নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি হয়তো মানুষ নই, মানুষগুলো অন্যরকম, হাঁটতে পারে, বসতে পারে, এ-ঘর থেকে ও-ঘরে যায়, মানুষগুলো অন্যরকম, সাপে কাটলে দৌড়ে পালায়। আমি হয়তো মানুষ নই, সারাটা দিন দাঁড়িয়ে থাকি, গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকি।

বাগান বিলাস

যাপিত জীবনকে নিয়ে ভাবনার অনেক উপাদান আছে। তবে সবকিছু ভাবতে পারি না। ভাবার সুযোগ পেয়েও অনেক অনুষঙ্গ নিজ প্রয়োজনে এড়িয়ে গেছি। অনেক বিষয়ে পরে ভাবা যাবে বলে ঐ পরিচ্ছেদে আর কখনও যাওয়াই হয়নি। তবে বারংবার আমি প্রকৃতির কাছে ফিরে গেছি। তার কাছে শিখতে চেয়েছি। প্রকৃতিও শেখালো ঢের। তবুও হয়তো আমার প্রত্যাশা ও শিখনফলে আছে হতাশা । ইচ্ছা ও প্রাপ্তির খতিয়ান খুব একাকী মিলিয়ে দেখি-কত কিছুইতো হলো না দেখা, হলো না কত শেখার শুরু । তবুও প্রাপ্তি কি একেবারেই কম? মোটেই না। পেয়েছিও ঢের। মনে তাই প্রশ্ন জাগে, যেদিন আমি আবার নিঃশ্বেস হয়ে যাব সেদিন কি প্রকৃতিও আমার মতো একা হয়ে যাবে? এর জবাবও প্রকৃতির বিবৃতিতেই পেয়েছি-না, ক্ষুদ্র জীবনের আঁচর প্রকৃতিতে বেশিক্ষণ মূর্ত থাকে না। অন্যকথায় প্রকৃতির মধ্যে বিষণ্নতা বেশি দিন ভর করে থাকে না। তাই সে সহজ, তাই সে সমাদৃত! আমার বিবেচনায় একারণে প্রকৃতি সকল জীব ও জড়ের কাছে সবচেয়ে বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

বাগান বিলাস › বিস্তারিত পোস্টঃ

ঘাত

০৬ ই নভেম্বর, ২০১৭ রাত ১১:০৪

চায়ের কাপে কোনো মৌমাছি বসেনি।

ঘুম থেকে উঠেই অবাক হয়ে গেলেন রহমত উল্লাহ। শোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসলেন। ঘরের ডিমলাইটের আলোয় চায়ের কাপে আরও একবার নিখুঁত দৃষ্টিতে দেখলেন। না, কোনো হেরফের নাই। তিনি জানালার দিকে তাকালেন। জানালা খোলা আছে।
বেশ কিছু দিন ধরে ঘটতে থাকা ঘটনার ব্যত্যয় ঘটল আজ। রুটিনটি চালু ছিল অনেক দিন। প্রতিরাতে ঘুমানোর আগে এক কাপ চা খান রহমত উল্লাহ। বেডসাইড টেবিলে ল্যাম্পের পাশে এক কাপ চা রেখে যায় আবুলের মা। রহমত উল্লাহ সাধারণত গরম চা খান না। চা ঠান্ডা হতে থাকে। তিনি পড়াশুনা বা অন্য অফিসিয়াল কাজ সেরে আস্তেধীরে সেই চা নেন। খালি কাপটি থেকে যায় বেডসাইড টেবিলে। রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখেন কয়েকটা মৌমাছি চায়ের সেই খালি কাপে বসা। একেবারে নিয়ম মাফিক। তারা চায়ের কাপে কী যেন খোঁজে।
যাহোক, রহমত উল্লাহ মনে মনে ধরে নিয়েছে মৌমাছিগুলো তার সকালিক বন্ধু। আজ কেন তারা এলো না তা রহমতউল্লাহর বোধগম্য হচ্ছে না।
দ্বিতীয়বার চোখের পাতায় আঙুল চালিয়ে ভ্রম কাটানোর চেষ্টা করলেন তিনি। হতাশ হয়ে অগত্যা ঘরজুড়ে দৃষ্টি প্রসারিত করলেন। তিনি নিজেকে প্রশ্ন করলেন, তারা কি ইতোমধ্যে চলে গেছে? বন্ধুরা তাকে ছাড়া একা একা চা খেয়ে চলে যাবে এটা কি হতে পারে? রহমত উল্লাহ কোনো কারণ খুঁজে পান না।

রহমত উল্লাহর বয়স পঞ্চান্নের কাছাকাছি। পেশায় তিনি চাকরিজীবী। রেশম উন্নয়ন বোর্ডের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। চাকরির পাশাপাশি তার মরহুমা স্ত্রী রাহেলার রেখে যাওয়া বুটিক হাউজ দেখাশোনা করেন। শখের বসে রাহেলা এটা শুরু করেছিলেন।

