নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

পড়ি এবং লেখি

সৃষ্টিশীল আলিম

ক্ষুদে সাহিত্যিক, সৃষ্টির নেশায় উন্মুখ

সৃষ্টিশীল আলিম › বিস্তারিত পোস্টঃ

জলের লিখন : কালের লিখন -মুনশি আলিম

১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ৯:৫৫

আজ হস্তগত হলো 'শব্দঘর' মাসিক সাহিত্যপত্রিকা। এ সংখ্যায় 'জলের লিখন : কালের লিখন' নামে আমার লেখা গ্রন্থালোচনা প্রকাশিত হয়েছে। পড়ার আমন্ত্রণ রইলো।








নিয়োগীর জলের লিখন উপন্যাসটি তাঁর তেরোতম রচনা। সমাজের প্রান্তজনদের নিয়েই তার রচনার মূল আকর্ষণ। উপন্যাসে দর্পণের মতো ফুটে উঠেছে এনজিও’র ভেতর ও বাহিরের নিটোল ক্যানভাস। প্রকৃত অর্থে লেখকের ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতারই ছায়াপাত ঘটেছে এ উপন্যাসে।

উপন্যাস শুরু করেছেন বর্ষা ঋতু দিয়ে। উপন্যাসটি উত্তম পক্ষে বর্ণিত। পাহাড়ি রাস্তার মতো এ উপন্যাসে রয়েছে ঘটনার বাক্প্রবাহ। সবগুলো ঘটনার সঙ্গেই রয়েছে সুসামঞ্জস্যতা। কেন্দ্রীয়চরিত্র মারিয়াকে কেন্দ্র করে মূলত এ উপন্যাসের ক্রম সাজানো হয়েছে। ফুলের মতোই শ্বেতশুভ্র মারিয়া। কিন্তু সামাজিক পরিচয়ের দলিলদস্তাবেজে সে একজন যুদ্ধকন্যা। একাত্তরে যার মা অপশক্তি দ্বারা ধর্ষিত হয়। পরবর্তীকালে বিদেশের স্বেচ্ছাসেবী আশ্রয়ে মানুষ হয় এবং নামকরণ হয় মারিয়া।

পূর্ণ সাবালিকা হওয়ার পর তার মনের ভিতর গুমরে ওঠে আত্মপরিচয়ের জিজ্ঞাসা। বাংলাদেশে এসে সে গ্রামীণ সমাজজীবনের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুবাদে সারা বাংলা চষে বেড়ায়। বাংলা একবারেই বলতে পারে না। ফলে বাংলাদেশে তার গাইড হিসেবে নিয়োগ পায় উপন্যাসের নায়ক আতিক। মারিয়ার আরেক সহচরী পারভিন মারিয়ার মতোই ট্র্যাজেডির শিকার। পিতৃপরিচয়হীন গর্ভের সন্তানটি তার এক আত্মীয়ের কাছে বড়ো হয়। মূলত এই দুই নারীর চাপা কান্নাই নায়কের মনকে ক্ষত-বিক্ষত করে দেয়। সমস্ত উপন্যাস জুড়ে এই তিন চরিত্রের হৃদয়রহস্য ধীরে ধীরে দানা বেঁধে উঠেছে।

ঔপন্যাসিকের লেখনির সূক্ষ্ম আঁচরে পার্শ্বচরিত্র নাফিজা, তুহিন, আসমা, রুস্তম, হাসু খালা, রূমালি, কবির, জিম, অ্যাঙ্গেলা, বিগগ্রেট, ব্রিজিড, মাইক, এরিক প্রমুখ প্রাণ পেয়েছে। পাশাপাশি প্রধান চরিত্রের সঙ্গেও এসব চরিত্রের রয়েছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যোগসাজেস ও সুসামঞ্জস্যতা। মূলত এসব চরিত্রের কারণেই প্রধান চরিত্রত্রয় ফুলে ফেঁপে উঠেছে।

ভাষার সরলীকরণ অত্যন্ত চমৎকার। চরিত্র অনুযায়ী সংলাপের বুনন সত্যিই যথার্থ। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস পঠনপাঠনে পাঠক ঘটনার পাশাপাশি দার্শনিক তত্ত্ব এবং তথ্যও খুঁজে বেড়ায়; বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসে পাঠক খুঁজে পায় কাব্যময়তা, অন্নদাশঙ্কর রায়ের উপন্যাসে পাঠক খুঁজে পায় আধ্যাত্মিকতার সুঘ্রাণ আর মোজাম্মেল হক নিয়োগীর উপন্যাসে পাওয়া যায় কঠিন বাস্তবতার সুঘ্রাণ! অবশ্য একই সঙ্গে কাব্যময়তা এবং দার্শনিক তত্ত্বও কম নয়।

