নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

কী ভাবার কথা কি ভাবছি?

ডি এইচ খান

স্বাধীনতা অর্জনের চে রক্ষা করা কঠিন

ডি এইচ খান › বিস্তারিত পোস্টঃ

আমি যখন হিলস এ ছিলাম – ২

২১ শে জুলাই, ২০১৪ রাত ১২:৩৩

‘জংলী বুট’ আসলে ‘জাঙ্গল বুট’ কথাটার অপভ্রংশ। সবদেশের সেনাবাহিনীতেই এ জাতীয় ‘জার্গন’ এর চল আছে। যেমন আমাদের এখানেও নাকি একসময় ‘ফিল্ড সার্ভিসেস মার্চিং অর্ডার (এফএসএমও)’ কে স্রেফ ঝোলা-চামড়া বলত, ইউনিফর্ম কে বলত ‘বর্দি’ (সম্ভবত উর্দি থেকে বর্দি)। যাহোক, পার্বত্য এলাকার উঁচু নিচু রাস্তার কথা ভেবেই সম্ভবত প্রচলিত চামড়ার কালো বুটের বদলে এই জংলি বুট ইস্যু ছিল। রাবার সোল আর কাপড় দিয়ে বানানো এইবুট পরে পেট্রোলিং করতে আসলেই খুব সুবিধা হত। বিড়ালের মত প্রায় নিঃশব্দেই হাঁটা যেত, শুধু দৌড়াতে গেলেই থপ থপ শব্দ হত। মজার ব্যাপার হল, এই বুট পরে দৌড়ালেই কেন যেন আমার ডিউস বল দিয়ে ক্রিকেট খেলার কথা মনে পড়ত, ব্যাট দিয়ে এই রাবার ডিউস বলে জোড়ে হিট করার পর বলটা আকাশে উঠেই কেমন যেন লম্বাটে হয়ে নেমে আসতো। টেপ টেনিসে খেলে অভ্যাস্ত প্লেয়ারদের ক্যাচ করতে সমস্যা হত।



একবার আমার এক কোর্সমেটের নিমন্ত্রনে গিয়েছিলাম তাদের মাঠে ক্রিকেট খেলতে। আমাদের টিমটা ভালই ছিল। কিন্তু ওদের মাঠে গিয়ে দেখি ওরা ডিউস বল দিয়ে খেলে। আমরা আবার টেপ টেনিসে খেলতাম। প্রীতি ম্যাচ, তাই আর দ্বিরুক্তি না করেই খেলতে নেমে গেলাম এবং হেরে এলাম। দুই ধরনের বলের পেস, মুভমেন্ট আর ড্রপিং রেস্পন্স একেবারেই দুইরকমের, তাই এডজাস্ট করে উঠার আগেই ম্যাচ হাতছাড়া! লেসন লার্ন্ট হইল, একমাত্র সিনেমাতেই এমনটা সম্ভব যে মোক্ষম সময়ে তুমি দেখবা আশেপাশে মাটিতেই একটা পিস্তল পরে আছে, সেইটার আবার ম্যাগাজিনও গুলিভরা থাকবে, আর তুমি খালি কুড়ায়া নিয়াই ঠা-ঠা গুলি চালাইতে পারবা। বাস্তব জীবনে ইফ ইউ আরন্ট সার্টেন এবাউট দ্য উইয়েপন এন্ড টেরেইন, বেটার লিভ দ্য গ্রাউন্ড এন্ড কামব্যাক লেটার।



আমার প্রথম পেট্রলিং এর অভিজ্ঞতা ভয়াবহ। সকাল সকাল নাইক্ক্যাপাড়া ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে সবুজ পাহাড়ের কার্নিশ দিয়ে পায়েচলা পথ ধরে এগুচ্ছিলাম আর মুগ্ধ হয়ে চারপাশ দেখছিলাম। কালো আর খয়েরী রঙের দুইটা কুকুর, শাবানা আর রোজিনা সাথে চলেছে। এরা ক্যাম্পের উচ্ছিস্ট খেয়ে থাকে। সারাদিন দেখা মেলে না, কিন্তু পেট্রল বের হলেই কোথা থেকে এসে হাজির হয়ে যায়। হয়ত কখনও কোন ক্যাম্প কমান্ডার ওদের আদর করত, হয়ত কিছুটা ট্রেনিং ও দিয়েছিল। সেই ক্যাম্প কমান্ডার চলে গ্যাছে, কিন্তু ওরা আর ক্যাম্পের মায়া ছাড়তে পারেনি। পেট্রলিং এর সময় অবাক হয়ে দেখলাম, এদের একজন সব সময় সামনের পয়েন্ট স্কাঊটের সাথে থাকে আর আরেকজন সারাক্ষন আমার আশেপাশে ঘুরঘুর করে। আবার মাঝেমাঝে পেছনেরটা সামনে আর সামনেরটা পেছনে জায়গাও বদল করে। পরে অনেকবারই আমার মনে হয়েছে আমাদের প্রত্যেক ক্যাম্পেই এমন একজোড়া করে কুকুর থাকলে খুব ভাল হত।



