নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি হয়তো মানুষ নই, মানুষগুলো অন্যরকম, হাঁটতে পারে, বসতে পারে, এ-ঘর থেকে ও-ঘরে যায়, মানুষগুলো অন্যরকম, সাপে কাটলে দৌড়ে পালায়। আমি হয়তো মানুষ নই, সারাটা দিন দাঁড়িয়ে থাকি, গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকি।

বাগান বিলাস

যাপিত জীবনকে নিয়ে ভাবনার অনেক উপাদান আছে। তবে সবকিছু ভাবতে পারি না। ভাবার সুযোগ পেয়েও অনেক অনুষঙ্গ নিজ প্রয়োজনে এড়িয়ে গেছি। অনেক বিষয়ে পরে ভাবা যাবে বলে ঐ পরিচ্ছেদে আর কখনও যাওয়াই হয়নি। তবে বারংবার আমি প্রকৃতির কাছে ফিরে গেছি। তার কাছে শিখতে চেয়েছি। প্রকৃতিও শেখালো ঢের। তবুও হয়তো আমার প্রত্যাশা ও শিখনফলে আছে হতাশা । ইচ্ছা ও প্রাপ্তির খতিয়ান খুব একাকী মিলিয়ে দেখি-কত কিছুইতো হলো না দেখা, হলো না কত শেখার শুরু । তবুও প্রাপ্তি কি একেবারেই কম? মোটেই না। পেয়েছিও ঢের। মনে তাই প্রশ্ন জাগে, যেদিন আমি আবার নিঃশ্বেস হয়ে যাব সেদিন কি প্রকৃতিও আমার মতো একা হয়ে যাবে? এর জবাবও প্রকৃতির বিবৃতিতেই পেয়েছি-না, ক্ষুদ্র জীবনের আঁচর প্রকৃতিতে বেশিক্ষণ মূর্ত থাকে না। অন্যকথায় প্রকৃতির মধ্যে বিষণ্নতা বেশি দিন ভর করে থাকে না। তাই সে সহজ, তাই সে সমাদৃত! আমার বিবেচনায় একারণে প্রকৃতি সকল জীব ও জড়ের কাছে সবচেয়ে বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

বাগান বিলাস › বিস্তারিত পোস্টঃ

কালচক্র

০১ লা ডিসেম্বর, ২০১৭ রাত ৯:০৭


ঈশ্বর বিমুখ হলে ভাগ্যকে বারবার বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।
ফারহান বিরক্তি নিয়ে মুখ দিয়ে একটি অস্ফুট শব্দ করে, ওফ! তার নিজের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কপাল চাপড়িয়ে কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না। সে ঘড়ি দেখল। রাত এগারোটা। রাস্তায় বাসের চাকা নষ্ট হয়েছে। এ চাকা খুলে অন্য একটি চাকা না লাগানো পর্যন্ত সহযাত্রীদের মতো তাকেও সময় পার করে যেতে হবে।
বাসের জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে চোখ রাখল ফারহান। লাইটপোস্টের আলোয় রাস্তার কালো পিচ এবং অনতিদূরে নির্জন প্রকৃতির গায়ে জড়িয়ে থাকা ভুসা কালির মতো কালো অন্ধকার ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ল না।
শহরও এখান থেকে খুব কাছে বলে মনে হয় না। সাধারণত কোনো শহরের উপর দিয়ে অতিক্রান্ত প্রধান রাস্তার তিন-চার মাইল আগে-পিছে শহরতলীর ছিটেফোঁটা থাকে। এখানে তেমন কিছু চোখে পড়ছে না। অবস্থা যা এখান থেকে বাগেরহাট শহর আরও কম করে দশ-বারো মাইল হবে। তার বেশিও হতে পারে। ফারহান সুপারভাইজারকে দেখতে পায়। সে তাকে জিজ্ঞাসা করে, এখান থেকে শহর আর কত দূর?
লোকটি কর্কশ ভাষায় বাসযাত্রীদের সঙ্গে কথা বলছে। সে যাত্রীদের অপেক্ষা করতে বলে। একজন যাত্রীর সঙ্গে সে বিবাদে জড়িয়ে পড়েছে। উঁচু স্বরে বলছে, এটা আমার হাতের কাজ না। যে কাজ করবে তাকে ডাকা হয়েছে, এলে বলা যাবে কত সময় লাগবে। আপনারা নিচে নেমে আশপাশে হাঁটাহাটি করতে পারেন। বেশি দূরে যাবেন না। আমরা কারও জন্য অপেক্ষা করতে পারব না।
ফারহান জেদী কণ্ঠে বলে, এইযে সুপারভাইজার সাহেব, আপনাদের মেকানিক আসুক না আসুক আমার তাতে কিছু যায় আসে না। আমি জানতে চাচ্ছিলাম এখান থেকে শহর কত দূর?
‘নয় মাইল’। মুখ খিঁচিয়ে উত্তর দেয় লোকটি।
ফারহান লোকটিকে একটা গালি দিতে গিয়েও দেয় না।
সুপারভাইজার সেই যাত্রীটির উপর ক্ষেপে গিয়ে আঞ্চলিক ভাষায় তাচ্ছিল্যের সুরে বলে, আমার চাক্কা নতুন। হেই চাকা যে ফাডব এইডা কইব কেডা? আমি কি আপনের মতো দেবদূত, আগে থাইকা সব জানুম? অঘটন কারও কইয়া আহে?
