নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বুনোমানুষের ব্লগে স্বাগতম

© তন্ময় ফেরদৌস

তন্ময় ফেরদৌস

একি আজব কারখানা...

তন্ময় ফেরদৌস › বিস্তারিত পোস্টঃ

ছেলেবেলার শব্দসুর

২৭ শে জুলাই, ২০১৭ রাত ১০:৩৩




সাউন্ড রেকর্ডিং এর কাজ চলছে একটা প্রজেক্টের। সাউন্ড ডিজাইনারের সাথে কথা বলতে বলতে, হটাৎ করেই ফ্ল্যাশব্যাকে চলে গেলাম নিজের জীবনের একটা সময়ের। আছে না কিছু পারিপার্শিক ব্যাপার, যা কখনো কখনো স্টিমুলির মত কাজ করে। যেমন ধরুন, কোন ভিজুয়াল, বা গন্ধ, বা কোন চরিত্র। কখনো কখনো এমনকি কিছু শব্দও।

লেট এইটিজ এবং নাইন্টিজের কথা। আমার শৈশব, কৈশর, এবং তারুন্যের একটা বড় অংশ কেটেছে কলোনীতে। অদ্ভুত সুন্দর সেই সব দিনগুলি। কলোনী বা মহল্লা টাইপের যায়গাগুলোর এমন কিছু চমৎকার ব্যাপার ছিলো, যা আজকাল এপার্টমেন্ট কালচারে বড় হওয়া অনেক বাচ্চারাই বুঝতে পারবে না। আমরা থাকতাম মতিঝিলের একটা সরকারি অফিসার্স কোয়ার্টারে। আমাদের ওখানে প্রতিটা বাড়ির সামনেই ছোট হলেও একটা করে খেলার মাঠ ছিলো। ছিলো প্রচুর গাছপালা। বাচ্চারা সেই সব মাঠে খেলতো, আর মুরুব্বিরা হাটাহাটি করতো মাঠঘিরে থাকা টানা রাস্তায়। আর ছিলো বাতাসে ভেসে বেড়ানো নানাবিধ শব্দ। একধরনের সাউন্ডস্কেপ বলা যেতে পারে।

আমাদের কলোনীতে সকাল, দুপুর, রাত্রীর আলাদা আলাদা সাউন্ড ক্যারেক্টার ছিলো। ধরুন আমার সকালটা শুরুই হতো, পাশের বাড়ির আপুর সারেগামা রেওয়াজ কিংবা ‘প্রজাপতি মেলে দিক পাখনা’ গান গাওয়ার চেষ্টায়। ভর দুপুরে বাসার ছাদ থেকে হটাত উড়ে যাওয়া পায়রার শব্দ, সাথে ফেরিওয়ালার চিতকার, শীইইইইইইইল পাটা...ছিলো কলোনীর বুয়াদের চিৎকার করে করে চলে যাওয়ার শব্দ। বিকেলবেলায় বাচ্চাদের চিৎকার চেচামেচি আর ফুটবলের হুইসেল। একটা আচারওয়ালা মামা আসতো, যে খানিক পর পর অদ্ভুত গলায় ডেকে উঠতো, পাগলা পানিইইইইইই। একদম ছোটদের টিলো এক্সপ্রেস, তার এক সাইজ বড়দের ক্রিকেট ফুটবল, আর তার এক সাইজ বড়দের বাসার ছাদে কার্ড খেলায় ঝগড়াঝাটি। কলোনীর পাশেই বাউন্ডারির ওপারে ছিলো হিন্দুপট্টি। সন্ধ্যা নামি নামি করলে, ওখান থেকে শুনা যেতো পূজার উলুধ্বনি। দেখতাম বাইরে রাত কাটিয়ে পরদিন বাসায় ফেরার কারনে কোন এক বড় ভাইকে তার বাবা জুতা নিয়ে সারা কলোনী দৌড়ানি দিচ্ছে। আর চেচিয়ে পাড়া মাথায় করছে তার মা। রাত্তিরে মাঠের এক পাশে কোর্ট করে ব্যাডমিন্টন খেলা, আর আর একটা গ্রুপ হয়তো মাঠের আরেকপাশে বসে গিটার বাজিয়ে গাইছে জেমস এর গান। ফাগুনের বাতাসে ছড়িয়ে পড়তো সেই গানের সুর।

