নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি হয়তো মানুষ নই, মানুষগুলো অন্যরকম, হাঁটতে পারে, বসতে পারে, এ-ঘর থেকে ও-ঘরে যায়, মানুষগুলো অন্যরকম, সাপে কাটলে দৌড়ে পালায়। আমি হয়তো মানুষ নই, সারাটা দিন দাঁড়িয়ে থাকি, গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকি।

বাগান বিলাস

যাপিত জীবনকে নিয়ে ভাবনার অনেক উপাদান আছে। তবে সবকিছু ভাবতে পারি না। ভাবার সুযোগ পেয়েও অনেক অনুষঙ্গ নিজ প্রয়োজনে এড়িয়ে গেছি। অনেক বিষয়ে পরে ভাবা যাবে বলে ঐ পরিচ্ছেদে আর কখনও যাওয়াই হয়নি। তবে বারংবার আমি প্রকৃতির কাছে ফিরে গেছি। তার কাছে শিখতে চেয়েছি। প্রকৃতিও শেখালো ঢের। তবুও হয়তো আমার প্রত্যাশা ও শিখনফলে আছে হতাশা । ইচ্ছা ও প্রাপ্তির খতিয়ান খুব একাকী মিলিয়ে দেখি-কত কিছুইতো হলো না দেখা, হলো না কত শেখার শুরু । তবুও প্রাপ্তি কি একেবারেই কম? মোটেই না। পেয়েছিও ঢের। মনে তাই প্রশ্ন জাগে, যেদিন আমি আবার নিঃশ্বেস হয়ে যাব সেদিন কি প্রকৃতিও আমার মতো একা হয়ে যাবে? এর জবাবও প্রকৃতির বিবৃতিতেই পেয়েছি-না, ক্ষুদ্র জীবনের আঁচর প্রকৃতিতে বেশিক্ষণ মূর্ত থাকে না। অন্যকথায় প্রকৃতির মধ্যে বিষণ্নতা বেশি দিন ভর করে থাকে না। তাই সে সহজ, তাই সে সমাদৃত! আমার বিবেচনায় একারণে প্রকৃতি সকল জীব ও জড়ের কাছে সবচেয়ে বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

বাগান বিলাস › বিস্তারিত পোস্টঃ

হাতবদল

০৯ ই নভেম্বর, ২০১৭ রাত ১২:২০

রাত হয়েছে।
টুপটাপ বৃষ্টিও পড়ছে। আজ তুলনামূলক আগেই চেম্বার ফাঁকা হয়েছে অ্যাডভোকেট রশিদুল ইসলামের। বৃষ্টির কারণে মক্কেলরা তাড়াতাড়ি চলে গেছে। হঠাৎ টেবিলের উপর পুরাতন খাতার মতো একটা কিছু চোখে পড়ল তার। তিনি খাতাটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলেন।
একটা ডায়েরি। তিনি বিরক্ত হলেন। কার ডায়েরি এটা, আর তার টেবিলেই বা কেন?
মাহজাবিন পাশের ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছে। রশিদুল তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করবেন কি না ভাবলেন একবার। শেষে শোবার ঘরে গিয়ে মাহজাবিনকে ডেকে তুললেন। কৌতূহল থেকেই জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কী মাহজাবিন? আমার চেম্বারের টেবিলে কেন?
মাহজাবিন প্রথমে কিছু বুঝতে পারল না। দুহাতে চোখ ঘষে ঘুমের ঘোর কাটাবার চেষ্টা করল। তারপর ঘোর কেটে গেলে বলল, ও আচ্ছা। এটা ফার্নিচারের মিস্ত্রিরা দিয়ে গেছে। তোমার বইয়ের যে আলমারিগুলো রিপেয়ার করতে দিয়েছ-তার একটাতে নাকি পাওয়া গেছে।

রশিদুল কিছু পুরাতন ফার্নিচার মেরামত করতে দিয়েছে কাঠমিস্ত্রিদের। সেখানে ল চেম্বারের কিছু বইয়ের আলমারিও আছে। অনেকদিন রং-বার্ণিশ না করায় আলমারিগুলো শ্রী হারাতে বসেছে। কিছুটা ব্যবহার অনুপযুক্ত হতে চলেছিল।

রশিদুলরা তিন পুরুষ ধরে আইনজীবী। দাদা-বাবা-সে। মেরামত করতে দেওয়া বইয়ের আলমারিগুলো রশিদুলের পিতামহ বইসহ এক হিন্দু আইনজীবীর কাছে থেকে কিনেছিলেন। সেই ভদ্রলোক নাকি শহরের নামকরা আইনজীবী ছিলেন। এখনও তার নাম অনেক প্রবীণ আইনজীবীরা জানেন। সাতচল্লিশে দেশ ভাগের সময় তিনি তার সমুদয় বিষয়-আসায় বিক্রি করে দিয়ে ভারত চলে গেছেন।
রশিদুল চিন্তায় ছেদ ঘটিয়ে মাহজাবিনের উদ্দেশ্যে বললেন, তাই নাকি? ইন্টারেস্টিং তো। দাদা, বাবা এতদিন এ আলমারি ব্যবহার করলেন-এরপর আমি ব্যবহার করছি। আমাদের কারও চোখে পড়ল না? স্ট্রেন্জ।
মাহজাবিন বলল, আমি মিস্ত্রিদের কিছু জিজ্ঞেস করিনি। তারা বলল, কোথায় নাকি একটা গোপন ড্রয়ার ছিল। ফল্স ড্রয়ারটা রং করে কাঠের সাথে মিলে দেওয়া ছিল। সেজন্য হয়তো কারও চোখে পড়েনি। আর ওই পুরাতন আলমারিটা তো সবসময় বন্ধই থাকত দেখতাম। তুমি তো কোনোদিন বুঝি খুলেও দেখনি।
ফল্স ড্রয়ার?
রশিদুলের কৌতূহল কমল না।
তারা আমাকে তাই বলেছে। আর তুমিতো দেখি আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে তোমার ওকালতির জেরা শুরু করলে।
সরি, আসলে আমার খুব অবাক লাগছে।
তুমি কাল ওদের কাছে বিস্তারিত জেনে নিও প্লিজ।
মাহজাবিনের কণ্ঠে কিছুটা বিরক্তি।

