নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি হয়তো মানুষ নই, মানুষগুলো অন্যরকম, হাঁটতে পারে, বসতে পারে, এ-ঘর থেকে ও-ঘরে যায়, মানুষগুলো অন্যরকম, সাপে কাটলে দৌড়ে পালায়। আমি হয়তো মানুষ নই, সারাটা দিন দাঁড়িয়ে থাকি, গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকি।

বাগান বিলাস

যাপিত জীবনকে নিয়ে ভাবনার অনেক উপাদান আছে। তবে সবকিছু ভাবতে পারি না। ভাবার সুযোগ পেয়েও অনেক অনুষঙ্গ নিজ প্রয়োজনে এড়িয়ে গেছি। অনেক বিষয়ে পরে ভাবা যাবে বলে ঐ পরিচ্ছেদে আর কখনও যাওয়াই হয়নি। তবে বারংবার আমি প্রকৃতির কাছে ফিরে গেছি। তার কাছে শিখতে চেয়েছি। প্রকৃতিও শেখালো ঢের। তবুও হয়তো আমার প্রত্যাশা ও শিখনফলে আছে হতাশা । ইচ্ছা ও প্রাপ্তির খতিয়ান খুব একাকী মিলিয়ে দেখি-কত কিছুইতো হলো না দেখা, হলো না কত শেখার শুরু । তবুও প্রাপ্তি কি একেবারেই কম? মোটেই না। পেয়েছিও ঢের। মনে তাই প্রশ্ন জাগে, যেদিন আমি আবার নিঃশ্বেস হয়ে যাব সেদিন কি প্রকৃতিও আমার মতো একা হয়ে যাবে? এর জবাবও প্রকৃতির বিবৃতিতেই পেয়েছি-না, ক্ষুদ্র জীবনের আঁচর প্রকৃতিতে বেশিক্ষণ মূর্ত থাকে না। অন্যকথায় প্রকৃতির মধ্যে বিষণ্নতা বেশি দিন ভর করে থাকে না। তাই সে সহজ, তাই সে সমাদৃত! আমার বিবেচনায় একারণে প্রকৃতি সকল জীব ও জড়ের কাছে সবচেয়ে বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

বাগান বিলাস › বিস্তারিত পোস্টঃ

জলপরির জলছবি

২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ দুপুর ২:২৭


জলপরির জলছবি

- মোস্তাফিজার রহমান

কাঠের চাকা দুটি গতরের শক্তিতেই চলে।
বড় কষ্টের জীবন ফেলুর। সতেরশ টাকা দিয়ে কেনা ঠ্যালাগাড়িটার পিছনেই কেটে গেলো তার সারাটা জীবন। সেই বারো বছর বয়স থেকে ঠ্যালাগাড়িটি চালাতে চালাতে কত যে গায়ের ঘাম বাতাসে, এই শহরের মাটিতে মিশে গেল তার আর লেখাজোখা নেই। তবে ঠ্যালাগাড়িটার পিছনে রক্ত পানি করে, ঘাম ঝরিয়ে প্রতিদিন যে আয় হয় তাতেই কষ্টেসৃষ্টে চলে যায় তার তিন জনের সংসার।
ফেলু বাদশার চোখের সামনে বদলে গেল শহরটা। কত কী যে বদলাল। এক সময় শহরের পুরোটা কাঁচা রাস্তাঘাট ছিল। ধীরে ধীরে তাতে ইট পড়ল, পিচ উঠল। শহরে কম বেশি বড় বড় দালান উঠল। ঠ্যালা, রিকশা, ভ্যানগাড়িকে পায়ে মাড়িয়ে কত কী হলো। আগে তো এ সবের বালায় ছিল না। ফেলু যখন তার বাবার সাথে ঠ্যালাতে হাত দেয় তখন শহরে চলত কেবল গরুর গাড়ি আর ঘোড়ার গাড়ি। গাধার গাড়িও দেখা যেত। আর ইঞ্জিনের গাড়ি বলতে দেখা মিলত সুগার মিলের দু-একটা ট্রাকটর।
আজ দিন বদলে গেছে। ট্রাকটর, নসিমন, করিমন কত কী যন্ত্রচালিত যান এসেছে। এরাই মৌমাছির মতো দখল করে আছে শহরের রাস্তা। এ শহরে ঠ্যালার আর জায়গা কোথায়? বলতে গেলে ঠ্যালা তেমন চলেই না। একেবারে কোনঠাসা হয়ে পড়েছে। এখন শহরে গরুর গাড়ি বা ঘোড়ার গাড়িরও চল নাই বললেই চলে। ফেলু তবুও ঠ্যালাগাড়িটা ছাড়ে না। মায়া জন্মে গেছে ঠ্যালাটার প্রতি, পেশার প্রতি। তার চেয়ে বড় কথা ফেলু তো রিকশা বা ভ্যানগাড়ি চালাতে জানে না।
জাহাজঘাটে জাহাজ ভিড়লে মহাজনরা ফোন দেয়। তাদের ফোনকে সে না বলতে পারে না। ফেলুরা কয়েকজন এক সাথে ঠেলা চালায়। তাদের একটা সমিতি আছে। সুলতান সে সমিতির সভাপতি। ফেলুকেও কি যেন একটা পদ দিয়েছে। ফেলুর পদের নাম মনে থাকে না। সে সুলতানকে বলে, ওসব সমিতি-ফমিতি দিয়া যদি প্যাড চলত তাইলে হইত। সমিতির কাম কি?
বরিশাল থেকে জাহাজে আসা মাল আনলোড করে ফেলুরা ঠ্যালাতে তোলে। জাহাজঘাট থেকে সেসব মালামাল যেমন- কাগজ, সুপারি, গুড়, তেলের ড্রাম, বিস্কুট ইত্যাদি মহাজনদের মোকামে নিয়ে যেতে হয়ে।
মাঝেমধ্যে বেনু বাপের গাড়িতে হাত লাগাতে চায়। কিন্তু ফেলু বাদশা তা পছন্দ করে না। বেনু মাত্র আটে। স্কুলে যায়। এ বয়সে তাকে পেটের চিন্তা করতে হবে? বাদশাহী না থাক, জন্মদাতা পিতা ফেলু বাদশা কি মারা গেছে? ফেলু তাই বলে, তুই আগে বড় হ বাজান। লেখাপড়া শিখে মানুষের মতো মানুষ হ। এখন তো তুই দুধের ছাওয়াল। আর তোর বাজান, ফেলু বাদশা এখনও মরে নাই। তোর গাড়ি টাননের কাম নাই। তোর দাদায় গাড়ি টানছে। আমারে কইছিল পড়তে। আমি পড়ালেখা শিখিনি, ভুল করছি। নয়তো আমারও গাড়ি টানন লাগত না। বাপের কথা শুনলে আজ মস্ত সাহেব হইবার পারতাম। খালি একটা ভুল...পড়ি নাই। তুই পড় বেনু। তোরে সাহেব হইতেই হইব। বাকিটা উপরওয়ালার ইচ্ছা।

