নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শব্দকবিতা : শব্দেই দৃশ্য, শব্দেই অনুভূতি [email protected]

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই

দুঃখের কবিতাই শ্রেষ্ঠ কবিতা। ভালোবাসা হলো দুঃখ, এক ঘরে কবিতা ও নারী।

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই › বিস্তারিত পোস্টঃ

ঋতুর জন্য ভালোবাসা

২২ শে আগস্ট, ২০১৮ রাত ৯:২৫

জাতীয় জাদুঘরের মিলনায়তনে কবিতাসন্ধ্যা ছিল। ঋতুর এক বান্ধবীর তাতে একটা আবৃত্তি ছিল। বান্ধবীর কারণে ঋতুর সেখানে যাওয়া এবং ঋতুর যাওয়ার খবর পেয়ে আমিও গিয়েছিলাম, তবে কবিতা আবৃত্তি শুনতে নয়, ঋতুর সাথে একটু দেখা হয় এই আশায়। যথারীতি সঙ্গে সুহৃদ।
প্রথম সারিতে বিখ্যাত ব্যক্তিরা, পরের সারিতে ঋতু এবং ওর বান্ধবীরা। আমার অনেক ইচ্ছে হয়েছিল আমি ঠিক ওর পাশটাতে বসি, অথবা পেছনের যেই সারিটাতে আমি আর সুহৃদ বসেছি, ঋতু এসে একান্তে আমার নির্জন পাশে গা ঘেঁষে বসে আমার হাতে হাত রাখুক- ইচ্ছে হয়েছিল। আমি সারাক্ষণ ওর দিকে তাকিয়েছিলাম, ঋতু বার কয়েক পেছন ফিরে আমাদের দেখেছে, হেসেছে, আমি ইশারায় আসতে বলেছি, ঋতু মুখ ফুটে কিছু বলে নি, তবে আমি বুঝেছি বান্ধবীদের ছেড়ে সে আসতে পারে না।
অনুষ্ঠান শেষ হলে আমরা গেইটের বাইরে গিয়ে ফোঁচকা খেতে বসি। আমি, সুহৃদ এবং ঋতু। ঋতু ওর বান্ধবীর সাথে চলে যেতে চেয়েছিল, পরে ‘চুক্তি’ হয় একেবারে ‘নিরুপদ্রবে’ তাকে বাসায় পৌঁছে দিতে হবে। এক টেবিলে আমরা তিনজন ফোঁচকা খেতে থাকি।
ঋতুর সাথে সেটা সুহৃদের দ্বিতীয় সাক্ষাৎ ছিল। ও এমনিতেই বড়ো মুখচোরা, ঋতুর মতো অপরিচিতা ও রূপবতী মেয়ের সামনে ওর জড়তা কিছুতেই কাটছিল না। অথচ, আমি বুঝতে পারছিলাম, ঋতু চাইছিল সুহৃদ যেন অনর্গল প্রাণোচ্ছলভাবে ওর সাথে কথা বলে, যদিও আমি তা চাইছিলাম না, কারণ, সুহৃদ আমার প্রতিদ্বন্দ্বী। ওর কথায় ঋতু আকৃষ্ট হোক তা আমি ভাবতে পারি না।
সুহৃদকে উদ্দেশ্য করে ঋতু ছোটোখাটো রসিকতার কথা বলছিল।
তোমার বন্ধুটা কি বোবা? ঋতু আমাকে জিজ্ঞাসা করে।
বোবা হবে কেন? ও একটা বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী, পণ্ডিত ব্যক্তি। পণ্ডিত ব্যক্তিরা সবার সাথে কথা বলে না। আমি বলি।
ঋতু ফিক করে হেসে দেয়। ফোঁচকা মুখে দিতে দিতে সুহৃদও হাসতে থাকে।
আমি ঋতুকে বলি, তুই জানিস ওর ভেতরে কী জিনিস আছে?
কী জিনিস আছে?
আমার বোধোদয় হয়, আমি এ কী করছি? আমার প্রতিদ্বন্দ্বীকে আমার ঈপ্সিতার কাছে এত বড়ো করছি কেন? আমি চুপ মেরে যাই। প্রসঙ্গ পালটাবার জন্য অন্য কথা ধরি।
ফোঁচকাটা দারুণ, তাই না? ঋতুকে লক্ষ করে আমি বলি।
কিন্তু সুহৃদকে লক্ষ করে ঋতু বলে, বলুন তো আপনার মধ্যে কী জিনিস আছে?
সুহৃদ হেসে বলে, জানি না তো। যে বলেছে তাকেই জিজ্ঞাসা করুন।
আমি হাসতে হাসতে বলি, ওর মধ্যে একটা দারুণ জিনিস আছে, যা আমার মধ্যে নেই ... ওর গাম্ভীর্য্য আছে।
মুচকি একটু হাসি ছড়িয়ে দেয় ঋতু। তারপর সে ফস করে বলে বসে, আচ্ছা ভাইয়া, আমি ভুলে গেছি, গাম্ভীর্য্য অর্থটা যেন কী?
