নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মোহাম্মদ বাংলাদেশ হোসেন, এখন কেমন আছেন?

ফরহাদ মেঘনাদ

জয়তু মানুষ মানে— তোর পাখি হবার মুরোদ নাই

ফরহাদ মেঘনাদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

বেচাকেনা

১৬ ই নভেম্বর, ২০১৬ রাত ১১:১৭


নয়া রিকশা কত হইল্ দিনু ভাই ? 'বারো আজার দুইশ', মুখও ঘাড়ের ঘাম মুছতে মুছতে জবাব দিলো দিনু। তার মন মেজাজ আজ দারুণ খোশ। বহুদিনের লালিত স্বপ্ন তার একটা টকটকে নতুন নিজের রিকশার। সেটা আজ সত্যি হয়েছে। কথার কথা স্বপ্ন না, সে প্রায়শই ঘুমের ঘোরে এরকম একটা রিকশা স্বপ্নে দেখেছে। রিকশা’র পেছনে রং-কারিগরের আঁকা মক্কা-মদিনা’র ছবি, আর মাঝখানে লাল রংয়ে লেখা ‘পায়রা’। কেনা রিকশা’টা যদিও সেরকম না, পেছনে আঁকা নর-নারীর হ্যান্ডশেক করা হাতের ছবি, আর উপরে লেখা ‘যুগল মিলন’। তাতে কিছু যায় আসেনা। দিনু সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কিছু টাকা জমলেই স্বপ্নের রিকশা’র মত মক্কা-মদিনা আর ‘পায়রা’ আঁকিয়ে নেবে সে।

পায়রা নাম’টা দিনু’র স্ত্রীর। দশ-মাস আগে বিয়ে হয়েছে তাদের। বউটা খুব’ই ভালোবাসে দিনু কে। কিন্তু দিনু'র ভালোলাগেনা এ-জীবন। সারাদিন ভাড়া’র রিকশা টেনে, সন্ধ্যায় রিকশা ও রোজগারের বেশী অংশ’টা রিকশা-মালিক কে বুঝিয়ে দিয়ে, মালিকের মুখ থেকে ‘এটা ভাঙা কেন, ওটা ভাঙা কেন, খানকির পোলা দেইখা চালাইতে পারস না’ শুনে মন খারাপ হয়ে থাকে তার। ভাত রোচেনা মুখে। অথচ, নিজের একটা রিকশা হলে শুনতে হতনা এসব, রুচতো মুখে ভাত, তবেই না পায়রা'র সোহাগে সুখ।
মজার কথা, পায়রা কে দিনু বিয়ে করেছে প্রেম করে। প্রেমের সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে, দিনু’র বুক এখনো কেমন কেমন যেন করে, টনটনে ব্যাথা হয়, উদাস উদাসও লাগে। দিনু’রা এখন যে বস্তিতে আছে, এখানেই পায়রা, তার বাবা-মা আর ছোটভাই মিলে এক পরিবার থাকতো। দিনু শুনেছে, পায়রা’র বয়স তিন থেকেই ওরা এই বস্তির বাসিন্দা । দিনু’রা এসেছে বছর তিন আগে। বাপ আর মা নিয়েই ছিলো দিনু’র পরিবার। রিকশা’র ড্রাইভার ছিলো দিনু-পায়রা দুজনের বাবা’ই। পায়রা’র চেহারা মারাত্মক। মারাত্মক চেহারা দেখেই দিনু তার প্রেমে পড়েছিলো। পায়রা তো কোনমতেই রাজি না। সে প্রেম করবে বড় ঘরের ভদ্রলোকের ছেলের সাথে। যে তাকে কিনে খাওয়াবে আঠারো টাকা দামের ‘চকোবার’ আইসক্রীম। পায়রা কে টলাতেই পারেনা দিনু। শেষে একদিন দিনু বাপের টাকা চুরি করে পায়রা’র জন্য কিনে আনলো পাঁচটা চকবার ও একটা কসমেটিকস বক্স, আর নিজের জন্য ইঁদুর মারা বিষ। পায়রা সেগুলো নিয়ে চকবারে কামড় বসাতেই দিনু বিষ হাতে নিয়ে বললো, ‘ইবার ক আমারে বালাবাসপি, নয় এক্ষণ বিষ খামু, এক্ষণ’। চকবার গলায় আটকে গেল পায়রা’র। সে থাবা দিয়ে দিনু’র হাতের বিষ ফেলে দেয়। তারপর থেকেই ঘোরতর প্রেম পায়রা-দিনুর।