শহর থেকে দেড় কিলোমিটার পূবে শাপলাপুর গ্রাম। সে গ্রামে দুই শতাংশ জায়গায় ফেলুর বাপ-দাদার ভিটা। পৈত্রিক সেই ভিটার একটা ছনে ছাওয়া ঘরে ফেলু বসবাস করে। প্রতিদিন কাজ শেষে নীড়াশ্রয়ী পাখির মতো সেই ঘরেই সে ফিরে আসে। ফেরার সময় ফেলু কিছু কলা-কদলি কেনে, তরিতরকারি কেনে। মাছের বাজারে আগুন। তাও তার জানটা খেতে চায়। সাধমতো না পারলেও সাধ্যমতো ফেলু মাছ কেনার চেষ্টা করে। রোজগারপাতি ভালো হলে কেনে ফার্মের মুরগি। মাঝে মাঝে মনে করে পাঁচ-দশ টাকার মুড়িমাখা কেনে। বড় মেয়ে কুসুম ঝালমুড়ি খুব পছন্দ করে। চাপা স্বভাবের মেয়েটা একেবারে খেতে চায় না। কেবল ঝালমুড়িটা তার পছন্দ। বাড়ি ফিরে ফেলু ঝালমুড়ির ঠোঙাটা কুসুমের হাতে তুলে দিলে তার ফর্সা মুখে একটা হাসির আভা ফুটে ওঠে। পূর্ণিমার চাঁদের মতো সেই হাসিখুশি মুখটা দেখে ফেলুর চোখে আনন্দে জল এসে যায়। কুসুম মুড়িমাখাকে তিন ভাগ করে। একটা বেনুর, একটা বাজানের আর অন্যটা তার। ফেলু প্রায়ই বলে না-গো মা। আমারটা তুই খা। তুই খাইলেই আমার খাওয়া। আর এইডা আমার প্যাডে সয় না। গ্যাস্টিক রইচে তো।
কুসুম বাপের মুখে অসুখের কথা শুনে বিচলিত হয়। অনুযোগের সুরে বলে, তয় এইসব আনতে গেলা ক্যান? তুমি গ্যাসের বড়ি আনছ?
ফেলু মাথা নেড়ে বলে, না-রে মা, গরিবের প্যাডত একটু আধটু বিষ তো থাকবই। পানি খাইলেই ঠিক হইয়া যাইব। আর যখন তখন ওষুধ খাওন ভালা না।
বেশি রাত জাগতে পারে না বেনু। সন্ধ্যার আগেই পেটে কিছু দিয়ে বাবার জন্য অপেক্ষা করে। এশার নামাজের আজান পর্যন্ত জেগে থাকে। ফেলুর আসতে দেরি হলে তার চোখ ধরে আসে, ঘুমিয়ে যায়।
দুরন্ত ছেলে বেনু। কোথাও এক মুহূর্ত স্থির থাকতে পারে না। ফেলু বেনুর চঞ্চলতা নিয়ে দুশ্চিন্তা করে। প্রায়ই মনমরা হয়ে ভাবে, স্কুলে গিয়ে ছেলেটা কী যে করে কে জানে। বেনু হয়েছে মেয়েটার ঠিক বিপরীত। সারাক্ষণ ছুটাছুটি, হৈচৈ। স্কুল থেকে ফিরেই বই খাতা ফেলে দে দৌড়। মাঝে মাঝে কুসুম ওকে ধরে খাইয়ে ছেড়ে দেয়। বর্ষায় গাছ থেকে পিছলে পড়ে যাওয়ার তোয়াককা না করে এগাছ ওগাছ থেকে কদম ফুল ছিঁড়ে। ফাগুনের ঝিরিঝিরি বাতাসে ঘুড়ি উড়িয়ে, পুকুর-বিল ঘুরে মাছ ধরে, ডাংগুলি খেলে, আম-জাম কুড়িয়ে অথবা ঝিল থেকে পকেট ভরে শাপলা, ভ্যাটফল তুলেই ওর সময় কেটে যায়। কখনও কুসুমের জন্যও ভ্যাটফল নিয়ে আসে। এইতো সেদিন হাপাতে হাপাতে গায়ের গেঞ্জি খুলে বানানো পুটলিটা কুসুমের সামনে মেলে ধরে। বলে, বুবু দেখ তোমার লাইগা কি আনছি।
ঘরের একচিলতে বারান্দায় বসে কুসুম তার বাবার শার্টের ছেঁড়া অংশটা রিপু করছিল। সুঁচের কাজ করতে থাকায় প্রথমে বেনুর দিকে তাকায়নি কুসুম। বেনুর উল্লাস আর চেঁচামেচিতে শেষে মাথা তুলে তাকাতে বাধ্য হয়। বেনুকে দেখেই তার চোখ ছানাবড়া।
বেনু তুই আবার গেছিলি ওই জিন্দা ঝিলে? তোরে কইনি ওই জিন্দা ঝিলে থাকে পদ্মগোখরা?
না বুবু, ঝিলের মাঝেত যাইনি আমি। বলটু, রিপন গেছে। ওদের লগে গিয়ে ধার থেইকা তুইলা আনছি। আজ ভ্যাটের খই বানাইবা। কাল বাজানরে কইছি মহাজনের আড়ত থেইকা গুড় আনতে। গুড় দিয়া ভ্যাট খই, উম...জম্মের মজা হইব।
না হেসে পারে না কুসুম।
তয় বেনু এই শ্যাষ। এরপর তুই আর ওই ঝিলে যাবি না।
কুসুমের অনুশাসনে বেনুর মন খারাপ হয়। মলিন মুখে উপরে নিচে মাথা নেড়ে বলে, আইচ্ছা ঠিক আছে বুবু। আর যামু না।
একটু দম নিয়ে কণ্ঠ সতেজ করে বেনু আবার বলে, ও বুবু এইডা একটু খাইয়া দেখ। পক্ব হইচে। এক্কেবারে সরিষার মতো দানা, তাই না?
কুসুম একমনে সুঁচ চালাতে থাকে। বেনুর কথার জবাব দেয় না।
খাও বুবু একডা। আবারও সাধে বেনু।
কুসুম বেনুর অনুরোধ সইতে না পেরে একটা ভ্যাটফল খুলে মুখে দেয়। কুসুমের ভ্যাটফল খাওয়া দেখে বেনু খুশিতে আটখানা হয়ে যায়। ছোট বেনুর চোখের কোণে এক প্রশান্তির দ্যুতি ঢেউয়ের মতো ভাসতে থাকে। এতোক্ষণে তার ভ্যাটফল তুলে আনার পরিশ্রম যেন স্বার্থক হলো।

