নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

পড়ি এবং লেখি

সৃষ্টিশীল আলিম

ক্ষুদে সাহিত্যিক, সৃষ্টির নেশায় উন্মুখ

সৃষ্টিশীল আলিম › বিস্তারিত পোস্টঃ

বোধের পাঠশালা: পর্ব ৪

২০ শে মার্চ, ২০২২ রাত ৮:০০



প্রাইমারি লাইফে একজন স্যারকেই সবচেয়ে বেশি মিস করি। বলা যায় তাঁর আদর্শ অনেকটাই আমার অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে গেছে। একালে অনেকেই হয়ত নাক ছিটকাবেন। প্রাইমারির শিক্ষকও আবার আদর্শ হয় নাকি?

শুচিবায়ুওয়ালাদের উদ্দেশ্যই বলছি, হ্যাঁ, হয়। প্রাইমারির এমনও শিক্ষক রয়েছেন যার কথা, আচার-আচরণ, দিকনির্দেশনা, আদেশ, উপদেশ, সদা হাসিমাখা মুখ, বিনয়ী ব্যবহার, পরম মমতায় কাছে টানা, কোনো শিক্ষার্থীকে প্রহার না করা ইত্যাদি ইত্যাদি গুণের কারণে অনেক শিক্ষার্থীর হৃদয়েই তাঁরা মূর্তমান হয়ে আছেন।

আমার জীবনের এমনই এক সেরা শিক্ষক আফাজ মৌলভী। আমরা তাঁকে মৌলভী স্যার বলেই ডাকতাম। আমার জানামতে স্কুলের কোনো শিক্ষার্থীই তাঁকে ভয় পেত না। বরং কোনো কারণে তিনি স্কুলে অনুপস্থিত হলে সকলেরই মন খারাপ হতো।

এই যে আমরা নিত্য গান শুনি—সব গানই কি আমাদের হৃদয় ছুঁতে পারে? নিশ্চয়ই নয়। এরকম সব সব শিক্ষকই সকল শিক্ষার্থীর হৃদয় ছুঁতে পারে? নিশ্চয়ই না। কোনো শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে যদি শিক্ষার্থীর মন খারাপ হয়, কিংবা সে শিক্ষকের উপস্থিতি সকল শিক্ষার্থী মনেপ্রাণে কামনা করে—বুঝতে হব তিনি শুধু শিক্ষকই নন, তিনি সবার প্রিয়জন, তিনি সবার ‘আইকন’।

শিক্ষক অনেকেই হতে পারেন, কিন্তু সেরা শিক্ষক হতে পারে কজন? আর সেরাদের সেরা হওয়া তো আরও অন্য বিষয়। ওই যে জীবনানন্দ দাশ তাঁর এক কবিতায় বলছিলেন—সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি; ব্যাপারটি ঠিক ওই রকমই। সকলেই আদর্শ শিক্ষক নন, কেউ কেউ। সকলেই আইকন নন, কেউ কেউ আইকন!

আমরা তাঁকে মৌলভী স্যার হিসেবই জানতাম। তাঁর মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় তখনও আমার জানা ছিল না। ক্লাসে কোনোদিন সে পরিচয় দিয়েছেন বলেও আমার মনে পড়ে না। প্রধান শিক্ষকের নির্দেশ মতো তাঁর টেবিলেও বেত থাকত। তবে সে বেতের ব্যবহার ছিল ভিন্ন!

কী বুঝতে পারলেন, তাই তো। তিনি ডিরোজিও মতো শিক্ষক। তিনি বন্ধুবৎসল। শিক্ষার্থীর ভেতরের সত্ত্বাকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করতেন। তাঁর পাঠদান ছিল আনন্দঘন। কোনো শিক্ষার্থীই তাঁর ক্লাসে বিরক্তি প্রকাশ করত না। কত মতের, কত পথের, কত নিয়ন্ত্রণহীন দুষ্টু, কত দুরন্ত শিশুদের নিয়েই যে প্রাইমারির শিক্ষকদের কাজ করতে হয়; প্রাইমারির শিক্ষক মাত্রেই তা স্বীকার করবেন। এত এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও যাঁরা এসব শিশু হদয়কে জয় করে পঠনপাঠনকে আনন্দমুখর করেন, তাঁরা নিঃসন্দেহ মহান শিক্ষক।

