নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সাইকেল চালানো স্বাস্থ্যের জন্য ভাল। ইহা ক্ষুধা উদ্রেক করে!

হঠাৎ ধুমকেতু

আমি মহিউদ্দিন খালেদ। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। পড়তে ভালোবাসি। নিজের একটা চিন্তা জগত আছে। সেখানে চারপাশের অনেক কিছু নিয়ে অনেক নিঃশব্দ আলোচনা হয়! সেই আলোচনা গুলোর সাথে বৃহত্তর জগতের সংযোগ ঘটাতে ইচ্ছে করে!

হঠাৎ ধুমকেতু › বিস্তারিত পোস্টঃ

বুবু’র প্রেম

১৭ ই জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ১১:২১

ছোট বেলায় আম্মার মুখে শোনা একটা অন্যরকম প্রেমের গল্প হঠাৎ মনে পড়ে গেল।গল্পটা যেভাবে শুনেছি সেভাবেই বলছি। বর্ননার খাতিরে কিছু রূপকের আশ্রয় নেয়া ছাড়া এখানে আমার নিজস্ব কোন বক্তব্য নাই।

ঘটনার সময়কাল উনিশ শ পঞ্চান্ন সাল এবং ঘটনার যিনি নায়িকা তাকে আম্মা বুবু বলে ডাকতেন। গ্রামের সম্ভান্ত মুসলিম পরিবারের এই বালিকার বয়স যখন পনের তখন তার বিয়ে হয় একই গ্রামের বাইশ বছর বয়েসী এক যুবা পুরুষের সাথে। বুবু ছিলেন শান্ত স্বভাবের এবং শ্যাম বর্ণের মায়াবী চেহারার মেয়ে। বুবুর বর ছিলেন টকটকে গৌর বর্ণের খড়গনাসা দীর্ঘাঙ্গি পুরুষ। সেই বয়সেই তার কাছে লাইসেন্স করা বন্দুক ছিল এবং তিনি নিয়মিত শিকার করতেন।

বুবুর পেটে যখন দ্বিতীয় বারের মত বাচ্চা এসেছে তখন তার শিকারি পুরুষ স্বামী পাশের কোন এক গাঁয়ে শিকারের উদ্যেশ্যে গিয়ে নিজেই শিকার হয়ে গেলেন! আগুনের মত রূপ(!) এক কিশোরী স্নান সেরে পুকুর ঘাট থেকে ফিরছিল। দেখে উনার মাথায় বাজ পড়ল! সেই বাজ পড়ার ঘটনা গ্রামে খুব দ্রুত ই জানাজানি হয়ে গেল এবং সবাই সেটাকে খুব স্বাভাবিক ভাবে নিল। বৌ যখন পোয়াতি তখন যুবক স্বামীর অন্য রূপবতী নারীর দিকে চোখ পড়া এবং তাকে বিয়ে করে ফেলাকে সাধারণ ঘটনা হিসেবেই তখন দেখা হত। ছেলে যদি অবস্থাপন্ন হয় আর মেয়ে যদি দরিদ্র পরিবারের হয় তাহলে কোন প্রকার ঝামেলা ছাড়াই ‘শুভকাজ’ সম্পন্ন হতে পারত।

এক্ষেত্রেও কোনরূপ ঝামেলা ছাড়াই বুবুর বরের দ্বিতীয় বিয়ের আয়োজন চলতে লাগল। বুবুর বর সকাল বেলা বুবুর বানানো চালের পিঠা দিয়ে নাস্তা করে নতুন বৌয়ের বিয়ের শাড়ি এবং গয়না বাছতে ঘোড়ায় চড়ে রওনা হন শহরের দিকে। ঘোড়ার পিঠে সপাং করে চাবুক কষাতে কষাতে ‘নিকট ভবিষ্যতের এক উত্তেজনাপূর্ন বাসর কল্পনা’ ঘোড়ার পিঠের উপরেই তাকে অস্থির করে তুলে! অবলা ঘোড়ার পিঠে তিনি আবার সপাং করে চাবুক কষান।

এসব জীবন সিনেমার এই ক্লাইম্যাক্সে বুবুর ভূমিকায় যিনি থাকেন তিনি হয় অতি ধার্মিক হয়ে যান অথবা অপ্রকৃতস্থ আচরণ শুরু করেন। স্বামীর হবু স্ত্রীর জন্য ফুলের মালা গাঁথতে বসেন অথবা দিন রাত লাল শাড়ি পরে বসে থাকেন এবং যখন তখন পান খেয়ে ঠোঁট লাল করেন।স্বামীর দ্বিতীয় বিয়েতে তিনি যে কিছুই মনে করেন নাই(!) সেটা বোঝানোর জন্য স্বামীর বেশি বেশি সেবা যত্ন শুরু করেন এবং দেখে সবাই বলাবলি করে-বাহ বাহ, একেবারে বেহেশতি মেয়েছেলে!!

