নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমার চিন্তা ভাবনার খোলা খাতা আপনাদের সবার ভালো লাগলে ভালো না লাগলে দুঃখিত

মুর্খদের সাথে তর্ক করতে ভাল্লাগেনা,মুর্খ দের এভয়েড করতে ভাল্লাগে

ধ্রুব অন্যকোথাও

আমাকে অমানুষ ডাকুন

ধ্রুব অন্যকোথাও › বিস্তারিত পোস্টঃ

রক্তনদী ১৯৭১ (১)

০৫ ই আগস্ট, ২০২৩ সকাল ৯:১৩

সারাদিন ধরে প্যাচপেচে বৃষ্টি। কাদার ভিতর দাঁড়িয়ে সিগ্রেট জালানোর আপ্রান চেষ্টা চালাচ্ছে তাপস। কোনোভাবেই জ্বলতেছে না। দেশলাই এর কাঠির কোনোভাবেই থাকতেছে না। লাইটার ও নাই পুরো ক্যাম্পের কারোর। আরেকপাশের ক্যাম্পে খুজতে যেতে ইচ্ছে করতেছে না তাপসের কোনোভাবেই। এই বৃষ্টির ভিতর হেটে কোথাও যাওয়ার ইচ্ছেটাও নেই। সিগারেট গুলো নষ্ট করতে চাচ্ছে নাহ। খিদেও লাগছে অনেক কিন্তু খাবার রান্নার জন্য আগুন জ্বালাতে মানা করে গেছে সবুজ ভাই। ময়মনসিং এলাকা টা পুরোটাই পাকিস্তানি আর্মি আর রাজাকার দিয়ে ঠাসা। এইখানে আগুন জালাইলে এই ৪০ জনের একজন ও বাচবে না। অস্ত্র শস্ত্র তেমন নাই হাতে। রাশিয়া থেকে সাপ্লাই আসার কথা ভারত হয়ে কিন্তু কেন জানি দেরি হচ্ছে। মেঘালয় অত বেশি দূরে না তাও কেন দেরি হচ্ছে তাপস বুঝতে পারতেছে না।
খুব বিরক্তিকর সময় যাচ্ছে। স্কাউটিং এর কাজ চলতেছে। ফেরিওয়ালা সেজে রহমান ভাই আর সিদ্দিক প্রতিদিন শহরের দিকে যায়। বিশাল আর্মির ক্যাম্প বসছে। সেই সাথে এপ্রিলের বিমান হামলার ভয় এখনো সবার মনে রয়ে গেছে। আবার, এই কিছুদিন আগে মে মাসের শেষের দিকে মর্টার মেরে ক্যাম্প ধ্বংস করে দিছে পানিহাটার দিকে।সব মিলিয়ে একটা আতংক বিরাজ করতেছে ক্যাম্পজুড়ে। একজন আছে প্রতিরাতে চিতকার করে কেদে কেটে উঠে হাত পা কাপাকাপি শুরু করে নিয়ন্ত্রনহীন ভাবে।
চিতকার করে কাদতে কাদতে বলে “আপুরে,মাফ করে দে আমাকে।পারলাম না তোকে বাচাইতে। ও আপুরে মাফ কর আমাকে”
একটু পর থেমে আবার শুরু করে চিতকার করে কান্না।
“ওরে ছাইড়া দেন।দোহাই লাগে।পায়ে পড়ি। মাফ করেন আমাদের। আমি মুক্তি আমাকে মারেন। ওরে ছাইড়া দেন”
সাধারনতঃ এটা পাচ মিনিটের মতো চলে। কেউ না কেউ দৌড় দিয়ে মুখ চেপে ধরে আর পানি মারে চোখে মুখে। মনে করায় দেয় যে, ক্যাম্পে আছে। এগুলো অতীত ছাড়া কিছু না।
