নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

যুক্তির আকাশে উড়ুক মুক্তির বারতা

বেপরোয়া বক্তা

আইনজীবী , সাবেক ছাত্রনেতা

বেপরোয়া বক্তা › বিস্তারিত পোস্টঃ

৭১ এ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র

১৪ ই অক্টোবর, ২০১৫ বিকাল ৪:৫৩

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানী সেনা বাহিনী ঢাকা বেতার কেন্দ্র দখল করে নিয়ে এর নাম দেয় ‘রেডিও পাকিস্তান ঢাকা’। বাঙ্গালীদের কণ্ঠরোধের জন্য কেন্দ্রটি সামরিক আইনে পরিচালিত হতে থাকে। পাকিস্তানীরা দখল করে নেবার আগে বাঙ্গালীদের পক্ষ থেকে নাজমা আকতার ঢাকা বেতার কেন্দ্রে শেষ বার্তাটি ঘোষণা করেন। ঘোষণায় বলা হয়, বাংলার সাড়ে সাত কোটি স্বাধীনতা প্রিয় জনগণ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নৃশংসতার শিকার হয়েছে। বাংলার জনগণ এই রক্তের বদলা নেবেই। আমরা এই আত্মত্যাগকে বৃথা যেতে দেবো না।

Sadhin b

একই দিন বিকেল থেকে চট্টগ্রামের উত্তরে কালুরঘাটের একটি ছোট্ট রেডিও স্টেশন থেকে বাঙ্গালীদের উপর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নৃশংস গণহত্যার খবর সম্প্রচারিত হতে থাকে। সেই সাথে সারা বিশ্বকে জানিয়ে দেয়া হয়, পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি মানুষের দেশকে শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা করছেন। স্টেশনটিকে পরিচিতি করানো হয় ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ হিসেবে।

অপারেশন সার্চলাইট নামক গণহত্যার পর হতবিহ্বল বাঙ্গালী জাতিকে উজ্জ্বীবিত করে তোলে একটি বাক্য ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি ….’। এই একটি বাক্যই পুরো জাতিকে দৃঢ় প্রত্যয়ে ও সাহসের সাথে পাকিস্তানী বাহিনীকে প্রতিহত করার দৃঢ় মনোবল তৈরি করে দেয়।

১৯৭১ সালে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানী বাহিনী ঢাকার ইপিআর ও রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাক আক্রমণ করার পরপরই এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক গ্রেপ্তার হবার আগে ২৬ মার্চের রাতের যেকোন সময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র লিখে রেখে যান। ঘোষণাপত্রটি ২৬ ও ২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে পাঠ করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার এই ঘোষণাটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও সংবাদ মাধ্যমগুলো গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করে। এরমধ্য দিয়ে সারা বিশ্ব জানতে পারে, বাংলাদেশ স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছে।

২৫ মার্চ ’৭১ এর কালোরাত্রির পরের চারদিন এই বেতার স্টেশনটি পাকিস্তান আর্মির বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা মূলক যুদ্ধে লিপ্ত হয়। কারন সেই সময় বাঙ্গালীর হাতে না ছিল কোন যুদ্ধ সরঞ্জাম, না ছিল যুদ্ধের কোন প্রশিক্ষণ। পৃথিবী বিখ্যাত একটি প্রশিক্ষিত সেনা বাহিনীর বিপক্ষে বাঙ্গালীর উপর অন্যায় ভাবে চাপিয়ে দেয়া এই অসম যুদ্ধে জনগণের হৃত মনোবল ফিরিয়ে আনা তথা বঙ্গবন্ধুর সেই উদাত্ত আহ্বান ‘যার যা আছে তাই নিয়েই শত্রুর মোকারেলা করতে হবে’কে কার্যকর করার জন্য কিছু উদ্দীপনা মূলক বার্তার প্রয়োজন ছিল। সেই কাজটিই করেছে এই বেতার কেন্দ্র্র্র্র্র্র্র্র্র্রেটি।

