নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সবার জন্য ভালোবাসা।

গেছো দাদা

গেছো দাদা › বিস্তারিত পোস্টঃ

সমস্ত অহিন্দু ধর্মদর্শন কি হিন্দুদের বেদান্ত দর্শন থেকেই উৎপন্ন হয়েছে বা ধার করেছে?? মননশীল বন্ধুরা কি বলেন?একবার পড়েই দেখুন না !!

২৮ শে এপ্রিল, ২০১৮ রাত ১২:২৮


হিন্দু বেদান্তশাস্ত্রকে কেন্দ্র করে তিনটি মতবাদের সৃষ্টি হয়েছে, যথা- দ্বৈতবাদ, দ্বৈতাদ্বৈতবাদ বা বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ এবং অদ্বৈতবাদ। দ্বৈতবাদের প্রবর্তক মাধবাচার্য, দ্বৈতাদ্বৈতবাদের প্রবর্তক শ্রীরামানুজ এবং অদ্বৈতবাদের প্রবর্তক জগদ্গুরু শংকর। নিচে এই তিন মতবাদ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হল।

দ্বৈতবাদ

দ্বৈত অর্থ দুই। ঈশ্বর ও জগত দুই অর্থাৎ এক নয়, এটাই দ্বৈতবাদের মুল কথা। মাধবাচার্যকে দ্বৈতবাদের জনক বলা হয়, তবে দ্বৈতজ্ঞান মূলত স্বভাবজাত বা জন্মগত জ্ঞান। দ্বৈতবাদীরা মনে করেন ঈশ্বর নিরাকার নয় অর্থাৎ ঈশ্বরের নির্দিষ্ট রূপ আছে। ঈশ্বরের কোন সৃষ্টিকর্তা নেই। তিনি নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করেছেন, এজন্য তিনি স্বয়ম্ভু। দ্বৈতবাদীরা মনে করে ঈশ্বর কোন নির্দিষ্ট লোকে বাস করেন। তাই তাঁরা বিষ্ণুলোক বা বৈকুণ্ঠলোক, শিবলোক, ব্রহ্মলোক প্রভৃতি লোকের অস্তিত্ব স্বীকার করেন। তারা মনে করেন ঈশ্বর ঐসব লোকে বাস করেন আবার সূক্ষ্ম-আত্মা রূপে জীবের হৃদয়াকাশেও বাস করেন। কুমার যেমন নিজ হাতে মাটি দিয়ে কলস, ঘট প্রভৃতি তৈরি করেন, ঈশ্বরও তেমনি পঞ্চভূত দ্বারা এই জড়-জগৎ ও জীবকুলকে সৃষ্টি করেন। ঈশ্বর একাধারে সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা ও ধ্বংসকর্তা।

ভক্তিযোগই দ্বৈতবাদীদের প্রধান অবলম্বন। ঈশ্বরকে ভক্তি করলে তিনি সন্তুষ্ট হয়ে মুক্তি দেবেন-এটাই দ্বৈতবাদীদের সাধনার মূলকথা। দ্বৈতবাদীদের ঈশ্বর সচ্চিদানন্দময়। ঈশ্বর সৎ অর্থাৎ তাঁর সত্ত্বা আছে, চিৎ অর্থাৎ তিনি চৈতন্যময় আবার তিনি আনন্দময়ও বটে। ঈশ্বর-ভক্তির মাধ্যমে ভক্তের দুঃখ দূর হয় এবং ভক্ত আনন্দ লাভ করেন। ব্রহ্মসূত্রেও বলা হয়েছে- ‘‘আনন্দময়েহভ্যাসাৎ’’ অর্থাৎ ব্রহ্ম আনন্দস্বরূপ, শাস্ত্রে পুনঃপুনঃ এ কথাই বলা হয়েছে। দ্বৈতবাদীরা ঈশ্বরের অবতারে বিশ্বাসী। তাঁরা মনে করেন যখন ধর্মের পরিমান কমে যায় এবং অধর্ম বেড়ে যায়, তখন ঈশ্বর বিভিন্ন রূপে পৃথিবীতে এসে ধর্মকে রক্ষা করেন এবং অধর্মকে বিনাশ করেন।

দ্বৈতবাদীরা স্বর্গ-নরকে বিশ্বাসী। তাঁরা মনে করেন পাপকার্য করলে নরকে যেতে হবে এবং পুণ্যকর্ম করলে স্বর্গে যাওয়া যাবে। তবে স্বর্গে গেলেও পুণ্যফল ক্ষয় হওয়ার পর আবার নতুন দেহ ধারণ করে মর্ত্যে ফিরে আসতে হবে। কিন্তু উপাস্য-দেবতার লোকে (যেমন- ব্রহ্মলোক, বিষ্ণুলোক, শিবলোক প্রভৃতি স্থানে) গেলে আর মর্ত্যে ফিরে আসতে হয় না। এটাই দ্বৈতবাদীদের নিকট মুক্তি নামে কথিত। জগতে যা কিছু হচ্ছে, সব ঈশ্বরের ইচ্ছায় হচ্ছে। ঈশ্বর যাকে সংসার-বন্ধন হতে মুক্তি দেবে একমাত্র তিনিই মুক্তি পাবেন। বস্তুত দ্বৈতবাদ স্বভাবসিদ্ধ জ্ঞান হলেও এ জ্ঞান চিরস্থায়ী নয়। জ্ঞানের পূর্ণতা আসলে দৈতজ্ঞান দূর হয়ে যায় তখন ঈশ্বরকে আর দূরে মনে হয় না।

বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ

বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ বা দ্বৈতাদ্বৈতবাদের প্রবক্তা হলেন শ্রী রামানুজ। রামানুজের পূর্বে যারা বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী ছিলেন তাঁরা হলেন- নাথমুনি ও যমুনাচার্য। কিন্তু একমাত্র রামনুজই সুন্দরভাবে যুক্তি স্থাপন করে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদকে প্রচার করেছেন এবং এই মতাদর্শী সম্প্রদায়ও তৈরী করে গেছেন বলে রামানুজকেই বৈশিষ্টাদ্বৈতবাদের জনক বলা হয়। রামানুজের দ্বৈতাদ্বৈতাবাদের ভিত্তি মূলত উপনিষদ, গীতা, মহাভারতের নারায়ণী অধ্যায় ও বিষ্ণু পুরাণ। দ্বৈতবাদ অনুসারে জগৎ ও ব্রহ্ম এক নয়, ভিন্ন। কিন্তু দ্বৈতাদ্বৈতবাদ অনুসারে জগত ব্রহ্ম থেকে পৃথক নয় আবার জগৎ মিথ্যা বা অস্তিত্বহীন নয়। কারণ ব্রহ্মই জগতে পরিণত হয়েছে। তবে ব্রহ্ম জগতে পরিণত হলেও তা ব্রহ্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি। জগৎ ও ব্রহ্মের মধ্যে এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বিদ্যমান। ব্রহ্মের অপরিণামী ও পরিণামী এই দুইটি অংশ রয়েছে। পরিণাম অর্থ অবস্থান্তর বা বিকার। তাই যার অবস্থান্তর বা পরিবর্তন ঘটে অর্থাৎ যা বিকৃত হয়ে অন্য বস্তুতে পরিণত হয় তাই পরিণামী। ব্রহ্মের এই পরিণামী অংশের বিকার ঘটার কারণে জগতের উৎপত্তি হয়েছে। সোজা কথায় ব্রহ্ম রূপান্তরিত হয়ে জগতে পরিণত হয়েছে। তাই এই প্রাণিকুল ও উদ্ভিদকুলসহ দৃশ্যমান যা কিছু আছে তা ব্রহ্মের পরিবর্তিত রূপ।
দ্বৈতাদ্বৈতবাদীদের নিকট জগৎ ব্রহ্ম হতে অভিন্ন কিন্তু জগৎ ব্রহ্ম নয়, কারণ ব্রহ্মের অচিৎ অংশ জগতে পরিণত হয়েছে। ব্রহ্ম বলতে শুধু চিৎ বা নিত্য ও অপরিণামী অংশকেই বুঝতে হবে। মুণ্ডক উপনিষদের আছে-

যথোর্ণনাভিঃ সৃজতে গৃহ্ণতে চ যথা পৃথিব্যামোষধয়ঃ সম্ভবন্তি।

যথা সতঃ পুরুষাৎ কেশলোমানি তথাহক্ষরাঃ সম্ভবতীহ বিশ্বম্।।

- মুণ্ডক (১/১/৭)

-ঊর্ণনাভ (মাকড়সা) যেমন নিজ দেহ থেকে তন্তু উৎপাদন করে পুনরায় নিজ দেহেই তা গ্রহণ করে, পৃথিবীতে যেমন করে ওষধিসমূহ (ধান, গম, যব প্রভৃতি) উৎপন্ন হয়, মনুষ্যদেহে যেমন করে কেশ ও লোম উৎপন্ন হয়, ঠিক তেমন করে অক্ষর ব্রহ্ম হতে এই বিশ্বের উৎপত্তি।

মাকড়সা তার দেহে থেকে সুতা নির্গত করে জাল তৈরী করে। ঐ জাল মাকড়সার দেহ থেকে অভিন্ন নয়। জাল মূলত মাকড়সার দেহেরই একটি রূপান্তরিত অংশ। তাই জালকে মাকড়সা বলা যাবে না। তেমনি এই জীব-জগতও ব্রহ্মের একটি পরিবর্তিত রূপ। সেজন্য জীব-জগৎ ব্রহ্ম নয়। মাকড়সার জাল যেমন তার দেহ থেকে অভিন্ন তেমনি এই জীব-জগৎও ব্রহ্ম থেকে অভিন্ন।

