নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নিষ্পত্তি কি সব সময়ে জয়-পরাজয়ে? ময়দানি ধুলোয় তার বাইরেই যে পড়ে থাকে খেলার আসল-নকল গল্পগুলো৷ ময়দানের ঘাস-ধুলো যাঁর প্রিয়তম বন্ধু, তাঁর কলমে অভিজ্ঞতার দস্তাবেজ৷

ফেলুদার তোপসে

দিনরাত সাদা-কালো জীবনের মধ্যে এক্কাদোক্কা খেলতে খেলতে হারিয়ে যাই অচেনা দুপুরের কোলে। বাকি থেকে যায় কিছু মরচে পড়া নিঃশ্বাস, কয়েকটা পোড়া স্বপ্ন আর কিছু ব্যক্তিগত উন্নাসিকতা। রাত আসে, শহর ঘুমিয়ে পড়ে... আর মন পড়ে থাকে কোনও একলা ছাদের অন্ধকারে। এভাবেই চলছে জীবন... এভাবেই মাঝে মাঝে ভিড় করে আসে রাত জাগানো শব্দেরা। ইচ্ছে, কবিতা, প্রেম, রাস্তা, অন্ধকার... আমি।

ফেলুদার তোপসে › বিস্তারিত পোস্টঃ

গ্রামের নামটি \'বিরহী\'

২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১২:৩৮


বিরহী নামের কোনও গ্রাম হতে পারে আমাদের এই বাংলায়? থাকলে সেই গ্রামের লোকগুলো কেমন? আমার আপনার মতো চিরকালীন বিষয়ী, লোভী, হিংস্র, স্বার্থপর, রাগী হবে? না, একটু উদাস উদাস? চারপাশের পৃথিবী সম্পর্কে চূড়ান্ত উদাসীন? সংসার, মানুষজন, জীবিকা সম্পর্কে খোঁজই রাখে না।



রোদ পড়েছে মাঠে, জ্যোৎস্নায় ভাসছে সবুজ বাগান, রিমঝিম বৃষ্টি পড়ে চলে জাতীয় সড়কে–শুধু এ সব নিয়েই তাঁদের যাবতীয় আগ্রহ? শুধু বিরহের গজল আর পুরোনো আধুনিক গান গায়? নি:শব্দে হারানো প্রেমিক বা প্রেমিকার জন্য চোখের জল ফেলে। বা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাসগুলোর মতো পরাবাস্তব, স্বপ্নময় চরিত্র সব। মোটেই বিষয়ী নন। সংসারীও নন।



বারাসত থেকে জাতীয় সড়ক ধরে শান্তিপুরের দিকে এগোলে, হরিণঘাটা পেরোলেই ‘বিরহী’ গ্রাম। সরকারি বোর্ডে বড় করে লেখা রয়েছে ‘বিরোহি’।



দেখে একটু ধাক্কাই খায় চোখ–আহা, তা হলে কি এ গ্রামের নাম ‘বিরহী’ নয়? বিরহী নামের গ্রাম আর জীবনে খুঁজে পাওয়া হল না!নদী একটা রয়েছে গ্রামে ঢোকার মুখেই। নাম যমুনা। সে তো কচুরিপানায় এমন ঢাকা, যে নদী বলে মনেই হয় না। খাল মনে হয়। জাতীয় সড়কের উপরে কোনও ক্যালভার্ট।



তবু নদী তো নদীই! গ্রামের লোকেরা বললেন, ভাগীরথী থেকে বেরিয়ে সে নাকি মিশেছে ইছামতীতে। কোথা থেকে কোথায় চলে গিয়েছে আরও শীর্ণা হতে হতে প্রেমিক ইছামতীর দিকে। এ নদী বিরহী হয়েও খুঁজে নিতে পারে প্রেমিক।



