নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শব্দকবিতা : শব্দেই দৃশ্য, শব্দেই অনুভূতি [email protected]

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই

দুঃখের কবিতাই শ্রেষ্ঠ কবিতা। ভালোবাসা হলো দুঃখ, এক ঘরে কবিতা ও নারী।

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই › বিস্তারিত পোস্টঃ

খ্যাতির লাগিয়া

০৩ রা এপ্রিল, ২০১৮ রাত ৯:৪১

সুহৃদ রহমান আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু। সে একজন মাঝবয়সী নবীন লেখক। গল্প, কবিতা, ছড়া লিখতে লিখতে সে বড়ো হয়েছিল, লিখেছেও ভূরি ভূরি, কিন্তু সাহিত্যমহলে তার আত্মপ্রকাশ ঘটলো ঔপন্যাসিক হিসাবে।
সুহৃদ রহমান তার আসল নাম, কিন্তু বইয়ের ওপর সে এক ছদ্মনাম ছেপে দিল।
আমি বললাম, এই নামে তোকে কে চিনবে?
সুহৃদ বললো, আমাকে চেনার দরকার কী? আমার বইকে চিনলেই হবে। আমি কি আমার নাম ফুটাবার জন্য বই লিখি?
রাগে আমার শরীরে আগুন ধরে যায়। তবু শান্ত স্বরে বলি, তুই যে বনফুল বা শংকর হতে চাস তা কিন্তু পরিষ্কার। যে লোক জীবনে একটি মাত্র বই বের করেন তিনি তাঁর আসল নামেই বের করেন, এবং শুধু তাই নয়, আসল নামের আগে-পিছে যতরকম লেজুড় আছে সব জুড়ে দিয়ে নিজের চৌদ্দ গুষ্টির নাম ‘ফাটিয়ে’ দেন। তোর প্রচুর টাকাকড়ি আছে এবং তুই কম করে হলেও আরো বিশটি বই ছাপবি। পত্রপত্রিকায় তোর ছদ্ম নামের পাশাপাশি আসল নামটাও ছাপা হবে। অর্থাৎ তুই যে কেবল তোর একটি নামের খ্যাতি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে চাইছিস না তা কোলের শিশুটিও বোঝে।
সুহৃদ রেগে যায়। বলে, কী বলতে চাস তুই? টাকাকড়ি না থাকলে কি সাহিত্যিক হওয়া যায় না?
না, যায় না। গেলে আমাকেও লোকে সাহিত্যিক বলতো। আমার লেখার ভাণ্ডার কি তোর চাইতে কম নাকি? আমার টাকা নেই বলে বই ছাপতে পারি নি এবং তথাকথিত সাহিত্যিকও হতে পারি নি।
তুই যা লিখেছিস তা কোনো লেখা হয়েছে? ওগুলো তো ছাগলেরও ‘অখাদ্য’।
আমারও মুখ ফস্‌কে একটা দাঁতভাঙা উত্তর বের হয়ে আসছিল, কিন্তু সংযমের পরীক্ষা দিয়ে তা বলি না। বিনিময়ে ওর কাছে একটা ‘গভীর’ দর্শন তুলে ধরতে সমর্থ হলাম। প্রত্যেকটা মানুষই কবি। মানুষ ছন্দোবদ্ধভাবে কথা বলতে পছন্দ করে। বক্তা অনর্গল কথা বলে যাচ্ছেন, কথার শ্রীবৃদ্ধির জন্য হঠাৎ দু-চার ছত্র কবিতা কিংবা ছড়া আবৃত্তি করলেন, মানুষ মজা পেয়ে হাততালি দিয়ে উঠলো। কবি মাত্রই ভাবুক। এমন কেউ কি আছেন যিনি কোনোদিন কিছু ভাবেন নি? কবি মাত্রই স্বপ্নচারী। এমন কি কোনো মানুষ খুঁজে পাবেন, যিনি সুখের স্বপ্ন দেখতে দেখতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন নি? তারপরও কি আমরা সব মানুষকে কবি বলি? বলি না। কারণ, আমরা সব মানুষের নাম জানি না, কারণ বাজারে সব মানুষেরই অন্তত একটি করে কবিতার বই বের হয় নি। আচ্ছা, যিনি বলেন যে আমি খুব প্রচারবিমুখ কবি, বলতে পারেন কি তিনি তাঁর কবিতার বইটি কেন ছাপেন, বা ছেপেছেন? একটি বই বের হওয়া মানেই তো জনসমক্ষে তাঁর প্রচার ছড়িয়ে পড়া। বস্তুত আমরা যাঁদের নাম শুনি কিংবা জানি তাঁরা কেউ কিন্তু প্রচারবিমুখ নন, হলে আমরা তাঁদের নামই শুনতাম না। অতএব, সুহৃদ রহমান যে খ্যাতির জন্যই এবং আসল ও ছদ্ম নাম ‘ফুটাবার’ জন্যই বই ছেপেছে তা বলাই বাহুল্য।
আমার কথা শুনে সুহৃদ নরম হয় এবং আমার কাঁধে হাত রেখে দুঃখ-বিগলিত হয়। বলে, তোর কথাই ঠিক। আমি দুটি নামেরই খ্যাতি চাই। দুটি নাম যেন আমার দুটি পৃথক সত্তা। আমি আমার ছদ্ম নামের ওপর ভর করে সুহৃদ রহমানকে শীর্ষে তুলতে চাই। দুটি নামের মধ্যে অন্তত একটি তো বাঁচবে। যেটি শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে সেটাই প্রকৃত আমি।

