নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

পড়ি এবং লেখি

সৃষ্টিশীল আলিম

ক্ষুদে সাহিত্যিক, সৃষ্টির নেশায় উন্মুখ

সৃষ্টিশীল আলিম › বিস্তারিত পোস্টঃ

একজন গুণী শিক্ষকের বিদায় ও বিবিধ প্রসঙ্গ-মুনশি আলিম

২৯ শে অক্টোবর, ২০১৮ রাত ১:০৪




ছবি : মো. সরোয়ার হোসেন

১.
শিক্ষকতা কারো জন্য কেবল পেশা, আবার কারো জন্য পেশা ও নেশা। কেউবা আবার এটাকে কেবল পেশা বা নেশা হিসেবে নয়, বরং মিশন হিসেবে গ্রহণ করে। যাঁরা মিশন হিসেবে গ্রহণ করে তাঁদের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত উপকৃত হয় শিক্ষার্থী, সহকর্মী, সমাজ, রাষ্ট্র তথা বিশ্বাবাসী। সাহিত্যেও আমরা এমনটি দেখতে পাই। জীবনানন্দ দাশের ভাষায়—সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি। তেমনই শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত থাকলেও সকলেই আদর্শ শিক্ষক হতে পারে না। সকলেই শিক্ষার্থীর ভেতরের সত্ত্বাকে জাগিয়ে তুলতে পারে না, তাদের কৌতূহল উদ্রেক করতে পারে না, আর যারা কৌতূহলী হয় তাদের কৌতূহলকেও শুভ চোখে দেখে না। আর যাঁরা এসব অতিক্রম করতে পারে, তারা নিঃসন্দেহে মহান, কালের আয়নায় তাঁরা অনুসরণীয় তো বটেই। শিক্ষার্থীদেও হৃদয় জয় করা এমনই একজন শিক্ষক হলেন মো. সরোয়ার হোসেন। হ্যাঁ, আমি আমির মিয়া উচ্চবিদ্যালয়, জাফলং’র সাবেক প্রধান শিক্ষকের কথাই বলছি।

সমাজে প্রতিটা সেক্টরেই অলরাউন্ডারদের অগ্রধিকার থাকে। সাধারণে তাদের ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে, অনুসরণ করে, ক্ষেত্রবিশেষে অনুকরণও করে। সরোয়ার হোসেন এমনই একজন শিক্ষক যাকে শুধু অনুসরণ নয়, নিঃসন্দেহে অনেক বিষয়েই অনুকরণের যোগ্য। তিনি সচরাচর ক্লাস নিতেন না, কিন্তু যখন নিতেন তখন কয়েক ঘণ্টাব্যাপী নিতেন। বিশেষ করে ভূগোল ক্লাস। জটিল বিষয়গুলো সহজ ভাষায়, কখনোবা গল্পে গল্পে, কখনোবা নানা উপকরণযোগে বুঝানোর চেষ্টা করতেন।কখন দেড় ঘণ্টা, দু’ঘণ্টা, আড়াই ঘণ্টা চলে যেত টেরও পেতাম না!

প্রশাসনিক তকমা দূরে ঠেলে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর প্রথাগত দূরত্ব কমিয়ে তিনি বন্ধুবৎসল হয়ে উঠতেন। তাঁর কথাগুলো সর্বদাই জ্ঞানগর্ভমূলক। এরিস্টটলের সময় ধারণা করা হতো, পৃথিবীর তাবৎ জ্ঞান সম্পর্কেই তিনি জ্ঞাত। সরোয়ার স্যার যখন ক্লাস নিতেন বা কোনো অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে বক্তৃতা দিতেন, তখন মনে হতো তিনিও এরিস্টটলের মতোই সকল বিষয়েই জ্ঞান রাখেন!

