নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

https://www.facebook.com/asrafulalam

ব্যোমকেশ বাবু

ব্যোমকেশ বাবু › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাড়িয়ে বলা গল্প : গোপনকথা ডট কম

০৪ ঠা মার্চ, ২০১৮ রাত ২:৪৮

( গল্প )
তানিমের হাতে মিসির আলীর একটা উপন্যাস । রাতের খাবার শেষে ড্রয়িং রুমে বসে বসে ১২ তম বার এই উপন্যাসটা পড়ছে, আসলে পড়ছে না, পড়ার ভান করছে । একটু পরেই রিমি ঢুকবে ঘরে আর এই ভয়ে তানিমের গলা শুখিয়ে যাচ্ছে বার বার । রিমি , তানিমের সহধর্মিনী । তানিম প্রায়ই ভাবে, কিভাবে ও রিমিকে এতো ভয় পায় ? সারা দিন চোর ছেচড়াদের সাথে কারবার , তারপরও কেন যে রিমিকে এতো ভয় পায়, তানিম জানে না ।নিজের জীবনটাকে কোন ভাবেই মিসির আলী বা হিমুর সাথে মিলাতে পারছে না তানিম ।কারণ সামাজিক আর আর্থিকভাবে সে মিসির আলী বা হিমু কারো পর্যায়ই পরে না ।পেশায় অ্যাডভোকেট আর বাবার রেখে যাওয়া অঢেল টাকা পয়সার মাজে কিভাবে নিজেকে মিসির আলী ভাববে ? আর ভাবলেই তো হবে না, রিমি তো আর এটা মেনে নেবে না ।

ঘরে ঢুকেই একটা দীর্ঘশাস ফেললো রিমি । এর অর্থ তানিম বুজতে পারলো । নিজে অ্যাডভোকেট হয়েও প্রতিদিন রাতের এই সময়টায় রীতিমতো অত্যাচার এর মাঝে দিয়ে যেতে হয় নিজেকে । দেশে পুরুষ মানুষ অত্যাচারের তেমন কোনো আইন কানুন নেই , আর থাকলেও বা কি, কোনো পুরুষ মানুষ কি কখনো গলা উঁচু করে বলবে যে সে রাতের বেলা বউ দ্বারা নির্যাতিত হয় ? তবে একটা আইন থাকলে খুব একটা মন্দ হতো না । যাই হোক , তানিম একেবারে যে মজা পায় না তা কিন্তু না , তবে সমস্যা হচ্ছে রিমি খুব জোরে গাড়ির ব্রেক করে, গাড়ি থামাবার সময় । তানিমের এই জোরে ব্রেক করার ব্যাপারটা ছাড়া আর সবই পছন্দ রিমির ।

তবে আজ রাতে মনে হচ্ছে অন্য কিছু হবে, রিমি বেশ রেগে আছে ।

"কত করে বললাম, কিছু একটা শুরু করো । আমার ভাই স্টেটস এ থাকে , ওকে সাথে নিয়ে একটা স্টার্টআপ করো । আমাদের সমান ছেলে মেয়েরা কত কিছুই না করছে । আর তুমি , দিনরাত শুধু মিছির আলী , শার্লক হোমস এইসব । কবে যে বাস্তব জীবনে ফিরবে তুমি আমি জানি না "

রিমির এইসব কথা তানিমের মুখস্ত । তবে খুব একটা খারাপ বলে না রিমি । লন্ডন থেকে ল এর উপর ডিগ্রী নিয়ে দেশে এসে , জজ কোর্টের অ্যাডভোকেট । এটার জন্য লন্ডন না গেলেও হতো হয়তো । যে কেয়ই তো অ্যাডভোকেট হতে পারে এখন । সে যাই হোক, কিছু একটা শুরু করা দরকার । আজকালকার যুগে একটা স্টার্টআপ না থাকলে তো স্টেটাস থাকে না ।

ক্ষনিকের জন্য তানিম মিসির আলীর কথা ভুলে গিয়ে ,জুকারবার্গের কথা মনে করার চেষ্টা করলো । কিন্তু তেমন একটা আগ্রহ পেলো না চিন্তা টুকু । অনিচ্ছা সত্ত্বেও রিমিকে শান্তনা দিলো তানিম ।

"আরে জান আমার, এতো চিন্তা করছো কেন , আমি একটা স্টার্টআপ করবোই । দেখে নিয়ো এই মাসের মধ্যে আমি আমার নতুন ডোমেইন নাম রেজিশ্ট্রেশন করবো , আর আমি ভাবছি তুমিও আমার সাথে থাকবে । একসাথে শুরু করবো , ঠিক আছে না ?"