‘গামলা ভর্তি ...’
সঙ্গে সঙ্গে ... ঠাস ... ।
আমার শেষ শব্দটার উচ্চারণ শেষ হতে না হতেই ঋতুর হাতের কঠিন একটা চড় এসে আমার গালে লাগে। তারপর উঠে হন হন করে সে-স্থান ছেড়ে একাই ঋতু বাসায় চলে গিয়েছিল।
ওর নরম হাতের চড়টা ছিল প্রচণ্ড শক্ত ও চর্মভেদী। গালে যতটুকু চোট লেগেছিল, আমার অন্তরে লেগেছিল তার চেয়ে অনেক বেশি, ঋতুর চড় খাওয়ার জন্য নয়, ‘সাধ না মিটিতেই’ সে চলে গিয়েছিল বলে।
আমি ভেবেছিলাম ঋতু জীবনে আমার সাথে আর কথা বলবে না। সেই ভয়েই ওদের বাড়িতে যাওয়া বন্ধ থাকে প্রায় তিন মাসের মতো। বাসায় যাওয়ার জন্য খালা খবর পাঠান, আমি যাই না। একবার- দু’বার- বহুবার। আমার ভয়, ও-বাড়িতে গেলেই ঋতু আমার ওপর চড়াও হয়ে বলবে, তুমি এতখানি অশ্লীল হতে পারলে কী করে? একটা অপরিচিত মানুষের সামনে আমাকে এমন লজ্জা দেয়ার স্পর্ধা তোমার কীভাবে হলো?
আমি এখনো বুঝি না ঋতু আমাকে ভালোবাসে কিনা। আমার প্রতি ওর কোনোরূপ আবেগ লক্ষ করি নি কোনোদিন। মাথায় উকুন আছে কিনা বা খুশকি লেগেছে কিনা, এই অজুহাতে ওর চুল ছুঁতে গেলেই ও এক লাফে দূরে সরে গেছে। ও যখন পড়তে বসতো, একেবারে খাঁটি মন নিয়ে ওর পড়ার খোঁজ নেয়ার জন্য ওর পড়ার ঘরে ঢুকতাম। ঘরে যদি ও একা থাকত, একেবারে অহেতুক অছিলায় সে আমার সামনে থেকে দ্রুত বের হয়ে যেত। একবার ওর দাঁতে ব্যথা, এমন সময় আমি গিয়ে হাজির, খালা বললেন, করিম, তাড়াতাড়ি ওকে নিয়ে দাঁতের ডাক্তারের কাছে যা। ঋতুর সাথে এক রিক্সায় পাশাপাশি বসে যাব, এই আশায় আমার সুখ আর ধরে না। কিন্তু ঋতু বললো, ব্যথা সেরে গেছে। এর ঘন্টা দুয়েক পর ওর প্রাইভেট টিউটর বাসায় এলো, ঋতু তাকে সঙ্গে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেল। আমি তো কোনোদিন ঋতুর জন্য কোনো ভয়ের কারণ হই নি- ওর বুকে হাত দিতে উদ্যত হই নি, তবু ওর এত ভয় কেন ছিল? ও আমার খালাত বোন, ছোটোবেলায় আমাদের বাড়িতে বেড়াতে গেলে ও সারাক্ষণ আমার পিছে পিছে ঘুরতো। গাছ থেকে বরই পেড়ে দেয়া, পেয়ারা পেড়ে দেয়া, দোলনা বানিয়ে দেয়া সবই আমি করে দিতাম, আমাকে দিয়েই সে এসব করাতো। শীতের রাতে আমার গলা ধরে সে ঘুমাতো, ঘুমের মধ্যে কাঁথা সরে গিয়ে শীতল হয়ে পড়লে ঘুমের ঘোরেই সে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকের মাঝখান থেকে সবটুকু ওম সে কেড়ে নিত। আস্তে আস্তে বড়ো হতে থাকি, আমাদের মধ্যে ভাবও তত গাঢ়তর হয়, মা-খালারা বলাবলি করেন, করিম আর ঋতুর বিয়েটা দারুণ হয়- নানিজান বলেছিলেন, তাই হবে। আমি বড়ো হই, বড়ো হয় ঋতু। ঋতুর জন্য আমার মনে কত ভাবনা জাগে। ঋতুর জাগে কিনা কিছুই বুঝি না। একবার ওর জন্য কিছু অন্তর্বাস কিনে এনে গোপনে ওর বালিশের নিচে রেখে দিয়েছিলাম। ও সুন্দর করে কাগজে মুড়িয়ে ওগুলো আমাকে ফেরত দিয়ে বলেছিল, আমার জন্য আর কক্ষনো এগুলো আনবে না।
ঋতু আমাকে খুব উপেক্ষা করতো। প্রথম দিকে আমি ভাবতাম, সতী-সাধ্বী বালিকা, বিয়ের আগে হবু স্বামী দ্বারা দংশিত হবার আশংকায়ই হয়ত আমার সংস্পর্শ সে সাবধানে এড়িয়ে চলে।