যুদ্ধে এসব হবেই। তাপস বিরক্ত হয় এসবে। দেশ কে স্বাধীন করা লাগবে। সবাই সমান হবে। বাংলায় কথা বলবে সবাই। জোতদার আর মহাজন দের কাছ থেকে জমি নিয়ে নেওয়া হবে। বর্গাচাষী দের জীবন সহজ হবে। বাংলায় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা হবে। রবীন্দ্রনাথ পড়া হবে স্কুল কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই উর্দু চিরতরে নাই হয়ে যাবে। ক্রিকেট টিম হবে আমাদের। লাল সবুজ এর পতাকা কে পৃথিবীর বুকে উড়ানোর জন্য লাল রক্ত তো একটু যাবেই। এই লাল রক্তের লাল না শুধু এটা সমাজতন্ত্রের লাল ও বটে। সাম্য প্রতিষ্ঠা হবে। সবার জন্য একই সুযোগ থাকবে। সবাই কাধে কাধ মিলিয়ে একসাথে দেশ কে গড়বে আর নিজেকে গড়বে।
প্রতিদিন কোথাও না কোথাও ব্রিজ ,কালভার্ট, পাওয়ার স্টেশন ধ্বংস হচ্ছে। এগুলো কে গড়তে হবে। একদম নিজের হাতে। ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের দেশ গুলো যেভাবে ঘুরে দাড়াচ্ছে তাদের চেয়েও বেশি কিছু হবে বাংলাদেশ। তাদের কেও তাক লাগাই দিবে বাংলাদেশ। তাপসের বিদেশে চলে যাওয়া বন্ধুরা ফিরে আসবে দেশে। কারন দেশই তাদের কে এমন সব সুযোগ দিবে বাংলাদেশ কে গড়ার যে তার চেয়ে লোভনীয় কিছু হবে না। পুজিবাদি বাংলাদেশ বিরোধী দেশে কি আর বেশিদিন থাকবে কোনো বাংলাদেশী?আমেরিকা তো প্রথম থেকে বাংলাদেশ বিরোধী। শিকাগো,সিয়াটল আর মিশিগানের সব বাংলাদেশী ইঞ্জিনিয়াররা দেশে চলে আসবে। দেশের প্রতিটা ইটের গাথুনিতে তাপস আর তার বন্ধুদের হাত থাকবে।বোয়িং,ফোর্ড এর মতো কোম্পানি বাংলাদেশে হবে। তখন পশ্চিমিরা আমাদের ট্যাক্স এর টাকা নিতে পারবেনা সব এখানেই থাকবে।
তাপস মাঝে মাঝে জেগে এসব স্বপ্ন দেখে। কিন্তু বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আর অপেক্ষা করে করে সময় গুলো কেটে যাচ্ছে। ভারতে গিয়ে রাইফেল চালানোর টুকটাক ট্রেনিং নিয়ে গোলাবারুদ টানাটানি করে বেশিরভাগ সময়। যুদ্ধের সিনেমা গুলো একটু ভুল ধারনা দিছিলো তাকে।তাপস পাক আর্মি মারছে সেটা শিওর কিন্তু কয়জন কে মারছে সেটা বলতে পারে না ঠিকমতো।
একবার যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে আসলে বোঝা যায় না কিছু আর। তার উপর যদি হয় গেরিলা যুদ্ধ। বুঝা কঠিন হয়ে যায়। কি হচ্ছে।এদিক ওদিক বুলেট উড়াউড়ি করতে থাকে।চারিদিকে পরিচিতরা পটাপট মরতে থাকে।পাখির মতো। মাঝে মাঝে কভার থেকে গুলি করে একজন দুইজন আর্মি কে কতল করা যায় । কিন্তু পাক আর্মির সাথে সম্মুখ যুদ্ধে জড়ানোর মতো অবস্থাও আসলে নাই তাপসের দলের। এটা তাপস কে আরও বিরক্ত করছে। যুদ্ধ নিয়ে ফ্যান্টাসিগুলো বৃষ্টিতে নেতায় গেলেও তাপস বিশ্বাস রাখে যুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশ সারা পৃথিবীর জন্য উদাহরন হবে।