প্রেমের তিনমাসের মাথায়, এক সন্ধ্যায় আগুন লাগে দিনু-পায়রা’দের বস্তিতে। এক নিমেষে সব শেষ। দিনু-পায়রা’র বাপ-মা-ভাই সব মরে সাফ । শুধু বেঁচে গেল দিনু-পায়রা। সেদিন দুর্ঘটনার কিছু আগে তারা লুকিয়ে ঘুরতে গিয়েছিলো। তারপর তো দুজনেই একা। শোকের কিছুদিন পায়রা কে আশপাশের ভাবি-চাচী’রা নিজেদের কাছে রেখেছে। দিনু’র দিন কেটেছে খেয়ে না-খেয়ে ভাবান্তরহীন ভবঘুরে। তারপর একদিন রিলিফের নামমাত্র কিছু টাকা হাতে এলো তাদের। সেগুলো দিয়েই হলো বিয়ে, নতুন একটা বস্তিতে ঘর ভাড়া নেয়া, আর দিনু’র ভাড়ায় রিকশা চালানো বাবদ জামানতের যোগান । যদিও নতুন বস্তিতে তারা টেকেনি বেশীদিন, পুরোনো বস্তি ঠিক হতেই আবার ফিরে এসেছে চেনা মাটির টানে।

বেলা প্রায় সাড়ে-বারোটা। প্রতিদিন এই সময়ে দিনু বস্তিতে যায় দুপুরের খাবার খেতে। আজ তার ব্যতিক্রম। আজ নতুন রিকশা হাতে তাই দিনু ঠিক করেছে, সারাদিন খেপ মেরে সন্ধ্যায় পায়রা’র জন্য একটা ফেয়ার এন লাভলি আর নতুন রিকশা নিয়ে বস্তিতে গিয়ে পায়রা কে চমকে দেবে। কি’যে খুশি হবে পায়রা, ভাবতেই দিনুর ঠোঁটের কোণে হাসির ঝিলিক খেলে গেলো। পায়রা অনেকদিন থেকেই ফেয়ার এন লাভলির জন্য ঘ্যানঘ্যান করছে, দিনু কিনে দিতে পারেনি। বাজারের চাল-ডালের টাকা’ই জোগাড় হয়না, আবার ফেয়ার এন লাভলি ! ঘ্যানঘ্যানানির জের ধরেই দিনু সেদিন বৌ’কে বললো, ‘তর রূপ দেখইনা মানুষ তো আমিই, নাকি ? ফেয়ার এন লাভলি ছাড়া রূপ’ই আমি ভালাপাই। নাকি নাগর জুটছে নতুন, রূপ দেখইনা ?’ পায়রা খুব’ই রাগ করেছিলো শুনে। রাগ হবার’ই কথা। একে টানাটানির সংসারে সাধ-আল্লাদের কপাল ফাটা, তার উপর এমন কথা। ভাবতেই দিনু’র মন সহানুভূতিতে চুকচুক করে ওঠে।

মাত্রই দিনু একটা খেপ নামিয়ে এসেছে। রিকশা’টাকে সাইড করে পার্ক করেছে ছায়ায়। নতুন রিকশা চকচক করছে, তবু গামছা দিয়ে রিকশা পরিষ্কারে লেগে গেলো সে। পরিষ্করণের মাঝে দিনু লক্ষ্য করলো, বাম চাকার একটা স্পোক ভাঙা। তার বুক মুচড়ে উঠলো। ভাঙা স্পোকের যায়গায় এমনভাবে হাত-বুলাতে লাগলো, যেন ভালোবাসার মানুষের ব্যথা পাওয়া যায়গায় হাত-বুলাচ্ছে সে, আদরে আদরে ভুলিয়ে রাখতে চাইছে বেদনা। ‘আমার নয়া রিকশার স্পুক ভাঙছত মাদারির পুত, দেখলাম না খালি, কাসুন্দি মাখাইয়া খাইতাম তরে দেখলে’। দিনু হাত-বুলাচ্ছে আর অদেখা ক্ষতিকারকের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করছে বিড়বিড় করে। গালাগালির ফাঁকেই আরেকটা খেপ জুটে গেল তার। খেপ যাবে সদরঘাট। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে। নিশ্চই প্রেমের জোড়া। দিনু রিকশা চালাচ্ছে ঢিমেতালে। যাত্রী ছেলেমেয়ে দুটি গল্প করছে নিজেদের মত। দিনু প্যাডেল চাপছে যদিও, কিন্তু তার কান খাড়া। এরকম প্রেমের জোড়াগুলো রিকশায় উঠলেই অসভ্য অসভ্য কথা বলে, দিনু শোনে আর মনে মনে খিকখিক করে। এরাও নিশ্চই বলবে। কিন্তু দিনুর ইচ্ছা অপূর্ণ রেখেই জোড়া’র ছেলেটি গান ধরলো। চাপা, কিন্তু স্পষ্ট কণ্ঠে গাইছে, ‘দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা’। দিনু নাখোশ হয়ে মনেমনে খেঁকিয়ে উঠলো, ‘গান বন্ধ কইরা কতা ক হারামজাদা’। এরকম দু-একটা জুটে যায় মাঝেমধ্যে, কাজের কাজ বাদ দিয়ে খালি সারিন্দা বাজায়। পিছে তাকালে দেখা যাবে আরেক ন্যাকামি। চুম্মা-চাট্টি বাদ দিয়ে হয়তো মেয়েটিও ছেলেটির কাঁধে মাথা রেখে গান শুনছে। যদিও পায়রা গান খুব পছন্দ করে। কিন্তু দিনু তেমন একটা গাইতে পারেনা। গাইতে গেলে ঘুরেফিরে একই গানের দুটো কলি’ই গায় সে, ‘ও পাগল মন মনরে, মন কেন এত কথা বলে’। সারাজীবন ধরে এটুকুই মুখস্থ করতে পেরেছে দিনু। পায়রা এ-গান শুনলেই কুটকুট করে হাসতে থাকে। হাসির কি ? দিনু তো আর জমিদারের ছেলে না, যে গানে-মানে জীবন হবে তার। সে গরীবের ছেলে, তাকে কাজ করে খেতে হয়।

