নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সাইকেল চালানো স্বাস্থ্যের জন্য ভাল। ইহা ক্ষুধা উদ্রেক করে!

হঠাৎ ধুমকেতু

আমি মহিউদ্দিন খালেদ। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। পড়তে ভালোবাসি। নিজের একটা চিন্তা জগত আছে। সেখানে চারপাশের অনেক কিছু নিয়ে অনেক নিঃশব্দ আলোচনা হয়! সেই আলোচনা গুলোর সাথে বৃহত্তর জগতের সংযোগ ঘটাতে ইচ্ছে করে!

হঠাৎ ধুমকেতু › বিস্তারিত পোস্টঃ

বইমেলার সবখানে ছোপ ছোপ রক্ত

০৪ ঠা মার্চ, ২০১৫ রাত ১১:২৬


তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। আমার বন্ধু হারুনের কাছ থেকে চেয়ে নিলাম সবুজ মলাটের একটি বই। বইয়ের নাম আশি দিনে বিশ্ব ভ্রমণ। লেখকের নাম জুলভার্ন। এই বইটা আমাকে আনন্দ জগতের একটা রাস্তা চিনিয়ে দিল। মধ্যবিত্ত বাড়ির আধো অন্ধকার একটা ঘরের চৌকির উপর শুয়ে শুয়ে আমার বিশ্বভ্রমণ শুরু হল। স্কুলের বেঞ্চিতে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, লেখাপড়ায় ভাল অন্য ভাইবোনদের আমাকে নিয়ে সীমাহীন লজ্জায় পড়তে হয়,চট্টগ্রাম বিভাগের তৎকালীন সময়ের বখে যাওয়া ছেলেমেয়েদের ঠিকানা কুমিরা স্কুলে আমাকে পাঠানোর একটা ভয়াবহ চিন্তাও সম্ভবত আব্বা আম্মার মনে উঁকি দিয়ে যায়! কিন্তু রবিন্সন ক্রোশো, আঙ্কল টমস কেবিন, ডেভিড কপারফিল্ড, পিটকেয়ার্ন্স আইল্যান্ড, ক্রীতদাসের হাসি পড়ে আমি যে মজা পাই সেটা মুখস্তের অঙ্ক, বিজ্ঞান পড়ে কিছুতে পাই না। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বই পড়া প্রতিযোগিতার ফলাফলের দিন যখন বলে চতুর্থ স্থান দখল করেছে মহিউদ্দিন খালেদ( উল্টা দিক থেকে বলে আসত। দশম হয়েছে তমুক, নবম হয়েছে অমুক ইত্যাদি) তখন আমি পরম কৌতূহল নিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকি। নিশ্চয় আমাদের কক্সবাজারে আরেকজন মহিউদ্দিন খালেদ আছে! সে নিশ্চয় স্কুলে আমার মত দুতিন সাবজেক্টে ফেল করে না।

খানিকটা বড় হবার পর অর্থাৎ ষোল সতের বছর বয়সে আমি ব্যাপার টা বুঝতে পারি। গল্প বই গুলো আমার উপর কেউ চাপিয়ে দেয়নি। আমি সম্পুর্ন নিজের ইচ্ছায় পড়েছি। যে বইটা পড়তে গিয়ে ভাল লাগেনি সেটা কখনোই পড়িনি। যেটা আমাকে চুম্বকের মত টেনে ধরেছে সেটা আমার খাওয়া, গোসল এমন কি ছাদে উঠে ঘুড়ি উড়ানো অথবা সাইকেলে চড়ে সমুদ্র চরে যাবার বারটা বাজিয়েছে। সেইরকম বইগুলো যুক্ত হয়ে গিয়েছিল আমার মননের সাথে। এবং সেই বইগুলোর নির্যাস, সেই বইগুলো লেখার সময়ে তৈরি হওয়া লেখকদের মহত্বম বোধগুলোর কিছু কিছু যুক্ত হয়ে গিয়েছিল আমার নিজের মননের সাথে। এবং নিজের মননের সাথে সংযুক্ত হয়ে যাওয়া সেই বোধ গুলোই কিছুটা হলেও আমার মানসিকতাকে উন্নত করেছে। আমি মানুষ কে অনুভব করতে শিখেছি। আমি কোন ঘটনার নেপথ্যে কারন খুঁজতে শিখেছি। মানুষ কে ক্ষুদ্র গণ্ডিতে আবদ্ধ না করতে শিখেছি।