যাহোক, কিছুক্ষন পর পেট্রল সার্জেন্ট একটা ব্রেক নেবার প্রস্তাব করল। আমি তখনো কান্ত বোধ করছিলাম না, তাই সেকেন্ড লেফটেন্যান্টের জোশে প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে এগিয়ে চললাম। চারটা পাহাড় পার হতে না হতেই দেখি আমার ওয়াটার বটল প্রায় খালি। পথ চলতে চলতে কখন যে সবটা পানি সাবরে দিয়েছি সেই খেয়াল নেই। বাকিটা পথ কিভাবে চলবে ভাবতেই গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এল। আশে পাশে পানির কোন উৎসই চোখে পরে না। সবার কোমরেই আমার মত ঐ একটা করেই ওয়াটার বটল ঝুলছে, তাই অন্যকারো কাছে চাইতেও পারছিনা লজ্জায়। দুপুরের দিকে সুর্য যখন ঠিক মাথার উপর, কলার থেকে জংলি বুট অবধি আমরা সবাই তখন কুলকুল করে ঘামছি। আক্ষরিক অর্থেই আমার মনে হচ্ছিল আমি একটা স্বচ্ছ কাঁচের পানি ভর্তি বোতলের ভেতর বসে যেন চারপাশটা দেখছি। তারপরও প্রানপন চেস্টায় যতটা সম্ভব নির্বিকার ভাবে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাত মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল।



মুখে পানির ঝাপটা পেয়ে সংবিত ফিরে পেয়ে দেখি আমার পেট্রল সার্জেন্টের কোলে আমার মাথা। চট করে উঠে বসলাম। এবার সবাই নির্ভার হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে রেস্ট নিতে লাগল। আমাকে হতবাক করে দিয়ে সার্জেন্ট তার বিগপ্যাক থেকে ধীরেসুস্থে ভরা একটা ওয়াটার বটল বের করে এগিয়ে দিয়ে কোমোর থেকে আমার খালি ওয়াটার বটলটা খুলে নিল। কোথায় যেন পড়েছিলাম, একবার স্যান্ডহার্স্টের এক সার্জেন্টকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে ইউনিটে সেকেন্ড লেফটেন্যান্টদের কাজ কি? উত্তরে সে নাকি বলেছিল যে সেকেন্ড লেফটেন্যান্টরা যুদ্ধক্ষেত্রে ইনিশিয়েটিভ দেখাতে গিয়ে প্রান দেবেন আর আমাদের জন্য আত্মত্যাগের উদাহরন তৈরি করবেন। এই বক্তব্যের প্রেক্ষাপট কি তা জানিনা, তবে একথা অনস্বীকার্য যে যুগযুগ ধরে ভাল সার্জেন্টরা সাবাল্টার্ন্দের ভাল অফিসার হয়ে উঠতে গুরুত্বপুর্ন ভুমিকা রেখে আসছে।



আরেকবার পেট্রলিং এর সময় পথে একটা ছরা পড়ল। ছরা হল পাহাড়ি নালা। এম্নিতে গোড়ালি-হাটু পানি বয়ে যায়। কিন্তু বৃস্টির পরপর প্রচন্ড খরস্রোতা হয়ে ওঠে। এতোটাই খরস্রোতা যে স্বচক্ষে না দেখলে আন্দাজ করা কঠিন। তো সেদিনকার ছরাটা ছিল দশ-পনের ফিট চওড়া আর হাটু পরিমান গভীর। হঠাত দেখি পেট্রল জেসিওর ইশারায় দুজন মিলে আমাকে কাঁধে তুলে ছরাটা পার করে ফেলল। না না করেও লাভ হল না। ব্যাপারটা আমার মোটেই পছন্দ হলনা। তাই ওপারে পৌছে প্রথম ব্রেক নেবার সাথে সাথে পেট্রল জেসিওর কাছে জানতে চাইলাম কেন তিনি এমন করলেন। সে সরল হেসে জবাবদিহি করল, যেন আমার বুট না ভিজে যায় সেজন্যই এমন করা। ব্যাপারটা আরো হাস্যকর লাগল আর মেজাজটা আরো তেতে উঠল।



আমার রাগটা টের পেয়ে পেট্রল জেসিও তার ভাষায় যে ব্যাখ্যাটা দিলেন তার সারমর্ম হল, আপনি পেট্রল কমান্ডার আর আপনাকে ফিট রাখাটা আমাদের কর্তব্য। আমাদের কর্তব্য এজন্য যে, সৈনিক হিসেবে আমার ওপর ফায়ার আসলে আমি কিভাবে ফায়ার ব্যাক করব, সেইটা আমাকে শেখানো হয়েছে। আর আপনাকে শেখানো হয়েছে কিভাবে গোটা পেট্রলটাকে সেভ করে বের করে নিয়ে যাবেন। ফায়ার ওপেন হলেই প্রথমে কমান্ডারকে কভার করতে হবে, এইটাই নিয়ম। এজন্যই আমদের গায়ে গুলি লাগিয়ে হলেও আপনার গায়ে আমরা গুলি লাগতে দেবনা। কেননা আমাদের স্বার্থেই আপনাকে, আপনার মাথাটাকে আমাদের দরকার। আর আপদের সময় আপনার মাথাটা যেন গুলায়া না যায় সেইজন্যই মাথাটা ঠান্ডা রাখা জরুরী। সেইজন্যই আপনার বুট যেন না ভিজে, আপনি যেন আমাদের চেয়ে বেশি ক্লান্ত হয়ে না পড়েন সেইটা নিশ্চিত করাও জরুরী।



