নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সাইকেল চালানো স্বাস্থ্যের জন্য ভাল। ইহা ক্ষুধা উদ্রেক করে!

হঠাৎ ধুমকেতু

আমি মহিউদ্দিন খালেদ। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। পড়তে ভালোবাসি। নিজের একটা চিন্তা জগত আছে। সেখানে চারপাশের অনেক কিছু নিয়ে অনেক নিঃশব্দ আলোচনা হয়! সেই আলোচনা গুলোর সাথে বৃহত্তর জগতের সংযোগ ঘটাতে ইচ্ছে করে!

হঠাৎ ধুমকেতু › বিস্তারিত পোস্টঃ

সঙ্গম তত্ত্ব এবং এক ফোঁটা নোনা জল

২২ শে জুলাই, ২০১৫ বিকাল ৩:১৬



‘আমি আত্নহত্যা করব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি’ আমার দিকে তাকিয়ে বাবু এমনভাবে কথাটা বলল যেন গার্লফ্রেন্ড কে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে! দীর্ঘ প্রণয় শেষে পরিণয়ের সিদ্ধান্ত। বাবুর ঝাঁকড়া চুল গুলো কপালের উপর থেকে সরিয়ে দিতে দিতে আমি বললাম-বাবু তুই আগে ফ্রেশ হয়ে নে। লম্বা জার্নি করে আসছিস। লুঙ্গি টাউয়েল নিয়ে বাথরুমে ঢুকে যা। আমি ভাত চড়িয়ে দিচ্ছি। তোর ভাবী যাওয়ার সময় বলছিল ডীপ ফ্রিজে গরুর মাংসের কালা ভুনা আছে।কালা ভুনা গরম করে নিচ্ছি।

বাবু ওর ইয়াবড় ট্রলি ব্যাগ খুলে লুঙ্গি টাউয়েল বের করল। আড়চোখে খেয়াল করলাম বই পাগল বাবুর ট্রলি ব্যাগের ভেতর অনেকগুলো বই যার একটির নাম ‘হাউ টু কমিট সুইসাইড’!বুঝলাম সব কাজে অতি প্রফেশনাল বাবু আত্নহত্যা করতে গিয়েও কোন ভুল করতে রাজী না। গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়লাম, অথচ দড়ি যথেষ্ট শক্ত না হওয়ায় ছিঁড়ে পড়ে গেল- এ ধরনের কাঁচা কাজ বাবু করবে না।
-‘বাবু, বাথরুমে আত্নহত্যার কোন পদ্ধতি বইয়ে লেখা নাই ত?’ আমার একথার জবাবে বাবু হাসল। তারপর আমাকে আশ্বস্ত করে বলল- টুবলু ভাই তুমি কোন চিন্তা করিও না। তোমাকে আমি বিপদে ফেলব না। আজকে ত বৃহস্পতিবার। আগামী রোববার রাতে পানি তে ডুবে আত্নহত্যা করব। হাজার হোক আমি একজন বুয়ে্টিয়ান। পানিতে ডুবে মরাটা আমার সাথে যায়!

চুলায় ভাত চড়ানোর সময় খেয়াল করলাম নিজের অজান্তেই ভাতের ডেকচির ভেতর আমার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ল। বাবুর সাথে আমার মণিপুর স্কুল থেকে পরিচয়। বুয়েটে আমি যখন ফোর্থ ইয়ারে পড়ি বাবু তখন ফার্স্ট ইয়ারে। নজরুল ইসলাম হলে টেবিল টেনিস টুর্নামেন্টে ডাবলসে বাবু ছিল আমার পার্টনার। আমি আর বাবু জুটি ছিলাম আন্তঃহল চ্যাম্পিঅন। টেবিল টেনিস ছাড়াও বাবু ক্রিকেট খেলত।বুয়েটে ভর্তি আর ক্লাস শুরুর মাঝখানের এক বছরের গ্যাপে বাবু বাংলাদেশ বিমানের হয়ে লিগ খেলেছে। সব কিছু বাদ দিয়ে বাবু যদি শুধু ক্রিকেট খেলত তাহলে বাবু যে দেশ সেরা একজন অফ স্পিনার হত এটা নাকি মীনহাজুল আবেদিন নান্নু একবার বলেছিলেন! খেলাধুলা ছাড়াও বাবুর প্রকৃতি এবং মহাকাশ বিজ্ঞানে আগ্রহ ছিল। নজরুল ইসলাম হলের লাইব্রেরী তে মহাশূন্যের উপর লিখা ‘খগোল পরিচয়’ নামক থান ইট সাইজের একটা বই ছিল। একবার একটা পিএল এর অর্ধেক টা আমি বাবুকে এই বই পড়ে কাটাতে দেখেছিলাম। ‘কি রে বেটা এসব না পড়ে চোথা পড়। ফেল করবি ত!’ আমার এ কথার জবাবে বাবু বলেছিল- আমার লক্ষ্য হচ্ছে আড়াই জিপিএ নিয়ে বুয়েট পাশ করা। এর চেয়ে বেশি জিপিএ পেলে আমি ইন্সাল্ট ফিল করব। আমি মনে করব তুচ্ছ পার্থিব সুখ স্বাচ্ছন্দ্য লাভের ডিগ্রির পেছনে আমি প্রয়োজনের অতিরিক্ত সময় দিয়েছি।

- প্রয়োজনীয় সময় কি খগোল পরিচয় পড়ে ব্যয় করবি?
- গ্র্যান্ড ডিজাইন অভ ইউনিভার্স আমাকে বুঝতে হবে। ধর্ম-রাজনীতি-সমাজ-সংস্কৃতি মানুষের একশন কে কিভাবে নিয়ন্ত্রন করে আমাকে বুঝতে হবে।
- তোর ত দেখি জ্ঞানী হবার শখ!
- আমি জ্ঞানী হলে তোমরা মূর্খ দের কি সমস্যা?
- শাআলা!
- কোন সম্ভাবনাই নাই টুবলু ভাই।তুমি ত জানই আমি বাবা মার একমাত্র ছেলে!