রশিদুল চেম্বারে ফিরে ডায়েরিটা আবার নেড়েচেড়ে দেখলেন। আগামীকাল একটা গুরুত্বপূর্ণ মামলার যুক্তিতর্ক শুনানির জন্য আছে। মামলার ছায়ানথি পর্যালোচনা করে বাদী পক্ষের সাক্ষীদের জবানবন্দি ও জেরা ভালো করে স্টাডি করা দরকার। বাদির আর্জি ও সাক্ষিদের বক্তব্যের অসঙ্গতিগুলো পয়েন্ট আকারে নোট করা দরকার। এখন বারোটা বাজে। কিন্তু তিনি মামলার নথিতে মনোযোগ দিতে পারছেন না। ডায়েরিটা রশিদুলকে অন্যমনস্ক করে দিচ্ছে। তিনি অন্যমনস্কভাবেই ডায়েরির পাতা ওল্টাতে থাকলেন।

ডায়েরিটার প্রথম পাতায় রয়েছে একটা নাতিদীর্ঘ ভূমিকা-
দুঃখের উন্মুক্ত সাগর আমার বুকে। এ নামেই সবাই ডাকে আমাকে। সাগর। এখন আমার বয়স ছত্রিশ বছর চার মাস। থাকি কুষ্টিয়া। একটা ভাড়া বাসায়। কাজ করি গণপূর্ত অফিসে। আমার গ্রামের বাড়ি ভেড়ামারা। সেখানে দুই ভাই আছে। তারা তাদের মতো ব্যস্ত। মা-বাবা মারা গেছে। বোন ছিল একটা হারিয়ে গেছে বারো বছর বয়সে।
এ লেখাটা আমার ব্যক্তিগত জীবনচরিত। ঠিক দিনলিপি নয়। ফলে নির্দিষ্ট কোনো দিন-তারিখ উল্লেখ করিনি।
এরপর তিনি পরের প্যারায় শুরু করেছেন, যৌবনের শুরুতে কোহিনূর নামের একটি মেয়ের সাথে আমার খুব ভালো সম্পর্ক হয়। আরও স্পষ্ট করে বললে বলতে হয়, তাকে আমি খুব ভালোবাসতাম। কোহিনূর নিতান্ত সাধারণ একটি মেয়ের অন্তরালে অসাধারণ একজন মানুষ ছিল। উদারমনস্ক ও সংস্কৃতিমনা। সে কাজ করত ডাক বিভাগে। আমাদের সময়ে মেয়েরা সচরাচর অফিসে কাজ করত না। নারী চাকরিজীবীর কথা শুনলে অনেকে চমকে যেত। সে ছিল সেই সময়ের ব্যতিক্রম। কোহিনূর ছিল সাহসী আর প্রথাবিরোধী। তার সহজ সরল চেহারার আড়ালে তার কঠোর মনটাকে সে সহজেই লুকিয়ে রাখতে পারত।

অনেকদিন আগে গ্রামের বাড়িতে বড় ভাইয়ের কাছে পাঠানো একটা মানিঅর্ডার নিয়ে আমি বেশ ঝামেলায় পড়ি। কুষ্টিয়া থেকে একটা মানিঅর্ডার পাঠিয়েছিলাম তাকে। কিন্তু এক মাসেও তা পৌঁছেনি বলে টেলিগ্রাম পাই। আমি ডাক অফিসে পোস্টমাস্টারের সাথে কথা বলি। তিনিও আমার কথা শুনে বিচলিত হন। আমাকে চা খাইয়ে তিনি কোহিনূরকে ডেকে আমার বিষয়টার খোঁজ নিতে বললেন।
বিষয়টির সুরাহা পেতে আমাকে বেশ কয়েকবার ডাক অফিসে যেতে হয়। কোহিনূরের টেবিলে। তার সাথে আমার প্রথম পরিচয় সেখানেই।

আগেই বলেছি-কোহিনুর ছিল কুসংস্কারমুক্ত, সংস্কৃতিমনা এবং একইসঙ্গে উদার মানসিকতার একজন মানুষ। হয়তো কেউ সাতপাঁচ না ভেবে ঢালাওভাবে বলে ফেলবে সে নারীবাদী। কোহিনূর তার কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমার সামনে এমন সব কথা বলত যা সমকালীন সামাজিক প্রেক্ষাপটের সাথে বেমানান ছিল। সে আমাদের সমাজ ও নারীমুক্তি নিয়ে যেসব কথা বলত তা আপতদৃষ্টিতে সরল চরিত্রের হলেও আমার কাছে তা প্রতিবাদী মনে হতো। তবে তার এই একটু ভিন্নরকম চিন্তার অবস্থানটাকে আমি শ্রদ্ধা করতাম। তার কথার বিষয়বস্তু নিয়ে আমি ভাবতাম। তার চিন্তা-ভাবনার প্রকাশ দেখে আমার মনে হতো-হতে পারে শোষণ ও অমানবিক আচরণের মধ্য দিয়ে তার জীবনের একটা সময় অতিবাহিত হয়েছে।
কথায় কথায় জানতে পারি-কোহিনূর অবিবাহিত।

