নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

হৃদয় জুড়ে শতেক ফুটো খড়-কুটোতে ঢাকা-- জীবন যেন গত্তে পড়া গরুর গাড়ির চাকা--- তরল জলে সরল পুঁটি মনমোহিনী আঁশ--- এক ঝিলিকেই কী সুখ দিলো, সুখ যেন সন্ত্রাস!

বন্ধু তুহিন প্রাঙ্গনেমোর

আসুক শুভ্র সকাল, আসুক আবার শুদ্ধ সময়..

বন্ধু তুহিন প্রাঙ্গনেমোর › বিস্তারিত পোস্টঃ

পূর্ব পুরুষ

১৬ ই মার্চ, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:৫৫


অদ্ভুত এক গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী জন্মেছে বুকের ভেতর,
অনন্ত কালের মহাযাত্রায় হাঁটতে শুরু করেছে চৌদ্দ পুরুষ,
একের পর এক অনুভবের তরঙ্গ ভেদ করে কোথায় যেন যায়,
হারায় অথবা চলে অন্তহীন পথ ।

এই মাত্র জানি গ্রামের বাড়িতে আশি ঊর্ধ্ব ঠাকুর দা বসে আছেন,
চশমা তাঁর কোনদিন লাগেনি, খবর পড়ছেন আপন মনে;
মাঝে মাঝে কিছুটা দীর্ঘ শ্বাস অথবা এক শব্দ জয় জগৎবন্ধু;
না কখনই আমিষ খাননি, জীবনটা কেটেছে সাদা ধুতি আর চটি জুতোয়,
গ্রাম থেকে প্রায় মাইল ছয় এক দূরে থানা শহরে বেড়াতে আসতেন,
হাতে দুই প্যাকেট ওরিয়েন্টালের পয়সা বিস্কুট, গোল গোল অদ্ভুত আদুরে;
গ্রাম থেকে এটুকু পথ দেখিনি কখনো ইঞ্জিনে চড়তে , আসতেন পায়ে হেঁটে;
হঠাৎ একদিন খবর এলো ঠাকুরদা আর নেই , চলে গেছেন মহা যাত্রায়।

আমার সেই বয়সে খুব ভয় হত, ভূতের ভয়, পরীর ভয়, প্রেতাত্মার ভয়,
রাতবিরেতে এম্বুলেন্সের সাইরেন পেলেই ভয় হত এই তো মরা লাশ;
আমার থানা শহরের বাসার পাশ দিয়ে মহাশ্মশান পাহাড়ের নিচে,
প্রতিদিনই মৃত দেহ যেত ,দাহ হতে আগুনে, পুড়ে পাপ মোচনে,
আর মৃদঙ্গ, করতাল, ঘণ্টা , হারমোনিয়াম বাজিয়ে হরিবোল কীর্তন,
মাঝে মাঝে গুম গুম কান্না তার মাঝে হঠাৎ চিৎকার হরিবোল বল হরি,
আমি পালিয়ে যেতাম , চোখ বন্ধ আবার খুলে ছাদের উপরে দাঁড়িয়ে,
ভয় পেতাম ,ভীষণ ভয়, মাঝে মাঝে কেন জানি তবুও নজর পরে যায়,
তুলসী ঢাকা চোখে মহাযাত্রার পথে কোন এক পুরুষ;
আর সারা রাত ঘুমাতে পারতাম না, এপাশ ওপাশ অথবা দিদির ঘরে,
ইচ্ছে করে ঝগড়া বাধিয়ে দিতাম, আর দাদু থাকলে একদম চুপ;
আসলে ঠাকুরদাকে কেন জানি একটা বিগ পারসোনালিটি মনে হত
তাই কাছে যেতাম কিন্তু ছুঁতাম না, আবদার করতাম না, তবুও ভালবাসতাম।

