নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

জীবে প্রেম করে যেজন, সেজন সেবিছে ঈশ্বর

দীপান্বিতা

দীপান্বিতা › বিস্তারিত পোস্টঃ

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১৪৩

২৩ শে এপ্রিল, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:১৭

[পূর্বকথা - যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের অনুমতি নিয়ে রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করেন ....... মুনিরা হোম যজ্ঞের আয়োজন শুরু করেন.......দ্রুপদ ও অন্যান্য গণ্যমান্য রাজারা আসতে লাগলেন...... ভীমের সাজাপ্রাপ্ত কিছু রাজাকে কৃষ্ণ প্রাণদান করেন.... অবশেষে কৃষ্ণ ও বিভীষণ সভায় এলেন...... কৃষ্ণ সকলকে বিশ্বরূপ দেখালেন....... সভার সকলে মূর্ছা গেল.......যুধিষ্ঠির যজ্ঞ সমাপন করলেন.....সকলকে যার যা যজ্ঞভাগ তা দান করে তুষ্ট করলেন.... ভীষ্মের পরামর্শে যুধিষ্ঠির সকলের শ্রেষ্ঠ কৃষ্ণের পূজা করতে গেলে চেদিরাজ শিশুপাল তীব্র প্রতিবাদ করে কৃষ্ণ নিন্দা করতে লাগল .....কিছু রাজারা শিশুপালের সঙ্গ দিল...... ]


যুধিষ্ঠির ও ভীষ্ম

শিশুপালের প্রতি যুধিষ্ঠিরের ও ভীষ্মের বাক্যঃ

শিশুপাল চলে যাচ্ছে দেখে যুধিষ্ঠির দ্রুত সিংহাসন ত্যাগ করে তার কাছে গিয়ে মধুর বচনে বলেন –একাজ তোমার যোগ্য নয়, হে চেদীরাজ। যজ্ঞ ত্যাগ করে কেন তোমরা যাচ্ছ! কেনই বা মিছে গঙ্গাপুত্র পিতামহ ভীষ্মের নিন্দা করছ। নিজেই দেখ কৃষ্ণের পুজোয় অন্য বড় রাজাদের কোন আপত্তি নেই। তারা একে অপমানও মনে করছেন না। পিতামহ ভীষ্ম গোবিন্দের প্রকৃত তত্ত্ব জানেন। তাই তিনি কৃষ্ণের পূজা প্রথমে করালেন।

ভীষ্ম বলেন –হে ধর্মপুত্র, দমঘোষের পুত্র শান্তি যোগ্য নয়। কৃষ্ণ পূজার যে নিন্দা করে তাকে মান্য করার কোন দরকার নেই। দুষ্টবুদ্ধি শিশুপালের সামান্য জ্ঞানও নেই। রাজাদের মধ্যে গণ্য করার মত এ নয়। কৃষ্ণপদ পূজা করেন ত্রৈলোক্যের সকলে। আমি তো সেখানে এক সামান্য ক্ষুদ্র মানুষ মাত্র। বহু জ্ঞানী বৃদ্ধজনের মুখে শুনেছি কৃষ্ণের মহিমা। তিনি স্বয়ং পদ্মযোনি ব্রহ্মারও অগোচর। আমি আর তার কথা কি বলি!
পূর্বেরও সাধুজনেরা এই পৃথিবীশ্রেষ্ঠ রাজার রাজাকে পুজো করে গেছেন। বিপ্র মধ্যে পুজো পায় জ্ঞানী বৃদ্ধজন, ক্ষত্রিয়ের মধ্যে বলবান, বৈশ্য মধ্যে যার ধন ধান্য বেশি সে আগে পূজ্য আর শূদ্র মধ্যে আগে পুজো পায় বয়োধিক জন।
এই সভায় যত ক্ষত্রিয়রা আছেন সকলে দামোদরের সম্পর্কে জানেন। কোন রূপে তিনি এ সভায় ছোট শুনি! কূলে-বলে কে আর আছে কৃষ্ণ তুল্য! দান-যজ্ঞ-ধর্মকর্ম-সম্পদ-কীর্তিতে এ সংসারে কৃষ্ণই সকল গুণের আধার। সংসারে যত কর্ম মানুষ করে সব যদি গোবিন্দকে সমর্পণ করে তবেই তা সিদ্ধিলাভ করে। প্রকৃতি আকৃতি কৃষ্ণ আদি সনাতন। সর্বভূতে আত্মরূপে তিনি সবার মাঝে আছেন। আকাশ, পৃথিবী, তেজ, সলিল(জল), মরুত(বায়ু) সংসারে যা কিছু সব কৃষ্ণ হতে প্রস্তুত।
অল্পবুদ্ধির শিশুপাল কিছু জানে না তাই কৃষ্ণ পূজার নিন্দা করছে।