রাস্তার উভয় পাশে ঘন বন। দিক বুঝা যায় না। তবে ফারহান যেদিকে যাচ্ছে সেদিক হতে ফিনফিনে হাওয়া দিচ্ছে। বসন্তের এ হাওয়া খুব ভালো লাগে ফারহানের। ঝিরঝিরে হাওয়ার সঙ্গে গাছগাছালিগুলো যেন এক লয়ে নৃত্য করছে। লাইটপোস্টের কাছের গাছগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আকাশে চাঁদ নেই। পরিষ্কার তারা ভরা আকাশ।
অনেক সময় বাসে বসে থাকায় পায়ে আড়ষ্টতা এসেছে। হাঁটতে গিয়ে ফারহানের পা জড়িয়ে আসছে। মনে হচ্ছে পা যেন তার আগে চলছে।
ফারহান রাস্তার পাশ ধরে হাঁটতে থাকে। সে গাছের দিকে তাকিয়ে তাদের বিচিত্র জীবনের কথা ভাবতে থাকে। এই গাছগুলোই একসময় কালবৈশাখির কবলে পড়ে ডাল ভাঙে। কেউ উপড়ে পড়ে জীবন হারায়। তারাই আবার শীতে জুবুথুবু হয়ে থাকে, বর্ষায় বৃষ্টিতে ভেজে। কত রূপেই না সাজতে পারে প্রকৃতি। ফারহানের প্রকৃতির কাছাকাছি থাকতে ইচ্ছে করে সবসময়। বাস নষ্ট হওয়ার সুবাদে সে রাস্তায় একটু পায়চারি করে। রাস্তাটা নিস্তব্ধ।
কোলাহল নেই। নেই তেমন যানবাহন। অদূরে একটি খুপরি ঘর দেখা যায়। সেখান থেকে জোনাকির আলোর মতো টিপটিপে একটি আলো আসছে। ফারহান অনুমান করে ওটা একটা দোকানঘর হতে পারে। চায়ের নেশা পেয়েছে। চায়ের দোকান হলে খুব ভালো হয়। ফারহান ওই আলোর নিশানা ধরে হাঁটতে থাকে।
ফারহান আজ যাচ্ছিল কৌমুদির বাসায়। কৌমুদি ওর খালাতো বোন। ফারহানের ছোটকালের অনেক স্মৃতি ঊর্মি খালা ও কৌমুদিকে নিয়ে। নিউরণের স্তরে স্তরে সাজানো সেসব স্মৃতি মলিন হয়ে গেছে কিছুটা তবে একেবারে ম্লান হয়ে যায়নি। ফারহান ঊর্মি খালার বাসায় দিনের পর দিন থেকেছে। জীবনের স্বাধীনতা কী, তা সে সেখানে চর্চা করতে পেরেছে। ঊর্মি খালার ছেলে ছিল না। ফারহানকে তাই তিনি আপন ছেলের মতো ভালোবাসতেন। একবার তাকে বাগে পেলে ছাড়তে চাইতেন না। কী রমজানের ছুটি, কী গ্রীষ্মের ছুটি ফারহানের ঊর্মি খালার বাসায় যাওয়া চাই-ই চাই।
এখন আর সে সময় নেই। সভ্যতার সিঁড়ি তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের স্বপ্নটা খুব সাদামাটা। আর তার রঙের পরিবর্তনও হয় খুব কম। লেখাপড়ার ধাপ শেষ করে এখন সে মহাব্যস্ত কর্মক্ষেত্রের বিপণিবিতানে। এ বিপণিতে শ্রম ও মেধা বিপণনের মাধ্যমেই আসবে প্রকৃত উন্নতি, দেখা মিলবে মধ্যবিত্তের ট্রেডমার্ক সভ্যতা। সুতরাং ছোটো, উপরে উঠতে হবে। ফারহানের একার পক্ষে সমাজের এ অমোঘ নিয়মকে ভাঙা সম্ভব নয়। তাই চিরাচরিত নিয়মে প্রতিষ্ঠিত সহজ সে পথ ধরেই চলছে ফারহান। কিন্তু এ পথের শেষ কোথায়। হরপ্পা সভ্যতার মতো এ সভ্যতার শেষ হবে কবে?
আজ এতদিন পর বাল্যস্মৃতিকে ঘষেমেজে সাফ করার আর ফুসরত কোথায় ফারহানের। আজকের কর্মচঞ্চল ফারহান আর সেদিনের ফারহানের মধ্যে পার্থক্য ঢের। হয়তো প্রাণ একই আছে কিন্তু বদলে গেছে দেহের খোলস, আকৃতি ও চিন্তার রং। সকলের মতোই জৈবিক ও অজৈবিক এ পরিবর্তনের উপর তার যতটুকু হাত ছিল তার চেয়ে বেশি কার্যকর ছিল সময়ের প্রবাহ, জীবনের নিয়ম। অথচ শৈশবের সেই সুখস্মৃতিগুলো কতই না মধুর ছিল। কষ্টগুলো কতই না অনিশ্চিত ছিল। হয়তো সে সময় ওসব আসতো স্বর্গলোকের কোনো অন্দর দিয়ে। ফারহানের স্পষ্ট মনে পড়ে ঊর্মি খালার হৃদয় উদার স্নেহ-আদর, কৌমুদির সঙ্গে খেলা, খুনসুটি, ঝগড়া-বিবাদ অথবা একটু বড় হলে কৌমুদির সাথে ছাদে বসে পড়ালেখার বাতাবরণে সন্ধ্যা পর্যন্ত মুখোমুখি বসে থাকা, অকারণে উচ্ছ্বাস প্রকাশ-সেসব কতই না আনন্দময় ছিল!