ভাত পুড়ার গন্ধে আমি নস্টালজিয়া থেকে বাস্তবে ফিরে এলাম। বাবু বাথরুম থেকে গোসল করে বেরিয়েছে। সাতাশ বছর বয়সী ছেলেটার ছিপছিপে পেশিবহুল শরীরে টগবগ করছে প্রাণ! আর ঠিক দুদিন পরে এই দেহটা নিস্প্রান হয়ে যাবে। গভীর কোন নদী বা সমুদ্রের তলায় মাছে খুবলে খাবে এর হাত পায়ের তালু, চোখ! প্লেটে ভাত বাড়তে বাড়তে আমি জিজ্ঞেস করলাম-
-বাবু পানিতে ডুবে আত্নহত্যা করবি বলছিস। কোথায় ডুব দিবি সেটা ত বললিনা?
- কক্সবাজারে সমুদ্রের পানিতে ডুব দেব। পরশুদিন অমাবস্যা। ভাটার গভির টানে চলে যাব সমুদ্রের তলায়।
- ফা ফা ফাজলামি করছিস না ত!
- আত্নহত্যা করাকে তুমি ফাজলামি বলছ?
-না মানে আত্নহত্যার কথা কি কেউ এত সহজ ভাবে বলতে পারে!
- দেখ টুবলু ভাই। তুমি ভাল করেই জান আমি যুক্তিবাদি মানুষ। আমি আমার জীবনের কষ্টগুলোকে আগে পরিস্কার নিক্তিতে মেপেছি।তারপর হিসাব করেছি আত্নহত্যা করতে গিয়ে আমি কতটুকু কষ্ট অনুভব করব। যখন আমি পরিষ্কার বুঝতে পেরেছি বেঁচে থাকাটাই আমার জন্য বেশি কষ্টকর তখন আত্নহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই সিদ্ধান্ত নেবার ফলে আমি মানসিক ভাবে চাপমুক্ত হয়েছি। আমার প্রতিটা মুহুর্ত কাটছে ‘ইন্টেলেকচুয়াল প্লেজার’ নিয়ে।
- ইন্টেলেকচুয়াল প্লেজার?
- মানুষ যখন জীবন সম্পর্কে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে তখন সে ইন্টেলেকচুয়ালি ফুলফিলড থাকে। ইন্টেলেকচুয়ালি ফুলফিল্ড থাকলেই মানুষ সত্যিকারের বেঁচে থাকার আনন্দ পায়।
- তুই তাহলে বলতে চাচ্চিস তুই বেঁচে থাকার আনন্দ পাচ্ছিস?
- হ্যাঁ।
- অথচ তুই আত্নহত্যা করতে চাচ্ছিস!
- হ্যাঁ আত্নহত্যা করাটাই এখন আমার জন্য বেঁচে থাকা। আর বেঁচে থাকা মানে মৃত্যু যন্ত্রনা ভোগ করা।
- নাহ! বুঝতেছি না।
- স্বাভাবিক মস্তিষ্কে বুঝবে না। লাল পানি খেতে হবে। ভাবী না থাকলে ত লাল পানি খাও, নাকি?
-বাসায় খাই না।
- চল তাহলে বারে যাই। কালা ভুনা টা সেরকম হইছে। লাল পানির সথে খুব ভাল জমত। টিফিন ক্যারিয়ার আছে? কালা ভুলা কয়েক টুকরা নিয়ে নেই!