রাহেলা চলে গেছে প্রায় পনের বছর হবে। এখন সেই বুটিক হাউজ ডানা মেলেছে। আলাদা কারখানা হয়েছে। উৎপাদিত পন্যের মান, চাহিদা ও বিপনন বেড়েছে। তেতাল্লিশ জন মানুষ নিয়মিত কাজ করে বুটিক হাউজে। রহমত উল্লাহর ভালোয় লাগে। রাহেলার বুটিক হাউজের কল্যাণে কিছু মানুষের তো কর্মসংস্থান হয়েছে। এই বা খারাপ কী।
রহমত উল্লাহ ঘরের জিরো বাল্ব নিভে দিয়ে মার্কারি লাইট জ্বালালেন। ঘর কৃত্রিম আলোয় ভেসে গেল। হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে চোখ কিছুটা কুঞ্চিত হলো। ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই স্থির হয়ে গেলেন রহমত উল্লাহ। দুটা সাতাশ বাজে। তার মানে তো এখনও ভোরই হয়নি। নিজের উপর রাগ হলো তার। এতো বড় ভুল হয় কী করে মানুষের? এ যে ভোর না হতেই ভোরের স্বপ্ন দেখা। তিনি কি বিপ্লবী? নাকি দিন দিন আত্মবিশ্বাস কমে যাচ্ছে?
অন্যমনস্ক অথচ খেয়ালি এক দৃষ্টি নিয়ে তিনি পা টিপে টিপে জানালার পাশে গেলেন। তিনি চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে ঘুরে ফিরে দেখলেন, তারপর হঠাৎ কী মনে করে কাপটা মেঝেতে ছেড়ে দিলেন। সিরামিকের কাপটা যা শব্দ হওয়ার কথা তার চেয়ে বেশি শব্দে ভেঙে মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ল।
কাপটা ভেঙ্গে যাওয়ার পর রহমত উল্লাহ বুঝতে পারলেন কাজটা ছেলেমানুষি গোছের হলো। কিছুটা অস্বস্তি বোধ করলেন। অস্বস্তি কাটাতে তিনি লাইব্রেরি ঘরের দিকে পা বাড়ালেন।

কোনো রাতে শেষ কাপ চা খাওয়ার পর ঘুম না এলে গদিআঁটা চেয়ারে বসে বই পড়েন রহমত উল্লাহ। বইয়ের কিছু আছে অপার্থিব। যার সঙ্গে বিজ্ঞান বা দর্শনের চিরকালীন শত্রুতা। পদার্থবিদ্যার একজন ছাত্র হিসেবে নিজেকে তিনি কুসংস্কারমুক্ত মানুষ বলে দাবি করেন। এই তিনিই আবার কীভাবে অতিপ্রাকৃত বই পছন্দ করেন, রাদিয়ার তা মাথায় ঢোকে না। তার এ সব অতিপ্রাকৃত বিষয় রাদিয়ার একদম পছন্দ নয়।

গতরাতে রাদিয়া বাবার ঘরে ঢুকে লাইট অফ করে দেয়। রহমত উল্লাহ শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিলেন। তিনি বিপন্ন কণ্ঠে বললেন, ওফ রাদিয়া লাইট টা দে তো মা। পড়ছি, প্লিজ। বিরক্ত করিস না।
অবাক হয়ে যায় রাদিয়া। বাবা কেমন করে জানালো সে তার ঘরে ঢুকেছে? সে বলল, বাবা তুমি বুঝলে কেমন করে আমি তোমার ঘরে এসেছি? শব্দ হবে তাই খালি পায়ে এসেছি।
হাতের বইটা বন্ধ করে শব্দ করে হাসলেন রহমত উল্লাহ। অনেকক্ষণ। তারপর বললেন, তুই হলি আমার মেয়ে। আমি তোর চেয়ে বয়সে ও অভিজ্ঞতায় বড় তাই কি না ?
তা ঠিক বলেছ।
বাবার কথায় সম্মতি দেয় রাদিয়া।
তার বাবা বলতে থাকে, ভেবেছিস আমি তোর গতিবিধি বুঝি না? তা ছাড়া তুই আমার ঘরে এসে আমার উপর হামলা করবি আর আমি টের পাব না, আমাকে কি তুই কেমন প্রাণী ভাবিস বলতো?
আবার ঘর ফাটিয়ে ঠা ঠা করে হাসতে থাকেন রহমত উল্লাহ।
বাবা হেসো না তো আমার ভয় করে।
কীসের ভয়? ভূতের না কি রে?

রাদিয়া রহমত উল্লাহর একমাত্র মেয়ে। মা মারা যাবার পর তার বাবাই তাকে মায়ের ও বাবার আদরে রেখেছেন। এখন সে কলেজে পড়ে। এইচএসসি সেকেন্ড ইয়ার। সে হয়েছে ঠিক তার মায়ের মতো। তীক্ষ্ণ ও গভীর প্রজ্ঞাসম্পন্ন। সবকিছুতেই গভীর দৃষ্টি।
উঠে গিয়ে নিজ হাতে সুইচ টিপে লাইট জ্বালান রহমত উল্লাহ। রাদিয়ার জবাবের অপেক্ষা না করে নিজে থেকে বলতে থাকেন, দূর বোকা মেয়ে ওসব ভূত-পেতনী দেশে আছে নাকি? ওসব মিথ। দেখ কিছু কিছু কথা আছে যা কেবল বই পুস্তকেই মানায়। তিনি হাতে ধরা রবীন্দ্রনাথের একটি বই ইঙ্গিত করে বলেন, যেমন ধর এই যে রবীন্দ্রনাথ প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়কে একটি কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছিলেন...
রাদিয়া অধৈর্য হয়ে বলল, ওফ! বাবা প্লিজ। আমি বললাম, তোমার বিকট হাসি শুনে আমার ভয় করছে। আর তুমি টেনে আনলে রবীন্দ্রনাথকে। শুরু করলে অপ্রাসঙ্গিক লেকচার।
অপ্রাসঙ্গিক লেকচার কোথায় দেখলি?
অপ্রাসঙ্গিক নয়? তুমি যাপিত জীবনে টেনে আনলে কবিতার ভাবনা। কবির মনের আবেগ উপলব্ধি আর যাপিত জীবনকে তুমি এক করে ফেলেছ। জীবনে সবারই আলাদা অবস্থান আছে।
তাতো ঠিকই।
সপ্রশ্রয় মাথা ঝাঁকালেন তিনি।
আমি বললাম আমার ভয়ের কথা, আর তুমি আনলে রবীন্দ্রনাথের আবেগকে। কবিরা মানুষের আবেগ অনুভূতির চর্চা করে, তাদের বিভিন্ন উপমায় সাজায়। এটাই তাদের কাজ। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি বলে তার ক্ষেত্রে এটা আরও বেশি সত্য।
কথার মারপ্যাঁচে পড়ে রহমত উল্লাহ কিছুটা নিশপিশ করতে লাগলেন। তিনি আবার কাতরকণ্ঠে যোগ করলেন, আমি এখানে রবীন্দ্রনাথের...
বাবার কথা শেষ করতে দেয় না রাদিয়া। অস্বস্তি নিয়ে বলে, বাদ দাও তো বাবা এ প্রসঙ্গ। আমার কোনো ভয় করেনি। এবার হলো?
চা খাবে নাকি বলো। আবুলের মাকে চা করতে বলে এসেছি। অনেকদিন ডিনারের পর তোমার সাথে চা খাওয়া হয় না।
ঠিক আছে। চা দিতে বল।
রাদিয়া চা দিতে আবুলের মাকে ডাকে।
আবুলের মা শুনতে পায় না। রাদিয়া ঘর থেকে বেরিয়ে গলা উঠিয়ে তাকে ডাকে।
রাদিয়া?
জ্বি বাবা?
তুই কি একটু অপেক্ষা করবি মা? ফোনে ম্যানেজার সাহেবের সাথে একটু কথা সেরে নেই তারপর এক সাথে চা খাব।
কি আলাপ বাবা, ব্যবসা সম্পর্কিত?
হ্যাঁ মা। বুটিক হাউজে কয়েকজন লোক নিয়োগ করতে হবে। ভাবছি খবরের কাগজে ছেপে দেবো। দেখি ম্যানেজার সাহেব কি পরামর্শ দেয়।
রহমত উল্লাহ ম্যানেজারকে ফোন দেন।

