নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

কী ভাবার কথা কি ভাবছি?

ডি এইচ খান

স্বাধীনতা অর্জনের চে রক্ষা করা কঠিন

ডি এইচ খান › বিস্তারিত পোস্টঃ

জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীর একরাত - ২

২১ শে জুলাই, ২০১৪ রাত ১২:২৯

দাগ হ্যামারশেল্ড, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বলেছিলেন, "শান্তিরক্ষা সৈনিকের কাজ না, অথচ একমাত্র সৈনিকেরাই পারে শান্তিরক্ষা করতে।" তো হ্যামারশেল্ড সাহেবের মতের সাথে দ্বিমত করতে না পেরেই বুঝি ২০০৯ এর জুন মাসের কোনএক সকালে আমার বর্তমান কর্মস্থল এক অনাড়ম্বর 'টি-আউট' এর মাধ্যমে প্রাক্তন হয়ে গেল। নিয়মরক্ষার বিদায়ীভাষনে বললাম, "আমার নতুন ঠিকানা সাউথ সুদানের জুবা নামক এক শহরে, সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন।" মিশনে যাবার উদ্দেশ্যে তাড়াহুড়া করেই ঢাকা চলে এলাম, শুনলাম আগস্ট মাসেই ফ্লাইট।



রোটেশন মিশন মানে জিনিসপত্র যা যেখানে আছে সেভাবেই থাকবে বিদেশের মাটিতে, স্রেফ নতুন লোক যাবে আর পুরাতনেরা ফিরে আসবে। দুর্ভাগ্যবশত আমাদেরটা রোটেশন মিশন ছিলনা। ঢাকায় গিয়ে দেখি অস্ত্র-গাড়ি-তাবু সবই নতুন করে সংগ্রহ করে, জাহাজে তুলে নিয়ে যেতে হবে। যাহোক হাড়ভাঙ্গা খাটুনি শেষে একদিন সরঞ্জামাদি নিয়ে জাহাজ পোর্ট সুদানের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। এই জাহাজ পোর্ট সুদানে ঠেকলেই আমরাও প্লেনে করে সুদানের উদ্দেশ্য উড়াল দেব। কিন্তু অক্টোবর যায়, নভেম্বর যায়, ডিসেম্বরও যায়। ফ্লাইটের কোন খবর নেই। স্লীম সাহেবের ফরগোটেন আর্মির মত আমরাও যেন ফরগোটেন কোম্পানি। কোম্পানি কমান্ডার প্রতিদিন নানান ফন্দি ফিকির করেন কোম্পানির মোরাল চাঙ্গা রাখার, কিন্তু হতাশা সবাইকে দিনরাত কুড়ে কুড়ে খায়।



জাহাজটা ঠিকই সময়মত পোর্ট সুদানে নোঙ্গর করেছিল। কিন্তু সুদান অধিপতি প্রেসিডেন্ট বশির এমনিতেই ইউএন এর উপর নাখোশ ছিলেন। তারউপর আরো একজাহাজ ইউএন সামানা তিনি তার দেশে ঢুকতে দিতে নারাজ। সপরিবারে আমরা আল্লাহ আল্লাহ করি, আল্লামা বশির সাহেবের দিলে যেন রহম হয়। কারন ইতোমধ্যে আমাদের পরে অন্যদেশের মিশনে যাদের নাম আসছে, তারা ছয় মাস মিশন শেষ করে ছুটি আসতে শুরু করেছে। আমাদের কোম্পানি টু আই সি মিজান স্যারের অবস্থা আরো শোচনীয়। ক্যাপ্টেন র‍্যাঙ্কে তার মিশনে যাবার কথা ছিল। এরিমধ্যে তার কোর্সমেটরা মেজর র‍্যাঙ্ক পরতে শুরু করছে। আজব ব্যাপার হল মিজান স্যারে দুঃখেই কিনা কে জানে, আমাদেরই আরেক সহকর্মীর মাথার চুল আরো দ্রুত পরতে লাগল।