দ্বৈতাদ্বৈতবাদীরা মনে করেন ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করেননি, তিনি নিজেই জগৎ হয়েছেন। যেহেতু জগৎ হল তার পরিণাম সেহেতু তিনি জগৎ নন। বদরায়ণ প্রণীত ব্রহ্মসূত্রে আছে- ‘‘আত্মকৃতে পরিণামাৎ’’ অর্থাৎ ব্রহ্মের পরিণামেই জগতের উৎপত্তি। ব্রহ্মসূত্রের অন্যত্র আছে-‘‘উপসংহারদর্শনান্নেতি চেৎ ন ক্ষীরবৃদ্ধি’’ অর্থাৎ উপকরণ ব্যতীত ব্রহ্ম কিভাবে জগৎ সৃষ্টি করলেন? যদি এরকম আপত্তি ওঠে, তার উত্তরে আমরা বলব, দুগ্ধ যেমন দধিতে পরিণত হয় ব্রহ্মও সে রকম জগতে পরিণত হয়ে থাকে’’। উপকরণ বা উপাদান ছাড়া কোন কিছু সৃষ্টি সম্ভব নয়। তবে ব্রহ্ম জগৎ সৃষ্টি করলেন কি উপাদান দিয়ে? সৃষ্টির আদিতে ব্রহ্ম ছাড়া কিছুই ছিল না তবে ব্রহ্ম জগৎ তৈরীর উপাদান কোথায় পেলেন? এর উত্তর ব্রহ্ম ও জগতের মধ্যে এক কার্য-কারণ ভাব আছে। প্রত্যেক কার্যের মূলে একটা কারণ থাকে অর্থাৎ কারণ বিনা কার্য হয় না। যেমন কুমার মাটি দিয়ে কলস তৈরি করল। এখানে মাটি কারণ আর কলস কার্য। কার্য-কারণ একে অন্যের পরিপূরক। কারণ না থাকলে কার্য হয় না আবার কার্য ছাড়া কারণের অস্তিত্ব কি? জগৎ কার্য হলে তার কারণ হবে ব্রহ্ম। ব্রহ্ম যেহেতু এক ও অদ্বিতীয় সেহেতু তিনি অন্য কোন উপাদান থেকে জগৎ সৃষ্টি করেননি। ব্রহ্ম নিজেই উপাদান কারণ অর্থাৎ ব্রহ্মের পরিণামী বা অচিৎ (জড়) অংশই জগতের উপাদান কারণ। দুধ দধিতে পরিণত হতে অন্য কোন উপাদানের প্রয়োজন হয় না। দুধের মধ্যেই যে উপাদান আছে তা দধিতে পরিণত হয়। তদ্রূপ ব্রহ্মের অচিৎ অংশে জগৎ সৃষ্টির উপাদান রয়েছে যা হতে জগৎ সৃষ্টি হয়। কিন্তু ব্রহ্মের চিৎ অংশ অপরিণামী অর্থাৎ তার বিকার নেই।

রামানুজের মতে জগৎ ও ব্রহ্মের মধ্যে স্বজাতীয় ও বিজাতীয় ভেদ নাই কিন্তু স্বগত ভেদ আছে। স্বজাতীয় ভেদ বলতে একই জাতীয় দুটি জীবের মধ্যে ভেদ বা পার্থক্য বোঝায়। যেমন- দুইটি গরুর মধ্যে যে ভেদ। দুইটি ভিন্ন জাতীয় জীবের মধ্যে যে ভেদ, তাকে বিজাতীয় ভেদ বলে। যেমন- একটি ঘোড়া ও একটি সিংহের মধ্যে যে ভেদ। একই জীবের শরীরের বিভিন্ন অংশের মধ্যে যে ভেদ, তাকে স্বগত ভেদ হল । যেমন- মানুষের হাত ও পায়ের মধ্যে যে ভেদ। যেহেতু ব্রহ্মের অচিৎ (জড়) অংশ জগতে পরিণত হয়েছে সেহেতু জগৎ ও ব্রহ্ম ভিন্ন জাতি নয় এবং একই জাতির দুটি ভিন্ন বস্ত্তও নয়। তাই জগত ও ব্রহ্মে কোন স্বজাতীয় ও বিজাতীয় ভেদ নেই। কিন্তু ব্রহ্মের অচিৎ অংশ সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে জড়-জগতে পরিণত হয়েছে। তাই জগতের পরিণাম বা বিকার আছে কিন্তু ব্রহ্মের চিৎ অংশের কোন পরিণাম বা বিকার নেই। জগৎ ও ব্রহ্ম একই দেহের দুটি অঙ্গ সরূপ। একই দেহের দুইটি অঙ্গের মধ্যে যেরকম ভেদ থাকে, সেরকম জগৎ ও ব্রহ্মের মধ্যে স্বগত ভেদ রয়েছে। তাই জগৎকে ব্রহ্মের দেহ বলা চলে।

এই জগৎ পরিবর্তনশীল এবং জগতের জীব-জড় সকল বস্তু পরিবর্তনশীল। এক জড় পদার্থ অন্য জড় পদার্থে রূপান্তরিত হয়। জীবের জন্ম হয়, বৃদ্ধি ঘটে আবার মৃত্যু হয়। জগৎ যদি ব্রহ্মের দেহ হয়ে থাকে এবং জগতের সব কিছু যদি নশ্বর ও পরিবর্তনশীল হয়ে থাকে তবে ব্রহ্মের কি পরিবর্তন হবে না? জগতের পরিবতর্নের সাথে ব্রহ্মেরও পরিবর্তন হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু রামানুজ বলছেন, ব্রহ্ম বিকারশূন্য, অবিনশ্বর ও অপরিণামী। তিনি আরও বলেছেন যে, জগৎ যদি দেহ হয় তবে ব্রহ্ম হবে আত্মা। দেহের জন্ম-মৃত্যু আছে কিন্তু আত্মার জন্ম-মৃত্যু নেই। যেহেতু দেহের পরিবর্তনে আত্মার পরিবর্তন হয় না সেহেতু জগতের পরিবর্তনে ব্রহ্মেরও পরিবর্তন হবে না।