অপারেশন সার্চলাইট নামক গণহত্যার পর থেকেই পাকিস্তান আর্মি দাবী করছিল, বাংলাদেশের সর্বত্র শান্ত অবস্থা বিরাজ করছে তখন এই গোপন কেন্দ্রটি থেকে জানানো হতে থাকে, বাঙ্গালী স্বাধীনতাকামী বাহিনী রাজধানীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে এবং পাকিস্তানী বাহিনী আত্মসমর্পন করবে। যখন পাকিস্তানী বাহিনী দাবি করে, বাঙ্গালীদের স্বাধীনতার ইচ্ছাকে ধুলায় মিশিয়ে দেয়া হয়েছে, তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র জানায়, মুক্তিবাহিনীর গুলিতে পাকিস্তানী মিলিটারি গর্ভনর জেনারেল টিক্কা খান আহত হয়েছেন। আবার, বাঙ্গালীরা পরাজয় বরন করেছে, পাকিস্তানি বাহিনী এই দাবির বিপক্ষে এই গোপন বেতার থেকে ঘোষণা আসে বাংলাদেশের প্রাদেশিক সরকার গঠন করা হয়েছে। একই সঙ্গে জানানো হয়, বাঙ্গালী জনসাধারন হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে প্রাণপণ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের আহ্বায়ক কমিটির সচিব কামাল লোহানি বলেন, বেতারটি বিশ্বের সামনে এই বার্তা পৌঁেছ দেয় যে, পাকিস্তানী ট্যাঙ্ক ও যুদ্ধবিমান সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর কণ্ঠরোধ করতে পারবে না। গণহত্যার শিকার বাঙ্গালীর এই আত্মত্যাগ বৃথা যাবে না, বাঙ্গালী পিছু হটবে না, বাঙ্গালী প্রাণপণ যুদ্ধ করবে। রক্ত দিতে শেখা বাঙ্গালী রক্ত দিয়েই স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে আনবে। মূলত মার্চের শেষ পাচঁ দিন বাঙ্গালীর হৃত মনোবল ফিরিয়ে আনা, জনগণকে সংগঠিত করা এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য ঐক্যবদ্ধ করার জন্য এই কেন্দ্র থেকে প্রচারিত বার্তা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। একই সাথে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে দেয়ার প্রাথমিক কাজ করছিল ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’।

মূলত চট্টগ্রাম রেডিও সেন্টারের দশজন তরুনের সাহসী পদক্ষেপ ছিল এই বেতার কেন্দ্রটি। যারা চট্টগ্রামের প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। প্রথম দিকে এই সংগঠনের প্রধান ব্যক্তি ছিলেন বেলাল মাহমুদ, তিনি ছিলেন পাকিস্তান রেডিওর স্ক্রিপ্ট রাইটার ও আর্টিস্ট। অন্যরা হলেন, সৈয়দ আব্দুস সরকার, মোস্তফা আনোয়ার, আবদুল্লাহ আল ফারুকী, আবুল কাশেম সন্দীপ, আমিনুর রহমান, রাশেদুল হোসাইন, এ. এম. শরফুজ্জামান, কাজী হাবিব উদ্দিন মনি এবং রেজাউল করিম চৌধুরি।

৭১ নং কালুরঘাট রেডিও স্টেশনের ট্রান্সমিশনটির ধারন ক্ষমতা ছিল সীমিত পর্যায়ের। মাত্র ১০ কিলোওয়াটের একটি ট্রান্সমিশন ছিল এখানে। তাই স্টেশন থেকে প্রেরিত বার্তা প্রথমে বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত একটি জাপানিজ জাহাজ গ্রহণ করত, এরপর রেডিও অস্ট্রেলিয়া থেকে পুনঃপ্রেরিত হয়ে সর্বশেষে প্রেরণ হতো বিবিসি থেকে।

বেতার কেন্দ্রটি কাজ শুরু করার পাচঁ দিন পর ৩০ মার্চ পাকিস্তান বিমান বাহিনী স্টেশনে গোলা বর্ষণ করলে এই দশজন তরুন কর্মী ও প্রকৌশলীরা দুই দলে বিভক্ত হয়ে দুর্গম বন পাড়ি দিয়ে ইন্ডিয়ার সীমান্ত শহর ত্রিপুরার বাগপাতে চলে যান। সাথে করে তারা শুধু এক কিলোওয়াটের একটি ট্রান্সমিটার নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ)-এর সহায়তায় ৩ এপ্রিল প্রথমে ত্রিপুরার বাগপা থেকে এই বেতারের দ্বিতীয় পর্যায়ের কার্যক্রম শুরু হয়। প্রকৌশলী সৈয়দ আব্দুস সরকার কালুরঘাট থেকে বয়ে নিয়ে আসা ক্ষতিগ্রস্ত ট্রান্সমিটারটি মেরামত করে কাজের উপযুক্ত করে তোলেন। এই একটি মাত্র সর্ট ওয়েভ ট্রান্সমিটার দিয়েই কেন্দ্রটির কার্যক্রম চলত বলে এর সম্প্রচার ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল ছিল। এরপর কেন্দ্রটি আগরতলার শালবাগান ও বাগাফা-বেলোনিয়া ফরেস্ট হিল রোড স্থানান্তরিত হয়। তখন এখান থেকে শুধু সকাল সাড়ে আট’টা থেকে নয়’টা এবং বিকেল পাঁচ’টা থেকে সাত’টা পর্যন্ত অনুষ্ঠান চলত। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই বেতারটি ছিল বাংলার মুক্তিকামী মানুষকে সংগঠিত করার একমাত্র কণ্ঠস্বর; যা বাংলার মানুষকে আশান্বিত করেছে, শক্তি ও সাহস যুগিয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে।

