নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

কী ভাবার কথা কি ভাবছি?

ডি এইচ খান

স্বাধীনতা অর্জনের চে রক্ষা করা কঠিন

ডি এইচ খান › বিস্তারিত পোস্টঃ

'দ্য আর্ট অব ওয়ার' : ১২ : এটাক বাই ফায়ার

২১ শে আগস্ট, ২০১৪ বিকাল ৫:৪২





মেল গিবসন অভিনীত ‘দ্য পেট্রিয়ট (২০০০)’ মুভির দৃশ্য। সাউথ ক্যারলিনার বিদ্রোহী নেতা বেঞ্জামিন মার্টিন (মেল গিবসন) গিয়েছেন বৃটিশ কন্টিনেন্টাল আর্মির জেনারেল কর্নওয়ালিসের অফিসে দেখা করতে। উদ্দেশ্য কন্টিনেন্টাল আর্মির হাতে ধরা পরা কিছু বিদ্রোহীদের ছারিয়ে নিয়ে যাওয়া। কর্নওয়ালিসের অফিসে যাওয়ার আগে বেঞ্জামিন মার্টিন কিছু খড়ের তৈরি পুতুলের গায়ে বৃটিশ অফিসারদের ইউনিফর্ম পরিয়ে দিয়ে এমন জায়গায় খুটির সাথে বেঁধে রেখে এসেছিলেন, যেন কর্নওয়ালিস চোখে দুরবীন ঠেকালেই খুটির সাথে বেধে রাখা একসারি বৃটিশ অফিসারদের আবছা দেখতে পান। বেঞ্জামিনের এই আয়োজন দেখার পর কর্নওয়ালিস চোখ থেকে দূরবীন নামিয়ে বললেন, ‘ওদের নাম আর র‍্যাঙ্ক কি?’



জবাবে বেঞ্জামিন মার্টিন বললেন, ‘তারা আমাকে তাদের নাম বলেনি। তবে তাদের নয় জন লেফটেন্যান্ট, পাচ জন ক্যাপ্টেন, তিনজন মেজর, আর একজন খুব মোটা কর্নেল যিনি আমাকে “চিকি ফেলো” বলে ডাকছিলেন।’



কর্নওয়ালিস উষ্মা প্রকাশ করে বললেন, ‘আপনি জানেন কোন ভদ্রলোক এমন কাজ করতে পারেন না।’



বেঞ্জামিন মার্টিন জবাব দিলেন, ‘আপনার অফিসারদের কাজকর্ম যদি ভদ্রলোক যাচাইয়ের মাপকাঠি হয়, সেক্ষেত্রে আমি নিজেকে প্রশংসিতই ভাবব। যাহোক, আমি কি এবার আমার লোকদের নিয়ে যেতে পারি?’



বিব্রত কর্নওয়ালিস চিবিয়ে চিবিয়ে জেনারেল ও’হারার উদ্দেশ্য উচ্চারন করলেন, ‘আরেঞ্জ দ্য এক্সচেঞ্জ!’



‘দ্য পেট্রিয়ট’ মুভির বেঞ্জামিন মার্টিন চরিত্রটি আদতে আধুনিক গেরিলা যুদ্ধের জনক ফ্রান্সিস মেরিওনের ছায়া অবলম্বনে তৈরি। ফ্রান্সিস ১৭ শতকে যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ক্যারোলিনা রাজ্যে বৃটিশ কন্টিনেন্টাল আর্মির বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। গেরিলা যুদ্ধে তার সাফল্যের জন্য তাকে ‘সোয়াম্প ফক্স’ নামে ডাকা হত। একবার তাকে ধরতে বৃটিশ কর্নেল টার্লেটন জলাভুমির ভেতর দিয়ে টানা ২৬ মাইলেরও বেশি পর্যন্ত পিছু ধাওয়া করে ব্যর্থ হয়ে বলেছিলেন, ‘স্বয়ং শয়তানেরও সাধ্য নেই এই বুড়ো শিয়ালটাকে ধরার!’