বলেই তানিমের মনে হলো, গল্পের এই অংশটুকু রিমির ভালো লাগেনি । আর লাগবেই বা কেমন করে, তানিমের নিজেরই এসব কথা খুব একটা ভালো লাগে না । যে মানুষ নেশার মতো মিসির আলী পড়ে , বোম্বকেশ বসু, শার্লক হোমস যার রক্তে, সে কিভাবে জুকারবার্গের পথ অনুসরণ করবে ?

অন্ধকারে রিমির চেহারা দেখা না গেলেও তানিম ঠিক বুজতে পারলো, রিমি প্রচন্ড বিরক্ত হচ্ছে তানিমের উপর । কাপড় না বদলিয়েই রিমি শুয়ে পড়লো । আরেক অত্যাচারের শিকার তানিম । এটাও একটা অত্যাচার । আজ সারা রাত তানিমের ঘুম হবে না । আশ্চর্য এক মনের খেলা, কাছে আসলে মনে হয় অত্যাচার আর কাছে না আসলেও মনে হয় অত্যাচার । ব্যাপারটা তানিম বিয়ের ৭ বসার পরও বুজতে পারে না । অদ্ভুত একটা নির্যাতিত মানুষের মতো তানিম শুয়ে থাকলো আর ভাবতে লাগলো কিভাবে একটা কিছু শুরু করা যায় । এই স্টার্টআপ জিনিসটাই তানিমের মাথায় আসে না । একটা ওয়েবসাইট খুলো , এর পর বসে থাকো কখন সবাই লাইক দিবে , স্টেটাস লিখবে এই সব । কেন যে মিসির আলী বা হিমু এই স্টার্টআপ নিয়ে কিছু লিখে গেলো না ? তানিমের চোখ বুজে আসতে থাকে ধীরে ধীরে ।

সকালে তানিম আর রিমি একসাথে বের হয় অফিসের জন্য । বলা হয়ে উঠেনি মনে হয়, রিমিও কিন্তু অ্যাডভোকেট , মানে রিমি আসলে ব্যারিস্টার । লন্ডনে তানিম আর রিমি একসাথে একই ইউনিভার্সিটিতে পড়তো । রিমি এক চান্সে ব্যারিস্টারি পাশ করে ফেললো আর তানিম সাথে সাথে রিমিকে বিয়ে করে ফেললো । তানিমের আর ব্যারিস্টারি পাশ করা হলো না । রিমি এখন একটা প্রাইভেট ভার্সিটির লেকচারার । এটাও অবশ্য তানিমের জন্য আরেক ধরণের অত্যাচার । হাসব্যান্ডের থেকে বৌ যদি বেশি শিক্ষিত হয় তবে সুক্ষ একটা মানসিক অত্যাচারের মধ্যে থাকতে হয় হাসবেন্ডকে ।সে যাই হোক, তানিম আর রিমির ছোট সংসারে তাদের নিজেদের একটা সন্তান ছাড়া আর সবই আছে । নিজেদের গাড়ি, একটা ফ্লাট, মাস শেষে মোটা ইনকাম, অবশ্য যার বেশির ভাগই আসে তানিমের বাবার জমা করে রাখা ব্যাংকের FDR থেকে ।

গাড়িতে উঠেই তানিম মুচ্কি হেসে বললো,

"জান আমার, আমি আমাদের স্টার্টআপ আইডিয়া পেয়ে গেছি ।"

রিমি খুব একটা শুনতে না পাওয়ার ভান করে ফোনে ফেইসবুক লগইন করলো ।

"আচ্ছা শুনো না জান, আমি ঠিক করেছি আজকেই একটা ডোমেইন নাম রেজিস্ট্রেশন করবো আর নামটা হবে গোপনকথা , মানে http://www.goponkotha.com

রিমি মনে হলো এইবার শুনতে পেলো ।

মানে কি ? কি হবে এতে ?