চা আসে। রাদিয়া হাই তুলে বলে, বাবা আমি চা খাব না। ঘুমাতে গেলাম। রহমত উল্লাহ চা শেষ করে কাপটা বেডসাইড টেবিলে রেখে দেন।

শব্দটা বিমলের কানে গেল।
ঘুমায়নি বিমল। রাতও আহামরি গভীর হয়নি। ঘুমও আসছিল না তার। বসে বসে বিড়ি টানছিল। নিচতলা থেকে শব্দের উৎসটা ধরতে পারল না। শব্দটা উপরের তলা থেকে আসতে পারে বলে তার ধারণা। চোর-ডাকাত আসেনি তো? চৌকিতে বসে বিড়ি টানতে টানতে সে কান পেতে রাখে। আরও কোনো শব্দ আসে কি না। না। আর শব্দ নেই। তবে সে বসে থাকতে পারে না। কোনো অঘটন যদি ঘটে যায়।
সে চৌকি থেকে উঠে তড়িঘড়ি কোমরে বেঁধে নেয় গামছা। মাথার পাশের তোশক উল্টে একটা চাকু কোমরে গোঁজে নিয়ে গেঞ্জি দিয়ে ঢেকে দেয়। ঘুমন্ত দারোয়ানকে ডেকে চাবি খুলে নেয়। তরতর করে উঠতে চায় উপরে। দারোয়ান বিরক্তিকর প্রশ্ন করে। এখন এত প্রশ্নের জবাব দেওয়ার সময় আছে?
ক্যামন শব্দ হুনলা?
মারাত্মক।
ক্যামুন মারাত্মক? হেইডা তো তোমার শুননের কথা?
নাহ্ শুনতে পাই নাই।
তুমি শুনবা কেমনে? তুমি তো খালি ঘুমাও। লাডি নিয়া ঠিকঠাক খাড়াও। এই দিকে যেন কোনো ব্যাডা আইতে না পারে। আইলে ঠেঙ্গাইবা। পারবা না?
হে ক্যামুনে কই? হেই যদি আমারে আগে ঠেঙ্গায়?
আরে ব্যাডা এই সাহস লইয়া তোমার দারোয়ান হওয়া ঠিক হয়নি। খাড়াও এইহানে। স্টুপিড।
কী কইলা?
কিছু না। খাড়াও আইতাছি।

বিমল স্টুপিড কথাটা আয়ত্ত করেছে বড় সাহেবের কাছে থেকে। কোনো এক মেঘলা বিকালে নিজ বাসার চারপাশের ওয়াকওয়ে ধরে হাঁটছিলেন। সঙ্গে রিংকু, পোষা কুকুর। মন ভালো ছিল না রহমত উল্লাহর। বিমল ব্যালকনিতে বেতের চেয়ার পেতে দিয়ে রহমত উল্লাহর পিছনে পিছনে গিয়ে বলে, স্যার বৃষ্টি নামব। ব্যালকনিতে চেয়ার দিছি। বসেন।
আচমকা তিনি রেগে যান বিমলের উপর। কপাল কুঁচকে বাজখাঁই গলায় বিমলের উদ্দেশ্যে বলেন, স্টুপিড।
বিমল নিরক্ষর। সে স্টুপিড শব্দের অর্থ জানে না। তবে ভাবে ও উচ্চারণে সে বুঝতে পারে সাহেবের মনটা ভালো নেই এবং এটা ভদ্রগোছের কোনো গালি।

বিমল ছেলেটা খুবই বিশ্বাসী। সাধারণত মানুষ এত নির্লোভ আর উদার হয় না। রহমত উল্লাহ তাকে পেয়েছিল চুয়াডাঙ্গায় কাজ করার সময়। তখন বিমল অনেক ছোট ছিল। তাও আজ প্রায় পঁচিশ বছর আগের কথা। তার বাবা মা ছিল না। অফিসের এক পিয়ন বিমলকে সঙ্গে করে এনেছিল। বলেছিল, স্যার এতিম ছেলে। কেউ নাই। আমাদের ফুটফরমায়েশ খাটবে। বিমল অফিসে চা পানি এনে দিত। অফিস ঘরটাকে মুছে তকতকে রাখত। রহমত উল্লাহর সওদাপাতি করে দিত। খুব বিশ্বাসী বলে অল্প দিনেই সে অফিসের সকলের আস্থা অর্জন করে ফেলে। রহমত উল্লাহ তাকে খাওয়াত। ঈদ পরবে সালামি, নতুন জামাকাপড় দিত। চুয়াডাঙ্গা থেকে তার বদলির সময় বিমল খুব কাঁদে। রাহেলা তাকে বলে, তুই আমাদের সাথে যাবি? উপরে নিচে মাথা ঝাঁকিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে বিমল। দৌড়ে সোজা গিয়ে উঠে তাদের মালামাল বোঝাই ট্রাকে। সেই থেকে বিমল রহমত উল্লাহর সংসারের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তার সংসারের সকল দুঃখে সুখে বিমল সমান অংশীদার।