দ্বৈতাদ্বৈতবাদ মতে ব্রহ্মের স্বরূপ সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। দ্বৈতাদ্বৈতবাদ অনুসারে ব্রহ্ম এক ও অদ্বিতীয়। কিন্তু তাঁর দুইটি ভাব, একটি ব্যক্ত এবং অপরটি অব্যক্ত ভাব। অব্যক্ত ভাবে তিনি নিরাকার, অনন্ত, অসীম ও নির্গুণ। ব্রহ্মের এ অব্যক্ত ভাবকে পরমাত্মা বলা হয়। জীবাত্মা হল পরমাত্মার অংশ। যেমন অগ্নির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্ফুলিঙ্গ অগ্নির অংশ এবং ঐ স্ফুলিঙ্গের মধ্যে অগ্নির গুণ বিদ্যমান তেমনি জীবাত্মার মধ্যেও পরমাত্মার গুণ বিদ্যমান। পরমাত্মার মত জীবাত্মাও অবিনশ্বর অর্থাৎ জন্ম-মৃত্যুরহিত। যেহেতু জীবাত্মা পরমাত্মার অংশ সেহেতু জীবাত্মা অসীম নয়, সসীম। জীবাত্মার আকার অতি সূক্ষ্ম বলেই তা জীবের সমস্ত শরীরব্যাপী রয়েছে। আত্মার আকৃতি অতি সূক্ষ্ম বলে তাঁকে নিরাকারই বলা চলে। জীবাত্মা সমীম কিন্তু পরমাত্মা বা ব্রহ্ম অসীম তাই জীবাত্মা ও ব্রহ্ম অভেদ হতে পারে না। আবার জীবাত্মা ব্রহ্মের চিৎ-সত্ত্বার ক্ষুদ্র অংশ, তাই জীবাত্মার সাথে ব্রহ্মের ভেদও থাকতে পারে না কারণ অংশকে অংশী হতে পৃথক করা যায় না। তাই রামানুজের মতে জীবাত্মা ও পরমাত্মার মধ্যে ভেদ ও অভেদের সম্পর্ক বিদ্যমান অর্থাৎ জীবাত্মা ও পরমাত্মা এক আবার দুই। এজন্য রামানুজের মতবাদকে দ্বৈতাদ্বৈত মতবাদ বলে।

উপনিষদের ‘‘তত্ত্বমসি’’ কথাটির প্রকৃত অর্থ হল- তুমিই সেই ব্রহ্ম। কিন্তু রামানুজ ‘তৎ’ শব্দের অর্থ করছেন জগৎ-স্রষ্টা ব্রহ্ম এবং ‘ত্বম’ শব্দের অর্থ করেছেন জীবরূপী ব্রহ্ম। তাহলে তত্ত্বমসি (তৎ-ত্বম-অসি) শব্দের অর্থ দুই প্রকার গুণবিশিষ্ট ব্রহ্মের মিলন বা একত্ব। রামানুজের মতে অবিদ্যা বা অজ্ঞানতার জন্য আত্মার বন্ধন হয়। দেহে আত্মা বন্ধনপ্রাপ্ত হলে পুনর্জন্ম লাভ হয় এবং কর্মফল ভোগ করতে হয়। দেহ ও আত্মা ভিন্ন। দেহকে আত্মা মনে করাই হল অজ্ঞানতা। তাই আত্মাকে দেহ থেকে ভিন্ন মনে করে আত্মার মুক্তির জন্য সাধনা করাই দ্বৈতাদ্বৈতবাদেও মূল লক্ষ্য।

আত্মার মুক্তির জন্য বেদ নির্দেশিত কর্ম যেমন- আশ্রমধর্ম পালন, যাগযজ্ঞ পভৃতি করতে হবে। এবং তত্ত্বজ্ঞান লাভ করতে হবে। তবে ঈশ্বরের কৃপা ছাড়া মুক্তি লাভ সম্ভব নয়। ঈশ্বরকে সাধনার দ্বারা তুষ্ট করলে ঈশ্বর মুক্তি দেবেন। তাই রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ দর্শনে জ্ঞান ও ভক্তিযোগের অপূর্ব সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়।

অদ্বৈতবাদ

উপনিষদে অদ্বৈতবাদের বীজ থাকলেও জগদ্গুরু শঙ্করকেই অদ্বৈতবাদের জনক বলা হয়। অদ্বৈত অর্থ দুই না অর্থাৎ ব্রহ্ম ও জগৎ বা পরমাত্মা ও জীবাত্মা দুই নয়, এক। ব্রহ্ম ও জগতের মধ্যে স্বজাতীয়, বিজাতীয় এবং স্বগত ভেদের কোন প্রকার ভেদই নেই। বৃহদারণ্যক উপনিষদে (১/৪/১০) আছে- ‘‘ব্রহ্ম বা ইদমগ্র আসীৎ তদাত্মানমেবাবেৎ অহং ব্রহ্মাস্মীতি’’ অর্থাৎ এই জগৎ ব্রহ্ম রূপেই বর্তমান ছিল। তিনি নিজেকে ‘আমিই ব্রহ্ম’ রূপ জেনেছিলেন। মাণ্ডূক্য উপনিষদে আছে ‘‘সর্বং হ্যেতদ্ ব্রহ্ম, অয়মাত্মা ব্রহ্ম’’ অর্থাৎ এই সকলই ব্রহ্ম, এই আত্মাই ব্রহ্ম। ঈশ উপনিষদে আছে-‘‘যোহসাবসৌ পুরুষঃ সোহহমস্মি’’ অর্থাৎ ঐ যে সূর্যমণ্ডলস্থ পুরুষ আমিই তিনি। ছান্দোগ্য উপনিষদে তত্ত্বমসি (তুমিই সেই) ও সঃ অহম (আমিই তিনি) বাক্যদ্বয় রয়েছে। ছান্দোগ্য উপনিষদের অন্যত্র আছে ‘‘সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম’’ অর্থাৎ সব কিছুই ব্রহ্ম। ব্রহ্ম সংক্রান্ত এই বিদ্যাকে শাণ্ডিল্য বিদ্যা বলা হয়। অতএব একথা স্পষ্ট যে উপনিষদ বা বেদান্তই অদ্বৈতবাদ দর্শনের ভিত্তি।