ওদের মা নেই। বেনুর জন্মের দুই বছরের মাথায় জোবেদা কলেরায় মারা গেছে। বেনু তখনও মায়ের দুখ খায়। ছেলেটারও কলেরা হয়। বেনুও হাসপাতালে ভর্তি থাকে এগারো দিন। তার কোনো আশাই ছিল না। তারপর কেমন করে যেন যমের হাত থেকে ফিরে আসে।
সেই থেকে এই দুটো সন্তানকে অনেক ভালোবাসা দিয়ে বড় করে তুলছে ফেলু। অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে তাকে। প্রতিটি দিন অসীম ধৈর্য্য আর পরম মমতা দিয়ে তাদের লালন করছে। ফেলুর জীবনে একমাত্র আনন্দ হল তার সন্তান দুটি জোবেদার অভাব বুঝতে পারে না। কুসুম তার মাকে একটু করে মনে করতে পারলেও বেনু একেবারে পারে না। তাদের কাছে মা মানে একটা কবর। ঘরে বেঁধে রাখা একটা ছবি। একটা অনুভূতিহীন সম্পর্ক।
জোবেদার মৃত্যুর পর ফেলু চাইলে অনায়াসে দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারত। কিন্তু সে তা করেনি। জোবেদার কথা রেখেছে।
ফেলুর এখনও স্পষ্ট মনে আছে জোবেদা মারা যাওয়ার আগের দিন সকালে ফেলুর হাত ধরে কী যেন বলতে চেয়েছিল। তার বলার মতো শক্তি ছিল না। বেনুর মাথায় কাঁপা কাঁপা হাত রেখে অঝোরে কেঁদেছিল। বেনু হয়তো তার মায়ের শেষ আদরটুকু উপভোগ করেছিল। সে কী যেন ভেবে মায়ের দিকে তাকিয়ে নিচের পাটির চারটি দাঁত বের করে ফিক করে হেসে উঠেছিল।
ফেলু জোবেদার সামনে নিজেকে ভাঙতে দেয়নি। তবুও কোথায় যেন কী ভেঙে যাওয়ার আওয়াজ সে শুনতে পায়। ফেলু দুহাতে নিজের চোখ চেপে ধরে। মৃত্যু পথযাত্রীকে চোখের জল দেখাতে নেই। ফেলু চিন্তা করে কারও বিদায়ের সময়টা যেন আনন্দের হয় সে ব্যবস্থা যথাসম্ভব করা উচিত।

সেদিন কী বলতে চেয়েছিল জোবেদা তা বুঝতে কষ্ট হয়নি ফেলুর। জোবেদা চলে যাবার পর ফেলু গভীরভাবে অনুভব করে সে ছাড়া শিশু দুটির এ সংসারে আপন বলতে আর কেউ নেই। ফেলুই ওদের একমাত্র ভরসা। সমভাবে ফেলুর জীবনের প্রতিচ্ছবি ওরা। কুসুম আর বেনু যেন তার জীবনের আয়না।
ফেলু সারাদিন কাজে ডুবে থাকে। কিন্তু তার মন পড়ে থাকে বাড়িতে। কান দুটো খাড়া থাকে সতর্ক হরিণের মতো। না জানি বাচ্চা দুটো কী করছে!
জোবেদা বেঁচে থাকতে বাচ্চাদের নিয়ে ফেলুর তেমন চিন্তা ছিল না। কেবল কুসুম আর বেনুর জন্যই জোবেদাকে আলাদাভাবে স্বরণ হয় ফেলুর। জোবেদা মারা যাওয়ার পর বেনুর জন্য ফেলু রোজ এক পোয়া গাইয়ের দুধের ব্যবস্থা করে। ফেলুর পাশের বাড়ির দূর সম্পর্কের এক চাচি রাবেয়া শিশু দুটিকে খানিক দেখভাল করে, ফেলুকে সহযোগিতা করে। এই বা কয়জন করে। এ কারণে রাবেয়া চাচির প্রতি ফেলুর কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। ফেলু ঠ্যালা চালাতে গেলে কুসুম ও বেনু থাকে সেই পাড়াতো দাদি রাবেয়ার কাছে। এ যেন এক কঠিন জীবনের মুখোমুখি ফেলু।

সেই বিড়াল ছানার মতো শিশু দুটি চোখের পলকে বড় হয়ে গেল। বেনু বারোয় পা রেখেছে আর কুসুম তেরোয়। বেনু পাশের গ্রামে একটা স্কুলে পড়তে যায়। হাইস্কুলে উঠলে কুসুমকে পড়ালেখা ছাড়তে হয়।

