নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

গেন্দু মিয়া একজন সহজ সরল ভালমানুষ। তাকে ভালবাসা দিন। তার ভালবাসা নিন। ছেলেটা মাঝে মাঝে গল্পটল্প লেখার অপচেষ্টা করে। তাকে উৎসাহ দিন।

গেন্দু মিয়ার চরিত্র – ফুলের মতন পবিত্র!

গেন্দু মিয়া

কিছু জানার চেষ্টা থেকে ব্লগে আসা। সাহিত্য চর্চা করতে চাই।

গেন্দু মিয়া › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্পঃ হারজিত

২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৪:২৮

(১)

‘মাইয়্যাটার জীবন নষ্ট অইয়া যাইবো’, গণিচাচা হাউমাউ করে কাঁদছেন। ‘বদনাম অইয়া যাইবো। আর বিয়া অইবো না।’

উঠোনের এক কোণে আট দশটা কাঠের চেয়ার পাতা। গণ্যমান্যরা ওখানে বসেছেন। প্রাইমারী স্কুলের হেডমাস্টার এসেছেন। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এসেছেন তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে। এলাকার মুরুব্বিরাও আছেন। তাদের ভেতরে আরো আছেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম। এদের মাঝে দু’টো কাঠের চেয়ারে বজ্রাহতের মতো বসে আছেন হামিদুর রহমান আর রশিদুর রহমান। আপন ভাই। কিছুক্ষণের ভেতর অন্য একটা সম্পর্কে নিজেদের জড়াতে যাচ্ছিলেন। হলো না।

‘বিয়ার লগন ফিরানো মাইয়ারে সবে আলুক্ষইন্যা কইবো।’ গণিচাচা কান্না তখনও অব্যাহত।

শব্দটা “আলুক্ষইন্যা” না। “অলক্ষুণে”। কিন্তু সেটা বলে দেবার মতো পরিস্থিতি এখন নেই।

হামিদ চাচা কিছু বিড়বিড় করে কিছু একটা বলা চেষ্টা করলেন। কী বলতে চাইলেন ঠিক বোঝা গেল না। হেনার বাবা রশিদ চাচা একেবারে পাথরের মতো বসে আছেন। চোখের পাতি পর্যন্ত ফেলছেন না।

সামনে উঠোনওয়ালা দো’তলা পাকা বাড়িটা সাজানো হয়েছে নানান রঙের কাগজ দিয়ে। উঠোনে বাঁশ দিয়ে লাল সবুজ প্যান্ডেল টাঙানো। দুপুরের রোদ উঁকি দিয়ে ফিরে যাচ্ছে। আমন্ত্রিত অতিথিদের অনেকে এসেছেন। প্যান্ডেলের নিচে খাবার দাবারের ব্যবস্থা – ডেকোরেটরের টেবিল পাতা হয়েছে।

কাচ্চি বিরিয়ানির গন্ধে এলাকাটা মৌ মৌ করছে। সবাই অপেক্ষায় ছিল। কবুল কবুল কবুল। জাদুমন্ত্র।

‘এতদিন পেরেম কইরা এখন যদি এই বিয়া না অয় তইলে এলাকার লোকে কী কইবো?’ – গণিচাচার কন্ঠে আকুতি। ‘আমরার মুখ আর থাকবো না।’
‘গণি তুমি থামো।’ হেডমাস্টার সাহেব খেঁকিয়ে উঠলেন। ‘এইসব কুসংস্কারের যুগ নাই।’

‘মাস্টারসা’ব কয়জনের মুখ বন্ধ করবেন?’ – চেয়ারম্যানের গলায় হতাশা। ‘গেরামের লোক এই গুলান মানে। কথা ছড়ায়া যাইবো।’

‘অয়। অয়।’ মাতব্বরেরা ধীরলয়ে মাথা নাড়েন। কুঞ্চিত ভ্রুঁতে আরো ভাঁজ জমে। বিয়ে খেতে এসে এমন ঘটনা দেখবেন তা কে জানতো? পক্ককেশ ন্যুব্জ মাথাগুলো অনাগত ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তায় ব্যাকুল।
ভেতরবাড়ি থেকে আফিয়া চাচী বের হয়ে আসেন। হামিদ চাচার বৌ। তার মুখ থমথমে। গলা বাড়িয়ে বলেন – ‘মেহমানদের আর বসায়া রাখা দরকার নাই। খাওয়াইয়া দাও।’