দোতলায় উঠে শব্দ হওয়ার মতো কোনো লক্ষণ চোখে পড়ে না বিমলের। সবই ঠিকঠাক। রাদিয়া শুয়ে আছে তার ঘরে। দরজা বন্ধ। সাহেবের শোবার ঘরের দরজাও ভেড়ানো। আজিজ মামার ঘরেও কোনো সাড়া শব্দ নেই। তবুও আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য সে সব দরজায় মৃদু চাপ দিয়ে পরখ করে দেখে। না ঠিকই আছে। দরজা বন্ধ। লাইব্রেরি রুমে উঁকি দেয় বিমল।
ডুপ্লেক্স বাসার উপর তালায় চারটা ঘর। একটি ডাইনিং। একটি লাইব্রেরি। রাজ্যের বই ওইখানে।

আজিজ মামাকে এ বাসায় সকলে মামা ডাকে। রাহেলার মৃত্যুর পর রহমত উল্লাহ রাহেলার ছোটো ভাই আজিজকে তার বাসায় নিয়ে আসেন। সে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করছে। রহমত উল্লাহ তাকে আপন ছোটো ভাইয়ের মতো দেখেন।
বিমল!
নিরবতা ভেঙ্গে অস্ফুটস্বরে ডাক দেন রহমত উল্লাহ।
ভয় পেয়েছিস? অন্ধকারে তোকে পিছন থেকে ডাকলাম।
মৃদু চমকে উঠে বিমল। তড়িৎ জবাব দেয়, না স্যার।
আমার মনে হয় তুই লুকাতে চাইছিস। ভয় কিছুটা পেয়েছিস।
পাইনি স্যার।
তবে তোর জায়গায় আমি হলে কিন্তু ভয় পেতাম।
জ্বি স্যার। লাইট দিমু স্যার?
দে।
বিমল লাইট জ্বালায়। দ্রুত চোখ ঘুরিয়ে চারপাশ দেখার চেষ্টা করে। সবকিছু তার স্বাভাবিক মনে হয়।
তুই কেন উপরে এসেছিস তাতো বললি না বিমল। রহমত উল্লাহ তাকে প্রশ্ন করেন।
বিমল কিছু বলতে চায় না। আমতা আমতা করে। রহমত উল্লাহ বিমলের কাঁধে হাত রেখে বলেন, আমি কিন্তু জানি তুই কেনো এত রাতে উপরে এসেছিস।
বিমল চুপ করে থাকে। বুঝতে পারে তার অনুমানটা ঠিক ছিল না।
শব্দটা তোর কানে গেছে তাই না?
জ্বে স্যার। আমি মনে করেছি চোর-ডাকাত। হরবর করে বলে ফেলে বিমল।
রহমত উল্লাহ হাসতে হাসতে লাইব্রেরি ঘরটার পড়ার টেবিলের দিকে যান। পিছনে বিমল তাকে অনুসরণ করে।
বিমল তুই আসলে বোকাই থেকে গেলি। বাসার মেইন গেট বন্ধ। দোতলার সিঁড়ি বন্ধ। লিফট বন্ধ। তুই কেমন করে ভাবলি বাসায় চোর ডাকাত এসেছে?
অন্ধকারে চেনা জগৎটাকেও অচেনা মনে হয়, তাই না বিমল? অন্ধকারকে আমরা অযথা ভয় পাই।
জ্বি।
আচ্ছা, অন্ধকার কি জানিস বিমল?
জ্বে স্যার। ঘুটঘুটা আন্ধার। কিছু দেখন যায় না।
হু। তুই ঠিকই বলেছিস। যা ঘুমাতে যা।
বিমলের জবাবের একটা অংশ রহমত উল্লাহর মাথায় ঘুরতে থাকে ‘ঘুটঘুটা আন্ধার’।
তিনি নিজে নিজে ভাবতে থাকেন, ছেলেটার কোনো পরিবর্তন হলো না। ওর চিন্তা কত সরল। কত নিষ্পাপ!