একবারের ঘটনা। ফারহান তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ে। মে মাসের মাঝামাঝি। খালার বাসা থেকে টেলিফোন এল ঊর্মি খালা অসুস্থ। বুকে ব্যথা। স্থানীয় ডাক্তার প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে বলেছে হার্ট ডিজিজ। বাঁচা-মরা আল্লাহর হাতে। ঊর্মি খালারা তখন দিনাজপুর থাকতো। রাতেই ফারহান, তার মা, তূর্ণা ও ফারহানের ছোট চাচা ইজাজ নাটোর থেকে রওয়ানা দিলো দিনাজপুর। বিশেষ কাজে আটকা পড়ায় ফারহানের বাবা যেতে পারলেন না। সারা রাস্তায় চোখ মুছতে মুছতে ফারহানের মা ও তারা রাত এগারোটায় পৌঁছাল দিনাজপুরে। ফারহানের প্রিয় খালা তখন হাসপাতালে। ফারহানের মা ঝটপট ওদেরকে বাসায় রেখে ইজাজকে সাথে নিয়ে হাসপাতালে গেলেন। ফারহানের খালু হাসপাতালেই আছেন।
বাসায় রইল কৌমুদি, তূর্ণা, ফারহান আর হাড় জিরজিরে গৃহকর্মী রাহেলা। প্রথম দর্শনে চল্লিশোর্ধ রাহেলাকে দেখে যে কারও ভয় পাওয়ার একটা সম্ভাবনা থাকবে। তবে মানুষ হিসেবে সে খুব ভালো।
সেরাতে ঘন্টার পর ঘন্টা জেগে তারা রাহেলার কাছে ভূতের কেচ্ছা শোনে। দোতলার বড় ঘরের মেঝেতে মাদুর পেতে শুয়ে শুয়ে ভূতের গল্প শুনে তাদের গা হিম হয়ে আসে। রাহেলাকে কেউ কেউ শক্ত করে ধরে থাকে ভয়ে। কৌমুর গলা শক্ত করে ধরে থাকে ফারহান, ফারহানের গলা কৌমু। তারা মুখে ভয় প্রকাশ করে না। তবুও গল্প শুনতে চায়। রাহেলা শেষ করতে চায়। তারা আবার অনুরোধ করে। কেচ্ছা শেষ হয় না। কেচ্ছা বলার ফাঁকে ফাঁকে রাহেলা দম নেয়। পান সাজিয়ে মুখে দেয়। জিভের ডগায় চুন লাগিয়ে বলে, কিগো পুলাপান ভয় লাগে?
তারা ঢোক গিলে সমস্বরে বলে, না-না আর একটু বলো।
রাহেলা উদ্যম না হারিয়ে পরবর্তী কেচ্ছার ঝাঁপি খোলে। এবারের কেচ্ছার নাম পঞ্চভূত।
পরপর কয়েক রাত চলল একই ধারায়। রাহেলার কেচ্ছার ঝুড়ি শেষ হয় না।
নয় দিন হাসপাতালে কাটিয়ে ঊর্মি খালা সুস্থ্য হলেন।
ফারহানের মা ও তূর্ণা চলে গেল তার বাবার সঙ্গে। ইজাজ আগেই চলে যাওয়ায় ফারহানের বাবা তাদের নিতে এসেছিলেন। ফারহানকেও নিয়ে ফিরতে চাইল তার বাবা। তবে তার খালা খুব জোড় জবরদস্তি করে তাকে রেখে দিল। ফারহানের বাবা মাকে সাফ জানালোÑসামনে গ্রীষ্মের ছুটি। ছুটি শেষ করে নাটোর ফিরবে।
ফারহানের মা একটু আপত্তি করলেও তার খালা মোটেই তা গ্রাহ্য করেননি। ঊর্মি খালা যুক্তি দিলÑতুই ওকে রেখে যা তো, কৌমুদি আছে ওরা একসঙ্গে পড়লে পড়ায় অসুবিধা হবে না। ঠিক হলো, ফারহানকে দেড় মাস খালার বাসাতেই গৃহশিক্ষক রেখে পড়ানো হবে।
পড়াশুনা শেষে সারাদিন এটাসেটা করেও হাতে অনেক সময় থাকতো ফারহানের। গৃহশিক্ষক তার পড়াশুনা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করলেও সেদিকে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সারা দিন খালুর পুকুরে ছিপ দিয়ে মাছ ধরে, ঘুড়ি উড়িয়ে, ফড়িঙ ধরে তার দিন চলতে থাকল। সেখানে ফারহানকে শাসন করার কেউ নেই। ঊর্মি খালা যাই বলেন ফারহানের মনে হয়-তিনি আদর করে বলছেন, শাসন করে নয়।
এক বিকালে কৌমুদি ও ফারহানকে নিয়ে মেলায় ঘুরতে গেল তার খালু। গোপিনাথপুরের রথের মেলা। আহা কী বাহারি জিনিসপত্রে ঠাসা মেলা। ফারহানের মনে হলো যেন সব কিনে নেয়। ফারহান বায়না ধরল এয়ারগানের গুলি ছুঁড়ে বেলুন ফাটাবে। মনে খুব সাহস ছিল, সে সবকটা বেলুন ফাটিয়ে ফেলতে পারবে। কিন্তু দশটা গুলি খরচ করে সে একটা বেলুনও ফাটাতে পারল না। চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ফারহানের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। হেসে তার খালু বলল, আবার চেষ্টা করবে নাকি?