বলার জন্যই বলা। গ্রামের অতিথিরা শহরের মতোন অতটা বাণিজ্যিক নন। এসে খেয়ে চলে যাবেন আর বর-বধুর চেহারা পর্যন্ত দর্শন করবেন না, এমনটা হয় না। তাদের আর খাবারের খিদে নেই। মুখরোচক কিছু একটা কাহিনী শোনার জন্য তাঁরা মুখিয়ে আছেন। সহজে অনুষ্ঠান ছেড়ে যাবেন না।

শোয়েব আমার পাশে মাথা নিচু করে বসে আছে। মাথায় চড়ানো পাগড়িটার ওজনেই কিনা কে জানে? চোখ মুখ শক্ত।

ভেতর বাড়িতে থেকে থেকে কান্নার রোল উঠছে। শ্রেষ্ঠাংশে নিশ্চয়ই সুফিয়া বানু আছেন। যেকোন পরিস্থিতিতে মহিলার বিলাপ করার ক্ষমতা বিশ্ববিদিত।

মাস্টার সা’ব শুভাকাঙ্ক্ষীর মতো মৃদু স্বরে কথা বলছেন রশিদ চাচার সাথে। ‘এই ধরণের ব্যাপার এক্কেবারে লাস্টে বের হইলো, আগে কোন আঁচ পাইলাম না। আপনেরা কি আসলেই জানতেন না।’

‘বিশ্বাস করেন মাস্টার সা’ব’, রশিদ চাচার গলা কাঁদো কাঁদো, ‘পোলা মাইয়া দুইটা একলগে বড় অইসে। হেগোরে কুনোদিন মিলমিশ করতে বারণ করি নাই। ছুডুবেলা থেকে একলগে খেলতো। আমরা কইতাম হ্যারা বড় হইলে বিয়া দিয়া দিমু। সারাজীবন একলগে থাকবো।’

‘কিন্তু এ বিয়া ধর্মে নাই। অইবো না’, মসজিদের ইমাম সাহেবের দৃঢ় কন্ঠস্বর শোনা যায়। ঘটনা শোনার পর তিনিই এটা প্রতিষ্ঠা করেছেন।

‘সুন্নী মতে এই বিয়া অসম্ভব।’

কুঞ্চিত ভ্রুঁগুলো আরো কুঁচকে যায়। ‘অয়। অয়।’

---------------

(২)

শোয়েব আর আমি একদিনের বড় ছোট। হেনার সাথে ব্যবধান এক মাসের মতো। পাশাপাশি বাড়ি হবার সুবাদে জন্মকাল থেকেই আমার অবাধ আনাগোনা। আমাদের পড়াশোনাও একসাথে। শোয়েব-হেনাদের যৌথ পরিবারের প্রতিবেশী হয়ে পুরো অর্ধেকটা জীবন কাটিয়ে দিলাম আমি।

আমরা গরীব। ওরা বড়লোক। কিন্তু এই ব্যবধানটা ঘুঁচিয়ে দিয়েছিল আমাদের জন্ম।

কাঁচা বাড়িতে আঁতুর ঘর হতো না। আমার জন্মের সময় প্রতিবেশী হবার অধিকারে আমার মা এসে উঠেছিলেন হামিদ চাচা - রশিদ চাচার পাকাবাড়ির আঁতুর ঘরে।

ছোট বেলা থেকেই তিনজন ছিলাম – যাকে বলে কিনা একেবারে হরিহর আত্মা। একসাথে স্কুলে যাওয়া থেকে শুরু করে বিকেল বেলার খেলাধুলো, এমন কি মাঝে মাঝে আমি রাতের খাওয়া সেরে ওদের বাসায় ঢুকে যেতাম। তিনজন মিলে এক বিছানায় ঘুমাতাম। আর গল্প। কত গল্প! আমাদের গল্প কখনও শেষ হতো না। হেনা দু’হাত দিয়ে আমাদের দু’জনকে স্পর্শ করে থাকতো। মিথ্যে বলবো না - গল্প করার জন্য নয়, ঐটুকু স্পর্শের জন্য আমি রাতের পর রাত তাদের বাসায় পরে থাকতাম।