বিমল চলে যায়।
রহমত উল্লাহ পুনরায় লাইব্রেরি ঘরের সুইচ বন্ধ করে অন্ধকারে তার পড়ার টেবিলের কাছে যান। চেয়ার টেনে বসেন। অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না। তিনি নিজের সঙ্গে কথা বলতে থাকেন, অন্ধকার হলো দ্রাবক। এতে সবাই দ্রবীভূত হয়ে যায়। যেমন আমি এখানে অন্ধকারের শরীরে মিশে গেছি। এই মুহূর্তে আমার চারপাশের সব কিছু, যেমন: এই ঘর, সব বই, পড়ার টেবিল, দেওয়ালের পোট্রেট ইত্যাদির আলাদা কোনো অস্তিত্ব নেই। সকলেই অন্ধকারে দ্রবীভূত হয়ে গেছি।
রহমত উল্লাহ অন্যমনস্কভাবে আঙুল মটকাতে মটকাতে চিন্তা করতে থাকেন, মহাবিশ্বটাও একটা দ্রাবকের মতো। মহাবিশ্বে দূরত্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রহ-নক্ষত্রসহ সকল অস্তিত্ব ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয় এবং একসময় দৃশ্যহীন হয়ে যায়। অন্যকথায় বস্তুর অস্তিত্ব থাকার পরও দূরত্বের কারণে তা অদৃশ্য হয়ে মহাশূন্যের অন্ধকার গহবরে দ্রবীভূত হয়ে যায়।
রহমত উল্লাহ হাত আন্দাজে বুকসেলফ থেকে একটা বই টেনে নিয়ে অন্ধকারেই চেয়ারে বসে বইটির পাতা উল্টাতে থাকেন। তিনি ভাবতে থাকেন, অন্ধকার ও অস্তিত্বহীনতার মধ্যে এক ধরণের নিবিড় সম্পর্ক আছে। তিনি বইটি নাড়াচাড়া করতে করতে ভাবতে থাকেন, আর এক দিকে বলতে গেলে অস্তিত্ব থাকার পরও আমি যা দেখি না বা অনুভব করতে পারি না, সেটাই আমার কাছে অন্ধকার বা অস্তিত্বহীন। যেমন স্ট্যাচু অব লিবার্টির অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও আমি দেখিনি, তাই আমার কাছে এটা অস্তিত্বহীন। আবার অপর এক ধরণের অস্তিত্বহীনতার সঙ্গেও আমার পরিচয় আছে। যেমন রাহেলা মারা গেছে। এখন তার অস্তিত্ব নেই অর্থাৎ রাহেলা ও অন্ধকার সমার্থক। তবে বাস্তবতার নিরিখে আমার কাছে স্ট্যাচু অব লিবার্টি ও রাহেলার অস্তিত্বহীনতার মধ্যে বস্তুগত ফারাক আছে। পার্থক্য হলো আপাত অস্তিত্বহীন ও চূড়ান্ত অস্তিত্বহীন। যেমন আমি আমেরিকা গেলে স্ট্যাচু অব লিবার্টিকে অনায়াশে দেখতে পাব। অর্থাৎ এর বাস্তবতা আছে। আর শত চেষ্টা করেও রাহেলাকে আর কোথাও দেখতে পাব না। অর্থাৎ আমার কাছে রাহেলা চূড়ান্ত অস্তিত্বহীন। যা বিমলের কথায় ঘুটঘুটে আন্ধার।
রাহেলার কথা মনে হতেই রহমত উল্লাহর মনটা খারাপ হয়ে যায়। লাইট জ্বালিয়ে বইটিতে চোখ ফেলে কিছু একটা পড়তে চান। তার আর পড়তে ভালো লাগছে না। আলো নিভে দিয়ে শোয়ার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েন।

পরদিন শুক্রবার। রাদিয়ার কলেজ ছুটি। শুক্রবারে তার দেরিতে ঘুম ভাঙে। কলেজে যাওয়ার পিড়াপিড়ি নেই। ছুটির দিনে সে একটু আয়েশ করে ঘুমায়। তার বাবা তাকে ডাকে না। সপ্তাহের ক্লান্তিটা সে এই দিনটার সকালের হাতে তুলে দেয়। মনটা ঝরঝরে হয়। অলসতার বিলাসিতা করে।
রাদিয়া ঘুম থেকে উঠে দেখে তার বাবা ও মামা নাশতা শেষ করে চা খাচ্ছে। আজ তারাও দেখি লেট পার্টি, মনে মনে বলে রাদিয়া।
সে বাবার পাশের চেয়ারটায় গিয়ে বসে। একটু আহ্লাদী স্বরে বলে, বাবা আমাকে না ডেকে তোমরা নাশতা খেলে কেন?
রহমত উল্লাহ একটু প্রশ্রয়ের হাসি হাসেন। তারপর জবাব দিলেন, তুই কি ছুটির দিনে এত সকালে উঠিস? আর সকালে উঠলে আজ তোর ছুটির দিন থাকতো? আরম আয়েশ করলি এর মূল্য নেই? আজিজ তুমি কিছু বলছ না কেন?
দুলাভাই, রাদিয়া আসলে আপনার কাছে যে নালিশটি করেছে তা সে ভালো করেই জানে সেটা অর্থহীন। আপনি বা আমি যদি তাকে সাত সকালে ডেকে নাশতা করতে বলতাম তাহলে দেখতেন ওর মুখের কী অবস্থা।
রাদিয়া মামার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, মামা তুমি তো দেখি বাবার ম্যানেজারের মতো হয়ে গেছ। যেন তুমি সব জানো। অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ যা ঘটেছে তাও, যা ঘটেনি তাও।
আজিজ আত্মবিশ্বাসের সাথে হাসে। যেন রাদিয়া যা বলেছে তা সর্বৈব সত্য। রাদিয়া হঠাৎ বলে, বাবা চলো না কোথাও যাই আজ।
রহমত উল্লাহ বললেন, কোথায় যাবি?
চলো না, আমার আর একটুও ভালো লাগছে না। কোথাও থেকে আজ একটু ঘুরে আসি।
আজিজ বলে, দুলাভাই যান কোথাও থেকে ওকে ঘুরে নিয়ে আসেন।
তুমি যাবে না? রহমত উল্লাহ তাকে প্রশ্ন করেন।
না দুলাভাই। আমাদের ডিপার্টমেন্টে আজ প্র্যাকটিক্যাল রিভিউ ক্লাস হবে। আগামি সপ্তাহে আমার সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল একজাম শুরু। কোথাও যাওয়ার সময় পাব না।
তোমার পরীক্ষা শেষ কবে? আজিজের কাছে জানতে চান রহমত উল্লাহ। ফেব্রুয়ারির বাইশ তারিখ।
আর রাদিয়ার একজাম?
আমার তো দেরি আছে বাবা। এপ্রিলে শুরু, চলবে প্রায় একমাস। রাদিয়া জবাব দেয়।
আচ্ছা তোদের দুজনেরই পরীক্ষা শেষ হোক। আমরা কোথাও থেকে ঘুরে আসব।
দেশে না বাইরে দুলাভাই?
রাদিয়া মামার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলে, বাবা চলো আমরা দাদু বাড়ি যাই। ওখানে অনেক দিন যাই না। এবার অনেক দিন থাকব। ঘুরব, মাজা করব। অন্ধকার রাতে বাগানে বসে জোনাকি দেখব। দাদু বাড়িতে একটা ঘাটবাঁধানো পুকুর ছিল না বাবা? সেই ঘাটের পাশে বড় একটা শিমুল গাছ ছিল। এখনও নিশ্চয় আছে। সেই পুকুরে মাছ ধরব। আমাদের শিকার করা মাছ দিয়ে ছোটখাটো একটা পিকনিক হবে। তুমি এক রাতে পালাগানের আয়োজন করবে। আমরা সারা রাত ধরে গান শুনব। খুব মজা হবে। আমরা সবাই যাব। আমাদের বিমল ওরাও, রিংকুও।
আজিজও তাতে সায় দেয়।
রাদিয়া আরও যোগ করে, বাবা আমরা কিন্তু গাড়িতে যাব না প্লিজ। রাতের ট্রেনে যাব। পূর্ণিমা দেখতে দেখতে যাব।
রহমত উল্লাহ খুব খুশি হয় রাদিয়ার প্রস্তাবে। অনেক দিন গ্রামের বাড়ি যাওয়া হয় না। এই সুযোগে এলাকার লোকজনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হবে। মা-বাবার ও রাহেলার কবরটা জিয়ারত করা যাবে। মনটা উচাটন লাগে তার। হাজার হলেও নিজের জন্মস্থান। নাড়ি পোঁতা আছে সেখানে। রহমত উল্লাহ বলেন, আজিজ তোমার ভাগ্নি তো দেখি বড় হয়ে কবি হবে।
কেন? কথা ধরতে পারে না আজিজ।
দেখছ না, কথায় কথায় জোছনা, গান।
সবাই সমস্বরে হেসে উঠে।