টিফিন ক্যারিয়ারে সালাদ সহ কালা ভুনা ভরে আমার কলাবাগানের বাসার অদূরে ‘এরাম’ এ চলে গেলাম। অন্ধকার রুমের মধ্যে সারি সারি টেবিলে ঢালাও পানের ব্যবস্থা। দুপাশের দেয়ালের টিভিতে লাইভ ক্রিকেট খেলা হচ্ছে। বাংলাদেশ বোলিং করছে। উইকেট পড়লেই গ্লাস ঠুকার শব্দ। কোনার দিকের তুলনামূলক নিরিবিলি একটা টেবিল বেছে নিয়ে আমি আর বাবু বসলাম।
‘টিচার্চ হুয়িস্কি, আপাতত ছ টা দাও, খালি প্লেট আর কাঁটা চামুচ দাও, বরফ দাও।‘- বাবু ই অর্ডার করল।
আমরা যে মুহুর্তে প্রথম গ্লাস ঠুকে চিয়ার্স করলাম ঠিক সেই মুহুর্তে সাকিব আল হাসানের বলে নিউজল্যান্ডের শেষ উইকেট পড়ল। দেশের জয়ের অসম্ভব আনন্দে বুক ভিজিয়ে নিতে নিতে আমি বাবুর দিকে তাকিয়ে বললাম- ক্রিকেট টা কন্টিনিউ করলে আজ তুই ও সাকিব দের সাথে উদযাপন করতি!
- নিয়ম বহির্ভুত ব্যাপার। তখন হয়ত সাকিব আল হাসান এখানে বসে বসে তোমার সাথে লাল পানি খেত। বাসের একটা সীটে একসাথে একজনের বেশি বসতে পারেনা!
- তুই বাসে চড়ে মজা পাচ্ছিস, আবার সীট ছাড়ার চিন্তা ভাবনা করছিস!- এটা আমার কছে আজীব লাগছে!
লাল পানির সাথে কাঁটা চামচ দিয়ে তুলে তুলে কালা ভুনা খাচ্ছি। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, বাবুর আত্নহত্যার ঘোষনা আমার মন কে তীব্র বিষণ্ণ করে রাখলেও আমি কালা ভুনার স্বাদ ঠিকই পাচ্ছি।
তিন পেগ খাবার পর সুরা সাগরে আমাদের তরি যখন মাত্র ভাসতে শুরু করেছে বাবু তখন তার গল্প বলা শুরু করল।
-বুয়েট পাশ করার পর এক বছর ত আমি ড্রাগ এডিক্ট ছিলাম। তুমিই ত আমাকে ফিরাই আনছিলা।ইনফ্যাক্ট তখনি আমি বুঝতে পারি মানুষ কে প্রভাবিত করার সাঙ্ঘাতিক একটা ক্ষমতা তোমার আছে।তোমার কাছে যে আমি আসি প্রেমের টানে আসি না। তোমার এই রহস্যময় ক্ষমতার উৎস অনুসন্ধান করতে আসি!
- মরার আগে রহস্যময় ক্ষমতার উৎস অনুসন্ধান করে কি করবি?
- তুমি আসলে মৃত্যু ব্যাপার টাই বোঝ নাই। এজন্য গবেটের মত কথা বলছ। যাই হোক আমরা মূল প্রসঙ্গে ফিরে যাই। ড্রাগ ছাড়ার কারন হিসাবে তুমি আমাকে যে কঠিন লজিক দিছিলা সেটা তোমার মনে আছে?
- হ্যাঁ মনে আছে। কিন্তু তোর মুখ থেকে শুনতে চাচ্ছি।
- তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করলা কি ড্রাগস নেই। আমি বললাম ফেন্সিডিল। সকালে একটা। সন্ধায় একটা। তুমি জিজ্ঞেস করলা- ইউনিভার্সের গ্র্যান্ড ডিজাইন নিয়ে আমার চিন্তা ভাবনার কদ্দুর কি হল? আমি বললাম- চিন্তার এক পর্যায়ে এসে আমি সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ নিয়ে চিন্তা করা শুরু করি।মানুষ নিয়ে চিন্তার এক পর্যায়ে আমি প্রচন্ড হতাশ হয়ে পড়ি। প্রচন্ড হতাশ! তুমি জিজ্ঞেস করলা-এত হতাশ হবার কারন কি? আমি বললাম- আমার একটা ডিডাকশন হল সৃষ্টির সূচনাবিন্দু থেকে আজ পর্যন্ত মহাবিশ্ব যে যায়গায় এসেছে মানুষ ঠিক তার সমান। অর্থাৎ মানুষ সমগ্র মহাবশ্ব কে নিজের মধ্যে ধারণ করতে সক্ষম। কিন্তু সে মহাবিশ্বের খুব সামান্যটুকুও নিজের মধ্যে ধারণ করতে পারেনি। তুমি জিজ্ঞেস করলে- কেন? ধারণ করতে পারেনি কেন? আমি বললাম- প্রকৃতিতে মানুষ ই একমাত্র সৃষ্টি যার কাছে প্রকৃতি নিজেকে প্রকাশ করতে চাইল। প্রকৃতির যোগাযোগের ভাষা অদ্ভুত। সে মানুষের কোন প্রশ্নের উত্তর দেয়না। কিন্তু মানুষের মনে কেবল প্রশ্নের পর প্রশ্ন সৃষ্টি করতে থাকে।সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করার দায়ীত্ব মানুষের। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানুষ প্রশ্নের উত্তর না খুঁজে মনগড়া উত্তর তৈরি করল। মানুষের মনে প্রশ্ন আসল ভুমিকম্প কেন হয়? মানুষ মনগড়া উত্তর বের করল- গরুর শিং এর উপর পৃথিবী দাঁড়িয়ে আছে। গরু যখন এক শিং থেকে আরেক শিং এ পৃথিবী কে পার করে তখন ভুমিকম্প হয়! আমি একথা বলার পর তুমি বললে- কিন্তু মানুষ ত পরে টেক্টোনিক প্লেট থিওরি আবিস্কার করল।ভুমিকম্প কেন হয় তার উত্তর বের করল। আমি বললাম- হতাশা টা ত এখানেই। উত্তর বের করার পর সিংহভাগ আধুনিক মানুষই উত্তর টাকে মনের মধ্যে ধারন করতে পারেনি। তুমি একহাজার জন আধুনিক মানুষের সাথে কথা বলে দেখ। দেখবা তারা টেক্টোনিক প্লেট থিওরি সম্পর্কে জানে। সেটা বিশ্বাস ও করে। আবার গরুর শিং থিউরি কেও সে মন থেকে বাতিল করেনি! এই দ্বৈত সত্ত্বার চিপায় পড়ে মানুষের সর্বনাশ হয়েছে। একটা ইমারত বানাতে গিয়ে ইটের পর ইট না গেঁথে শ্রমিক রা ইট নিয়ে মারামারি করলে যে অবস্থা হবে মানুষের জ্ঞানের হয়েছে সেই অবস্থা।ফলে সময় গড়িয়েছে। কিন্তু মানুষ জন্মের মূর্খ থেকে গেছে। তুমি বললে- তুই পৃথিবীর একটা অঞ্চলের মানুষ কে দেখে সারা পৃথিবীর মানুষ সম্পর্কে ধারনা করতে পারিস না।তোর উচিৎ দেশের বাইরে যাওয়া। আরো বৃহত্তর মানব সমাজ কিভাবে চিন্তা করে সেটা কাছ থেকে দেখা। এত দ্রুত সিদ্ধান্তে আসা মনে হয় ঠিক হয় নি। তোমার কথা আমার কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হল এবং আমি বিদেশ যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। তুমি আমাকে বললা- মানুষ নিয়ে আবার স্টাডি শুরু করার পর তোর ড্রাগ এডিকশন আর থাকবেনা। কারণ স্ট্রং লজিকের কোন মানুষ একসাথে দুইটা নেশায় আসক্ত থাকতে পারেনা। বিদেশ গিয়ে ফেন্সিডিল না পেলেও বিকল্প ড্রাগস ছিল। কিন্তু মানুষ নিয়ে স্টাডি শুরু করার পর আমার ড্রাগ এডিকশন পুরোপুরি চলে গেল। আমার ধারনা তোমার ‘স্ট্রং লজিকের কোন মানুষ একসাথে দুইটা নেশায় আসক্ত থাকতে পারেনা’ এই লজিক আমার অবচেতন মন বিশ্বাস করেছিল এবং সেই বিশ্বাসের কারনেই মানুষ নিয়ে পূনরায় স্টাডি শুরু করার পর আমার মন ড্রাগস প্রত্যাখ্যান করা শুরু করে!

ইতোমধ্যে আমাদের পাঁচ পেগ করে খাওয়া হয়ে গেছে। বসা অবস্থাতেই হাল্কা টলছি। টিভিগুলো অফ করে দেবার কারনে পানশালার ভেতর টা কেমন ভৌতিক লাগছে। পাশের টেবিলের কয়েকজন অদ্ভুতুড়ে গান জুড়েছে। খুব জনপ্রিয় একটা গানের প্যারোডি। স্থায়ী অন্তরা শেষে মিউজিক এর জায়গাটা এরা পুরন করছে খিস্তি দিয়ে। মূল গায়ক স্থায়ী অন্তরা শেষ করার পর সবাই মিলে খিস্তি উচ্চারন করছে- তর মায়রে বাপ, মায়রে বাপ, মায়রে বাপ, মায়রে বাপ!! এই ভৌতিক অন্ধকার, সামনে একজন আত্নহননের সিদ্ধান্ত নেয়া মানুষ, পাশের টেবিলের নারকীয় খিস্তি সব মিলিয়ে আমার কাছে পরিবেশটা হঠাৎ অসহ্য ঠেকল। আমি টলতে টলতে উঠে দাঁড়িয়ে বাবুকে বললাম- বাবু তোর বাকী গল্প কালকে শুনব। আজকে বাসায় যাই।
কিন্তু বাবু আমার হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিল। ওর হাত ধরে টানা এবং চোখের চাহনির মধ্যে কেমন যেন একটা হিংস্রতা টের পেলাম।হিংস্র চাপা গলায় বাবু বলল- আজকে এই মুহুর্তে তোমাকে সব বলে আমি আমার বোঝা হাল্কা করতে চাই। আত্নহত্যার আগের আটচল্লিশ টা ঘন্টা আমি আমার মাথাটাকে পুরোপুরি নির্ভার রাখতে চাই। মাথা নির্ভার না থাকলে কোন কাজই নিঃখুত ভাবে করা যায় না!
আমি অসহায় এর মত গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে বাবুর অসমাপ্ত গল্প শুনতে লাগলাম।