ফারহান মাথা নাড়ে, না। তার আর সাহস হয় না। ফারহান তার মুখ লুকাতে মেলায় বসানো কৃত্রিম ফোয়ারার দিকে তাকিয়ে থাকে।
কৌমুদির মধ্যে একটি আশ্চর্য ভালো গুণ ছিল। সে কোনো দিন ফারহানকে ঈর্ষা করত না। কিন্তু ওদের মধ্যে ঠান্ডা ঝগড়া ও প্রতিযোগিতা ছিল। ফারহান বয়সে কৌমুর প্রায় সমসাময়িক। বছর খানেকের ছোট হবে কৌমু। ফারহান বড় হলেও স্বভাবে শান্ত নয়। ওর মধ্যে দস্যিপনাটা বেশি। কৌমুদি ছিল খালার একমাত্র কন্যা। সে ছিল খুব প্যানপ্যানানি আর আহ্লাদী স্বভাবের। তবে কৌমুর আদরে ভাগবসাতো তূর্ণা, ফারহানের বোন। কিন্তু ফারহানের আদরে কোনো ভাগ ছিল না। সে ছিল দুই পরিবারের একমাত্র শিশু পুত্র।
দোকান ঘরটির সামনে অনেক সময় বসে আছে ফারহান। বেঞ্চে দক্ষিণ মুখ হয়ে বসেছে। গাড়িটার জ্বেলে রাখা হেডলাইট দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। তার পাশে বসে আছে আরও একজন সহযাত্রী। ভদ্রলোকের নাম মমিনুল হক। উত্তরবঙ্গের মানুষ, মন খোলা। তিনি কাজ করেন পানি উন্নয়ন বোর্ডে। এখানে বসে ফারহান দুই কাপ চা খেয়েছে ইতোমধ্যে। ভদ্রলোক পুনরায় আর এক কাপ অফার করলেন। ফারহান বিনীত ভঙ্গিতে বলল, মাফ করবেন ভাই। আমি অলরেডি নিয়েছি।
আরে ভাই খান আর এক কাপ। না-কি ঘুষের পয়সা খান না?
চা কি ঘুষের পয়সায় খাওয়াতে চান?
লোকটি মুচকি হেঁসে বলেন, না-রে ভাই। পানি উন্নয়ন বোর্ডে চাকরি করি। লোকজন ভাবে আমরা বুঝি বেতন পাই না। কেবল ঘুষের জন্য হাত বাড়িয়ে বসে থাকি।
চা নিল ফারহান। চা খেতে খেতে আবার সে মৌন হয়ে গেল। ডুব দিল আগের চিন্তায়।
বিয়ের অনেক দিন বাদে ফারহানকে ফোন দিয়েছিল কৌমুদি। জানায় সে একটি কন্যা সন্তানের জননী হয়েছে। কৌমুদির বিয়ে হয় অনার্স পাশ করে। জামাই ব্যবসা করে। বাগেরহাটে মাছের হ্যাচারি ও ঘের আছে। চোখের দেখায় মনে হয়েছে লোকটি মানবিক ও মার্জিত। সুপুরুষ তো বটেই।
বিয়ের কথা পাকাপাকি হওয়ার পর ফারহান কৌমুদিকে ঠাট্টা করে বলেছিল, যা কৌমু তোর কপাল ভালো। আমার মতো অকালকুষ্মা-ের গলায় তোকে ঝুলতে হলো না।
কৌমুদি খুব গভীরভাবে নেয় কথাটা। সে ধীরস্থির জবাব দেয়, ফারহান জীবনে যতবার রংধনু দেখতে চেয়েছি ততবার মেঘে ঢাকা আকাশ পেয়েছি। হয়তো যখন রবির দেখা মিলবে তখন আর বৃষ্টি থাকবে না। গ্রীষ্মের খাঁ খাঁ রোদে রংধনু থাকবে না। সেদিন আমি হয়তো জীবনকে জীবনের মূল্য দিয়ে কিনতে সক্ষম হব। কিন্তু সেটা আমার ঈপ্সিত জীবন হবে না। আমি মানি, কারও স্বপ্নের সঙ্গেই জীবনের শতভাগ অঙ্ক মেলে না। তাই বলে বিশ্বাস ও বাস্তবতার যোগ-বিয়োগের ফলাফলে এত ফারাক!
