

ল্যাটিন ভাষায় সাত, আট, নয় এবং দশকে বলা হয় সেপ্টাম, অক্টো, নভেম এবং ডেসিম। এই শব্দগুলো থেকে বাকি চারটি-মাসের নাম রাখা হয়েছে। গ্রহের নামকরণেও নিম্নরূপ রোমান প্রভাব প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

মার্কারি (বুধ): রোমান ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী মার্কারি ছিলেন দেবতাদের দূত।
ভেনাস (শুক্র): দেখতে সুন্দর গ্রহটির নাম ভেনাস। ভেনাস ছিলেন সুন্দরের দেবী।
মারস (মঙ্গল): লাল রঙের গ্রহটির নাম মারস। মারস ছিলেন যুদ্ধের দেবতা।
জুপিটার (বৃহস্পতি): সবচেয়ে বড় গ্রহ । সবচেয়ে বড় ও প্রধান দেবতা ছিলেন জুপিটার।
স্যাটার্ন (শনি): রোমান কৃষি দেবতা স্যাটার্ন।
নেপচুন: সমুদ্রের দেবতা, জুপিটারের ভাই।
প্লুটো: জুপিটারর ভাই, পাতালে থাকেন।

লেখক: আসিফ আযহার
শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, শাবিপ্রবি
ই-মেইল: [email protected]
ওয়েবসাইট: http://www.asifajhar.wordpress.com
ফেসবুক: Asif Ajhar, যোগাযোগ: 01785 066 880

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ১০:৪০

স্বপ্নের শঙ্খচিল বলেছেন: ইতিহাস কখনো ক্ষমা করে না,
আবার ইতিহাস আমাদের পথ দেখায় ।

২| ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ ভোর ৬:৪৮

উম্মু আবদুল্লাহ বলেছেন: এন্টনির মত বীর যোদ্ধাও পরাজিত হতে পারেন! ক্লিওপেট্রার কারনে তার এই পতন হয়েছিল। এরকম বীর যোদ্ধা আর কৌশলী রাজনীতিবিদ এভাবে প্রেমে পড়ে সব কিছু বিসর্জন দেবেন তা খুব বিষ্ময়কর। মানুষের মন বড়ই বিচিত্র।

৩| ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ ভোর ৬:৫২

উম্মু আবদুল্লাহ বলেছেন: ক্লিওপেট্রার মৃত্যুর যে কারন দিলেন তা নিয়ে মনে হয় বিতর্ক রয়েছে। ক্লিওপেট্রাকে অক্টেভিয়ান ক্ষমা করেন নি। তিনি জন সমক্ষে ক্লিওপেট্রাকে চুনকালি দেবার পক্ষপাতী ছিলেন। ক্লিওপেট্রার মত সম্রাজ্ঞীর জন্য এটা চেয়ে মৃত্যুও ভাল ছিল। যার ফলে তিনি আত্মহননকে বেছে নিয়েছিলেন।

৪| ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ সকাল ৮:২১

রাজীব নুর বলেছেন: যিশুর জন্মের আগের কাহিনি গুলো আমাকে ভীষন অবাক করে!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.