নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি হয়তো মানুষ নই, মানুষগুলো অন্যরকম, হাঁটতে পারে, বসতে পারে, এ-ঘর থেকে ও-ঘরে যায়, মানুষগুলো অন্যরকম, সাপে কাটলে দৌড়ে পালায়। আমি হয়তো মানুষ নই, সারাটা দিন দাঁড়িয়ে থাকি, গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকি।

বাগান বিলাস

যাপিত জীবনকে নিয়ে ভাবনার অনেক উপাদান আছে। তবে সবকিছু ভাবতে পারি না। ভাবার সুযোগ পেয়েও অনেক অনুষঙ্গ নিজ প্রয়োজনে এড়িয়ে গেছি। অনেক বিষয়ে পরে ভাবা যাবে বলে ঐ পরিচ্ছেদে আর কখনও যাওয়াই হয়নি। তবে বারংবার আমি প্রকৃতির কাছে ফিরে গেছি। তার কাছে শিখতে চেয়েছি। প্রকৃতিও শেখালো ঢের। তবুও হয়তো আমার প্রত্যাশা ও শিখনফলে আছে হতাশা । ইচ্ছা ও প্রাপ্তির খতিয়ান খুব একাকী মিলিয়ে দেখি-কত কিছুইতো হলো না দেখা, হলো না কত শেখার শুরু । তবুও প্রাপ্তি কি একেবারেই কম? মোটেই না। পেয়েছিও ঢের। মনে তাই প্রশ্ন জাগে, যেদিন আমি আবার নিঃশ্বেস হয়ে যাব সেদিন কি প্রকৃতিও আমার মতো একা হয়ে যাবে? এর জবাবও প্রকৃতির বিবৃতিতেই পেয়েছি-না, ক্ষুদ্র জীবনের আঁচর প্রকৃতিতে বেশিক্ষণ মূর্ত থাকে না। অন্যকথায় প্রকৃতির মধ্যে বিষণ্নতা বেশি দিন ভর করে থাকে না। তাই সে সহজ, তাই সে সমাদৃত! আমার বিবেচনায় একারণে প্রকৃতি সকল জীব ও জড়ের কাছে সবচেয়ে বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

বাগান বিলাস › বিস্তারিত পোস্টঃ

দেবদাসঃ সময়ের জীবন্ত ছাপচিত্র

১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৩:৪৫



(মুক্তিযুদ্ধ ক্ষেত্রে একুশে পদক প্রাপ্ত অধ্যাপক মজিবর রহমান দেবদাস। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় যাকে উপাধি দিয়েছিলেন ‘জীবন্ত শহীদ বুদ্ধিজীবী’। আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।)

মধ্যরাত হয়েছে। শিশির ভেজা গ্রামীণ হেমন্তের মাথার উপর স্নিগ্ধ আকাশ। আধো অন্ধকারে ঢাকা টানা বারান্দা। হালকা শীত পডেছে। চাদর মুড়ি দিয়ে এক বয়োবৃদ্ধ চুপচাপ বারান্দায় বসে আছেন চেয়ারে। ঘুমাতে যাননি তিনি। চোখ বন্ধ, ডান হাতের আঙ্গুলে কি যেন গুনছেন মনে মনে। এক দুই তিন চার…এক দুই…। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের প্রাক্তন অধ্যাপক। অধ্যাপক মজিবর রহমান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে গণিতে এম.এ এবং পরে অস্ট্রেলিয়ার মেলর্বোন ইউনিভার্সিটি থেকে এ্যাপ্লাইড ম্যাথামেট্রিক্সে এম.এস-সি ডিগ্রি অর্জন করেছেন।

গণিতের জ্ঞানকে প্রসারিত করার জন্য ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত করাচির সেন্ট্রাল সরকারি কলেজে শিক্ষাকতা করেছেন। এ পর্যন্ত খুব সাদামাটা একটি গল্প। আর দশজনের জীবনের সাথে এর মিল পাওয়া যাবে। এর পরের অংশটি গ্যাণিতিক সমীকরণের মতো সহজে মিলানো যাবে না। নাইট্রিক এসিডে পোড়ানো খাঁটি সোনার মতো,সহজ প্রক্রিয়া কিন্তু রাসায়নিক ও মানবিক শ্রেষ্ঠত্বের পীরক্ষা।