এই গুণী মানুষটি ১৯৫৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। পৈতৃক নিবাস টাঙ্গাইল জেলার, সদর পৌরসভার অন্তর্গত ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাগমারায়। পিতা ইদ্রিস আলী, মাতা মোছা. ডালিমন বেগম। আমির মিয়া উচ্চবিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে প্রথম চাকরিতে যোগদান করেন ১৯৮৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। এরপর নিজের যোগ্যতাবলেই তিনি ১৯৮৬ সালে এই প্রতিষ্ঠানের প্রধানশিক্ষক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। এক দুই করে এই স্কুলেই তিনি কাটিয়ে দিয়েছেন প্রায় তিনযুগের মতো সময়। ছোটো টিনের ঘর দিয়ে স্কুল শুরু করেছিলেন। শিক্ষার্থীসংখ্যাও ছিল তখন একেবারেই হাতেগোনা। আর এখন শিক্ষার্থীসংখ্যা ২ হাজারের বেশি! এলাকাবাসী এবং তাঁর অদম্য প্রচেষ্টাতেই এই স্কুলটি বর্তমানে কলেজ সেকশনে বর্ধিত হয়েছে। অর্থাৎ বর্তমানে এটি কলেজিয়েট স্কুল। ক্যাম্পাস ও বিল্ডিংয়ের সেটাপ-গেটাপ এতটাই নান্দনিক যে, কাছে গেলে মনে হবে যেনো কোনো ছোটোখাটো বিশ্বিবিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস! তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতা, বিচক্ষণতা, মননশীলতা, দূরদর্শিতা প্রখর থাকার কারণেই এই স্কুলের আজ প্রভূত উন্নতি সম্ভব হয়েছে।



ছবি : ফুলের সুবাসে বিমোহিত মো. সরোয়ার হোসেন।

২.
শিক্ষাকে নানাভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। সহজ ও স্বাভাবিক ভাষায় বলা যায়, শিশুর সার্বিক বিকাশের নাম শিক্ষা। যদিও মানুষ প্রতিনিয়ত শিখে, তবু দেহ ও মনের সামঞ্জস্যপূর্ণ বিকাশ সমান্তরাল রেল পাতের মতো। মানবশিশুর এ বিকাশে সম্ভবত ৮০% দায়িত্ব পালন করেন শিক্ষকসমাজ। কবি গোলাম মোস্তফা যথার্থই বলেছন—
পিতা গড়ে শুধু ছেলের শরীর
শিক্ষক গড়ে তার মন
পিতা বড় না শিক্ষক বড়
বলবে সে কোন জন?
[খন্দকার আবদুল মোমেন, দৈনিক সংগ্রাম, ২০.১০.২০১২, প্রিণ্ট]

আমি মনে করি এ বিষয়ে বিতর্ক একেবারেই নিষ্প্রয়োজন। শিক্ষকের প্রভাব শিক্ষার্থীর ওপরে মা-বাবার চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশি। একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক যেমন দেশের জন্য শুধু যুদ্ধই করেন না, জীবন উৎসর্গ করতেও দ্বিধাবোধ করেন না, তেমনই একজন আদর্শ শিক্ষকও কেবল নিজের জীবিকার জন্যই এ পেশা গ্রহণ করেন না, প্রজন্মের পর প্রজন্মকে আলোকিত করতে নিজের জীবন-যৌবনকেও নির্দ্বিধায় উৎসর্গ করেন। সরোয়ার স্যার এমনই একজন শিক্ষক যিনি শিক্ষকতাকে কেবল ব্রত হিসেবেই গ্রহণ করেননি তিনি এটাকে নিয়েছেন মিশন হিসেবে। শিক্ষার্থীদের যুক্তিবাদী করে গড়ে তুলতে তিনি নিরলসভাবে কাজ করেছেন। আর যোগ্যতাবলেই তিনি উপজেলাপর্যায়ে দু‘বার সেরা শিক্ষক এবং দু‘বার সেরা প্রতিষ্ঠানপ্রধানও নির্বাচিত হন। তাঁর মেধা, প্রজ্ঞা, সহমর্মিতা, উদারতা, নৈতিকতার উদাহরণ প্রজন্মের পর প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের চরিত্র ও বোধকে শাণিত করে তুলবে বলেই আমার বিশ্বাস।