বৃষ্টি টা কমার লক্ষন নেই কোনো রকমের। অনেক ক্ষন চেষ্টা করে তাপস আগুন ধরাতে পারে সিগ্রেটের। সিগ্রেট টা মুখে দিয়ে একটু আরাম হতে থাকে। ঢাকার জীবনের সাথে শেষ কানেকশন এই মুহুর্তে এই সিগ্রেট। সিগ্রেট গুলো একেক টা টাইম ক্যাপসুলের মতো কাজ করে। নিউক্লিয়াসের মিটিং, ঢাবি তে আড্ডাবাজি, শাহানার গায়ের গন্ধ, পুরান ঢাকার বিরানি আর কাবাব সবই সিগ্রেটের প্রতিটা টানের ভিতরে। সিগ্রেট খেতে খেতে ঢাবির হলের প্রতিদিনের রুটিনের কথা ভাবতে থাকে তাপস।
ক্লাস অতো পাত্তা দিতো না।পরাধীন দেশে ক্লাস করবে না ভেবে তাপস বেশীর ভাগ দিন যেতোই না ক্লাসে। স্বাধীন দেশে ডিগ্রি নিবে তাপস। সকালে বেলা করে উঠতো সারারাত আড্ডার পর। বাসি মুখে সিগ্রেট আর চা খেয়ে বাথরুম করতো। বাসিমুখের চা আর সিগ্রেট ছাড়া বাথরুম টা হইতে চাইতো না। এরপর বের হয়ে যেতো। সারাদিন মিটিং মিছিল আড্ডা করে বিকাল সন্ধ্যায় শাহানার সাথে সময় কাটাতো।
শাহানার মুখ,হাসি, চপলতা,চঞ্চল ভাব খুব মিস করে তাপস মাঝে মাঝেই। কিন্তু স্বাধীন দেশে গিয়েই শাহানার হাত টা ধরবে। শাহানা কি ওর হাত টা ধরবে, শাহানা কি ওর জন্য অপেক্ষা করবে, শাহানা সেফ আছে তো? তাপস হিন্দু এটা কি ওর পরিবার মানবে?
“তাপস দাদা, কমান্ডার সবুজ ভাই আপনাদের কে তলব করছে। একটু আসেন আমার সাথে।”

তাপসের চিন্তার স্রোতে বাধা পড়ে। একটু বিরক্ত হয় প্রথমে। কিন্তু মনে মনে আবার এক্সাইটেড হয়ে যায়। নিশ্চয়ই, অপারেশন এর প্লানিং হবে। অথবা পরবর্তী কি করা হবে সেটা নিয়ে আলাপ করবে। তাপস কে ডাকতে আসছে খালেদ। এই ছেলেটাও ঢাবির। কমান্ডার সবুজ ভাইয়ের ডান হাত। ক্যাডেটে ছিলো।অনেক এক্টিভ একটা ছেলে।দোষ একটাই সবকিছু তেই ক্যাডেট কলেজের গল্প।
ভাত খেতে বসলেও চালের কোয়ালিটি নিয়ে বলবে ক্যাডেট কলেজের চাল সেরা। খুবই বিরক্তিকর।
কিন্তু তাপস এসব না ভেবে হাটা দিলো।
নতুন কিছু হয়তো আজকে হতেও পারে।




কমান্ডার সবুজ ভাই প্রতিদিন রাশিয়া থেকে যে এক্সপ্লোসিভ গুলো আসবে সেগুলোর আশায় বসে আছেন। পাওয়ার স্টেশন উড়িয়ে দিয়ে নেক্সট মিশনে মুভ করা দরকার। সময় ঘনিয়ে আসতেছে। আর্মি থেকে পলাতক সবুজ এই কাদামাটির ভিতরে মাঝে মাঝে ক্যান্টনমেন্ট এর জীবন মিস করেন। কিন্তু সময়ের প্রয়োজনের এই যুদ্ধ না করলেও নিজেকে ক্ষমা করতে পারতো না সবুজ। এক্সপেরিয়েন্স থাকার কারনে সেই এই দল টার ক্যাপ্টেন হয়েছে।
সময় গুলো দ্রুত চলে যাচ্ছে। রাশিয়ার এক্সপ্লোসিভ গুলোর খবর পাওয়া দরকার আসলে খুবই। বেশিদিন এইভাবে এই জায়গায় থাকলে সবাই মিলে একসাথে মারা যাবার ভয় আছে। পাখির মতো গুলি করে মুক্তিযোদ্ধা দের মারার ট্র্যাক রেকর্ড আছে এই পাকিস্তানি দের।