যাহোক, সেয়ানে সেয়ানে যুদ্ধে চমৎকার সব ট্যাকটিকাল মেনুভার দেখা যায়, কিন্তু অসম যুদ্ধেও কিন্তু কম চমক থাকেনা। ২০০৬ সালের ইসরায়েল বনাম হেজবুল্লাহ যুদ্ধে সুসজ্জিত ইসরায়েলী বাহিনীর বিরুদ্ধে হেজবুল্লাহ সেনাদের কৌশলী যুদ্ধ ছিল সত্যি চমকপ্রদ। ইসরায়েলী বিমান বাহিনীর সামর্থ্যের বিপরীতে তারা তাদের কাতিউশা রকেট লাঞ্চার গুলো কুয়ার ভেতর এমনভাবে বসিয়েছিল যে রকেট ছোড়ার পর ইসরায়েলী বিমান আসার আগেই তারা পুলি টেনে এই লাঞ্চারগুলো কুয়ার গভীরে নিয়ে ওপরটা ঢেকে দিত, আর ইসরায়েলি বিমানগুলো টার্গেট খুঁজে হয়রান হয়ে ফিরে আসত। হেজবুল্লাহরা দামী ইসরায়েলি ট্যাঙ্কের সাথে ট্যাঙ্ক কিনে পাল্লা না দিয়ে স্রেফ রাশান এন্টি-ট্যাঙ্ক মিসাইল দিয়ে টেক্কা মেরে দিল। তেত্রিশ দিনের এই যুদ্ধ শেষে শক্তিশালী ইসরায়েলী বাহিনী হাল ছেড়ে দিয়ে পিছু হটল। এই যুদ্ধ শেষে জনৈক ইসরায়েলী সৈন্যের স্বীকারোক্তি ছিল, ‘হেজবুল্লাহরা হামাস অথবা ফিলিস্তিনিদের মত না। এরা প্রশিক্ষিত আর উন্নত্মানের যোদ্ধা। এদের সাথে লড়তে এসে আমরা সবাই বেশ অবাক হয়েছি।’



সানজুর এই অধ্যায়ের নাম ‘অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে আক্রমন।’ যুদ্ধে আগুনের ব্যবহার সত্যি ভয়ঙ্কর। কারন এঁর তাপে যেমন গা ঝলসে যায়, তেমনি ধোয়ার কারনে শ্বাস নিতেও কস্ট হয়। তাছাড়া ধোঁয়ার কারনে খুব বেশিদুর পর্যন্ত দেখাও যায়না, তাই সৈন্যদের মাঝে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পরে সহজেই। আধুনিক যুদ্ধক্ষত্রে এই ইফেক্টগুলোই নিশ্চিত করা হয় নানান ধরনের বোমা-গোলা মেরে। তাই সানজুর অগ্নিসংযোগ বলতে এই সময়ে আপনাকে বিভিন্ন প্রকার আধুনিক বোমা-গোলাবর্ষনকেই বুঝে নিতে হবে। সানজুর মতে পাঁচ উপায়ে আপনি বোমাবর্ষনের মাধ্যমে আক্রমন করতে পারেন।



একঃ শত্রুর ক্যাম্পের ওপর অগ্নিসংযোগ করে তাদের ক্যাম্প তছনছ করে দিতে পারেন। শত্রুর ক্যাম্পে এমন অতর্কিত আক্রমন তাদের মধ্যে চরম ভীতি আর বিভ্রান্তি সৃস্টি করে।



দুইঃ শত্রুর খাদ্য আর জ্বালানীর মজুদে অগ্নিসংযোগ করে তাদের ভীষন অসুবিধায় ফেলে দেয়া যায়। কখনো কখনো এমন আক্রমনের কারনে শত্রু তার পরিকল্পনা বদলাতে, এমনকি পিছু হটতেও বাধ্য হয়।