একটু থেমে আবার বলেছিল, ফারহান আমি খুব অসহায়। আমাকে একা ছেড়ে দিও না। পথ হারিয়ে ফেলব। একটা নিরিবিলি পথ আমাকে দাও যে পথে কোনো পথিক থাকবে না। যে পথের অনর্থক শাখা-প্রশাখা থাকবে না, হেরে যাওয়ার ভয় থাকবে না। তুমি চাইলে এখনও পারো ফারহান। প্লিজ।
ফারহানের সঙ্গে কৌমুর বিয়ে যে কেনো হলো না সে বিষয়ে খুব বেশি যেতে চায় না ফারহান। আজ হাতে সময় আছে, ওদিকে একটু ঢুঁ মেরে আসা যায়।
বিয়েটা না হওয়ার পিছনে সিংহভাগ দোষ ছিল ফারহানের। বাকিটা পরিবার ও তকদিরের। অবশ্য তার ঊর্মি খালাও চায়নি বিয়েটা হোক। তার খালার যুক্তি ছিল আতœীয়ের মধ্যে আতœীয়তা নয়। তা ছাড়া তিনি প্রাথমিকভাবে আরও চেয়েছিলেন, তাদের যেহেতু একটি মেয়ে এবং আর কোনো সন্তান ছিল না, সেহেতু হাতের কাছাকাছি থাকবে এমন একটা ছেলের হাতে কৌমুকে তুলে দেবেন। জামাই তাদের বিপদে আপদে দেখাশুনা করতে পারবে। ফারহানের পক্ষে এমন কিছু করা সম্ভব নয়। নিজ পরিবার থেকে সে বাধা পাবে।
ফারহানের বাবার চাহিদা হলো ছেলে আইন বিষয়ে পড়ছে তাকে এ পেশাতেই থাকতে হবে। ইংল্যান্ড থেকে ব্যারিস্টারি পড়ে এসে ঢাকায় কোনো ভালো সিনিয়রের সঙ্গে প্র্যাকটিস শুরু করবে। গাঁও-গেরামে থেকে জীবন নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না। তিনি চাকরি করতে এসে দেখেছেন চাকরি কখনও মানুষকে শিড়দাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে দেয় না। কোথাও না কোথাও তাকে নত হতে হয়। প্রভুরা অনুগত দাস পছন্দ করে। এর চেয়ে স্বাধীন পেশা হিসেবে ওকালতি ভালো। পেশার প্রতি সৎ থেকে একটা ভালো ব্যারিস্টার হতে পারলে সারা দেশের মানুষ চিনবে। যশ কামাতে এ পেশার কমতি নেই।
উভয় পরিবারের বৈরি মনোভাবের পরিস্থিতিতে সত্যিকারের ভালোবাসায় দেখা যায় নায়ক বা নায়িকা ভালোবাসার সফলতার বিনিময়ে সব পার্থিব স্বার্থ ত্যাগ করে। ঝুঁকি নিয়ে তাদের মিলন ঘটায়। কিন্তু ফারহানের ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। কৌমুদির বিয়ের সময় তার বয়স ছিল তেইশ বা চব্বিশ। সবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র। বয়স, ভবিষ্যত, ক্যারিয়ার, পারিবারিক বৈরিতা ইত্যাদি বিষয় হিসেব নিকেশ করে এসময় তার ঝুঁকি নিতে সাহস হয়নি।
কৌমুর বাবা একদিন ফারহানকে ডেকে বলেন, ফারহান এক কাজ কর। পরিবারে অশান্তি করে বিয়ে করার দরকার নেই তোমার। তার চেয়ে বরং কৌমুদিকে আমরা দেখেশুনে বিয়ে দিয়ে দেই। তাতে দুই সংসারের শান্তি অক্ষুন্ন থাকে। তোমার যা বয়স তাতে একসময় এসব ভূত মাথা থেকে চলে যাবে। আর তুমি আমাদের যেমন ছিলে তেমনই থাকবে।
এমন সহজ সমীকরণে প্রেম চলে না। কিন্তু ফারহান গরজ করে কৌমুদির বিয়েতে বাধা দেয়নি।
কৌমুদি সত্যিকারের ভালোবাসার মানুষের মতো নাওয়া খাওয়া ভুলে যায়। খুব কান্নাকাটি করে। ফারহানের উপর খুব অভিমান হয় তার। রাগ হয় নিজের উপরও। জগতে এত মানুষ থাকতে ফারহানের মতো একজন কাপুরুষকে ভালোবেসেছিল সে? নিজেকে ধিক্কার দেয়। তারপরও সে কাপুরুষটাকে ভুলতে পারে না। ফারহানের সঙ্গে তার বিচ্ছেদ সে কোনোভাবেই মানতে পারে না। শেষ পর্যন্ত হয়তো ফারহান ফিরবে এমন আশা জিয়ল মাছের মতো কৌমুদির বুকভরে জীবিত থাকে।
কৌমুর বিয়ের আগে ফারহান একবার ভেবেছিল সে কৌমুদির কাছে ক্ষমা চাইবে। অনুতপ্ত হবে। কিন্তু পরিণামের কথা ভেবে সেই চিন্তা থেকে সে সরে আসে। ফারহান মনে করে কৌমুদির এতে কষ্ট বাড়বে বৈ কমবে না। মানুষের কষ্টের সময়ে আবেগ সংহত থাকে না। ফলে এ সময় স্পর্শ্বকাতর বিষয়ে নিয়ে নাড়াচাড়া করলে কোনো ভালো ফল আসে না বরং এতে কষ্ট ও ঘৃণা দুটাই বাড়ে। কৌমুদি তার জন্য আরও কষ্ট পাক সে তা চায়নি।