কোনো শিক্ষার্থী স্কুলে না এলে তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজখবর নিতেন। পারতপক্ষে তাঁর ক্লাসে কোনো শিক্ষার্থীই ফাঁকিজুঁকি দিত না। একালেও এমন শিক্ষক খুঁজে পাওয়া ভার!

আমি তাঁর কাছ থেকে এটাই শিখেছি—শিক্ষার্থীদের ভয় দেখিয়ে নয়, বরং ভালোবেসে পাঠদান করানো উচিত। বেতের স্থলে সদা হাসিমাখা মুখ। আর বিনয়ই হলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো অস্ত্র; যা দিয়ে পৃথিবীর কঠিন থেকে কঠিনতর বিষয় আয়ত্ত্বে আনা সম্ভব।

একজন শিক্ষার্থী ক্লাসমুখী না হলে এ ব্যর্থতা নিঃসন্দেহ সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের। কেননা, শিক্ষার্থীরা ক্লাসে বা পাঠে আনন্দ না পেলে তারা ক্লাস বিমুখ হয়। আর এ কারণে শিক্ষকে প্রতিনিয়ত হতে হয় আপডেট।

যাইহোক, এবার মূল কথায় আসি। পঞ্চম শ্রেণির ফলাফলে যারপরনাই খুশি হয়েছিলেন আমার এক আংকেল। তিনি শুধু আংকেলই নন, তিনি আমার পারিবারিক শিক্ষক। আমি আবুল কালাম আজাদ আংকেলের কথাই বলছি। তাকে কেউ কালাম ডাকে কেউ বা আবু। আমি কালাম আংকেলই ডাকি।

আমার লেখাপড়ার হাতেখড়ি মূলত তাঁর হাত ধরেই। উদ্যম, পরিশ্রম, শৃঙ্খলা এবং নিয়মানুবর্তিতাসহ জীবন গড়ার সকল কোর্সেই তিনি আমার লিপিপাঠ করিয়েছেন। এক জীবনে তাঁর ঋণ কখনোই শোধ হবার নয়।

তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম, শাসন আর যুগোপযোগী দিকনির্দেশনাতেই আমি প্রথম হতে পেরেছিলাম। ফলে আমার চেয়ে তিনিই সেদিন বেশি খুশি হয়েছিলেন। যা বলতে চাচ্ছিলাম—প্রাইমারির বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে খুশিমনে বাড়ি আসি। খুব উচ্ছ্বাস নিয়ে বাবাকে বললাম—আমি এক নাম্বার হইছি। সবার মধ্যে ফাস্ট। বাবা একটু মুচকি হাসলেন। আমার উচ্ছ্বাসের শতকরা ৫ ভাগও তার মধ্যে দেখতে পেলাম না। মুহূর্তে কিসমিসের মতো আমার সমস্ত আনন্দ চুপসে গেল। অনুমান করলাম আর বোধহয় পড়াশোনা করা হবে। বড়ো ভাইয়ের সঙ্গে বা বাবার সঙ্গে নিয়মিত কাজে লেগে যেতে হবে।

কত কাজ! কৃষি কাজ, পাথরের কাজ, গৃহস্থালির কাজ! প্রাইমারি লাইফে আমি ছিলাম খুবই দুরন্ত, দুষ্টু। অন্যের থেকে সবসময়ই বেশি কথা বলতাম। অবশ্য এ নিয়ে কেউ কেউ আবার আমাকে বাচালও বলত। সবচেয়ে দুরন্ত ছেলেটা, সবচেয়ে দুষ্টু ছেলেটা, সবচেয়ে বাচাল ছেলেটা হঠাৎই গম্ভীর হয়ে গেল। এসব বিষয় ভাবলে এখনও গা শিউরে ওঠে। মায়ের কাছ থেকে জানতে পারলাম—আমাকে আর পড়াশোনা করাবে না।