বসন্তের হাওয়া বইতে থাকা এপ্রিল মাস শেষে সবার মন চনমনিয়ে উঠে। রাদিয়ার পরীক্ষা শেষ। আজিজের তৃতীয় বর্ষের ক্লাশ এখনও শুরু হয়নি। ফুলে ফুলে সুশোভিত প্রকৃতি। এ সময়টাকে সবাই উপভোগ করতে চায়। রহমত উল্লাহ অফিস থেকে পনেরো দিন শ্রান্তিবিনোদন ছুটি নেন।

সবার মধ্যে গ্রামের বাড়ি যাবার প্রস্তুতি পুরোদমে চলতে থাকে। যেন অনেক দিন ফেরা হবে না এ বাসায়। কাদেরের উপর গুরুদায়িত্ব এই ছুটির সময়ে। আরও দায়িত্ব নিয়ে বাসা দেখেশুনে রাখতে হবে। এ কয়েকদিন কাদের শুধু এ বাসার দারোয়ানই নয় আরও বেশি কিছু, বাসার মালিকও বটে। তাকে নিজের মতো করে রান্নাবান্না করে খেতে হবে। আবুলের মা কাদেরকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বুঝিয়ে দেয় কোথায় রান্নার কোন সরঞ্জাম আছে। এ ছাড়া খাবারের পর রান্নাঘরের জিনিসপত্র ধুয়ে কীভাবে কোথায় রাখতে হবে তাও দেখিয়ে দেয়।

বিমলও তার কাজ সেরে রাখে।
বিশেষ করে তাদের বাসায় না থাকার সময়টায় কাদেরকে কীভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে তা ভালোভাবে বুঝিয়ে দেয় বিমল। বাসার সিকিউরিটি যেন কোনোভাবে বিঘ্নিত না হয়। দোতলায় দিনে একবার যাবে। সব বন্ধ ঘরগুলো বাইরে থেকে ধাক্কা দিয়ে পরীক্ষা করে দেখবে। সে কাদেরকে বুঝিয়ে বলে কোনো বিষয়ে যদি তার সমস্যা হয় তাহলে যেন সঙ্গে সঙ্গে তাকে ফোন করে। কাদের মাথা নেড়ে সায় দেয়। বিমল বুঝিয়ে দেয় কোন লাইট কখন জ্বালাবে কখন নেভাবে। বিদ্যুতের অপচয় বিমল সহ্য করতে পারে না। এটা যে দেশের অপচয় তা কাদেরকে পুনরায় স্মরণ করে দেয়।
সব সমস্যার মোটামুটি সমাধান করে ফেলে বিমল। কেবল একটি সমস্যার কোনো সমাধান খুঁজে পাচ্ছে না সে। রাদিয়া রিংকুকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু ট্রেনে কুকুরকে কে কীভাবে নেবে তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে যায় বিমল। এ নিয়ে রহমত উল্লাহর সঙ্গে কথা বলতে সে ভয় পায়। রহমত উল্লাহ খুবই ভালো মানুষ। ভয় পাওয়ার কিছু নাই। কিন্তু ছোটকাল থেকেই তাকে কেন যেন তার ভয় করে। সব কথা সহজে বলতে পারে না। পেঁচিয়ে যায়।

রিংকুর কুলকিনারা করতে না পেরে শেষে আজিজ মামার কাছে কথাটা তোলে বিমল। আজিজ মামা একটা সমাধান দেয়। একটা কাঠের বাক্সে রিংকুকে নেয়া হবে। বাক্সে বাতাস চলাচলের জন্য কিছু ফুটো থাকবে। চিড়িয়াখানার পশুদের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেভাবে স্থানান্তর করা হয় ঠিক সেভাবে। বুদ্ধিটা রাদিয়ারও মনে ধরেছে।

ম্যানেজার সাহেবকে সব নির্দেশনা দিয়ে দিয়েছেন রহমত উল্লাহ। তা ছাড়া তিনি মোটামুটি চৌকস। চোখ কান খোলা তার। সমস্যা হলে সমাধান করে নিতে পারবেন। আর মোটেই দুই সপ্তাহের ট্রিপ। সমস্যা হওয়ার কথা না। কোনো সমস্যা হলে ফোন তো আছেই কথা বলে ঠিক করে নেয়া যাবে।
সব প্ল্যান মোতাবেক ঠিক হলো।