একুশে বই মেলাতে সুহৃদের প্রথম উপন্যাস ‘স্খলন’ বের হলে চারদিকে হৈচৈ পড়ে গেল। এই ‘চারদিক’ কিন্তু জগৎজোড়া কিংবা দেশজোড়া ‘চারদিক’ নয়, এর একটা নির্দিষ্ট সীমারেখা আছে।
সুহৃদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যা।
সুহৃদের জন্য সবচাইতে বিব্রতকর অবস্থা হলো সে যখন লিখতে থাকে ওর বউ তুলি ভাবী তখন গালে হাত দিয়ে একধ্যানে খাতার ওপর তাকিয়ে থাকেন। এভাবে চোখের সামনে বসে থাকলে কি স্বচ্ছন্দে লেখা যায়? কিন্তু ভাবীর যেন তর সয় না, সুহৃদ কী লিখলো তা পড়ার জন্য তিনি অধৈর্য হয়ে পড়েন। সুহৃদের প্রায় গল্পেই ওর পূর্ব প্রেমের ছায়া থাকে, ওসব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ভাবী পড়েন। ভাবীর মাথায় অবশ্য কিছুটা দুশ্চিন্তাও কাজ করে- সুহৃদের হৃদয় কাননে এখনো কি সেই বিগত প্রেমিকা নাচানাচি করে? এটা জানার জন্য ভাবীর খুব আগ্রহ। ‘স্খলন’ ছাপা হবার পর ভাবী পড়ে দেখেন নি, কেননা তিনি আগেই এর পাণ্ডুলিপি পড়েছিলেন। ভাবী বইটি সম্পর্কে বলেন, এটা একটা অতিশয় ‘করুণ’ গল্প হয়েছে; তাঁর মতে এত দুঃখের কাহিনি না লিখে হুমায়ূন আহমেদের মতো হাসির গল্প লেখা উচিত। ভাবী যদিও অন্য লেখকের বই তেমন একটা পড়েন না, এমনকি হুমায়ূন আহমেদের গল্পও না, তবুও হুমায়ূন আহমেদ তাঁর দ্বিতীয় ফেভারিট লেখক। বলাই বাহুল্য- সুহৃদ রহমানই তাঁর ‘প্রিয়তম’ লেখক। ভাবী সুহৃদকে প্রায়ই বলে থাকেন, টাকা দিয়ে চোখের পানি ফেলতে কে কিনবে তোমার বই? যতবারই আমি পড়ি, চোখের পানিতে আমার বুক ভেসে যায়। এত কষ্টের কাহিনি লিখলে আমি আর তোমার কোনো বই-ই পড়বো না। সুহৃদের ছেলের বয়স সাত, মেয়ের বয়স পাঁচ। ওরা ‘স্খলন’ উচ্চারণ করতে পারে না। ‘সলন’, ‘খলন’, ‘সখলন’- ইত্যাকার যেসব উচ্চারণ ওদের মুখে আসে ওরা তার সবই বলে। মাঝে মাঝে ওরা বিরক্ত হয়ে বলে, বইয়ের নাম এত্ত কঠিন কেন? আমাদের পড়ার বইয়ের নাম কত সহজ- ‘আমার বই’, ‘অংক বই’...। বাসায় যে কোনো মেহমান এলে ওরা দু-ভাই বোন দ্রুত দুটি বই হাতে নিয়ে তাদের সামনে গিয়ে হাজির হয়। বই দেখিয়ে বলে- দেখুন, আব্বু কত সুন্দর বই লিখেছে। বইয়ের মলাট দেখায়, পাতা উলটে দেখায়। ছেলে ওর ক্লাসে একদিন একটি ‘স্খলন’ নিয়ে গিয়েছিল তার সহপাঠীদের দেখানোর জন্য। তারা একটি করে বই চেয়েছে, সে সবাইকে কথা দিয়েছে বই তাদের দেবেই। স্কুল থেকে ফেরার সময় বইটি তার ক্লাস-মিসকে দিয়ে এসেছে। ক্লাস-মিস তাকে বাহবা দিয়ে বলেছেন, তুমি তো দেখছি একজন ‘বিরাট’ লেখকের ছেলে! কীভাবে বই লিখতে হয় তা শেখার জন্য একদিন তোমার আব্বুর কাছে যাব।

সুহৃদের বাবা-মা ও ভাই-বোন- পরিবার।
সুহৃদের বাবা-মা বই পড়তে পারেন না, তবে ছেলের বইটি হাতে নিয়ে খুব গর্বের সাথে তাঁরা মানুষকে বলে থাকেন, আমার পুলা একটা বিখ্যাত বই লিইখ্যা ফালাইছে। ওর ভাই-বোন-ভ্রাতৃবধূ-ভগ্নিপতিগণ একসাথে গোল হয়ে বসে বইটি পড়ে। বইটি খুব রহস্যে ভরা। একেকটা অনুচ্ছেদ পড়ার পর তার ওপর পর্যালোচনা চলে। ওটি থেকে কে কতটুকু রসাস্বাদন করতে পারলো, বা কে কী বুঝতে পেরেছে তার ওপর একটা নাতিদীর্ঘ আলোচনা হয়। সবাই তো আর সমান মেধা নিয়ে জন্মায় নি, তাই এক-আধটু ভুল-চুক হতেই পারে, এবং যথারীতি একটু ভুল হলেই সঙ্গে সঙ্গে সুহৃদের ছোটো ভাইয়ের বউ আকলিমা কটাক্ষে ‘ভুলকারীর’ মেধার কথাটি স্মরণ করিয়ে দেয়- অবশ্য সেই সাথে ও-অংশটুকুর সঠিক অর্থটা ধরিয়ে দিয়ে আত্মগর্বের হাসি হাসে।