সবুজ চিন্তা ভাবনা করে কিছু প্ল্যান দাড়া করিয়েছে তা এখন সিনিয়র মেম্বার দের সাথে এবং দলের আরও কিছু লোকজন যারা ইম্পর্টেন্ট তাদের সাথে এখন আলাপ করবে। সাওতাল গেরিলা দের বর্ডার এলাকা থেকে এই এক্সপ্লোসিভ গুলো নিয়ে আসার কথা ছিলো । কিন্তু গেরিলা দের গতকাল থেকে কোনো খবর নাই। দিনে একবার ওরা রেডিও করতো। কিন্তু এখন তাও করছে না। দুঃশ্চিন্তায় পড়ে যাওয়ার সিচ্যুয়েশন তৈরি হয়েছে। সাওতাল দের বিশ্বাস করবে কিনা সেটা নিয়ে চিন্তা কাজ করে। সেদিন শোনা গেলো চিটাগং হিল ট্রাক্ট এর ওইদিকে চাকমা রা নাকি পাকিস্তানি দের সাথে একজোট হয়ে যুদ্ধ করতেছে। চিন্তার আসলে শেষ নেই। বেশিরভাগ মানুষই কম্ব্যাট এ একেবারে পারদর্শী না। বন্দুক আর গুলির অভাবের কথা চিন্তা করে দিন শেষ। অক্টোবার নভেম্বর এর দিকে ভারতীয় সৈনিক রা যুদ্ধে যোগ দেওয়ার সমূহ সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে । তখন সবুজের দলের একটা বড় অংশেরই কাজ হবে মালপ্ত্র টানা হেচড়া করা।
সবুজ এসব চিন্তা করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। যদিও ময়মনসিংহ সদরের কিছু ট্রেনড ছেলেবুড়ো আছে। ত্রিশাল এর ম্যাসাকারে বেচে যাওয়া কিছু স্কিল ফুল ছেলেপেলে আছে।
“সবুজ ভাই, সবাই চলে আসছে”
সবুজ এর দুশ্চিন্তার ট্রেনে ছেদ পড়ে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মনে একটু ভয় কাজ করে সবুজের। ওর এই প্ল্যান টা কিভাবে নিবে তাপস। তার সাথে যে কাকে পাঠাবে চিন্তা করতে থাকে। তাপস একদম কচি একটা ছেলে। ননীর পুতুল টাইপ আদর্শবান ছেলে। কিছুটা অনভিজ্ঞ ও বটে। ছাত্র ইউনিয়নে কিছুদিন ছিলো ঢাবি তে এরপর যুদ্ধে চলে আসলো। ছাত্র ইউনিয়নের কিছু সাওতাল দের সাথে মিলামিশা আছে তার আগে থেকেই।এটা একটা সুবিধা।
সেই সাথে ওকে এইখানে রেখেও লাভ নাই। ইউজলেস কাউকে পাঠানো সহজ হবে। যে কিনা কথা বলতে পারে।
ছোট্টো তাবুর ভিতর ১০ জনের মতো আসলো। সবুজ ঠোট থেকে সিগ্রেট নামালো। চা এর কাপে এক চুমুক দিলো। বিস্বাদ চা মুখে দিয়ে মাত্র বমি চলে আসলো। সিগ্রেট এ টান দিয়ে স্বাভাবিক হলো সবুজ।
সবাই তাকিয়ে আছে উতসুক ভংগীতে সবুজ কি বলবে সেটা শোনার অপেক্ষায়। সবুজ এর মুখ এর তালু শুকিয়ে আসে। মানুষজন সবাই অধৈর্য্য হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কঠিন খবর কিভাবে দিবে মানুষদের কে সেটা ভেবে পাচ্ছে না সবুজ।
“সবুজ ভাই, কিছু বলেন। কথা শেষ করেন তারপর খাইতে যামু। মেলা পথ হাটাহাটি করে আসছি।”
রহমান ভাইয়ের এই বাহানা শুনে সবুজ এর ঘোর ভাংগে।