বেণী মাধব নাথ আমার ঠাকুর দার শরীর যখন লাশে পরিণত হল
তখন আর সব মৃত দেহের মত নিয়ে আসা হল উঠোনে
বসিয়ে দেয়া হল , হাঁটু ভাজ করা হল , হাত রাখা হল সামনে,
এই প্রথম আমি লাশ দেখলাম, আমার পূর্ব পুরুষের লাশ
ঠিক যেন একজন ধ্যান রত ঋষি বসে আছেন সবুজ উঠোনে
আমার গলার ভেতর কেন জানি লালা জমতে লাগল, চোখ ভারি হল,
কিন্তু জল ঝরতে দিলাম না, আড়াল করি , যদি কেউ দেখে ফেলে;
পুরুষ মানুষ না ? কাঁদি কি করে?
আমার লাশের ভয় এক লাফে দূরে গেল, আমি অপলক চেয়ে থাকি ,
ঠাকুর দার চোখে তুলসী পাতা, দেখতে এত মায়াবী লাগছে;
দূর দূরান্ত থেকে কত মানুষ এলো, অনেক নামী সন্ন্যাসী গেল শেষ যাত্রায়,
এর পর স্নান করে দাদুর পায়ে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান,
আমার দেবার পালা, মা আমার হাতে দিল নিম আর কাচা হলুদ, সরিষার তেল,
ভিড়ের ভেতর সামনে বসে আমি ছোঁয়ালাম আমার হাত দাদুর কপালে,গালে, হাতে,
এই প্রথম আমি ছোঁয়া পেলাম আমার পূর্ব পুরুষের, পরম মমতায়;
দাদু চলে গেল, আমার ভেতরে মৃত মানুষের ভয় আর কোনদিন আসেনি।

বেণী মাধব নাথ চলে যাবার পর ঠাকুর মা প্রায় একা হয়ে গেলেন,
আর দশ পাঁচটা স্বামী স্ত্রী যেমন একজন চলে যাবার পর আর একজন যা হয় তাই;
অদ্ভুত ব্যাপার হল, দুইজন মানুষ এক অন্যরকম সংসার গড়েছেন
এগার জন সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, অথচ দাদু আজীবন নিরামিষ আর ঠাকুরমা আমিষ,
দাদু আপাদ মস্তক বিবাগী আর ঠাকুরমা আগাগোড়াই সংসারী।

একটু পরেই নাটক শুরু হবে নাট্যশালায়, সাউন্ড করছি রক্তকরবীর,
নাটকে প্রথম যখন রাজা ঢুকল হঠাৎ ইলেকট্রিসিটি বন্ধ, লোড শেডিং!
পাত্র পাত্রী সবাই দাঁড়ানো, আমার মোবাইল ফোন বেজে উঠল ,
ঠাকুর মা মহাকালের যাত্রায় পাড়ি দিয়েছে পাঁচ মিনিট হল,
বিদ্যুৎ এলো, শুরু হল নাটক , অসম্ভব ভালো শো, দর্শকের করতালি উৎসব স্থান
বুকের ভেতর কেন জানি চাপ চাপ আবার সেই চাপ, এক জেনারেশনের প্রস্থান।

এখন এখান থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরে আমার থানা শহর;
প্রতিদিন ঠিক সাড়ে ১০ টা থেকে সাড়ে ১১ টার মধ্যে বাবা মায়ের সাথে কথা হয়,
আমার রিটায়ার্ড পিতা তবুও ব্যস্ত একজন লেখক যেমন ব্যস্ত তেমন,
না এবার মা ফোন দিল, বাবা কাঁদছে, বাবা কাঁদছে?
জেঠামনি আজ চলে গেল মহা যাত্রায়...................................
আবার সেই পাথর চাপা কষ্ট, গলার ভেতরে লালা জমে যায়,
আড়াল করি জল, পাছে কেউ দেখে ফেলে, আমার পূর্ব পুরুষ,
পুরুষ মানুষ না ? কাঁদি কি করে?
.........................

৩চৈত্র ১৪২৬ বাংলা, বন্ধু নিবাস, হাতির ঝিল, সন্ধ্যার হওয়ায়..

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.