অবশেষে কোহিনূর আমার সমস্যাটার সমাধান করে দেয়। আমি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তাকে ধন্যবাদ দেই। সে বলে, মাঝে মাঝে আসবেন চা খাওয়া যাবে। অল্পবিস্তর আড্ডা দেওয়া যাবে।
কোহিনূর তার প্রত্যাশাকে আরও প্রলম্বিত করে বলেছিল, আপনি কতটা কৃতজ্ঞ তা বোঝা যাবে আপনি কবে আবার আমার চায়ের দাওয়াত রক্ষা করতে আসেন তা দেখে।
ভারি মিষ্টি মেয়ে কোহিনূর। অনেক কথা হড়বড় করে নির্দ্বিধায় বলে ফেলতে পারে। দেখতেও সুন্দর। প্রথম দর্শনেই যে কেউ মুগ্ধ হবে। এ ছাড়া তার কথাবার্তা বলার ঢঙ, সঙ্গ, স্পষ্টবাদিতা ইত্যাদি যেকোনো পুরুষকে টানবে।

তারপর কারণে-অকারণে প্রায়ই যেতাম সেখানে। গল্পগুজব করতাম কোহিনূরের সঙ্গে। পোস্টমাস্টারের সাথেও একটা সখ্যতা গড়ে ওঠে আমার।

আগুন আর মোম পাশাপাশি থাকলে যা হয়। আমারাও বুঝতে পারছিলাম ক্রমশ এক অনিবার্য মধুর পরিণতির দিকেই আমরা যাচ্ছিলাম। উভয়ের আগ্রহেই আমরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে আমাদের পারস্পরিক বোঝাপড়াটা সহজ করে তুলছিলাম। সকালের সূর্যের মতো এক অনিবার্য উদয়ই আমাদের কাছে কাঙ্খিত ছিল। সেখান থেকে পিছু ফেরার গরজ আমাদের কারও ছিল না। এরই অনুবৃত্তিক্রমে আমি কোহিনূরের বাসায় যাওয়ার অনুমতি পাই।
সেখানে দিনের পর দিন আমাদের জমিয়ে আড্ডা-গল্প-গান চলত।

এর পরের ঘটনা আমি বিচ্ছিন্নভাবে উল্লেখ করছি।
একদিন ঈদের আগে, অফিস তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেল আমার। হাতে কাজ নেই। বাসায় ফেরার তাগিদও নেই। আমি একটা রিকশায় চেপে বললাম, জেলখানা রোড। সেই রোডেই কোহিনূরের বাসা। তার সাথে তার মা ও এক ভাই থাকে। ভাই ছোট। জিলা স্কুলে পড়ে। নক করতেই দরজা খুলে গেল।
কোহিনূর সুন্দর আসমানী রঙের একটি শাড়ি পড়েছে। আমি মুগ্ধতা না লুকিয়ে প্রকাশ্যেই বলে ফেললাম, কোহিনূর কখনও কখনও প্রজাপতিও হয় দেখছি!
সে আমার কথায় কিছুটা হকচকিয়ে গেল। সামলে নিয়ে বলল, আপনি এসেছেন আমি খুব খুশি হয়েছি। আজ আমার বাইশতম জন্মদিন। আপনার অফিসে খোঁজ নিয়ে আপনাকে পাইনি। নেহায়েত আপনার ঠিকানায় গিয়ে নিমন্ত্রণ জানাতে হবে বলে আমি পারিনি। একটা মেয়ে একটা ব্যাচেলর মানুষের বাসায় যাবে এটা কে মানবে? আর কে জানতো গুণে গুণে আমার জন্মদিনের আগেই পক্ষকাল আপনি লাপাত্তা হয়ে যাবেন।
মনেমনে আমি ভীষণ লজ্জিত হই। কহিনূরের জন্মদিনে খালি হাতে চলে এসেছি। এরপর বাইশে এপ্রিল প্রতিবছর আমি কহিনূরের জন্য ওর পছন্দের একগুচ্ছ ফুল আনতাম। শুভ্র বেলি।

তবে তার অফিসে ঘন ঘন যেতে আমার অস্বস্তি লাগত। মনে কিছুটা দ্বিধা কাজ করত। সবসময় ভাবতাম, কেউ আমাদের সম্পর্কের কথা জেনে ফেলেনি তো?