এক্ষেত্রে সবাই অবাক হয়ে লক্ষ্য করল বুবুর মধ্যে সেধরনের কোন পরিবর্তন নাই। বুবু যেন ঠিক আগের মতই আছেন! শুধু আগের চেয়ে খানিক টা নির্বাক, খানিকটা বিষণ্ণ! তবে সেই নির্বাকতা বা বিষণ্ণতা সবার চোখে পড়েনা। যাদের অনুভূতি অন্যদের চেয়ে খানিকটা উন্নত এবং যারা বুবুর খুব কাছের মানুষ তাদের ই হয়ত বা চোখ এড়ায় না। সেই সময় আমার আম্মার বয়স পনের বছর এবং আম্মা ছিলেন বুবুর খুব আপন মানুষ। একদিন দুপুরের আগে আগে আম্মা বুবুকে ধরে বসলেন!

বুবু, তুই সবার থেকে লুকাতে পারিস। আমার থেকে না! তোর মনের মধ্যে কি চলছে আমাকে বলতে হবে! বলতেই হবে!!

বুবু চমকে উঠে অজানা এক অভিমানে আগুনের মত জ্বলতে থাকা তার এই কনিষ্ট সহোদরার দিকে তাকালেন! তারপর স্মিত হেসে বললেন- সাজু! ‘ছবর’ এর মধ্যে কি আছে আমি দেখতে চাই। রিজু’র বাপের যা ইচ্ছে হয় করুক, আমি ছবর করব। ছবরের মধ্যে কি আছে আমি দেখব!!

আম্মা অনেক কাকুতিমিনতি করেও বুবুকে এর চেয়ে বেশি কিছু বলাতে পারলেন না। বুবু গোছল করে পরিষ্কার শাড়ি পরে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গীতে যোহরের নামাজ পড়লেন।দুহাত তূলে অনাগত সন্তানের জন্য আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করলেন। তারপর খাওয়া দাওয়া করে হাণ্ডি ডেকচির প্রয়োজনীয় তদারক করে জর্দা ছাড়া পান মূখে দিয়ে শুতে গেলেন।

দেখতে দেখতে ‘শুভ কাজ’ এর দিন ঘনিয়ে আসল। কনে বাড়ীতে কনের জন্য কন্ঠার ছড়া,হাতের মোটা বালা, গোড়ালিতে পরার খাড়ু ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছে। বলাবাহুল্য সবই সোনার! নিতান্তই মুসলিম পরিবার দেখে বাইজী নাচের ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। কিন্তু বিয়ে উপলক্ষে গ্রামের সবাইকে ‘তামাশা’ দেখানোর ব্যবস্থা হবে। আর গ্রামের যেসব যুবক ‘একেবারেই বখাটে’ তামাশা দেখার পর একটু ‘শরাব’ পান না করলে তাদের ঘুম আসবে কিভাবে??

‘শুভ দিনে’ বুবুর বর পাগড়ি শেরওয়ানী পরে কনের বাড়িতে উপস্থিত। কনের বাড়িতে দুলহা’র জন্য খানাদানার এলাহি আয়োজন। ঘরের সবচেয়ে বড় ‘রাতা’ জবাই করে ‘দুরুচ কোরা’ বানানো হয়েছে। সেই দুরুচ কোরা শুধু দুলহা’র পাতে দেয়া হবে।

বুবুর কাছে সব খবর যায়। বুবু নির্লিপ্ত মুখে অনাগত সন্তানের জন্য কাঁথা সেলাই করে। রেজোয়ান অর্থাৎ রিজু সবেমাত্র ধুলাবালিতে হামাগুড়ি দেয়া শুরু করেছে। হামাগুড়ি দিতে দিতে ফ্যাঁত করে নাক দিয়ে সিকনি বের করে। বুবু একহাতে রিজুর মাথার তালু ধরে আরেক হাতে নাকের সিকনি মুছে দেয়।

বরপক্ষের দেয়া টকটকে লাল রঙের শাড়িতে কনে কে সাজানো হয়েছে।ঘোমটা দেয়া কিশোরী বঁধু ঘোমটার আড়াল দিয়ে দোর্দন্ড প্রতাপশালী হবু স্বামীর দিকে তাকাল। কিন্তু কোথায় কি??

চব্বিশ বছরের টগবগে যুবকের দৃষ্টিতে প্রেম বা কাম কিছুই নেই! যেন এক উদ্ভ্রান্ত উন্মাদের দৃষ্টি!!

কাজী কিতাব খুলে বললেন, মিয়া সাব বলেন কবুল!