তিনঃ শত্রুর সাপ্লাই লাইনে অগ্নিসংযোগ করেও তাকে সিদ্ধান্তহীনতায় ফেলে দেয়া যায়।



চারঃ শত্রুর গোলাবারুদের মজুদে অগ্নিসংযোগ করতে পারলে একে তো তাদের যুদ্ধের জন্য অপরিহার্য গোলাবারুদে টান পরে, তারউপর গোলাবারুদের মজুদ বিস্ফোরিত হয়ে চারপাশে ভয়াবহ বিপর্যয়ও ডেকে আনে।



পাচঃ সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে আক্রমন শত্রু সৈন্যদের সরাসরি হতাহত করে, আর এঁর কলে সৃস্ট ধোঁয়ার কুয়াশা যুদ্ধক্ষেত্রে ছড়িয়ে দেয় ভীতি আর বিভ্রান্তি।





অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে আক্রমনের জন্য উপযুক্ত উপকরন সবসময় মজুদ থাকা চাই। শুষ্ক মৌসুম এ ধরনের আক্রমনের জন্য উপযুক্ত। বাতাসের গতি আর দিক বোঝাও খুব জরুরী। অনুকুল বাতাসের দিক বুঝে আগুন লাগালে আগুন আর ধোঁয়া শত্রুর দিকে ছুটে যায়। মনেরাখা ভাল যে, বদ্ধ পরিবেশে কিন্তু আগুনের চে ধোঁয়ার কারনে বেশি প্রানহানী হয়। অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে আক্রমনের সময় পাঁচটি বিষয়ে তৎপর থাকতে হয়।



একঃ ক্যাম্পে আগুন লাগার পর শত্রুদের মাঝে যখন বিশৃংখলা দেখা দেয়, তখনি আক্রমন করতে হয়। আধুনিক যুদ্ধে আক্রমনের আগমুহুর্ত পর্যন্ত শত্রু অবস্থানের ওপর টানা গোলাবর্ষন করা হয়। ২য় বিশ্বযুদ্ধে এল-আলামিনের প্রান্তরে জার্মানদের বিরুদ্ধে বৃটিশ ফিল্ড মার্শাল মন্টগোমারির অপারেশন লাইটফুট শুরুর পুর্বে টানা সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা ধরে ৮৮২টা কামান শত্রুর ওপর গোলাবর্ষন করেছিল। মোট গোলার সংখ্যা ছিল ৫,২৯,০০০!



দুইঃ ক্যাম্পে আগুন লাগার পরও শত্রুদের মাঝে যদি কাঙ্ক্ষিত বিশৃংখলা না দেখা যায়, তবে বুঝতে হবে শত্রুর প্রস্তুতি বেশ ভাল বলেই অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে প্রত্যাশিত চমক অর্জন করতে আপনি ব্যর্থ হয়েছেন। আর প্রস্তুত শত্রুকে আক্রমনে জয়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ।



তিনঃ আগুনের লেলিহান শিখা যখন দাউ দাউ করে জ্বলে তখন শত্রু সেনারা দিশেহারা থাকে, তাই এটাই আক্রমনের মোক্ষম সময়। আর আগুন যখন নিভু নিভু ততক্ষনে শত্রু নিজেদের ফিরে পেতে শুরু করে, তাই এসময় আক্রমন না করাই শ্রেয়।



চারঃ দূর থেকে নিক্ষেপ করে যদি শত্রুর ক্যাম্পে আগুন লাগান যায়, সেক্ষেত্রে ক্যাম্পের ভেতর ঢুকে আগুন লাগাবার ঝুঁকি না নেয়াই ভাল। আর আগুন লাগানোর পর উপযুক্ত মুহুর্তে আক্রমন করা সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন।



পাচঃ বাতাস যেদিকে বয়, আগুন সেদিকেই ধেয়ে যায়। তাই আক্রমনের সময় আগুনের পিছু পিছু এগুতে হয়। বাতাসের গতি যদি অনুকুলে না থাকে, অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে আক্রমনের চেস্টা না করাই ভাল।



অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে আক্রমনের ক্ষেত্রে আগুন নিয়ন্ত্রনের কৌশল জানা আবশ্যক। দিনের কখন কি ধরনের বাতাস বয়ে যায়, তা জানতে হবে। জানতে হবে আকাশের গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান। সর্বপোরি মোক্ষম সময়ের প্রতি নজর রাখতে হবে, যেন কোন সুবর্ন সুযোগ হাতছাড়া না হয়।





ঝড় বৃস্টির রাতে দেখার আর শোনার ক্ষমতা কমে যায়, তাই এমন আবহাওয়ার সুযোগে আপনি সহজেই শত্রুর খুব কাছে পৌছে যেতে পারেন। খরস্রোতা নদী পার হওয়া কঠিন, তাই নদী সামনে রেখে ডিফেন্স নিলে অনেক সুবিধা। কর্দমাক্ত এলাকা শত্রুর চলার গতিকে শ্লথ করে দেয়। আবার আটকে রাখা পানি হঠাত ছেড়ে দিয়ে শত্রুকে ভাসিয়ে দেয়া যায়। তাইতো আগুনের মত ভয়ঙ্কর না হলেও, কাজে লাগাতে জানলে পানিও কিন্তু কম বিধ্বংসী না।





১৯২১ সালে লিডেলহার্ট আক্রমনের নতুন ধারনা দিলেন। তার মতে আক্রমন করা যায় দুইভাবে। একঃ ম্যান ইন দ্য ডার্ক রুম কনসেপ্ট। ধরুন আপনি আর আপনার শত্রু দুইজনই একটা অন্ধকার ঘরে আটকা পরে আছেন। কেউ কাউকে দেখতে পান না। তখন আপনি কি করেন? প্রথমে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সতর্ক হন, এইটা হল যুদ্ধে যে কোন আর্মির সহজাত ডিফেন্সিভ পোশ্চার। তারপর একটা হাত সামনে বাড়িয়ে হাতড়ে হাতড়ে শত্রুকে খুজতে থাকেন, এইটা হল রেকনিসেন্স পর্ব। এরপর শত্রুকে স্পর্শ করা মাত্র আপনি তার কলার চেপে ধরার চেস্টা করেন, এইটা হল ফিক্সিং দ্য এনিমি। এরপর আপনি তাকে সর্বশক্তিতে আঘাত করেন ধরাশায়ী করতে, একে বলে ডিসাইসিভ মেনুভার। সবশেষে আপনি তাকে পেরে ফেলে কষে বেঁধে ফেলেন, একে বলে এক্সপ্লোয়েটেশন।



দুইঃ এক্সপান্ডিং টরেন্ট কনসেপ্ট। পানির স্রোত যখন কোন দেয়ালের গায়ে আছড়ে পরে, তখন দেয়ালের ফাটলের ওপর পানির চাপ ক্রমশ বাড়তে থাকে। একসময় চাপ এতোটা বেড়ে যায় যে ফাটলের দৈর্ঘ্য ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। একসময় সেই ফাটল বেড়ে দেয়াল ভেঙ্গে যায় আর পানির স্রোতও এগিয়ে যায়। যুদ্ধে প্রতিপক্ষের ডিফেন্সের ফাটল গলে এভাবেই আক্রমন করতে হয়।