ইস, প্রথম যেদিন কৌমুদি একটু ভিন্ন স্বরে বলেছিল, ফারহান চল ছাদে যাই। ঘুড়ি উড়ানো দেখি। তখন ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে ফারহান। আর কৌমুদি ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে। কৌমুদির সে আহ্বানে চুম্বকের মতো আকর্ষণ ছিল। সে সন্ধ্যাতেই ফারহান কৌমুদিকে নতুন করে আবিস্কার করে। তারা দুজনেই বুঝতে পারে তাদের পরস্পরের পরস্পরকে কিছু একটা বলার আছে। কৌমু ফারহানের হাত ধরতে চায়। কিন্তু পারে না। কৌমুদির হাত মৃদু বাতাসে কুপির খোলা শিখার মতো কাঁপতে থাকে। একটা লজ্জা, একটা নামগোত্রহীন আড়ষ্টতা তাদের আচ্ছন্ন করে। কৌমু এক দৌড়ে ছাদ থেকে নিচে নেমে আসে।
সেদিন থেকেই ফারহান কৌমুদির সম্পর্ক খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনের মতো তাদের পরস্পরের কাছে প্রকাশিত হয়েছিল। কৌমু হয়েছিল ফারহানের, একান্ত আপন। ছায়ার মতো খুব কাছের। তারপর কত আবেগ, কত অভিমান, কত ভালোবাসার পরিস্ফুরণ। কত ফোন, মেসেজ আদান-প্রদান, কত কথা! আহ! সময় কত দ্রুত যায়। প্রথম দিনের স্বপ্নিল ঐ সন্ধ্যাটি এখন শুধু নিথর স্মৃতি। অথচ এখনও ভাবলে শিড়দাঁড়া দিয়ে একটা সুখের অনুভূতি পরশ বুলিয়ে যায়। ভালোলাগায় আবেশিত হয় চিন্তার জ্যামিতি।
পাশের লোকটি বললেন, ভাই চা টা মনে হয় ঠান্ডা হয়ে গেছে। কাপটা রেখে দিন। লোকটি সিগারেট বের করে। ইশারা দিয়ে বলে, চলে?
ফারহান মাথা নাড়ে। হু।
লোকটা খুশি হয়। কিছুটা উল্লসিত ভঙ্গিতে বলে, মাল দেখেই বুঝা যায় চলে কি না। আমি আপনাকে দেখেই বুঝেছিলাম আপনি সিগারেট খান।
ফারহান সিগারেট ছেড়ে দিয়েছে এ কথা লোকটাকে বলতে তার ভালো লাগছে না। ফারহানের কর্মস্থলে সিগারেট খাওয়ার স্পেস নাই। রুমে সারাক্ষণ এসি চলে, সিগারেট খাওয়া যায় না। তবে এখন একটা সিগারেট হলে মাথার মধ্যে চলতে থাকা সিনেমার সঙ্গে একটা সংঘাত হয়। তাতে বিস্ফোরণটা আরও আকর্ষণীয় হবে।
ফারহান হাত বাড়িয়ে সিগারেট নেয়।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে ব্যারিস্টারি পড়তে যাওয়া হয়নি ফারহানের। তার বাবার বোন ক্যান্সার ধরা পড়ে। চিকিৎসায় অনেক টাকা খরচ হয়। বছরের মাথায় তার বাবা চলে যায়। শেষে সংসারের হাল তাকেই ধরতে হয়। সেও তার বাবার ইচ্ছে মতো মস্ত উকিল হতে পারেনি। প্রায় সাত বছর হতে চলল একটা বেসরকারি ব্যাংকে আইন কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছে। দিনকাল একেবারে খারাপ যায় না। তূর্ণাকে বিয়ে দিয়েছে।
তূর্ণা মেডিকেল পাশ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছে। ওর জামাইও সেনাবাহিনীতে কাজ করে। ফারহানের মা ফারহানের সঙ্গেই গাজীপুরে থাকে। বাবা মারা যাবার পর তার মার শরীর ভেঙে পড়েছে। মানসিক শক্তি কমে গেছে। অবশ্য তারও বয়স হয়ে গেছে। তবুও ছেলে, বউ-মা, ছয় বছর বয়সী নাতিকে নিয়ে তার সময়টা ভালোয় কেটে যায়। তবে সে যে সুস্থ আছে সেটাই ভালো খবর। ওপরওয়ালাকে ধন্যবাদ।
সিগারেটে আগুন জ্বালিয়ে ফারহান কাশতে থাকে।
লোকটি বলেন, কোনো দুশ্চিন্তা করছেন মনে হয় ভাই।
ফারহান একটু ধাতস্থ হয়ে বড় বড় শ্বাস নিয়ে ছোট করে জবাব দিল, জ্বি।
চিন্তা ভাবনার কোনো কাজ নেই। গাড়ি ঠিক করতে আরও এক ঘন্টা যে লাগবে তা আমার কাছে লিখে নিতে পারেন।
তিনি গলার শ্লেষ্মা পরিষ্কার করে আবার বললেন, গাড়ির যা কন্ডিশন দেখলাম তাতে ওরা যদি আমাদের বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত পৌঁছে দেয় তাহলে ওদের হাজার সালাম। লাগেজ-ব্যাগেজ না থাকলে এই রাতেই হাঁটা দিতাম। নির্ঘাত এতক্ষণে বাগেরহাট পৌঁছে যেতাম।
সিগারেট ফেলে দিয়ে ফারহান তাকে তোয়াজের স্বরে বলল, ভাই আপনারা সরকারি চাকুরে। আপনারা পারেন না হেন কাম নাই। এদের একটু টাইট দেন না ভাই।