তানিম এইবার গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিলো । এই না হলে পুরুষ মানুষ, পায়ের পাতার এক চাপে গাড়িটা কেমন দোড়াচ্ছে ।

"শুনো জান , আমি ঠিক করেছি, আমি ফাউন্ডার আর তুমি হবে কো-ফাউন্ডার । আমরা একটা ওয়েবসাইট খুলবো , যেখানে সবাই সবার গোপন কথা জমা রাখবে ।"

"তোমার কি মাথা ঠিক আছে? কে কার গোপন কথা তোমার ওয়েবসাইটে পোস্ট করবে ? আজিব সব চিন্তাধারা। এই সব চিন্তা বাদ দাও আর গাড়ি আস্তে চালাও ।" তানিমের মনে হলো রিমিকে বোঝানো বেশ কঠিন হবে । এটাও একটা অত্যাচারের মতো । এক কথায় রিমি কোনো দিন কিছু বুঝে না । আর তানিমও কি করবে বুজতে পারে না । ওতো আর বিজনেস নিয়ে পড়াশুনা করেনি । চাইলেই যে কাওকে যেকোনো কিছু দিয়ে বুজ দিয়ে দেয়া যায়

গাড়ির গতি আরো বাড়ায় তানিম ,

"আচ্ছা , আমাকে ৫ টা মিনিট দাও । আমি বুজিয়ে বলছি তোমাকে । ধরো অনেক মানুষ আছে যারা সব সময় নিজেদের অপরাধী ভাবে , কাওকে বলতে পারে না নিজের মনের গোপন কথা । আমাদের ওয়েবসাইটটা এদের জন্য ।এই অপরাধী মানুষ গুলো নিজেদের মনের গোপন কথা আমাদের সাইট এ স্টোর করে রাখবে, মানে, অনেকটা এদের কনফেশান জমা করে রাখবে আমাদের সাইটে । আমরা এদের এই কনফেশান গুলো আইন কানুন মেনে সংরক্ষন করবো , যত দিন এরা চাইবে । অবস্য একটা ফী আমরা নিতে পারি এর জন্য । আর আমরা যেহেতু ওকালতি করি , মানুষজন আমাদের বিশ্বাস করবেই ।" কি বলো তুমি ?

বুজলাম না , কেন সবাই তাদের অপরাধের কথা, গোপন কথা জমা করে রাখতে যাবে ? আর এতে ওদের এই বা লাভ কি ? একটু করে হলেও তানিমের মনে হলো রিমি আগ্রহ পাচ্ছে । তানিম গাড়ির গতি আরো বাড়ায় ।

"ধরো , অনেকে আছে যারা আজকের দিনে হয়তো এমন কিছু একটা করলো যা সে কাওকে মুখে বলতে পারছে না । কিন্তু সে যদি আমাদের সাইট এসে ভিডিও ব্লগের মাধ্যমে নিজের মনের কথা গুলো জমা করে রাখে আর পরে কখনো যদি প্রয়োজন হয় এই ভিডিওটা একটা এভিডেন্স বা সাক্ষ হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে । অবস্যই যদি কেয় তা চায় ।

রিমিকে খুব একটা আগ্রহী বলে মনে হলো না তানিমের । রিমির ভার্সিটির সামনে চলে এসেছে ওরা । গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে রিমি একটু থমকে দাঁড়িয়ে বললো ,

"ঠিক আছে , আমি আছি তোমার সাথে । তবে স্বর্থ একটাই , যা করার জলদি করবা "

তানিম হটাৎ করে জোরে গ্যাস প্যাডেলে চাপ দিলো আর গাড়ির ইঞ্জিনে বিশ্রী রকমের একটা আওয়াজ করে উঠলো । গাড়ি গিয়ার যে কখন নিউট্রাল করেছে তানিম ভুলে গিয়েছিলো । রিমি খিলখিল করে হেসে উঠলো । তানিমের মনে হলো আজকে রাতটা হয়তো আনন্দদায়ক একটা অত্যাচারের মধ্যে দিয়ে যাবে ।

