নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

অনিরুদ্ধ রহমান

[email protected]

অনিরুদ্ধ রহমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

একা বসে থাকি

২২ শে অক্টোবর, ২০১৪ রাত ৯:০৫

ফেনী থেকে ফেরার পথে শেষ বিদায়ের সময় ’কাহা’ বুকে জড়িয়ে ধরে শুধু বলল এই দুই দিন আমরা সাথে থাকাতে এবারের সফরে শেষ পর্যন্ত সে কিছু একটা পেল।

বুঝলাম অন্যকারো উপর অভিমানেই বলছে একথা। বলতে বলতে গলা ধরে এল তার। হেলপার তারা দিচ্ছিল। বাস চলতে শুরু করাতে আমাকে আর সোহাগকে নামতে হলো। বাস এক টানে চোখের আড়াল হয়ে গেল। বাস থেকে নামতে যেয়ে চোখে ধূলো পড়াতেই কিনা ’কাহা’র চোখের জল আমাদের চোখেও কিছুটা চলে আসল।

আমি আর সোহাগ আরেক বাসে উঠে ঢাকার পথ ধরলাম। ’কাহা’ ওই বাসেই বাড়ির পথ ধরল। কাহা মূলত সোহাগের মামাত ভাই। সমবয়সী হওয়ায় ওদের সম্পর্কও বেশ নিবিড়। আর ভালোবাসার সমারোহ যেখানে ’মফিজ’ হয়ে যায় ’জান’, মৌসুমি হয়ে যায় ’মিয়াও’ সেখানে চাচারা যাই মনে করুক না কেন মামাত ভাই নাহয় ভাই না হয়ে ’কাহা’ই হলো। সোহাগের কাহা, অতএব আমাদেরও।

***

কাহা ছয় মাসের ছুটিতে দেশে এসেছিল এবার। বিদেশ ফিরে যাবার আগে শেষ ক’টা দিন কিছুটা সঙ্গ দিতেই সোহাগের কুমিল্লা যাওয়া। সাথে আমারও।

বিছানার এপাশ থেকে ওপাশ ফিরে শুতেই নাকি ছয়টি মাস কেটে গেল। এবার নিয়ে গত প্রায় আট বছরে দুবার দেশে আসলো ছেলেটা। প্রথমবার এসেছিল পাঁচ বছর পর। এবার আসলো দুই বছর পর। দুই সফরে ছয মাস-ছয় মাস অর্থাৎ সাত বছরে কাজ করে এক বছরের ছুটি।

আট বছরে কিশোরী নারী হয়, নারী হয় মা, শিশু জন্ম গ্রহণ করে স্কুলে যাওয়া শিখে যায়; প্রৌঢ় হয়ে যায় বৃদ্ধ, বৃদ্ধ নেয় চিরতরে ছুটি। আমরা যারা কিশোর ছিলাম, তরুণ ছিলাম আমরা হওয়া শুরু করেছি স্বামী হওয়া-পিতা হওয়া। এই আট বছরে সুদান ভেঙ্গে দু’টুকরো হয়েছে, ক্রিমিয়া ইউক্রেন ছেড়ে যোগ দিয়েছে রাশিয়ার সাথে।

কাহা দেশ ছাড়ার প্রথম পাঁচ বছরেই ওর আপন ভাই, আপন বোনের বিয়ে হলো। বিয়ে-শাদি হলো চাচাতো-মামাতো বোনসহ আরও অনেকের। আমি ওর ফুপাত ভাই এর বন্ধু হিসেবে ঢাকা থেকে যেয়েই তিনটে বিয়ে খেয়েছি। কেবল বিয়ে খেয়েছি বললে ভুল হবে, সেই সব বিয়ের কেনা কাটা, ঘর সাজানো, হলুদের মঞ্চ সাজানো--ঘরের মানুষ হয়ে আমরাই করেছি। সেই ভাই, সেই বোন, সেই চাচাত বোন--সবার কোল আলো করে এসেছে সন্তান, বিদায় নিয়েছে ওর বেশ কজন নিকট আত্মীয়। অথচ প্রবাসে বসে দিনার কামানো ছাড়া কাহা আর কিছুই পায় নি।

এবার এসেই দ্রুত বিয়ের কাজটা সেরে ফেলেছিল। বাংলাদেশে আসার এক সপ্তাহের মাথায় বিয়ে। হাতে সময় খুব কম। বিয়ের মাস খানেকের মধ্যেই ’সুখবর’--বউ বমি-টমি করা শুরু করেছে। বিয়ের পর ছেলে-মেয়েরা নিজেদের মধ্যে ভাব-ভালোবাসার জন্য বছর খানেক সময় নেয়। কিন্তু প্রবাসীর হিসেব অন্যরকম। কেননা একবার গেলে আবার কমপক্ষে দুই বছর। এর মধ্যে জীবনে প্রথমবারের মতো নরমাংসের স্বাদ পাওয়া বাঘিনীর মত ঘরে তরুণী বধূ। অতএব তাকে কোন একটা কাজে ব্যাস্ত রেখে যেতে হবে। পেটে দিয়ে যাওয়া সন্তান হয়তো কোলে এসে তার মন জুড়ে থাকবে। ভুলিয়ে দেবে এককী সময় কাটানোর দু:খ। তাই ভাব ভালোবাসার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো বউ এর স্বল্পতম সময়ে মাথা-ঘুরানো, বমি বমি ভাব হওয়া।