দুলহা বসা থেকে লাফ দিয়ে উঠলেন! হারামজাদা!! তোরা আমারে জাদু করছস, বিয়া আমি করতাম না!!

সবাই বিস্ময়ে বিমূঢ়! কি হল!! দুলহা মিয়ার বংশে পাগল আছে বলে ত কেউ কখনো শুনেনি!

কনে মুর্ছিত। কনের বাবা মা অপমান এবং আতঙ্কে এতটুকু! গরিব ঘরের মেয়ে। মানুষ যখন শুনবে বিয়ে করতে এসে জামাই বিয়ের আসর থেকে উঠে চলে গেছে তখন কলঙ্ক রটাতে দেরি করবে না। মেয়ে যেহেতু সুন্দরী কলঙ্ক ছড়িয়ে পড়বে আগুনের চেয়ে দ্রুত গতিতে!

দুলহার জন্য সাজিয়ে রাখা দুরুচ কোরার রুপার থাল লাথি মেরে উল্টে ফেলে দুলহা হন হন করে কনেবাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। হাটবার দেখে বিয়ের তারিখ ঠিক হয়েছিল। হাটের নিজস্ব খলিফার দোকানে গিয়ে শেরওয়ানী পাগড়ি ছেড়ে কুর্তা পাজামা পরলেন। হাট থেকে নিজে দেখে বড় শিং মাছ কিনলেন। কালি জিরা কিনলেন। বড় দেখে লাউ কিনলেন। এসব খেলে বুকে দুধ আসে! তারপর ঘোড়া ছুটিয়ে বাড়ির পথে রউনা দিলেন।

বুবুর বর কে কনের পরিবর্তে বাজারের থলে কাঁধে ঘোড়া থেকে নামতে দেখে সবাই বিস্মিত! শুধু বুবুর মুখ ভাবলেশহীন। আসন্ন প্রসবা বুবু ভারী লাউ নিজের হাতে ধরতে চাইলে বুবুর বর বুবুকে কড়া ধমক দিলেন- এই অবস্থায় তুমি ভারী জিনিষ আলগাচ্ছ! তোমার কি আক্কেল বলে কিছু নেই?

সবাই কে অবাক করে দিয়ে সেদিন বুবুর বর বুবুকে পাশে বসিয়ে দুপুরের খাবার খেতে বসলেন। বেড়ার ফাঁক দিয়ে উকি দেয়া নানান রকম(!) আবেগে আচ্ছন্ন অনেকগুলো চোখের সামনে নিতান্ত লাজলজ্জার মাথা খেয়ে হাত দিয়ে মুখে তুলে বুবুকে ভাত খাইয়ে দিলেন বুবুর বর!

বুবুর ‘ছবর’ এর ভাণ্ড সম্ভবত শেষ হয়ে আসছিল। কাজেই বেড়ার ফাঁক দিয়ে যারা উঁকি দিচ্ছিল তাদের অনেকেই দেখতে পেল বুবুর চোখ দিয়ে টপ টপ করে অশ্রুর ফোঁটা ভাতের থালার উপর পড়ছে।


বুবু অথবা বুবুর বর কেউ আজ আর বেঁচে নেই। কিন্তু এই অদ্ভুত ভালোবাসার গল্পটা তাঁদের দুজনের ঘরভর্তি সন্তান এবং নাতি নাতনিদের মধ্যে বেঁচে আছে!

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ১৮ ই জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ১২:৩১

আজকের বাকের ভাই বলেছেন: লেখাটি ভাল লাগল।
কিন্তু সেই রূপসী যুবতীটির কী হলো জানা হলো না। যেই লোকটি আপনার গল্পের নয়ক সেই লোকটিই রমনীটির পরিবারের সবচেয়ে বড় দুশমন।

১৮ ই জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ১২:৪১

হঠাৎ ধুমকেতু বলেছেন: এই ব্যাপারে আমি আপনার সাথে একমত। গল্পের নায়ক তার সবচেয়ে বড় দুশমন সন্দেহ নাই। কিন্তু মেয়ের বাবা মা র কি এতে দায় নেই? তখনকার সমাজ এর মুর্খতাও মাথায় রাখতে হবে। তখনকার তুলনায় এখনকার সমাজ কি আসলেই আগাইছে নাকি মোড়ক পাল্টাইছে সেটাও দেখতে হবে।

ধন্যবাদ বাকের ভাই!

২| ১৮ ই জানুয়ারি, ২০১৫ দুপুর ১২:২৯

হাসান মাহবুব বলেছেন: অদ্ভুত এক কাহিনী পড়লাম।

২০ শে জানুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৫:১৪

হঠাৎ ধুমকেতু বলেছেন: ধন্যবাদ হাসান মাহবুব ভাই। গল্পটা লিখার সময় ও বেশ অদ্ভুত অদ্ভুত লাগছিল!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.