আমাদের ভাষাগত সীমাবদ্ধতা আছে, শব্দ ভান্ডারেও ঘাটতি আছে। কিন্তু সবচে গুরুত্বপুর্ন হল প্রাচীনতম পেশা হিসেবে সৈনিক জীবনের ট্র্যাডিশনাল স্পিরিটটাকে উপলব্ধি করতে পারা। জাতি হিসেবে আমরা এমনিতেই ‘সরি’ ‘থাঙ্ক ইউ’ বলতে এখনও তেমন সচ্ছন্দ্য নই। কিনতু এর মানে এই না যে আমরা অনুশোচিত বা কৃতার্থ হই না। এই উপলব্ধিটা কিন্তু দ্বিপাক্ষিক, এই উপলব্ধি থেকেই আসে তথাকথিত ‘বন্ড’ (অনেকেই বলে ‘বন্ডেজ’, কথাটা ভুল, ‘বন্ডেজ’ শব্দের অর্থ অন্যকিছু!)। কোথায় যেন পড়েছিলাম, কে যেন বলেছিলেন, আমরা প্রায়শই লয়ালটির কথা বলি, ব্যাপারটা স্রেফ উর্ধমুখী না, লায়ালটি একটি উভমুখী ব্যাপার। উপলব্ধি থেকে দায়বদ্ধতা, আর দায়বদ্ধতা থেকে কর্তব্যবোধ।



পুনশ্চঃইউএস আর্মির ওয়ারিওর ইথোসের একটা লাইন খুব চমৎকার, i will never leave a fallen comrade...kudos!!



মন্তব্য ৭ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৭) মন্তব্য লিখুন

১| ২১ শে জুলাই, ২০১৪ দুপুর ১:২৬

ভুং ভাং বলেছেন: ভাল লাগলো।

২১ শে জুলাই, ২০১৪ বিকাল ৩:৫২

ডি এইচ খান বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই

২| ২২ শে জুলাই, ২০১৪ রাত ১:১৭

ইয়ার শরীফ বলেছেন: will never leave a fallen comrade

ভালো লাগলো

২২ শে জুলাই, ২০১৪ বিকাল ৩:০৬

ডি এইচ খান বলেছেন: আপনাকে ধন্যবাদ ভাই

৩| ২১ শে আগস্ট, ২০১৪ বিকাল ৪:৪১

বিতর্কিত বিতার্কিক বলেছেন: সিরিজটা থামিয়ে দিলেন কেন? ভালই তো লাগছিল। বেশিরভাগ সিভিলিয়ানেরই সামরিক জীবন সম্পর্কে তেমন কোন আইডিয়া নেই। আইডিয়া পাবার উপায়ও খুব বেশি নেই।
সামরিক বাহিনী সম্পর্কে জ্ঞানঃ "দেশের টাকায় আজাইরা হাতি পালা" তে সীমাবদ্ধ। সেখানে এই ধরনের লেখার গুরুত্ব আছে।
মন্তব্য না করলেও আপনার আর্ট অব ওয়ার খুব উপভোগ করছি। সেই ব্যস্ততার ফাঁকে এই সিরিজটাও চললে ক্ষতি কি?

২১ শে আগস্ট, ২০১৪ বিকাল ৫:৩৫

ডি এইচ খান বলেছেন: কে যেন বলল আরো স্মৃতি জমে নিক, তারপর স্মৃতি রোমন্থন কোরো; আমিও বললাম তথাস্তু! তাই এই আপাত অচলাবস্থা।

"দেশের টাকায় আজাইরা হাতি পালা" !!! হাহাহা, হাতি কিন্তু মরলেও লাখ টাকার।

আপাতত আর্ট অব ওয়ার নিয়েই আছি রে ভাই, প্রজেক্ট টা শেষ করতে পারাটা আমার নিজের জন্যই খুব জরুরী। হাতিদেরওতো শখ হয় কিছু কাজ শেষ করে যেতে, এইটা পরের প্রজন্মের করভ দের জন্য কিঞ্চিত দায়বদ্ধতাই বলতে পারেন।

আপনার লেখা খুব ঝরঝরে, পড়তে ভাল লাগে। ধন্যবাদ ভাই।

৪| ১৫ ই মার্চ, ২০১৬ রাত ৮:২৩

আততায়ী আলতাইয়ার বলেছেন: আমাদের ভাষাগত সীমাবদ্ধতা আছে, শব্দ ভান্ডারেও ঘাটতি আছে। কিন্তু সবচে গুরুত্বপুর্ন হল প্রাচীনতম পেশা হিসেবে সৈনিক জীবনের ট্র্যাডিশনাল স্পিরিটটাকে উপলব্ধি করতে পারা।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.