পশ্চিম পাকিস্তান তার ভালো লাগে না। কী যেন একটানে তিনি সেখানে গাড়ি-বাড়ী, সুখ-স্বাচ্ছন্দের অতীত ফেলে চলে এলেন নিজ ভূখন্ডে,পূর্ব পাকিস্তানে। অন্য চাকুরি নয় জ্ঞানের বিতরণই তার পছন্দ। দেখা করলেন তার প্রিয় শিক্ষক বগুড়া আজিজুল হক কলেজের তার সময়ের অধ্যক্ষ জ্ঞান তাপস ড. মুহম্মদ শহিদুল্লাহ্ এর সাথে। প্রিয় শিক্ষক প্রিয় ছাত্রকে পেয়ে পুলকিত হলেন। জানলেন মজিবরের পশ্চিম পাকিস্তান ছেড়ে আসার কথা। প্রিয় ছাত্রকে দেখতে চাইলেন ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয়ে। শিক্ষকতা যখন করবে তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালই উপযুক্ত। কিন্তু কোথায় যেন বাধা, কোথায় যেন দ্বিধা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের।

অধ্যাপক মজিবর রহমান চরম আত্নমর্যাদাবান। কারো উদাসীনতা, অনুকম্পা তার পছন্ত নয়। ফিরে এলেন। অবশেষে ড. মুহম্মদ শহিদুল্লাহ্ এর পরামর্শ দিলেন রাজশাহীতে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে, ওখানেই যোগ দাও। অধ্যাপক মজিবর রহমান ১৬ অক্টোবর, ১৯৬৭ সালে যোগ দিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে সিনিয়র লেকচারার হিসাবে। শুরু হলো অধ্যাপনা, জ্ঞানের আলো ছড়ানো কাজ । তিনি তো শুধুই গণিতের শিক্ষক নয় তুলনামুলক ধর্মশাস্ত্র,দর্শনের ও মেধাবি ছাত্র। ম্যাট্রিক, ইন্টারমিডিয়েট ও বিএ তে বোর্ডের মেধা তালিকায় স্থান পাওয়া এ অধ্যাপক জীবন দর্শনের নতুন ক্ষেত্র খুঁজতে থাকলেন। ধর্ম নিয়ে তার চিন্তা ভাবনার অন্ত নেই। সময় কেটে গেল অনেকটা। যৌবনের মধ্য দপুরের ছায়া হেলে গেল পশ্চিমে। তিনি থেকে গেলেন অকৃতদার। পরিছন্ন মনের নিপাট ভদ্রলোকটি পাকিস্তান রাষ্ট্রের বৈষমমূলক নীতিতে পূর্ব পাকিস্তানের আর সকল মানুষের মতোই তিনি ক্ষুদ্ধ ছিলেন। পশ্চিম, পাকিস্তানে থাকাকালে পূর্ব পাকিস্তানের লোকের প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিলের দৃষ্টিভঙ্গি তাকে আহত করে। তিনি অনেকাটা ভবিষ্যত দ্রষ্টার মতো বলতে থাকলেন, পাকিস্তান টিকবে না। আর এর মূল কারণ শুধুই অর্থনিতি ও সংস্কৃতির বৈষম্য নয় দৃষ্টি ভঙ্গির বৈপরীত্য ও অন্যতম। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা দাবি পূর্ব পাকিস্তানে দাবি আদায়ের আবহ তৈরি করলো। ১৯৬৯ সালের আগরতলা মামলা রাজনিতকে দাবি আদায়ের অস্ত্রে পরিণত করলো। ১৯৭০ সালের নির্বাচন হলো। পূর্ব পাকিস্তানের নিরংকুশ বিজয়, ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা হস্তান্তরে অনিহা, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং সকল অনাচরের প্রতিবাদে শুরু হওয়া মুক্তিযুদ্ধ ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিল স্বাধীনতা যুদ্ধের।

