নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

পেশায় শিক্ষক হলেও নেশায় লেখক ও পর্যটক। \'\'ভালো আদর মন্দ আদর\'\'(২০১৩) তাঁর প্রকাশিত প্রথম বই

এইযেদুনিয়া

আমার চোখে তো সকলই শোভন/সকলই নবীন,সকলই বিমল/ সুনীল আকাশ,শ্যামল কানন/বিশদ জোছনা,কুসুম কোমল/সকলই আমার মত

এইযেদুনিয়া › বিস্তারিত পোস্টঃ

রাজাকারের চেহারা

২৯ শে আগস্ট, ২০১৪ বিকাল ৩:২৫



আমাদের মধ্যে কেউ পড়ত ক্লাস টুতে, কেউ থ্রিতে, কেউ ফোরে। হেনা(ছদ্মনাম, এখানে শুধু এই নামটিই ছদ্মনামে রাখা হল)-ই ছিল আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বড়। ও পড়ত ক্লাস ফোরে।বিকেলে বাসার সামনের উঠানের মত জায়গাটাতে আমরা এক্কাদোক্কা, বরফ-পানি, কুমির তোর জলে নেমেছি, ফুলটোকা, সাতপাতা, মাংসচোর, টিলো-স্প্রেস, পুতুলের বিয়ে নানান রকম খেলা খেলতাম।আমরা মানে, আমি, হেনা, সুবর্ণা,কণা, রুমি আরো নতুন কেউ যদি আসতো খেলতে।সুলতানা আপু, সামিনা আপুরা একটু বড় হয়ে গেছেন বলে আর আমাদের সাথে খেলতে আসেন না। তাদের ঘর থেকে বের হওয়াই নিষেধ। আর ছিল ছেলেরা। ছেলেদের সাথে আমাদের প্রায় সময়ই ঝগড়া লেগে যেত। আমাদের সাথে কুতকুত বা এক্কাদোক্কা খেলার জন্য খুব ঘ্যানঘ্যান করতো ওরা।কিন্তু খেলতে নিলেই এমন চোরামি করত যে ওদেরকে খেলা থেকে বাদ দিতেই হতো। ওরা তখন দূর থেকে আমাদের খেলা নিয়ে হাসাহাসি করতো।নিজেদের মত লাটিম ঘুরানো বা সাতা চাড়া খেলত ওরা।কিন্তু আমরা মেয়েরা মেয়েরা খেলতে নিলেও ঝগড়া লেগে যেত।বিশেষ করে কণা, ও সব সময় ঝগড়া করত।রাগ করে খেলা বাদ দিয়ে চলে যেত। তখন হেনা বলত, ‘’দেখেছো, কেমন ঝগড়া করে মেয়েটা? ও মুসলমান না। ও হলো খ্রিস্টান। না, না, খ্রিস্টান না। ও আসলে বৌদ্ধই।ওর নামটা দেখেছো? কণা! এটা কি মুসলমানদের নাম হলো?’’



হেনার কথা আমরা মেনে নিতাম।আমাদের সাথে পরীর মত মেয়ে ছিল সুবর্ণা।ভীষণ মিশুক আর খালি হাসত। সুবর্ণা ছিল হিন্দু।একদিন সুবর্ণাদের বাসা থেকে আমাকে বের হতে দেখে হেনা বলল, ‘’ওদের বাসায় যেয়ে আবার কিছু খাও নি তো? ওরা কিন্তু হিন্দু।‘’ ধর্ম বিষয়ে হেনা-ই আমাদের চেয়ে বেশি জানত।লাল পিপড়াগুলোও যে হিন্দু, এদেরকে মেরে ফেলতে হবে, এ তথ্য হেনার কাছ থেকেই জেনেছিলাম। আমি তখন পরতাম ক্লাস টুতে। আমাদের সবার কাছেই প্রিয় ছিল বাংলা ‘’আমার বই’’।একদিন হেনা আমাদের বাসায় আসলে আমি ওকে আমার বাংলা বইয়ের একুশে ফেব্রুয়ারি ও মুক্তিযুদ্ধের প্রবন্ধগুলো দেখাচ্ছিলাম।হেনা বলল, ওদের স্কুলে নাকি এই গল্পগুলো পড়ায় না, ওদের স্যার বলেছে এসব নাকি সব মিথ্যে!তাই এসব মিথ্যা গল্প ওদের সিলেবাসেও রাখেনি। আমি দুঃখভরা চোখ নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম।