প্রায় দুই মাস পরের কথা। আমি কোহিনূরকে একটা চিঠি লিখলাম।
চিঠি দিয়ে উত্তরের প্রতীক্ষায় থাকলাম। না, কোনো উত্তর পেলাম না।
পারিপার্শ্বিক পরিমণ্ডল একটা ন্যায়সঙ্গত প্রেমকে মেনে নেবে বা প্রমের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেবে এমন সামাজিক পরিবেশ তখনও গড়ে ওঠেনি।
দীর্ঘদিন অপেক্ষা করে সব জল্পনার অবসান ঘটাতে সাহস করে একদিন আবার ওর অফিসে গেলাম। কোহিনূর কাজে মাথা গোঁজে আছে টেবিলে। আমি সরাসরি তার টেবিলের সামনে গিয়েই বললাম, কেমন আছ তুমি।
এই প্রথম তাকে ‘তুমি’ সম্বোধন করলাম। আমারও কিছুটা অস্বস্তি ছিল। কিন্ত গলায় তা প্রকাশ পেল না।
কোহিনূরের ফর্সা মুখটা লাল হয়ে ওঠল। তবে আমার সম্বোধন শুনে সে চমকে উঠল না বা প্রতিবাদ করল না।
বিচলিত ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, বসুন।
হাতে খুব কাজ?
আছে।
ছোট করে জবাব দেয় কোহিনূর।
আমার চিঠিটা পেয়েছ?
কোহিনূর মুচকি হাসে।
কোন চিঠির কথা বলছেন? এখানে প্রতিদিন তো কত চিঠি পাই।
তার কণ্ঠে কিছুটা হেঁয়ালি। হয়তো আরও বাজাতে চাইছে আমাকে।
তোমাকে লেখা আমার চিঠি।
আমি সরাসরি জবাব দিলাম।
একই শহরে থেকেও চিঠি চালাচালি করতে হয়? আপনাকে বলেছিলাম না, সময় পেলে চলে আসবেন। কাজের ফাঁকে কথা বলা যাবে। আপনার কাজ শেষ তো আর এদিকে আসেন না তেমন। আসলে এমনই হয়।
আগে তো আসতাম। এখন...
এখন কী হলো?
অস্বস্তি লাগে।
এত অল্পতেই? ভাগ্যিস বিস্বাদ লাগে না।
না না, আমার খারাপ লাগে না। তোমার সঙ্গ আমি খুব উপভোগ করি। কিন্তু তুমি অবিবাহিত একজন মেয়ে। আমি ঘন ঘন তোমার অফিসে এলে...কথায় আছে না-পাছে লোকে কিছু বলে।
আপনিও সে দলের? আর আমাকে কী সেরকম গড়পড়তা কিছু মনে হয়? ভেবেছেন আমি এত কিছু মেনে চলি? তাহলে তো আপনাকে বাসায় আসতে কোনোদিনও বলতাম না।
হুম। আপনার সাহসিকতাকে শ্রদ্ধা করি।
আর?
আর বাকি কথা চিঠিতে বলেছি।
কোহিনূর কোনো জবাব দেয় না। তবে তার মুখমণ্ডলে যে অভিব্যক্তির উদয় হয় তাতে স্পষ্ট হয় যে সেই চিঠি পাওয়া এবং আমার প্রেম নিবেদনের বিষয়টাকে সে প্রত্যাখ্যান করছে না।
আজ আমি অনেকদিন পর তার অফিসে। মুখোমুখি।
চা খান। তার মুখের হাসি আরও বিস্তৃত করে বলে, সাগর আপনি খুব কি ভীতু? কেন বলতো?
আপনি একটা মেয়েকে ভালোবাসেন তা মুখে বলতে পারেন না?
আমি ছোট করে বলি, ঘটা করে বলার প্রয়োজন কী? অনেক কিছুতো আপনা আপনি প্রকাশিত হয়। তথাপি আমি গোপন রাখিনি। বলেছি।
হুম। চোরের মতো। চুপিচুপি। চিঠিতে।
সামনাসামনি বলা আর চিঠিতে বলার মধ্যে পার্থক্য কী? চিঠিতে বলায় বরং তুমি ভাববার ও সিদ্ধান্ত নেওয়ায় সময় পেয়েছ?
কোহিনূর মাথা নাড়ে।
তবে আমি ধন্যবাদ দেই। আপনি অন্তত বলার ক্ষমতা রাখেন।

আমাদের সম্পর্কটার ডালপালা গজিয়ে প্রতিবেশীর খাওয়ার টেবিলে গবেষণার সূচিভূক্ত হওয়ার আগেই আমি কোহিনূরকে বিয়ে করে ফেলি। বিয়ের পর সে সারাক্ষণ আমাকে সুখানুভূতিতে আবেশিত করে রাখত।
কোহিনূরের আগেই অফিস ছুটি হতো। সে আগে বাড়ি ফিরত। আমার সব সময়ই একটু দেরি হতো। এই সময়টা সে রান্না করে, বই পড়ে, অথবা কোনোদিন আমার বন্ধু নিয়াজের সাথে আলাপ-আড্ডা দিয়ে কাটাত।
বিয়ের পরপরই আমরা আলাদা একটা বাসা নেই। সেটা কোহিনূরের ইচ্ছাতেই। তার মা ও ভাইয়ের বাসার পাশেই।

নিয়াজ আনছারি ছিল আমার স্কুল-কলেজের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বন্ধুমহলে সে বিজ্ঞজন বলেই বিবেচিত। অনেক বই পড়ত। শহরের সংস্কৃতিমনা লোকদের সাথে তার উঠবস ছিল। আমি বই-টই ততটা পছন্দ করতাম না। সন্ধ্যের পর আমি বরং কালেক্টরেটের অফিসারদের সাথে ব্যাডমিন্টন খেলে, একটু-আধটু তাস-টেনিস খেলে সময় পার করতাম।
সন্ধ্যায় কোহিনূরকে বেশি সময় দিতে পারতাম না বলে ছুটির দিনগুলোতে আমরা বাইরে বের হতাম। হঠাৎ পড়ন্ত বিকেলে নৌকায় চেপে বসতাম। নদীর জলে সূর্যাস্ত দেখতাম। ইচ্ছে হলে অনেক রাত অবধি নদীর ধারে বসে জোছনা দেখতাম। খুব উপভোগ্য ছিল সময়টা।
দেখতে দেখতে তিন বছর কেটে গেল। আমাদের কোনো সন্তান আসছিল না। আমার ও কোহিনূরের অনেক চিকিৎসা করালাম। অনেক কবিরাজ-হেকিম দেখালাম। কাজ হলো না। শেষে ঢাকা গেলাম। সেখানকার ডাক্তার আমাদের দুজনকেই পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানালেন, মেল ইনফার্টিলিটি প্রবলেম। অর্থাৎ সমস্যা আমার।
সন্তান নিয়ে আমরা দুজনেই খুব হতাশা ও বিষণ্নতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলাম। সমস্যা সনাক্ত হওয়ার পর আমাদের দৃশ্যমান বিষণ্নতা কোথায় যেন হঠাৎ উধাও হয়ে গেল। আমরা দুজনেই নিজ নিজ সক্ষমতায় এ বিষণ্নতা লুকিয়ে রাখতে চাইতাম। আর দুজনেই প্রাণপন চেষ্টা করতাম বিষয়টা মেনে নিতে। কিন্ত আমারা ক্রমেই বুঝতে পারলাম আমাদের জীবন থেকে এ হতাশা ঝেরে ফেলার অভিনয় করছি মাত্র। কাঁচা অভিনেতার মতো আমরা বারবার পরস্পরের কাছে ধরাও খেতাম। ধরা পরার পর প্রতিবারই চেষ্টা করতাম আরও নিখুঁত আরও পটু অভিনেতা হতে। কিন্তু তা সম্ভব হতো না। আমাদের এ হতাশা উভয়ের জীবনে কষ্টের বিষবৃক্ষ হয়ে স্থায়ী রূপ নিল।