বারান্দায় বসে পান চিবাচ্ছিল ফেলু। বৃষ্টি পড়ছে। তাকে কাজে যেতে হবে। মহাজন খবর দিয়েছে-ঘাটে জাহাজ ভিড়েছে। ছাতা মাথায় দিয়ে আঙিনা মাড়িয়ে কে যেন তার সামনে এসে দাঁড়ায়। ঘোমটা দিয়ে মুখ আড়াল করা।
দেখতো আমারে কেমন লাগতাছে?
ফেলু চমকে ওঠে। একি! এটা কুসুম নাকি?
মাথার ঘোমটাটা ফেলে দিয়ে সে বলে, বাজান আমারে চিনতে পারনি? আমি কুসুম। এইডা দাদির নতুন শাড়ি, মার দেওয়া। দাদিই আমারে কইচে কয়দিন শাড়িডা পইড়া একটু নরম কইরা দিতে।
জাম রঙের শাড়িতে ধবধবে সাদা কুসুমকে যেন কাশফুলের জলছবির মতো অপরুপা লাগছে। মাথার দুপাশের বেণী দুটোতে তাকে আরও উচ্ছলিত দেখাচ্ছে। ফেলু বিষ্ময় লুকাতে ট্যাঁকে গোঁজা লুঙ্গির পলট থেকে বিড়ির প্যাকেট বের করে। কুসুমকে ফরমায়েশ করে, কুসুম আমারে ঘর থোইকা ম্যাচডা দে তো মা।
ফেলু বাদশা অবাক হয়ে দেখে হঠাৎ বড় হয়ে যাওয়া তার মেয়েকে। মাঝের দিনগুলো কী তবে স্বপ্নের মতো পার হয়ে গেল? ফেলুর অজান্তে চলে যাওয়া দিনগুলোর কথা তার মনেই পড়ত না আজ যদি না জলপরির মতো মেয়েটা তার সামনে এসে না দাঁড়াত। কুসুম তার মেয়ে এবং সে ফেলুর খুপরি ঘরে বাস করে এ এক বিষ্ময় মনে হয় ফেলুর কাছে। কুসুম যেন তার ভাঙা ঘরে পূর্ণিমার আলো।
বাজান এই লও আগুন। বাবাকে ম্যাচ এগিয়ে দেয় কুসুম।
বাজান তুমি না কইচো বিড়ি ছাড়বা? কতদিন খালি কও বিড়ি ছাড়–ম, ছাড়ুম। কিন্তু কথা আর কামে তোমার মিল নাই। কুসুমের গলায় কিছুটা অনুযোগ।
ছাড়–ম। তয় এইডা ছাড়লে ক্যামনে চলব মা?
চলব ঠিকই। যারা বিড়ি খায় না তাদের চলে না?
কুসুমের খবরদারি ফেলুর ভালো লাগে।
দেখবা বিড়ি খাইতে খাইতে একদিন তোমার কইলজাডা পইচা গেছে। সেদিন তুমি থামবা।
কুসুম একটা পিঁড়ি টেনে নিয়ে তার বাবার পাশে বসে। মাথার চুলে পাক ধরেছে ফেলুর। কুসুম বাবার মাথায় হাত বুলায় আর একটা দুইটা করে পাকা চুল তোলে।
বেনুর স্কুল ছুটি হইব কখন রে মা?
ফেলু মেয়েকে প্রশ্ন করে। কুসুম জবাব দেয়, আজ নাকি হেগর স্কুলে ফুটবল খেলা হইব। এইডাতে জিতলে জেলায় যাইতে পারব।
হ। বেনুও তাই কইছিল। জিতলে তো খুবই ভালা। আজ যেমন বৃষ্টি পড়তাছে। হাত-পা ই ভাঙে নাকি, আল্লাই জানে।
দোয়া করো বাজান। হে পাড়ায় যেমন ভালা, খেলাতেও ভালা করব। দেইখ। আমি আগাম কইয়া রাখলাম।
ফেলুর মনের এক কোণে কষ্টের কষ জমা হয়। কুসুমকে পড়াতে না পারার কষ্ট। মেয়েটাকে হাইস্কুল পাশ করানোর ইচ্ছে ছিল তার। পারল না। সিক্সে উঠে কুসুমকে স্কুল ছেড়ে দিতে হলো। আজকালের বাজারে দুজনের স্কুলের জামাকাপড়, পড়ার খরচ যোগান সহজ কথা নয়। তারচে ঘরে থেকে দু-চারটা গরু-ছাগল পাললে সংসারে কামে লাগে। সামনে মেয়েকে বিয়ে দিতে হবে। সেখানে একটা বড় খরচের ব্যাপার আছে। ফেলু কারও কাছে হাত পাততে চায় না।

মেয়েটি তার মায়ের ধাত পেয়েছে। খুঁটে খুঁটে কাজ করতে শিখেছে। রান্না বান্না, সুঁচের কাজ, সুরা-কেরাত শিখেছে। ফেলুর ঘরটা ভাঙা হলেও তার ঘর-বারান্দা, আঙিনা ও আশপাশ ছিমছাম, পরিষ্কার। ঘরের চালে সিম ও লাউ চাষ করেছে। মুরগি, হাঁস পালে। ডিমের অভাব নেই।
চালার পানি পড়ে প্রতি বর্ষায় উঠোনের মাটি কেটে যায়। কুসুম ও বেনু অসিম সুবর্ণর পতিতজমি থেকে ইয়া ইয়া মাটির চাঙর এনে উঠোন ঢেকে দেয়। দুই ভাইবোন মিলে মাটির দলাগুলো ভেঙে সমান করে ছড়িয়ে দেয়। কুসুম লেপ-পোঁচ করে ঝকমকে করে তোলে। ফেলু অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে এসব দেখে। তার চোখ খুশিতে চিকমিক করে ওঠে।

একদিন ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে একটা অঘটন ঘটে। কুসুম তার মায়ের বাঁধানো ছবিটা মুছে দেয়ালে পুনরায় আটকাতে গেলে হাত ফসকে মাটিতে পড়ে যায়। আর সাথেসাথেই ঝনঝন শব্দে ছবির বাঁধানো কাচটা ভেঙে যায়। বেনুর কিছুটা মন খারাপ হয়। তার মাকে সে মনে করতে পারে না। এই ছবির মানুষটাই তার মা। সে তার মনোজগতে এই ছবির মানুষটাকে জীবিত রাখতে চায়। ছবিটা না থাকলে তার মাকে সে আর কোথায় খুঁজে পাবে?
কুসুম নিচু হয়ে অপরাধীর মতো মেঝে থেকে ফ্রেমসহ ছবিটা তোলে। অপরাধবোধ থেকে ভাঙা কাচের টুকরাগুলোও নিজের অজান্তে তোলার চেষ্টা করে।
ও বুবু ওইডা রাইখা দাও। বাজান আইলে কমু আমি ভাঙছি। বকা দিলে আমারে দিব। বেনু পাশ থেকে বলে ওঠে।
বেনুর কথা শুনে হঠাৎ কোথায় যেন কুসুমের ধক করে ওঠে। সে বেনুর প্রতি এক অকৃত্তিম মমতা অনুভব করে। কুসুম বেনুকে বুকে টেনে নেয়। অজান্তেই কুসুমের চোখ অবাধ্য হয়, ভিজে ওঠে।

ভাদ্রের কাকপোড়া রোদে কাজ করে দুপুরের খাবার খেতে আসে ফেলু। তখন সে প্রায় শারিরীক শক্তি হারাতে বসে। ঘর থেকে নকশাকাটা হাতপাখা দৌড়ে বের করে আনে কুসুম। তারপর বাপের হাত ধরে মাটির ঘরের উঁচু বারান্দায় বসায়। বিছানা বিছিয়ে দেয়। আলস্যে বিছানায় শুয়ে পড়ে ফেলু। কুসুম বাবার গামছাটা নিয়ে গায়ের ঘাম, লবণ মুছে দেয়। বাতাস করে। সুখে ফেলুর আত্মা ডুকরে ওঠে। ফেলু কোনো রাজ সিংহাসন চায় না। মানুষ তো বাদশা হয় মনের শক্তিতে, মনের প্রশান্তিতে। হিরে জহরতে নয়। পৃথিবীতে অনেকের অনেক টাকা আছে কিন্তু শান্তি নেই। তারা শান্তির কাঙাল। আর ফেলুর টাকা নেই, আছে শান্তি। ফেলু প্রশান্তির বাদশা।

এত সব শান্তির মধ্যেও ফেলুর মনের আকাশে একটা নৈরাশ্য নিভৃতে ঘড়ির কাঁটার মতো সব সময় টিপটিপ করে বাজতে থাকে। মেয়ে বড় হয়েছে। তাকে পরের বাড়ি দিতে হবে। আর্থিক সংকটের সাথে সাথে ফেলুর আরও একটি বড় সমস্যা আছে। তাহলো কুসুমকে ছাড়া ফেলু একটা দিন কল্পনা করতে পারে না। খুব মায়াবতী একটা মেয়ে। ফেলুর হাড় খুলে যেন ঈশ্বর তাকে বানিয়েছে। এত মমতা ও ভালোবাসার এ বন্ধন কী করে ছিঁড়ে ফেলবে ফেলু?

