নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

যুক্তির আকাশে উড়ুক মুক্তির বারতা

বেপরোয়া বক্তা

আইনজীবী , সাবেক ছাত্রনেতা

বেপরোয়া বক্তা › বিস্তারিত পোস্টঃ

কলঙ্কিত ৩ রা নভেম্বর : মোহনলালদের নিশ্চিহ্ন করার এক প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের এপিটাফ

০৩ রা নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৫:২৬

আজ ৩রা নভেম্বর।কলঙ্কময় জেল হত্যা দিবস ।১৯৭৫ সালের এইদিনে ভোর রাতে ঢাকা কেন্দ্রীয়
কারাগারে নিরাপদ হেফাজতে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী বাংলাদেশের প্রথম অস্হায়ী রাস্ট্রপ্রতি সৈ্য়দ নজরুল ইসলাম , প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রী সভার সদস্য ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এই এইচ এম কামরুজ্জামান। পৃথিবীর ইতিহাসে সৃষ্টির আদি থেকে মধ্যযুগ পেরিয়ে আধুনিককাল পর্যন্ত সময়ে এশিয়া থেকে আফ্রিকা , উত্তর হতে দক্ষিণ মেরু , আটলান্টিক থেকে আরব সাগর চষে ফেললেও রাস্ট্রীয় নিরাপত্তার আচ্ছাদনে ঢাকা কোনো দেশের জেলখানাতে বাইরে থেকে সামরিক বাহিনীর লোকজন ঢুকে এভাবে ব্রাশফায়ারে মানুষ খুনের নজির আর দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয়না।

"সব সম্ভবের বাংলাদেশ " এ কিন্তু সেই অবিশ্বাস্য নজিরই সেদিন স্থাপিত হয়েছিলো।


আমি আমার লেখাটির শিরোনামে এই দিনটিকে আখ্যায়িত করেছি "মোহনলালদের বিদায়ের দিন" হিসেবে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বিজয় লাভের পরে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর মসনদকে পাকাপোক্ত করতে তাদের আজ্ঞাবহ মীরজাফর গং হত্যা করেছিলো নবাবের বিশ্বস্ত সেনাপতি মোহনলাল , আলেয়া , গোলাম হোসেনদেরকেও। কারণ তারা আশংকা করেছিলো যে , এরা জীবিত থাকলে তাদের নিজেদের সাধের মসনদ হয়তো বিপন্ন হতে পারে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকরা বর্বরোচিতভাবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যা করে। এর কিছুদিন পরই বঙ্গবন্ধুর আজীবন রাজনৈতিক সহচর, বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে যারা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেই জাতীয় চার নেতাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতর গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে ঘতকরা।বাকি ৩ জনের নেতার মৃত্যু নিশ্চিত হলেও, আরও ঘণ্টাখানেক বেঁচে ছিলেন তাজউদ্দিন আহমেদ। ‘পানি, পানি’ বলে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অার্তনাদ করেছিলেন মুক্তিসংগ্রামের এই অকুতোভয় সিপাহশালার্। কিন্তু ঘাতকেরা তাদের হত্যাযজ্ঞ শেষে চলে যাবার আগে সেলটির তালাবদ্ধ করে চলে যাওয়ায় শেষ পানিটুকু এগিয়ে দেয়া কারো পক্ষে সম্ভবপর হয়নি।

মীরজাফর গংদের মতোই খন্দকার মোশতাক , ফারুক , রশীদ , ডালিম গংদের ও একই আশংকা ছিলো বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত বিশ্বস্ত এই সহচরদের ঘিরে। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ৬৯ এর গণআন্দোলনকে গণঅভ্যুত্থানে রূপান্তরিত করার পেছনের কুশীলব ছিলেন এরাই। মুক্তিযুদ্ধকালে মুজিবনগর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে থেকে জাতীয় চার নেতা ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। ওই সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাজউদ্দিন আহমেদ, অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, খাদ্য ও ত্রাণ মন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান।শুধু মুক্তিযুদ্ধ নয়, সকল আন্দোলন-সংগ্রামে এই চার নেতা বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট সহযোদ্ধা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকেছেন। বিভিন্ন সময় বঙ্গবন্ধুকে যখন কারাগারে বন্দি রাখা হয়েছে তখন আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দিয়ে এই চার নেতা আন্দলন-সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়েছেন।