ঋতু আমাকে যেদিন বললো, বিয়ের পর বউকে কী খাওয়াবে, সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম ঋতু আমাকেই মনেপ্রাণে স্বামী হিসাবে চায়, আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু আমার ভবিষ্যত অনিশ্চিত হওয়ায় আমার স্বামীত্ব গ্রহণে সে বিষম দ্বিধাগ্রস্ত। আমি আমার অবস্থা উপলব্ধি করি; আমি এক লাফাঙ্গা, ভবঘুরে, অপরিণামদর্শী, জোর করে বা পারিবারিক সমঝোতায় হয়ত ওর সাথে আমার বিয়েটা হলেও হয়ে যেতে পারে। কিন্তু এ আগুনকে আমি শান্তও রাখতে পারবো না, শান্তিও দিতে পারবো না। আমার মতো অভাগার ঘরে ও সারাজীবন জ্বলেপুড়ে অঙ্গার হোক, আমি যদি ওর প্রকৃত শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে থাকি তবে তা হতে দেয়া যায় না। খিদের কষ্টে ভালোবাসা পালায়- ‘পূর্ণিমার চাঁদ’ হয় ‘ঝলসানো রুটি’, আর অভাগা পুরুষের শরীরটাকে মনে হয় বুকের ওপর হাজারমণী পাথর, সেই পাথর শ্বাসরুদ্ধ করে, গলা চেপে রাখে, দম আটকে হত্যা করে।
ঋতুকে পাবার আশা আমি ছেড়েই দিয়েছিলাম। আমার ভবিষ্যত ভাবনায় কারো দিবানিশি উদ্বিগ্ন থাকার প্রয়োজন নেই- আমি আমার মতোই থাকবো, বাঁচবো আমার মতো করে। ঋতুকে বলেছিলাম, ‘যাবি যদি যা’, আমি কাউকে ধরে রাখি নি, ‘পিঞ্জর খুলে দিয়েছি’।
ঋতু টিটকিরি করে বলেছিল, আহ্‌হারে ...
এরপর বছর দুই চলে যায়, একবারের জন্যও খালার বাসায় যাওয়া হয় না। কেন যাব? ঋতুর জন্য? ঋতুকে আমি বলে দিয়েছি, ‘যা কিছু বলার ছিল বলে দিয়েছি’। সে তার ভবিষ্যত স্থির বুঝে নিয়েছে। যদি তা নাইবা হতো, সে কি অন্তত একটি বারের জন্য হলেও আমাদের ‘নোংরা’ মেসটিতে আসতে পারতো না? কেন সে আসে নি? সে কি সত্যি আমাকে ভুলে গেছে?
হঠাৎ একদিন ঋতু আমাকে খবর পাঠিয়েছিল, আমি যেন গিয়ে দেখা করে আসি। ঋতুর খবরটি আমাকে ওর কাছে চুম্বকের মতো টেনে নিয়ে যায়। আমার ভেতরের সকল মান-অভিমান কোথায় মিলিয়ে গিয়েছিল, সব ভুলে আমি ঋতুর জন্য ছুটে ছিয়েছিলাম, যেতে যেতে ঠিক হাঁপিয়ে উঠেছিলাম।
আমাকে ওর ঘরে ডেকে নিয়ে খুব আদর করে বসায়। আমি নতুন করে আমার জীবনকে উপলব্ধি করি, নতুন করে জীবন সাজানোর প্রতিজ্ঞা করি। আমি স্থির করি, ঋতুকে আজ বলবো, আমি আজ আমার কথা ফিরিয়ে নিচ্ছি। তোকে আমি মন থেকে মুক্তি দেই নি। ওটি আমার ভান ছিল। তোকে ছাড়া আমি আর কিছুই ভাবতে পারি না। আমি তোকে বিয়ে করবো, আগামী এক বছরের মধ্যেই।
আমি বলি, ঋতু একটা কথা আছে। বলতে বলতে ওর দিকে এগিয়ে যাই। ও পিছু হটতে থাকে। একদম ওর শরীর ঘেঁষে দাঁড়াই। আমার শ্বাস ঘন হয়ে আসে।
কী করছো? ছিঃ, আমি চিৎকার দেব কিন্তু। ভয়ার্ত স্বরে ঋতু বলতে থাকে।
আমি দু-হাতে ওর দু-বাহু শক্ত করে ধরি, মুখের কাছে মুখ এগিয়ে নেই। ও বুকের ওপর দু-হাত বেঁধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে, আমি আরো গাঢ় করে ওকে জড়িয়ে ধরতেই চাপা স্বরে চিৎকার দিয়ে ওঠে, আমাকে তুমি নষ্ট করবে? ছিঃ ... ছাড়ো আমাকে ... মা ... মা ...।