জীবের সাথে ব্রহ্মের এবং জগতের সাথে ব্রহ্মের যদি কোন পার্থক্য বা ভেদ না থাকে তবে জীব-জগৎকে ব্রহ্ম হতে পৃথক মনে হচ্ছে কেন? প্রকৃতপক্ষে এই ভেদজ্ঞান অজ্ঞানতাবশত সৃষ্টি হয়। প্রকৃত জ্ঞানের উদয় হলে রাতের অন্ধকার যেমন দিনের আলোর সাথে মিলিয়ে যায় তেমন করে এই অজ্ঞানতা দূর হয়ে যায়। জগৎই ব্রহ্ম অর্থাৎ জগৎ ও ব্রহ্মে কোন ভেদ নেই, এরকম চিমত্মাই হল জ্ঞান আর জগৎ ও ব্রহ্মে ভেদ কল্পনা করাই হল অজ্ঞান বা অবিদ্যা।

প্রকৃতপক্ষে এই দৃশ্যমান জগৎ মিথ্যা এর অর্থ জগৎ অস্তিত্বহীন নয়। জগৎ মিথ্যা বলতে বোঝায় জগৎ আপেক্ষিক, পরিবর্তনশীল ও পরিণামী। স্থান-কাল-পাত্রভেদে জগতের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এক এক স্থানে জগৎ এক এক রকম, এক এক সময়ে জগৎ এক এক রকম এবং এক এক জনের কাছে জগৎ এক এক রকম। অর্থাৎ জগৎ সব সময়, সব স্থানে এবং সবার কাছে এক রকম মনে হয় না। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে প্রাচ্য দেশে ও পাশ্চত্য দেশে জগতের রূপ এক রকম নয়। বসমত্ম ঋতুতে জগৎকে যেমন দেখা যায় বর্ষা ঋতুতে তেমন দেখা যায় না। একজন মানুষ জগৎকে যেমন দেখে একটি গরু বা অন্য প্রাণী কিন্তু তেমন দেখে না। তাই জগৎকে সৎ মনে হলেও অর্থাৎ স্থান-কাল-পাত্রভেদে পরিবর্তনশীল হওয়ায় জগৎকে মিথ্যা বলা হয়েছে। ভগবান শঙ্করাচর্য তাঁর বিবেকচূড়ামণি নামক গ্রন্থে বলেছেন-

ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যেত্যেবংরূপো বিনিশ্চয়ঃ।

সোহয়ং নিত্যানিত্যবস্তুবিবেকঃ সমুদাহৃতঃ।।

-বিবেকচূড়ামণি (২০)

-‘ব্রহ্ম সত্য ও জগৎ মিথ্যা’ এই ধারণায় দৃঢ় প্রত্যয় হওয়াকেই নিত্য-অনিত্য-বস্তু-বিবেক বলে। জগৎকে সত্য বলে মনে করা মূলত ভ্রম ছাড়া অন্য কিছু নয়। রজ্জুতে যেমন সর্প ভ্রম হয় ব্রহ্মতে তেমনি জগৎ ভ্রম হয়। ভগবান শঙ্করাচার্য এ সম্পর্কে বলেছেন-

সম্যগ্ বিচারতঃ সিদ্ধা রজ্জুতত্ত্বাব ধারণা।

ভ্রান্তোদিতমহাসর্পভয়দুঃখ বিনাশিনী।।

বিবেকচূড়ামণি (২)

অর্থাৎ অজ্ঞানের জন্যে ভ্রান্তিবশত রজ্জুতে মহাসর্পের মিথ্যাজ্ঞান থেকে ভয়, হৃদকম্প ইত্যাদি যে সব দুঃখের উদ্ভব হয় সেসবের নাশ হয় রজ্জুকে রজ্জু বলে জানলে। ঠিক-ঠিক বিচারের দ্বারা জ্ঞানের উন্মেষ হলে সর্পের মিথ্যাজ্ঞান চলে গিয়ে রজ্জুর পরিচয়ই সত্য হয়। দড়িকে অনেক সময় সাপ বলে মনে হয়। অজ্ঞানতা বা ভ্রমের কারণে এমন মনে হয়। প্রকৃতপক্ষে দড়ি দড়িই, সাপ নয়। তেমনি ব্রহ্মকেও অজ্ঞানতাবশত জগত মনে হয়। যখন অজ্ঞানতা দূর হয় তখন কিন্তু দড়িকে সাপ মনে হয় না। ভ্রম যতক্ষণ পর্যন্ত স্থায়ী হবে ঠিক ততক্ষণ পর্যমত্ম দড়িকে সাপ মনে হবে এবং ভ্রমের ক্রিয়া শেষ হয়ে গেলে সাপের আর অস্তিত্ব থাকবে না। সাপ যেমন মিথ্যা এবং দড়িই সত্য তেমনি এই জগৎ মিথ্যা এবং একমাত্র ব্রহ্মই সত্য।