১৭ এপ্রিল ১৯৭১ কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আ¤্রকাননে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার শপথ বাক্য পাঠ করেন। এরপরই এই সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ নেয় একটি শক্তিশালী সম্প্রচার কেন্দ্র স্থাপনের। ইন্ডিয়ান সরকারের সহায়তায় কোলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে ৫০ কিলোওয়াট মিডিয়াম ওয়েভ ক্ষমতা সম্পন্ন একটি বেতার কেন্দ্র স্থাপনের কাজ শুরু হয়। স্বল্প অভিজ্ঞতা এবং সরঞ্জাম নিয়ে মুজিবনগর সরকারের ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’টি যাত্রা শুরু করে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকীর দিন ২৫ মে ১৯৭১, ১১ জৈষ্ঠ্য তারিখে। ২৬ মে কেন্দ্রটির নামকরণ করা হয় ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’।

কামাল লোহানি বলেন, আমরা ভারত সরকার থেকে শুধু ৫০ কিলোওয়াট মিডিয়াম ওয়েভ ক্ষমতা সম্পন্ন একটি ট্রান্সমিটার ও বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িটা নিয়েছিলাম। বিএসএফ’এর একজন জোয়ান প্রতিদিন তিন বেলা করে এসে অনুষ্ঠান রেকর্ডের স্কুপ ব্যাগে ভরে জীপে করে নিয়ে ৪০/৪৫ মিনিটের পথ সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত ট্রান্সমিটারে বয়ে নিয়ে যেতেন সম্প্রচারের জন্য।

এছাড়া আর কোন সাহায্য আমরা ইন্ডিয়ার সরকারের কাছ থেকে নেইনি, যদিও আমাদের তখন সাজ সরঞ্জাম, অর্থকড়ি কিছুই ছিল না। আমরা ঐ বাড়িতেই রাতে থাকতাম, ঘুমাতাম, দিনে কাজ করতাম। কোন বিছানাপত্র ছিল না। খাওয়া দাওয়ার ঠিক ছিল না। বসে সংবাদ পাঠের কোন ব্যবস্থা ছিল না। স্টুডিওতে সাউন্ডপ্রুফ বা কোন এয়ার কন্ডিশনের ব্যবস্থা ছিল না। আমরা সাধারন একটি ঘরের দরজা, জানালা ও ফ্যান বন্ধ করে কাজ করতাম। কাজ করতে করতে ঘেমে গেলে বাইরে গিয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার কাজ করতাম। এমনকি তখন গানের জন্য হারমোনিয়াম ছাড়া আর কোন বাদ্যযন্ত্রও ছিল না। তবলার কাজ সারতাম টেবিল ঠুকে ঠুকে। এই অবস্থা থেকে আমরা বেতার কেন্দ্রটিকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ কেন্দ্রে রূপ দিতে পেরেছিলাম আমাদের প্রবাসী সরকার ও প্রবাসী বাঙ্গালীদের আর্থিক সহায়তায়।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের চার্জে ছিলেন ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলীর টাঙ্গাইলের সদস্য জনাব আবদুল মান্নান। স্বল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রায় তিনশ’ দক্ষ টেকনিশিয়ান ও শিল্পী কলাকুশলী এসে জড়ো হন এই কেন্দ্রে। ক্রমে এখানে প্রথম দশজন কর্মীর সাথে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আমলা, কবি, সাহিত্যিক, লেখক, সাংবাদিক প্রত্যেকে একই ব্যানারে নিজের সর্বস্বটুকু দিয়ে কাজ শুরু করেন দেশের জন্য। আগস্ট ’৭১, এই কেন্দ্রে কর্মরত বিভিন্ন কলাকুশলীকে নিয়োগপত্র দেয়া হয়, যা কার্যকর হয় জুলাই ’৭১ থেকে।

৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, এই দিন ইন্ডিয়া সরকার একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে এবং তার প্রবাসী সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান করেন। একই দিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নাম ‘বাংলাদেশ বেতার’ করা হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হয় ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। প্রবাসী সরকার ২২ ডিসেম্বর দেশে ফিরে আসে। সেই দিনই ‘বাংলাদেশ বেতার’ স্বাধীন দেশে সম্প্রচার কার্যপরিচালনা শুরু করে।

পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে এদেশের ছাত্র, শিক্ষক থেকে শুরু করে অতিসাধারন খেটে খাওয়া মানুষেরা অস্ত্র ধরেছিল; তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ময়দানে সাহসের সাথে নিরবিচ্ছিন্নভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য এই বেতার থেকে সম্প্রচারিত গণজারনের গান, দেশাত্মবোধক গানগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবলকে অটুট রাখত। স্বাধীনতা যুদ্ধের নয়টি মাস এই বেতার পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছে সফলতার সাথে।

তিনটি অধিবেশনে এই বেতারের অনুষ্ঠান প্রচারিত হতো। এরমধ্যে রাতের অধিবেশনই প্রধান আকর্ষণ ছিল। ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ গানটি উদ্বোধনী সঙ্গীত হিসেবে প্রচারিত হতো। তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল এম.আর. আকতার মুকুল লিখিত ও পঠিত চরমপত্র। তিনি পুরান ঢাকার স্থানীয় অধিবাসীদের ভাষায় যুদ্ধক্ষেত্রে পাক আর্মিদের বেগতিক অবস্থাকে কৌতুকের মধ্য দিয়ে বর্ণনা করতেন। এখানে ঢাকার গেরিলা বাহিনীকে ‘বিচ্ছু’ নামে অভিহিত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের একটি পর্যায়ে গিয়ে এই বিচ্ছু বাহিনীর নাম শুনলেই পাকিস্তানী আর্মি ও রাজাকারা ভয়ে কাপঁত। চরমপত্রে রসাত্মক ভাবে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধকে বর্ণনা করা হলেও সেগুলো আমাদের জাতীয়তাবোধের শক্তিকে উজ্জ্বীবিত করেছে দারুন ভাবে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মানসিক দৃঢ়তাকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করেছে। চরমপত্রের পরিকল্পনায় ছিলেন ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলীর সদস্য আবদুল মান্নান।

আরেকটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল, কল্যাণ মিত্র লিখিত ‘জল্লাদের দরবার’। বাঙ্গালীদের উপর ইয়াহিয়া খানের অমানবিক আচরণ ও পশুসুলভ কর্মকা-কে হাস্যরসাত্মক করে তুলে ধরা হতো। এখানে ইয়াহিয়া খানের নাম দেয়া হয়েছিল ‘কেলা ফতেহ খান’; যার প্রধান চরিত্রে রাজু আহমেদ অভিনয় করতেন।

‘বজ্রকণ্ঠ’তে শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ ই মার্চের ভাষণ প্রচার করা হতো। পবিত্র কোরআন থেকে তিলাওয়াত হতো। দেশাত্মবোধক গান, কবিতা, নাটক ও পুথিঁ পাঠ হতো। পুথিঁ পাঠ করতেন মোহাম্মদ শাহ বাঙ্গালী। সংবাদ প্রচার করা হতো বাংলা, ইংলিশ ও উর্দূ ভাষায়।

এই বেতার কেন্দ্রের কলাকুশলীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন, সংবাদ বিভাগের প্রধান হিসেবে কামাল লোহানি। ইংরেজীতে সংবাদ পাঠ করতেন রোকেয়া হায়দার; বাংলায় বাবুল আকতার। এছাড়া নাসিমুল কাদের চৌধুরীও সংবাদ পাঠ করতেন। রাতের অধিবেশনে প্রণবেশ সেন লিখিত ও দেবদুলাল বন্দোপাদধ্যায় পঠিত সংবাদ পরিক্রমা মুক্তিসেনা ও অবরুদ্ধ বাঙ্গালীদের মনে সাহসের খোরাক যুগিয়েছে। সঙ্গীত পরিচালক ও গীতিকার ছিলেন অজিত রায়; সঙ্গীত পরিচালক ও গায়ক ছিলেন শুয্যেও শ্যাম; গায়ক ছিলেন আপেল মাহমুদ, আবদুল জাব্বার, মালা খান, রূপা খান, সুরকার জাহাঙ্গীর হায়াত, শাহীন সামাদ, বিপুল ভট্টাচার্য সহ আরো অনেকে।