যাহোক ফেব্রুয়ারি নাগাদ সব গিট্টু খুলল আর আমরাও এক মধ্যরাতে হৃদয়বিদারক পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে প্রিয়জনদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। কাঙ্খিত বিচ্ছেদের নতুন অনুভুতি নিয়ে যখন আমাদের প্রিয়জনেরা বাসায় গিয়ে কেবল দু চোখের পাতা এক করছেন, তখনি দরজায় করাঘাতের শব্দ। সুদান সরকারের শেষমুহুর্তের জটিলতায় আমাদের ফ্লাইট বাতিল, তাই শেষরাতে আমরা সবাই আবার ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়ন। ভালোই হল, সুদানে মিশনে অনিশ্চয়তার ব্যাপারটা সম্মন্ধে পরিবাররা আরো ওয়াকিবহাল হবার সুযোগ পেল। যাহোক, পরদিন রাতে সবাইকে হতবাক করে সতি সত্যি আমরা সুদানের উদ্দেশ্যে উড়লাম। আমাদের অনেকেরই প্রথম বিমান যাত্রা। সন্দেহ একটা অবশ্য সবার মনেই ছিল, ইয়েমেন পর্যন্ত গিয়ে না আবার ফেরত পাঠায়। সম্ভবত সেকারনেই ইয়েমেনে যাত্রাবিরতির সময় জর্দানী ক্রুরা ফ্লাইটের কাউকেই নিচে নামতে না দেবার মত বর্বরোচিত আদেশ দেবার পরও, স্মোকাররাসহ কেউই কোন টু শব্দটিও করলনা!



একরাশ মরীচিকা সাঁতরে বিমানটা জুবা রানওয়ে স্পর্শ করল। সিড়ি বেয়ে নিচে নামতেই সুদানিজ রোদে দুচোখ ঝলসে গেল। ব্যানব্যাট-৪ এর সদস্যরা সাদরে স্বাগত জানাল আমাদের। অদুরেই ছোট্ট একটা চা চক্রের আয়োজন ছিল। সেখানেই দেখলাম নবাগত আর বিদায়ীদের অভিজ্ঞতা, মোবাইল সিম আর মুদ্রা বিনিময়ের সংক্ষিপ্ত অথচ তাতপর্যপুর্ন ঘটনা।



জেট ল্যাগ কাটিয়ে উঠার আগেই রাত কেটে গেল। সকালেই টরিট ক্যাম্পের অভিমুখে হেলিকপ্টারে চেপে বসলাম আমরা ত্রিশ জন। টরিট হল ইস্টার্ন ইকোটরিয়ায় অবস্থিত একটা ইউএন ক্যাম্প। এরা বলে টম্পিং সাইট অথবা টিম সাইট। চারপাশে মাটির দেয়াল ঘেড়া, ভেতরে ইউএন এর নানান পদের এমপ্লয়িরা থাকে। নিরাপত্তার দায়িত্ব আমাদের। ইস্টার্ন ইকোটরিয়ার আয়তন প্রায় ৮২, ৫৪২ বর্গ কিঃ মিঃ। কোম্পানি সাইজের একটা ফোর্সের জন্য বেশ বড়সড় এলাকাই বলতে হয়।