খানিকটা বড় হবার পর স্কুলের পরীক্ষায় ফেল করার কারণ আমার কাছে স্পষ্ট হয়েছে। আমি স্পষ্ট বুঝতে পেরেছি এর কারন আমার মেধাহীনতা নয়। স্কুলের প্রথাগত পড়ার পদ্ধতি আমাকে গণিতের আনন্দের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় নি। বিজ্ঞানের প্রশ্নের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়নি। নিউটনের ‘অত্যাশ্চর্য্য মনন’ এর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়নি। নিরেট নির্মমতার সাথে কেবল মুখস্ত করিয়েছে- ‘বস্তুর ভরবেগের পরিবর্তনের হার বস্তুর উপর প্রযুক্ত বলের সমানুপাতিক!’ এই প্রহসন বুঝতে পারার পর আমার মনের সংসদে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার উপর সম্পুর্ন অনাস্থা প্রস্তাব এনে আমি নিজের মত করে অঙ্ক বিজ্ঞান পড়তে শুরু করেছি। নিজের মত করে পড়ার ফলে খুব সামান্য হলেও গণিত এবং বিজ্ঞানের বিশাল আনন্দ এবং ছন্দময় জগতকে আমি নিজের ভেতর অনুভব করেছি। খুব দুর্লভ কোন কোন মুহুর্তে আমার মনে হয়েছে- আমি যেন সম্পূর্ন বিশ্ব ব্রক্ষান্ডের সাথে সংযুক্ত।মুক্ত অনুভবের সেই অসাধারণ প্রশান্তির মুহুর্তে আমি অনুভব করেছি মহান সৃষ্টিকর্তা আমাদের খুব কাছটিতে অবস্থান করেন এবং স্রষ্টার কাছে কিছু চাইলে আমরা পেতে পারি!

স্রষ্টার কাছে চেয়ে কিছু পাবার এই বোধ আমাকে সাংসারিক অনিশ্চয়তাবোধ থেকে খানিকটা হলেও মুক্তি দিয়েছে এবং আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি ও কল্পনা করেছি আমি লেখালেখি করব। সেই কল্পনা এবং সিদ্ধান্ত প্রথম বারের মত বাস্তবায়ন হয়েছে এবারের একুশে বইমেলায়। এবারের একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে আমার প্রথম বই। কিন্তু এই লেখার উদ্যেশ্য বই এর বিজ্ঞাপন করা নয়।

বইমেলায় প্রথম বারের মত আমার বইটার মুখোমুখি হবার সুযোগ আমি পাই সাতাশে ফেব্রুয়ারি রাত আট টায়। প্রথম বই ছাপা হবার পুরা সময় টুকু একজন লেখক পুরোপুরি ঘোরের মধ্যে থাকে এবং একুশে বইমেলায় বইয়ের স্টলে গিয়ে নিজের বই দেখা, সেই বইয়ের সাথে ছবি তোলা যে কিরকম একটা ব্যাপার সেটা এই বিষয়ে যার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে তিনি নিশ্চয় জানেন। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা হল সম্পূর্ন ভিন্ন রকম। টিএসসির মুখে রিকশা থেকে নেমে আমি যখন বইমেলার দিকে আগাচ্ছি তখন সেখানে মশাল মিছিল। ব্যানার হাতে প্রতিবাদ সভা। লেখক অভিজিত রায়কে আগের দিন রাতে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তার আশৈশব স্মৃতি বিজড়িত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। প্রতিটা পদক্ষেপের সাথে আমার হৃৎপিণ্ডে ধড়াস ধড়াস শব্দ হচ্ছে। আমার ভিজুয়াল হেলুসিনেশন হচ্ছে। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি বইমেলার সবখানে ছড়িয়ে আছে ছোপ ছোপ রক্ত। অভিজিত রায় এর ছোপ ছোপ রক্ত ছড়িয়ে আছে বইমেলার প্রতিটা বইয়ের মলাটে, মেলায় আসা প্রতিটা মানুষের ললাটে। সভ্য সমাজের সমস্ত নিয়ম নীতি লঙ্ঘন করে একজন মানুষ কে খুন করা হয়েছে-এই সত্য একুশে বইমেলার আত্মাকেই যেন জবাই করে দিয়েছে। উৎসবের রঙ মুছে গিয়ে চারদিকে নেমে এসেছে শ্মশানের অন্ধকার।