অধ্যাপক মজিবর রহমান গতানুগতিক মানুষের মতো নয়। নিজের বিবেকের বিরুদ্ধে অবস্থান নেননি কখনও। মুক্ত মনের এ মানুষটি যা ভালো মনে করেছেন, ন্যায় ও সংগত মনে করেছেন তা আর কারও পছন্দ হোক বা না হোক তিনি তা স্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ করেছেন। তবে রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি ও ধর্ম নিয়ে তার প্রকাশ ছিল পরিমিত। তিনি যতুটুকু চাইতেন ততটুকুই। এরপর কেউ শত-সহস্র প্রশ্নবানে বিদ্ধ করলেও আর কোন কথা বলবেন না। আসলে তার চরিত্রটাই এরকম। দুর্বোধ্য, সহজে অনুপ্রবেশযোগ্য নয়।

পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তান যুদ্ধের সব আলামতই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ক্রমশঃ। অধ্যাপক মজিবর রহমান তখন বসবাস করতেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জুবেরী হাউজে। সঙ্গে আরও কয়েক জন শিক্ষক। সন্ধার পর ক্লাবে জমতো আড্ডা। তবে খুব সংক্ষেপে। সর্তকতার সাথে রাজনীতি নিয়ে আলোচনা হতো। বলা যায় না, দেয়ালেরও কান আছে। তার চেয়ে মুখে কুলুপ এঁটে থাকা ভালো। তিনি মাঝেমধ্যে সে আলোচনায় যোগ দিতেন। বিরবির করে কি যেন আপন মনে বলতেন। প্রচন্ড মেধ্যাবী ও সল্পভাষি দু’একটি মন্তব্য করতেন যা সবার দৃষ্টি কাড়তো। সহজবোধ্য নয় বলে তার আলাদা একটি ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠেছিল।

২৬ মার্চ, ১৯৭১ সাল। সকালে জুবেরী হাউজের আবাসিক ঘরের দরজায় টকাটক শব্দ। চোখ মুছতে মুছতে দরজা খুলতেই সবার পা কাঁপতে থকে। এ যে সাক্ষাৎ যমদূত! রাইফেল উঁচিয়ে পাকিস্তানী সৈন্য বাহিনী । তারা অধ্যাপকদের ঘর থেকে বের করে লাইন করে সামরিক কায়দায় হাঁটিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন ভিসির বাসভবনের দিকে। পথে মজিবর রহমান বলে উঠলেন, মুহাম্মদ নামে একজনের জম্ম হয়েছিল মানব জাতির কল্যাণের জন্য। এরপর মুহাম্মদ নামে যত মানুষের জম্ম হয়েছে তারা চোর, বদমাশ ও গুন্ডা। জোয়ানদের এত ঐদ্ধত্ত পছন্দ হলো না। লাথি মারলো বুটের। তিনি পড়ে গেলেন মাটিতে। টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হলো ভিসির বাংলোয়। ভিসি প্রত্যয়ন করলেন এরা শিক্ষক। ভাগ্যগুণে এ যাত্রায় বেঁচে গেলেন তিনি।
দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তেমন একটি গড়ে ওঠেনি। অকস্মাৎ আক্রমনের স্বীকার পূর্ব পাকি¯তান খানিকটা হতবিহ্বল। জ্বলছে দাউদাউ আগুন। হত্যা,ধর্ষণের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান বাহিনী ‘এদেশের মানুষ চাইনা ,মাটি চাই’-ইয়াহিয়ার এ ঘোষণাকে প্রতিপালন করছে। ইতোমধ্যে পাকবাহিনী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সামরিক ঘাঁটি গেড়েছে। জোহা হল তৈরী হয়েছে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে।