মিশন এলাকায় আমার অভিজ্ঞতা আর উপলব্ধি বিচিত্র। মিশন এলাকায় পা দেবার অনেক আগেই শুরু হয়ে যায় একেকজন যোদ্ধাকে শান্তিরক্ষীতে রুপান্তরের দুরুহ আর জটিল প্রক্রিয়া। প্রক্রিয়াটা জটিল হলেও খুব জরুরী। ওয়েস্টার্ন যুবকেরা নাকি আর্মিতে যোগ দেয় চারটা কারনে। হয় এটা তাদের পারিবারিক ঐতিহ্য, দাদা আর্মিতে ছিল, বাবাও ছিল, সেও চায়; নাহয় সে ভাবে সে দেশপ্রেমিক, আর্মিতে এসে সে দেশের জন্য কিছু করতে চায়; আর নাহয় যেকোন একটা চাকরী হলেই তার চলত, চান্স পেয়ে গেসে আর্মিতে, তাই চাকরি করবে; আর কিছু ব্যাতিক্রমী ক্ষেত্রে কিছুলোক বৈধ পথে মানুষ মারার লাইসেন্সটা ভালবাসে, তাই আর্মিতে ঢোকে। উপমহাদেশে যারা যে কারনেই আর্মিতে ঢুকুক না কেন, পশ্চিমাদের সাথে আমাদের জব মোটিভেশনে বিস্তর ফারাক আছে।



প্রথম ও দ্বিতীয়, উভয় মহাযুদ্ধে অসংখ্য ভারতীয় সৈনিক বৃটিশদের হয়ে লড়ে প্রান দিয়েছে। ইম্ফল-কোহিমার যুদ্ধেতো বৃটিশ-জাপান দুপক্ষের হয়েই লড়েছে। মজার কথা হল এরা কেউই কিন্তু বৃটিশ রানী অথবা ইউনিয়ন জ্যাকের জন্য প্রান দেয়নি। প্রান দিয়েছে তাদের কমান্ডার আর রেজিমেন্টের জন্য। এই রেজিমেন্টের জন্য আত্মবিসর্জনের ধারাটা সারা বিশ্বে পুর্ব থেকে পশ্চিমে ক্রমশ হালকা হয়ে গেছে। ভাগ্যিস আমরা কিঞ্চিৎ পুর্ব দিকে পড়ে গিয়েছিলাম তাই রক্ষা। আর সেকারনেই শান্তিরক্ষী হিসেবে আমরা বেশ সহজাত। কেননা কঠোর রেজিমেন্টাল ঐতিহ্যের কারনেই আমাদের সৈনিকেরা পশ্চিমা সৈনিকদের মত সুরা আর সাকি তে অন্ধ আসক্ত নয়। তাই এহেন বিপর্যস্ত এলাকায় দ্রুত আমরা বিশ্বস্ততা অর্জন করতে পারি। আর শান্তিরক্ষায় বিশ্বস্ততার চে মোক্ষম আর কোন অস্ত্র নেই।



যুদ্ধ অথবা শান্তিরক্ষা মিশনের আরেক সুবিধা হল লোকবল আর রসদের পর্যাপ্ততা। তারপরও গোটা ইস্টার্ন ইকোটরিয়ার আয়তন আমাদের জন্য একটু বেশিই ছিল বলা চলে। কাপোয়েতা ছিল আমাদের দুরবর্তী গন্তব্য, অথচ এরপরও আরো অন্তত ২০০ কিঃ মিঃ এলাকায় কোন ইউএন ফোর্স কখনই পা ফেলেনি। রাজধানী জুবার কয়েক কিলো বাদে গোটা সাউথ সুদানের সব রাস্তাই তখন কাচা ছিল। গুড়িগুড়ি লালচে নুড়ি পাথরের খানখন্দে ভরা রাস্তা, প্রায় জ্যামতিক ভাবে সরল রৈখিক। সুর্য যতক্ষন আকাশে থাকে ততক্ষনই প্রচন্দ তেতেই থাকে আর রাস্তার দুপাশে মাইলের পর মাইল বুক সমান উঁচু কাটাঝোপ। ইংরেজিতে বলে সাভান্নাহ। রাস্তার পাশে ক্বচিৎ কোন বড় গাছের দেখা মেলে। খানখন্দে ভরা কাচা রাস্তা ধরে আমাদের কনভয় ধুকতে ধুকতে এগিয়ে চলত।