সিয়াটলে আমার সাথে পরিচয় হল হৃদিমা সারোধী’র সাথে। হৃদিমা দিল্লির মেয়ে। ওকে আমি সিয়াটলে প্রথম দেখি একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। হৃদিমার একক নৃত্য ছিল। আমি সামনের সারির দর্শক।টুবলু ভাই, নারীর সৌন্দর্য্যের বর্ননা অনেক বইয়ে অনেক রকম ভাবে পড়েছি। কিন্তু হৃদিমা কে দেখে যে বর্ননা আমার মনে এল সেটা কোন বইয়ে পড়িনি।
বিন্যাস সমাবেশের নিঃখুত অঙ্ক মেনে শ্রষ্টা তার দেহ টা গড়েছেন। সেই দেহের উপর শাড়ি,ব্লাউজ, চেলি, নুপুর, টিপ, আলতা দিয়ে যে তাকে সাজিয়েছে সে তার দেহের সৌন্দর্য্যের সন্মান বজায় রেখেই সেটা করেছে। যার ফলে সঠিক ভোল্টেজের আলোয় স্বর্গের কক্ষগুলো যেন আলোকিত হয়ে উঠেছে। আমাদের বিউটিপার্লারগুলো যেমন চোখ ধাঁধাতে গিয়ে স্বর্গ কে আহসান মঞ্জিল বানিয়ে ফেলে এদের ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। বাজনার তালে হৃদিমা যখন মঞ্চে নেচে উঠল তখন আমার সামনে দুলে উঠল সময়হীন জগত। তার নাচের একেকটা মুদ্রা আমার সামনে উন্মোচিত করতে লাগল যুগে যুগে সভ্যতার বাঁকে বাঁকে আবিস্কৃত পুরুষের ইন্দ্রিয়সুখের একেকটা দরজা!
বস্তত সেদিন হৃদিমাকে দেখার পর ই আমি সঙ্গম শব্দটার অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে পারলাম। নিছক শারীরক মিলন এবং সঙ্গম যে সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিষ সেটা আমি বুঝতে পারলাম। সভ্যতা এবং বিবর্তন একজন নারী এবং একজন পুরুষের দেহ মনে যত রকম সৌন্দর্য্য সঞ্চয় করেছে সেই সৌন্দর্য্য সমূহের পরিপূর্ন বিনিময়ের নামই হচ্ছে সঙ্গম এবং সঙ্গমের চেয়ে শ্রেষ্ট আনন্দের কিছু জগতে থাকতে পারেনা।
পরের এক সপ্তাহ আমার পরিপূর্ণ উন্মাদের মত কাটল। চোখ বন্ধও করতে হয়না। চোখের সামনে হৃদিমাকে নাচতে দেখি আর মাথার মধ্যে একটা শব্দই বাজতে থাকে-সঙ্গম!

হৃদিমার ঠিকানা পেয়েছিলাম।একদিন মদ খেয়ে মাতাল অবস্থায় তরকারী কাটার একটা ধারালো ছুরি পকেটে নিয়ে হৃদিমার কাছে উপস্থিত হলাম। পকেট থেকে ছুরিটা বের করে মাথা নিচু করে ছুরিটা তার দিকে বাগিয়ে ধরলাম। তারপর স্পষ্ট উচ্চারণে বললাম- আমি তোমার সাথে সঙ্গম করতে চাই। ভন্ডামি আমার আসেনা। নাও ছুরিটা নাও।ছুরি দিয়ে তুমি এই পশুটাকে জবাই কর।
আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে হৃদিমা আমার হাত থেকে ছুরিটা নিল। তারপর পরিপূর্ণ শীতল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। নারীর চোখ যেন পুরুষের মনোটেলিভিশনের রিমোট কনট্রোল। একেকটা দৃষ্টি নিক্ষেপ মনোটেলিভিশনে একেকটা চ্যানেল চালু করে দেয়! হৃদিমার শীতল দৃষ্টি আমার মনোটেলিভিশনে যে চ্যানেল চালু করল সেটার মুল বার্তা হল- এই নারী এখন তোমাকে যেটা বলবে সেটা তোমাকে শ্রদ্ধা এবং সন্মানের সাথে শুনতে হবে। চ্যানেলের বার্তা হৃদয়ঙ্গম করার কারনে আমার এপিয়ারেন্সে যে পরিবর্তন হল সেটা দেখে হৃদিমা সম্ভবত আশ্বস্ত হল। আমার উপর তার নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা হয়েছে এটা বুঝতে পেরেই সম্ভবত তার চোখের দৃষ্টি অনেকটা শান্ত হয়ে আসল। সে দৃঢ় অথচ স্বাভাবিক উচ্চারনে বলল- আমার পড়াশোনার সাব্জেক্ট উইমেন স্টাডিজ।আমার থিসিসের বিষয়বস্তু ‘এপ্টিচুড অভ ম্যান টুওয়ার্ডস ওইমেন’। থিসিস সম্পন্ন করার জন্য নির্দ্বিধায় নিজের ভেতরের কদর্য দিক গুলো প্রকশ করে এরকম্ একজন শিক্ষিত পুরুষের সাথে আমার কয়েকটা সিটিং দেয়া দরকার। আগামী মঙ্গল বারে যদি তুমি মদ না খাও তাহলে বেলা সাড়ে তিন টায় এখানে আসতে পার।