ঋতুর কণ্ঠস্বরে আমার স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল। ওর কথা শুনি নি, কথার শব্দ শুনেই সামনের দিকে তাকিয়ে দেখি চেয়ারের হাতলে বসে আমার দিকে তাকিয়ে সে মিটিমিটি হাসছে।
এমন বিড়বিড় করছিলে কেন? ঋতু জিজ্ঞাসা করে।
ঘুম পেয়েছিল। খুব টায়ার্ড লাগছে রে। বলেই আমি আড়মোড়া দিই।
আমার উচ্ছ্বসিত আশায় ভাটা পড়ে যায়। আমি ভেবেছিলাম, কত দীর্ঘদিন সে আমাকে দেখে নি, আমার জন্য সে কত প্রতীক্ষায় ছিল, কেঁদে কেঁদে কত নিশি সে বিনিদ্র কাটিয়েছে, বিরহ-বেদনায় দুঃখী-ম্লান তার চেহারা, আমাকে দেখে সে পাগলের মতো ছুটে এসে বুকে ঝাঁপিয়ে পড়বে- বলবে, আমাকে না দেখে তুমি কীভাবে এতদিন দূরে থাকতে পারলে? তোমার কি পাষাণ মন? আমাকে দেখতে তোমার এতটুকু সাধ হয় নি?
ঋতুর সুখী সুখী চেহারা, সে মিটিমিটি হাসছে। আমার অন্তরে কষ্ট তোলপাড় করে।
গোলাপি রঙের একটা শাড়ি পরেছে ঋতু। শাড়ি তাকে খুব একটা পরতে দেখি নি, পরেছে আজ, দারুণ মানিয়েছে। একটি পা মাটিতে ভর করে আরেক পা সে দোলাচ্ছে। এর আগে আমার এত কাছে কখনো সে আসে নি; আমি ওর শোবার খাটে, হাত বাড়ালেই ওর হাঁটুতে ‘অনধিকার’ হাতটি রাখতে পারি।
আমি বুঝতে পারি না, আবার বুঝিও কিছুটা কেন সে আমাকে ডেকেছে। একি তার আত্মসমর্পণের পূর্বাভাস!
এটা কি তোমার শাড়ি? আমি জিজ্ঞাসা করতেই ঋতু খিলখিল করে হেসে ওঠে গলে পড়ে যায়।
বলি, এত হাসির কী হলো?
ঋতু হাসতে হাসতেই বলে, হঠাৎ ‘তুমি’ করে সম্বোধন করছো যে?
তুমি এখন বড়ো হয়েছ না? আমি বলি।
ঋতু আরো জোরে হাসে। বলে, বড়ো হওয়ার সাথে সাথে সম্বোধন পালটে যায় তা জীবনে প্রথম শুনলাম।
কিন্তু আমি অনেক আগেই দেখেছি। একদম ছোটোবেলায় যখন কথা বলতে শুরু করেছিলে তখন আমার সাথে তুই তুই করে কথা বলতে। তারপর আপনি করে চললো দীর্ঘ সময়। আমাকে তুমি করে বলছো বছর তিনেকও হয় নি।
ঋতু কথা বলে না, কিন্তু ফুঁসফাঁস করে হাসতে থাকে। ও এমন করে হাসছে কেন?
ঋতু জিজ্ঞাসা করে, এতদিন কেন আসো নি?
আমি বলি, তোমাকে আজ ভীষণ সুন্দর লাগছে। কার শাড়ি, খালার?
ঋতু বলে, তুমি এখন কী করো, বলো তো? তোমার কাজ কারবার কিছু ধরতে পারি না। পড়াশোনা কি আছে, না নেই?
আমি বলি, তোমার পরীক্ষা কবে শুরু?
ঋতু ক্ষেপে যায়, বলে, খালি কথা এড়াও কেন? যা জিজ্ঞাসা করি তার সাফ সাফ জবাব দাও।
আমিও একটু কঠিন স্বরে বলি, আগে তো কোনোদিন জিজ্ঞাসা করো নি আমি কী করি, কী খাই, কোথায় যাই, কোথায় থাকি, কার সাথে মিশি। হঠাৎ আজ জানতে চাচ্ছ কেন?