সুহৃদের কতিপয় শ্যালক-শ্যালিকা।
সুহৃদের শ্যালক-শ্যালিকাদের সঠিক সংখ্যানুধাবন ও নামমালা মুখস্থ করতে বিয়ের পর প্রায় ছয় মাস সময় অতিবাহিত হয়ে গিয়েছিল। অক্লান্ত পরিশ্রম শেষে সে সাত শ্যালক ও পাঁচ শ্যালিকার নাম-ধাম মুখস্থ করতে পেরেছিল। দুলাভাই হিসাবে সুহৃদ অত্যন্ত ভাগ্যবান- ওর শ্যালক-শ্যালিকারা ওকে সর্বদা মাথায় তুলে রাখে। ‘স্খলন’ এর অবস্থাও ও-রকম মাথায় তুলে রাখার মতো হলো- তারা বইটি নিয়ে হৈচৈ শুরু করে দিল, কিন্তু কেউ ওটি পড়ে দেখলো না। কারণ, ওদের বই পড়ার কোনো অভ্যাস নেই, অক্ষর দেখলে ওদের কান্না পায় দুঃখে- না খেয়ে না খেয়ে অক্ষরগুলোর কী করুণ হাল হয়েছে! সুহৃদ ঘোষণা দিয়েছিল, আমার কোনো শ্যালক কিংবা শ্যালিকা যদি বইটি সারা জীবনে অন্তত একবার পড়ে শেষ করতে পারে, তার জন্য আমার নগদ এবং অগ্রিম পুরস্কার রইল দুই হাজার টাকা। ঘোষণার সাথে সাথে অবশ্য ওর সুন্দরী কনিষ্ঠতম শ্যালিকা বই পড়তে শুরু করে দেয় এবং তিন দিনের মাথায় দুই পৃষ্ঠা পড়েও ফেলে। সুহৃদ খুশিতে ডগমগ হয়ে কথামতো দুই হাজার টাকা অগ্রিম পুরস্কার প্রদান করেছিল। এরপর দু-তিনবার তার হাতে বই দেখা গেছে বটে, তবে পড়ার অগ্রগতি হয়েছে বলে সুহৃদের জানা হয় নি। আরেকটি কথা, যদিও এরা কেউ পুরো বইটি পড়ে নি, তবু তারা জানতে পেরেছে যে বইটিতে কোনো প্রেমের কাহিনি নেই। তারা আক্ষেপ করে বলেছে, দুলাভাই কি জীবনে প্রেম করেন নি? তাহলে প্রেমের গল্প লেখেন না কেন? এর পরের বইতে যেন প্রেম থাকে।

আমাদের কতিপয় বন্ধুবান্ধবী, যেমন-
সজল- সদর ঘাটের এক হাইস্কুলের ইংলিশ টিচার। শিক্ষক হিসাবে অতি অল্প সময়ে সে প্রচুর নাম করেছে। জীবনে সে প্রথম উপন্যাস যেটি পড়েছিল তা হলো শরৎ চন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’। আমাদের সময়ে এইচএসসি-তে ‘শ্রীকান্ত’ প্রথম পর্ব পাঠ্য ছিল। সত্যি কথা বলতে কী, সজল সেই উপন্যাস থেকে পরীক্ষার জন্য সম্ভাব্য সবকটি প্রশ্নোত্তরই টানা মুখস্থ করেছিল, যদিও মূল বইটি সে কোনোদিন স্পর্শ করেছিল বলে আমাদের কাছে খবর নেই। ‘শ্রীকান্ত’ই এদ্দিন পর্যন্ত সজলের পঠিত বা অ-স্পর্শিত একমাত্র উপন্যাস ছিল। কিন্তু সেই সজলই সুহৃদ রহমানের ‘স্খলন’ পড়তে পড়তে উন্মাদ হয়ে গেল। ‘স্খলন’ এর মূল পাণ্ডুলিপি সে পড়বার সুযোগ পায় নি আমার কারণে, ওটি আমি বহুদিন আটকে রেখেছিলাম। ছাপার পর ওটি হাতে পেয়েই সে গোগ্রাসে গিলতে শুরু করলো। সজল রাত দশটার পর নাকি কখনো ঘুমের যন্ত্রণায় জেগে থাকতে পারে না। ও বলেছে, বইটি যেদিন ওর হাতে যায় সেদিন রাত দশটায় পড়তে শুরু করে, একটানা ভোর পাঁচটা পর্যন্ত পড়ে ওটি শেষ করে ফেলে। ঘুম থেকে ওঠে এগারোটার পর। বিলম্বিত-নাস্তা খেয়ে আবারো পড়তে বসে এবং একটানা ছয় ঘন্টা পড়ে দ্বিতীয়বারের মতো শেষ করে। বইটি ওকে নেশা ধরিয়ে দিয়েছে। এমন বই নাকি সে জীবনে পড়ে নি। (না পড়ারই কথা। এর আগে সে মাত্র একটি উপন্যাসই তো পড়েছে, যা ছিল ‘শ্রীকান্ত’। ও হ্যাঁ, সজল কিছু ইংলিশ নভেল পড়েছে, তবে তা-ও শ্রীকান্তের মতোই পাঠ্য তালিকাভুক্ত ছিল, এবং মূল বইগুলো সে জীবনে চোখে দেখেছে কিনা জানি না, কারণ, ডিগ্রী অর্জনের জন্য মূল পুস্তক পাঠ আবশ্যিক ছিল না, আবশ্যিক ছিল পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে প্রাঞ্জল ভাষায় ‘টু-দ্য-পয়েন্ট’ উত্তর প্রদান)। যাহোক, সদ্য উপন্যাস-নেশাগ্রস্ত সজল আরো বেশি বেশি করে উপন্যাস লেখার জন্য সুহৃদ রহমানকে অনবরত মানসিক ও শারীরিক চাপ প্রয়োগ করে আসছে। ওদিকে ওর বউ নাকি ‘স্খলন’ পড়ে হাসতে হাসতে হার্টফেল করতে বসেছিলেন- গোপাল ভাঁড়ের কৌতুক নকশাকে এ বই হার মানায়। ভাবী সাহেবার সামান্য হার্টের রোগ আছে; দমফাটানো হাসি হৃদরোগের মহৌষধ- বেশি বেশি হাসি পেতে তিনি নাকি বিশবার ‘স্খলন’ পাঠ করেছেন। এ অবশ্য সবই আমার শোনা কথা- সজলের কাছ থেকে শুনেছি।