৩.
সরোয়ার হোসেন একজন মানবিকবোধসম্পন্ন যুক্তিবাদী মানুষ। আরও সহজ করে যদি বলি তাহলে বলতেই হয়—তিনি যতটা মহৎ ঠিক ততটাই যুক্তিবাদী। ফুলের মতো শিক্ষার্থীদের ফুটাতে যেখানে আলোর প্রয়োজন সেখানে তিনি ঠিকই আলো ব্যবহার করতেন। তিনি জানেন, ফুল ফুটতে তাপ নয়, আলোরই প্রয়োজন। সহকর্মীদের তিনি পরিবারের সদস্যের মতোই মনে করতেন। সহকর্মীরাও তাঁকে বটবৃক্ষের মতোই জ্ঞান করতো। তবে অন্যায়কে তিনি কখনোই প্রশ্রয় দিতেন না। ১৯৮৬ সালে তিনি বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সঙ্গে জড়িত হয়েছেন। তিনি টানা তিনবার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। অর্থাৎ একাধারে তিনি প্রায় দশ বছর এ দায়িত্ব পালন করেন। একবার সিনিয়র সহসভাপতির দায়িত্বও পালন করেন।

বিয়ে করেছেন ১৯৮৫ সালে। তিন ছেলেমেয়ে নিয়েই তাঁর ছোটো সংসার। সবার ছোটো হাবিবুর রহমান তন্ময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে যোগদান করলেও বর্তমানে ক্যাপ্টেন হিসেবে বগুড়াতে কর্মরত। সাবিহা আফরিন বিথু এবং সানিয়া তাবাসসুম তন্নি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। তাঁর স্ত্রী এসএম হাসিনা সরোয়ারও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে এলাকাতে সমধিক পরিচিত।

সরোয়ার হোসেন শিক্ষক হিসেবে যেমন ছিলেন কঠিন, প্রয়োজনে ঠিক তেমনই ছিলেন কোমল। তিনি যেমন বড়ো মনের মানুষ, ঠিক তেমন বড়ো মানের শিক্ষকও। তিনি এমন একজন আদর্শ শিক্ষক—যে শিক্ষককে আদর্শ হিসেবে প্রত্যাশা করে পৃথিবীর সকল অভিজাত সমাজ, সভ্য সমাজ, মননশীল সমাজ, যুক্তিবাদী সমাজ, আধুনিক সমাজ। একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীর জীবনে কখনো অবতীর্ণ হন অভিভাবক রূপে, পথনির্দেশক হিসেবে, বন্ধু রূপে, নৈতিকতার ধারক রূপে… প্রভৃতি। একজন আদর্শ শিক্ষককে শিক্ষার্থীরা স্মরণ করে জীবনের বাঁকে বাঁকে।

কথায় বলে, “বাপ বানায় ভূত, আর শিক্ষক বানায় পুত!” একজন আদর্শ শিক্ষক শিক্ষার্থীর জন্য সর্বদাই আশীর্বাদ স্বরূপ। বাগানে মালির কাজ কতই না নিখুঁত! দিনের পর দিন চারাগাছগুলোর কী যত্নই না তিনি করেন। আগাছা সাফ করেন।প্রয়োজনে চারাগাছের গোড়ার মাটি আলগা করে দেন। সকাল-বিকাল আবার সেসব গাছে পানিও দেন। কী নিষ্ঠা, কী মমত্ববোধ তার এসব কাজে! তারপর একদিন ফুলে ফুলে সুশোভিত হয়ে ওঠে বাগান। চতুর্দিক আমোদিত হয় সুবাসে সুবাসে। শিক্ষকের কাজ এ মালির কাজের সঙ্গে তুলনীয়। কেননা তাঁর শ্রমসাধনায় এক-একটি শিশু কালক্রমে পরিপূর্ণ মানুষে পরিণত হয়। তাদের সুকৃতি সমাজে আনয়ন করে সুখ সমৃদ্ধি।