খোলা মনে নিজের ভেতরের কদর্য দিক গুলো প্রকাশ করতে গিয়ে আমি খোলাখুলি ভাবে আমার ‘সঙ্গম তত্ত্ব’ হৃদিমার কাছে প্রকাশ করলাম এবং আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে হৃদিমা আমাকে বলল- তোমার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে তোমার সাথে আমি আমার জীবন বিনিময় করতে চাই। আমার সেই মুহুর্তের অনুভুতি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। মনে আছে তখন আমরা শান্ত একটা লেকের পাড়ে বসে ছিলাম। ছোট্ট একটা সাদা টেবিলের এই পাশে আমি। অন্যপাশে হৃদিমা। আশেপাশের বর্নণা তেমন একটা দিতে পারতেছিনা। হৃদিমা সামনে থাকলে আশেপাশের কিছু তেমন একটা চোখে পড়েনা। শুধু নীল রঙের একটা টিয়েপাখি ‘টুইট টুইট’ করতে করতে একপাশের গাছ থেকে আরেকপাশের গাছে উড়ে যাচ্ছিল এটা মনে আছে।
হৃদিমার যে নিস্প্রাণ চোখ এক ঘন্টা আগেও কঠোর ব্যক্তিত্ব দিয়ে আমাকে শাসন করতেছিল সে চোখের তারায় ধীরে ধীরে কিভাবে প্রাণবন্ত প্রেম জেগে উঠছিল এই দৃশ্য আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম। হৃদিমার দুটো হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে আমি বলেছিলাম- যুগে যুগে পৃথিবীতে জন্ম নেয়া সমস্ত নারীর হৃদয় থেকে হৃদয়ে বিকশিত সমস্তটুকু প্রেম এখন তোমার হৃদয়ে।যুগে যুগে পৃথিবীতে জন্ম নেয়া সমস্ত পুরুষের হৃদয় থেকে হৃদয়ে বিকশিত সমস্তটুকু প্রেম এখন আমার হৃদয়ে।আমাদের প্রেম হচ্ছে সভ্যতার শ্রেষ্ঠ নির্মান এবং আবিস্কার!
হৃদিমা আমার হাত নিয়ে ওর চিবুকে ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে বলল- আমরা পনের দিনের জন্য নির্জন একটা কটেজ ভাড়া করব। বাইরের পৃথিবীর কেউ কিছু জানবে না। কারো সাথে যোগাযোগ ও থাকবে না। এই পনের দিন ‘সভ্যতার শ্রেষ্ঠ আবিস্কার এবং নির্মাণ’ আমরা পরস্পর কে নিবেদন করব!

পর্যাপ্ত এসি এবং ডিম লাইটের হাল্কা আলোর মধ্যেও বুঝতে পারছিলাম বাবু প্রচন্ড ঘামছে। প্রবল নস্টালজিয়ার ঘোরের মধ্য দিয়ে যেতে শরীর যে বাড়তি ক্যালরি খরচ করছে সেটাই ঘাম আকারে বের্র হচ্ছে। মদের ফোঁটা ঠোঁট বেয়ে পড়ে বাবুর হাতের সিগারেট ছ্যাঁৎ করে নিভে গিয়েছিল। আমি লাইটার দিয়ে সিগারেট জ্বালিয়ে দিতে দিতে বললাম- হৃদিমা মারা গেছে। না!
বাবুর দুই চোখ দিয়ে নিঃশব্দে জলের ধারা বেরিয়ে এল। আমি বাবুকে আমার জীবনে এই প্রথম কাঁদতে দেখলাম। চোখের জল কে জলের মতই ঝরতে দিয়ে চুপচাপ কিছুক্ষণ ধুমপান করল বাবু। মদের খালি গ্লাস টা হাতে নিয়ে খামাকাই এটার আগাগোড়া তীক্ষ্ণ চোখে দেখল। তারপর টিস্যু পেপার দিয়ে চোখ মুছে আবার বলতে আরম্ভ করল। তার গলার আওয়াজ মনে হল গভীর কোন কুয়ার ভেতর থেকে উঠে আসছে।

‘ড্রীম টুইট’ কটেজে আমরা উঠলাম। বিশাল উঁচু ঘাসে ঢাকা লনের ঠিক মাঝখানে স্বপ্নের মত বাড়ি টা। একপাশে সুইমিং পুল টার ডিজাইন এমন ভাবে করা দেখে মনে হয় গ্রামের পুকুর। কিন্তু পানি টলটলে পরিস্কার।লনে নির্দিষ্ট দূরত্বে বপন করা উঁচু উঁচু গাছ গুলো অনেক উপরে উঠে এমন ভাবে শাখা বিস্তার করেছে যে সূর্যের আলোকে সব সময় মিষ্টি রোদ হয়ে ঢুকতে হচ্ছে। পনের দিনের জন্য এমন ভাবে কন্ট্রাক্ট করা ছিল যে পনের দিন এখানে কাক পক্ষী ও আসবে না। রান্না বান্না সব আমাদের নিজের।
উঁচু ঘাসের মধ্যে শুধুমাত্র ঘাসের জামা পরে মুখোমুখি বসে দুজন দুজনের হাত ধরে একদিন আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে উঁকি দেয়া সূর্য মনে হচ্ছে আমাদের দিকে তাকিয়ে দুষ্টু দুষ্টু হাসছে। অসম্ভব আবেগ মাখা গলায় হৃদিমা হঠাৎ মনে হল স্বগতোক্তি করছে- একজন নারী এবং একজন পুরুষ।তাদের উপর কেউ কোন বন্ধন বা কুসংস্কার কখনো চাপিয়ে দেয়নি। বেড়ে উঠার সাথে সাথে প্রকৃতি তাদের সাথে কথা বলেছে। প্রকৃতি ই তাদের নিঃশব্দে চিনিয়ে দিয়েছে নিজেকে! নির্দিষ্ট বয়সে এসে আরো একটা নিস্পাপ ভালোবাসা অনুভব করে তাদের বুক হু হু করে উঠেছে।পরস্পরের সান্নিধ্যে এসে তারা পরস্পরের সাথে অবিরল ভাবে বিনিময় করেছে তাদের সমগ্র স্বত্ত্বা- শরীর এবং মন! এই পবিত্র সঙ্গই সঙ্গের অধিক কিছু। এই পবিত্র সঙ্গের নামই সঙ্গম!

আমি বাবুর দিকে তাকিয়ে দেখি বাবু থর থর করে কাঁপছে। পানশালা দেখতে দেখতে ফাঁকা হয়ে গেছে। যে বেয়ারা আমাদের কে পরিবেশন করছিল সে শূন্য মুখে অদুরে দাঁড়িয়ে আছে। বেয়ারার কাছে তিনহাজার টাকা আগেই জমা দেয়া ছিল।টিপস একশ টাকা রেখে বাকী টাকা ফেরৎ দিতে বলে আমি বাবুকে হাত ধরে উঠালাম। বললাম- বাবু চল। তোর জায়গায় হলে আমি নিজেও সম্ভবত আত্নহত্যা করতাম!!
বাবু আমাকে জড়িয়ে ধরে শিশুর মত কেঁদে উঠল। কাঁদতে কাঁদতে বলল-কীচেনে পাঁচ কেজি ওজনের দুইটা এলপিজি সিলিন্ডার ছিল। দুইটা দুই কোম্পানীর। ঠিক চৌদ্দ দিনের মাথায় একটা শেষ হলে বার্নারের সাথে আরেকটা যুক্ত করি। হৃদিমা কফি বানাতে গিয়েছিল। পরনে ছিল সিন্থেটিক জামা। বার্নারের মুখে লাইটার জ্বালাতেই আগুনের শিখা দপ করে অনেক উপরে উঠে যায়। প্রথমে হৃদিমার চুলে, চুল থেকে সিন্থেটিক জামায় আগুন ধরে যায়। সব নেটোয়ার্কের সাথে কটেজের ফোন কানেকশন ও অফ ছিল। পনের দিন পার হলে সব অটো কানেক্ট হয়ে যাবে! কাজেই দ্রুত হসপিটালে নিলে হৃদিমাকে বাঁচানোর যে নূন্যতম সম্ভাবনা ছিল সেটা কাজে লাগানো গেল না।