বিষয়টি পছন্দ হলোনা মজিবর রহমানের। হজম করতে পারলেন না তিনি এ অনাচারের। যখন সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান আগ্রাসী পাক বাহিনীর বন্দুকের নিচে অসহায়, চারদিক মৃত্যপুরি, যত্রতত্র লাশের মিছিল, কুকুরও রাস্তা দিয়ে হাঁটতে ভয় পায় তখন অধ্যাপক মজিবর রহমান এ হত্যার বিরুদ্ধে দৃঢ় ভাষায় প্রতিবাদ স্বরূপ তিনি মজিবর রহমান নাম ত্যাগ করে ‘দেবদাস’ নাম গ্রহণ করলেন। পরবর্তীতে তার সাথে আলাপচারিতায় জেনেছি দেবদাস বা দেবের দাস ও মজিবর সমার্থক। অর্থাৎ তিনি নামের অর্থ ঠিক রেখে আরবি/মুসলিম নাম ত্যাগ করে বাংলা নাম, অনেকের দৃষ্টিতে হিন্দু নাম গ্রহণ করলেন। যে সময় নন-মুসলিমরা নিজ নাম গোপন করে মুসলিম নামে নিজেদের পরিচয় দিচ্ছেন, পাকবাহিনী নন-মুসলিম পেলেই গনহারে হত্যা করছে, সে সময়ে তিনি মুসলিম নাম ত্যাগ করে হিন্দুয়ানি নাম নিয়ে প্রতিবাদ করলেন পাকি¯তানের হত্যাযজ্ঞের, একি কোন স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে সম্ভব ? মজিবর রহমানের মাথা কি ঠিক আছে ? অথচ তিনি যেন নির্বিকার, অবিচল। সত্য প্রকাশে উচ্চকিত মশাল। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে এক ঐতিহাসিক পত্র লিখলেন-

DEPARTMENT OF MATHAMATICS
RAJSHAHI UNIVERSITY

MAY 10, 1971

This is to inform the authority that I am going to leave the Campus since the University Campus has, at the moment, been degraded to the state of military camp. I may come to the campus when university regains its status of sanctity and starts functioning as a university in the true sense and when…. I hope to be kept informed about situation here in the address noted below, where I hope to spend these days of calamity, genocide and freedom movement.
Please note change of my name and new name should be used in future communications.

Sd/-D.Das
Devdas (দেবদাস)
10.5.71

Vill .Maharul
P.O.Bogra- P.batipur
Dt. Bogra
East Bengal.

জয়তু দেবদাস।
জয়তু এক সাহসী বাঙ্গালীর। স্বাধীনাতা যুদ্ধকালে শক্তিশালী পাকি¯তান বাহিনীর বন্দুকের নলের মুখে অনন্য সাহসিকতার সাথে বুক চেতিয়ে সামরিক বাহিনীর আগ্রাসন, গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য।
জয়তু দেবদাস। সমগ্র বাঙ্গালীর পক্ষে প্রতিরোধের এ পরীক্ষা দেয়ার জন্য।
উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালের ২৯ এপ্রিল চিঠিটি the wave পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

এর পরের ঘটনা এখন ইতিহাস।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার এ চিটি তৎক্ষণাত পাঠিয়ে দেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী আর্মি ক্যাম্পে। এমন পরমানু বোমার মুখোমুখি হয়ে হতবম্ভ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পের পাক কমান্ডার। ফরমান হলো, Capture.
অপর দিকে তার বিভাগের সহকর্মী বন্ধু ড. সুব্রত মজুমদার সহ বন্ধু পরিবারের সকলেই তাকে অনুরোধ করলেন তাদের সাথে ভারতে চলে যাওয়ার জন্য। ড. মজুমদার তাকে বুঝাতে চাইলেন এখন তার দেশে থাকাটা ঠিক হবেনা। বিপাদের সমূহ সম্ভবনা রয়েছে। অধ্যাপক মজিবর রহমান স্পষ্ট ভাষায় জানালেন, তিনি কোন অন্যায় করেননি। দেশ ছেড়ে যাবেন না। মৃদুভাষী অধ্যাপকের এ বক্তব্যকে কেউ যুক্তি দিয়ে অতিক্রম করতে পারলেন না। উল্টো মজিবর রহমান ড. মজুমদারকে অনুরোধ করলেন, আপনারা চলে যান। জুবেরী হাউজে বাবুর্চি নেই, রান্না-খাওয়া সমস্যা। বরং এখানেই একটা রুমে থেকে যাই। নিজে রান্না করে খাওয়া যাবে। শিউরে উঠলেন ড. সুব্রত মজুমদার। এখন যেখানে পাক বাহিনী হিন্দুর গন্ধ পেলেই খতম করছে, পুড়িয়ে দিচ্ছে সবকিছু, সেখানে হিন্দু নাম গ্রহণ করে হিন্দু অধ্যাপকের বাসায় অবস্থান ? ঘোরতর বিপদ। সুহৃদ অধ্যাপক রহমানকে তার বাসায় মৃত্যুর মুখে ফেলে দিয়ে চলে যাবেন পরিবারসহ ভারতে? মন সায় দিলোনা। অন্য দু-একজন বন্ধুও অধ্যাপক রহমানকে বুঝাতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু তার সাফ কথা, তিনি দেশ ছেড়ে যাবেন না।