বড় রাস্তার বাঁদিকে অজস্র গাছের মধ্যে উঁকি মারে দুটো সাদা রংয়ের ইঁটভাটা। ডানদিকে একটা দীর্ঘ ছায়া নিয়ে দাঁড়িয়েছে শিরীষ গাছ।তাদের ছায়াই অন্যরকম। বটের ছায়া থেকেও বেশি মায়াময় এক এক সময়। বাসস্টপ কয়েক পা দূরে। সেখানে গিয়ে আশ্বস্ত হওয়া গেল। সব দোকানের সাইনবোর্ডে নাম ‘বিরহী বাজার’। গ্রামের নাম বিরহীই। বিরোহি নয়।



বিরহীরও নামের পাশে বাজার বসে তা হলে! বিরহী শব্দের সঙ্গে আর যাই হোক, ঠিক বাজার মানায় না। তবে কী করা যাবে? সব মফসসল বা আধা শহরে এ সব হয়। নামের সঙ্গে জুড়েই যায় বাজার। মাইকে গান বাজছে। এ গ্রামের লোকেরা তো আমাদের মতোই। ভেতরে গিয়ে সবুজে সবুজ একটা গ্রাম পাওয়া যায়। বাঁশ, কলা, ধান, বট, অশ্বত্থ। শব্দহীন। হালদারপাড়া এটা। সবুজ ফুটবল মাঠে গরু চরে। গায়ে সাইনবোর্ড লাগানো। ‘বিরহী ভারতী সঙ্ঘ’। স্থাপিত ১৯৬১। বিরহী ভারতী সঙ্ঘ শুনতে কেমন লাগে! আর একটু এগোলে অন্য একটা ক্লাবের নাম ‘বিরহী’র মতোই অন্যরকম মন কেমন। ‘বটবৃক্ষ মিতালী সঙ্ঘ’। ওখানে সত্যিই একটা বটগাছ রয়েছে। দীর্ঘ ছায়া নিয়ে।



নদিয়া জেলার এ গ্রামের একটাই রাস্তার মোড়। জাতীয় সড়ক থেকে একটা রাস্তা চলে গিয়েছে মদনপুর রেলস্টেশনের দিকে, অন্য রাস্তা নোয়াখালির দিকে। পৃথিবীর এটাই মজা। গ্রামের নাম বিরহীও হয়, আবার তার পাশে মদনপুরও থাকে। মদনপুরের লোকদের নিশ্চয়ই বিরোহীর লোকদের ওপর রাগ হয়, ঈর্ষা হয়। তোদের গ্রামের এত ভালো নাম, আর আমাদের…।



মদনপুরের দিকে একটু হাঁটলেই অবশ্য একটা বড় রহস্য ফাঁস হয়। এ গ্রামের নাম কেন হল বিরোহী? কেনই বা হঠাৎ এল মদনপুর নাম।হয়তো সবই লোকগাথা। স্রেফ গল্প। তবু তো বিরহের স্পর্শে অন্য রকম হয়ে উঠছে ভালোবাসার সুগন্ধ। সেই রাধা কৃষ্ণের চিরন্তনী প্রেম।

রাস্তার বাঁ দিকে ছায়ামাখা এক মন্দির। মদনমোহনের। স্থাপিত ১৭৬০ সাল। মানে পলাশী যুদ্ধের তিন বছর পরে তৈরিহয়েছিল এ মন্দির। মূর্তি দেখে তাক লেগে যায়, এ কী দেখলাম! কালো রূপ ঠিককে বেরোয় মদনমোহনের। কোথাও যা দেখিনি, এখানে তাই নজরে এল। ছোট মন্দিরে রাধা কৃষ্ণের মূর্তির পাশেই বিরাট খাট, বিছানা, মশারি। রাতে মদনমোহনের শোয়ার নিপাট ব্যবস্থা।



মদনমোহনের মন্দির থেকে মদনপুর নাম হতে পারে। কিন্তু বিরহী? সে নাম কী করে হল?