রোজ সকালে উঠে বাপের জন্য ভাত রান্না করে কুসুম। ফেলু খেয়ে-দেয়ে ঠ্যালা নিয়ে বের হয়। বেনু যায় স্কুলে। সারাদিন ফেলুর একটা কান বাড়িতে পড়ে থাকে। মেয়ে বড় হচ্ছে কখন কী হয়। কতো রকমের মানুষ দেশে। কার মনে কী আছে কে জানে। ফেলু তার রাবেয়া চাচিকে বলে রাখে, চাচিমা আমার কুসুমের দিকে একটু লক্ষ্য রাখিস। ফেলুর চাচি বলে, হ। হ্যাগো তো ছোডকাল থেইকাই দেইখা রাখছি। তয় ফেলু কওন যায় না বাবা। একডা ভাল ঘরবর দেইখা কুসুমরে পরের হাতে তুইলা দে। মাইয়া মানুষ সারা জীবন তো আর ঘরে রাখতে পারবি না। আর যত বড় হইব তত মানুষের নজরে পড়ব।
ফেলু মাথা নাড়ে। একমত হয়। কুসুমকে নিয়ে তার মনের গভীরে চিন্তা ঢেউয়ের মতো তরঙ্গায়িত হতে থাকে।
ক্যান চাচিমা কিছু হুনছস না কি?
না ফেলু। হাওয়ায় ম্যালা কথা ভাসে।
কী কথা?
রাতে কমুনি, তুই ঠ্যালা বইয়া আয়।
ফেলুর কপালের চামড়া কুঁচকে যায়। চিন্তার ভাঁজ পড়ে মুখে। ফেলুর মুখের থুতু আঠালো হয়ে আসে। ‘চাচিমা তো আগে এমন কিছু কয় নাই। তবে কী এমন ঘটলো?’ আনমনে চিন্তা করে ফেলু।
খারাপ কিছু না তো চাচিমা?
না বাবা, তেমন বড় কিছু না। ফিরা আয় কমুনি। একডা পান দে তো বাবা।
রাবেয়া চাচি ফেলুকে আশ্বস্ত করে। ফেলু কিছুটা স্বস্তি পায়। অনেকটা প্রসন্ন মনে ফেলু জবাব দেয়, ঘরে পানবাটায় পান আছে চাচিমা। সাজাইয়া খা।

বেনু বিকেলে পশ্চিম আকাশ লাল হওয়ার আগেই কাদা পানি গায়ে-গতরে, শার্টে মেখে পলিথিনের ব্যাগে বই নিয়ে ঘরে ফিরে। তাকে দেখে মনে হবে সে কোনো পুকুর সেঁচা কাদা-পানিতে গোসল করে এসেছে। এখনই যেমন খুশি তেমন সাজ অনুষ্ঠানে মূর্তির মতো কোথাও দাঁড়িয়ে যাবে। বেনুর মুখে হাসি।
বেনু বাড়ির কাছাকাছি এসে দূর থেকেই কুসুমকে ডাকতে থাকে, বুবু, ও-বুবু।
বেনু কোনো সাড়া পায় না।
বেনু এবার গলা চড়িয়ে ডাকে, ও-বুবু তুমি কই?
বেনু বইগুলো বারান্দায় রেখে কলতলায় যায়। তার সাথে রাবেয়া দাদির দেখা হয়। তাকে জিজ্ঞেস করে, ও-দাদি, কুসুম বু কই গেছে?
দাদি বলে, গরু ছাগল লইতে মাঠে গেছে। তয় তোর এ কোন সুরত?
জানিস দাদি আজ আমাগো স্কুলে ফুটবল খেলা ছিল। আমরা জিতছি। তিন গোলে। বলতে বলতে বেনুর চোখ বড় হয়ে উঠে। চকচকে সে চোখে আনন্দের প্রক্ষেপন দেখা দেয়।
ভালা করছস। তোর গায়ে যত কাদা, কলের পানি দিয়া এ কাদা উঠব না। যা গা ঘইষা পুকুর থেইকা ভালা কইরা গোসল কইরা আয়। তোরে ভূতের মতো লাগতাছে।
বেনু হেসে ওঠে। আমি একাই দুই গোল করছি দাদি। আর রমজান একডা, ঐ মিয়া পাড়ার হালিম একডা।
খুব ভালা করছিস। যা জুত ইইয়া আয়। কুসুম তোরে এই অবস্থায় দেখলে মাইর দিব।
বেনু গান গাইতে গাইতে পুকুরের দিকে দৌড় দেয়।