আমাদের পাশের বাসাতেই থাকতো হেনারা। আমার আম্মার কাছে শুনেছি, হেনার মা নাকি গর্ব করে বলে যে, হেনার বাবা ৭১ সালে রাজাকার কমান্ডার ছিল।এখন জামাতে ইসলামীর বড় রোকন।প্রতিবেশি হিসেবে হেনারা খুব ভাল ছিল, আমাদের সাথে ওদের সম্পর্কও ভাল ছিল।কিন্তু হেনার বাবার পরিচয়টা নিয়ে আমাদের ভেতরে ভেতরে ঘৃণা ছিল, যা প্রকাশ করতে পারতাম না।হেনার একটি অসুস্থ কংকালসার ছোট ভাই ছিল, হাঁটতে পারতো না, চোখে দেখতো না, কানে শুনতো না, কথাও বলতে পারতো না।একটি ঘরে তাকে একা রাখা হয়েছিল। হেনার বাবা সেই ছেলের কোন চিকিৎসা করে নি, হেনার মাকেও দিত না ছেলের পরিচর্যা করতে।স্বামীর রাগের কারণে ছেলেকে মা লুকিয়ে লুকিয়ে যত্ন নিত, খেতে দিত। অযত্ন, অবহেলা ও অপুষ্টিতে একদিন হেনার ভাইটা মরে গেল। তাতে হেনার বাবাকে দেখে মনে হল যেন, আপদ বিদেয় হয়েছে। আর ওদিকে হেনার মা স্বামীর ভয়ে ছেলের জন্য কাঁদতেও পারতো না।



হেনার বাবার চোখগুলো ছিল বড় বড় আর লাল।চাহনির মধ্যেই ভয়ংকর একটা ভাব ছিল।বাবা বাসায় ফিরলেই হেনার মধ্যে একটা ভয়ার্ত ভাব লক্ষ্য করতাম।খুব সন্তর্পণে চলাফেরা করত, মাথায় ওরনা দিয়ে রাখত। আর যখন ওর বাবা বাসায় থাকত না, হেনা যেন পালটে যেত।আমার শৈশবের অনেকটা সময় ছিল হেনাকে নিয়ে।সেই সময়ে মুনির-রীমা-খুকু এসব ঘটনা নিয়ে প্রতিদিন পত্রিকায় খবর থাকতোই।এছাড়াও চিত্রবাংলা, চিত্রালী টাইপ পত্রিকাগুলোতে অনেক রসালো খবর ছাপা হত।আমরা খুব বেশি পড়তে পারতাম না, তাই শুধু ছবি দেখতাম। একটা ছবি ছিল মুনির সোফাতে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে আর খুকু ম্যাক্সি আর সানগ্লাস পরে তার পেটের উপরে বসে খুব হাসছে।আমাদের শিশুমনে এই ছবিটি একটা নতুন ভাবনা সৃষ্টি করেছিল। এই যে এভাবে খুকু মুনিরের পেটের উপরে বসে আছে, এতে মুনিরের পেটে ব্যাথা লাগছে কি না, এসব নিয়ে আমাদের জল্পণা কল্পণার শেষ ছিল না।এসব নিয়ে হেনা-ই জ্ঞানগর্ভ মন্তব্য করতো। আমি ওর কথাই বিশ্বাস করতাম। শত হলেও আমি ক্লাস টুতে পড়ি আর হেনা ফোরে।



হেনার সাথে আমার অনেক দিন যোগাযোগ ছিল। দুজনেই যেহেতু ঢাবির শিক্ষার্থী ছিলাম, বাসাটাও একই পাড়াতে, তাই ভার্সিটির ‘’কিঞ্চিৎ’’ বাসে করে গল্প করতে করতে মাঝে মাঝে ওদের বাসাতেই চলে যেতাম। আমাদের বন্ধুত্ব শৈশবের। আমাদের বন্ধুত্বে কে রাজাকার, কে মুক্তিযোদ্ধা এসব ভেদাভেদ কাজ করে নি। এমন কি আমার মা ও হেনার মায়ের বন্ধুত্বেও না।আগে হেনাদের অবস্থা বেশি ভাল না থাকলেও পরবর্তীতে হেনার বাবার ভাগ্য ফিরে যায়। ওরা নতুন যে বাসায় ভাড়া উঠেছিল সেটাও অনেক বড় আর অভিজাত।আমি একদিন হেনার পুরোনো ডায়রীগুলো পড়ছিলাম।এসব পড়ার অনুমতি ছিল আমার।সেই ডায়রীতে একটি দিনের কথা লেখা, ‘’আজ গোলাম আজম দাদুকে গ্রেফতাম করে নিয়ে যাওয়া হলো।‘’ এরপর এই ঘটনায় হেনা কতটা কষ্ট পেয়েছে সেসব লেখা। আমি তো ঐ লেখাগুলো পড়ে হাসতে হাসতে হেনার বিছানায় গড়াগড়ি খেলাম কতক্ষণ। হেনাকে বললাম, ‘’এসব তুমি কি লিখেছো? হিহিহি। গোলাম আজম রাজাকারকে তুমি দাদু বলো?’’ আমার হাসি যেন আর থামেই না।আমার এমন অমানবিক (!) হাসিতে আর বিদ্রুপে হেনা শুধু ব্যথিত চোখে তাকিয়ে ছিল, কিছুই বলে নি।