জাহিদ- সদ্য বিদেশফেরত সুদর্শন কুমার। সে বিয়ে করতে পাগল, কিন্তু মনের মতো পাত্রী পায় না। যে-বাড়িতে একাধিক যুবতী কন্যা আছে, সেখানে পাত্রী দেখতে গেলে গণ্ডগোল বেঁধে যায়। আসল পাত্রী তো বটেই, অন্য মেয়েরাও গোপনে প্রেমপত্র চালাচালি করতে থাকে- এতসব মজা করতে করতে ওর ভালোই দিন-মাস-বছর কেটে যাচ্ছে। এমন ভাগ্য যাদের তাদের আর বিয়ের দরকার নেই। সে জীবনে দেশিবিদেশি প্রচুর লেখকের অসংখ্য বই পড়েছে; স্কুলজীবনে আমরা ওর কাছ থেকে বই নিয়ে পড়েছি। বই পড়া যেমন ওর নেশা, তেমনি সে গান গায়। ওর খালি গলায় গাওয়া গান শুনে আমরা মুগ্ধ হয়ে ভাবি, এমন রত্ন দেশে থাকতে আমাদের গানের দশা এমন কেন! কিন্তু তবলা-হারমোনিয়ম-বাদ্যযন্ত্রযোগে মাইকে ওর গান বড়োই বিশ্রী শোনায়। স্কুলে গানের প্রতিযোগিতায় সে হেঁড়ে-গলা সুহৃদ রহমানের চেয়েও কম নম্বর পেয়ে বাইশ জন প্রতিযোগীর মধ্যে বিশতম স্থান অধিকার করেছিল। আসলে জাহিদের সমস্যা হলো, বেশি মানুষের সামনে সে গান গাইতে পারে না। তবে ওর ভেতরে একটা দারুণ জিনিস আছে- তা হলো কবিতা। ও কথায় কথায় কবিতা আওড়ায়। একে তো সুদর্শন, তার ওপর মুখে ফোটে কবিতার খই, মেয়েরা ওর জন্য পাগল হয়ে যায়। সুহৃদ রহমানের ‘স্খলন’ পড়ে সে বললো, বইটি অসম্ভব ভালো হয়েছে, একশোতে একশো দিলে স্বজন-প্রীতির অভিযোগ উত্থাপিত হবার সমূহ সম্ভাবনা; তাছাড়া এটা একটা সাহিত্য- পরীক্ষার খাতায় সাহিত্যে বড়োজোর ৬৫ পার্সেন্ট নম্বর দেয়া হয়ে থাকে- Suhrid Rahman, my nearest dearest and closest ‘Blossom Friend’ has really impressed me by his ‘Skhalan’. I would like to give him a little more marks than others would do, that is, he gets ‘pure’ sixty six from me. জাহিদ ওর মেয়ে-বন্ধুদের মাঝে প্রচুর ‘স্খলন’ বিতরণ করেছে। ওর দুই ভাই ও দুই ভাবী, তিন বড়োবোন ও তিন দুলাভাই, এক ভাগ্নে, দুই ভাগ্নি, তিন ভাতিজি প্রত্যেককে সে একটি করে ‘স্খলন’ উপহার দিয়েছে। সর্বসাধারণ্যে ওর গর্ব- আমার এক বন্ধু আছে যে উপন্যাস লিখতে জানে- তার নাম সুহৃদ রহমান।