এরামের লোহার সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে নামছি। আমি নিজেও ছ পেগ মদ খেয়েছি। কিন্তু বাবুর কথা ভেবে নিজের ইন্দ্রিয়ের উপর জোর প্রয়োগ করে ইন্দ্রিয় কে সজাগ রাখছি। সিঁড়ি দিয়ে ফুটপাতে নামতেই সৌভাগ্যক্রমে একটা রিকশা পেয়ে গেলাম। বাবুকে ধরে রিকশায় উঠিয়ে দিতেই এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া গায়ে ঝাপটা মারল। রাস্তা এবং আকাশের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম একটু আগেই বেশ ভারী বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। ওদিক থেকে আসা একটা রিকশার চালক উদাস গলায় সিটি বাজাচ্ছে। রিকশায় কোন আরোহী নেই।
-বাবু, এই ঘটনাকে ত পুলিশ পরিকল্পিত হত্যাকান্ড বলে সন্দেহ করার কথা।
-সেটাই করেছিল। আমিও আত্নপক্ষ সমর্থন করে কিছু বলিনি। ভেবেছি- তাড়াতাড়ি বিচার করে ঝুলাই টুলাই দিলেই হয়! কিন্তু ওদের আইন কড়া! ওরা পুরা ঘটনা তদন্ত করল। এলপিজি সিলিন্ডারে সাধারনত প্রোপেন থাকে তিরিশ ভাগ, বিউটেন সত্তর ভাগ।তদন্তে দেখা গেল যে সিলিন্ডার থেকে এক্সিডেন্ট হয়েছে সেটাতে প্রোপেন ছিল সত্তর ভাগ, বিউটেন তিরিশ ভাগ! প্রোপেনের ভেপার প্রেশার বেশি। কাজেই বার্নার জ্বালানোর সাথে সাথে শিখা প্রায় এক ফুট লাফ দিয়ে উঠে হৃদিমার চুল স্পর্শ করেছিল। দেশে হলে আমি পুলিশ কে পয়সা খাইয়ে তদন্ত রিপোর্ট পাল্টে দেয়াতাম। আমাকে আর এত কষ্ট করে আত্নহত্যা করতে হত না!
-বাবু তুই আত্নহত্যা করার সময় আমি তোর সাথে থাকতে চাই। সাথে থেকে তোর কষ্ট টা কিছুটা হলেও নিজের করে নিতে চাই।
বাবু আবেগের সাথে আমার পিঠে হাত রাখল- টুবলু ভাই। তোমার সাথে ত আমি প্রায় ই কঠিন বেয়াদপি করি। মাপ করে দিও। তুমি সাথে থাকলে আমার মানসিক কষ্ট কিছুটা লাঘব হবে ঠিকই। কিন্তু সাথে থাকা উচিৎ হবেনা। আইনি ঝামেলায় পড়ে যাবে।
- আমি সেটাই চাচ্ছি বাবু। তোকে আমি আপন ছোট ভায়ের মতই ভালবাসি। তুই আত্নহত্যা করার পর নিজে কিছু ঝামেলায় পড়লে আমার ব্রেন সেই ঝামেলা নিয়েই ব্যস্ত থাকবে। এতে করে আমি হয়ত তীব্র আবেগতাড়িত মানসিক কষ্ট থেকে রেহাই পাব।
- তুমি আবারো আমাকে প্রভাবিত করে ফেললে! সত্যিই তুমি একটা বিস্ময়কর মানুষ টুবলু ভাই!!


পরিশেষঃ
রোববার রাত দুইটা বেজে তের মিনিট।পুর্ন অমাবশ্যার অমানিশায় ঢাকা কক্সবাজার সমূদ্র সৈকতের বুকে দুটো সাদা হেলানো চেয়ার খুব আবছা চোখে পড়ছে। দুটো চেয়ারে আধশোয়া হয়ে দুজন যুবক বসে আছে। একজনের বয়স মাত্র সাতাশ। আরেকজন সদ্য ত্রিশ পার করেছে। সাতাশ বছরের যুবকের নাম বাবু। বাবু কিছুক্ষন পরেই আত্নহত্যা করবে। তার প্যান্টের পকেটে একটা ছোট্ট বিষের শিশি। দুবছর আগে আমেরিকা থেকে কেনা। এই বিষ খাবার ঠিক আধ ঘন্টা পর চেতনা লোপ পেতে শুরু করে। চেতনা লোপ পাবার একুশ থেকে ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে ভিক্টিমের মৃত্যু হয়। রাত দুইটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে বিষ পান করলে ঠিক তিনটা পনের মিনিটে বাবুর মৃত্যু হবে। আজ থেকে ঠিক দুবছর আগে হৃদিমা নামের অপ্সরীতুল্য একটা মেয়ে আমেরিকায় ড্রীম টুইট নামক একটা হানিমুন কটেজে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যায়। সে যখন মারা যায় তখন বাংলাদেশ সময় রাত তিনটা বেজে পনের মিনিট।

বিষ পান করে বাবু ধীরে ধীরে সমুদ্রের দিকে হেঁটে যাবে। প্রতিটা পদক্ষেপ অনুভব করে ধীরে ধীরে হাঁটবে আর হৃদিমার উদ্যেশ্যে বলবে- ‘হৃদিমা এই যে দেখছ আমি আসছি! জীবনে মরনে আমি শুধু তোমার সাথেই সঙ্গম করতে চাই’। গভীর ভাটা যে মুহুর্তে তাকে সমুদ্রের গভীরের দিকে টান দেবে ঠিক তখনি হয়ত তার চেতনা লুপ্ত হবে।এই মুহুর্তে পাশে বসা টুবলু নামক ত্রিশ বছর বয়সী যুবক বসে বসে এই দৃশ্য দেখবে। এই দৃশ্য দেখার পর একা একা অনেক খানি পথ হেঁটে তাকে হোটেলে ফিরতে হবে। টুবলু প্রানপনে আশা করছে রাতের মধ্যেই তাকে পুলিশ এরেস্ট করে যাহোক কিছু একটা করবে! বাবু হঠাৎ টুবলুর দিকে তাকিয়ে প্রায় ফিস ফিস করে বলল-