মানে সমস্ত আওয়াজগুলোই ছিলো বেশ ঘনঘটাপূর্ণ। কিছু সময় বাদে, একেবারে শান্তিতে বা নির্জনতায় কোন একটা যায়গায় বসে আছি, এই ব্যাপারটা খুব একটা ছিলো না। এমনকি সবচাইতে মজার সময় ছিলো লোড শেডিং এর টাইমে। পুরো কলোনীর প্রায় সবাই নিমে আসতো নিচে, ছেলে মেয়েরা বন্ধু বান্ধবের সাথে, বাবারা অন্য মুরুব্বিদের সাথে, আর মায়েরা অন্য মায়েদের সাথে। কি দারুন একটা কমিউনিটি। বর্তমানের এই ইন্ডিভিজুয়ালিজমের সময়ে এমনটা আসলে ভাবাও যায় না। আমি নিজেই এখন চিনিনা আমার দুই ফ্ল্যাট পর কে থাকে। ‘প্রতিবেশী’ শব্দটার অর্থ উপলব্ধি করার জন্য পাড়া মহল্লা বা কলোনীর একটা বিশাল অবদান আছে। শুধুমাত্র সাউন্ডস্কেপ দিয়ে এক একটা পাড়াকে আলাদা করে ফেলা যেত। সবাই জানতো কোন বাড়িতে কে কি বলছে, কি ঘটছে।

আবার শীর্ষেন্দুর ছোটদের বইয়ের মত, ছিলো অদ্ভুত সব ক্যারেক্টার। একটা পাগল ছিলো আমাদের কলোনীতে, সারাদিন চেচিয়ে বেড়াতো। এক আঙ্কেল ছিলো, যিনি আবার বাসায় মুরগি পালতো, আশে পাশে গন্ধে ভেড়া যেতোনা ঐ বাসার। একজন দুইজন ছিলো, যারা আবার পার্টি করতো, কোমরে মেশিন নিয়ে ঘুরে বেড়ানো তেমন কোন বড় ব্যাপার ছিলো না। কিন্তু বই পত্তরের ভাষায় তাদের মাস্তান বা সন্ত্রাসী বলা হলেও, সব সময় দেখেছি নিজের পাড়ার মানুষজনের প্রতি তারা সাঙ্ঘাতিক প্রটেক্টিভ ছিলো। আমাদের কলোনীর শীর্ষ সন্ত্রাসিকে দেখেছি, আমার বাবার বাজার হাতে করে বাসায় তুলে দিতে, আমাদের জন্য দেখা হলেই লজেন্স খাইয়ে মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিতো। সোশিও ইকোনমিক ক্লাস একই হলেও, কোন কোন বাসা থেকে শোনা যেত দিদি তেরা দিবার দিওয়ানা, আবার কোন বাসায় শোনা যেত রাগ ইমনের বান্দিশ। কি যে একটা খিচুড়ি ছিলো নানান পদের সাউন্ডের। এমনকি কলোনীর পা ভাঙ্গা কুকুরটার ডাক মনে হয় আমি আজো আলাদা করতে পারবো অন্য সব কুকুরের ডাক থেকে।

কলোনীর যেই শব্দজাল, তার ঘোর আমার এখনো কাটেনি। আমি আজো সহ্য করতে পারিনা প্যা পো গাড়ির সাউন্ড, কিংবা একেবারে নিঝুম নির্জনতা। এই বিচিত্র সাউন্ডস্কেপের আসলে একটা সিগনিফিকেন্স আছে। আর তা হচ্ছে, মানুষ।শব্দ তো আর এমনি এমনি হয় না, তার বেশিরভাগই ছিলো মানব সৃষ্ট। এক একটা গলার স্বর হচ্ছে এক এক ধরনের মানুষের রিপ্রেজেন্টেশন। নানা রকমের, নানান চিন্তার, নানান বয়সের কিছু মানুষ এবং তাদের চারিত্রিক বা সামাজিক বৈশিষ্ট্য আমাকে শিখিয়েছিলো, কি করে কিছু মানুষ মিলে একটা পরিবেশ তৈরি করে, একটা বিশেষ যায়গার মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

যাই হোক, ধান ভানতে শীবের গীত গেলে ফেললাম। তবে মাঝে মধ্যে খারাপ লাগেনা নষ্টালজিয়ায় হারিয়ে যেতে। মনে হয়, আহা, ওটাই ছিলো জীবন।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ৩০ শে জুলাই, ২০১৭ সকাল ১১:৪৮

হাসান মাহবুব বলেছেন: অসম্ভব সুন্দর লেখা। খুব ভালো লাগলো।

তবে লেখাটা দুবার এসেছে। ঠিক করে নিও।

২| ৩১ শে জুলাই, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৩১

বঙ্গভূমির রঙ্গমেলায় বলেছেন:
সহজ ও সাবলীল ভাষায় সুন্দর স্মৃতিচারণ।

এখনকার বাচ্চারা এই রকম পরিবেশ পাবে কোথায়? খুব আফসোস হয়...

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.