পৃথিবীর সব দেশেই শাসন ও শোষণের চিত্র রয়েছে। এটা প্রাচীনকালেও যেমন ছিল বর্তমানকালেও রয়েছে; কেবল ধরন একটু বদলেছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। স্বাধীনতার পূর্ব ও পরে এদেশে বেসরকারি সংস্থাগুলো জনকল্যাণের নাম করে খুব কৌশলীভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে সাধারণের কাছ থেকে শোষণ করে নিচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকা। রাতারাতি কেউ কেউ আঙুল ফুলেও কলাগাছ বনে যাচ্ছে। নিম্নবিত্তদের ব্যবহার করে বিদেশি দাতব্যসংগুলোর কাছ থেকে এনজিও মালিকরা লুফে নিচ্ছে বড়ো অংকের টাকা। নিঃসন্দেহে ঔপন্যাসিকের ব্যক্তিজীবনের প্রভাব পড়েছে এ উপন্যাসটিতে। কেননা, ব্যক্তিজীবনে এ সংস্থার সঙ্গে বিস্তর পরিচয় থাকার কারণেই তিনি চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে পেরেছেন। এককথায় এনজিও তথা বেসরকারি সংস্থাগুলোর চরিত্র একেবারে উলঙ্গ করে ছেড়েছেন।

বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের পটভূমিকে কেন্দ্র করে সাজানো হয়েছে কেন্দ্রীয় চরিত্রের চেতনা। প্রকারান্তরে এটি স্বদেশচেতনা, মুক্তিযুদ্ধেরই চেতনা। সবগুলো চরিত্রকেই খুব আপন মনে হয়। মনে হয় যেনো হাজার বছরের পরিচিত। জলের লিখন মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আশ্রিত দেশেপ্রেমের নিটোল মাহাত্ম্যগাথা।

উপন্যাসের নায়ক আতিক; যে প্রতিমুহূর্তেই নিজেকে নিজের সততা, আত্মবিশ্বাস ও প্রচেষ্টার সৎগুণে উতরে যাওয়ার চেষ্টা করে। উপন্যাসটিতে কখনো আতিককে খুবই বুদ্ধিদীপ্ত, সাহিত্যপ্রেমী আর রোমান্টিক মনে হয়। আবার কখনো মনে হয় দার্শনিকের মতোই উদাসীন। প্রকৃত অর্থে এ উপন্যাসে নায়কের উদাসীনতার পরিবর্তে নিষ্কাম ও গাঢ় প্রেমের চিত্রই অঙ্কিত হয়েছে। ব্যক্তিত্বের আলোকধারায় সমুজ্জ্বল নায়ক আতিক; যে প্রেমের জন্য নায়িকা মারিয়ার সাড়ার অপেক্ষায় থাকে দিনের পর দিন। নিজের ভেতর ক্ষরণ ঘটেছে তবুও স্থিরসিদ্ধান্তে তিনি ছিলেন অটল।

অর্থনৈতিক টানাপোড়েন আতিকের যেনো নিত্যসঙ্গী। তবু আতিক হেরে যাওয়ার পাত্র নয়। আত্মবিশ্বাসের জোরেই তিনি অভাবকে জয় করেছেন, জয় করেছেন দারিদ্র্যকে এমনকি সফলও হয়েছেন প্রেমে। আত্মবিশাসই তাকে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখায়। জীবন জয়ের প্রেরণা জোগায়। দীর্ঘ সময় কাছে পেয়েও নায়িকার সঙ্গে তার নৈতিক স্খলন ঘটেনি। ঔপন্যাসিকের লেখনীগুণে কোনো কোনো চরিত্র স্থান-কাল-পাত্র ছাপিয়ে কখনো হয়ে উঠে সার্বজনীন। কখনো হয়ে ওঠে আইডল। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দেবদাস উপন্যাসের কেন্দ্রীয়চরিত্র দেবদাস আজ বাঙালিপাঠকের মুখে মুখে। শুধু তাই নয়, দেবদাসকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ধরনের পণ্য।

মোদ্দাকথা কেন্দ্রীয়চরিত্র ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হয়ে উঠলে খুব দ্রুত তা সর্বমহলে প্রচার ও প্রসার লাভ করে। জলের লিখন উপন্যাসের নায়ক আতিক দেবদাসের মতো না হলেও ব্যক্তিত্বগুণে কোনো অংশেই তাকে পেছনে ফেলা যাবে না। একটু প্রচার-প্রসার পেলে এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয়চরিত্রও সার্বজনীন আইডল হিসেবে গণ্য হওয়ার যোগ্যতা রাখে।