রাতে ফেলুর উঠোনে রাবেয়া চাচি ফেলুর মুখোমুখি পিঁড়ি নিয়ে বসে। পান চিবাতে চিবাতে চাপা স্বরে বলে, গতকাল নরিজের বাড়িতে হঠাৎ গিয়া শুনি কুসুমকে নিয়ে কথা চলতাছে। নরিজের বৌ লাইলি নরিজরে বলতাছে, যোয়ানধারী মাইয়া ঘরে, ফেলু বাদশা তো বাদশার মতোন গায়ে ত্যাল দিয়া ঘুমায়। মাইয়ার বিয়ার বয়স যায় সেদিকে হুস নাই।
আমারে দেইখা কথাবার্তা থাইমা যায়। আমিও ছাড়ি না। প্যাচ দিয়া ধরি। কে লাইলি কার কতা কও। তখন সে এড়িয়ে যাইয়া বলে, এই দেখ না কতজনের বিয়ার বয়স পার হয়ে যায়। তাও বিয়া দেয় না। মাইয়া মানুষের বিয়ার তো একডা বয়স থাকে, তাই না?
রাবেয়া চাচি ফেলুর উদ্দেশ্যে বলতে থাকে, মানুষের এসব আলগা কথা আমার বাপু ভাল লাগে না। কুসুম মনে হয় তাগোর মাথার উপর উইঠা নাচতাছে। তয় লোকে যাই বলুক, আমাগো কুসুম মা মরা মাইয়া, তার উপর গঠন-চরণ মাশাআল্লাহ। কার কখন নজর পড়ে কে জানে। একটা অঘটন ঘটতে সময় লাগে না। তুই বাবা দেরি করিস না । কুসুমের ঘর দেখ। বিয়া দিয়া দে।
ফেলুর মুখে চিন্তার রেখা ফুটে ওঠে। বিয়ে দিতে হবে এটা ঠিক। তাই বলে মানুষের তাতে কী? তাদের এত মাথা ব্যাথা কেন? ফেলু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, চাচিমা চাইলেই কী ঘর পাওয়া যায়? আমরা গরিব মানুষ। ট্যাহা পয়সা নাই। কে করব আমার মাইয়ারে বিয়া?
ট্যাকা না থাকলে কী আর বিয়া হয় না? কুসুম না থাকলে তোর সংসার চলব কেমনে- তুই তাই ভাবতাছস, ঠিক না?
ফেলু কিছুটা বিব্রত গলায় বলে, না চাচিমা, আমি আসলে...
রাবেয়া অনতিদূরে পিচ করে পানের পিক ফেলে মুখটা হাল্কা করে। ফেলুকে বুঝানোর সুরে বলে, না আর কেমনে কী কস? জোবেদা যখন মরল তখন তোর সংসার চলেনি? তখন তো তোর দুইডা দুধের পোলা মাইয়া। এখন বেনু বড় হইচে। কুসমকে বিয়া দিয়া ব্যাডারেও বিয়া করা। ঘরে ব্যাডার বৌ আন। খালি খালি মানুষের কথা শুনতে যাইবি ক্যান? মাইয়া বড় হইলে বিয়া দিতে হইব। সারাজীবন ওরে ঘরে রাখতে পারবি? তুই বাপু সামছুল ঘটককে খবর দে। হের হাতে ছেলেপুলে থাকে। দেখ কুসুমের একডা ব্যবস্থা হইয়া যাইব। আমার আজিমরেও আমি কইয়া রাখতাছি। হেও পারলে দেখুক।
ফেলু মত দেয়।

ফেলুর সময় দ্রুত বদলে যেতে থাকে। অনেকটা বিকালের রোদের মতো। ফেলুর মাথায় এখন একটাই চিন্তা। কুসুম। কুসুমের বিয়ে। ঘটক তাকে বলে গেছে ভালো ছেলে একটা আছে। কিন্তু তার হাতে দিতে হবে নগদ আটাশ হাজার টাকা। ত্রিশ চেয়েছিল। কথাবার্তা বলে আটাশে রফা হয়।
ঘওে শুয়ে শুয়েই তার বাবা ও রাবেয়া দাদিও কথোপকথন শুনছিল কুসুম। তার মন খারাপ। অনেকটা রাত হয়েছে। কুসুম ওঠেনি। কুপিও জ্বালায়নি। কুসুম চুলায় আগুনও দেয়নি। তার চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরতে থাকে। বাবা ও ভাইকে ছেড়ে তার যেতে হবে অজানা গন্তব্যে, কুসুম এ নির্মম সামাজিক রীতিকে কিছুতেই মানতে পারে না।
রাবেয়া চাচি চলে গেলে ফেলু ঘরের বারান্দায় মাদুর ফেলে শুয়ে থাকে। বারান্দা থেকে পরিষ্কার আকাশ দেখা যায়। আকাশে ফুলবাগানের মতো অনেক তারা ফুটে আছে। ফেলু সেদিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কুসুমকে কিছু বলে না। সে কখনোই কোনো বিষয়ে ছেলে মেয়েদের উপর চাপ দেয় না। ফেলুর পাশে বেনু এসে শোয়। ফেলু একটু পাশে সরে গিয়ে বেনুকে জায়গা করে দেয়।
বাজান? ও বাজান?
ফেলু জবাব দেয় না।
বাজান?
বেনু তাকে হাত দিয়ে একটু নড়ে দেয়।
উঁ?
চিন্তা কইরো না বাজান। আমি তোমার সাথে কাম করুম। কাল আমারে একডা ঠ্যালা ভাড়া কইরা দিও। আমরা বাপ-বেটা দুজনে কাম করলে ট্যাকা গোছ করতে আমাগো সময় লাগব না বাজান। দরকার হইলে আমাগো কালা ছাগলডাও বেইচা দিমু।
ও বাজান? হুনছ?
একটা অবাধ্য কষ্টের গোলা ফেলুর গলা দিয়ে তির বেগে বের হয়ে আসে। সে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না। ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। বেনু তার বাবার গায়ে হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করে। একইসাথে ঘর থেকে আসা কুসুমের কান্নার শব্দ গোঙ্গানির মতো শুনায়।
বেনু তার বাবাকে প্রবোধ দেয়, শান্ত হও বাজান। আমরা তো গরিব। নিয়ম তো বড়লোক গরীব হক্কলের লগে এক। বুজানের বিয়া তো দিতেই হইব। ট্যাকাও লাগব।
ফেলু বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলে, বেনু তোরে আমি সাহেব বানাইতে চাইছিনু বাপ। আমার অক্ষমতার লাইগা তোর পড়া বন্ধ হইব। আমার স্বপ্ন ভাইঙ্গা যাইব, এইডা কেমনে সই? বাপ হইয়া আমি তোদের লগে কিছুই করতে পারলাম না। তোর আর কুসুমের জীবনডা ভালোমতো গইড়া দিতে পারলাম না। এ কষ্ট আমি কোথায় রাখি?
ঘরে কুসুমের কান্নার শব্দ বাড়তে থাকে।

বেনু ভালো ঠ্যালা চালায়। তার কাজে কোনো ফাঁকিবাজি নাই। অল্প দিনেই সে ভালো ঠ্যালা শ্রমিক হিসেবে জাহাজঘাটে পরিচিতি পায়।
বেনু বেশ বুদ্ধিমান। সে দেখে ঠ্যালা শ্রমিকদের বেশির ভাগ সময় বসে থাকতে হয়। কাজও কম। এর চেয়ে জাহাজঘাটে কুলি শ্রমিকদের কাজ বেশি। কিন্তু কুলি শ্রমিক সমিতিতে নাম লেখানো সহজ কথা নয়। লোকেরা বলাবলি করে এখানকার পয়সার নাকি পাখা আছে। অনেক দিকে উড়ে যায়।
বেনু ঠ্যালা চালানোর ফাঁকে ফাঁকে জাহাজঘাট এলাকার স্থানীয় এক রাজনৈতিক নেতার ফুটফরমায়েশ খাটা শুরু করে। ধীরে ধীরে নেতার সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে। সেই নেতার আশির্বাদে অল্পদিনেই সে কুলি শ্রমিক সমিতিতে সদস্য হিসেবে নাম লেখাতে সমর্থ হয়। সকলেই বিশ্বাস করতে শুরু করে বেনুর কপালের সাথে কারও কপালের তুলনা হয় না। তারা এও বিশ্বাস করে অচিরেই সে জাহাজঘাটে একটা শক্ত অবস্থান তৈরি করে ফেলবে।