গোপনকথার ওয়েবসাইট টা অদ্ভুত একটা সাইট হলো । মাত্র এক পেজের একটা ওয়েব সাইট । শুধু মেম্বার লগ ইন করে ঢোকা যাবে ।কেয় কারো ভিডিও ব্লগ দেখতে পারবে না শুধু জমা রাখতে পারবে । হটাৎ করে তানিম কেনই বা এই রকম একটা জিনিস করতে গেলো রিমি বুজতে পারছে না , তবে কিছু বলছেও না মুখে । বলা তো যায় না যদি জুকারবার্গ টাইপের কিছু একটা হয়ে যায় ।

তানিমের দিন কাল ইদানিং খুব ভালো যাচ্ছে । ফেসবুক , টুইটার সব খানে গোপনকথা ছড়িয়ে দিচ্ছে । আস্তে আস্তে মেম্বারও বাড়ছে । অনেক ভিডিও জমা পড়েছে । কোনটি মৃত্যুর পর ছেলে মেয়েদের লগইন পাসওয়ার্ড দেবার রিকোয়েস্ট, কোনটি আদালতের রেফারেন্স এই টাইপের । ভিডিও গুলো তানিম দেখে না । মানুষের গোপনীয় জিনিস পত্রে তানিমের তেমন কোনো আগ্রহ নেই । আর তাছাড়া এই সব দেখা নিজের বানানো নিয়ম ভাঙার মতো । সবকিছু ডিজিটাল হচ্ছে , মানুষের উইল করার পদ্ধতি ডিজিটাল হবে না এটা কি করে সম্ভব । তানিমের সাইটের বেশির ভাগ ক্লায়েন্ট হচ্ছে বয়স্ক । এরা এদের ছেলে মেয়েদের সহায় সম্পত্তি টাকা পয়সার ভাগ বাটোয়ারা এই সব নিয়ে মনের কথাগুলো ভিডিও করে জমা রাখছে তানিমের সাইটে ।

বিয়ের সাথ বছর পরও নিজেদের সন্তান না হবার দোষটা রিমি নিজের ঘাড়ে নেয় । ওদের পারিবারিক ডাক্তার আর বন্ধু শিপলু রিমির ট্রিটমেন্ট করছে । তানিম অবশ্য অনেকবার বলেছে টেস্টটিউব বেবি নিতে , কিন্তু রিমি রাজি হয়নি । একটা নবজাতক প্রাকৃতিক ভাবে না হয়ে কি সব টেস্টটিউবে হবে এটা ভাবতেই রিমির বমি বমি লাগে । এর চেয়ে শিপলুর নানারকম এলোপ্যাথি ওষুধেই ভালো । রিমির বিশ্বাস একদিন না একদিন তাদের ঘরে ফুটফুটে একটি সন্তান আসবেই । তানিমের অবশ্য এ নিয়ে তেমন কোন আক্ষেপ নেই । শুধু মাজে মাজে ভাবে নিজের DNA টা যদি গোপনকথা সাইটের মতো কোনো জায়গায় জমা রাখা যেত তাহলে ভালোই হতো ।শুনেছে বিদেশে নাকি এই DNA জমা রাখার ব্যাংক আছে । ভাবছে রিমিকে ব্যাপারটা বলবে কিনা । কিন্তু পরক্ষনেই রিমির চেহারা মনে হলে সব কিছু ভুলে যায় তানিম ।একদিন সাহস করে বলেই ফেললো তানিম ।তবে সময়টা ছিল আলো আঁধারির মাঝে রিমির পায়ে যখন গাড়ির এক্সসিলেটর থাকে তখন ।

"আচ্ছা একটা কথা বললে রাগ করবা নাতো ?" এই কথা শোনার সাথে সাথেই রিমি রেগে গেলো ,

"মানে কি , কি করছো আবার ? কোথায় আবার কি ঘোল পাকাইছো ?? বলো বলো, এক্ষুনি বলো "