লোকটি মশকরা বুঝতে পারে। হো হো করে হেসে ওঠে।
তার হাসির শব্দ বেশিক্ষণ ফারহানের কানে ধ্বনিত হয় না।
ফারহান ভাবতে থাকে-জীবন যত বাড়তে থাকে পারস্পরিক সম্পর্কগুলো তত শিথিল হতে থাকে। ঊর্মি খালার বাসায় আর যাওয়া হয় না অনেক দিন। যোগাযোগটাও আর সেভাবে নেই। ফোনে কথা হয় মাঝে মাঝে। তার ঊর্মি খালা আর খালু চাকরি শেষে দিনাজপুরেই থিতু হয়েছে। কৌমুদি ও তার স্বামী অনেক সাধাসাধি করলেও খালুর অবসরের পর তার পরিচিত শহর ছেড়ে কৌমুদির সঙ্গে বাগেরহাটে যায়নি।
ফারহানকে আজ বাগেরহাট যেতে হচ্ছে অফিসের কাজেই। সেখানে তাদের ব্যাংকের একটা নতুন শাখা হবে। সে অফিসের লোকেশন ঠিক হয়ে গেছে। ব্যাংকের কাজ প্রাথমিভাবে শুরু হবে একটা ভাড়া করা ভবনে। সেই ভবনের মালিক থাকেন দেশের বাইরে। মালিকের পক্ষে ভবনটি ভাড়া দেবেন তার এক নিকটাত্নীয়। উভয় পক্ষের মধ্যে ভাড়া সংক্রান্ত ডিড হবে। ডিডের খসড়া নিয়ে উভয় পক্ষে আলোচনা করা এবং জমির দখল ও কাগজপত্রে কোনো সমস্যা আছে কি না তা সরেজমিন দেখে মতামত দেওয়ার জন্যই মূলত তার বাগেরহাটে যাওয়া।
ফারহানের বাগেরহাট যাওয়ার কথা শুনে তার মা বলে, বাগেরহাটে তো আমাদের কৌমুদি আছে। যা তুই এক ফাঁকে ওকেও একটু দেখে আসিস। যাতায়াত না থাকলে কী আর আত্মীয়তা থাকে? তারপর ফারহানের মা-ই জানায় কৌমুদি আর ঊর্মি খালাকে। কৌমুদি খুব খুশি হয়। সে একটু অভিমানী কণ্ঠে বলে, খালা ফারহান আমাদের বাগেরহাটে আসবে আর আমাকে একটুও জানালো না। না কি সে আগের মতোই মুখচোরা থেকে গেল? খালা ফারহানকে বলবে, ও যেন সোজা আমার বাসায় এসে উঠে। অন্য কোথাও উঠলে তোমাদের সঙ্গে আমার আত্নীয়তা শেষ, বলে রাখলাম।
কৌমুদি তার খালাকে কোনো জবাব দেওয়ার সুযোগ না দিয়ে বলতে থাকে, না খালা থাক। আমিই ওকে ফোন দেবো।
অনেকদিন পর অফিসে কৌমুদির ফোন পায় ফারহান।
কৌমুদির বিয়ের পর সামনাসামনি দেখা হয়নি তাদের। ফোনে কথা হয়েছে হাতে গুনে কয়েক বার। ফারহানের দিক থেকেই ফোনে যোগাযোগ রাখায় আপত্তি ছিল। প্রথমে স্পষ্টত এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করত ফারহান। তার যুক্তি ছিল, দুজনেরই বিয়ে হয়েছে। অতীতের কোনো বিষয় যেন তাদের সংসারে শান্তির অন্তরায় না হয় সেটা খেয়াল রাখা খুবই প্রয়োজন। গতিময় জীবনের বাঁকে বাঁকে কিছু পরিক্রমা থাকে, দাবি থাকে, সেটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমন্বয় করে নিতে হয়।
ফারহান, আমি কৌমুদি।
ফারহানের বুঝতে একটু সময় লাগে।
খালা বলল, তুমি নাকি অফিসের কাজে বাগেরহাট আসবে।
হুম। অফিসের একটা কাজে আমাকে পাঠানো হচ্ছে।
ভালোই তো। এদিকে আসোনি বোধহয় আগে।
না।
ভালোয় হলো। সুন্দরবন ঘুরে যাও। খান জাহান আলীর মাজার, ষাটগম্বুজ মসজিদ, কোদলা মঠ এগুলোও দেখে যেতে পারবে। খালাম্মা আর ভাবিকেও নিয়ে এসো।
কৌমুদি একটু হেঁয়ালি করে বলে, তোমাদের সঙ্গে আমরাও একটু খোলা হাওয়া খেলাম আর কী! মন্দ হবে না। তোমার ভাইকেও বলে রেখেছি। সে তো মাছের হ্যাচারি আর ঘের নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত থাকে। আমার মেয়েটাকেও ঠিক মতো সময় দিতে পারে না। সারা দিন খালি ব্যবসা আর ব্যবসা। আমি তো চাকরিজীবী ঘরের মেয়ে, এখানে দেখলাম ব্যবসায়ীরা টাকা ছাড়া আর কিচ্ছু চেনে না। তবে তোমরা এসো, সে সব রেডি করে রাখবে। কয়েক দিন হাতে সময় নিয়ে এসো।
তোমরা মানে? পাল্টা প্রশ্ন করে ফারহান।
তোমরা মানে সবাই। খালা, তুমি, ভাবি, তোমার ছেলে। সবাই মিলে এসো।
ইস, আগে জানলে বাবা-মাকেও আসতে বলতাম। একটা গেট টুগেদার হয়ে যেতো।
দেখি যদি ছুটি পাই। তবে ওদের আসার সুযোগ দেখছি না।
চেষ্টা কর।
দেখি।
দেখাদেখির কী আছে? ছুটি নিয়ে এসো।
কবে রওয়ানা দেবে?