আটাশ হাজার টাকা গোছাতে ফেলু-বেনুর প্রায় বছরখানিক সময় লাগে। এরপর ফেলু সামছুল ঘটককে খবর দেয়। ঘটক জানায় আগের ছেলেটা বিয়ে করে ফেলেছে। তবে ঘটক ফেলুকে আশ্বস্ত করে বিকল্প ছেলে তার হাতে আছে। এ ঘরে একটু খরচ বেশি হবে। পঁয়ত্রিশ হাজার। কোর্টকাছারি এলাকায় ছেলের চায়ের দোকান আছে। ভালো চলে।
ফেলু রাজি হয়ে যায়।

বেনু এখন মহাব্যস্ত। সে কুলি সমিতি ও সরকার দলীয় রাজনীতি নিয়ে সমান সক্রিয়। ছেলেটা সুপারি গাছের মতো লিকলিকে আর লম্বা হয়ে উঠেছে। উচ্চতা বাড়ার সাথে সাথে বেনুর স্বভাব ও হাবভাব দিন দিন যেন ফেলুর কাছে অচিন পাখির মতো অচেনা হয়ে উঠতে থাকে। সহসা বেনুকে চিনতে পারে না ফেলু। বয়সে বেনু কিশোর হলেও আচরণে সে এখন মস্ত যুবক। এছাড়া নেতার ডান হাত বলে জাহাজঘাটে সে ভালো প্রভাবও রাখে।

ঠ্যালা চালাতে গিয়ে ফেলুর মুখ দিয়ে একদিন রক্ত উঠে। ঠ্যালাচালক সমিতির সভাপতি সুলতানের চোখে পড়ে সেটা। সে ফেলুকে বলে হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তার দেখাতে। ফেলু তা কানে তোলে না। শেষে সুলতান কথাটা বেনুকে জানায়। ডাক্তারী পরীক্ষানিরীক্ষা করে ফেলু জানতে পারে তার যক্ষা হয়েছে। অবশ্য ডাক্তার তাকে বলেছে, ভয় নাই। ভালো হয়ে যাবে। তবে ওষুধের কোর্স শেষ করতে হবে। আর বিশ্রামে থাকতে হবে।
সেই থেকে বাবাকে আর সে জাহাজ ঘাটে যেতে দেয় না বেনু। শেষে বেনুর চাপাচাপিতে ঠ্যালা গাড়িটাও বেচে দেয়। বেনুর এখন এক কথা, বাজান তুমি খাইয়া না খাইয়া আমাগো মানুষ করছ, এখন তুমি অসুস্থ। তোমার এখন কাম করনের দরকার নাই। ডাক্তারের কথা মোতাবেক বিশ্রাম কর। কুসুম বুর বিয়া আর সংসার আমি দেখতাছি।
সাঁঝ পার হয়েছে। জোছনা আর খন্ড মেঘের আলো আঁধারিতে শাপলাপুরে কুসুমের বিয়ের বাজনা বাজছে। একটা জলচৌকির উপর বসে ফেলু বিড়ি টানছে। ডাক্তার বিড়ি খাওয়া বন্ধ করতে বললেও এখনও পুরাপুরি ছাড়তে পারেনি ফেলু। এ নিয়ে বেনু, কুসুম রাগারাগি করে। আজ একটা আনন্দের দিন। আনন্দ উদ্যাপনের জন্য ফেলু বহুদিন পর বিড়ি হাতে নিয়েছে। গ্রামের ছেলে মেয়েরা আনন্দে নাচানাচি হৈ-হল্লা করছে। এবাড়ি ওবাড়ির বৌ-ঝিরা নেচে নেচে সুর করে গীত গাইছে। আজ ফেলুর একটা স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে। মা মরা মেয়টা সে সৎগতি করতে পারছে।
ফেলু ভাবতে থাকে, তার মাথার অর্ধেক চুল পেকে গেছে। বয়স হেটে যাচ্ছে। তাছাড়া যে অসুখে ধরেছে তার থেকে সে রেহাই পাবে এ বিশ্বাস সে পুরাপুরি রাখতে পারে না। তবুও ভালো ছেলেটা একটা কাজে লেগেছে। ভালো রোজগারপাতি করে। জাহাজঘাটে সবাই তাকে গোনায় ধরে, ইজ্জত করে। এই বা কম কী!

গীত শুনতে শুনতে ফেলুর জোবেদার কথা মনে পড়ে। এই তো কয়দিন হলো তার বিয়ের দিনে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশিরা এ ভিটায় একই রকম আনন্দে হৈচৈ করেছিল। তাদের বিয়ে হল। তারপর কুসুম এল, বেনু এল। আবার সবকিছু ফেলে রেখে জোবেদা অসময়ে চলে গেল। ফেলু আজও জোবেদার মারা যাওয়ার সময়ের চোখের চাহনিটা ভুলতে পারে না। বেনুর মাথায় হাত রেখে জোবেদা যা বলতে চেয়েছিল তা সে যৎকিঞ্চিত সম্পন্ন করতে পেরেছে। এটাই তার সান্তনা। একসময় ছেলেকে তার বড় শিক্ষিত করার সখ ছিল। কিন্তু এ সমাজে লেখাপড়া এক ধরণের বিলাসিতা। গরীবের তা মানায় না। যা-হোক বেনু তো ভালোয় আছে। আজ ভালো ঘরে কুসুমের বিয়ে হচ্ছে। এ যে ফেলুর কত বড় আনন্দ। কত বড় গর্বের! আজ জোবেদা থাকলে কত যে খুশি হতো। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ফেলু।