পুরোপুরি অপ্রসতুত তানিম বুজতে পারছে না কি বলবে । এই অববস্থায় কথাটা বলা যে কত বড় ভুল হয়েছে , ভুলটা করার পরে তানিম টের পেল । চুপ করে থেকেও রক্ষা পাচ্ছে না তানিম ।

"চুপ করে আছো কেন ? জবাব দাও । কি বলবা বলো" রিমি সহজে ছেড়ে দেবে বলে মনে হচ্ছে না ।

উপায়ন্তর না দেখে তানিম আমতা গলায় বললো ,

"না মানে আমি মজা করছিলাম আরকি । ওই যে নেটে দেখলাম লন্ডন এ একটা স্পার্ম ব্যাংক আছে । মানে চাইলেই যে কেও ...মানে ইয়ে DNA জমা রাখতে পারে " বলেই তানিম কান্নার মতো করে হাসতে লাগলো ।

"কেন তোমার কি জমা রাখার স্বাদ হয়েছে জান । আচ্ছা এতই যখন উপচে পড়ছে লন্ডন কেন যাবে একটা শিশি এনে দেই । ঐখানে জমা রাখো । "

প্রচন্ড অপমান বোধ করলো তানিম । এর কোন মানে হয় না । সামান্য জোকস এভাবে বাজে ভাবে নেবে রিমি ভাবতে পারছে না তানিম । রিমি এক ধাক্কায় তানিমকে সরিয়ে দিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেলো । তানিমের কান্না পাচ্ছে রীতিমতো । রিমি যা করছে এটা সভ্য সমাজে হয় না । হাসব্যান্ড ওয়াইফের মাজে মজা হয় । কিন্তু এই মজা সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে । এখন কঠিন একটা ধমক দিতে পারলে ভালো হতো । কিন্তু তানিম ভয়ে কাঁপছে ।

রিমি সত্যি সত্যি এই কাজ করতে পারে তানিম কল্পনাও করতে পারছে না । এটা অবশ্যই আইনের আওতায় আনা দরকার ।

তানিমের গোপনকথা সাইটটির মেম্বারস লিস্ট ভারী হচ্ছে দিনের পর দিন । এতটা আশা করেনি তানিম । কোর্টে যখন গোপনকথার ভিডিও ব্লগ এভিডেন্স হিসাবে দেখানো হয় গর্ভে তানিমের বুক ভরে যায় । নিজেকে জুকারবার্গের চেয়ে বড় কিছু মনে হয় তখন । বেজায় ব্যাস্ত থাকে তানিম সব কিছু নিয়ে । সমানে ব্লগ লেখা, আপডেট করা , সব কিছু যেন সিনেমার মতো । নিজেদের গাড়ির জন্য একটা ড্রাইভার রেখেছে তানিম । এখন আর গাড়ির এক্সসিলেটরে চাপ দিতে ভালো লাগে না । রিমিও কেমন যেন মেনমেনে স্বভাবের হয়ে গেছে । আগের মতো গাড়ি হটাৎ করে ব্রেক করে না । সব কিছু যেন অসম্ভব এক নিয়মের মধ্যে চলছে । খুব একটা সমস্যা বলে কিছু নেই তানিমের এখনকার জীবনে । নিজের অজান্তেই তানিম ভুলে গেলো মিসির আলী , শার্লক হোমস অথবা ব্যোমকেশ বাবুর কথা ।

আজ রিমির ৮ তম বিবাহ বার্ষিকী। রিমি তানিমকে অসম্ভব রকম একটা সারপ্রাইস দিবে প্ল্যান করে রেখেছে । নিজেরদের বেড রুমটাকে অনেকটা নাটক সিনেমার মতো করে আধো আলো আধো ছায়ার মতো করে রেখেছে রিমি । তানিম আসবে আর হটাৎ করে সারপ্রাইজড হবে । রাত ১১ দিকে তানিম ঘরে ঢুকলো আর রিমির সাজানো নাটকে অবাক হলো রিমির মতো করে । সবচেয়ে অবাক হলো নিজের বাবা হবার কথা শুনে । ৮ বছর পর বাবা হবার যে কি আনন্দ সেটা তানিম কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারছে না । এতো আনন্দ না হলেও চলতো । কেন যে মানুষ বড় রকমের আনন্দে চুপচাপ থাকতে পারে না । তানিম দীর্ঘশাস ফেলে আর ভাবে, তার জায়গায় হিমু থাকলে কি এই রকম করে আনন্দ করতো নাকি রিমিকে ধমক দিয়ে বলতো "হারামজাদি এতদিন পরে কেন ? আগে কই ছিলি ?" এইটুকু ভেবেই ভয় পেয়ে গেলো তানিম । মনে হলো রিমি যদি শুনতে পায় ।