আমি মায়ের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। আমার অশ্রুসিক্ত চোখের ভাষায় সেদিন হয়ত তার হৃদয় ফেটে গিয়ছিল। ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীদের মতামতের খুব একটা মূল্যায়ন হয় না। মায়ের অসহায়ত্বটাও আমি বুঝি। আমি নিরাসক্ত। মা আমার দিকে একপলক তাকিয়ে মুহূর্তই মাথা নিচু করলেন। ছোটো হলেও মায়ের ভেতরের ক্ষরণটা আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম। আর মায়েরা তো সন্তানদের দীর্শ্বাসের ভাষাও বোঝেন!

যেদিন সার্টিফিকেট আনতে যাব, সেদিন আর দশজন শিক্ষার্থীর মতো আমার মনে কোনো আনন্দ ছিল না। সার্টিফিকেট হাতে নিয়ে সেই প্রিয় শিক্ষক আফাজ মৌলভী স্যারের কাছে গেলাম। তিনি মহা-আনন্দে আমার সার্টিফিকেটের গায়ে হাত বুলাচ্ছেন। হঠাৎ সে সার্টিফিকেটে আমার দুফোটা চোখের জল গড়িয়ে পড়ল।

স্যার স্তব্ধ হয়ে গেলেন। দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বললেন—কী হয়েছে? আমি কোনো উত্তর দিতে পারিনি। ভেতর থেকে কেন যেনো কোনো শব্দই বের হচ্ছে না। স্যার, বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলেন। আমাকে জড়িয়ে ধরতেই আমি হাউমাউ করে কেঁদে ফেললাম। স্যারকে কিছুই বলিনি; কিন্তু মনে হলো স্যার আমার হৃদয় পড়ে ফেললেন।


এভাবে কতক্ষণ যে তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলেন এ মুহূর্তে তার সঠিক হিসেবও আর মনে করতে পারি না। তবে মনে হলো স্যার নিজেও তাঁর আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতেও অনেক সময় নিয়েছিলেন। একসময় আমার কান্না থেমে যায়। কিন্তু তখন দীর্ঘশ্বাস বড়ো হতে থাকে। আমি স্যারের দিকে তাকাই। অপ্রত্যাশিত অশ্রুতে তাঁর চোখও টইটম্বুর। বমি দেখলে যেমন বমি পায় তেমনই কান্না দেখলেও কান্না পায়। কেননা, কান্না হলো সংক্রামক।

স্যার, এক হাতে চশমা খুলে অন্য হাতে রুমাল দিয়ে চোখের পিচুটি মোছার ছলে অশ্রু মুছলেন। তারপর মুখে কৃত্রিম হাসি এনে বললেন—বাড়িত যা পাগলা, তর মাইরে বলিস কালকে স্যার আসব।


পরদিন। বিকেল বেলা। স্যার সত্যি সত্যি আমাদের বাড়ি গিয়ে হাজির। তাও একা নন। স্কুলের সব স্যার! আমার চোখ তো একেবারেই ছানাবড়া! হেডস্যারকে দেখে তো আমি যারপরনাই অবাক হয়েছি। গরিবের বাড়িতে হাতির পা! অজ্ঞাত আনন্দে আমার হাতপা কাঁপছে। আমি দৌড়ে মাকে খবর দিলাম।

কুশলাদি বিনিময়ের পর সাধ্যমতো আপ্যায়ন করা হলো। মূলপর্ব মৌলভী স্যারই উপস্থাপন করলেন। তিনি কোনো ভূমিকা ছাড়াই বললেন—ছেলে আপনার এটা সর্বজন সত্য। তবে আজ থেকে আপনার ছেলের লেখাপড়ার যাবতীয় খরচ আমরা বহন করব। এই মেধাবী ছেলেটার পড়াশোনা থামানো যাবে না। আপনি কেবল তাকে স্কুলে যাওয়ার সুযোগ করে দিবেন। কী, পারবেন না?