পিংকি- সে ডিভোর্সি, কিন্তু তার চেহারায় বাঙালি বিধবা নারীর চিরন্তন মলিনতা বা দুঃখের ছাপ নেই। তার হালহকিকত আর চলাফেরা, সর্বোপরি তার পোশাকআশাক দেখে তাকে যেমন বিধবা মনে হয় না, আবার তার বয়সও ঠিক ঠাওর করা যায় না। সে যৌবন ধরে রাখতে চায়। তার আট বছরের একটি মেয়ে আছে, মেয়েটি দাদি এবং নানির আদরে বড়ো হয়। সে বড্ড স্বাধীনচেতা, সেজন্য বিয়ের দু-বছরের মাথায় স্বামীর মৃত্যুর পর দ্বিতীয়বারের জন্য স্বামী নামক ‘শৃঙ্খলে’ সে নিজেকে জড়ায় নি। অবশ্য, যদ্দূর শুনেছি, খুব একটা দেখি নি, স্বামীর সাথে সে কখনো স্বামীর মতো ব্যবহার করে নি, করেছে বন্ধুর মতো। ওরা পার্কে যেত, সংসদ ভবনে যেত, বাদাম খেতে খেতে বসে বসে গল্প করতো, মনে হতো একযুগল প্রেমিকপ্রেমিকা। আমরা একত্রে আড্ডায় বসলে পিংকি আজকাল বেশির ভাগ সময় জাহিদের পাশে ওর কাঁধে হাত রেখে বসে। মাঝেমধ্যে পিঠে বা ঘাড়ে চাপড় মারে যেমন আমি বা আমার মতো ছেলেরা অন্য ছেলেদের মেরে থাকি। পিংকি খুব খেয়ালি মেয়ে। ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমরা কেউ তেমন একটা কিছু করি না। ও যদি বলে, চল করিম, সাভারে স্মৃতিসৌধ ঘুরে আসি, আমি যদি বলি আমার বউ আছে, ও তখন একটা ঝামটা দেবে এবং নিরেট একাকী সাভারের উদ্দেশ্যে বাসের হাতল ধরে ঝুলে হলেও যেতে থাকবে। তবে ওর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুটি হলো ওর বড়ো মামা, যিনি এগারো বার প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়ে আমৃত্যু চিরকুমার থাকার ব্রত নিয়ে এখন ঘুরে বেড়ান। বিভিন্ন বিষয়ে তিনি পিংকিকে নিত্য পরামর্শ ও অনুপ্রেরণা দিয়ে থাকেন। তিনি অবশ্য একজন বিশিষ্ট পাগল হিসাবে পরিবারে অশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। পিংকি খুবই ফ্যাশন দুরস্ত। সেলোয়ার কামিজ সে কদাচিৎ পরে, আমাদের স্কুলে কোনো মেয়ে কখনো শাড়ি পরে আসে নি, পিংকিকেও দেখি নি; তার সাধারণ পোশাক হলো জিনস আর টি-শার্ট। ওর এ ধরনের পোশাক জাহিদের খুব পছন্দ, পিংকিও এ পোশাকেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, কারণ এতে ওড়না পরার ঝামেলা নেই, সবাই ভাবে সুপার স্মার্ট ওয়েস্টার্ন গার্ল। পিংকি লিপস্টিক মাখে না ঠোঁটে, কিন্তু ওর ঠোঁট এতই রাঙা যে দেখলেই লিপস্টিক মাখা বলে ভ্রম হতে পারে। পিংকি সুন্দরী, এমন সুন্দরী যে স্কুলজীবনে ওর জন্য আমাদের মাথায় সারাক্ষণ চক্বর লেগে থাকত। আমাদের ঘোর এখন কেটেছে বইকি, তবে জাহিদের খবর জানি না। জাহিদ ওকে ওয়েস্টার্ন ডিটেক্টিভ পড়তে বলে। গাঁওগেরামের স্টাইলিশ মেয়ে ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ার সময় থেকেই পুরো ওয়েস্টার্ন বনে গেছে- পাশের জন্য সে ক্লাসের বই পড়তো। সে অন্য বই পড়ে না, মেয়ে-বন্ধুদের নিয়ে ছেলে-বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিত দোয়েল চত্বরে, পাবলিক লাইব্রেরিতে, টি.এস.সি-তে। মেয়ে-বন্ধু আর ছেলে-বন্ধু কথা দুটিকে সে আর মানে না- সে বলে বন্ধু বন্ধুই- স্রেফ ফ্রেন্ড। ছেলে আর মেয়েতে বিভেদ কেন? সে নর-নারীর সমান অধিকার নিয়ে বিতর্ক সভা করে, তার দল জয়লাভও করে। সে তর্কে খুব পটু। সুহৃদ রহমানের ‘স্খলন’ বের হবার পর সে ‘স্খলন-ভক্ত’ হয়ে উঠলো। তার হাতে সর্বদা একখানা ‘স্খলন’ থাকে, বসে থাকলে তার পাতা উলটায়, ঠোঁট বিড়বিড় করে পড়ে। আমি ভাবি, বাঃ, মেয়েটা দারুণ পড়ুয়া তো!

হারুন- ও বলেছিল, বিয়ের আগে বউয়ের সাথে পাক্বা দশ বছর ‘অবৈধ প্রেম’ করবো। আশ্চর্য মানুষের ভাগ্য, কলেজে পা দিয়েই সে এক ষোড়সী বালিকার প্রেমে পড়ে যায়, তা-ও সেই প্রেম মাত্র দুই মাস বারো দিন স্থায়ী হয়েছিল। প্রেমের দহনে তার জীবন সংশয় দেখা দেয়- শংকিত মা-বাবা আদুরে পুত্রের জীবন রক্ষার্থে দুজনের বিয়ে দিয়ে দেন। ওর বউ বড্ড সুন্দরী- ওরা একসাথে কলেজ করতো, আমরা ওদের কলেজ করা দেখে মর্মে মরে যেতাম। হারুনের পরিবারে একটা ‘স্খলন’ আছে, ওটি বেশির ভাগ সময়ে ওদের তিন বছরের মেয়ে টুনির হাতে থাকে- ‘স্খলন’ টুনির প্রিয় খেলনা, এর সুন্দর মলাটটা ওকে খুব আকৃষ্ট করে। টুনি অকারণে কাঁদলে, বা ওরা দুজন কর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়লে টুনিকে ব্যস্ত রাখার জন্য হাতে ‘স্খলন’ ধরিয়ে দেয়। টুনি ওটা আছাড় দেয়, লাথি মারে, মাথায় নিয়ে টুপি পরার মতো পরে, ওর মুখের লালা জড়িয়ে যায় বইটিতে; খেলতে খেলতে হাসতে হাসতে টুনির সময় চলে যায় খুব ভালোই। সুহৃদ হারুনকে আরো একটা ‘স্খলন’ দিতে চেয়েছিল। ভাবী বলেছিলেন, একটায়ই হবে, আগে তো টুনি পড়তে শিখুক।