ব্রহ্ম অনাদি, অসীম, অনন্ত, নিরাকার ও অপরিণামী। ব্রহ্মের সৃষ্টি ও ধ্বংস নেই। ব্রহ্ম থেকে জগৎ সৃষ্টি হয়নি। ব্রহ্ম আগেও যেমন ছিল, এখনও তেমন আছে এবং ভবিষ্যতেও তেমন থাকবে। বস্ত্তত জগৎ সৃষ্টির ধারণা ভ্রম মাত্র। কোন কিছু সৃষ্টি করতে হলে উপাদান বা উপকরণ প্রয়োজন। ব্রহ্ম যদি এক ও অদ্বিতীয় হয় তবে উপকরণ সৃষ্টি হবে কিভাবে? যদি উপকরণের অস্তিত্ব কল্পনা করা হয় তখন ব্রহ্ম দুই হয়ে যাবে। ব্রহ্ম থেকেও উপকরণের সৃষ্টি হতে পারে না। কারণ ব্রহ্ম চৈতন্যয় ও অপরিণামী। কিন্তু উপকরণ হল জড় ও পরিণামী। একই বস্ত্তর মধ্যে পরিণামী ও অপরিণামী এই দ্বৈত-সত্ত্বা থাকা অসম্ভব। তাই ব্রহ্মের কোন উপাদান বা উপকরণ নেই। যেহেতু উপাদান নেই সেহেতু সৃষ্টি অসম্ভব। সুতরাং কোন কিছুই সৃষ্টি হয়নি। যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে হয় তা আসলে মায়া। মায়ার কারণেই ব্রহ্ম ও জীবে এবং ব্রহ্ম জগতে ভেদজ্ঞান হয়। মায়া কেটে গেলে দৃশ্যমান জগৎ অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে। তাই যতক্ষণ মায়া থাকবে ঠিক ততক্ষণ জগৎকে সত্য বলে মনে হবে। এই মায়াকে ত্রিগুণাত্বিকা প্রকৃতিও বলা হয়।

কোন হ্রদের জলে সূর্যের যে প্রতিবিম্ব পড়ে সে প্রতিবিম্ব মিথ্যা। দর্পণে যে প্রতিবিম্ব দেখা যায় তাকে সত্য বলে মনে হলেও তা আসলে সত্য নয়। ঐ প্রতিবিম্ব যেমন মিথ্যা, জগৎও তেমনি মিথ্যা। জলে যে বুদবুদের সৃষ্টি হয় সে বুদবুদ জল থেকে পৃথক নয় অর্থাৎ জল ভিন্ন অন্য কিছু নয়। তদ্রূপ জগৎও ব্রহ্ম ছাড়া অন্য কিছু নয়। অদ্বৈতবাদ দর্শনে জীবাত্মা ও পরমাত্মার পৃথক অস্তিত্ব নেই।

অদ্বৈতবাদ কি শূণ্যবাদকে সমর্থন করে? শঙ্কর বলেছেন দড়িতে সর্প-ভ্রমের কথা কিন্তু তিনি শূন্যে অর্থাৎ যেখানে কোন কিছু নেই এমন স্থানে সর্প-ভ্রমের কথা বলেননি। দড়ি ছিল বলে সর্প-ভ্রম হয়েছে কিন্তু দড়ি না থাকলে সর্প-ভ্রম হত না। অজ্ঞানতাবশত শূন্যস্থানে জগৎ কল্পিত হয় না ব্রহ্মকেই জগত বলে মনে হয়। সুতরাং অদ্বেতবাদ শূণ্যবাদকে সমর্থন করে না। তাই অদ্বৈতবাদের মুলকথা হল মায়ার কারণেই ব্রহ্মকে জগৎ বলে মনে হয়। মায়াই মরুভূমিতে মরীচিকা সৃষ্টি করে। মরুভূমিতে মরীচিকার কারণে তপ্ত বালিকে জল বলে মনে হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত কাছে না যাওয়া হয় ততক্ষণ পর্যন্ত জলের অসিত্মত্ব থাকে কাছে গেলে জলের অস্তিত্ব থাকে না তখন শুধু বালিই দেখা যায়। তাই মায়া দূর হলে অথাৎ জ্ঞানের উদয় হলে জগতের অস্তিত্বও দূর হয়ে যায়।

রামানুজের দ্বৈতাদ্বৈত দর্শন মতে জীবাত্মা পরমাত্মার অংশ। কিন্তু পরমাত্মা অখণ্ড ও পূর্ণ এবং তাঁকে কর্তন ও ছেদন করা যায় না। সুতরাং পরমাত্মার কোন অংশ হতে পারে না। উপনিষদে বলা হয়েছে, ‘‘পূর্ণমদ, পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে। পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে।।’’অর্থাৎ এই পরব্রহ্ম পূর্ণ (অখণ্ড), এই নাম-রূপস্থ ব্রহ্মও পূর্ণ, পূর্ণ হতে পূর্ণ উদ্গত হন। পূর্ণের (নাম-রূপস্থ ব্রহ্মের) পূর্ণত্ব গ্রহণ করলে পূর্ণই (পরব্রহ্ম) অবশিষ্ট থাকেন। জীবাত্মা ও পরমাত্মার ভেদজ্ঞান মূলত ভ্রম বা মায়া। একটি ঘটের মধ্যেও আকাশ আছে আর ঘটের বাইরেও আকাশ আছে তাই জীবাত্মা যদি হয় ঘটের আকাশ তবে পরমাত্মা হবে বাইরের উন্মুক্ত আকাশ। ঘটের ভেতরের আকাশ ও ঘটের বাইরের আকাশ মূলত একই। তাই জীবাত্মা ও পরমাত্মাও এক কিন্তু মায়ার কারণে ভেদজ্ঞান সৃষ্টি হয়। শঙ্কর বলেছেন, ‘‘অজ্ঞানযোগাৎ পরমাত্মনস্তব হ্যনাত্মবন্ধস্তত এব সংসৃতিঃ’’ অর্থাৎ অজ্ঞানযুক্ত হওয়ার ফলেই তোমার এই দেহাদি অনাত্মবস্তুতে বন্ধন, বস্ত্ততঃ তুমি পরমাত্মাই