রিমি উনিভার্সিটির চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে । বাসায় বসে আর নিয়মিত ডাক্তারের কাছে চেকাপ করে সময় কাটে এখন । ওহ অবশ্য গোপনকথা ওয়েবসাইটের কো-ফাউন্ডার রিমি আর আপাতত তানিমকে বাসায় বসে সাহায্য করা রিমির কাজ । রিমি বেশ অবাক হচ্ছে তানিম সাফল্য দেখে । দেশ বিদেশের এতো মেম্বার এই সাইটের রিমির ধারণা ছিল না । রিমি নিজের কোনো ভিডিও পোস্ট করেনি এখনো । তবে বাসায় বসে বসে বিরক্ত হচ্ছিলো বেশ কিছু দিন থেকে । ভাবছে একটা গোপনকথা না হয় লুকিয়ে রাখবে এখানে ।

২০ বছর পর
স্থান : লন্ডন

শিমুল, রিমি আর তানিমের ছেলে । নামটা মায়ের রাখা ।ইস্ট লন্ডনের একটা এপার্টমেন্টে ল্যাপটপের সামনে বসা। চোখের সামনে গোপনকথার ওয়েবসাইটটি খোলা। ৩ মিলিয়ন পাউন্ডের এই স্টার্টআপ তার বাবা মায়ের করা । আজকের দিনে সে একমাত্র জীবিত কো-ফাউন্ডার । জন্মের কয়েক বছর পরই মা মারা যান আর বাবা গত বছর । পেশায় শিমুল মা বাবার মতো ব্যারিস্টার । অনেক অল্প বয়সে শিমুল ব্যারিস্টারি পাশ করে ।

আজকের এই দিনটির জন্য শিমুল অনেক দিন থেকে অপেক্ষা করছিলো । আজ ১২ই জানুয়ারী ২০৩৬ সাল । আজকের দিনটিতে শিমুল তার বাবা মায়ের ভিডিও পোস্ট গুলো দেখতে পারবে । আজকের এই তারিখ দিয়ে ব্লক করা ছিল এতদিন বাবা মায়ের ভিডিও গুলো । শিমুলের চোখে পানি । কি এমন গোপন কথা ছিল বাবা মায়ের , যার জন্য এতো গুলো বছর অপেক্ষা করতে হলো ।

তানিমের ভিডিও ব্লগ

" শোন বাবা, আজকে তোমার ২০ বছর পূর্ণ হলো । আমি গোপনকথা সাইটের ২০ বছরের রেজিস্ট্রেশন ফিস দিয়ে দিয়েছি । যাতে করে তুমি আমার এই ভিডিও দেখতে পারো । আমি জানি না এখন কি অবস্থা আমার এই স্টার্টআপের আর জেনেও বা কি হবে । সে যাই হোক , তুমি আমার এই একটা মাত্র ভিডিও ব্লগ পাবে এই সাইটে । কিছু সত্য তোমার জানা দরকার । আর এই সত্য সামলানোর জন্য তোমার ২০ বছর বয়স যথার্থ বলে মনে হয়েছে আমার ।"

শিমুল দেখলো বাবা ভিডিওটি পোস্ট করছে মা মারা যাবার কয়েক বছর পর । বাবাকে অনেক ক্লান্ত লাগছে । ক্লান্ত গলায় তানিম আবার শুরু করলো ,

"তোমার মা অসম্ভব মায়াবতী এক নারী ছিলেন । আমি যাকে ভালোবাসতাম , ভয় পেতাম , রাগ করতাম কিন্তু কখনোই তোমার মায়ের উপর সাহস করতাম না । এর মানে আমি ভীতু এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই । আমাদের দুজনের সংসার জীবন অনেক সুখী ছিল । কিন্তু একটা কমতি ছিল তোমার । তুমি এলে আমাদের সংসারে ৮ বছর পর ।

