নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি হয়তো মানুষ নই, মানুষগুলো অন্যরকম, হাঁটতে পারে, বসতে পারে, এ-ঘর থেকে ও-ঘরে যায়, মানুষগুলো অন্যরকম, সাপে কাটলে দৌড়ে পালায়। আমি হয়তো মানুষ নই, সারাটা দিন দাঁড়িয়ে থাকি, গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকি।

বাগান বিলাস

যাপিত জীবনকে নিয়ে ভাবনার অনেক উপাদান আছে। তবে সবকিছু ভাবতে পারি না। ভাবার সুযোগ পেয়েও অনেক অনুষঙ্গ নিজ প্রয়োজনে এড়িয়ে গেছি। অনেক বিষয়ে পরে ভাবা যাবে বলে ঐ পরিচ্ছেদে আর কখনও যাওয়াই হয়নি। তবে বারংবার আমি প্রকৃতির কাছে ফিরে গেছি। তার কাছে শিখতে চেয়েছি। প্রকৃতিও শেখালো ঢের। তবুও হয়তো আমার প্রত্যাশা ও শিখনফলে আছে হতাশা । ইচ্ছা ও প্রাপ্তির খতিয়ান খুব একাকী মিলিয়ে দেখি-কত কিছুইতো হলো না দেখা, হলো না কত শেখার শুরু । তবুও প্রাপ্তি কি একেবারেই কম? মোটেই না। পেয়েছিও ঢের। মনে তাই প্রশ্ন জাগে, যেদিন আমি আবার নিঃশ্বেস হয়ে যাব সেদিন কি প্রকৃতিও আমার মতো একা হয়ে যাবে? এর জবাবও প্রকৃতির বিবৃতিতেই পেয়েছি-না, ক্ষুদ্র জীবনের আঁচর প্রকৃতিতে বেশিক্ষণ মূর্ত থাকে না। অন্যকথায় প্রকৃতির মধ্যে বিষণ্নতা বেশি দিন ভর করে থাকে না। তাই সে সহজ, তাই সে সমাদৃত! আমার বিবেচনায় একারণে প্রকৃতি সকল জীব ও জড়ের কাছে সবচেয়ে বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

বাগান বিলাস › বিস্তারিত পোস্টঃ

আজ থেকে এ মাসের নাম স্বাধীনতা

০৮ ই মার্চ, ২০১৮ সকাল ৯:৫৭



খুব সতর্কভাবে মার্চকে আমি মার্চ বলি না।
বলি, আমাদের স্বাধীনতার মাস।
মা বিতর্ক এড়াতে বলতেন-গন্ডগোলের মাস।
মার্চ শব্দটার মধ্যে একটা পরাধীনতার গন্ধ আছে।

মার্চ বললে আমার মনে পড়ে ব্রিটিশ শাসনের কথা
মার্চ বললে আমার মনে পড়ে
আমার পূর্বপুরুষের গা থেকে
চামড়া খুলে নেয়া অত্যাচারী নীলকরবাবুদের কথা
তাদের ধাবমান ঘোড়ার খুর থেকে উৎসারিত শব্দের আতঙ্কে
আমার পিতামহের চোখ কোটরে ঢুকে যেত,
শুকে খাক হয়ে যেত তার রোগাক্রান্ত কলিজা।
তাদের জীবনে একরাতের জন্যও চোখে প্রশান্তির ঘুম ছিল না
হ্যাটওয়ালা বাবুদের চাবুক থেকে বের হয়ে আসা
সাপের জিভের মতো মুনাফার লালসা তারা শোধ দিত
তাজা রক্তে।

মার্চ বললে আমার মনে পড়ে পলাশীর কথা
বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর
জগৎশেঠ, উমিচাঁদ
রায়দুর্লভ, রাজবল্লভের কথা।
তারা বিলিয়ে দিয়েছিল বলেই পুনর্বার আমাদের কিনতে হয়েছিল
বাংলাকে-ক্লিষ্ট দিয়ে, রক্ত দিয়ে, সম্ভ্রম দিয়ে।

মার্চকে আমি স্বাধীনতা নামে ডাকি
কারণ এমাসেই এসেছিল স্বাধীনতার ডাক।
এ মাসেই স্বপ্নসমৃদ্ধ একটি রসুন মাটিতে পুঁতে রেখেছিল
একজন অভিলাষী কৃষক,
সেটি ছিল আমাদের বিজয়ের স্বপ্ন, যুদ্ধ জয়ের একমাত্র প্রেরণা।
মার্চকে আমি স্বাধীনতার মাস বলি
কারণ মার্চ উচ্চারিত হলেই কামরুল হাসানের
অঙ্কিত সেই বিখ্যাত পোস্টারে ইয়াহিয়ার রক্তাক্ত দাঁত
এবং তাদের রক্তচোষার ইতিহাস
আমাকে তাড়া করে।
মার্চ উচ্চারিত হলেই আমি শুনতে পাই
ব্যারাকে, বাংকারে, কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে
উপর্যপুরি ধর্ষিত মা-বোনদের বোবা কান্নার শব্দ।