জন্মমুহূর্তে শিশুর মন শূন্য কলস বা পরিষ্কার শ্লেটের মতো থাকে না। তার মধ্যে থাকে পরিপূর্ণ মানুষের যাবতীয় গুণাবলির সুপ্ত অবস্থা; যেমন একটি বিশাল বটবৃক্ষ লুকিয়ে থাকে তার ছোট্ট বীজের মধ্যে। শিশুর অন্তর্নিহিতি সম্ভাবনার বিকাশসাধনের দুরূহ কাজটি করতে হয় শিক্ষককে। এ কাজের সফলতায় মমত্ববোধ যেমন প্রয়োজন তেমনই প্রয়োজন নিষ্ঠা এবং দক্ষতার। আর এসকল গুণই ধারণ করেন আদর্শ শিক্ষক। শিক্ষার্থীদের ভেতরের সত্ত্বাকে জাগিয়ে তুলতে, সুপ্ত প্রতিভাকে জাগ্রত করতে কাঁর কৌশলী ভূমিকা নিঃসন্দেহে প্রশসংসার দাবি রাখে। তিনি শুধু ভালো একজন শিক্ষকই নন, ভালো একজন প্রেজেন্টার, ভালো একজন বাগ্মীও। তিনি কথা বললে ছেলে-বুড়ো তন্ময় হয়ে শুনতে থাকে। কথায় এত তথ্য-উপাত্ত, বইয়ের রেফারেন্স বেরিয়ে আসতো যে, আমাদের বিস্ময়ের সীমা থাকতো না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই পঙ্ক্তিটাই কেবল মনে হতো—“তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী, আমি অবাক হয়ে শুনি।''



ছবি : শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে মো. সরোয়ার হোসেন।


৪.
শিক্ষকরা হলেন প্রদীপের মতো। পৃথিবীর সকল প্রদীপগুলো হয়ত বর্ণ ও আকারে কিছুটা আলাদা কিন্তু আলো একই। মহাকাল বড়োই নিষ্ঠুর। সবাইকে মনে রাখে না। কেবল মানবকল্যাণে নিবেদিত মানুষদের মনে রাখে। সক্রেটিসের নিজের লেখা কোনো বই নেই অথচ এই একবিংশ শতাব্দীর মানুষ আজও তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। কারণ একটাই—তিনি ছিলেন আদর্শিক গুরু। সত্যের জন্য আজীবন লড়েছেন। ন্যায়ের পথে থেকেছেন। সত্য ও সুন্দরের চর্চা করেছেন। কৌতূহল উদ্রেক করে তরুণদের মধ্যে জ্ঞানচর্চার ব্যাপ্তি ঘটানোই ছিল তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য। তরুণদের মধ্যে যুক্তিবোধ জাগ্রত করাই ছিল তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্বিবিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. জাফর ইকবালকে যতজন মানুষ চিনে বা জানে ততজন হয়ত ওই বিশ্বিদ্যালয়কেই চিনে না। সক্রেটিস, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, জাফর ইকবাল, জফির সেতু, প্রশান্ত মৃধা স্যার এঁরা নিজেরাই এখন এক-একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এঁদের মতোই আরেকজন ব্রান্ড শিক্ষকের নাম সরোয়ার হোসেন।

তিনি শিক্ষক হিসেবে শেষ কর্মদিবস পালন করেন ২০১৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। এরপর স্কুল কমিটি তাঁর ত্যাগ, আন্তরিকতা, নিষ্ঠা, মানবিকতা, সততার কারণে পুনরায় তাঁকে দু’বছরের জন্য মনোনিত করেন। কিন্তু পরবর্তী দিনগুলো তাঁর জন্য বেশ সুখকর হয়নি। শীঘ্রই তিনি অপরাজনীতির কালো থাবায় জর্জরিত হন। ক্ষত-বিক্ষত হয় তাঁর নৈতিকতার আবেষ্টিত পিঞ্জর। নিজের সম্ভ্রম রক্ষার্থে তিনি মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ২০১৮ সালের ১১ সেপটেম্বর রিজাইন লেটার লিখে সহকারী প্রধান শিক্ষকের নিকট জমা দেন।