তাই ঘাতকদের মনে আশংকা জন্মেছিলো যে , বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেও তাঁর এই বিশ্বস্ত সহচররা যদি জীবিত থাকেন , তাহলে আর শেষরক্ষা হবেনা তাদের্। এতদিনের সযত্নে গড়া নীলনকশার ষড়যন্ত্র মাটিতে মিশিয়ে দেয়ার জন্য এদের যেকোন একজনই ছিলেন যথেষ্ঠ। আর তাই এই মোহনলালদের ও সরিয়ে দিতে হবে পৃথিবী থেকে। সেই সিদ্ধান্ত থেকেই সংগঠিত হয় এই নির্মম হত্যাকাণ্ড।

এদেশের ষড়যন্ত্রের রাজনীতির ইতিহাস নিয়ে ধারাবাহিক অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশিত হচ্ছে প্রথিতযশা সাংবাদিক মুক্তিযোদ্ধা আবেদ খানের কলামে। ৩ রা নভেম্বর হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে তিনি লিখেছেন ,

"বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মোশতাক-জিয়া চক্র খুব একটা স্বস্তিতে ছিল না। তারা সব সময় একটা পাল্টা অভ্যুত্থানের আশঙ্কায় ছিল। কেননা ঢাকা তখন এক অস্থির নগরী। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে অস্থিতিশীলতার অন্ত ছিল না, প্রতিনিয়ত পাল্টে যাচ্ছিল দৃশ্যপট, একের পর এক চলছিল অভ্যুত্থান এবং পাল্টা অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি। আর এই পাল্টা আঘাত এলে তা কীভাবে প্রতিহত করা হবে, এ নিয়ে খুনিচক্র ছিল ভীষণ উদ্বিগ্ন। অন্যদিকে পাল্টা অভ্যুত্থানের পাশাপাশি খন্দকার মোশতাকের প্রধান অস্বস্তি ছিল আওয়ামী লীগের মধ্যে বিদ্রোহের আশঙ্কা। যদিও আওয়ামী লীগের নেতারা তখন দিশেহারা। চার জাতীয় নেতাসহ প্রায় ৭৫ জন এমপি-মন্ত্রী কারাগারে। এর বাইরে অনেকে আত্মগোপনে, কেউ কেউ রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয়। কয়েকজনকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে মোশতাক মন্ত্রিপরিষদে যোগ দিতে বাধ্য করেছেন বটে, কিন্তু এ সত্ত্বেও খন্দকার মোশতাকের মধ্যে আওয়ামী লীগ-ভীতি ক্রমান্বয়ে তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে


আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে আরো দুর্বল করতে মোশতাক জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। এর পাশাপাশি ফারুক ও রশিদ সিদ্ধান্ত নেয়, পাল্টা অভ্যুত্থানে যদি মোশতাককে হত্যা করা হয়, তাহলে দুটি বিষয় অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে করতে হবে। প্রথমে প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে সঙ্গে সঙ্গে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ করতে হবে, যাতে রাষ্ট্র পরিচালনায় কোনো শূন্যতার সৃষ্টি না হয়। একই সঙ্গে মোশতাকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ওই সময় কেন্দ্রীয় কারাগারে একটি ঘাতক দল পাঠিয়ে জাতীয় চার নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে হত্যা করতে হবে। এ জন্য তারা ৫ জনের একটি ঘাতক দল গঠন করে। ঠান্ডা মাথায় খুনের ব্যাপারে এ ঘাতক দলের সদস্যরা ছিল বিশেষভাবে পারদর্শী। এই দলের দায়িত্ব দেয়া হয় রিসালদার মুসলেহ উদ্দিনকে। ‌বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের কিছুদিন পর তাকে অনারারি লেফটেন্যান্ট পদে উন্নীত করা হয়। ১৫ আগস্ট শেখ মনির বাসায় হত্যাযজ্ঞে নেতৃত্ব দিয়েছিল এই মুসলেহ উদ্দিন। মোশতাক-জিয়া চক্র অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় চার নেতা হত্যার ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করে। আওয়ামী লীগ যাতে পুনরায় ক্ষমতায় আসতে না পারে, মূলত সে জন্যই জেলে বন্দী চার নেতাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এভাবেই খুনি চক্র তাদের সকল সম্ভাব্য প্রতিপক্ষকে সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করে।"


সেদিনের হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে একটি এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট করেছিলো বিবিসি বাংলা। নীচে তা হুবুহু তুলে ধরছি।