মার্চ বললে আমার চোখে ভেসে ওঠে
গভীর রাতে বালিশে মুখ গোঁজে
আমার বীরাঙ্গনা মায়ের ফুঁপিয়ে কান্নার স্মৃতি।
আমাদের সৌভাগ্য তিনি ফিরে এসেছিলেন।
তার সহগামিনী অনেকের নাম এখনও
রয়ে গেছে না-ফেরার পাতায়।

এই মার্চেই নিখোঁজ হয়েছিল আমার
ভাই ফারুক।
বাবা ছিলেন প্যালপিটিশনের রুগি। তিনি যুদ্ধকে ভয় পেতেন খুব।
আমার ভাইকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর তিনিও আর বসে থাকতে পারেননি।
ঘরে থাকা একটি মরচে পরা ভোঁতা দা হাতে বেরিয়ে পড়েছিলেন।
কোথায় গিয়েছিলেন
আজও তার হদিস মেলেনি।
আর মার্চেই আগুনে ভস্মীভূত করেছিল
আমাদের মাথা গোঁজার একমাত্র ঘর।

এখানেই শেষ নয়
পাশের বাড়ির সেই রকিব উদ্দিনের
যোগসাজসে ক্যাপ্টেন রিজভি
ধরে নিয়ে গিয়েছিল আমার বড় চাচাকে।
তার অপরাধ ছিল তিনি এক ঐতিহাসিক চিঠিতে এ দেশের
নির্দোষ মানুষদের আকস্মিক ও পাইকারি হারে খুন করায়
একে আখ্যায়িত করছিলেন
জেনোসাইড বলে,
তার অপরাধ ছিল তিনি বাংলাদেশের সে সময়কে
স্পষ্টত চিহ্নিত করেন-দুর্যোগময় দিন বলে
তিনি অকপটে এও বলেছিলেন, এটা আমাদের মুক্তির আন্দোলন।
শেষে প্রতিবাদ ও ঘৃণায় নিজের মুসলিম নাম
পরিবর্তন করে সমার্থে বাংলায় নিজের নাম রাখেন
দেবের দাস বা দেবদাস।
তিনি প্রকাশ্যে তাদের মুখের উপর বলেছিলেন হানাদার।
যাদেরকে তিনি তার ভাষায় ডেকেছিলেন ‘মার্ডারার’ নামে।

জল্লাদরা তাকে জিজ্ঞেস করছিল গণহত্যা কী
তিনি ক্রোধে বৈশাখি মেঘের বজ্রনিনাদ
কণ্ঠে ধরে বলেছিলেন,
এই সময়ে তোমরা যা করছ।
এ জন্য তাকে মাশুল গুনতে হয়
তারা তাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সাপমারার মতো মারতে চেয়েছিল।
কিন্তু মৃত্যুকেই শ্রেয় মেনেছিলেন, তিনি থামেননি।

হন্তারকেরা তাকে ছেড়ে দিতে চেয়েছিল
শর্ত ছিল তাদের সরকারের অধীনে পুনরায় কাজে যোগ দিতে হবে।
তিনি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন,
তোমাদের জালিম সরকারের অধীনে আমি কাজে যোগ দিতে চাই না।
তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজ বিভাগে কাজে যোগ না দিয়ে
পাকবাহিনীর বর্বরতার সাক্ষীস্বরূপ আবক্ষ মূর্তিতে
পরিণত হয়েছিলেন এ মাসে আরোপিত যুদ্ধেই।

মার্চ বললে আমার নাকে এসে লাগে পচা লাশের গন্ধ,
মার্চ বললে আমার চোখে ভেসে ওঠে হায়েনার প্রতিকৃতি
মার্চ বললে বারুদের গন্ধে আমি হই দ্রোহী, মাতাল।
ইয়াহিয়ার জঙ্গি বিমান থেকে ফেলা বোমার ধ্বংসযজ্ঞ
আমাকে ক্রোধে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য করে তোলে।
প্রতিশোধের ইচ্ছায় আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যাই।
জান্তাদের সাঁজোয়া বাহিনীর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে
এ স্বাধীনতার মাসে আমাদের চোখে ছিল
রক্তচন্দনের ন্যায় সঞ্চিত ক্রোধের উত্তাপ।
সে তাপ বারুদ হয়ে নয় মাস বাংলাদেশ জ্বলেছিল এক সাথে।
তারপর আমাদের সামনে উপস্থিত হয় ইতিহাস, ষোলোই ডিসেম্বর।