প্রতিষ্ঠান থেকে ‘আনুষ্ঠানিক বিদায় অনুষ্ঠান’ নিয়েও শুরু হয়েছে ধুম্রজাল। শুধু তাইই নয়, তাঁর আবাসিক ভবন (প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কোয়ার্টার) নিয়েও আড়ালে-আবডালে নানা কথা হচ্ছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তাঁকে আবাসন ছেড়ে দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে। বিদায়লগ্নে এটা একজন শিক্ষকের জন্য শুধু অন্যায়ই নয়, অমানবিকও বটে। যেখানে সরকারি বিধিমোতাবেক একজন শিক্ষক অবসরে যাওয়ার পর ৬ মাস বা একবছর পর্যন্ত বসবাস করার এখতিয়ার রাখেন। প্রয়োজনে তা আরও ছ’মাস বর্ধিত করার বিধান রয়েছে। বর্তমানে স্কুলে এমপিও স্টাফ ১৬ জন। এছাড়াও খন্ডকালীন শিক্ষক রয়েছেন ১৪ জন। স্কুলে কর্মরত অবন্থায় একসময় সরকারিভাবে যখন এমপিও শিক্ষকদের দু’মাস/তিনমাস’র বেতন বন্ধ ছিল তখন এই সরোয়ার হোসেন এবং তাঁর স্ত্রীর জমানো টাকা থেকে, তাতেও যখন পেরে উঠছিলেন না, তখন তিনি ও তাঁর সহধর্মিণীর নিজস্ব স্টিলের ব্যবসা প্রায় ক্লোজ করে সহকর্মীদের নিয়মিত বেতন-ভাতা প্রদান করেছেন। একজন প্রতিষ্ঠানপ্রধান কতটুকু উদার আর মানবিক হলে এমনটি সম্ভব! বাংলাদেশে এমন নজির খুব একটা মিলবে বলে মনে হয় না।

৫.
সময়ের পালাবাদলে যেমন রাজা যায়, রাজা আসে তেমনই এক শিক্ষকের বিদায় ও তদস্থলে অন্য শিক্ষকের আগমন ঘটে। এটাই পৃথিবীর রেওয়াজ। প্রকৃতি শূন্যস্থানে বিশ্বাস করে না। কিন্তু শূন্যস্থানে কারো কারো অভাব অনুভব করে দীর্ঘকাল। এমনই একজন শিক্ষক সরোয়ার স্যার। কতিপয় স্বার্থান্বেষী ছাড়া তাঁর অভাব অনুভব করবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম।

শিক্ষা যদি জাতির মেরুদণ্ড হয় তবে নিশ্চিতভাবেই শিক্ষক হয় শিক্ষার মেরুদণ্ড। এর এমন শিক্ষক হবেন আদর্শ শিক্ষক যিনি তৈরি করবেন আদর্শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সকল শিক্ষার আদি, মধ্য, অন্ত্য পরের ভাবনা ভাবতে শেখা। যার মধ্যে এ ভাবনা নেই সে যেমন শিক্ষক নয়, তেমনই শিক্ষিতও নয়। শিক্ষকের স্বার্থকতা শুধু শিক্ষাদান করার মধ্যেই নয়, বরং শিশুকে তা অর্জন করতে সক্ষম করানোর মধ্যে। আর এ অসাধ্য সাধনের কাজটিতে অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন সরোয়ার হোসেন।

একজন শিক্ষকও মানুষ। তিনিও অন্যসবার মতোই সামাজিক জীব। তিনিও ভুলের ঊর্ধ্বে নন। এ দৃষ্টিকোণ থেকে সরোয়ার হোসেনও ভুলের ঊর্ধ্বে নন। হয়ত রাজনীতির যাতাকলে পড়ে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেননি। কখনো ক্ষমতার তাঁবেদারি করেননি। এটা ক্ষমতার কালো চশমায় বিচার করলে হয়ত আপাতদৃষ্টিতে অন্যায় মনে হবে, কিন্তু মোটেই অপরাধ নয়। এ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তেলে তেলে তৈলাক্ত! তিনিও ক্ষমতার পুজো করে, তেল দিয়ে থাকতে পারতেন কিন্তু তা করেননি অর্থাৎ তিনি ভেঙেছেন কিন্তু মচকাননি। এখানেই একজন আদর্শ, মহৎ, গুণী শিক্ষকের স্বার্থকতা। তবু কথা থাকে। মানুষ ভালো গুণগুলোকেই মনে রাখে। মহাকালও। একজন সাধারণ মানুষকেও কেবল একটি দিক দিয়ে বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিলে সে সিদ্ধান্ত ভুল হতে বাধ্য; আর গুণী শিক্ষকের ক্ষেত্রে এ রকম সিদ্ধান্ত তো শুধু অন্যায়ই নয়, অমানবিকও বটে!