"১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর মধ্যরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে একটি পিকআপ এসে থামে।তখন রাত আনুমানিক দেড়টা থেকে দুইটা।প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় সে গাড়িতে কয়েকজন সেনা সদস্য ছিল।ঢাকা তখন এখন অস্থিরতার নগরী। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে অভ্যুত্থান এবং পাল্টা অভ্যুত্থান নিয়ে নানা রকম কথা শোনা যাচ্ছে তখন।সে সময় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জেলার হিসেবে কর্মরত ছিলেন আমিনুর রহমান।রাত দেড়টার দিকে কারা মহাপরিদর্শক টেলিফোন করে জেলার মি:রহমানকে তাৎক্ষনিকভাবে আসতে বলেন।

দ্রুত কারাগারের মূল ফটকে গিয়ে মি: রহমান দেখলেন, একটি পিকআপে কয়েকজন সেনা সদস্য সশস্ত্র অবস্থায় আছে।মূল ফটকের সামনে সেনা সদস্যরা কারা মহাপরিদর্শককে একটি কাগজ দিলেন।সেখানে কী লেখা ছিল সেটি অবশ্য জানতে পারেননি মি: রহমান।মূল ফটক দিয়ে ঢুকে বাম দিকেই ছিল জেলার আমিনুর রহমানের কক্ষ। তখন সেখানকার টেলিফোনটি বেজে উঠে।মি: রহমান যখন টেলিফোনের রিসিভারটি তুললেন, তখন অপর প্রান্ত থেকে বলা হলো, প্রেসিডেন্ট কথা বলবেন।"

২০১০ সালে বিবিসি বাংলার কাছে সে ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে মি: রহমান বলেন,

"টেলিফোনে বলা হলো প্রেসিডেন্ট কথা বলবে আইজি সাহেবের সাথে। তখন আমি দৌড়ে গিয়ে আইজি সাহেবকে খবর দিলাম। কথা শেষে আইজি সাহেব বললেন যে প্রেসিডেন্ট সাহেব ফোনে বলছে আর্মি অফিসাররা যা চায়, সেটা তোমরা কর।"

মূল ফটকের সামনে কথাবার্তার চলতে থাকে। এক সময় রাত তিনটা বেজে যায়।আমিনুর রহমান বলেন,

"এক পর্যায়ে তৎকালীন আওয়ামী লীগের চার নেতাকে একত্রিত করার আদেশ আসে।কারা মহাপরিদর্শক একটি কাগজে চার ব্যক্তির নাম লিখে জেলার আমিনুর রহমানকে দিলেন।সে চারজন হলেন - সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামান।"


আমিনুর রহমানের বর্ণনা অনুযায়ী সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং তাজউদ্দীন আহমদ কারাগারের একটি কক্ষে ছিলেন।ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামানকে অপর কক্ষ থেকে এখানে নিয়ে আসা হয়।সেখানে আসার আগে ক্যাপ্টেন মনসুর আলী কাপড় পাল্টে নিলেন।

মি: রহমানের বর্ণনা করেন,

"তাজউদ্দীন সাহেব তখন কোরআন শরীফ পড়ছিলেন। ওনারা কেউ আমাদের জিজ্ঞেস করলেন না আমাদের কোথায় নেও ( নেয়া হচ্ছে)? সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব হাত-মুখ ধুলেন। আমি বললাম আর্মি আসছে।"


চারজনকে যখন একটি কক্ষে একত্রিত করার ক্ষেত্রে কিছুটা সময় লাগার কারণে সেনাসদস্যরা কারা কর্মকর্তাদের নোংরা ভাষায় গালিগালাজ করছিল, বলছিলেন মি: রহমান।

"মনসুর আলি সাহেব বসা ছিল সর্ব দক্ষিণে। যতদূর আমার মনে পড়ে। আমি মনসুর আলীর 'ম' কথাটা উচ্চারণ করতে পারি নাই, সঙ্গে সঙ্গে গুলি," বলেন মি: রহমান।

কারাগারের ভেতর এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের খবর চার নেতার পরিবার সেদিন জানতে পারেননি।
তাজউদ্দীন আহমদের পরিবার কারাগারের খোঁজ নেবার জন্য সারাদিন চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন।

পরের দিন অর্থাৎ ৪ নভেম্বর পুরনো ঢাকার এক বাসিন্দা তাজউদ্দীন আহমদের বাসায় এসে জানান যে তিনি আগের দিন ভোরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গুলির শব্দ শুনেছেন।

মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় সিপাহশালার শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা সিমিন হোসেন রিমি ২০১০ সালে বিবিসি বাংলাকে বলেন,

"৪ নভেম্বর বিকেল চারটার দিকে খবর আসতে শুরু করলো তাজউদ্দীন আহমদসহ চারজন নেতাকে হত্যা করা হয়েছে।১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমানকে প্রায় সপরিবারে হত্যার ঘটনার সাথে জেল হত্যাকাণ্ডের যোগসূত্র আছে বলে মনে করা হয়।তখন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে লে. কর্নেল হিসেবে কর্মরত ছিলেন আমিন আহমেদ চৌধুরী, যিনি পরবর্তীতে মেজর জেনারেল হয়েছিলেন। কয়েক বছর আগে ইন্তেকাল করেন মি: চৌধুরী।


২০১০ সালে তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন,

"তখন সেনাবাহিনীতে নেতৃত্ব নিয়ে টানাপোড়েনের পরিণতি ছিল জেলখানার হত্যাকাণ্ড।১৫ই আগস্টের অভ্যুত্থানের বিপরীতে পাল্টা আরেকটি অভ্যুত্থান হয়েছিল ৩ নভেম্বর।সেটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফ।আমিন আহমেদ চৌধুরীর মতে, ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানটি ছিল অনিবার্য।কারণ শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছয়জন জুনিয়র সেনা কর্মকর্তা তখন বঙ্গভবনে বসে রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাককে পরিচালনা করছিলেন।শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছয়জন জুনিয়র সামরিক কর্মকর্তাকে সেনাবাহিনীর চেইন অব কম্যান্ড-এর আওতায় আনার জন্য ৩ নভেম্বর খালেদ মোশারফের নেতৃত্ব অভ্যুত্থান হয়েছিল" বলে উল্লেখ করেন জেনারেল চৌধুরী।

তাছাড়া শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডকেও তাঁরা মেনে নিতে পারছিলেন না বলে তিনি উল্লেখ করেন।কিন্তু খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে সে অভ্যুত্থান সেনাবাহিনীর ভেতরে আবারো চেইন অব কমান্ড ভাঙার সম্ভাবনা তৈরি করেছিল বলে মনে করেন জেনারেল চৌধুরী।খালেদ মোশারফের অনুগত সৈন্যরা বন্দি করে সেনা প্রধান জিয়াউর রহমানকে।

ঢাকা সেনানিবাসে যখন এ অবস্থা চলছিল সে সময় পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে জেলখানায় আওয়ামী লীগের চারজন সিনিয়র নেতাকে হত্যা করা হয়।পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টিতে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর থেকেই হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তারা পাল্টা আরেকটি অভ্যুত্থানের আশংকায় ছিল।

সেনাবাহিনীর মধ্যে ছিল এক ধরনের বিশৃঙ্খলা। সিনিয়র সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিল ক্ষমতার দ্বন্দ্ব।একদিকে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং অন্যদিকে মেজর জেনারেল খালেদ মোশারফ।তখন ঢাকা সেনানিবাসে মেজর পদমর্যাদায় কর্মরত ছিলেন বর্তমানে বিগ্রেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন (সাবেক নির্বাচন কমিশনার )

তিনি এসব ঘটনা প্রবাহ বেশ কাছ থেকে দেখেছেন। তার সে অভিজ্ঞতা নিয়ে ব্রিগেডিয়ার হোসেন একটি বই লিখেছেন 'বাংলাদেশ রক্তাক্ত অধ্যায়: ১৯৭৫-৮১' শিরোনামে।শেখ মুজিবকে হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তারা তখন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদকে পরিচালনা করছিলেন।মি: হোসেন বলেন ,

"বঙ্গভবনের থাকা সেনা কর্মকর্তাদের সাথে একটা সংঘাত চলছিল সেনানিবাসের উর্ধ্বতন কিছু সেনা কর্মকর্তাদের সাথে। খন্দকার মোশতাক যে বেশিদিন ওখানে টিকবেন না, এটাও ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে সিনিয়র অফিসারদের মধ্যে একটা ধারণা জন্মেছিল। তখন আবার সিনিয়র অফিসারদের মধ্যেও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ছিল,"


শেখ মুজিবকে হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তারা ধারনা করেছিলেন যে কোন পাল্টা অভ্যুত্থান হলে সেটি আওয়ামী লীগের সমর্থন পাবে। সে ধরনের পরিস্থিতি হলে কী করতে হবে সে বিষয়ে মুজিব হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তারা কিছুটা ভেবেও রেখেছিলেন।