তুমি দেরি করে আসার কারণ হয়তো তোমার মা । এর জন্য তোমার মা অনেক চিকিৎসাও করিয়েছে । এর পর তুমি এলে । সব কিছুই ঠিক ছিল । কিন্তু হটাৎ একদিন আমার অদ্ভুত এক খেয়াল চাপলো । আমি তোমার জন্মের প্রায় মাস খানেক পর , আমার ফার্টিলিটি টেস্ট করালাম । ডাক্তারের রিপোর্ট মতে আমার পক্ষে সন্তান জন্ম দেয়া কখনোই সম্ভব না । আমি বার বার এই একই টেস্ট করলাম বিভিন্ন জায়গায় । আর সবকটির রেজাল্ট একই । "

দীর্ঘক্ষণ চুপ থেকে তানিম আবার বলে উঠলো

তোমার জন্মের এক বছর পর এক পূর্ণিমার রাতে আমি তোমার মা কে হত্যা করি । তোমার বেড়ে উঠার সব দায়িত্ব আমি নিজে নেই । এর কোনো কারণ তুমি খুঁজো না , কারণ আমার জানা নেই । তুমি চাইলে আমার মৃত্যু পরবর্তী একটা কেস ফাইল করতে পারো । এই অধিকার তোমার আছে । আর সাক্ষ প্রমান হিসাবে আমার এই ভিডিওটি ব্যবহার করো । রায় তোমার মায়ের পক্ষে যাবে "

"এর চেয়ে বেশি কিছু আমার বলার নেই । তোমার মায়ের জন্য তৈরী করা এই গোপনকথার সাইটটি আমি চাইলেই বন্ধ করে দিতে পারতাম । কিন্তু আমি এই দায়িত্ব তোমাকে দিলাম। ভালো থেকো ।

রিমির ভিডিও ব্লগ

রিমির ভিডিও ব্লগটি শুধু খিলখিল শব্দে ভরা । কথার আগেই হাসছে রিমি । অসাধারণ মায়াবতী যাকে বলে রিমি অনেকটা ঐরকম ।

"আমার জান , এটা তোমার জন্য । বাসায় বসে বসে বিরক্ত হচ্ছিলাম তাই একটা ভিডিও আপলোড করলাম । কিন্তু তুমি এটা কখনোই দেখতে পারবা না । আমার পারমিশন নাই তোমার জন্য এটা দেখার । "

"আচ্ছা শোনো , তুমি যে বরাবরই আমাকে সন্দেহ করো আমি জানি ।তোমার ধারণা আমাদের দুইজনের মাজে তৃতীয় একজন আছে । তোমার ধারণা ঠিক । তোমার মনে আছে আমরা যখন লন্ডন ছিলাম তখন আমাদের বাসায় সব সময় কে যাওয়া আসা করতো ? তোমার তো ভুলে যাবার কথা নয় । যাই হোক , তৃতীয় পাত্র থাকা নিয়ে তুমি যত টেনশান কর আমি তত মজা পাই । তুমি জানো বুজো কিন্তু মুখ ফুটে আমাকে কিছু বলতে পারো না ।"

"মনে আছে আমাদের সন্তান না হবার কারণ ? আসলে আমার কোনো সমস্যা ছিল না । সমস্যা ছিল তোমার । আমি ডাক্তার সাহেবকে বলে রিপোর্টটা বদলে ফেলেছি । সব সমস্যা আমার ঘাড়ে নিলাম আমি । কেন জানো ? তোমাকে অসম্ভব ভালোবাসি বলে । আমি জানি তুমি যখন আসল রিপোর্ট হাতে পাবে, নিজেকে স্থির রাখতে পারবে না । আমি সহ্য করতে পারবো না । এতো ভালোবাসার কোন মানে নেই । কিছু ভালোবাসা এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয়া দরকার ।"