বি এইচ লিডেলহার্ট ছিলেন ইংরেজ সমরবোদ্ধা, আর ১৯২০ সালে যখন তিনি এই থিওরি দুটোর উপর প্রজেন্টেশন দেন তখন তিনি সবে ক্যাপ্টেন। কিন্তু বৃটিশ আর্মি তার কাছ থেকে শিখতে দ্বিধা করেনি অথবা তাকে স্বীকৃতি দিতেও কার্পন্য করেনি। অথচ ২য় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান আর্মির সফল ব্লিতজক্রিগ আক্রমন পদ্ধতি নাকি প্রথম এক ফরাসী ক্যাপ্টেনের মাথায় আসে। কিন্তু ফ্রেঞ্চ আর্মির সেই বাতিল করে দেয়া পান্ডুলিপি থেকেই নাকি গুদেরেইন ব্লিতজক্রিগ এর বাস্তবায়ন ঘটান। আবার আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে সুয়েজ খাল পেরিয়ে ইসরায়েলী বার্লেভ লাইন অতিক্রম করতে গিয়ে ঈজিপশিয়ান আর্মি বার্লেভ লাইনের বালির প্রাচীরে আটকে গেল। কোন এক্সপ্লোসিভেই বালির এই দেয়ালের তেমন ক্ষতি হয়না। এদিকে পেছনে একেরপর এক ইউনিট সুয়েজ পাড়ি দিয়ে জমে যাচ্ছে। এমন সময় এক ইঞ্জিনিয়ার ক্যাপ্টেন আইডিয়া দিল পানির পাম্প দিয়ে এই বালির দেয়াল ধসানো সম্ভব। ভাগ্যিস ঈজিপশিয়ান হাই কমান্ড আইডিয়াটা নিয়েছিল, আর ঈজিপশিয়ান আর্মিও দ্রুত সিনাই তে ঢুকতে পেরেছিল। সানজু বলেন বিচক্ষন জেনারেল তার অধস্তনদের প্রতিভার মুল্যায়ন করেন বলেই তার পরিকল্পনায় উদ্ভাবনী চমকের শেষ থাকে না।





দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ডি-ডে তে সফল এম্ফিবিয়াস ল্যান্ডিং শেষে জার্মানদের ধাওয়া করতে করতে মিত্রবাহিনীর রসদে টান পড়েছে। মিত্রবাহিনী প্রধান জেনারেল আইজেনহওয়ার চাইছিলেন বৃটিশ, আমেরিকান আর কানাডিয়ান সব বাহিনী মিলে একসাথে (মাল্টিপল থার্স্ট) জার্মানির দিকে এগুতে, কিন্তু বৃটিশ ফিল্ড মার্শাল মন্টগোমারি গোয়ার্তুমি শুরু করলেন তার বাহিনী নিয়ে একাই সিঙ্গেল থার্স্টে দ্রুত বার্লিনের দিকে এগিয়ে যেতে। অগত্যা আইজেনহওয়ারকে মন্টগোমারির প্রস্তাবিত অপারেশন মার্কেট-গার্ডেন কে হ্যাঁ বলতেই হল।



‘মার্কেট’ ছিল প্যারাট্রুপারদের দিয়ে নেদারল্যান্ডের তিনটা ব্রিজ দখলের পরিকল্পনা আর ‘গার্ডেন’ ছিল ব্রিজ দখলের চার দিনের ভেতর বাদবাকি বৃটিশ সেনাবাহিনীর এগিয়ে গিয়ে প্যারাট্রুপারদের সাথে যোগ দেবার পরিকল্পনা। তিন ব্রিজের একটা ছিল আর্নহেমে, যা পিছুহটা জার্মানরা বেশ শক্তভাবেই দখল করে রেখেছে বলে গোয়েন্দা তথ্য ছিল। ইন্টেলিজেন্স অফিসার যখন এই তথ্য বৃটিশ কমান্ডার জেনারেল ব্রাউনিং কে জানাতে গেলেন, তখন তিনি তা উড়িয়ে দিয়ে ইন্টেলিজেন্স অফিসারকে অসুস্থতাজনিত ছুটি যেতে বাধ্য করলেন যেন আর কেউ অপারেশন মার্কেট-গার্ডেন রুখবার কথা ভাবতেও না পারে। ‘মার্কেট’ ছিল ইতিহাসের সবচে বড় এয়ারবোর্ন অপারেশন, কিন্তু আর্নহেমে জার্মানদের প্রতিরোধের মুখে গোটা অপারেশন মার্কেট-গার্ডেন এমনভাবে ভেস্তে যায় যে, ক্রিসমাস আসার আগেই যুদ্ধ শেষ করার স্বপ্নটা মিত্রবাহিনীর জন্য অধরাই রয়ে যায়।