আন্তনগর ট্রেনে রবীন্দ্র সঙ্গীত বাজছে।
‘আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে
বসন্তের এই মাতাল সমীরণে। আজ..’
বিমল, ড্রাইভার হোসেন, আবুলের মাসহ ছয় জনের টিম আজ বিনোইল যাচ্ছে। বিনোইল রহমত উল্লাহর গ্রামের বাড়ি। রাজশাহী থেকে নীলফামারীর গ্রামের বাড়ি যাওয়া এবারই প্রথম নয়। রাদিয়া তিন চার বছর বয়সে একবার গেছে ওখানে। কিন্তু বুঝতে শেখার পর রাদিয়াকে নিয়ে যাচ্ছেন এবারই প্রথম। এ কারণে রহমত উল্লাহর খুশির মাত্রাটা বেড়ে গেছে। গানের কথাগুলো রাতের ট্রেনের ঝিকঝিক শব্দের সঙ্গে মিলে অমৃতের মতো লাগছিল রহমত উল্লাহর।

জীবনের এত সুখ, এত শান্তি কোথায় লুকিয়ে ছিল? সত্যিই জীবনটা উপভোগ করতে শিখতে হয়। নইলে জীবনের অবস্থান সম্পর্কে নিজের ভালো ধারণা হয় না। তার মনে হয় পৃথিবীময় সবার জন্যই শান্তির উপাদান বপন করা আছে। এমন কী অনেক ছোটো বিষয়েও অনেক বড় প্রশান্তি লুকায়িত থাকে। তাকে কেবল আবিষ্কার ও গ্রহণ করতে হয়, গ্রহণের মানসিকতা থাকতে হয়। চাইলেই যে কেউ এ সুযোগ গ্রহণ করতে পারে। তবে সকলেই তা পারে না। সকলেই তা গ্রহণ করে না। জীবনটাকে জটিলভাবে হিসেব করে। অনেক কিছুতে সম্পৃক্ত হতে চায়। যেচে যাতনা নেয়। সহ্য করতে পারে না। দুঃখ পায়। এটাও সবার জীবনেই সত্য। আসলে আমরা কোনো সুখেই বেশি দিন আবেশিত থাকতে চাই না। আমরা নদীর মতো গতি চাই। নতুন কিছু প্রবাহ চাই। কিছু প্রবাহ আমাদের অনুকূলে থাকে, কিছু থাকে না। সৃষ্টি হয় নতুন অধ্যায়, নতুন সুখ, নতুন দুঃখ।

রাতের ট্রেন। রাদিয়ার ইচ্ছেতেই তারা বার্থে সিট নেয়নি। এসি চেয়ারে সিট নিয়েছে। ট্রেনের শব্দ ও হৈ চৈ একসঙ্গে মিশে যেন ট্রেনের কামরায় পিকনিক মুড চলে এসেছে। রাদিয়া জানালা পাশে সিটে বসেছে।
ট্রেনে ভিড় বলতে কিছুই নেই। অধিকাংশ সিট ফাঁকা। কেউ কেউ আয়েশ করে ঘুমাচ্ছে। একটা ছয় সাত বছরের শিশু কম্পার্টমেন্টের এ মাথা থেকে ওমাথা দৌড়াচ্ছে। মাঝে মধ্যে চলন্ত গাড়ির সঙ্গে গতি সমন্বয় করতে পারছে না। পড়ে যাচ্ছে। আবার উঠে দৌড়াচ্ছে। এতে তার আনন্দের শেষ নেই। মাঝে মধ্যে আড়চোখে তাদের দেখছে। নিদ্রাভুক অপরাপর মানুষগুলোকে দেখছে। রাদিয়ার বাবার কাছে এসে এক সময় জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবে তোমরা?
রাদিয়া তাকে হাত ইশারা করে কাছে ডাকল। গালে টোকা দিয়ে বলল, কি নাম তোমার?
ছেলেটি গালে টোকা খেয়ে বিরক্ত হল। চোখেমুখে স্পষ্ট বিরক্তি ফুটে তুলে বলল, বলব না।
একটু পর ফিরে এসে ফের রাদিয়াকে প্রশ্ন করল, তুমি কোথায় যাচ্ছ?
বেড়াতে। তোমার সাথে আর কে আছে?
আব্বু আছে।
তোমারা কোথায় যাচ্ছ?
শিশুটি কিছু একটা বলল। কিন্তু ট্রেনের শব্দে রাদিয়া বুঝতে পারেনি। সে শিশুটির মুখের কাছে মাথা এগিয়ে নিয়ে পুনরায় জিজ্ঞাসা করল, কি বললে?
আজিজ রাদিয়ার প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করে, তোমরা কোথায় যাচ্ছ?
ডোমার যাচ্ছি। আম্মুর কাছে।
বাহ, সুন্দর তো। আম্মু ডোমার থাকে?
হ্যাঁ।
ছেলেটি আবার দৌড় দেয়।
কোথায় যেন ছাঁত করে উঠে রাদিয়ার। কথাটা নিজের সঙ্গে মেলায়। আয়নার প্রতিবিম্বের মতো নিজের সঙ্গে কথা বলতে থাকে রাদিয়া, সে আম্মুর কাছে যাচ্ছে। আমার তো মা নেই। তাহলে আমি কোথায় যাচ্ছি? বিনোইলে মার কবরের পাশে? কবরটি কেমন আমার ঠিক মতো মনে আসে না।
হাতে থাকা মোবাইলটা খোঁচাতে থাকে রাদিয়া। মায়ের ছবিটা বের করে মোবাইল থেকে। শান্তশিষ্ট পাতলা গড়নের ইন্দিরা গান্ধীর মতো দেখতে এটিই তার গর্ভধারিণী। তার মা! তার চার বছর বয়সে তাকে একা রেখে চলে গেছে না ফেরার দেশে। গভীর আবেগে চোখে জল আসে রাদিয়ার। সে ছবি থেকে চোখ ফেরাতে পারে না। রাদিয়া তার মায়ের ছবির সঙ্গে নিঃশব্দে গল্প করে, মা কেমন আছ তুমি? মা, তোমার আনন্দ হচ্ছে না আজ আমরা সবাই তোমাকে দেখতে বিনোইল যাচ্ছি। না না, তুমিও তো আজ আমাদের সঙ্গেই যাচ্ছ, তাই না মা ? এই যে আমরা একই ট্রেনের যাত্রী। এই যে তোমাকে দেখতে পাচ্ছি ষোলো বছর আগের ছবিতে। মা, তুমি কিন্তু আর বলতে পারবে না তোমার মেয়েটা কোথাও যেতে চায় না।
এই প্রথম মায়ের অভাব খুব স্পষ্ট অনুভব করল রাদিয়া। কী আজব এক জিনিস ‘মা’। রাদিয়ার চোখ ভিজে ওঠে। সে মোবাইল ফোন অফ করে ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে চোখ ফেলে। তার ভেজা চোখ যেন কেউ না দেখতে পায়।