গঙ্গাপুত্র ভীষ্মের কথা শুনে সহদেব বলেন –দেব নারায়ণ অজ্ঞেয়, অসীম। তার পূজায় যে নিন্দা করে তার মস্তকে আমি বাম পদ রাখি। রাজকার্য পরিচর্চায় কৃষ্ণের চেয়ে বুদ্ধিমান কে আছে শুনি!

মাদ্রীপুত্র সহদেবের এ কথায় আগুনে যেন ঘি পরল। শিশুপাল ও তার সাথী রাজারা ক্রোধে গর্জে উঠল –এ যজ্ঞ আমরা বন্ধ করব আর পাণ্ডবদের মারব। সেই সাথে বৃষ্ণিবংশ ধ্বংস করে মাধবকেও হত্যা করব। এই বলে তারা কোলাহল শুরু করল।

প্রলয়ের সময় যেমন সমুদ্র উতলায় তেমনি রাজাদের মধ্যেও ক্রোধের রেশ দেখে ধর্মরায় যুধিষ্ঠির ভীষ্মকে ডেকে বলেন –পিতামহ, এর উপায় বলুন। রাজাদের ক্রোধ দেখে অনর্থ হওয়ার আশঙ্কা করছি। এদের কিভাবে শান্ত করব, কি ভাবেই বা যজ্ঞ পূর্ণ হবে!

ভীষ্ম বলেন –হে রাজন, ভয় পেয় না। প্রথমেই এর উপায় আমি বলে দিয়েছি। যে জন গোবিন্দের আরাধনা করে তার এ তিন ভুবনে কোন ভয় নেই। তুমি এই রাজাদের ক্রোধ দেখেই ভয় পাচ্ছ! দেবকীনন্দন কৃষ্ণ তো সিংহের সমান। সিংহ যতক্ষণ নিদ্রা থেকে না ওঠে শৃগালরা ততক্ষণ গর্জায়। গোবিন্দ যতক্ষণ এদের অবজ্ঞা করছেন ততক্ষণ এরা গর্জেই যাবে। শিশুপালের বুদ্ধিতে যারা চলছে তাদের বিনাশ শীঘ্রই ঘটবে। আগুন দেখে পতঙ্গরা যেমন বিক্রম দেখায়, কিন্তু স্পর্শ মাত্র ভস্ম হয়। তেমনি উৎপত্তি, প্রলয়, স্থিতি যার হাতে সেই কৃষ্ণের শক্তি মূঢ শিশুপাল কিছুমাত্র বুঝবে না।