এবার গেলে আবার কবে আসবে জানতে চাইলে কাহা প্রথমে জানালো আঠার মাস। পরে কাটছাট করে বলল পনের মাস। আমি জানি, ও পনের মাসে আসবে না, আসা হয়ে উঠবে না। পনের মাসও যদি ঠিক থাকে তারপরও সব ঠিক ঠাক থাকলে সে আবার আসসে আসতে ওর সন্তানের বয়স হবে প্রায় এক বছর। এক বছর বয়সের সন্তানকে প্রথম দেখবে পিতা, সন্তান প্রথমবার দেখবে পিতা নামের কোন ব্যক্তিকে।

আমার সন্তানের বয়স এখন এক বছর। আমি ভালো করেই জানি সন্তানের বয়স এক বছর হয় কত দিনে। এই এক বছর নিছক ৫২ সপ্তাহ বা ৩৬৫ দিন নয়। সন্তানের প্রথম কান্না, প্রথম হাসি, তার আধো আধো বোলে প্রথম বাবা ডাকা। প্রথম দাঁত ওঠা, দুটি দাতের জন্য তার ছোট্ট ব্রাশ, ছোট বেল্ট, ছোট্ট জুতা কত আনন্দ। প্রথম বসতে শেখা, প্রথম দাড়াতে শেখা, প্রথম হাটতে শেখা। বাবাকে বাবা হিসেবে চেনা, বাবার কাছে আব্দার। সকালে অফিসে যাবার সময় আমার সাথে বাইরে বের হবার তার আকুতি কিংবা রাতে বাসায় ফেরা মাত্র আমাকে দেখে তার যে উদ্ভাসিত মুখ এসব কে দেবে?

তার পরও নতুন বউ নিয়ে গত মাস ছয়েক সময়টা ভালোই কাটার কথা ছিল। হয়তো খুব একটা খারাপও কাটেনি। কিন্তু বউ এর বমি বমি ভাবের পরও কাহার মন খারাপের কারন এই ছয় মাসেই বউ এর সাথে মনমালিন্য। উপায়ান্তর না দেখে এমনকি একবার মেয়েটাকে তার বাবার বাড়ি রেখেও আসা হয়েছে। দুই বছরের জন্য দেশ ছাড়তে কাহার সময় বাকি যখন ঘন্টার হিসেবে তখন এত সব কান্ড। বিষন্ন ছেলেটাকে সঙ্গ দিতেই, দেশ ছাড়ার আগে শেষ কয়েকটা দিন একটু রাঙিয়ে দিতেই তাই আমাদের এই কুমিল্লা যাওয়া। সাথে যোগ দিয়েছিল কাহার কুয়েত ফেরত আরেক বন্ধু।

হাতে সময় আছে আর দিন তিনেক। নববধূ নেই বাড়িতে। দুঃখের মাঝেও কাহা এই স্বাধীনতাটা কাজে লাগাতেই যেন একেবারে আমাদের নিয়ে বের হয়েছিল। প্রথম দিন পুরোটাই নৌকায় চড়ে বিলেই কাটিয়ে দিলাম। এমনকি রাতও কাটালাম নৌকায়। শেষ রাতের দিকে হঠাৎ বৃষ্টি নামায় নৌকা এক মাজারের ঘাটে থামিয়ে চারজন মাজারেই ঘুম দিলাম। পরের দিনও নৌকা নিয়ে সারাদিন বিলে বিলে কাটিয়ে সন্ধ্যায় আমরা গিয়েছিলাম কবি নজরুলের স্মৃতিধন্য দৌলতপুরে। ফেরার পথেই খবর পেলাম কোন এক আত্মীয়কে সাথে নিয়ে বউ নিজেই চলে এসেছে। আজ রাতেও নৌকা নিয়ে আমাদের বিলের মাঝেই ঘুমানোর কথা ছিল। এজন্য প্রয়োজনীয় ’রসদ’ও আমরা সংগ্রহ করছিলাম। হঠাৎই সবকিছু অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেলে।

এদেশে বাড়ি থেকে চলে যাওয়া যত কঠিন একটা মেয়ের জন্য বাড়ি ফেরা তার চেয়ে হাজারগুণ বেশী কঠিন। সেটা নিজের বাড়ি হলেই এই অবস্থা। শ্বশুড় বাড়ি হলেতো কথাই নেই। এ বাড়িতে একটা জরুরি অবস্থা জারি হয়ে গেল। সবাই সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায়। মেয়ের বাবা-চাচাসহ অপরাপর মুরুব্বিদের খবর দেয়া হলো।