রবিবার।
খুব ভালো হলো, সোম থেকে বুধবার আমার মেয়ের স্কুল বন্ধ। ও এবার ক্লাস ফাইভে।
ফারহান কিছুটা স্বস্তি পায়। কৌমুদি অনেক বদলে গেছে। তার গলায় সেই অভিমান নেই। ক্ষোভ নেই। অনেকটা ভাদ্রের রোদের মতো চনমনে ও সাবলীল কণ্ঠস্বর।
গাড়ির হর্ন শোনা যাচ্ছে। মেরামত হয়ে গেছে মনেহয়। সহযাত্রী মমিনুল হক হাতব্যাগটা কাঁধে তুলে নিতে নিতে বললেন, ওঠেন ভাই। বিধাতা বুঝি মুখ তুলে তাকালেন।
ফারহান ওঠল না। সে বেঞ্চটায় আরও জুত হয়ে বসল। ভদ্রলোক অবাক হয়ে বললেন, আরে ভাই ওঠেন। বাসের হর্ন দিচ্ছে।
উত্তর করল না ফারহান। আগের মতোই বসে রইল। আচরণে তার রাজ্যের উদাসীনতা।
ফারহান তার কাছে সিগারেট আছে কি না জানতে চাইল। ভদ্রলোক অবাক হয়ে বললেন, কী ভাই, এখানে থেকে যাবেন না কি?
ভদ্রলোক তাকে সিগারেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিলেন। সিগারেট নিতে নিতে ফারহান বলল, খোদা হাফেজ ভাই। আমি যাচ্ছি না।
যাচ্ছি না মানে?
ফারহান আর কোনো কথা বলল না। লোকটি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে যা বুঝার বুঝে নিল।
আকাশে কিছুটা চাঁদ উঠেছে। আধো অন্ধকার। সবকিছু স্পষ্ট দেখা যায় না। তবে আবছা আবছা কিছু দেখা যায়। ভদ্রলোক আর কথা বাড়াল না, দ্বিধা নিয়ে পা ফেলল। লোকটা ওঠামাত্র দোকানদার দোকান বন্ধ করে দিল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বাসটি তাকে অতিক্রম করে বাগেরহাটের দিকে দৌড়াতে থাকল।
ফারহানের ফোন আসে। কৌমুদি ফোন করেছে। সে ফোন ধরবে কি না ঠিক করতে পারে না। কৌমুদি হয়তো ফারহানের পৌঁছাতে দেরি হওয়ার জন্য চিন্তা করছে।
কৌমুদির জন্য যে তীব্র পাপবোধে ওর ভেতরটা জারিত সে অনুশোচনাটাকে ফারহান হাওয়ায় মিলিয়ে দিতে চায় না। মমির মতো পুষে রাখতে চায়। অনুপুঙ্খ এ পাপবোধের কালচক্রেই সে কৌমুদিকে বেঁচে রাখতে চায়।
ফারহান তার গন্তব্যের বিপরীত দিকের একটা গাড়ির জন্য অপেক্ষা করে। খুলনা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলে রাতে থাকার একটা বন্দোবস্ত হয়ে যাবে। খুলনা থেকে বাগেরহাটের যোগাযোগ ভালো বলেই জানা আছে তার। দিনে দিনেই অফিসের কাজ সারা যাবে।
ফারহান ফোনটা কেটে দিয়ে মোবাইলে সময় দেখল। ভারি হয়েছে রাত। বারোটা দশ।

উল্লেখ্য, গল্পটি ‘জলপরির জলছবি’ গল্পগ্রন্থে অন্তর্ভূক্ত হয়ে অমর একুশে বইমেলা ২০১৮ তে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০২ রা ডিসেম্বর, ২০১৭ রাত ১২:৪১

কালীদাস বলেছেন: সহজ সরল, সুন্দর :)
প্রকাশিত হতে যাচ্ছে সেজন্য অনেক অনেক শুভেচ্ছা !:#P

০২ রা ডিসেম্বর, ২০১৭ সকাল ১১:০০

বাগান বিলাস বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ রইল আপনার প্রতি। মন্তব্য প্রকাশের জন্য কৃতজ্ঞতা। ভালো থাকুন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.