আমার প্রয়োজন আছে তাই জানতে চাচ্ছি। ঋতু বলে।
আমার সম্পর্কে কারো এত না ভাবলেও চলবে। কে আমি? আমি কে? আমার ভালোমন্দে কারো কিছু যায় আসে না।
কিন্তু আমার যায় আসে। বলে ঋতু ক্রুদ্ধ চোখে আমার দিকে তাকায়। তাকিয়ে থাকে। ধীরে ধীরে চোখ নেমে আসে, সে মাটির দিকে তাকায়। বলে, তুমি ভেবো না যে, তোমাকে বিয়ে করার জন্য আমি পাগল হয়ে গেছি। আমি জানি আমাকে বিয়ে করে তুমি নিজেও সুখে থাকতে পারবে না, আমাকেও শান্তিতে রাখতে পারবে না, তারপরও তোমার চিন্তায় আমি সারাক্ষণ অস্থির থাকি, তোমার কী হবে! এখন বুঝতে পারছি, তুমি দূরে থেকেও আমাকে শান্তি দেবে না- তোমার জন্য না হোক, অন্তত আমার কথাটি ভেবে হলেও তুমি একটু তোমার নিজের দিকে নজর দাও। তুমি কি চাও তোমার জন্য আমার অন্তর পুড়ে খাক হোক সারাটা জীবন?
ঋতুর গলা ধরে আসে। আমি শরীর ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ি। চলে যেতে হবে। ঋতু চেয়ার থেকে নেমে সামনে এসে দাঁড়ায়। আমার বুকের কাছাকাছি এসে ঘন হয়ে দাঁড়ায়। ডান হাতে আমার বোতাম নাড়ে। আমি ওর শরীরের ঘ্রাণ পাই, অদ্ভুত সুঘ্রাণে আমি মাতাল হয়ে ওঠি।
আমার শ্বাস ঘন হয়ে আসে, অতি দ্রুত হৃদ্‌স্পন্দন হয়। মাথা নিচু করে ঋতু অনবরত আমার বোতাম নেড়ে যাচ্ছে। আমি ওকে পেয়েছি, আমার অন্তরে আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই- আমি ঋতুর মন পেয়েছি; যদি চাই, আমি নিশ্চিত, ওর এই লতানো সুন্দর শরীরটাকেও আমি পেতে পারি। আমি জানি, আমার ঘরে সে বউ হয়ে আসবে না, ওর শরীরে একটি ‘ফুল’ কিংবা ‘কলংক’ এঁকে দিই, প্রথম ভালোবাসার চিহ্ন, কোনো এক এমন অবসরে ও ভাববে, একদিন আমি অন্য কারো ছিলাম।
আমার কণ্ঠস্বর আর্দ্র হয়ে আসে, জড়ানো স্বরে বলি, শুধু চুমো নয়, তোকে আজ সবটুকু চাই।
ঋতুর চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। বলে, শুধু কি আমার শরীরটাই তুমি চাও? মনটা চাও না? এই শরীরটা কি শুধু আমারই শরীর? তোমারও না? তোমার জিনিস তুমি নষ্ট করে কতখানি আনন্দ পাবে? নাও, যতখানি পারো ... নাও। বলে সে আগুন চোখে তাকায়, সেই আগুনে অনেক আকুলতা, অনেক কাতরতা, অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে।
আমি পারি নি। মহাপুরুষ হওয়ার আশ্চর্য সংযম নেমে আসে আমার মধ্যে। আমি ঋতুর মন পেতে চেয়েছিলাম, মন পেয়েছিলাম। একদিনের নেশায় আমি সারাজীবনের জন্য ওর বুকের কাঁটা হয়ে থাকতে চাই নি, একটা স্থায়ী বসবাস চেয়েছি ওর মনের গভীর গহন অরণ্যে।