এখন মায়া প্রসঙ্গে বিশেষ কিছু কথা বলা প্রয়োজন। মায়া আসলে কি? কোথা থেকে এর উৎপত্তি? মায়া কি ব্রহ্ম ? এসব প্রশ্নের উত্তরে শঙ্কর বলেছেন,‘‘মায়া ব্রহ্মের শক্তি। মায়াকে অব্যক্তও বলা হয়। এই মায়া অনাদি, সত্ত্ব-রজঃ-তমঃ এই তিন গুণবিশিষ্ট, কারণসরূপা। বিজ্ঞ ব্যক্তি জগতের সৃষ্টিকার্য থেকে এর অস্তিত্ব অনুমান করেন। এই মায়া যে আছে তাও নয় আবার নেই এরকমও নয়। আছেও আবার নেইও এ দুই এর মিশ্রণও নয়। মায়া পরমাত্মা থেকে ভিন্ন নয় অভিন্নও নয় আবার ভিন্ন ও অভিন্ন উভয়রূপাও নয়। মায়া অঙ্গযুক্ত বা অঙ্গহীন নয় অথবা অঙ্গ আছে আবার নেই এই দুয়ের একত্র অবস্থাও নয়। মায়া অতি অদ্ভুতরূপা ও বাক্যের দ্বারা অবর্ণনীয়’’।

প্রকৃতপক্ষে মায়া অজ্ঞেয়। মানুষের চোখ তার নিজের বদনমণ্ডলকে দেখতে পায় না কিন্তু অন্য মানুষ তার বদন-মণ্ডল দেখতে পায়। চোখ বদনমণ্ডলে অবস্থিত, তাই চোখ নিজের বদনমণ্ডলকে দেখতে পায় না কিন্তু অন্যের বদনমণ্ডলকে দেখতে পায়। জীব মায়ার মধ্যে বাস করে তাই সে মায়া উপলব্ধি করতে পারে না। কারণ মায়াকে উপলব্ধি করতে হলে মায়া-সমুদ্রের ওপারে যেতে হবে যা জীবের পক্ষে সম্ভব নয়। অতএব মায়া অজ্ঞেয়। মায়া অজ্ঞেয় বলেই সৃষ্টিপ্রবাহ বেঁচে আছে। মায়াকে জানলে সৃষ্টির অস্তিত্ব থাকে না।

প্রকৃতপক্ষে এই জগৎ-প্রপঞ্চ মনের ভ্রম ছাড়া অন্য কিছু নয়। কিন্তু মন কি? মন কি দেহ থেকে পৃথক? আসলে মন-দেহ সবই মায়া। পঞ্চ-জ্ঞানেন্দ্রিয় দ্বারা কোন বস্তুর অস্তিত্ব উপলদ্ধি করা হয়। যতক্ষণ পঞ্চ-ইন্দ্রিয় ক্রিয়াশীল থাকে ততক্ষণ পর্যমত্ম জগতের অসিত্মত্ব থাকে। ঘুমের সময় পঞ্চ-ইন্দ্রিয় (চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহবা ও ত্বক) মনে লুপ্ত হয়। তাই স্বপ্ন দেখার সময় মনই জগৎকে বিভিন্ন রূপে দর্শন করায়। কিন্তু স্বপ্নহীন নিদ্রা বা সুসুপ্তির সময় পঞ্চ ইন্দ্রিয় মনে এবং মন আত্মাতে লীন হয়। তখন জগৎকে আর উপলব্ধি করা যায় না। তখন মনই জগৎকে উপলব্ধি করায়। এই মন আছে কি নেই তা বোঝা কষ্ট, তাই এই মনও মায়া। যদি জগৎ সত্য হত তবে সুসুপ্তির সময়ও জগৎকে উপলব্ধি করা যেত। যেহেতু সুসপ্তিতে জগৎকে উপলব্ধি করা যায় না সেহেতু জগৎ মিথ্যা।

এখন অদ্বৈতবাদ দর্শনের মুক্তি প্রসঙ্গে আসা যাক। যেহেতু আত্মা মুক্ত অর্থাৎ আত্মার কোন বন্ধন নেই সেহেতু মুক্তির প্রশ্নই আসে না। যদি জীবাত্মা ও পরমাত্মা একই হয় তাহলে আবার মুক্তি কিসের? অদ্বৈত দর্শনে মুক্তি অর্থ অজ্ঞানতা বা মায়া থেকে মুক্তি। কারণ মায়ার কারণেই আত্মার বন্ধন হয়েছে এমন মনে হয়। এ প্রসঙ্গে ভগবান শঙ্কর বলেছেন-