গল্পটা বললেন শুভ্রাংশু রায়। আদতে উত্ত প্রদেশর লোক, পদবি তিওয়ারি। পাঁচ পুরুষ হল এখানে। নদিয়ার রাজা তখন বিখ্যাত কৃষ্ণচন্দ্র। তিনি এঁদের পূর্বপুরুষদের পদবি করে দেন রায়। ওই সূত্রের এ অন্চলের জমিদার হয়ে ওঠেন রায় পরিবার। সেই জমি অবশ্য অত নেই। রায়বাবুদের এক বিশাল হাট রয়েছে। আর মোড়ের মাথায় বাড়িতে ওষুধের দোকান কুন্দন ফার্মেসি। কথা হল ওখানেই। কৃষ্ণচন্দ্রের কথা, বিরহী গ্রামের নামের কথা।



ওই কৃষ্ণচন্দ্রই এক রাতে স্বপ্ন দেখে মদনমোহনের মন্দির বানিয়েছিলেন এ গ্রামের যমুনাতীরে। গোপাল নামে এক বালক ছিল। সে নাকি কাঁঠাল গাছের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল। তার কথা ভেবেই কাঁঠাল কাঠ থেকে তৈরি হয় মদনমোহনের মূর্তি। কিছুদিন বাদে কৃষ্ণচন্দ্র আবার স্বপ্ন দেখেন। মদনমোহন বলছেন, তিনি রাধার বিরহে কাতর। একা মন্দিরে থাকতে পারছেন না। যমুনা নদী একেবারে মন্দিরের গায়েই। সেখানে ভেসে আসছিল নিমগাছ। সে কাঠ থেকেই তৈরি হয় রাধা মূর্তি।



বিরহের দিন শেষ। তবু থেকে গিয়েছে বিরোহী নামটি। দুশোর বেশি বছর হয়ে গেল। জানি না, এত সুন্দর গল্পের সঙ্গে জড়িত মন্দিরের তেমন প্রচার হল না কেন। বাঙালি তো জানেই না এ অনি:শেষ বিরহ মন্দিরের গল্প। বিরহের গ্রামের রূপকথা।

যমুনা পাশে থাকলেই কি রাধার জন্য বিরহে কাতর হয়ে ওঠেন শ্যাম? কচুরিপানা ভর্তি নদীটিতে যতটুকু দৃশ্যমান জল মন্দিরের গায়েই। কার্তিকের রোদভরা সকালে গিয়ে দেখি, প্রাচীণ সব বটের দীর্ঘ ঝুরি নেমে এসেছে প্রায় জল ছুঁতে। ঘাটের সিঁড়ির পাশে শুধু জল দৃশ্যমান। সেখানে আজও পড়ে প্রচুর মূর্তির কাঠামো। মানে গ্রামের সব মূর্তির বিসর্জন ওখানেই হয়। ভাইফোঁটার সময় মন্দিরের সামনে গাছের ছায়ায় মেলা বসে। সেখানে হিন্দু বোনেরা ফোঁটা দেন মুসলিম ভাইদের। মুসলিম বোনেরা ফোঁটা দিয়ে যান হিন্দু ভাইদের। বিরহ যন্ত্রণা মুছে তৈরি হয়ে যায় অন্য রকম ভালোবাসা। চুঁইয়ে পড়ে সুখ।



বিরহের দিন শেষ। তবু বিরহী গ্রাম আজও থেকে গিয়েছে। বাংলার এক যমুনা তীরে।

গ্রামের নামটি 'বিরহী'

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ দুপুর ২:১৫

রাজীব নুর বলেছেন: ্লেখা এবং ছবি সুন্দর।
এই গ্রামে বেড়াতে যাব।

২| ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৫:৪২

মোহাম্মদ মজিবর রহমান বলেছেন: দারুন বিরহি রুপকথা।উ্ত্তর প্রদেশেও বিরহি নামের গ্রাম আছে।
আপনার গ্রাম কি নদিয়ায়?

৩| ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ সকাল ১০:১০

মাঈনউদ্দিন মইনুল বলেছেন:

লেখাটি ভালো লেগেছে। আমাদের গ্রামগুলো এরকম কিছু অসাধারণ ঘটনার সাক্ষী। কিছু নামের সাথে যুক্ত হয়ে আছে, অবশিষ্ট আছে গ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও মানুষগুলোর সাথে।

৪| ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ সকাল ১০:১৭

সেলিম আনোয়ার বলেছেন: সুন্দর।বিরহী নামটিও বেশ কাব্যিক। উচ্চারণ কিন্তু বিরোহি। :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.