ক্রিসমাসের আগে যুদ্ধ শেষ করার একটা তাগদা তো মন্টগোমারির ছিলই, আরো ছিল মিত্রবাহিনীর কমান্ডারদের মাঝে অন্যতম সেরা কমান্ডার হিসেবে নিজেকে প্রমান করার অদম্য বাসনা। জেনারেল ব্রাউনিং মুল্যবান গোয়েন্দা তথ্য উপেক্ষা করেছিলেন নাইটহুড পাবার মোহে। আর ব্রাউনিং এর এমন উপেক্ষাকে মন্টগোমারি প্রশ্রয় দিয়েছিলেন আইজেনহাওয়ারের প্রতি ঈর্ষা আর নিজের পরিকল্পনামত যুদ্ধ নিশ্চিত করতে। অপারেশন মার্কেট-গার্ডেনকে মন্টগোমারি তার অন্যতম বাজে ভুল বলে পরে স্বীকার করে গেছেন। এই অপারেশনে ১৫,০০০ এরও বেশি মিত্রবাহিনী সৈন্য প্রান হারায়। সানজু বলেছিলেন, ক্রোধান্বিত হয়ে কোন ভাল শাসক তার আর্মিকে যুদ্ধে পাঠায় না, আর স্রেফ অহঙ্কারে বশবর্তি হয়ে কোন জেনারেল যুদ্ধে লড়তে যাননা।



লাভজনক না হলে অযথাই এগিয়ে যাবেন না, বিশেষ কোন প্রাপ্তি না দেখলে অযথাই বল প্রয়োগ করবেন না, বাধ্য না হলে লড়তে যাবেন না। যুদ্ধে আবেগের বশবর্তি হয়ে নেয়া সিদ্ধান্ত চরম বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। তাই সিদ্ধান্ত গ্রহনের আগে নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রন করুন। সৈন্যদের মৃত্যুমুখে পাঠানোই জেনারেলের কাজ, কিন্তু এই মৃত্যু যেন অর্থহীন কারনে না হয় তা নিশ্চিত করাও তারই দায়িত্ব। কারন মৃত ব্যক্তিকে তার প্রান যেমন ফিরিয়ে দেয়া যায় না, তেমনি ধ্বংস হয়ে যাওয়া রাজ্যকে আর কখনই আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায় না। তাই একজন আলোকিত শাসক হয় পরিনামদর্শী, আর বিচক্ষন জেনারেল হয় খুব সাবধানী। আর এভাবেই রাস্ট্রীয় নিরাপত্তা এবং রাস্ট্রের সেনাবাহিনীকে অক্ষুন্ন রাখা যায়।

মন্তব্য ১২ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (১২) মন্তব্য লিখুন

১| ২২ শে আগস্ট, ২০১৪ রাত ১২:১২

কাল্পনিক_ভালোবাসা বলেছেন: চমৎকার হচ্ছে আপনার এই লেখাগুলো। চলুক, সাথেই আছি।

২২ শে আগস্ট, ২০১৪ রাত ১:৫২

ডি এইচ খান বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই সহযাত্রী হলেন বলে।

২| ২২ শে আগস্ট, ২০১৪ রাত ১২:৩৪

মুনতাসির নাসিফ (দ্যা অ্যানোনিমাস) বলেছেন: চলুক, সাথে আছি অবশ্যই এই চমৎকার সিরিজটার ...

মাঝখানটায় কয়েকটা বোধহয় মিস হয়ে গেছে ব্লগে না থাকায় ...

শেষটায় অবশ্যই সব একত্রে পাবো ... আশা রাখি ...