মা তো রীতিমতো হতভম্ব। বাবা মাথা নিচু করে রইলেন। আপনার হয়ত বাবাকে ইতোমধ্যে গালিগালাজ শুরু করে দিয়েছেন। তবে আপাদত এটাই বলে রাখি—কিছু গালি ভবিষ্যতের জন্য জন্য জমিয়ে রাখুন, কিছু ভালোবাসাও!

হেডস্যার মুচকি হেসে বললেন—আপনার ফোয়া বৃত্তি ফাইছে। এখন তাকি তার আর কোনো টেখাপয়সা লাগত নায়, স্কুলো বেতনও দেওয়া লাগত নায়। বরং মাসে মাসে আফনার পোয়ায় স্কুল তাকি বৃত্তির টেখা পাইবা। আর ইতা দি তার হখল খরচ অই যাইব। আর যদি থোরা লাগে আমরা তো আছি। কিতা খইন মৌলভী সাব?মৌলবী স্যার মাথা নাড়েন।

আমি বাবার দিকে তাকিয়ে রইলাম। বাবা নির্বাক। অপরাধীর মতো অনেকটা অবনত মস্তকে বসে আছেন। স্যারের কথা শেষ হতেই তিনি এক দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। সে দীর্ঘশ্বাসের ভাষা কত যে জটিল তা ক্যালকুলাসের জটিল তত্ত্বে ধরা পড়বে কিনা সন্দেহ! তিনি দূর দিগন্তের পানে তাকালেন। কৌণিক দূরত্বে থাকায় তার দৃষ্টির ভাষা অধরাই রয়ে গেল। জগৎটা রহস্যময়। তার চেয়েও বেশি রহস্যময় জগতের মানুষজন। বাবার এক হাতে গামছা। সে গামছা দিয়ে মুখ মোছার ছলে চোখের জল মুছল কিনা ঠিক বোঝা গেল না। অদূরেই মগডালে বসা একটি কাক। সহসাই কা কা করে অদৃশ্য হয়ে গেল।

বোধের পাঠশালা
২০/০৩/২০২২
উপশহর, সিলেট

মন্তব্য ৭ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৭) মন্তব্য লিখুন

১| ২০ শে মার্চ, ২০২২ রাত ৮:৩৪

ইন্দ্রনীলা বলেছেন: বড় হয়ে তুমি কি পড়লে ভাইয়া?

হ্যাঁ এই শিক্ষকদের অবদান সাথে ভালোবাসা আসলেই ভুলে যাবার নয়।

২০ শে মার্চ, ২০২২ রাত ১০:৪২

সৃষ্টিশীল আলিম বলেছেন: নিরন্তর ভালোবাসা ও শুভকামনা জানবেন।

২০ শে মার্চ, ২০২২ রাত ১০:৪৩

সৃষ্টিশীল আলিম বলেছেন: কলেজশিক্ষক হলাম। তাও সাহিত্যের।

২| ২০ শে মার্চ, ২০২২ রাত ১০:৪৫

ইন্দ্রনীলা বলেছেন: বাহ! ভেরী গুড। অনেক শুভকামনা।

৩| ২১ শে মার্চ, ২০২২ রাত ১২:১৩

তানীম আব্দুল্লাহ্ বলেছেন: আপনার শিক্ষকদের জন্য শ্রদ্ধ্যা ।

৪| ২১ শে মার্চ, ২০২২ রাত ১:৫১

রাজীব নুর বলেছেন: মহৎ শিক্ষক এযুগে খুব কম।
আমি একজন মহৎ শিক্ষক পেয়েছিলাম। স্যারের নাম আলতাফ। মানুষ হিসেবে তিনি একজন ভালো মানুষ ।

২১ শে মার্চ, ২০২২ সকাল ৯:১৩

সৃষ্টিশীল আলিম বলেছেন: ভালোবাসা ও শুভকামনা জানবেন। আপনার স্যারের প্রতিও শ্রদ্ধা রইল।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.