অনেক কষ্টে নির্জনতা খুঁজে নিয়ে আমি একটি সিগারেট ধরাই। নিজেকে খুব নির্মম একটা প্রশ্ন করি। আচ্ছা আমি ত অভিজিত রায় এর লেখার বক্তব্যের সাথে একমত নই। আমার কখনোই মনে হয়নি ধর্ম বিশ্বাস একটা ভাইরাস। ধর্মান্ধতা বাদ দিলে ধর্ম মানুষের অন্তর কে মহৎ করে বলেই আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় আমি প্রমাণ পেয়েছি। তাহলে অভিজিত রায় এর মৃত্যু আমাকে এত কষ্ট কেন দিচ্ছে? নির্মম প্রশ্নের জবাব হয় নির্মোহ। আমার অন্তর থেকে যে নির্মোহ জবাব আমি পেলাম সেটা হল-শৈশব এবং কৈশোরে আমার মননের সাথে যুক্ত মহত্বম বোধ গুলোই এর কারন। যে মানুষের মন জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে কোন না কোনরূপ মহত্বম বোধের আনন্দে সিঞ্চিত হয় সেই মানুষের মন কখনো মানব হত্যাকাণ্ড মেনে নিতে পারেনা।

আমরা প্রতিটা মানুষ ভিন্ন। প্রতিটা মানুষের শৈশব ভিন্ন। বেড়ে উঠা ভিন্ন। চিন্তার ধরন ভিন্ন। মহান স্রষ্টা চাইলে একজন মানুষকে আরেকজন মানুষের ফটোকপি হিসেবে পৃথিবীতে পাঠাতে পারতেন। তিনি সেটা করেন নি। করেন নি বলেই প্রতিটা মানুষ কে তিনি ভিন্ন চেহারা, ভিন্ন মেধা, ভিন্ন চিন্তাশক্তি এবং ভিন্ন চিন্তাধারা দিয়ে পাঠিয়েছেন। এই ভিন্নতাকে শ্রদ্ধা করা মানে স্রষ্টার সৃষ্টি বৈচিত্র্য কে শ্রদ্ধা করা। এবং এই ভিন্ন চিন্তাধারাগুলোর মধ্যে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যম হল যুক্তি এবং অনুভব(অনুভবহীন যুক্তি এবং যুক্তিহীন অনুভব দুটোই আমার কাছে অসাড় মনে হয়)।

যুক্তি এবং অনুভবের শক্তিতে পৃথিবীকে সমন্বিত করার লক্ষ্যে যে মুহুর্তে পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে সে মুহুর্তে আমাদের দেশে মধ্যযুগীয় বর্বরতায় বইমেলায় খুন হয়ে যান একজন লেখক। যেই বইমেলা রঞ্জিত হয় লেখকের রক্তে সেই বইমেলা দিয়ে আমরা কি করব?

মন্তব্য ২ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৫ ই মার্চ, ২০১৫ বিকাল ৩:২৫

হাসান মাহবুব বলেছেন: মৌলবাদীদের সিরিয়াল কিলিং চলছে চলবে! কিন্তু কারো কোনো শাস্তি হয় নি, হবেও না।

০৫ ই মার্চ, ২০১৫ বিকাল ৪:৩২

হঠাৎ ধুমকেতু বলেছেন: এই কঠিন বাস্তবতা আমাদের গলা টিপে ধরছে প্রতিদিন। আতঙ্কিত পশুর জিবনযাপন আমরা মেনে নিয়েছি। মৃত্যুর আগেই আমরা নিহত হয়ে আছি। তবে আশার জায়গা হচ্ছে কথা বলার স্থান টা এখন বিস্তৃত। কথার শক্তি অসীম। কথাই আশা যোগায়!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.