৩| ২২ শে আগস্ট, ২০১৪ রাত ১২:৩৫

মুনতাসির নাসিফ (দ্যা অ্যানোনিমাস) বলেছেন: আগের পর্বগুলোর লিংক যোগ করে দিলে পাঠকের সুবিধা হয় বোধহয়, যারা নতুন পড়ছেন ...

পোস্টে প্লাস ...

২২ শে আগস্ট, ২০১৪ রাত ১:৫৪

ডি এইচ খান বলেছেন: আচ্ছা ভাই, আগের পর্বগুলোর লিংক যোগ করে দেব। আপনাকে ধন্যবাদ।

৪| ২২ শে আগস্ট, ২০১৪ দুপুর ২:৩৪

বিতর্কিত বিতার্কিক বলেছেন: ব্রাজিলের সদ্য বিদায়ী কোচ লুই ফিলিপ স্কলারির প্রিয় বই সানজু'র আর্ট অব ওয়ার। মাঝে মাঝে মিলাতে চেষ্টা করছি এই বইয়ের সাথে ফুটবলের প্রায়োগিক কি মিল আছে। আনাড়ি মাথায় মুক্তিযুদ্ধের সাথেও এই বইয়ের স্ট্রাটেজিক দিক গুলোর একটা কম্পারেটিভ এনালাইসিস আনমনেই চলে আসে।
আরেকটা বিষয়ে কৌতূহল হচ্ছে। সামরিক ক্ষেত্রে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ব্যবহার অনেক বেড়েছে। এর সাথে ক্লাসিক যুদ্ধ কৌশল এর অ্যাডাপ্টেশন কিভাবে করা হয়েছে? যদিও আপনার পোস্টে আধুনিক অনেক যুদ্ধের উদাহরন দিয়ে ভালোই বোধগম্য করেছেন। তবুও, কিউরিয়াস মাইন্ড ওয়ান্ট টু নো।

দুর্দান্ত সিরিজ। তবে পাঠকের রেসপন্স দেখে আমি হতাশ।

২২ শে আগস্ট, ২০১৪ বিকাল ৪:২৫

ডি এইচ খান বলেছেন: মজাটাইতো এখানে ভায়া, টেকনো এডভান্সমেন্ট টুলস আর ইন্সট্রুমেন্টস এ চেঞ্জ এনেছে। যেমন আগে তীর যেত সাকুল্যে ৩০০ মিঃ এখন আর্টিলারী রেঞ্জ বেড়ে হয়েছে প্রায় ১০ থেকে ১০০ কিলো, আগে তলোয়ার নিয়ে একহাতের মধ্যে লড়তে হত, এখন ভাল এসল্ট রাইফেল দিয়ে প্রায় ৩০০ মি দূর থেকেই ম্যান টু ম্যান ফাইট চলে, ঘোড়া আর রথের জায়গায় ট্যাঙ্ক স্পিড আর এন্ডুরেন্স বাড়িয়ে দিয়েছে, স্যাটফোন আগেকার ঘোড়সওয়ার দুত দের চে অনেক ফাস্ট, স্যাট ইমেজ অফসেট করে দিচ্ছে ম্যাপ কে। কিন্তু ডিসিশন এখনো মানুষই নেয়, ওয়েদার এখনো ঈশ্বর সামলান। তাই কমান্ডাররাও তাদের ডিসিশন মেকিং সাইকেলে এডজাস্টমেন্ট আনছেন।

১৮৫৭ র শেফিল্ড ক্লাবতাকে যদি আজকের বার্সেলোনার সাথে মাঠে নামান, স্কিল লেভেলে পার্থক্যটা বেশ টের পাবেন, কিন্তু রিয়েলের সাথে খেলা দেখার সময় কিন্ত হাড্ডাহাড্ডি লড়াই ই দেখবেন। যতদিন প্রশিক্ষন, পরিকল্পনা আর সিদ্ধান্ত নেয়ার কাজটা মানুষ করবে, তদ্দিন ট্যাক-স্ট্রেটেজিক অনেক কিছুই শ্বাশ্বত কিছু নিয়মের মধ্যেই কিঞ্চিত এদিক সেদিক হয়ে পুনরাবৃত্তি হতে থাকবে।