রাত একটা পর্যন্ত মিটিং-মিছিল চলল। মূল বক্তা হিসেবে কাহাকে তো মিটিং-এ থাকতে হবেই, সোহাগও একট গাম্ভীর্য নিয়ে মিটিং-এ নিজের একটা আসন পাকাপোক্ত করল। আমি আর কাহার কুয়েত ফেরত বন্ধু দুইজন শুকনো মুখে ঘাটে ভিরানো নৌকায় বসে ঝিমুতে থাকলাম। বাড়িতে সভা-সমিতি, সালিশ-মীমাংসা চলতে থাকল। সালিশ শেষ হতে হতে রাত প্রায় একটা। কাহা দেশে আছে আর মাত্র দুই দিন। আর ঈদের দিন থেকে শুরু করে বউএর সাথে বিরহ চলছে গত চার-পাঁচদিন যাবৎ। এরকম অবস্থায়ও ক্রন্দসী স্ত্রীকে ঘরে অন্ধকারে একা রেখেই মাঝ রাতের দিকে কাহাও আমাদের সাথে ঘাটে বাধা নৌকায় যোগ দিল।

***

বিলের মাঝে নৌকায় আমরা চারজন। মেয়েটার সকল দোষ-গুণ আমি বাদী পক্ষের মুখ থেকেই শুনেছি। অতএব আমার মনেও তার একটা অপরাধী মুর্তি। কিন্তু তার পরও সব কিছুতো মিটমাট হয়েই গেছে। মেয়েটা সমাবেত জনতার সামনে দাড়িয়ে তার কৃতকর্মের জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেছে। তাই কাহা বাড়িতে থাকলেই পারত। আমাদের উচিৎ ছিল কাহাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে রাতটা বাড়িতেই কাটাতে রাজি করানো। কিন্তু তাহলে আমাদের নৌকাটা মাঝ বিলে কে নিয়ে যেত? আমরা বাকি তিনজন নৌকা বাইতে পারিনা। শুধু বিলের মাঝে নৌকায় রাত্রি যাপনের বাসনাতেই এমন রাতেও কাহাকে জোর করে বাড়িতে না পাঠানোর জন্য একটু অপরাধবোধে ভুগতে লাগমাম।

আকাশে তরুণ চাঁদ। সবকিছু ছাপিয়ে হঠাৎই এই অপরাধী মেয়েটার জন্যই আমার মনটা হু হু করে উঠলো। মেয়েটার হাতে অবশিষ্ট মাত্র তিনটি রাতের একটি আমাদের কারণে নষ্ট হলো। দীর্ঘায়িত হলো বহুল প্রতীক্ষিত পুণর্মিলণী। অন্ধকার ঘরে মেয়েটা যে একা একা কাঁদছে তার এই কান্না কি শেষ হবে সহসাই? দিন দুই বাদে স্বামী চলে যাবে বিদেশে। বিয়ের ছয় মাসেই যাকে নিয়ে সালিশে বসতে হয় তাকে কি সহজেই আবার আপন করে নিতে পারবে শ্বশুড় বাড়ির লোকজন? পেটের সন্তান বড় হচ্ছে। শরীরের নিবিড় পরিবর্তনগুলো সে কাকে দেখাবে? অনাগত সেই সন্তান যখন প্রবল আবেগে মায়ের পেটে গুতো মেরে জানান দেবে তার অস্তিত্ব, মা নিঃসঙ্কোচে কাকে বলবে তার পেটে হাত রেখে সেই আনন্দের অংশীদার হতে? মাঝ রাতে সন্তানের ভেজা কাথা পাল্টে দিয়ে, স্তন্যদানে তৃপ্ত করে সে যে পাশ ফিওে শোবে, সেই পাশ ফেরার সেই তৃপ্তি সে কোথায় পাবে? অন্ধকে ফুল-পাখি-চাঁদ চেনানোর মতো করে সে সন্তানকে শেখাতে থাকবে বাবা কী বস্তু, গোলাকার না লম্বা। সেও নিজেও হয়তো স্মৃতি হাতড়ে ফিরবে একই ভাবে--স্বামী কী জিনিস।

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২৩ শে অক্টোবর, ২০১৪ সকাল ১১:০২

দেশ প্রেমিক বাঙালী বলেছেন: পড়ে ভালো লাগলো। তবে লেখাটি বড় অনেক হয়েছে।

২৩ শে অক্টোবর, ২০১৪ রাত ৮:৪৫

অনিরুদ্ধ রহমান বলেছেন: I would have written a shorter letter, but I did not have the time.

--Blaise Pascal,
http://en.wikiquote.org/wiki/Blaise_Pascal

২| ২৩ শে অক্টোবর, ২০১৪ দুপুর ১২:৪৫

কলমের কালি শেষ বলেছেন: :( :( :( দুঃখজনক । মন খারাপ হলো ।

২৩ শে অক্টোবর, ২০১৪ রাত ৮:৪৭

অনিরুদ্ধ রহমান বলেছেন: এখানেই কবির কলমের কালি শেষ হয়ে যায়...

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.