সদরঘাটের খেপ সহ আরো কিছু ভালো খেপ নামিয়ে, দিনু এখন ফেরার পথে। রাত আট’টার কাছাকাছি । আকাশের অবস্থা ভালো না, ভীষণ বাতাস হচ্ছে। একপশলা ধুলোবালি বাতাসের তোড়ে দিনু’র নাকমুখে ঢুকে পড়তেই সে গামছা দিয়ে নাকমুখ বেঁধে নিলো। বস্তির দিকে রিকশা ঘুরিয়েছে দিনু। পায়রা’র জন্য ফেয়ার এন লাভলি কিনতে হবে মাঝে কোথাও থেমে। কাজী-অফিসের মোড়ে যেতেই ‘এই রিকশা, যাবি?’ শুনে দাঁড়ালো সে। দিনু দাঁড়াত না, কিন্তু তাকে দাঁড়াতে হলো। কারণ, লোকটা তার চেনা। দিনুদের বস্তির সবার পরিচিত এই লোকটি হাতুড়ে ডাক্তার মজিদ। বস্তির মানুষের নাগালে এই একটি ডাক্তার’ই ভরসা ! দিনু’র জন্যও ভরসা হয়েছিলো এ ডাক্তার। তবে দিনু’র অসুখের জন্য নয়, সে অন্য ব্যাপার। দিনু’র ঘরের গজ-পঞ্চাশেক দূরেই ডাক্তার মজিদের ফার্মেসি। দিনু দেখলো, মজিদের হাতে ধরা লাল-শাড়ীতে ঘোমটায় মুখ ঢাকা একটা মেয়ে। এ মেয়েকে ডাক্তার বিয়ে করেছে বলেই মনে হলো দিনু’র।
নাকমুখে গামছা পেঁচানো তাই দিনু কে চিনতে পারেনি ডাক্তার। দিনুও অপরিচিতের মত বললো, ‘কই যাইবেন?’। ‘কমলাপুর রেলইস্টিশন’ বললো ডাক্তার। দিনু বললো, ‘আকাশের অবস্তা ভালা না, যামুনা’। ডাক্তার বললো, ‘ভাড়া বাড়াইয়া দিমু চল’। বাড়তি ভাড়ার লোভেই যেতে রাজি হলো দিনু। আকাশে মেঘ ডাকছে গুড়গুড়। দিনু রিকশার প্যাডেল হেঁকে যাচ্ছে দ্রুত। বৃষ্টি নামার আগেই তাকে খেপ নামিয়ে ফিরতে হবে পায়রা’র কাছে।
মাত্র’ই বস্তিতে ঢুকলো দিনু। কিন্তু তার ঘরে আলো জ্বলছেনা কেন ? রাত সবে দশটা, আর পায়রা তো তার সাথে না খেয়ে ঘুমায় না। সেকি, ঘরে তো তালা। দিনু জোরগলায় ডাকতে লাগলো পায়র’কে। দিনুর ঘরের সামনে আশপাশের লোকজন জমে গেল। সবার এক’ই মত, আছরের নামাজের পর থেকে কেউ দেখেনি পায়রা কে। তখনি ‘দিনু ভাই, দিনু ভাই’ করতে করতে ছুটে এলো মোড়ের দোকানের সবুজ ! সে হাঁফাতে হাঁফাতে বললো, ‘পায়রা ভাবি’রে মজিদ ডাক্তারের লগে ট্রেনের জানলায় বসা দেখছে রইস, আমারে ফোনে কইছে এক্ষণ। রইস দৌড়াইয়া হেগো কাছে যাওয়ার আগেই ট্রেন ছাইরা দিছে।’ চারদিকে হায় হায় রব পড়ে গেল। পাশের ঘরের ভাবি দিনু’র দিকে তাকিয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠলো, ‘যাইবোনা, যাইবোনা কেন ? গত দুইমাস ধইরা তো মাইয়াডারে মাইরের উপরে রাখছো। কি এমন হইলো, যে এত বাকবাকুম পিরিতের মইধ্যে মাইর ঢুকলো ?’ দিনু চুপ করে আছে। তার মুখ বিমর্ষ, মনে নোংরা প্রফুল্ল । বারো হাজার দুশো টাকায় আজ দুটো জিনিস বেচাকেনা করেছে সে।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৭ ই নভেম্বর, ২০১৬ সকাল ১০:২৭

হাসান মাহবুব বলেছেন: ট্রাজিক :(

১৭ ই নভেম্বর, ২০১৬ সকাল ১১:১৫

ফরহাদ মেঘনাদ বলেছেন: হুম! মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.