একজন শিক্ষকের রয়েছে শৈল্পিক মন। অনেকটা চিত্রশিল্পীর কাজের সঙ্গে তুলনীয়। একজন চিত্রশিল্পীর কাজ দেখুন। কী একাগ্রতা! কী নিষ্ঠা! তুলি ও রঙের খেলায় শিল্পীর নিপুণ হাতে এক-একটি ছবি আমাদের চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ওঠে। শিক্ষকের কাজে এমনই একাগ্রতা, নিষ্ঠা ও দক্ষতার প্রয়োজন। শিল্পীর কাজ যদি বিশেষ রূপায়বের আদলে বিশেষ মনোভঙ্গি বা বস্তুও নির্মাণকর্ম হয়, তবে শিক্ষকও একজন শিল্পী। চিত্রশিল্পী ছবি আঁকেন আর শিক্ষক হচ্ছেন শিশুর মন সুগঠিত করার শিল্পী। শিশুর মন বিমূর্ত জিনিস। এটি গঠন করা কতই না কঠিন কাজ! আর একাজেই যিনি তাঁর সমস্ত জীবন-যৌবনকে ব্যয় করলেন আর তাঁকেই কিনা আমরা ক্ষুদ্র স্বার্থের মোহে বিতর্কিত করছি!

সরকারি কিংবা বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠান থেকেই মানুষ দল-মত নির্বিশেষে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিদায় নেয়, প্রতিষ্ঠানও বিদায় দেয়। আবহমান কাল থেকেই এ রেওয়াজ চলে আসছে। একজন আদর্শ শিক্ষকের কাছে কেবল শিক্ষার্থীরাই ঋণী নন, ঋণী আমাদের সমাজ, ঋণী আমাদের রাষ্ট্র। শিক্ষার্থীদের প্রতি যেমন তাঁর দায়বোধ আছে, তেমনই আমাদের তথা সমাজের, তথা রাষ্ট্রেরও রয়েছে তাঁর প্রতি দায়বোধ। একজন যোগ্য শিক্ষকের প্রাতিষ্ঠানিক বিদায় আশা করাটা অন্যায় নয়, বরং এ অধিকার থেকে তাঁকে বঞ্চিত করাই সবচেয়ে নিন্দনীয় কাজ। সকলের শুভবোধের উদয় হোক। মানবিক আলোয় প্রস্ফুটিত হোক সবার হৃদয়। জয়তু জ্ঞানের ধারক-বাহক একালের সক্রেটিস মো. সরোয়ার হোসেন স্যার।

আরও বিস্তারিত:
http://www.expresstimes24.com/?p=7867&fbclid=IwAR1_tT077_uy_W7DGZnb_G9h1NkZeffi9uEvYUEPTjdlCGLyurU8ihW_gLg

http://www.dailybijoyerkantho.com/কালের-আয়নায়-একজন-গুণী-শিক/?fbclid=IwAR28MtV--SUnZMEDfw


http://zakiganjbarta24.com/একজন-গুণী-শিক্ষকের-বিদায়/?fbclid=IwAR3EeXaARLgrxY8ARQ4W3dcRN9fpe40DmBoodXRh1jThZOmDswldyLgIFKA



মন্তব্য ৪ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২৯ শে অক্টোবর, ২০১৮ রাত ১:১৯

স্বপ্নের শঙ্খচিল বলেছেন: পিতা গড়ে শুধু ছেলের শরীর
শিক্ষক গড়ে তার মন
পিতা বড় না শিক্ষক বড়
বলবে সে কোন জন?

........................................................................
খুবই সুন্দর এবং বাস্তব কথা

২৯ শে অক্টোবর, ২০১৮ রাত ১:৩১

সৃষ্টিশীল আলিম বলেছেন: নিরন্তর ভালোবাসা ও শুভকামনা।

২| ২৯ শে অক্টোবর, ২০১৮ বিকাল ৪:০১

রাজীব নুর বলেছেন: গ্রেট।
সালাম জানাই।

৩০ শে অক্টোবর, ২০১৮ রাত ১২:১৫

সৃষ্টিশীল আলিম বলেছেন: ধন্যবাদ ও শুভকামনা।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.