পিয়াল - ওর জীবনের লক্ষ্য ছিল সে ইউনিভার্সিটির প্রফেসর হবে, কারণ ও ভাবে ওর জ্ঞান খুব বেশি, প্রফেসর হতে পারলে একজন বুদ্ধিজীবী হিসাবে ব্যুৎপত্তি লাভ করতে পারবে। ও এখন ব্যবসা করে। তবে ভাব-সাবে মনে হয় সে সত্যিকারেই একজন প্রফেসর- কথায় কথায় যার তার সাথে সে ‘ইংলিশ মেরে’ থাকে- ভাবখানা এই, ‘ইংলিশ’ই তার মাদার টাং, বাংলায় কথা বলতে খুব কষ্ট হয়। অবশ্য ওর অশুদ্ধ ও আঞ্চলিক ভাষায় পীড়াদায়ক ‘ইংলিশ মারা’ দেখে সজল আর কৌশিক, এমনকি জাহিদও কেবল মুখ টিপে হাসে। নারী-সঙ্গ ওর একটা ‘বিশেষ শখ’ এবং নারীদের কাছে সে নিজেকে ‘অবিবাহিত’ বলেই জাহির করে থাকে। ওর পরীর মতো ফর্সা ও রূপবতী বউটি চান না যে আমরা পিয়ালের সাথে মিশি। তাঁর ধারণা, আমরা সবাই উচ্ছন্নে গেছি, পিয়াল এ দলে ভিড়লে নির্ঘাত নষ্ট হয়ে যাবে। আমরা অবশ্য ‘চান্সে’ আছি, একদিন তাঁকে একটা উচিৎ এবং কঠিন শিক্ষা দেবই দেব। পিয়ালের বই পড়ার একটা চমৎকার পদ্ধতি আছে। যে কোনো উপন্যাস পড়ে শেষ করতে ওর দশ মিনিটের মতো সময় লাগে। প্রথম পৃষ্ঠাটা সে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ে, বইয়ের মাঝামাঝি পৃষ্ঠা থেকে কয়েক লাইন এবং শেষ পৃষ্ঠার শেষ অনুচ্ছেদ- ব্যস, পুরো গল্প সম্বন্ধে তার সম্যক ধারণা হয়ে গেল। পিয়াল বলে, বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকতে হয় নাকি, কাজকর্ম নাই? মাথায় ঘিলু থাকলে এক-দুই পৃষ্ঠা পড়েই একটা বই সম্বন্ধে সব জানা যায়। সুহৃদ রহমানের ১৪৪ পৃষ্ঠার ‘স্খলন’ হাতে নিয়ে সে বললো, এটাকে কী বলবো? ছোটোগল্প, নাকি প্রবন্ধ? আমার মেজাজ চড়ে গিয়েছিল। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ১৪৪ পৃষ্ঠার ছোটোগল্প হয় চৌদ্দ জনমে কোনোদিন শুনেছিস? পিয়াল বলে, কড়ি দিয়ে কিনলাম, সাতকাহন, চরিত্রহীন, পূর্ব-পশ্চিম- একেকটা বইয়ের পৃষ্ঠা পাঁচশো, সাতশো, এক হাজার করে, আর ‘স্খলন’ হলো কত ছোটো, মাত্র তো একশো পৃষ্ঠার সামান্য বেশি। এত ছোটো উপন্যাস হয় নাকি? আমি বললাম, ‘শেষের কবিতা’র সাইজ কত বড়ো জানিস? পিয়াল বলে, ওটা তো রবীন্দ্রনাথের লেখা। ও- রবীন্দ্রনাথ ছোটো উপন্যাস লিখতে পারবেন আর সুহৃদ রহমান তা পারবেন না, না? বলে পিয়ালকে মৃদু ভর্ৎসনা করি। যাহোক, পিয়াল বইটি ওর বাসায় নিয়ে দশ মিনিটেই শেষ করেছে, ওর বউকেও বইটি সে দেখিয়েছে। ‘ভাবীজান’ এই একটা ব্যাপারে খুব প্রসন্ন হয়েছেন। তিনি পিয়ালকে ‘খোঁচা’ মেরে বলেছেন, তোমার বন্ধুরা বই লিখে ফেলেছে আর তুমি বসে বসে কী করছো? তুমিও বই লিখতে লেগে পড়ো। দেখা হলেই পিয়াল আজকাল বলে, সুহৃদের মতো আমিও লিখবো- I will write a very big and ‘dangerous’ book- that will be five times larger than bloody Skhalan. আমি বলেছি, তা তো হতেই পারে, তোর বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠাটি লেখায় ভরা থাকবে, মাঝখানের এক পৃষ্ঠায় কয়েক লাইন, আর শেষের পৃষ্ঠায় গল্পের শেষ অনুচ্ছেদ- বাকি পৃষ্ঠা ‘ফকফকা’ সাদা। এভাবে সব্বাই এক হাজার পৃষ্ঠার বই লিখতে পারে। আমার কথায় পিয়াল দাঁত কটমট করে তাকায়।