গলা খাকারি দিয়ে সবুজ বলা শুরু করে, “দেখেন আমরা সবাই এইখানে বসে আছি রাশিয়া থেকে এক্সপ্লোসিভ আসার অপেক্ষায়। একটা ব্রিজ আর বিদ্যুৎ কেন্দ্র উড়িয়ে দেওয়ার কথা আমাদের এই নতুন এক্সপ্লোসিভ দিয়ে। আমাদের সাওতাল কানেকশন এর বর্ডারের অইপাশ এর ঢালু ক্যাম্প থেকে ভারতীয় দের কাছ থেকে এনে আমাদের কাছে আসার কথা।কিন্তু কোনো খবর নাই তাদের । প্রায় ৪৮ ঘন্টা আগে তাদের সাথে কানেক্ট হওয়ার কথা ছিলো আমাদের। এখনো পর্যন্ত কোনো আওয়াজ। হাই কমান্ড আর ঢালু ক্যাম্পের লোকজন অপেক্ষা করতেছে সাওতাল গেরিলাদের অপেক্ষায়। ওদের কে এক্সপ্লোসিভ গুলো বুঝিয়ে দেওয়ার কথা কিন্তু এখনো কোনোরকমের খবর নাই। যোগাযোগ ও করে নাই সাওতাল রা। না আমাদের সাথে না ঢালু ক্যাম্পের সাথে।কমপ্লিট রেডিও সাইলেন্স।”
আশপাশের সবাই একটু নড়েচড়ে বসলো।
সবাই চিৎকার চেচামেচি শুরু করে দিলো।ঘরের একেক দিক থেকে একেক জন চিৎকার চেচামেচি শুরু করে দিলো। সবুজ এর দিকে তাক করেই সব চিৎকার চেচামেচি।
“তাইলে, কি আমরা এখানে শুধু শুধু বসে আছি দিনের পর দিন”
“ভাত নাই কাপড় নাই এর মাঝে বৃষ্টির ভিতর বইসা বইসা দিন কাটাচ্ছি”
“হাইটা হাইটা জান হাতে নিয়া আর্মি ক্যাম্পের সামনে বইসা বাদাম বেচছি এই বাল ছেড়ার জন্য?” একজন এই কথা বলে উঠে চলেই গেলো।
যাওয়ার সময় বলতে থাকলো “এর চেয়ে রাজাকার বাহিনি তে যাইতাম একটা বেতন পাইতাম,নিয়মিত খানা পাইতাম,ভালোই থাকতাম,এই বালের ঝড় বৃষ্টি আর কেদোর ভিতর দিন কাটতো না”
সবুজ এইবার মেজাজ খারাপ করে ফেললো। চিৎকার করে বলে উঠে, “থামেন সবাই।কথা শুনেন।এই সমস্যা কাটানোর প্ল্যান এর জন্যেই আপনাদের সবাই কে ডেকে আনছি”।
সবাই নিজেদের ভিতরকার চিতকার চেচামেচি বন্ধ করে সবুজের দিকে তাকায়।
“এখন আমার প্ল্যান টা শুনেন একবার আপনারা।”
আরেকজন চিতকার করে উঠে “কিয়ের প্ল্যান। সাওতাল রা দেখেন বোমা টা নিজেরা নিয়ে পশ্চিমি দের সাথে গিয়ে হাত মিলাইছে।”
পাশের জন ও গলা মিলায়, “দেখেন গিয়ে ২য় সাওতাল বিদ্রোহ শুরু করছে”
আরেকজন চিৎকার করে, “ হা, চলেন আমরা এডভান্স করে এই সাওতাল দের শেষ কইরা দেই। কত গুলো গেরিলা আছে ওদের? ১০০-২০০? আমাদের বাকি গ্রুপ গুলোকে বলি। সবাই মিলে ঘিরে ধরলে ঘন্টাখানিক এর মধ্যে শেষ করে দেওয়া যাবে এদের। দেশে অবাংগালি রাইখা লাভ নাই, মিত্র হইলেও।”
সবুজ খেয়াল করে তাপস পুরোটা সময়ে কিছুই না বলে চুপচাপ অবজার্ভ করছে সিগেরেট খেতে খেতে।
সবুজ এই বিতর্কে তাপস কে কাছে পাবে ভেবেছিলো। কিন্তু তাপসের নীরবতা দেখে সবুজ হতাশ হয়ে যায়। সে আবার কথা বলা শুরু করে, “আমরা একটু শান্ত হই। ধীরে সুস্থে চিন্তা করি। এইভাবে চিতকার করে কি লাভ? এর আগেও সাওতাল গেরিলা রা আমাদের কে সাপোর্ট দিছে।এছাড়াও ওদের উপরেও আক্রমন হইছে। আমার মনে হয় উনাদের উপর ভরসা আমাদের রাখা উচিত। তাপস সাহেব, আপনি কি বলেন?”