সানজুর লিমিটেশন হল অনেকক্ষেত্রেই তিনি স্পেসিফিক্স এ বলেছেন শুয়াই জান সাপ অথবা অন্যান্য। কিন্তু আপনি যদি এর নেপথ্যে লুকিয়ে থাকা প্রিন্সিপালটা ধরতে পারেন, দ্যাটস দ্য লেসন লার্নট।

পাঠকের রেস্পন্সে হতাশ হবেন না প্লীজ। আমরা কখনই ক্ষত্রিয়ের জাত ছিলাম না। আমাদের সানজু অথবা সানপিনের লেখার মত কোন টেক্সট আমাদের কখনই ছিলোনা। তাই ধার করে পড়া ছাড়া গত্যান্তর কই?

৫| ২২ শে আগস্ট, ২০১৪ রাত ১১:৩২

বিতর্কিত বিতার্কিক বলেছেন: আমরা কখনই ক্ষত্রিয়ের জাত ছিলাম না। আমাদের সানজু অথবা সানপিনের লেখার মত কোন টেক্সট আমাদের কখনই ছিলোনা। তাই ধার করে পড়া ছাড়া গত্যান্তর কই?
আমার মনে হয় কথাটা আংশিক সত্য। কৌটিল্য'র টেক্সট কিন্তু সমসাময়িক অন্যান্যর তুমনায় বেশ ভাল গভীরতা ধারন করে। আরও কিছু হয়তো পেতাম কিন্তু সানজু অথবা সানপিনের লেখার মত কোন টেক্সট যেমন আমাদের ছিলনা তেমনি যা কিছু ছিল তা সংরক্ষণের মত ঐতিহাসিক দূরদৃষ্টিও ছিলনা। সত্যি বলতে এখনও নেই।

২২ শে আগস্ট, ২০১৪ রাত ১১:৪৭

ডি এইচ খান বলেছেন: খুবই ঠিক বলেছেন। চানক্যের টেক্সট এর ব্র্যাকেট অনেক বড়, তারপরও আমাদের একমাত্র সম্পদ। কিন্তু আমাদের দেশে চর্চিত না। আমি নিজেও পুরো পড়িনি। অথচ রামায়ন আর মহাভারত দুটোই কিন্তু আদতে যুদ্ধের ইতিকথা। তারমানে ট্যাক্টিক্স আর স্ট্রেটেজিতে আমরা চীনাদের চেয়েও পুরাতন। স্পাইং এ ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি ইজিপ্সহিয়ানদের সমসাময়িক। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এর কিছুই সংরক্ষিত হয়নি। যেসব জ্ঞান অলরেডি টেস্টেড, সেটা কেঁচেগণ্ডূষ করার মানে হয় না। নিজেদের মত করে আদাপ্ট করে নেয়া যায়। কিন্তু আমরা যে কি চাই, সেটাইত জানিনা ঠিক মত।

৬| ০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সকাল ১০:৩৪

অরণ্যতা বলেছেন: আগের যুগে ভারতবর্ষে বলা হত, যেঁ সাগর পার হয় তার জাত চলে যায় কিন্তু ঠিকই ইংরেজরা সাগর পাড়ী দিয়ে এসে জাত নিয়ে গেল। ভাবতে অবাক লাগে পুরা ভারত বর্ষ একটা কোম্পানির কাছে ১০১ বছর শাসিত হয়েছে।

০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৩:৪৮

ডি এইচ খান বলেছেন: সত্যি অবিশ্বাস্য রে ভাই।

৭| ০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ৮:৫৬

মহামহোপাধ্যায় বলেছেন: খুবই চমৎকার একটা পোস্ট। সাথে মন্তব্য এবং প্রতি উত্তর গুলোও অনবদ্য। ভালোলাগা রইল।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.