নায়লা অতি প্রাণচঞ্চল ‘মহিলা’। সে একটা বিরাট বাড়িওয়ালা স্বামী পেয়েছে, যাঁর টাকার হিসাব নাকি তাঁর নিজেরই জানা নেই, (অবশ্য নায়লাই বলেছে, বলার সময় স্বামী-গর্বে ওর বুক স্ফীত হয়)। বাড়িটি অবশ্য নায়লার স্বামী শাহজাহন সাহেব পৈতৃক সূত্রে পেয়েছেন। তাঁর বাবা কোনো এককালে খুব গরীব ছিলেন, রেস্তরাঁয় বাবুর্চির কাজ করতেন। বাবুর্চি হিসাবে নাম করতে করতে একসময় দেখা গেল তিনি ঠিকই বাবুর্চি রয়ে গেছেন, তবে মাঝখান থেকে তাঁর একটা রেস্তরাঁও হয়ে গেছে। সেই রেস্তরাঁ একতলা থেকে বড়ো হতে হতে দোতলা, তিনতলা, বর্তমানে পাঁচতলা হয়েছে। নিচতলায় হোটেল, তৃতীয় তলায় নিজেরা থাকেন, বাকি ফ্ল্যাটগুলো ভাড়ায় চলে। ইচ্ছে করলে শাহজাহান সাহেব অনায়াসেই এটাকে চাইনিজ রেস্তরাঁ করতে পারেন, কিন্তু করেন না। তিনি বাবার মনের ইচ্ছেটা ধরে রেখেছেন। তাঁর বাবা খুব সাধারণ এবং না-শিক্ষিত লোক ছিলেন, সাধারণ মানুষের জন্য হোটেল করেছিলেন, সাধারণ মানুষকেই খাওয়াতেন, অন্য হোটেলের চেয়ে কমপক্ষে শতকরা দশ টাকা হারে কম দাম রাখতেন, যেমন শাহজাহান সাহেব নিজেও করেন এবং বাড়ি ভাড়ার ক্ষেত্রেও তা করে থাকেন। শাহজাহান সাহেব খুব আড্ডাপ্রিয় এবং আড্ডাবাজ, প্রতি সপ্তাহেই আমাদের জন্য পার্টির আয়োজন করতে চান তিনি। কিন্তু নায়লার জন্য তা পারেন না। আমার ধারণা, স্বামীর ঘরের টাকা আমাদের পেছনে খরচ করতে নায়লার বুকে খুব বাঁধে। ওর এই গর্বের একটা ধ্বস কবে দেখবো- আমরা এই প্রতীক্ষায় আছি। ওর দুরন্ত দুই ছেলের জন্য অবশ্য বাসায় গিয়ে আমরা অস্থির হয়ে পড়ি। বুকে, পিঠে, মাথায় ওদের কিলঘুষি, লাথি আর ধস্তাধস্তিতে আমাদের প্রাণান্ত হয়- ওরা মনে করে যে আমাদের শরীর লোহা দিয়ে তৈরি, এতে কোনো ব্যথা লাগে না। নায়লা খুব বই পড়ে। জাহিদের মতো সে-ও যে কোনো বই পড়ে লেখককে নম্বর দিয়ে থাকে। এ পর্যন্ত সে যতগুলো উপন্যাস পড়েছে তার মধ্যে সবচাইতে কম নম্বর পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসের জন্য। তিনি একশো নম্বরের মধ্যে শূন্য পেয়েছেন। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় ওর জনৈক গৃহশিক্ষক ওকে শেষের কবিতা পড়তে বলেছিলেন, এটা নাকি বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম উপন্যাস। সে ওটা পড়ে একবিন্দু মজা পায় নি, এবং সাথে সাথে বিরক্ত হয়ে, বরং গৃহশিক্ষকের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে সে রবীন্দ্রনাথকে এই নীরস উপন্যাস লেখার জন্য ‘শূন্য’ দিয়েছিল। তবে সর্বোচ্চ নম্বরপ্রাপ্ত লেখকও কিন্তু স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। শেষের কবিতার এত গুণগান আর নামডাক কেন, এটা নিয়ে কপোত-কপোতীদের মধ্যে এত হৈচৈ কেন- এই রহস্য উদ্ধার করতে গিয়ে সে কম করে হলেও তের বার শেষের কবিতা পড়েছে। শেষ পর্যন্ত সে বলেছে, শেষের কবিতার মতো বই-ই হয় না। আহা, বেচারা বেঁচে নেই, থাকলে তাঁকে একশোতে পুরো একশো সাথে আরো একশো বোনাসসহ মোট দুইশো নম্বর প্রাপ্তির একটা অভিন্দনপত্র সে রবীন্দ্রনাথকে পাঠাতো। গৃহশিক্ষক তাকে যে মিথ্যা বলেন নি কেবল এজন্যই সে তাঁর প্রেমে পড়ে যায় এবং গভীর ভাবে একটি চুম্বন উপহার দিয়ে তাঁকে বিয়ে করে; এখন সে দু-সন্তানের জননী হয়েছে। ও আজকাল এতই বই পড়ে যে মাঝে মাঝে স্বামীর চেয়ে বই ওর কাছে বেশি প্রিয় মনে হয়। সুহৃদ রহমান নায়লার কাছে দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ লেখক- প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে রবীন্দ্রনাথের পরেই তার অবস্থান। নায়লা তাকে একশোতে আশি নম্বর দিয়েছে, যদিও কোনো বোনাস দেয়া হয় নি। সে বলেছে, পরবর্তী বইয়ে তাকে অবশ্যই বোনাস দেয়া হবে, সুহৃদ যেন এ ব্যাপারে বেশি চিন্তা না করে। যে গৃহশিক্ষকের কথায় নায়লা একদিন বই পড়তে শুরু করেছিল, সেই শাহজাহান সাহেব কিন্তু এখন বই পড়েন না। এজন্য তাঁকে খুব একটা দোষও দেয়া যায় না, কারণ, তাঁর পড়ার সময় এখন খুব একটা নেই, অপর দিকে তিনি একজন হাই ব্লাড প্রেসারের রোগী, সর্বদা মাথা ও ঘাড়ের ব্যথায় অস্থির থাকেন, বই পড়তে গেলে সেই ব্যথা হুহু করে বাড়তে থাকে, চোখে নানা বর্ণের সর্ষে ফুল দেখেন। কিন্তু তিনি একটা দারুণ কাজ করেছেন। তাঁর হোটেলের প্রবেশ দ্বারে এবং ক্যাশবক্সের পেছনের দেয়ালে স্খলনের কভার পৃষ্ঠাগুলো সুন্দর করে আঠা দিয়ে লাগিয়ে রেখেছেন, তার নিচেই একটি বুকশেল্‌ফ, সেখানে তিনটি বই ডিসপ্লে করা আছে। খদ্দেরগণের কাছ থেকে বিল গ্রহণের ফাঁকে ম্যানেজার সাহেব গর্বের সাথে প্রায়ই বলে থাকেন- এই যে বইটি দেখতে পাচ্ছেন, এটা একজন বিখ্যাত লেখকের বই, যিনি আমার মালিকের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু- তাঁর সাথে মাঝে মাঝেই আমার দেখা হয়- তিনি আমাকে এক নামে চেনেন- এই বাসায় প্রায়ই আসেন তো!
এই চারদিকের আওতায় আরো যারা পড়েন তাঁরা হলেন আমাদের কয়েকজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক, শিক্ষকপত্নী, যেমন- সফিকুল ইসলাম স্যার, মাবুদ স্যার, প্রমুখ। সফিক স্যার বই হাতে পেয়ে খুব তারিফ করেছেন- ভালো, খুব ভালো- তোমরা যদি বই না লেখো তবে কারা লেখবে? তোমরাই তো আগামী দিনের নজরুল-রবীন্দ্রনাথ। সফিক স্যার ব্যস্ত মানুষ, সারাদিন অংক আর রাসায়নিক সমীকরণ নিয়ে গবেষণায় মগ্ন থাকেন, ‘স্খলন’ পড়ার সময় তাঁর নেই। তবে সফিক স্যারের বউ নাকি এই এক ‘স্খলন’ এক সপ্তাহে তিনবার পড়েছেন। বই পড়তে পড়তে তিনি আপন মনে হেসে ওঠেন, আবার আপন মনেই কাঁদতে থাকেন। যুগপৎ হাসি-কান্নার উপাদানে ভরপুর এমন বই নাকি ‘বাজারে’ খুবই বিরল।
সুহৃদের বই নিয়ে হৈচৈ করা ছিল কত স্বাভাবিক, কিন্তু একবারও মুখ খোলে নি- আমাদের এমন অন্তরঙ্গ বন্ধুও কিন্তু আছে। সে-কথা যথাসময়ে হবে। সময় হলে বা সুযোগ এলে আমার কথাটিও বলা যাবে।
হৈচৈ-এ মত্ত ‘চারদিকের’ আওতায় অবধারিতভাবে যাঁদের নাম উচ্চারিত হয় তাঁরা হলেন কনক ইসলাম, আরেক নব্য কবি ইমন মজুমদার, শহীদ খোনকার এবং বিনয়ী ও মুচকি হাসির স্বত্বাধিকারী, ‘চাষী’ কবিতাপত্র খ্যাত কবি-সম্পাদক প্রদীপ মিত্র।