"আমি টেস্টটিউব বেবি নিতে রাজি ছিলাম না । কারণ আমি সময় দিয়েছি তোমাকে । আমার বিশ্বাস ছিল একদিন তুমি ঠিকই সেরে উঠবে । আমি জানতাম রাতের পর রাত তুমি আমার কষ্ট সহ্য করছো । আমি চেয়েছি তুমি যাতে সেরে উঠো। মনে আছে সেদিন রাতে তুমি মজা করে বলেছিলে স্পার্ম ব্যাংকের কথা ? আমি জানতাম আমি বাড়াবাড়ি করেছি । কিন্তু আমার কেন যেন মনে হচ্ছিলো তুমি মন থেকে চেয়েছিলে ঐটা । আমি হার মানলাম নিজের কাছে । তোমার কষ্টের চেয়ে আমার ভালো লাগা বড় কিছু না । আমি সুযোগ টা কাজে লাগলাম । আমিই তোমার ব্যাংক জান । আমার মাঝে জমা আছে তোমার সব কিছু । আমার ছড়িয়ে দেয়া কিছু ভালোবাসার মানুষের মাধ্যমে আমি টেস্টটিউব বেবি নিলাম । আমার গর্ভে তোমার সন্তান । তবে প্রাকৃতিক ভাবে নয় । তোমার বন্ধু ডাক্তার সাহেবের পরামর্শে আমি ফার্টিলিটি সেন্টারে গিয়ে গর্ভ ধারণ করি । আমার কোনো উপায় ছিল না তানিম । আমি আর অপেক্ষা করতে পারছিলাম না ।"

"আমি সবকিছু তোমাকে খুলে বলতেও পারছিলাম না । তুমি অনেক কষ্ট পেতে । তোমাকে এতো ভালোবাসি । কিভাবে কষ্ট দেই বলো ? আমাদের সন্তান আসবে আমরা কত আনন্দ করবো । এর মাঝে আমি তোমাকে আমার এই সামান্য গোপন কথা বলে কষ্ট দিতে চাই না । তুমি যদি কখনো এই ভিডিও চুরি করে দেখো তাহলে কিন্তু খবর আছে ।"

খিলখিল করে হেসে উঠলো রিমি ।

ইস্ট লন্ডনের এই রুমটা এখন আজব ধরণের এক গোপনকথার সাক্ষী । শিমুলের মুখটা হা কয়ে আছে . নিঃশাস ছোট হয়ে আসছে । মায়ের ভিডিওটা বন্ধ হয়ে গেলো । নিস্তব্ধ নীরবতা । এভাবে কতক্ষন গেলো শিমুলের জানা নেই । তবে তার এই মুহূর্তে হাত পা নাড়াতে ইচ্ছে করছে না এটা সে ভালোভাবে বুজছে ।

শিমুল জেগে উঠলো কাঁধে নরম এক হাতের ছোয়ায় । প্রেমা, শিমুলের সহধর্মিনী ।

"এই কি করছো ? দেখি কি দেখছো ল্যাপটপে ? দেখি দেখি "

শিমুল প্রায় ঝড়ের গতিতে উঠে দাঁড়ালো আর প্রেমাকে জড়িয়ে ধরলো । প্রেমা বুজলো শিমুল কাঁপছে । কি করবে প্রেমা বুজতে পারছে না ।চুপ করে জড়িয়ে থাকলো শিমুলকে । শিমুল ল্যাপটপটা বন্ধ করে দিলো আর প্রেমাকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চা ছেলের মতো করে কাঁদতে লাগলো । প্রেমা বুজতে পারলো ল্যাপটপের মাজে কিছু একটা আছে । ।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৪ ঠা মার্চ, ২০১৮ সকাল ১০:০৮

আকিব হাসান জাভেদ বলেছেন: সত্য প্রকাশ হবেই । শুরুর আনন্দ আর শেষ পাঠে বিরহ গল্পটা তে জমে উঠেছে। সুন্দর গল্প । ভালো লাগলো পড়ে। সুন্দর++++++

২| ০৪ ঠা মার্চ, ২০১৮ সকাল ১০:৩৮

রাজীব নুর বলেছেন: সহজ সরল ভঙ্গি। ভালো লেখা।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.