মি: হোসেন বলেন,

"ঐ ধরনের ক্যু হলে তখনকার আওয়ামী লীগে যাতে কোন ধরনের লিডারশিপ না থাকে সেটাই তারা বোধ হয় নিশ্চিত করেছিল।"

হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তারা ভেবেছিল যদি সে চারজন রাজনীতিবিদকে যদি হত্যা করা হয় তাহলে পাল্টা অভ্যুত্থান হলেও সেটি রাজনৈতিক সমর্থন পাবেনা।

কিন্তু ৩রা নভেম্বর জেনারেল খালেদ মোশাররফ ও কর্ণেল শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে সংগঠিত পাল্টা অভ্যুত্থানে মাত্র ৮২ দিনের মাথায় ক্ষমতাচ্যুত হয় খন্দকার মোশতাক এর খুনী সরকার্। কিন্তু মাত্র ৮২ দিনের মধ্যেই খুনীচক্রের যাতে ভবিষ্যতেও আর কখনো বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো সম্ভব না হয় , সেই উদ্দেশ্যেই মোশতাক সরকার পাশ করেন কুখ্যাত "ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ ", যাতে খুনীদের দায়মুক্তি দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছিলো যে ,

"জেলে জাতীয় চার নেতাকে খুন এবং ১৫ আগস্টের খুনীদের বিচার করা যাবেনা। "

১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তিনি এই অধ্যাদেশ জারি করেন। আর জেলে নির্মম হত্যাকান্ড ঘটান ৩ নভেম্বর ভোর রাতে। নিজের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক বন্ধুদের খন্দকার মোশতাক বিবেচনা করতেন ৭৫ এর মোহনলাল হিসেবেই। জানতেন যে এদের মেরুদণ্ড তাঁর নিজের মেরুদন্ডের মতো দূর্বল নয়। লোভে ঘেরা মেরুদন্ডের দূর্বলতার কারণে তিনি খুনীদের তোষামদী করলেও , এনারা তা করবেননা কখনোই। আর তাই মোহনলালদের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করে দেয়াই সেদিনের খন্দকার মোশতাক নামের সেদিনের মীরজাফরের মূখ্য উদ্দেশ্যে। আর সেই উদ্দেশ্যেই এই বিরল নির্মমতার কলঙ্কিত ইতিহাস রচনা করে তারা। যে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল না করতে অপেক্ষা করতে হয়েছিলো দুই যুগেরও বেশী। কেননা এরপরবর্তী আসা জিয়া , এরশাদ , খালেদা সরকার এই অধ্যাদেশটি বজায় রেখে সমানেই খুনীদের পৃষ্ঠপোষকতার ধারা অব্যাহত রেখেছিলো।

আজকের এইদিনে সেদিনের মোহনলালদের পূণ্য স্মৃতি ও আত্মবলিদানের ইতিহাসকে করছি বিনম্র
শ্রদ্ধাভরে। ইতিহাস তাঁদের অবদান কোনোদিনই মুছে যেতে দেবেনা।

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ০৩ রা নভেম্বর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:১০

রাজীব নুর বলেছেন: মোস্তাক আর জিয়া এই দুইজন জীবিত থাকলে সব ঘটনা পরিস্কার হতো।

২| ০৩ রা নভেম্বর, ২০১৯ রাত ৯:১৮

জগতারন বলেছেন:
ওহ !
কী নির্মম !!
কী জঘন্য ষঢ়যন্ত্র !!!

মনাফেক জিয়া, মোশতাক, ফারুক, ডালিম, নূর, রশীদ গং বিলী হইয়াছে বাংলাদেশের আকাশ থেকে।
মোনাফেক কাজ, ষড়যন্ত্র, ব্যাক্তিস্বার্থ দিয়া রাজনীতি করা যায় না।
-- অন্তত ইতিহাস ও প্রকৃতির অভিশাব তাই স্বাক্ষী দেয়।

এই পোষ্টটিতে দূর্লব ছবিগুলি সুন্দর ও ঝকঝকে পরিস্কার।
পোষ্টটি লাইক দিলাম সংগ্র করিয়া রাখিলাম।

৩| ০৩ রা নভেম্বর, ২০১৯ রাত ৯:১৯

জগতারন বলেছেন:
টাইপো;
বিলী = বিলীন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.