----

'খ্যাতির লাগিয়া' উপন্যাসের প্রথম থেকে কিছু অংশ। প্রকাশকালঃ একুশে বইমেলা ২০০৪

খ্যাতির লাগিয়া উপন্যাসের পিডিএফ কপি এখানে ক্লিক করে ডাউনলোড করা যাবে


মন্তব্য ১০ টি রেটিং +৭/-০

মন্তব্য (১০) মন্তব্য লিখুন

১| ০৩ রা এপ্রিল, ২০১৮ রাত ৯:৫১

শায়মা বলেছেন: এই লেখাটা মনে হচ্ছে আগেও লিখেছিলে ভাইয়া। আমার প্রিয় লিস্টেও ছিলো কোনো এক নিকের ! :)

০৪ ঠা এপ্রিল, ২০১৮ সকাল ৯:৪৮

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: হ্যাঁ, এটা আগেই লিখেছিলাম :) কোনো এক নিকের প্রিয় লিস্টে রাখার জন্য ধন্যবাদ +++

২| ০৩ রা এপ্রিল, ২০১৮ রাত ১০:০৯

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: ফাটাফাটি লেখা :)

অসাধারন ! লেখক পাঠক বিশ্লেষনে একেবারে মাইক্রোস্কোপিক নজর দিয়েছেন দেখছি ;)
ভাল লাগল

+++

০৪ ঠা এপ্রিল, ২০১৮ সকাল ৯:৫১

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: ফাটাফাটি পর্যবেক্ষণ :) ধন্যবাদ বিদ্রোহী ভৃগু।

৩| ০৩ রা এপ্রিল, ২০১৮ রাত ১০:৫২

নাঈম জাহাঙ্গীর নয়ন বলেছেন: সুহৃদকে নিয়ে যে হাসি ঠাট্টা করা হয়েছে তাতে মনে হল লেখা লেখি করা ভালো, তবে ভালো না লিখতে পারলে নিজেকে হাসির খোরাক বানানো।
ভালোই লাগলো পিংকি হারুনদের নিয়ে হাসির স্মৃতিচারণা।

০৪ ঠা এপ্রিল, ২০১৮ সকাল ৯:৫৪

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: একটা বই একেকজনের কাছে একেক রকম মনে হতে পারে। কারো কাছে উচ্চাঙ্গীয়, কারো কাছে হালকা। উপন্যাসের এই অংশে সেই জিনিসটা উঠে এসেছে।

এটা আসলে ঠিক স্মৃতিচারণ না, তবে অভিজ্ঞতার কিছু ছায়া আছে এতে।

ধন্যবাদ নাঈম জাহাঙ্গীর ভাই। অনেকদিন পর দেখলাম।

৪| ০৪ ঠা এপ্রিল, ২০১৮ সকাল ১০:০২

নাঈম জাহাঙ্গীর নয়ন বলেছেন: হ্যা ভাই, অনেকদিন পরই, এখনকার কর্মস্থল অনেকটা ব্যস্ততম। তাই আগের মতো ব্লগে থাকতে পারিনা। মাঝেমধ্যে এসে ঘুরে যাই, সামনে যা পাই একদুটি পোষ্ট পড়ে যাই, কখনওবা মন্তব্য রাখার সময়ও হয় না।

দোআ রাখবেন ভাই,
শুভকামনা আপনার জন্য সবসময়।

০৭ ই এপ্রিল, ২০১৮ সকাল ১১:৩০

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: দোয়া থাকলো নাঈম জাহাঙ্গীর ভাই। ভালো থাকবেন।

৫| ০৭ ই এপ্রিল, ২০১৮ সকাল ১১:৩৭

মনিরুল ইসলাম বাবু বলেছেন: চমৎকার লেখা।

০৭ ই এপ্রিল, ২০১৮ সকাল ১১:৫৭

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: ধন্যবাদ মনিরুল ইসলাম বাবু।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.