বাইরে ভরপুর জোছনা। ট্রেনের জানালা দিয়ে যতদূর চোখ যায় কেবল জোছনার বিচালি। যেন থোকা থোকা শিউলি সাজিয়ে দিয়েছে রাতের প্রকৃতিকে।
রহমত উল্লাহ পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে রাদিয়াকে ভালো করে লক্ষ্য করছিলেন। তিনি রাদিয়ার মনোবেদনা আঁচ করতে পারেন। রহমত উল্লাহ জানেন রাদিয়ার মোবাইলে তার মায়ের কয়েকটা ছবি আছে। গুমোট ভাবটা কাটাতে তিনি আজিজকে উদ্দেশ্য করে বলেন, চা কফি কিছু খাবে না কি আজিজ? রাদিয়া তুই কিছু খাবি?
রহমত উল্লাহ কারও সম্মতির জন্য অপেক্ষা না করে বিমলকে ডাকেন। তাকে ক্যান্টিনে গিয়ে চা-কফির অর্ডার দিতে বলেন। যা পাওয়া যায়।
বিমল মাথা দুলিয়ে চলে যায়।

আজিজ রহমত উল্লাহকে উদ্দেশ্য করে বলে, আপনি এত রবীন্দ্রভক্ত মানুষ। এত জোছনা দেখেও আপনি চুপ করে আছেন দুলাভাই। আপনার তো কোনো প্রতিক্রিয়াই নেই। আমি কিন্তু খুব অবাক হচ্ছি।
রহমত উল্লাহ কথা বাড়ান না। ছোট করে বলেন, রবীন্দ্রনাথ তো আমাদের সাথেই আছে। গান শুনছ না?

রাদিয়ার দিকে তাকিয়ে রহমত উল্লাহর বুকেও কিছু একটা ব্যথা চিনচিন করে ওঠে। বাবারা কি কখনও পারে এককভাবে সন্তানের মা ও বাবা হতে?

ব্যাস। আর কিছু কানে ঢুকল না রাদিয়ার। ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। ঘুমে তার মাথাটাকে ভারি বোঝা মনে হচ্ছে। সে আর টানতে পারছে না। ট্রেনের একটানা ঘটাং ঘটাং শব্দ উপেক্ষা করে সিটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল রাদিয়া।

পরের দিন কাকডাকা ভোরে তারা ডোমার স্টেশনে পৌঁছাল। আনন্দের অশ্রু কোনোমতেই সংবরণ করতে পারলেন না রহমত উল্লাহ। তিনি স্টেশনের একটি চায়ের দোকানের পাশে দাঁড়ালেন। সবাইকে চা বিস্কুট নিতে বললেন। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তিনি ট্রেনটির দিকে তাকালেন। খুব আপন আপন লাগছে ওটাকে। একটা রাত ছিল এই ট্রেনটিই তাদের আশ্রয়স্থল।
লোকজন ট্রেনে উঠছে। সাত সকালেও স্টেশনে কত শোরগোল, কত কোলাহল! সব ট্রেনই কি যাত্রীদের এভাবে আপন করে নেয়, এক অজানা মমতায় বেঁধে ফেলে?
হুইসেল দিয়ে ট্রেন চলে যায়। খুব মন খারাপ হয় রহমত উল্লাহর।

উনিশে মে রবিবার বেলা এগারোটায় বিনোইলে অকস্মাৎ এক অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটে। রাজশাহী থেকে আগত রহমত উল্লাহর একমাত্র মেয়ে সান বাঁধানো পুকুরপারে পা পিছলে পড়ে যায়। পুকুরঘাটে শিমুল গাছের ছায়ার নিচে ইটে শ্যাওলা জমে পিচ্ছিল হয়েছিল। সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাদিয়া বড়শি দিয়ে মাছ ধরছিল। হঠাৎ অসাবধানতাবশত সে পা পিছলে পড়ে যায়। রাদিয়া মাথার পেছনে আঘাত পায়। একবার বমি করে জ্ঞান হারায়। সেই জ্ঞান আর ফেরে না। শহর থেকে অ্যাম্বুলেন্স আসে। তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। ইমারজেন্সির দায়িত্বপ্রাপ্ত ডাক্তার মেয়েটিকে পরীক্ষা করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।

এ দীর্ঘশ্বাস রহমত উল্লাহর বুকে এসে বাধে। তিনি সহ্য করতে পারেন না। ডুকরে কেঁদে উঠেন।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৭ ই নভেম্বর, ২০১৭ রাত ১:১৯

সচেতনহ্যাপী বলেছেন: এতদীর্ঘ গল্পটির শেষ অধ্যায়টুকু একটু যেন খাপছাড়া লাগলো।। গল্প লেই হয়তো।।

০৭ ই নভেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:২৯

বাগান বিলাস বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে এত দীর্ঘ গল্পটি পড়ে মন্তব্য করার জন্য। ছোটগল্পকে কোনো একজায়গায় থামতে হয় এবং তা দমের মধ্যে। শেষ অধ্যায়টির অবতারণা সে কারণে। অল্প কথায় পাঠককে ভাববার খোরাক করে দেবার চেষ্টা। কোনো পাঠক হয়তো ভাববেন- এভাবে শেষ না হলেও পারতো বা অন্যরকম হতে পারতো অথবা...

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.