তাপসের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে তাকে ইনভলভ করার চেষ্টা চালায় সবুজ। তাপস শুনে চুপচাপ থাকে কিছু মুহুর্তে তারপর সে কথা শুরু করে।
“এই যুদ্ধ অসম যুদ্ধ।পাক আর্মি আমাদের টাকায় তাদের সব রকমের আধুনিক সক্ষমতা তৈরি করেছে। মানুষ মারার মেশিন বানাইছে ঘুরে ঘুরে। আমাদের প্রায় সবার ঘরে ঘরে শহীদ আছে। কারোর মা,কারোর বোন,কারোর ভাই,কারোর বাবা কাউকে না কাউকে মারা হইছেই। আমরা গেরিলা যুদ্ধ করছি। আমাদের আসলে এত বাছাবাছি করার অবস্থা নেই একেবারেই। সাওতাল রাও এই দেশের মানুষ। ওরাও আমাদের হয়ে যুদ্ধ করতেছে। ওদের ও মানুষ মারা গেছে। অবাংগালী হইলেও ওরা মানুষ।এই দেশের মানুষ। আমাদের উচিত এদের উপর বিশ্বাস রাখা। আমি যাবো ওদের গ্রামে। দেখবো কি হইছে। আমি ঢালু যাবো এক্সপ্লোসিভ গুলো নিয়ে আসার চেষ্টা করবো। আমার সাথে কে যাবে?”
তাপস এক নিঃশ্বাসে সবার চোখে চোখ রেখে কথা গুলো শেষ করে। তাকিয়ে আছে কেউ কিছু বলে কিনা। সবাই চুপ। কেউ কিছু বলে না। তাপস এর কপালে এক ফোটা ফোটা করে ঘাম জমতে থাকে। ঢোক গিলে। হার্টবিট বেড়ে গেছে অনেক।
তাপসের কথা শুনে কেউ কিছু আর বলে নাই। কিছুক্ষন পরে কয়েকজন নিঃশব্দে উঠে চলে গেলো।
কেউ কেউ আবার কথা ছুড়ে দিয়ে গেলো।
“ধুর মিয়া,এসবের কোনো মানে আছে?”
“এভাবে পাক আর্মি রে হারানো যাবে?”
“ইন্ডিয়ান আর্মি ছাড়া গতি নাই”
সবুজ একজন কে থামানোর চেষ্টা করে, “ভাই তুই আমার কথা শোন।এই রেকি টা করে আয়”
“এইসব চো*চু* করার জন্য কি ট্রেনিং নিছি নাকি?”