ভীষ্মের এতকথা শুনে দমঘোষের পুত্র শিশুপাল আরো রেগে বহু কটুবাক্য ও নিন্দা করতে লাগল –ওরে বৃদ্ধ কুলাঙ্গার ভীষ্ম! সবাইকে তুমি বিভীষিকা, প্রাণভয় দেখাচ্ছ! বুড়ো হলে সবার মতিচ্ছন্ন ভীমরতি হয়। তোমারও তাই হয়েছে। তাই ধর্মচ্যুত কথা বলে যাচ্ছ। কুরুদের মধ্যে তুমি হচ্ছ সেই অন্ধ যার কাছে বংশের অন্য অন্ধরা পথের নির্দেশ চাইছে। কৃষ্ণের বড়াই তোমাকে আর করতে হবে না। তার গুণের কথা সবার জানা আছে। স্ত্রীজাতির পুতনাকে এই দুষ্ট হত্যা করেছিল। কাঠের শকট(শকটাসুর) ভেঙ্গে বীরত্ব দেখাল। পুরাতন দুই বৃক্ষ(প্রলম্বাসুর) ভাঙ্গল, আবার যুদ্ধে অক্ষম বৃষ(বৃষভাসুর) ও অশ্ব(অশ্বাসুর) বধ করে অহঙ্কার হল। ইন্দ্রজাল করে এ কংসকে হত্যা করেছে। এক সপ্তাহ গোবর্ধন পর্বত ধারণ করে, যা আমার কাছে উইঢিবি মাত্র। এসব ঘটনা আমার চিত্ত দুর্বল করতে পারবে না। মূঢ গোপরাই একে বড় করে তুলেছে। এই কৃষ্ণ মোটেও সাধু ব্যক্তি নয়। ধার্মিকরা বলেন স্ত্রীজাতী, গরু, ব্রাহ্মণ আর অন্নদাতার হত্যা উচিত নয়। কিন্তু কৃষ্ণ এসবই করেছে। এ পুতনাকে মেরেছে। মাঠে বৃষ হত্যা করেছে। আবার যে কংসের অন্ন গ্রহণ করত তাকেও হত্যা করেছে। তোমাদের গোবিন্দ নারীঘাতী পাপী দুরাচার। তার স্তুতু যারা করে তারাও সব কুলাঙ্গার। তোমার কুকর্মে পাণ্ডবরা ডুববে। তুমি দুষ্টমতি ধর্মচ্যুত পাপী, সকলের মাঝে নিজেকে ধর্মজ্ঞ বলে প্রচার করছ কোন মুখে!
সব রাজারা এর গুণের কীর্তি শুনুন। কাশীরাজের কন্যা অম্বা শাল্বকে বরণ করে তবু এই দুষ্ট গিয়ে তাকে হরণ করে। পরে সব জেনে আবার তাকে বর্জন করে। কিন্তু শাল্ব অম্বাকে আর গ্রহণ করেনি, তখন অম্বাকে আগুনে ঝাঁপ দিতে হয়। এই ভীষ্মও স্ত্রী বধকারী মহাপাপী। ওরে ভীষ্ম, তোমার ভাই বিচিত্রবীর্য তো তোমার স্বধর্মে ছিলেন। তবু তিনি মরতে তার স্ত্রীদের গর্ভে অন্যের সন্তান উৎপাদন করেছিলে। নিজেকে ব্রহ্মচারী বলে বড়াই করে হচ্ছে! এমন ব্রহ্মচর্য অনেক নপুংসকই করে থাকে। নিঃসন্তানের যজ্ঞ, দান, উপবাস সবই ব্যর্থ। এক প্রাচীন উপাখ্যান শোন। হাঁসেদের মধ্যে এক বৃদ্ধ হংস ছিল। সে সবাইকে ধর্মের কথা শোনাত। ধার্মিক ভেবে সকলে তার কথা মানত। হাঁসেরা যা খায় তার কিছু করে এনে তাকে দিত এবং নিজেদের ডিম বিশ্বাস করে তার কাছে রেখে যেত। কিন্তু সেই ভণ্ড বৃদ্ধ হাঁসটা সুযোগ বুঝে ডিম ভেঙ্গে খেতে থাকে। হাঁসেরা শোকাতুর হয়। তাদের মধ্যে এক বুদ্ধিমান হাঁস ধিরে ধিরে সব বুঝতে পারে যে বুড়ো হাসঁই ডিম খাচ্ছে। শেষে সব হাঁসেরা প্রচন্ড রেগে সেই বুড়োকে বধ করে। সেই বুড়ো হাঁসের মত তোমারও একই অবস্থা হবে ভীষ্ম। এই সব রাজারা তোমার সে ভাবেই হত্যা করবে।
ওরে জ্ঞানহারা বৃদ্ধ ভীষ্ম, যে গোপজাতির নিন্দা সকলে করছে, বৃদ্ধ হয়ে তাকেই তুমি স্তব করছ! তোমায় ধিক্‌! তুমি ক্ষত্র নাম ধারণ করছ অকারণে।
জরাসন্ধ রাজা ছিলেন রাজ চক্রবর্তী, তিনি এই কৃষ্ণকে গোপ জেনে ঘৃণা করে কোনদিন এর সাথে যুদ্ধ করেন নি। সেই রাজার ভয়ে এই গোপ সমুদ্রে গিয়ে আশ্রয় নেয়। দেশছাড়া শৃগাল প্রকৃতির কৃষ্ণ কপটতা করে জরাসন্ধকে মারল। কৃষ্ণ দ্বিজের ছন্মবেশে রাজপুরীতে প্রবেশ করে। এর দেখছি জাতের ঠিক নেই! কখনও নিজেকে ক্ষত্র বলে, কখনও গোপ, কখনোবা দ্বিজ।
হে ভীষ্ম এই যদি পৃথ্বীপতি তবে কেন ক্ষণে ক্ষণে নানা জাতির হয়! তোমার বুদ্ধি দেখেও অবাক হতে হয়। দুর্দৈব হবে তার, যার তুমি বুদ্ধিদাতা হবে। তোমার বুদ্ধি দোষেই রাজসূয় যজ্ঞ পণ্ড হল।