১২এপ্রিল, ১৯৭১ সাল। সকাল বেলা। ক্যাপ্টেন রিজভীর নেতৃত্বে একদল সশস্ত্র পাক বাহিনী ঘেরাও করলো ড. সুব্রত মজুমদারের বাসা।
ক্যাপ্টেন জিজ্ঞাসা করলেন, what is your name?
Devdas. নির্বিকার জবাব।
ক্যাপ্টেনের পুনরায় প্রশ্ন, what do you mean by genocide?
অধ্যাপক দেবদাস ভাত রান্না করছিলেন। অবিচল জানালেন, that which you are committing these days!
এই চপোটাঘাত পাক ক্যাপ্টেনের পছন্দ হবে কেন? তৎক্ষণাৎ তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কনসেনট্রেশন ক্যাম্প, জোহা হলে, নিয়ে যাওয়া হলো। ভাত খাওয়া হলোনা দেবদাসের। ভাত না জুটলেও সেখানে জুটলো মুহুর্মুহ নির্যাতন, বর্বর নিগ্রহ। দিনের পর দিন দিন বন্দি রেখে চোখের নীচে সুঁচ ফুটিয়ে, ডানা উল্টিয়ে দেয়ার চেষ্টা। রড় দিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে কথা আদায়ের চেষ্টা। আর ঘৃণাভরে উপহাস। বলা হতো, তোমাদের মতো লোকেরাই যতো ঝামেলা বাধাও।

এরপর শুরু হলো দেবদাসের মৃত্যু মহড়া। চোখ বেঁধে নেয়া হলো পাবনাসহ অনেক অচেনা জায়গায়। সহযাত্রীর সবাইকে ওরা সারি করে গুলি ছুড়ে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে, উল্ল¬াস করে। তাকেও লাইনে দাঁড় করানো হয়। তিনি বলে উঠলেন, ইউরাল পর্বতের ওপার থেকে একটি দল আসছে। এর মানে কি? হানাদারের কপালে ভাজ। রাশিয়া? না, এখানেই শেষ করা যাবে না। তথ্য থাকতে পারে। পুনরায় তাকে নেয়া হলো ক্যাম্পে। আবার শুরু হয় অকথ্য গলাগাল, নির্যাতন। নির্যাতন করে করে তথ্য উদ্ধার, এরপর নিকাশ। এ হয়তো তাদের ইচ্ছা ছিল।

এরপরের ঘটনা গুলো স্পষ্ট নয়। তিনি নিজেও এসব বিষয়ে সব কিছু বলতে চাননা। তাকে রাখা হয় নাটোর জেলে ডিটেনশনে। বিশ্ববিদ্যলয়ে রক্ষিত ফাইলে লে: ক: সুজাউদ্দিন বাটের ৫সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ খ্রিঃ তারিখে স্বাক্ষর করা সার্টিফিকেটে তা স্পষ্ট হয়।
অধ্যাপক মজিবর এখন দেবদাস। তিনি নিজেকে দেবদাস নামেই পরিচয় দিতে থাকেন। ছাড়া পেয়ে তিনি পুনরায় যান জোহা হলে। পাক সেনাদের উদ্দেশ্য চিৎকার করে বলতে থাকেন, আমার স্যুটকেস ফেরৎ দাও। ওখানে আমার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রয়েছে।