ভীড় নাই হয়ে যাওয়ার পর খালি একজনের হাত উঠা দেখা গেলো।
“আমি যামু। মোমেনশাহী এলাকা আমার পুরা চেনা। আমি সাওতাল গো ওইখানেও মেলাবার গেছি। আমি যামু,কোনো সমস্যা নাই।হাতের রেখার মতোন চিনি আমি সব ওইদিকে। বর্ডার পার কইরা গেছি। আবার আমি নৌকাও চালাইতে পারি। ওইখানে যাইতে নদীপথে সহজ হইবো।”
সবুজ স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো। রহমত এর কথা ও মনে মনে ভাবছিলো। কারন এই এলাকা সবচেয়ে ভালো চিনে এই লোক টাই। কিন্তু লোক টা কন্ট্রোভার্সিয়াল।
রহমত ইপিআর এর একদম নিম্ন পদের বর্ডার গার্ড ছিলো। ২৭ মার্চ নকশী ক্যাম্পের ম্যাসাকারে ছিলো। ২৬ মার্চের ঢাকার ম্যাসাকারের প্রতিশোধ তোলার ইপিআর এর নকশী এলাকার ক্যাম্পের ২২ জনের মতো পাঞ্জাবী বর্ডার গার্ড দের বিনা বিচারে নিরস্ত্র অবস্থায় জংগলে নিয়ে ব্রাশ ফায়ার করা হইছিলো। ওই ঘটনার সাথে রহমত ও জড়িত ছিলো।
রহমত এর ভিতরে একটা নৃশংসতা আছে। এখন সবুজ একটু চিন্তায় পড়ে গেলো। সাওতাল রা মিত্র হওয়া স্বত্তেও কিছুটা ভিন্ন। এদের সাথে রহমতের গেঞ্জাম লাগলে কি হবে ভাবতেছে সবুজ। সাওতাল রা লোকাল। সেই সাথে বর্ডারের ওপাশে যাওয়া আসার জন্য খুবই ভাইটাল। সাপ্লাই লাইনের জন্য অত্যন্ত জরুরী একটা অংশ এই সাওতাল রা। এদের সাথে এলায়েন্স ঠিক রাখা অনেক জরুরী। তাদের খুব একটা প্রটেকশন দিতে না পারায় একটা নাজুক অবস্থা। এখন রহমত গিয়ে উলটা পালটা ক্ষেপে গিয়ে সবাইকে আক্রমন করে বসলে এই কানেকশন টা মুহুর্তেই শেষ হয়ে যাবে। খুবই রিস্কি একটা বেপার। তাপস কে ভালোভাবে বুঝিয়ে বলতে হবে।যাতে রহমত কে দেখে শুনে রাখে। ঠান্ডা মাথায় যাতে কাজ টা করে ফিরে আসতে পারে। রহমত কে বুঝিয়ে বলতে হবে যাতে কোনোরকম এর ইন্সিডেন্স না ঘটে।
সর্বশেষ অপারেশন এর সময়, এক আহত পাকিস্তানি সৈন্যকে ইট দিয়ে মেরে মাথা থেতলে দিয়ে একটা কিরিচ নিয়ে হাত পা মাথা সব গুলো আলাদা আলাদা করে কেটে সদরের বাজারের গাছে গাছে রশি দিয়ে বেধে ঝুলিয়ে দিয়েছিলো বারবার মানা করার পরেও।
রহমত খেক খেক করে হাসছিলো আর বিভিন্ন অংগভংগী করে দেখাচ্ছিলো পাকিস্তানি আর্মির শরীর কিভাবে তরপাচ্ছিলো মাথা ফাটানোর সময়।
রহমত এর এই স্টান্টবাজির পর তার সাথে কথোপকথন টা এখনো সবুজ এর কানে বাজে।
“রহমত, এটা কি কাজ করলা?”
“কি কাজ,সবুজ বাই?”
“রহমত, এই যে তুমি আহত আর নিরস্ত্র সৈনিক রে মারলে আর তারপর গিয়ে বাজারে এভাবে ঝুলায় দিলে,এইটা ঠিক হইলো?”
“আমরা না মারলে তা আমগোরে এইভাবে মারতো”
“তারপরেও আমাদের তো একটা ইজ্জত আছে, হিসাব আছে।এগুলো আমাদের করা মানায় না”
“মানাইছে না আফনেরে কেডা কইছে”
“যুদ্ধের তো একটা নিয়ম আছে তাই না?”
“হুনেন, বর্ডারের পাঞ্জাবী দের আমি মারছিলাম এইডা তো আফনে জানোইন”
“হুম”
“পাঞ্জাবীরা ওই এলাকারে বেশ্যাপল্লী বানায় ফেলছিলো। বাচ্চা খালাস করাইছে যে কত মাইয়া। সবডি মাইয়া পেট বাধাইছিলো পাঞ্জাবীদের চোদা খাইয়া।”
রহমত এইটা বলে একটা বিড়ি ধরায়।কিযে বিশ্রি গন্ধ এসব লোকাল আর হাতে বানানো বিড়ি থেকে তা বলার মতো না। সবুজের নাক মুখ বন্ধ হয়ে আসে গন্ধে।
সবুজ নাক মুখ চেপে বলে “তো,কি বলতে চাচ্ছো?এজন্য ওদের মারা ঠিকাছে?”