---

'খ্যাতির লাগিয়া' উপন্যাস থেকে (একুশে বইমেলা ২০০৪)

'খ্যাতির লাগিয়া' ডাউনলোড করতে চাইলে নীচের লিংকে ক্লিক করুন।

'খ্যাতির লাগিয়া'র ডাউনলোড লিংক

উপরের লিংকটি কাজ না করলে নীচের লিংকটিও দেখতে পারেন।

এখান থেকে 'খ্যাতির লাগিয়া' ডাউনলোড করুন।


উৎসর্গঃ আপনি

মন্তব্য ১৬ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (১৬) মন্তব্য লিখুন

১| ২২ শে আগস্ট, ২০১৮ রাত ৯:৩৮

শাহারিয়ার ইমন বলেছেন: অনেক বড় পোষ্ট ,সময় নিয়ে পড়তে হবে

২২ শে আগস্ট, ২০১৮ রাত ১০:৫১

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: আচ্ছা ঠিক আছে। আপনার মতামতের আশায় থাকলাম।

ধন্যবাদ। ইদ মোবারক।

২| ২২ শে আগস্ট, ২০১৮ রাত ৯:৫৭

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: শেষটায় দারুন করে মহাপুরুষ হয়ে গেলেন যে বড়! ;)
হা হা হা

ভাল লাগল।
আসলেই সত্যিকারের ভালবাসা মহাপুরুষ বানিয়ে দেয় বটে।
মন পাবার আনন্দ যে কত অমূল্য যে মন পেয়েছ সেই জানে।
শরীরের আনন্দন তো ক্ষনিকের, বিবেক জেগে গেলেই যাতনা
আর মনের আনন্দ অনন্ত!

:)

ঈদ মোবারক

২২ শে আগস্ট, ২০১৮ রাত ১১:০৩

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: হাহাহাহাহা। তাইতো! শেষটায় দারুণ মহাপুরুষ বনে গেলাম! কিন্তু ঐ আমিটা এই আমি নই, উনি গল্পের নায়ক বটেন :)

কমেন্টে একটা অসাধারণ কথা বলে ফেলেছেন। কথাটা হুটহাট কীভাবে বলে ফেললেন জানি না, কিন্তু এটা অনেক অভিজ্ঞতায় পরিপক্ব না থাকলে কেউ বলতে পারবে না। কথাটি- মন পাবার আনন্দ যে কত অমূল্য যে মন পেয়েছ সেই জানে। একজন প্রেমিক, কৈশোর, তারুণ্য, যৌবনে এসেও প্রেমিকার মন পাবার আশায় নিরন্তর ছুটে চলছে, তার যৌবন হারিয়ে যাবে, প্রেমিকা অন্যের ঘরে বুড়িয়ে যাবে, তবু সেই বুড়ির মন পাবার জন্য তার মন কেবলই জ্বলতে থাকবে। 'কাঁদতে কাঁদতে জনম রে গেলো বন্ধু না দিলা সাড়া।' মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সে প্রেমিকার জন্য হাহাকার করতে থাকবে, হায়, যদি সে ফিরে তাকাতো!! ঠিক অমন সময়ে একদিন প্রেমিকা এসে তার হাত ধরলে, গা ঘেষে পাশে দাঁড়ালে, কাঁধে হাত রাখলে প্রেমিকের অবস্থা কেমন হবে, তা শুধু দাগী প্রেমিকরাই বুঝবে।

বাকি কথাগুলোও দারুণ।

আমার এ উপন্যাসটা একটা ভিন্নতর স্টাইলে লেখা হয়েছে। পুরোটা পড়লে এবং মনোযোগ দিয়ে পড়লেই শুধু ঐ স্টাইলটা ধরা যাবে।