- একটা কথা বলতে ভুলে গেছিলাম টুবলু ভাই। ঢাকায় আপনার বাসায় যেদিন গেলাম সেদিন আপনি ভাত রান্না করলেন। তরকারী গরম করে আনতে দেরি করছিলেন দেখে আমি শুকনা ভাত মুখে দিলাম। ভাত মুখে দিতেই খুউব হাল্কা একটু লবন লাগল! আপনি ত নিশ্চয় লবন দিয়ে ভাত রান্না করেন নাই। যে সিঙ্কে চাল ধুয়েছেন সেটার পানিও আমি পরদিন পরিক্ষা করে দেখেছি। পানি মোটেও লবনাক্ত না। ভাত খুউব হাল্কা লবন লাগার কারন টা আমার কাছে স্পষ্ট না টুবলু ভাই।
- আমি যখন চাল চুলায় বসাচ্ছিলাম তখন আমার চোখ থেকে দুফোঁটা পানি হাঁড়ির মধ্যে পরেছিল। চোখের পানি ত নোনতা হয়। কিন্তু সেই খুব সামান্য নোনতা স্বাদ ত তোর টের পাবার কথা না।
- দেখ আত্নহত্যার সিদ্ধান্ত নেবার পর থেকে আমি একটা ট্রান্স অবস্থায় আছি। আমার অনুভুতির তীক্ষ্ণতা তোমাদের চেয়ে আলাদা হবে।
- এই তীক্ষ্ণ অনুভুতি দিয়েও তোর কাছে একটা জিনিষ ধরা পড়ল না বাবু।
- কি সেটা?
- কোন অবস্থাতেই একজন মানুষ আত্নহত্যা করতে পারেনা। সব অবস্থাতেই একজন মানুষের জন্য পৃথিবীর কোথাও না কোথাও সঞ্চিত থাকে অন্তত এক ফোঁটা নোনাজল। সেই নোনাজল কে অস্বীকার করে নিজেকে হত্যা করা ভয়ঙ্কর অমানবিক কাজ বাবু!

বাবু বিস্মিত দৃষ্টিতে টুবলুর দিকে তাকিয়ে আছে। বুদ্ধিহীন অথচ শয়তানের সমান মেধাসম্পন্ন এই মানুষ টা আকাশে সদ্য ফোটা কয়ে্কশ তারার আলোয় তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। বরাবরের মত এবারো মানুষ টা তাকে যুক্তির খেলায় হারিয়ে দিয়েছে!

বাবুকে সাদা চেয়ারে বসিয়ে রেখে বিষের বোতল টা হাতে নিয়ে টুবলু একাই পানিতে নেমে গেল।ছিপি খোলা শিশি উপুড় করে সে সমুদ্র কে বিষ খাওয়াচ্ছে! আজ থেকে অনেক অনেক বছর আগে এই সমুদ্রের পানিতে ডুবে তার চার বন্ধু মারা গিয়েছিল। আজকে সে তার প্রতিশোধ নিচ্ছে। সমুদ্রের ফেনিল বুকে ছ্যার ছ্যার করে বিষ ঢালতে ঢালতে মনের মধ্যে পৈশাচিক আনন্দ অনুভব করল টুবলু।














মন্তব্য ২৯ টি রেটিং +৭/-০

মন্তব্য (২৯) মন্তব্য লিখুন

১| ২২ শে জুলাই, ২০১৫ বিকাল ৩:৫১

সাখাওয়াত হোসেন বাবন বলেছেন: চমৎকার লিখেছেন । ধন্যবাদ শেয়ার করার জন্য ।

২২ শে জুলাই, ২০১৫ বিকাল ৩:৫৮

হঠাৎ ধুমকেতু বলেছেন: ধন্যবাদ ভাইয়া।

২| ২২ শে জুলাই, ২০১৫ বিকাল ৪:০০

হাসান মাহবুব বলেছেন: অসাধারণ! খুব যত্ন নিয়ে লেখা প্রতিটা অধ্যায়। মেটাফর হিসেবে অশ্রূতত্ত্বের ব্যবহার আমাকে আবেগী করেছে। গল্পের প্রতিটা বাঁকে নতুনত্বের ছোঁয়া পেয়েছি। সমালোচনা যদি করতেই হয়, তাহলে বলবো প্রথমদিকে হুমায়ুন আহমেদ প্রভাবিত ছিলো। মনে হচ্ছিলো আরো একটা ফ্যান ফিকশন পড়তে যাচ্ছি। ব্যাপার না, ওপেনিংয়ে প্রথমদিকে একটু নড়বড়ে হতেই পারে ব্যাটসম্যানেরা।
প্রিয়তে নিলাম।

৩| ২২ শে জুলাই, ২০১৫ বিকাল ৪:০৬

হঠাৎ ধুমকেতু বলেছেন: ধন্যবাদ হাসান মাহবুব ভাই। এই গল্প লিখার জন্য ঢাকায় গিয়ে দুদিন এক বন্ধুর বাসায় ঘাপটি মেরে ছিলাম। ইম্প্রোভাইজেশন আছে। কিন্তু ব্রেন চট করে এক গল্প থেকে আরেক গল্পে চলে যায়! আপনি সৃষ্টিশীল লেখক। আপনার নিজের ও নিশ্চয় তাই হয়! যাই হোক, আপনার প্রেরণা আমার বড় সম্পদ।

৪| ২২ শে জুলাই, ২০১৫ বিকাল ৪:২৭

মাঘের নীল আকাশ বলেছেন: চমৎকার লিখেছেন!

২২ শে জুলাই, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:২৪

হঠাৎ ধুমকেতু বলেছেন: ধন্যবাদ।

৫| ২২ শে জুলাই, ২০১৫ বিকাল ৪:৫৯

রানা আমান বলেছেন: অসাধারণ হয়েছে ।

২২ শে জুলাই, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:২৫

হঠাৎ ধুমকেতু বলেছেন: ধন্যবাদ।

৬| ২২ শে জুলাই, ২০১৫ বিকাল ৫:১১

core needle007 বলেছেন: Bhai khub mugdho hoye apnar lekhata porlam.....really a excellent task.