রহমত বিড়ি নামায় মুখ থেকে। হো হো করে হাসে। মানুষ কে হাসতে দেখলে দেখলে ভালো লাগে। কিন্তু সবুজের আত্মা ঠান্ডা হয়ে যায়।
“নাহ,এজন্য কেন মারবো।এই সুযোগে তো কতরকমে মেয়ে দের লাগাইতে পারছি। পাঞ্জাবী রা লাগানো শেষ হইলে আমাদের দিতো। এইভাবে করে ছোট বড়, ছড়ানো দুধ,ডবকা দুধওয়ালী আর কতরকমের মাইয়া দের যে লাগাইলাম। তার হিসাব নাই। ওই মাইয়া দের জামাইরা চাষবাস করে তেমন টাকা পাইতো না তাই তাদের বউরাও আইতো টাকার জন্য ইপিআর ক্যাম্পের আশেপাশে। এভাবে আমগোর দিনকাল ভালোই যাচ্ছিলো।”
সবুজ এইরকম বিবরন শুনে থতমত খেয়ে যায়। বুঝে না কি বলবে। ঢোক গিলে তারপর জিজ্ঞেস করে “তো তাইলে কেন মারলা পাঞ্জাবী গুলারে”
রহমত বলে “কাহিনি তো বাকি আছে এখনো।একটা ছোটো মেয়ে ছিলো। ক্যাম্পের পাশের বাজারে বসতো।এতিম মাইয়া,দাদার লগে আইতো বাজারে। এটা সেটা ফলমূল,সবজি বিক্রি করতো। ৭-৮ বছর বয়স। বুনি উঠে নাই তখনো। বুনি বুঝেন তো সবুজ ভাই।
“হু”
“আমরা বেশি দাম দিয়া ওর কাছ থেকে তরি তরকারি লইতাম।ওর দিকে ওইভাবে তাকাইতাম না।একদিন নতুন একদল পাঞ্জাবী আইলো। তাদের মাঝে দুইজনের ওই মাইয়ারে পছন্দ হইলো।এরপর কি হইলো জানেন?”
সবুজ এর মাথা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। ও জানে এই গল্পের শেষ কোথায় এবং কিভাবে।
“পাঞ্জাবীরা মাইয়ার বাড়িতে যায়। দুইজন যায় মাত্র। তাদের রে মাইয়ার দাদা দা দিয়ে কোপ মারে। এরপর পাঞ্জাবীরা ক্যাম্পে গিয়ে পরে দল নিয়ে ওইখানে যায়। সারারাত্র যা করার করে। পরে ওই বাড়ি আর জমি পুড়াইয়া দেয়। এরপর মাইয়াটার কাপড় ছাড়া লাশ বাজারের বট গাছের সাথে বাইন্ধা ঝুলাইয়া রাখে সবার দেখার জন্য। কাগজ লাগাইয়া দেয় একটা। সেইখানে লেখা “কচি মাগী” পাঞ্জাবী ভাষায়।”
সবুজ এর গা গুলিয়ে আসে।
“তুমি পাঞ্জাবী ভাষা পড়তে পারো?”
“নাহ ওরা হাসাহাসি করতেছিলো দুপুরে খাইবার সময়। তখন হুনছি। কিছু কিছু শব্দ বুঝতে পারি।এরপর থেকেই আমি সুযোগের অপেক্ষায় আছিলাম।অবশেষে আসলো সুযোগ ২৭ মার্চ। আমি আর ছাড় দেই নাই অহনো দেই নাই।আফনের নীতির গো# মারি আমি”
রহমতের কথা শেষ হয়।
সবুজ চুপ করে থাকে।
“খানকি মাগীর এই দুনিয়ায় যে বাইচা যাইবো সেই ঠিক বাকি সবাই বেঠিক বুঝছেন সবুজ বাই”?
এই বলে সবুজের মুখে বিড়ির ধোয়া ছেড়ে রহমত চলে যায় হেটে।



মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ০৬ ই আগস্ট, ২০২৩ রাত ১০:১৭

রাজীব নুর বলেছেন: বেশ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.