এভাবে শিশুপাল বিভিন্ন ভাবে ভীষ্মকে কটু কথা বলে অপমান করতে লাগল। শুনতে শুনতে পবনপুত্র ভীম ক্রোধে জ্বলে উঠলেন। তার দুই চক্ষু রক্তবর্ণ হল। সর্বাঙ্গ ক্রোধে ঘেমে উঠল। ভুরু কুঁচকে, দাঁত কটমট করে রক্তমুখ বিকৃত হয়ে উঠল। অধর দন্তে চেপে সিংহাসন থেকে বীর ভীম লাফিয়ে পড়লেন। দেখে মনে হল যুগান্তের যম সৃষ্টি সংহার করতে চলেছেন। ক্রোধ দৃষ্টিতে ভীম শিশুপালের দিকে ধেয়ে চললেন। গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম ভীমের দুই হাত ধরে ফেললেন। যেন দেব ত্রিলোচন শিব কুমার কার্তিককে ধরলেন। অনেক মিষ্ট কথায় ভীষ্ম ভীমকে শান্ত করতে লাগলেন। যেন সমুদ্র তরঙ্গ কূলে লুকাল। ভীম ভীষ্মের হাত ছাড়িয়ে বেরিয়ে আস্তে পারলেন না। জল যেন দীপ্ত হুতাশন অগ্নিকে নিভাতে লাগল।

দুষ্ট শিশুপাল তা দেখে অবজ্ঞা করে হেসে ভীষ্মকে বলে –আরে ভীষ্ম ওর হাত ছেড়ে দাও। সভাস্থ সকলে রাজারা কৌতুক দেখুক! পতঙ্গের মত এই ভীমকে আজ আমি দগ্ধ করে ছাড়ব।

ভীমকে শান্ত করে গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম বলেন –এই শিশুপালের সকল বিবরণ আগে শোন।
......................................
উৎসর্গ: সকল ব্লগার বন্ধুকে
.....................................
আগের পর্ব:

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১৪২ Click This Link

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২৩ শে এপ্রিল, ২০১৭ রাত ১০:১৮

সিনবাদ জাহাজি বলেছেন: সুন্দর একটি প্রচেষ্টা আপনার দিদি।
ধন্যবাদ এ জন্য।
আমি ব্লগে আসার অনেক আগে থেকেই আপনার এই সিরিজের নিয়মিত পাঠক

০৭ ই মে, ২০১৭ সকাল ১১:৫৮

দীপান্বিতা বলেছেন: ধন্যবাদ, সিনবাদ জাহাজি!

২| ২৪ শে এপ্রিল, ২০১৭ রাত ৯:৩৮

রাতুল_শাহ বলেছেন: শিশুপালেের অনেক কথা সত্য, তবে সে অপমান করার জন্য সেগুলো ব্যবহার করেছে

০৭ ই মে, ২০১৭ সকাল ১১:৫৮

দীপান্বিতা বলেছেন: ধন্যবাদ, রাতুল_শাহ!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.