রহিমা চাচিমা পরিমরি করে একটা কুপি হাতে ফেলুর বাড়িতে দৌড়ে আসে। বৃদ্ধার কণ্ঠে অস্থিরতা।
ও-ফেলু, ফেলু?
অনেকের গীতের শব্দে বৃদ্ধার কন্ঠ মিলিয়ে যায়। তবে চাচিমার ডাক আলাদা করে ফেলুর কানে যায়। বৃদ্ধা আরও কাছে আসে।
ফেলু কই, আমগো ফেলু কই।
চাচিমা আয়। আমি এইহানে।
ফেলু প্রসন্ন কণ্ঠে জবাব দেয়। রহিমা চাচি অস্থিরভাবে দৌড়ে ফেলুর কাছে যায়। হাঁপাতে থাকে।
কি হইচে চাচিমা? বস।
ফেলু একটা পিঁড়ি এগিয়ে দেয়।
বাবা ফেলু, আমাগো বেনু কই।
ক্যান?
হে তো জাহাজঘাটে গেছে বিকালে।
বাবা কিছু হুনছ?
না চাচিমা। কি হুনুম?
ওরে বাবারে এইডা কী হইল রে!
কপাল চাপড়িয়ে বৃদ্ধা হঠাৎ মাতম করে উঠে।
ফেলুর ভেতরটায় মোচড় দিয়ে ওঠে।
কী হইচে চাচিমা?
ওরে বাবারে জাহাজ ঘাটে আজ সন্ধ্যায় গোলাগুলি হইচে। আমাগো বেনু আর নাই। আমাগো বেনুরে নাকি কারা গুলি করছে। তার লাশ থানায় নিয়া গেছে। ওই দেখ বাজান পুলিশ আইচে।
বৃদ্ধা হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে।
একজন পুলিশ অফিসার ও চারজন কনস্টেবল ফেলুর সামনে এসে দাঁড়ায়। ফেলুর মুখে টর্চের আলো ফেলে। একজন খপ করে তার হাত ধরে প্রশ্ন করে, তুই কি বেনুর বাবা, ফেলু বাদশা?
কোনো কথা ফেলুর কানে যায় না।
পুলিশ অফিসার আবার বলে, তোকে একটু আমাদের সাথে থানায় যেতে হবে। তোর ছেলে একটা বড় ধরণের ক্রিমিনাল অফেন্স করেছে। সেও গ্রিভিয়াসলি ইনজুর্ড। বুকের ডানপাশে গুলি খেয়েছে। তাদের গ্যাঙ ফাইটে জাহাজঘাটে একজন নিহত হয়েছে। বেনু এখন আমাদের হেফাজতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাকে ঢাকা মেডিকেলে পাঠানোর ব্যবস্থা চলছে।
পুলিশ অফিসার একটু থামে। দম নিয়ে বলে, আর ফেলু বাদশা, আমরা তোর ঘর সার্চ করর। বাসায় আরও কোনো অবৈধ অস্ত্র আছে কি না তা আমরা নিশ্চিত হব। তুই রেডি হ। তোর সাথেও কথা বলা দরকার। আমাদের সাথে তোকে থানায় যেতে হবে।
পুলিশ অফিসারটি ইঙ্গিত করতেই ফেলুর ঘরে দৌড়ে প্রবেশ করে তিনজন পুলিশ সদস্য।
ফেলু হঠাৎ কাঠের মতো শুকিয়ে যায়। তার ভেতর যেন আর বাতাস ঢুকছে না। কুসুমের বিয়ের গীত ও গানের মাইক বন্ধ হয়ে গেছে। বিয়ে বাড়ির আনন্দময় পরিবেশ নিমিষেই এক বেদনার্ত ও দুঃসহ পরিবেশে রূপান্তরিত হয়। আগত পাড়া প্রতিবেশীরা সকলে কুসুমকে ছেড়ে বৃদ্ধা রাবেয়া ও ফেলুকে ঘিরে ধরে। উপস্থিত বৌ-ঝিরা চিৎকার করে আহাজারি করতে থাকে, ওরে আল্লা রে এ কী হইল রে!

আলতা পড়ানো পা আর হলুদ শাড়িতে কুসুমকে আজ অন্যরকম সুন্দর লাগছে। কুপির আলো ও শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদের আলোর সংমিশ্রণে কুসুমের মুখাবয়বে পিঁয়াজের তাজা খোঁসার মতো এক নিপুণ সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে। আজ তাকে বৃষ্টিস্নাত পদ্মের মতো সজীব ও নির্মল দেখাচ্ছে।

পুলিশ সদস্যরা ফেলুর ঘর তন্ন তন্ন করে খোঁজে। কোনো অবৈধ অস্ত্র বা প্রশ্নবিদ্ধ কোনো আলামত পায় না।

কুসুম হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে এসে উঠোনে দাঁড়ানো বাবাকে জড়িয়ে ধরে। পুলিশ সদস্যরা তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে পিকাপের দিকে পা বাড়াতে চায়। কুসুম জোঁকের মতো তার বাবার গলা জড়িয়ে ধরে। আহাজারি করে বলতে থাকে, বাজান আমারে ক্ষমা কইরা দাও। ও বাজান, বাজান আমিই, আমিই বেনুর এ অবস্থার জন্য দায়ি। আমার জন্যই বেনু পড়ালেখা বাদ দিয়া জাহাজঘাটে গেছে। আমিই আমার বেনুরে মৃত্যুর মুখে ঠেইলা দিছি। বাজান আমিই আমার ভাইয়ের আজরাইল। আমারে গলা টিপা মাইরা ফেল বাজান। আমারে খুন কর।

ফেলুর ঘরের চালা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে একটা বড় কাঁঠাল গাছ। সেই গাছের ডালে দুইটি পেঁচা পাখা ঝাপটায়। রাবেয়ার সিক্ত চোখে এতে এক অশুভ ছায়ার প্রতিবিম্ব ধরা পড়ে। সে হাতের কুপিটা যথাসম্ভব মাথার উপরে তির্যকভাবে তুলে ধরে। কাঁঠাল গাছের দিকে তাকিয়ে রাবেয়া পেঁচাদের উদ্দেশ্যে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে, হিস্ হিস্। দূর হ লক্ষèীছাড়া, দূর হ।

ফেলুর মুখে কোনো কথা নেই। বোবার মতো জোছনামাখা আধো অন্ধকারে কুসুমের মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। পুলিশ অফিসার তাড়া দিয়ে বলে, ফেলু জলদি কর।
কুসুম এবার কান্নায় ফেটে পড়ে। অভাগিনীর কান্নার শব্দের পরিব্যপ্তি জোছনার আলোর বিস্তৃতিকে ছাপিয়ে যায়।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৫:২৯

নূর মোহাম্মদ নূরু বলেছেন:
চমৎকার কথামালায় গাথা
দারুন গল্প !!

২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:৫৯

বাগান বিলাস বলেছেন: অনেক কৃতজ্ঞতা জানবেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.