এক বাইশে এপ্রিল, কোহিনূরের তেইশতম জন্মদিন। আমরা বাসায় আমাদের চেনাজানাদের আমন্ত্রণ জানালাম। আমি সব সময় চেষ্টা করতাম কোহিনূর যেন বিষণ্ন বোধ না করে। সবসময় ওর মন প্রফুল্ল থাকে। এ জন্য আমি সন্ধ্যার পর খেলার মাঠ ছেড়ে দিয়ে কোহিনূরকে সময় দেওয়া শুরু করলাম। কোহিনূর অবশ্য খুব পরিপক্ব ও সংযত আচরণ করতে চেষ্টা করত। সে আমাকে পারতপক্ষে তার হতাশা বুঝতে দিত না। সেও আমাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করত।
কোহিনূরের জন্মদিনটা ভালোয় উদ্যাপিত হলো।
পরদিন কোহিনূর অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল। আমি দাড়ি কাটছিলাম।
কোহিনূর বলল, একটা বিষয় লক্ষ্য করেছ সাগর?
কী?
কাল কিন্তু নিয়াজ ভাই আসেননি।
হুম তাইতো। কেনো, তুমি ওকে বলনি?
আমি তো বলেছিলাম। তুমি কিছু বলনি তো?
কোহিনূর পাল্টা প্রশ্ন করল।
আমি আবার কী বলব? আমিতো ওকে সাথে নিয়ে তোমার জন্য শাড়ি কিনলাম। ও আসতে পারবে না তাতো আমাকে বলতে পারত।
আমার সত্যিই মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমার এতদিনের বন্ধু নিয়াজ সে আমাদের একটা পারিবারিক অনুষ্ঠানে এল না?
আমি অফিসে যাওয়ার পথে নিয়াজের বাসা হয়ে গেলাম। বাসায় তার ভাই জানালো নিয়াজ অসুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।
কোহিনূরকেও অফিস থেকে ফেরার পর নিয়াজের অসুস্থতার কথা জানালাম। সে কিছুটা বিমর্ষ হলো। বলল, চল তাকে একবার দেখে আসি। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, এত তাড়া কিসের? যাওয়া যাবে। সকালেই তো একবার দেখে এসেছি। আর এত সিরিয়াস কিছু নয়। সমান্য জ্বর, সেরে যাবে।
কোহিনূর রেগে গেল। তার কণ্ঠে উদ্বিগ্নতা। আমাকে খোঁটা দিয়ে বলল, একবার ভাবতো যদি তুমি অসুস্থ হতে আর নিয়াজ ভাই জানতেন তাহলে তিনি কী চুপ করে থাকতেন? মানুষে মানুষে এত পার্থক্য হয়?
নিয়াজের সাথে আমার তুলনাটা আমার ভালো লাগল না। আমি গোঁ ধরলাম। আমি তাকে বললাম, আমি তার বাসা ও হাসপাতালে আজই গেছি কোহিনূর। প্রয়োজন হলে আবার যাব। এত চাপাচাপি কেন? প্রয়োজন বোধ করলে তুমি যাও। আমি তো তোমাকে বাধা দিচ্ছি না।
কোহিনূর নিয়াজকে দেখতে একা যেতে রাজি হল। মুখ শক্ত করে বলল, ঠিক আছে, তোমাকে যেতে হবে না। আমি একাই যাব।

নিয়াজ কোহিনূরকে জন্মদিন উপলক্ষে ফুল ও একটা বই উপহার দিয়েছে। অফিস থেকে ফিরে কোহিনূর আমাকে বইটা দেখাল। প্যারিচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’। বইটার ভেতরে একজায়গায় নিয়াজের লেখা-প্রিয়দর্শিনী কোহিনূরকে।
লেখাটার উপর আমার চোখ আটকে গেল। বন্ধুপত্নীকে এভাবে সম্বোধন করে লেখা যায়? আমি একেবারে চমকে উঠি। তবে আমি এই প্রশ্নটা নিজের ভেতর লুকিয়ে রেখেই নীরবে কোহিনূরের মধ্যে এর উত্তর খুঁজতে থাকি।

আমার উত্তর পেতে খুব দেরি করতে হয়নি। আমার শঙ্কাই সত্যে পরিণত হয়েছিল। বদলে গিয়েছিল কোহিনূর। নিয়াজও আমার বিশ্বাস ভেঙেছিল। তারা একটা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল। আমি প্রথমে তা সহ্য করতে পারতাম না। খুব কষ্ট হতো। এতে আমার কষ্ট হলেও দাঁতে দাঁত চেপে থাকতাম। কোহিনূরকে আমার এ কষ্ট বুঝতে দিতে চাইতাম না। আমার দুর্বলতা ও কষ্টকে শামুকের মতো সবসময় খোলসে লুকিয়ে রাখতে চাইতাম। চোখের সামনে ওদের সব আচরণ দেখেশুনেও আমি নির্বোধের ভান করতাম। আমার নীরবতাকে তারা সুযোগ ভেবে তাদের সামর্থ্যের শেষ দিয়ে খেলছিল।
আমি ইচ্ছে করলেই কোহিনূরকে হয়তো এ পথ থেকে ফেরাতে পারতাম। ফেরাতে পারতাম কি না সেটা বলা মুশকিল। তবে তাকে কিছুটা হলেও বাধ্যবাধকতার অর্গলে বাঁধতে পারতাম। নিয়োজকে সরাসরি বলতে পারতাম-এটা তোর ঠিক হচ্ছে না।