ভালো লাগলো বিদ্রোহী আপনার উপস্থিতি।

ভালো থাকবেন। ইদ মোবারক।

৩| ২২ শে আগস্ট, ২০১৮ রাত ১০:০২

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: উপন্যাস থেকে নেয়া?
রীতিমত ছোটগল্প একটা। কখনোই মনে হয়নি, এটা উপন্যাসের একটা অংশ। ছোটগল্প হিসেবে চাকিয়ে দেয়া যায়, এবং তা হবে সার্থক।
অসাধারণ লেখনী।
২০০৪ সালে বই প্রকাশ করেছেন, ভাবা যায়! ভাল মন্দ বলব, তারও উপায় নেই!

২২ শে আগস্ট, ২০১৮ রাত ১০:৪০

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: আমার তো মনে হয়, জীবন যেমন ঘটনার সমষ্টি, একটা উপন্যাসও অনেকগুলো পরস্পর সম্পর্কযুক্ত গল্পের সমষ্টি। এজন্য যে-কোনো উপন্যাস থেকেই একটা ঘটনা বা গল্পকে আলাদা একটা গল্প হিসাবে বিবেচনা করা যায়।

উপন্যাসের এই অংশটার আগে দুই ফর্মা শেষ হয়ে গেছে এবং এর পরে আরো ৩ ফর্মার চেয়ে বেশি লেখা অবশিষ্ট আছে। গল্পের এই অংশটুকু আপাত সম্পূর্ণ মনে হলেও প্রথম দুই ফর্মা আগে পড়া থাকলে বোঝা যেত, ঘটনা সামনে অপেক্ষমান।

২০০৪ সালের বই। রবীন্দ্রনাথ ১০০/১৫০ বছর আগে লিখে গেছেন। ওগুলোর সমালোচনা তো কম হচ্ছে না। তিনি জীবিত অবস্থায় সবচেয়ে বেশি খোঁচা খেয়েছেন। -- সোনাবীজ একটা তেলাপোকা। মন্দ বলার জন্য সর্বদাই উন্মুক্ত।

আপনার কমেন্ট ভালো লাগে। বিশেষ কিছু পয়েন্টে আপনার চোখ যাওয়াটাই আপনার বিশেষত।

ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন। ইদ মোবারক।

৪| ২২ শে আগস্ট, ২০১৮ রাত ১০:০৪

পদাতিক চৌধুরি বলেছেন: বাহা! সুন্দর লিখলেন। উপন্যাসের একটি পর্ব হলেও গল্পটি বেশ পরিিপূর্ণ লাগলো । আপনার উপন্যাসে ঘুরে এলাম। ডাউনলোড করলাম, চেহারাটা বেশ বড়। পরে সময় নিয়ে পড়ে আসবো। ++++

শুভকামনা শ্রদ্ধেয় খলিল আহমেদভাইকে।

২২ শে আগস্ট, ২০১৮ রাত ১০:২৩

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: শুরুতেই আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি আমার প্রায় প্রতিটি পোস্টেই আপনি উপস্থিত হচ্ছেন, সেজন্য। এবং কৃতজ্ঞতা।

'খ্যাতির লাগিয়া' ৬ ফর্মার (৯৬ পৃষ্ঠা) একটা ছোট উপন্যাস। আমার সবচেয়ে ছোটো বই এটা :) এটা পড়লে মনে হবে এটা আমার প্রথম উপন্যাস 'স্খলন'-এর একটা স্বরচিত রিভিউ :) কথাটা সাদামাটাভাবে ঠিক, কিন্তু এর ভেতর দিয়ে আমি একটা জিনিস বলতে চেয়েছি। জানি না সেটা পাঠকের কাছে পৌঁছেছে কিনা।

আপনি যেহেতু ডাউনলোড করতে পারছেন, তাহলে নিশ্চিত হলাম ডাউনলোড লিঙ্কে কোনো সমস্যা নেই। আরণ্যক রাখাল, জাহিদ অনিক- এরা বলছিলেন যে ডাউনলোড হচ্ছে না।

আপনাকে আবারও ধন্যবাদ প্রিয় পদাতিক চৌধুরি।

৫| ২২ শে আগস্ট, ২০১৮ রাত ১০:০৮

সনেট কবি বলেছেন: ভাল লাগল।

২২ শে আগস্ট, ২০১৮ রাত ১০:১৫

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: ধন্যবাদ ফরিদ ভাই। ভালো থাকবেন।

৬| ২২ শে আগস্ট, ২০১৮ রাত ১০:০৯

রাজীব নুর বলেছেন: ভাই কেমন আছেন?
ঈদের দিন কেমন কাটলো?