ব্রহ্মাভিন্নত্ববিজ্ঞানং ভবমোক্ষস্য কারণম্।

যেন অদ্বিতীয়মানন্দং ব্রহ্ম সম্পদ্যতে বুধৈঃ।।

-ব্রহ্মের থেকে আমি অভিন্ন এই জ্ঞানই সংসার-বন্ধন থেকে মুক্তির কারণ স্বরূপ। আর এই জ্ঞানের দ্বারাই বিবেকী ব্যক্তিরা অদ্বিতীয় আনন্দরূপ ব্রহ্ম লাভ করেন ও ব্রহ্মই হয়ে যান। আবার তিনি বলেছেন- সকাম কার্য নাশ হলে বিষয়-চিন্তার নাশ হয় আর তার থেকে বাসনা ক্ষয় হয়ে যায়। বাসনার পুরোপুরি ক্ষয় হওয়াই হল মোক্ষ। এই অবস্থাকেই জীবন্মুক্তি বলে। মায়া দূর হলেই বিষয় চিমত্মা দূর হবে। তাই মায়া থেকে মুক্তি পেতে গেলে নিজেকে ব্রহ্ম থেকে অভেদ ভাবতে হবে এবং বেদবিহিত কর্ম করতে হবে। ভেতরের আমি-আমি ভাব বা অহংকার দূর করতে হবে কারণ এই অহং ভাবই ভেদজ্ঞান সৃষ্টি করে। শঙ্কারচার্যের মতে কর্ম হতে হবে নিষ্কাম। মুমুক্ষু জীব যখন বিষয়-তৃষ্ণা ত্যাগ করে, নিজেকে ব্রহ্ম থেকে অভিন্ন মনে করে উপাসনা করবে, তখন মায়া দূর হবে এবং মোক্ষলাভ হবে।

দ্বৈতবাদ, দ্বৈতাদ্বৈতবাদ ও অদ্বৈতবাদ এই তিন মতবাদের সমন্বয়

পূর্বেই বলা হয়েছে যে, দ্বৈতজ্ঞান স্বভাবসিদ্ধ জ্ঞান। একজন মানুষ দ্বৈতবাদী হয়েই জন্মগ্রহণ করে। দ্বৈতবাদে ঈশ্বরকে সব থেকে সহজে কল্পনা করা যায়। তাই অধিকাংশ মানুষই দ্বৈতবাদী। তবে দ্বৈতবাদ, দ্বৈতাদ্বৈতবাদ ও অদ্বৈতবাদ সাংঘর্ষিক নয়। এই তিন মতবাদ মূলত জ্ঞানের তিনটি স্তর বা সোপান। মানুষ প্রথমে ঈশ্বরকে দ্বৈত জ্ঞানেই পূজা করে। তারপর আর একটু জ্ঞানের বিকাশ ঘটলে তাঁর মনের দ্বৈতভাব কিছুটা দূর হয়। তখন সে মনে করে ঈশ্বর ও জগতে ভেদ নেই। অর্থাৎ ঈশ্বরই জগতে পরিণত হয়েছে এবং জীবাত্মা পরমাত্মারই অংশ। তারপর যখন জ্ঞানের পূর্ণতা আসে তখন সে উপলব্ধি করতে পারে যে জগৎ ও ঈশ্বর অভিন্ন এবং জীবাত্মা ও পরমাত্মার পৃথক অস্তিত্ব নেই। এভাবে একজন মানুষ জ্ঞানের বিকাশের সাথে সাথে দ্বৈতবাদ থেকে দ্বৈতাদ্বৈতবাদ এবং দ্বৈতাদ্বৈতবাদ থেকে অদ্বৈতবাদ স্তরে উপনীত হন।
.
.সহযোগিতায়---সুনীতা চক্রবর্তী দিদি ।

মন্তব্য ৫ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৫) মন্তব্য লিখুন

১| ২৮ শে এপ্রিল, ২০১৮ রাত ১২:৩০

চাঁদগাজী বলেছেন:


অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে সময় কাটাতে পছন্দ করেন?

২৮ শে এপ্রিল, ২০১৮ রাত ১২:৪৩

গেছো দাদা বলেছেন: সবার প্রয়োজনের তালিকা একইরকম নয় । আপনার প্রয়োজনীয় বিষয় আমার কাছে অপ্রয়োজনীয় হতেই পারে । আবার উল্টোটাও সত্যি হতে পারে । আপনার মনমতন ব্লগ লিখতে হবে ... এরকম কোনো নিয়ম আছে নাকি ? ধন্যবাদ ।

২| ২৮ শে এপ্রিল, ২০১৮ রাত ৩:১০

কবি হাফেজ আহমেদ বলেছেন: ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম নিয়ে জ্ঞানী হতে আমার এখনো অনেক সময় বাকি। অনেক ষ্টাডি করতে হবে। ভালোভাবে না জেনে কমেন্টস করার ক্ষমতা আমার নেই। তবে আপনার সম্পূর্ণ পোস্টটি না পড়েই আপাতত শুয়ে পড়লাম। ভালো থাকুন।

৩| ২৮ শে এপ্রিল, ২০১৮ সকাল ৯:২৬

রাজীব নুর বলেছেন: বালিশে মাথা রাখা মাত্র ঘুমিয়ে পড়ার সৌভাগ্য আমার না। আমাকে অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকতে হয়।

৪| ২৮ শে এপ্রিল, ২০১৮ সকাল ১১:০০

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: সমৃদ্ধ আলোচনা।

ভাল লাগল।

ভাবনা চিন্তাকে বিকশীত করে। বিকশিত চিন্তা সত্যালোক লাভ করে।

+++++++

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.