আমার প্রতি একটা চরম অন্যায় হচ্ছে দেখেও আমি মুখ খুলতে পারিনি। আমার দুর্বলতা আমাকে মুখ খুলতে দেয়নি। আমি ভেবেছিলাম কোহিনূর স্বচ্ছ বুদ্ধির মানুষ। ওর প্রতি আমার অগাধ বিশ্বাস ছিল। আমি আশাবাদী ছিলাম, সে একসময় তার ভুল বুঝতে পারবে। নিজেকে সামলে নেবে। আমি দিনের পর দিন নিজেকে মানসিক কষ্টে সঁপে দিয়ে কোহিনূরের সুবুদ্ধি উদয়ের অপেক্ষায় থেকেছি। আমি সংযত থেকে কোহিনূরকে একই সঙ্গে সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিলাম-আমার কাছে ফিরে আসার অথবা আমার কাছ থেকে সরে যাওয়ার। আমি জানতাম, কারও কাছে কিছু আদায় করতে হলে চাপ দিয়ে নয় বরং স্বাধীনতা দিয়ে আদায় করাটা অনেক সহজ। আমি তাই নমনীয়তা আর বিবেকের তাড়না দিয়ে তাকে ফেরাতে চেয়েছিলাম। আর এটা করেছিলাম আমাদের সামাজিকতার দায়ে এবং সংসার নামক কঙ্কালটাকে দাঁড় করে রাখতে। তারচেয়েও বড় কথা আমি কোহিনূরকে খুব ভালোবাসতাম। ওকে আমি হারাতে চাইনি। এ ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না।
আমার কোনো দাওয়াই কাজ করছিল না। বুঝতে পারছিলাম দিনদিন কোহিনূর নিয়াজের প্রতি আরও বেশি আসক্ত হয়ে উঠছিল। কোহিনূরের হাবভাবে তা অসংযতভাবে প্রকাশিত হতে থাকল।

এক ছুটির সন্ধ্যায় আমাদের দুজনের এক সাথে থিয়েটার হলে নাটক দেখতে যাওয়ার কথা। বাসায় সামান্য কিছু কাঁচাবাজার দরকার ছিল। আমি কোহিনূরকে তৈরি হতে বলে ঝটপট কাঁচা বাজারে যাই। বাজার থেকে ফিরতে আমার কিছুটা দেরি হয়।
বাসায় ফিরে দেখি নিয়াজ আমার ড্রয়িংরুমে বসে আছে। কোহিনূরের চোখে পানি। আমাকে দেখে সে ত্বরিত মুছতে চেয়েও সবটুকু মুছতে পারেনি। অন্তত চারপাশের আবহ ও তাৎক্ষণিক পরিবেশ তার অনুকূলে যায়নি। বৃষ্টির দিনে এক পশলা বৃষ্টি হওয়ার পর রোদ উঠলে যেমন গাছের পাতায়, মাটিতে বৃষ্টির ইশারা লেগে থাকে, ঠিক তেমনি সেদিন ঘরের আবহাওয়া বলে দিচ্ছিল অনেক কিছু। আমি তাৎক্ষণিক আর এ দৃশ্য সহ্য করতে পারি না। কোহিনূকে কিছুটা ক্ষোভ নিয়ে জিজ্ঞাসা করি, কি হয়েছে কোহিনূর?
সে কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতো বলল, কই? কোথায় কী হয়েছে? চিংড়ি পেয়েছ? অনেক দিন তোমাকে নারকেলের দুধ দিয়ে চিংড়ির দোপেঁয়াজা খাওয়াইনি। আজ খাওয়াব।
আমি আর ঘাটাইনি কোহিনূরকে। আমি মনেমনে কোহিনূরকে তবুও ধন্যবাদ দেই। সে আমার কাছে তখনও তাদের সম্পর্কটা লুকাতে চাচ্ছে। যদি সে এটা আমার সামনে প্রকাশই করে দিত তাহলেই বা কী হতো?

এরপর নিয়াজকে আমার ক্রমশ অসহ্য ঠেকতে শুরু করল। ওর প্রতি ঘৃণায় আমার মুখ তিতা হয়ে থাকত। আমার কেবলই মনে হত নিয়াজই আমার সংসারে আগুন ধরাল। তারপর থেকে ওকে দেখলে আমার রক্ত হিম হয়ে আসত। কিন্তু মুখে আমি তাকে কিছুই বলতাম না। কোহিনূরের কথা ভেবে, আমাদের হতাশার কথা ভেবে আমার নিজেকে খুব ছোট লাগত।

পিছু ধাওয়া করা নিয়াজ মোর্শেদ নামক বিষধর সাপটির হাত থেকে রেহাই পেতে কাউকে কিছু না বলে বাসা বদল করলাম। তাতেও কোনো লাভ হলো না। কোহিনূরই ওকে আবার ডেকে আনল। এরপর আমি একাধিকবার আত্মহত্যা করার কথা চিন্তা করি। কোহিনূরকে খুন করার চিন্তা করি। নিয়াজকে খুন করার চিন্তা করি।