আবার একটু পুরোনো দিনে ফিরে যাই।সেই যখন আমি ক্লাস টুতে আর হেনা ফোরে, সেই সময়ে। একদিন বিকেলে আমরা টিলো-ইস্প্রেস খেলছিলাম। খোলা জায়গাটাতে কিছু জবা গাছ, পাম ট্রির ঝোঁপ ছিল। আমরা ওখানেই দল বেঁধে সব লুকাতাম।আমাদের সাথে হেনার দু/তিন বছরের ছোট বোন মীনা-ও (এটাও ছদ্মনাম)ছিল। লুকানোর জায়গা থেকে মীনা হাঁসফাস করত, শব্দ করে ফেলত। আমরা ভয়ে থাকতাম প্রতিপক্ষের কাছে না ধরা পড়ে যাই।এমনিতে মীনা খুব শান্ত, কিন্তু সেদিন কেন যেন অস্থির হয়ে যাচ্ছিল।এদিকে আমাদের খেলার সময় প্রায় শেষ হয় হয়। সন্ধ্যা নেমে আসছে। আমাদের প্রতিপক্ষের দল আমাদের দেখে আগেই টিল স্প্রেস দিয়ে ফেললো। আমরা সব হৈ হৈ করে ঝোঁপ থেকে বের হয়ে আসলাম। শুধু হেনা তার বোনকে নিয়ে তখনো ঝোঁপের ভেতরে লুকিয়ে রইল। এমন সময়ে হেনার বাবা তিনতলা থেকে নেমে ঐ উঠানে আসলো।হেনার বাবা উঠানে এসেই হুংকার দিল,’’বেরিয়ে আয়।‘’ হেনা ভয়ে বের হতে চাইছিল না। আমরা ছোটরাও বুঝতে পারছিলাম না কি হতে যাচ্ছে না।হেনার বাবার চোখ রক্তলাল হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।হেনাকে আমরাই ঝোঁপ থেকে ধরে বের করে আনলাম, সাথে মীনা। হেনার বাবা হুংকার দিলো, হেনার জামা কাপড় সব খুলে ফেলার জন্য। হেনা ওর কোল থেকে মীনাকে নামিয়ে জামা কাপড় খুলে দেবার চেষ্টা করল।হেনার বাবা হুংকার দিল, ‘’না, ওকে তুই ধরবি না।মীনার জামা না, তোর জামা খোলা।‘’



হেনা বারবার বিল্ডিং বারান্দাগুলোর দিকে তাকাচ্ছিল। ওর সাথে আমরাও দেখলাম, ছয় তলা পর্যন্ত সব ফ্লাটের বারান্দায় সবাই নিচে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।হেনার বাবা আবারো হুংকার দিল, হেনাকে তার জামা খুলে ফেলার জন্য। হেনা বহু কষ্টে, অনেক লজ্জায়, এদিক ওদিকে তাকিয়ে নিজের জামাটা খুব ধীরে ধীরে, যতটা সম্ভব দেরি করা যায়, তার জামাটা খুলল।এরপর আবার হুংকার শুনলাম, মীনার জামা খোলার জন্য। হেনা ধীরে ধীরে মীনার জামা-কাপড় সব যখন খুলে ফেললো, আমরা বুঝতে পারলাম, মীনা হাগু করে দিয়েছে। ঠিক এমন মুহুর্তে মাগরিবের আযান শোনা গেল। হেনার বাবার ঠোঁটে সামান্য হাসির চিহ্ন যেন আমি দেখতে পেলাম।হেনার বাবা চলে গেল মসজিদের দিকে। হেনা খুব লজ্জিত ভংগিতে, খুব আড়ষ্ট হয়ে, মৃদুভাবে কাঁপতে কাঁপতে মাথা নিচু করে বোনকে কোলে নিয়ে তার ঘরের দিকে পা বাড়ালো। ওর হাঁটা দেখে মনে হচ্ছিল, এই বুঝি জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাবে। আমরাও সবাই যে যার ঘরে ফিরে এলাম খেলা ফেলে।যদিও কিছুই ছোট মাথায় কিছুতেই ঢুকছিল না, কেন, কি জন্য হেনার বাবা এমন করলেন হেনার সাথে!কী দরকার ছিল এসবের?



এরপর হেনা অনেক দিন খেলতে আসে নি আমাদের সাথে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.