না। দেবদাস আর কিছুই ফিরে পাননি। ফিরে পাননি তার সূক্ষ্ণ স্মৃতিশক্তি। দীর্ঘদিন নির্যাতনের স্বীকার হয়ে স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে যান এবং কথাবার্তায় অসংলগ্নতা আসে। চোখ খুলে, চোখ বদ্ধ করে, স্বপ্নে চারদিকে শুধু লাশের সারি দেখেন। গণিতের শিক্ষক পরিনত হন গণনাকারে। হাতের আঙ্গুলে গুনতে থাকেন এক দুই…। বলতে থাকেন, আজ ওখানে এতোজন মরেছে, কাল ওখানে এতোজন মরেছে। হাসতে হাসতে বলেন, অমুকতো অতো তারিখে মারা গেছে। এখন অমুকের বদলায় আর একজন এসেছে। সবকিছু কেমন যেন গোলমেলে।

আরো গোলমাল বাধে যখন মুক্তিযুদ্ধ শেষে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে যোগ দিতে যান। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানান, দেবদাস নামে কোন শিক্ষক এ বিভাগে ছিলোনা। তিনি নাম পরিবর্তনের এফিডেফিট জমা দেন। এরপরও গ্রেফতার ও নির্যাতনকালীন সময়ের কী হবে এ বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতা ও জটিলতা না কাটলে তিনি ৪ জুলাই, ১৯৭৩ সালে অনেকটা অভিমান করে পদত্যাগ করেন। এবং পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওনা পরিশোধের নির্দেশনা থাকলেও ৬/৮/৭১ খ্রিঃ তারিখ থেকে পদত্যাগ কার্যকর করার অনুরোধ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার পাওনা পরিশোধ না করেই ১১/৮/৭৩ খ্রিঃ তারিখে তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে বিশ্ববিদ্যালয় হতে তার সংযোগ ছিন্ন্ করেন। এরপর অনেক পরিচিতরা, সহকর্মীরা তাকে উম্মাদ, মাথা খারাপ বা পাগল বলে এরিয়ে চলতো। আর একান্ত পরিচিত জনরা জানাতো সহানুভূতি। কিন্তু কোনটিই তার পছন্দ নয়।

তিনি আরো গুটিয়ে নিলেন নিজেকে। ১৯৯৮ সালের ২ আগস্ট রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করেন। সেখানে কর্তৃপক্ষ তাকে ‘জীবন্ত শহীদ মুক্তিযোদ্ধা‘ নামে অবহিত করেন। তার সম্পর্কে জনাকীণৃ সংবর্ধনা সভায় কথা সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক বলেন, ‘আজকে আমাদের বলার দিন নয় দেখার দিন। তোমরা দেখে নাও এই যে, ওর (দেবদাস) ছিন্ন ভিন্ন শীর্ণ চেহারা এটাই বাংলাদেশের মানচিত্র, এটাই মুক্তিযুদ্ধ।’

এভাবেই অধ্যাপক মজিবর রহমান দেবদাস ব্যক্তি থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও পতাকার প্রতীকে পরিণত হয়েছেন। ইতোমধ্যে জীবন্ত শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মজিবর রহমান দেবদাস নামক গ্রন্থ সম্পদনা করেছেন প্রয়াত জনাব মনছুর আহম্মদ খান ও জনাব হাসিবুল আলম প্রধান। বাংলাদেশ গণিত সমিতি ১২ জুন, ২০০৯ খ্রিঃ তারিখে তাকে সংবর্ধনা দেন। প্রয়াত নাট্যকার লেখক নাজিম মাহমুদ তাকে নিয়ে ‘ঠিকানা কোথায়’ নাটক পরিচালনা করেন যা বিটিভি তে একাধিকবার প্রচারিত হয়েছে. মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্ট্রি জনাব মফিদুুল হক তাকে নিয়ে নির্মাণ করেছেন প্রামান্য চিত্র ‘কান পেতে রই’। যা চ্যানেল আই, এটিএন বাংলা, দেশ টিভিতে প্রচারিত হয়েছে। এ প্রমাণ্য চিত্রে দেবদাসকে নিয়ে বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ ও অনেক অজানা তথ্য উঠে এসেছে। নাজিম মাহমুদের লেখা যখন ক্রীতদাসঃ স্মৃতি’৭১ এ সে সময়ের সংলাপ সুন্দর ভাবে উঠে এসেছে। এছাড়া গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র গ্রন্থের ৮ম খন্ডে তাকে নিয়ে একটি প্রবন্ধ রচিত হয়েছে। উক্ত পুস্তকের ৪৬৭-৪৬৯ পৃষ্ঠায় বর্ণিত ‘হানাদারদের নির্যাতনের লক্ষ্য শিকারের অন্যতম অধ্যাপক মজিবর রহমান আজ দেবদাস হয়ে বেঁচে আছেন’ শীর্ষক প্রবন্ধে লেখক নজরুল ইসলাম বুলবুলের লেখায় ৭১ সালে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক, রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা, ক্ষমতা হস্তান্তর বিভিন্ন বিষয়ে অধ্যাপক মজিবর রহমান দেবদাসের মনোভাব স্পষ্ট উঠে এসেছে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দেবদাসের প্রাণ নেয়নি। যদিও প্রস্তুত ছিলেন তিনি। সত্য প্রকাশ করে পাকিস্তানী আগ্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে পাহাড়সম ঘৃণা ও বিবেকের দৃঢ়তা দিয়ে লড়ে গেছেন। প্রাণ না গেলেও জীবন দিয়েছেন তিনি, নি:শেষ হয়েছেন। আজ তার জীবন থেকেও মৃত। জীবন্ত শহীদ। এরচে’ বেশী আর কী দিতে পারতেন তিনি?