প্রচ- মানসিক আঘাতে আমি শারিরীকভাবে দুর্বল হয়ে পড়লাম। অফিস থেকে ছুটি নিলাম। সারাদিন বাড়িতে পড়ে থাকতাম কাঠের গুড়ির মতো। নিয়াজ হয়তো আমার মনের দিকটা বুঝতে পেরেছিল। সেই ঘটনার পর সে আমার বাসায় আর আসত না। কিন্তু কোহিনূর ছটফট করত। তার মন মেজাজ চরমে থাকত সবসময়।
ভালোবাসার পাখিরা একটা নীড় চায়। এটা পাখির দোষ নয়। আমি জানতাম এটা ভালোবাসার ন্যূনতম চাহিদা। এ চাহিদা পূরণে সবাই উদ্গ্রীব থাকে। হয়তো এ কারণেই কোহিনূর অসুস্থ স্বামীকে ফেলে রেখে নতুন ফন্দি আঁটল। সে বদলি নিলো পাশের জেলা-বগুড়ায়।
কোহিনূরকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলাম। অনুরোধ করলাম-তদবির করে আদেশটি বাতিল করাতে। যুক্তি দেখালাম-তুমি মেয়েমানুষ। একটা সম্পূর্ণ নতুন জায়গায় তোমার একা একা থাকতে সমস্যা হবে। আমরা দুজন দুদিকে হয়ে যাব। আমি তাকে আরও বুঝালাম-তা ছাড়া তোমার মা-ভাইও থাকে এখানে। তুমি আলাদা থাকবে কী করে? কিন্তু আমার যুক্তি, আমার আহূতি সবই ছিল অরণ্যে রোদন।
শেষে কোহিনূরকে বললাম-চাকরি ছেড়ে দাও। আমি যা পাই তা দিয়ে আমাদের চলে যাবে। তার মা, তার ভাই আলাদা করে তাকে বুঝাল। কিন্ত কোনো কথা শুনতে সে রাজি নয়। সে উল্টো আমাদের বুঝাতে চায়-সে ঊর্ধ্বতন মহলে চেষ্টা করেও নাকি তার বদলির আদেশ পরিবর্তন করতে পারেনি। অবশেষে আমি শেষ চেষ্টা করতে চাইলাম। তাতেও সে রাজি হলো না। তার বক্তব্য হলো, আমার বসদের আমিই বুঝাতে পারিনি। আর তোমার কথা শুনবে?

আমি অসুস্থ ও শারীরিকভাবে খুবই দুর্বল। তাই বগুড়া যেতে পারছি না। কোহিনূরের ছোট ভাই কোহিনূরের সাথে বগুড়া যাচ্ছে। তাকে ভাড়া বাসায় তুলে দিয়ে বাসা গোছগাছ করে দিয়ে আসবে।
ভেবেছিলাম কোহিনূর বোধহয় আমাকে একেবারে ছেড়ে মুক্ত মানুষ হয়ে নতুন কর্মস্থলে যাবে। কিন্তু সে তা করেনি। সুটকেস, বাক্স প্যাটরা ট্রেনে তোলা হলে কোহিনূর ট্রেনের জানালা দিয়ে আমার হাত ধরে বলে, ভয় পেও না সাগর। আমি তোমার এ হাত ছেড়ে যাব না।
আমি প্লাটফরমে ট্রেনের জানালায় কোহিনূরের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। শরীর ভালো না থাকায় আমার দাঁড়িয়ে থাকতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল।
তাহলে চলে যাচ্ছ কেন? খুব কী দরকার ছিল?
কোহিনূর আমার হাত ছেড়ে দিয়ে কিছুটা উষ্মা প্রকাশ করে বলে, সাগর, প্রথম থেকেই আমি লক্ষ্য করছি-তোমাদের সকলের মধ্যে একটা ভুল অনুমান কাজ করছে। তাহলো আমি ইচ্ছাকৃতভাবে তোমাদের ফেলে বগুড়া চলে যাচ্ছি। তোমরা কিন্তু কেউ আমার চাকরির বিষয়টাকে গুরুত্ব দিচ্ছ না।
আমি কোহিনূরের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি। তার চোখের গভীরে অন্য কথা ভাসছে।
তোমার মনে অন্যকিছু নেই তো?
কোহিনূর নিজেকে সামলে নিয়ে ঈষৎ হেসে বলে, আমরা সকলেই জীবনটাকে স্বার্থক করতে চাই সাগর। আমি চাকরি করি। তুমি তো আমাকে চেনোই। আত্ননির্ভরতাই আমার কাছে বড় স্বার্থকতা। মনে অন্যকিছু থাকবে কেন?
জীবনে জীবনে প্রভেদ রেখা টেনে অর্জিত এ স্বার্থকতার গুরুত্ব কতটুকু কোহিনূর?
এভাবে ভাবছ কেন? আমি তো বলেছি তোমাকে ছেড়ে যাব না।
এটা কি ছেড়ে যাওয়া নয়?
আমার জন্য সাময়িক এ অসুবিধা তুমি মেনে নিতে পারবে না?
আমি কোনো জবাব দেই না।
অনেকদিন কোহিনূরের সাথে এমন খোলামেলা আলাপ হয়নি। শেষ মুহূর্তে হলেও আজ কথাগুলো বলতে পেরে আমার ভালো লাগছে। ভেতরটা হাল্কা বোধ হচ্ছে। কোহিনূর আবার বলতে থাকে, আমি আবার চেষ্টা করব কুষ্টিয়ায় ফিরে আসতে।
আমি পরিষ্কার দেখতে পাই কোহিনূরের কথায় কোনো প্রাণ নেই।
কোহিনূর তার চলমান কথা শেষ করতে চায়-তা ছাড়া মানুষের জীবন সারাক্ষণ একভাবে সঞ্চালিত হয় না। মিলন ও বিরহ এ মিলেই জীবন। এ দুয়ের মধ্যেই জীবনের স্বার্থকতা লুকিয়ে আছে সাগর। আমরা একে যে যেভাবে নেই।
আমি কুণ্ঠিত হয়ে বলি, তাহলে তুমি জীবনকে স্বার্থক করতেই বদলি নিয়েছ? আমাদের এ বিরহ আরোপিত?
আর কথা আর বাড়ে না। বাঁশি বেজে উঠে, ট্রেনের চাকা সচল হয়।

মাস চারেক অসুখে ভুগে সেরে উঠলাম। এর মধ্যে একদিন কোহিনূরের চিঠি পেলাম। সে ভালো আছে। চিঠিটা নিতান্ত প্রাণহীন। খুব সাদামাটা গোছের কথা লেখা। সেই সময়ে আমি কোহিনূরের কাছে এর চেয়ে বেশি কিছু চাইতাম না। প্রত্যাশাও করতাম না। আমার সেই মুখ ছিল না।