কাপোয়েতা ছিল টরিটের পুর্বদিকে। বিশাল কাউন্টি; উত্তর, দক্ষিন আর পুর্ব কাপোয়েতায় বিভক্ত। পুর্ব কাপোয়েতায় শুনেছি স্বর্নখনি আছে, দেখার সৌভাগ্য হয়নি কখনো, রহস্যময় কারনে ইউএন কখনও ওখানটায় যাওয়া পছন্দ করেনা। চুকুদুম আর ইকোটস পাশাপাশি কাউন্টি, পুরোটাই পার্বত্য এলাকা। রাস্তা বিপদজনক সব বাঁকে ভরা। কালো বীভৎস সব পাথরের পাহাড় দেখলে গা শিউরে ওঠে। গাড়ি নস্ট হয়ে কনভয় একবার ফেঁসে গিয়ে বেশ বিপদেই পড়েছিলাম। লাফোন মোটামুটি ফিচারলেস কাউন্টিই ছিল, কিন্তু কেনিয়া-উগান্ডা সীমান্তবর্তী মাগউই কাউন্টি ছিল ছবির মত সুন্দর।



কেনেটি নদীর ধারে টরিট ছিল এই এলাকার প্রানকেন্দ্র। কমবেশি ২২ টা এনজিও এই এলাকায় কাজ করত। আমাদের চেনা ব্র্যাকও ছিল। ছিল ব্র্যাকের বাংলাদেশি ভায়েরাও। এরা সবাই এখানে বিনাসুদে ঋণ দেয়। স্থানীয়রা আবার ঋণ শোধে একেবারেই সিরিয়াস না। তারপরও দেয়, ব্র্যাকও একি কাজ করে। স্বার্থটা কি বুঝিনি, বুঝতে চাইওনি। ২২ টা এনজিও নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে, অথচ দেশটা এককদমও এগুচ্ছেনা। এখানে পুরো একটা প্রজন্ম গত প্রায় ষাট বছর ধরে নর্থ সুদানের সাথে লড়ে চলেছে। অবকাঠামো বলতে কিছুই নেই। প্রত্যন্ত এলাকায় সুন্দর সুন্দর সব গীর্জা। সাউথ সুদান জুড়ে নানান অজুহাতে পশ্চিমাদের অবাধ আনাগোনা। কেউ মাইন সরায়, কেউ উদ্বাস্তু সামলায়, কেউ গভীর নলকুপ বসায়, কেউ রিসোর্ট চালায়, কেউ স্কুল-হাস্পাতাল চালায়। এখানে পানির বোতলের চে বিয়ার সস্তা, আর স্থানীয়রা সেই বিয়ার আর চোলাই খেয়ে সারাদিন বুদ হয়ে থাকে। টাকা কুত্থেকে আসে, সেটাও এক রহস্য। সুদান পিপুলস রিপাব্লিকান আর্মি নামের একটা মিলিশিয়া নর্থ সুদানের আর্মির সাথে লড়ে তাই দেশটাও তারাই চালায়। সামনের রেফারেন্ডামে দেশটা ভাগ হবে, সাউথ সুদান নামে একটা নতুন রাস্ট্র জন্ম নেবে, সে বিষয়টা প্রায় নিশ্চিত। অথচ নতুন দেশের নাম কি হবে, পতাকা কেমন হবে সেসব নিয়ে কেউ কিছুই জানেনা। ২২ টা এনজিওর রাজনীতি বোঝা আমার মত লোকের পক্ষে বোঝা সত্যি কঠিন!



(চলবে)

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২১ শে জুলাই, ২০১৪ বিকাল ৫:৫০

মুদ্‌দাকির বলেছেন: দারুণ বর্ননা, দারুল লিখেছেন

২১ শে জুলাই, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:০৩

ডি এইচ খান বলেছেন: মুদদাকির ভাই, অসংখ্য ধন্যবাদ

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.