সাহিত্যিকের সুললিত কাহিনি বর্ণনা পাঠককে চিত্রকল্পের মতোই টেনে নিয়ে যাবে। পাঠক আবেগমথিত হবে। রোমান্সে শিহরিত হবে। কথাসাহিত্যিক উপন্যাসের কেন্দ্রীয়চরিত্রদ্বয়কে এমন আকর্ষণীয় করে গড়ে তুলেছেন যে, পাঠক আতিক ও মারিয়ার রোমান্টিকতার পথ ধরে হেঁটে চলবে অবলীলায়। কথা ও ভাবের সরসতায় বিমোহিত হবে। তবে জলের লিখন উপন্যাস কখনো সখনো পাঠকমনকে ক্ষতবিক্ষত করে। কখনো বা রোমান্টিকতার ভেলায় চরিয়ে পাঠককে টেনে নিয়ে যায় দূর থেকে দূরান্তরে। দেশপ্রেমের নিটোল চিত্র মেলে নায়কের বর্ণনায় :
যুদ্ধের সময় তো অনেক শিশুরই জন্ম হয়েছিল পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে। মারিয়া হয়তো তাদেরই একজন। চাঁদের আলোয় আমি তাকে আপাদমস্তক দেখলাম। মনে হলো আমার সামনে শুয়ে আছে শ্যামলসুন্দর এক বাংলাদেশ। আমি মারিয়ার মধ্যে দেখতে পাই টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপসা থেকে সুরমা-বিস্তৃত এক সমতল ভূমিতে উৎর্কীর্ণ হয়ে আছে হাজারো নদী অরণ্যের স্নিগ্ধ শ্যামল ছায়াময় বাংলার শ্বাশত রূপ মাধুর্য।

যুদ্ধকন্যা বা যুদ্ধশিশুর সামাজিক প্রেক্ষাপট, চুলচেরা বিশ্লেষণ ও সুনিপুন উপস্থাপনে উপন্যাসটিতে সংযোজিত হয়েছে ভিন্নমাত্রা। কাহিনির পরম্পরা রক্ষায় ঔপন্যাসিক খুবই দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। বিশেষ করে ঘটনার সন্নিবেশে সময়ের ঐক্য ও পরম্পরা রক্ষায় ঔপন্যাসিকের ভূমিকা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। দীনেশচন্দ্র সেন জীবনানন্দের কবিতা পড়ে বলেছিলেন—কবি, আমি তোমার কবিতা পড়ে কেঁদেছি। জলের লিখন উপন্যাস পঠনপাঠনেও পাঠকের হৃদয় কখনো ভারাক্রান্ত হবে, কখনো চোখ হবে অশ্রুসিক্ত! একজন সার্থক ঔপন্যাসিক ঠিক ওই জায়গাতেই সফল। সমালোচক আবুবকর সিদ্দিক যথার্থই বলেছেন। তাঁর ভাষায়:
জলের লিখন উপন্যাসটি লেখকের আগের বারোটি উপন্যাস থেকে শিল্পগুণে অনেক সমৃদ্ধ। তিনি কোথাও পাঠককে জোলো তৃপ্তি দেবার লোভে সস্তা ও কাঁচা বর্ণনার ফাঁদে পা দেননি। তাঁর সংযমবোধ ও নিরাসক্ত বর্ণনার কুশলী নির্যাসে বইটি অসাধারণ রচনা হয়ে উঠতে পেরেছে। এ বইয়ের নাম ‘জলের লিখন’ না হয়ে ‘কালের লিখন’ও হতে পারত। আমি অন্তত নিঃসন্দেহ, এটি একটি কালোত্তীর্ণ উপন্যাস।

কথার বুনন, ঘটনার পরম্পরা, চরিত্রচিত্রণ, সংলাপ চয়ন, সময়ের ঐক্য, ইতিহাসের যথোপযুক্ত সন্নিবেশ, বাস্তবতার নির্যাস, কাব্যময়তা, দার্শনিক পদবাচ্যের যথার্থ প্রয়োগ, ঘটনার বাস্তবতা, স্থানের ঐক্য, পটভূমির সুনিপুণ উপস্থাপনসহ যে দিক থেকেই তাঁর উপন্যাসকে বিশ্লেষণ করা হোক না কেন—সব দিক থেকেই তাঁর উপন্যাস নন্দিত; কাজেই তাঁর এই অর্জনকে বাংলা কথাসাহিত্যের জন্য নিঃসন্দেহে মাইলফলকস্বরূপ বললে খুব একটা অত্যুক্তি হবে না।



মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ১০:৩১

স্বপ্নের শঙ্খচিল বলেছেন: পৃথিবীর সব দেশেই শাসন ও শোষণের চিত্র রয়েছে। এটা প্রাচীনকালেও যেমন ছিল বর্তমানকালেও রয়েছে; কেবল ধরন একটু বদলেছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।
অতি বাস্তব কথা
তাই বলে আমরা চুপ করে থাকতে পারি না ।
,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
সার্বীক ঐক্য সকলের বিশ্বাস পারে জীবনটা পাল্টে দিতে ।

২| ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ সকাল ৯:৫২

রাজীব নুর বলেছেন: শব্দঘর কি দ: মোহিত কামালের?

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.