কিন্ত মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা নিয়ে তার ভাবনার আজো শেষ হয়নি। আপাতঃ দৃষ্টিতে পাগল এ মানুষটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা দর্শন করে তিনি তাঁর সে উদ্বেগের প্রকাশ ঘটালেন। নিজ হাতে তিনি সেখানে রক্ষিত মন্তব্য খাতায় লিখলেন:

Visited the museum on 10th August, 1998, I hope history will be able to overcome the distortion of facts depicted through pictures here.

Majobor Rahman
(Devdas)

আজও তার প্রতিটি নি:শ্বাস প্রাণের স্পন্দনের সামনে বালির বাঁধের মতো ভেঙ্গে যায় এ সমাজের সব কুপমন্ডুকতা, ক্ষয়িষ্ণুতা । এভাবেই স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম রশদ অর্থনৈতিক মুক্তি ও ধর্ম নিরপেক্ষতার ছায়াচিত্র হিসাবে তিনি বেঁচে আছেন।

রাষ্ট্র তাকে মনে রেখেছে কিনা এ প্রশ্নের জবাব খোঁজেননি তিনি। বরং অনুগ্রহ, অনুকম্পা ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেছেন আজীবন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সহকর্মী ড.শহীদুল ইসলাম তার এক লেখায় উল্লেখ করেছেন, তিনি ব্যতিক্রমী মানুষ। তার মতো সুস্থ্য-সরল তীক্ষ্ণ আত্মমর্যাদা সম্পন্ন, একশভাগ অসম্প্রদায়িক মানুষ-আদর্শের জন্য হাসিমুখে যিনি জীবন বিলিয়ে দিতে ভীত হননা মোটেই, এমন মানুষ বাংলাদেশে আর একজন আছেন কিনা, জানিনা।

বর্তমানে অধিকাংশ সময়েই স্বভাব সুলভভাবে চুপ থাকেন তিনি। কথা বলতে গেলে অসংলগ্ন হয়ে যান কখনো কখনো,ভর করে মুক্তিযুদ্ধের মৃত্যুপুরি। চোখ বন্ধ করে হাতে গুনতে থাকেন এক দুই…। কি গণনা করেন এই গণিতবিদ? মৃত শহীদদের সংখ্যা? অর্থনৈতিক মুক্তির সূচক?
এ প্রশ্ন করলে তিনি হয়তো নিরবই থাকবেন। তার নিরবতার মধ্যেই জবাব খুঁজতে হবে আমাদের। আজ আমরা যারা তার পরবর্তী প্রজন্ম আমরা কী পারবো তার হিসাবটি মিলিয়ে দিতে?

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৪:২৫

রানার ব্লগ বলেছেন: সেই সময়ের মানুষ গুল কি আর একবার গর্জে উঠতে পারে না ?

২| ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৫:১২

বাগান বিলাস বলেছেন: পারে। তারা জাগ্রত।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.