এছাড়া এই কেন্দ্রের তরুনদের একটি দল উদ্দীপনা মূলক গান গেয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জ্বীবিত করত। এই বেতার থেকে প্রচারিত অন্যান্য জনপ্রিয় গানের মধ্যে ছিল, ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, একটি ফুলকে বাচাঁবো বলে, সালাম সালাম হাজার সালাম ইত্যাদি। এই তরুনের দলটি পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে যুদ্ধে সাহায্যের জন্য তহবিল সংগ্রহ করত।

কামাল লোহানি বলেন, এই বেতার কেন্দ্রটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নয় মাস পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ পরিচালনা করে আমাদের জনগণের মনোবলকে দৃঢ় রেখেছে।

তিনি বলেন, যখন একটি দেশের কোটি মানুষ স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে লড়াঙ্গণে, অবরুদ্ধ হয়ে আছে দেশের ভেতরে অথবা শরণার্থী হয়ে ইন্ডিয়ার সীমান্ত শহরে দুর্বিসহ দিন কাটাচ্ছে তেমনি অবস্থায় আমাদের দেশেরই কিছু লোক, আমার মতে, যারা ঠিক মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ধুদ্ধ হয়ে এই কেন্দ্রে আসেনি বরং স্বাধীনতার পর কিছু সুবিধা পাওয়া যাবে এই বোধ থেকে এসেছিলেন, তারা মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে এসে বেতনের হার ও পদমর্যাদা নির্ধারণ নিয়ে স্মারকলিপি দেয়। প্রবাসী সরকার সকল দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাস দেয়ার পরও তারা তিনদিন ধর্মঘট করে। এই কয়দিন আমরা শুধু কোরআন থেকে তিলাওয়াত, বজ্রকণ্ঠ ও সংবাদ পাঠ প্রচার করতে পেরেছিলাম। এমনকি এসময়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় দুইটি অনুষ্ঠান চরমপত্র ও জল্লাদের দরবারও প্রচার করতে পারিনি।

এরপর প্রবাসী সরকারের স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পূণর্বাসন মন্ত্রী কামরুজ্জামান ও প্রতিরক্ষা সচিব এম. এ. সামাদ আমাদের কেন্দ্রে এসে ধর্মঘট করা কলাকুশলীদের সাথে কথা বলে বেতন কাঠামো নির্ধারণ করে দেন সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা ও সর্বনিু ২০০ টাকা। এরপরই তারা ধর্মঘট তুলে নিয়ে স্বাভাবিক কাজে ফিরে আসেন। আমার জানা মতে, পৃথিবীর কোন মুক্তিকামী বেতার কেন্দ্রেই এই ধরনের ঘটনা ঘটেনি। আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসে এর তাৎপর্য অনেক তাই অনেক।

কামাল লোহানি জানান, বর্তমানে একটি মহল বিশেষ বলছে, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চলেছে আকাশবাণী কোলকাতার তৎকালীন অভিজ্ঞ কলাকুশলীদের দিয়ে। এই কলাকুশলীরা পরে ছিল না বলে বাংলাদেশ বেতার পরে আর ভালো ভাবে পরিচালিত হতে পারেনি। কামাল লোহানি বলেন, যারা এই ধরনের লেখা লিখছেন তাদের হয় আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কে কোন ধারনা নেই অথবা তারা বিশেষ কোন স্বার্থসিদ্ধি করতে চাইছে।

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, স্বাধীনতার পর ৪০ বছরেও এতো গুলো সরকারের কেউই মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অবদানকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেয়নি। এমনকি এই কেন্দ্রের কোন কলাকুশলীকেই যথাযথ সম্মাননা দেয়া হয়নি। তাদের মধ্যে অনেকেই এখন বার্ধ্যকের দাড়ঁপ্রান্তে, অনেকে অসুস্থ; অথচ তাঁদেরকে বাংলাদেশ সরকার কোন আর্থিক সাহায্য দেননি।-

কৃতজ্ঞতা : রুবানা শারমিন

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৪ ই অক্টোবর, ২০১৫ বিকাল ৫:০৭

চাঁদগাজী বলেছেন:

ভালো

২| ১৪ ই অক্টোবর, ২০১৫ বিকাল ৫:২৮

বেপরোয়া বক্তা বলেছেন: ধন্যবাদ

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.