নিয়াজের সাথে আমার আর যোগাযোগ নেই। সে আমার বাসায় আর আসে না। আমরও আর তার বাসায় যাওয়া হয় না।

সুস্থ হয়ে দেরি করলাম না। বগুড়া গেলাম কোহিনূরকে দেখতে। তার দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী তাকে বাসায় পেলাম না। বাসাওয়ালার কাছে জানলাম, সে ও তার স্বামী নিয়াজ গতমাসে বাসা ছেড়ে চলে গেছে। কোথায় গেছে তা বলে যায়নি।
আমার মাথা ঘুরতে থাকে। শেষে তার অফিস খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম কোহিনূর মাসখানেক হলো চাকরি ছেড়ে দিয়েছে।
হতাশা-যন্ত্রণা-অপমান ও বঞ্চনার সাতকাহন ফিরিস্তি নিয়ে আমি পুনরায় কুষ্টিয়া ফিরে এলাম। মনে মনে কোহিনূরকে শুভকামনা জানালাম।

মাস তিনেক পর সংবাদপত্র মারফত জানতে পারলাম দুজন অজ্ঞাতনামা নারী ও পুরুষের লাশ পাওয়া গেছে করোতোয়া নদীতে। এ নিয়ে স্থানীয় থানায় একটা অপমৃত্যুর মামলা দায়ের হয়েছে।
একদিন বগুড়া কোতোয়ালি থানার তদন্ত কর্মকর্তা আমার অফিসে এলেন। তিনি কোনো ভূমিকা না টেনে আমাকে দুটা ছবি দেখিয়ে বলেন, এদের আপনি চেনেন?
আমি কোনো জবাব দেই না। আমার চোখে ভেঙে আসে সমুদ্র। আমি তলিয়ে যাই আমার সমুদ্র ঢেউয়ে।

দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন রশিদুল ইসলাম। ডায়েরিটায় আর কিছু লেখা নেই। বিশেষ আগ্রহ নিয়ে তিনি ডায়েরির বাকি সাদা পাতাগুলো উল্টেপাল্টে দেখলেন। পাতাগুলো ঈষৎ বাদামি বর্ণ ধারণ করেছে। প্রতিটি খালি পাতায় যেন লেপ্টে অমানিশা, বেদনার হাহাকার।
অ্যাডভোকেট ডায়েরিটা বন্ধ করলেন। তিনি চোখ বন্ধ করে ভাবলেন, মামলার রাষ্ট্রপক্ষ কোহিনূরের খুনিকে সনাক্ত করতে পেরেছিল কি না জানি না। তবে এই ডায়েরিটা সেই অপমৃত্যু মামলার সাথে কোনো না কোনোভাবে সম্পর্কিত হতে পারে। আর এখন এর সাক্ষ্যমূল্য যাই হোক না কেন, জীবনীমূল্য অনেক বেশি।
তিনি ঠিক করেন ডায়েরিটা পুনরায় যথাস্থানে রেখে পূর্বের মতো রং-বার্ণিশ করে দিতে বলবেন ফার্নিচারের মিস্ত্রিদের। তার দাদার কেনা আলমারি হয়তো আবার হাতবদল হয়ে পরবর্তী প্রজন্মের কোনো ব্যক্তির হাতে পড়বে। তিনিও রশিদুল ইসলামের মতো ডায়েরিটা পড়ে একান্তে দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন।

রাত পৌনে দুটা বাজে। এক্ষুণি তাকে আজকের মামলার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। তিনি মামলার ফাইলটায় চোখ বুলিয়ে স্টেট ভার্সেস নজরুল ইসলাম ৫৬ ডিএলআর (১৯৯৩) খুললেন।
রশিদুলের স্ত্রী ধীর পায়ে উঠে এসে তার কাঁধে হাত রাখল। তিনি নম্র দৃষ্টিতে মাহজাবিনের দিকে তাকালেন। মাহজাবিন বলল, এত রাত অবধি কী পড়ছ, ঘুমাবে চল।

বাইরে এখনও বৃষ্টি পড়ছে। টুপটাপ শব্দ তার কানে আসছে। এই বৃষ্টির ফোঁটাগুলোও কি সাগরের ডায়েরিটা পড়ে ফেলেছে? রশিদুল ইসলাম এ প্রশ্নের কোনো কূলকিনারা করতে পারলেন না। বৃষ্টির শব্দ বাড়ছে।

রশিদুল মাহজাবিনকে অনুসরণ করে ঘরের লাইট বন্ধ করে নিঃশব্দে ঘুমাতে গেলেন। মাহজাবিন বলল, কালকের মামলার জন্য তোমার খুব টেনশন হচ্ছে তাই না? ঘুমাও। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।
রশিদুল মাহজাবিনের কথার প্রতিউত্তর করলেন না। তিনি দীর্ঘশ্বাস গোপন করে মনে মনে বললেন, সাগর বিশ্বাস করুন আপনার জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।
মাহজাবিন শুয়ে তার স্বামীর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, ডায়েরিটায় কী লেখা আছে?
রশিদুল চটপট করে বললেন, নাহ্। কিছু না। তেমন কিছু লেখা নেই ওতে।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০১ লা ডিসেম্বর, ২০১৭ দুপুর ২:০৯

কঙ্কাবতী রাজকন্যা বলেছেন: কি দারুন একটি গল্প। জীবনের বাঁকগুলি বড় অদ্ভুত।

০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১:৪৮

বাগান বিলাস বলেছেন: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ জানাই গল্পটি পড়ে মন্তব্য করার জন্য। আপনার মন্তব্য আমাকে প্রাণিত করবে। ভালো থাকুন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.