ঈশ্বর বলেনঃ আমাকে কোথায় খুঁজছো হে বান্দা, আমি তো রয়েছি তোমার পাশেই।আমি মন্দিরে-মসজিদে-কাবায়-কৈলাসে থাকিনে।...

২২ শে আগস্ট, ২০১৮ রাত ১০:১৪

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: আমি ভালো আছি রাজীব ভাই। আমার ইদের দিনটা আরাম আয়েশেই কেটেছে আল্লাহর রহমতে। আপনি ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন; সংসারের অনেক কাজে আপনাকে হেল্প করতে হয়। এ গুড হাজব্যান্ড---------- লাইক মি :)

আমার কাছে আল্লাহর ধারণা হলো, আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান। বিশ্বজগতের আয়তন যতখানি, আল্লাহ সেই সমস্ত আয়তন জুড়েই আছেন। আমার রক্তকণিকায় আছেন তিনি, বাতাসে, জলে, শূন্যে, সর্বত্র তিনি। আমাকে আল্লাহ থেকে, কিংবা আল্লাহকে আমা থেকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব না। 'আনাল হক'।

৭| ২২ শে আগস্ট, ২০১৮ রাত ১০:২৬

বিজন রয় বলেছেন: কেন জানিনা এধরনের কাহিনী আমার একঘেয়ে লাগে। হতে পারে এধরনের কাহিনী বা ঘটনা অনেক পরিচিত, বা অনেক পড়ছি বা আশেপাশে দেখছি।

২০০৪ এখন ২০১৮।
আপনার লেখা পরিপাটী হয় বা খুব স্বাভাবিক, সেজন্য সহজ হয়।
কিন্তু আরো বৈচিত্র আশাকরি।

২২ শে আগস্ট, ২০১৮ রাত ১০:৪৮

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: কঠিন প্রেমের সময় যে দুই লাইনের চিঠি লিখতাম, ওটাও পরে কবিতা হিসাবে রয়ে গেছে। প্রেমের তাপ ও ক্ষমতা এত বেশি ও ভয়াবহ। যারা এই অভিজ্ঞতায় কখনো যায় নি, তাদের ওগুলো কখনো ছোঁবে না। আবার এটাও সত্য, যেমন আপনি বললেন, হয়ত অভিজ্ঞতা অনেক বেশি, পরিচিত, বা দেখতে দেখতে অভক্ত হয়ে গেছেন, তখন একঘেঁয়ে লাগতে বাধ্য।


আপনার লেখা পরিপাটী হয় বা খুব স্বাভাবিক, সেজন্য সহজ হয়।
দারুণ কমপ্লিমেন্ট।

কিন্তু আরো বৈচিত্র আশাকরি।
এটা তো পেছনের লেখা :) সামনে বৈচিত্র আনার চেষ্টা করবো। তবে, এই বৈচিত্রের ব্যাপারটা নিয়েও আমার ব্যাখ্যা আছে। আমার প্রায় প্রতিটি লেখাই কিছু নির্দিষ্ট আবেগ, উপলক্ষ বা ঘটনা প্রবাহ থেকে সৃষ্টি। কোনো প্রণোদনা বা ঘটনা ছাড়া আমি কদাচিৎ কিছু লিখতে পেরেছি। এজন্য, এ লেখাগুলো খুব সহজাতভাবেই লেখা হয়ে গেছে। আমি বৈচিত্র সৃষ্টির উদ্দেশ্যে লিখতে বসলে সেটা আর্টিফিশিয়াল হয়ে যাওয়ারই সম্ভাবনা বেশি থাকবে।

তবু, অভ্যাস বদলানোর চেষ্টা তো করে দেখা যায়।

ধন্যবাদ কবি বিজন রয়।

ইদ মোবারক।

৮| ২২ শে আগস্ট, ২০১৮ রাত ১১:৩৬

বর্ণা বলেছেন: খুব ভাল লাগলো।

২৩ শে আগস্ট, ২০১৮ দুপুর ১২:২৯

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ বর্ণা। শুভেচ্ছা ও ইদ মোবারক।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.