মার্চ বললে আমার মনে পড়ে যায়
অপারেশন সার্চ লাইট নামক একটি বেদনার্ত উপন্যাসের কথা।
যা লেখা হয়েছিল পরবর্তী আরও নয় মাস ধরে।

এ মাসেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা মারা পড়েছিল
অসহায় পাখির মতো।
রাস্তায়, হলের বারান্দায়, মিউনিসিপ্যালিটির ড্রেনে রক্তে রঞ্জিত
তাদের লাশ পড়েছিল গুলিবিদ্ধ কুকুরের সাথে।
তারা বুলেট ছুঁড়েছিল
রিকশাচালক, ঘুপচির পান দোকানি, সিনেমা হলের গেইট ম্যান,
নববধূ, শিক্ষক, সাধু, পাগল, কুকুর, চাষি, বেশ্যা ও ভিখারির
পেটে, করোটিতে, স্তনে, হৃৎপিণ্ডে।
তারা মেশিনগানের গুলি ছুঁড়েছিল
মানবতা ও অঙ্কুরিত একটি স্বপ্নের উদর বরাবর।
তাদের ট্যাংক ও মর্টারের গুলি থেকে কেউই রক্ষা পায়নি
বুলেটে বিদ্ধ হয়েছিল বাগানের শত শত তাজা গোলাপ
এবং দুইশ ছেষট্টিটি রাঙা প্রভাত।

এ মার্চেই শুরু হয়েছিল সর্বাত্মক এক নারকীয় হত্যাযজ্ঞ।
যুদ্ধে প্রতিরোধে যা শেষ হয়েছিল ত্রিশ লাখে।
পঁচিশে মার্চ রাতে রোকেয়া হলে দেয়া হয় আগুন
আতঙ্কিত ছাত্রীরা হল থেকে বের হতে শুরু করলে
তারা নিমিষে পরিণত হয় একদল ক্ষুধার্ত বাঘের আহারে।
তাদের উপর চালানো হয় নির্বিচারে গুলি
সম্ভ্রম ও জীবন বাঁচাতে সেরাতে অনেকেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল
হলের ভবন থেকে।
তাদের গুলিবিদ্ধ উলঙ্গ দেহই নাকি অন্ধকারকে সাক্ষী রেখে
বলেছিল, তোমাদের এ বীভৎস অত্যাচারের বিনিময়ে
আমরা কিনে নিলাম স্বাধীনতা।

আমার সামনে আজ সারি সারি গল্প।
এই দেখুন একটি যুদ্ধশিশুর গায়ে এখনও দোয়াতের কালো
কালির মতো স্বাধীনতার মাসের ছায়া।
এ শিশুরা অনেকেই পরবাসী, আলোর সামনে আসতে চায় না।

কতকিছুর বিনিময়ে
আহা! কতকিছুর বিনিময়ে যে আমরা কিনেছি মার্চকে
তার সব বৃত্তান্ত হরফে আসবে না।
ইতিহাসের উদ্ধৃত ও অনুদ্ধৃত, প্রকাশিত ও সঙ্গত কারণে অপ্রকাশিত
সকল মার্সিয়া শ্লোক বিচারেই এ মাসটা একান্ত আমাদের।
এটা আমার স্বাধীনতার মাস।

এ মাসটা মোগলের নয়
এ মাসটা মীর জাফরের নয়
এ মাসটা ইংরেজদের নয়
এ মাসটা কোনো বেনিয়ার নয়
কোনো লুণ্ঠনকারী ও মার্ডারারের নয়
এ মাসটা আমাদের।
এ মাস আমার বৃদ্ধ পিতামহ তার দুই পুত্র ও নাতির জীবন,
পুত্রবধূর সম্ভ্রম ও মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের বিনিময়ে
নগদে খরিদ করে নেন।
তারপরই বিলে-ঝিলে সব শাপলা ফোটার স্বাধীনতা পায়।

আর মার্চ নয়
আজ থেকে এ মাসের পরিচয় আমাদের স্বাধীনতার মাস।
আর মার্চ নয়
আজ থেকে এ মাসের নাম-স্বাধীনতা।

(কাব্যগ্রন্থ: দুয়ারে উদ্বাস্তু ঘাতক
ছবি কৃতজ্ঞতা: কালিদাস কর্মকার)

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.