২২ শে জুলাই, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:২৬

হঠাৎ ধুমকেতু বলেছেন: ধন্যবাদ।

৭| ২২ শে জুলাই, ২০১৫ রাত ৯:১০

প্রবাসী ভাবুক বলেছেন: অসাধারণ এক গল্প৷ প্রিয়তে নিলাম৷

২৩ শে জুলাই, ২০১৫ রাত ১২:১৪

হঠাৎ ধুমকেতু বলেছেন: ধন্যবাদ ভাইয়া।

৮| ২৩ শে জুলাই, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:০৩

অপ্রকাশিত কাব্য বলেছেন: সত্যিই অসাধারন লেখার ভঙ্গি। সঙ্গমের অপূর্ব সংঙা

২৩ শে জুলাই, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৪৭

হঠাৎ ধুমকেতু বলেছেন: ধন্যবাদ কাব্য ভাই। অপ্রকাশিত কেন??

৯| ২৩ শে জুলাই, ২০১৫ রাত ৮:২৯

গিয়াস উদ্দিন লিটন বলেছেন: অনেকদিন পর মেধাবী একজন লিখকের সৃষ্টি পড়লাম ।
হাসান মাহবুব বলেছেন: '' প্রথমদিকে হুমায়ুন আহমেদ প্রভাবিত ছিলো।''
আমি আসলে এই হুমায়ুনিয় ধাঁচে আকৃষ্ট হয়েই ভিতরে ঢুকেছি । পরবর্তীতে লিখকের মুনশিয়ানা আমার কাছে বিস্ময়কর ঠেকেছে ।
সম্ভাবনাময় একজন লিখকের আগমন ধ্বনি শুনছি ।
গো এহেড , সাথে অভিনন্দন !

২৩ শে জুলাই, ২০১৫ রাত ৮:৩৯

হঠাৎ ধুমকেতু বলেছেন: ধন্যবাদ ভাইয়া। অভিনন্দন আপনাকেও।

১০| ২৩ শে জুলাই, ২০১৫ রাত ৮:৩৮

অপ্রকাশিত কাব্য বলেছেন: সময় হলে প্রকাশ্যে আসবো তাই!

২৩ শে জুলাই, ২০১৫ রাত ৮:৪১

হঠাৎ ধুমকেতু বলেছেন: সময়ের অপেক্ষায় থাকলাম।

১১| ২৫ শে জুলাই, ২০১৫ ভোর ৬:৪৪

পাজল্‌ড ডক বলেছেন: গল্প ভাল লেগেছে। আপনার লেখা পেলে আমি পড়ি।

১২| ২৫ শে জুলাই, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৩২

হঠাৎ ধুমকেতু বলেছেন: ধন্যবাদ পাজলড ডক। আমরা সবাই ত আসলে পাজলড। জগত টাই ত একটা পাজল! :)

১৩| ২৬ শে জুলাই, ২০১৫ রাত ১:৪৫

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: সুন্দর লিখেছেন।
আপনার আগামী লেখার প্রত্যাশায় থাকলাম

২৬ শে জুলাই, ২০১৫ দুপুর ১:১৭

হঠাৎ ধুমকেতু বলেছেন: ধন্যবাদ আরন্যক। আশা করি প্রত্যাশা দীর্ঘায়িত হবে না !!

১৪| ০৬ ই আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ২:০৭

মম্ময় অপর্ণা বলেছেন: খুব ভালো লাগলো পড়তে। লেখায় যত্নের ছাপ দেখে ভালো লাগলো।
শুভকামনা রইলো

০৬ ই আগস্ট, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৪৬

হঠাৎ ধুমকেতু বলেছেন: ধন্যবাদ মন্ময় অপর্ণা। যত্ন নিয়েই লিখেছি। পাঠক হিসেবে আমি নিজেও এ ব্যাপার টা গুরুত্ব দিই।

১৫| ৩১ শে আগস্ট, ২০১৫ ভোর ৫:৪২

এস বাসার বলেছেন: Suparv!

১৬| ৩১ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ১১:৩১

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: ভাই আমি অনেক সৌভাগ্যবান যে, এই গল্পটি পড়তে পেরেছি। ভ্রমণ সংকলনের কাজ করতে গিয়ে গল্পটি চোখে পড়েছিল। না হলে অনেক বড় কিছু মিস করতাম। বহুদিন পর এমন দারুণ একটি গল্প পড়লাম। আমার অনুভূতি বুঝিয়ে এখন প্রকাশ করতে পারছিনা বলে দুঃখিত। +++++++++++++++

ভালো থাকুন সবসময়, অনেক অনেক শুভকামনা রইল। গল্প সোজা প্রিয়তে।

১৭| ০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:৪৪

এস বাসার বলেছেন: মোবাইলের ছোট্ট স্ক্রীনে গল্পটা পড়ে কমেন্টস করার খুব ইচ্ছে হয়েছিলো, তাই জাস্ট একটা ছোট্ট শব্দেই কমেন্টস করেছিলাম।

একটা সময় ব্লগে পোকার মতো পড়ে থাকতাম। বলা যায় ল্যাপটপের ব্রাউজারে অলটাইম সামু প্রেজেন্ট থাকতো। পোস্ট দিতাম কম, কিন্তু পড়তাম অনেক বেশী।

ধীরে ধীরে ব্লগ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলাম....... এখনো হঠাৎ হঠাৎ ব্লগে আসি, প্রায় কোন কিছুই পড়িনা। শিরোনামটায় অবহেলা ভরে দু একবার চোখ বুলিয়ে যাই.........

কিন্তু সেদিন রাতে খুব একটা ভালো ঘুম হয়নি, তাই স্মার্টফোনে ঘষাঘষি করেই নেটে ঘুরছিলাম,............ এবং হঠাৎই আপনার লেখাটা দেখলাম,পড়লাম এবং মুগ্ধ হলাম। ভালো লেগেছে গল্প বলার ধরনটা, গল্পটা এবং অবশ্যই আপনার লেখার প্রতি ভালোবাসাটা।

লিখুন, মাঝে মাঝে আপনার ব্লগে ঢু মারবো। ভালো থাকুন, শুভ কামনা রইলো।

১৮| ০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:২৬

জাহাঙ্গীর.আলম বলেছেন:
আবেগের লজিক্যাল বিশ্লেষণ নয়ত লজিকের আবেগীয় প্রয়োগ ৷যত্নের লেখায় শেষটায় পাঠক আটকে থাকবে কিয়ৎকাল ৷

আটকে রাখা লেখা অব্যাহত থাকুক ৷ শুভকামনা ৷

১৯| ০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৫০

তারছেড়া লিমন বলেছেন: আপনাকে অনুসরন করা হইল..................... দারুন লেখা ।। সিরাম হৈচে।।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.