শোয়েব আমাদের দলপতি। হেনা আমাদের মধ্যমণি। আমি আর শোয়েব দু’জন মিলে তাকে আগলে রাখতাম। কখনও তার গায়ে অমঙ্গলের আঁচটাও লাগতে দিতাম না। শোয়েব এ ব্যাপারে অগ্রগামী। হামিদ চাচা, রশিদ চাচা মজা করে বলতেন – ‘বড় অইলে এই দুইটার বিয়া দিয়া দিমো। সারা জীবন একলগে খেলবো।’

এই কথা শুনে ছোট্ট একটা হৃদয়ের রক্তক্ষরণ চর্মচক্ষুর আড়ালেই থেকে যেত।

আরেকটু বড় হয়ে মাঝে মাঝে জ্যোৎস্না দিয়ে গোসল করা রাতগুলোতে উঠোনে টাঙানো দোলনায় তারা দু’জন হাত ধরাধরি করে বসে থাকতো। আর আমি পেছন থেকে ঠেলা দিতাম। গ্রামের জ্যোৎস্না যারা দেখেনি তারা বুঝবে না কী তীব্র সেই আলো। সেই আলোয় দিনের মতোই ছায়া পরতো। চাঁদের দিকে মুখ করে তারা দু’জন হাত ধরাধরি করে বসে থাকতো, আর আমি থাকতাম তাদের পেছনের ছায়ায়। অন্ধকারে।

হঠাৎ হঠাৎ শোয়েব আমাকে বসার সুযোগ করে দিত। দোলনার ওপর। হেনার পাশে। এতটুকু স্পর্শ পাবার জন্য আমি মুখিয়ে থাকতাম। ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দোলনা ঠেলার পরিশ্রমকে তুচ্ছ মনে হতো।

শোয়েব প্রকৃত পুরুষ। গায়ে গতরে বরাবরই লম্বা চওড়া, পেশীবহুল। আমি হ্যাংলা পাতলা। শোয়েব প্রথম সারির ছাত্র। আমি টেনেটুনে পাস করি। ওর সাহসের কোন অভাব নেই। আমি ভীরু। সে সব ব্যাপারে আমাদের মধ্যে সেরা।

আমরা তিনজনে তখন এক বিছানায় ঘুমোনোর পালাকে সহস্র শতাব্দী পিছে ফেলে কলেজে উঠেছি। একদিন রাস্তায় একটা ছেলে হেনাকে কী একটা বাজে মন্তব্য করে। অনেকের সামনেই। আমরা দু’জন তখন ফুটবলের মাঠে। আমি দর্শকের সারিতে। আর উইং-ব্যাক শোয়েব মাঠের শেষপ্রান্ত থেকে বল নিয়ে পুরো মাঠ পাড়ি দিয়ে দৌঁড়িয়ে প্রতিপক্ষের পেনাল্টি বক্সে ঢুকে ফাউলের স্বীকার হয়েছে। পেনাল্টির জন্য প্রস্তুতিনেয়া হচ্ছে, এমন সময় এক ছোট ভাই হঠাৎ মাঠে ঢুকে শোয়েবের কানেকানে খবরটা দেয়।

শোয়েব দৌঁড়ুলো। আমি পিছে পিছে। একের পর এক ফুটবলের স্পাইক ওয়ালা জুতোর লাথি খেতে কেমন লাগে আমার জানা নেই। ঐ ছেলে আর তার বখাটে বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলে হতো।

শোয়েব দিন কতক পালিয়ে থাকলো। মাথায় স্টিচ নিয়ে ঐ ছেলে দু’টো হাসপাতালে। আমি অনেক অনুনয় বিনয় করে তাদের অভিভাবকদের নিরস্ত করলাম। থানা-পুলিশ হলো না।

এই ঘটনার কিছু দিনের মধ্যে দেখলাম শোয়েবকে একটু অন্য নজরে দেখা শুরু করলো হেনা। চাচাতো ভাই হয়েও সবসময়ই সে হেনার নজরে ছিল অন্য এক উচ্চতায়। সেদিনের ঘটনার পর থেকে উচ্চতাটা আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেল।

কলেজ শেষ করে আমরা তিনজন ঢাকা গেলাম। শোয়েব বুয়েটে ভর্তি হলো। হেনা একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্যে অনার্স নিলো। আমি ঢুকলাম ঢাকা কলেজে। ইংরেজিতে ডিগ্রী পাশ করে দেশ ও দশের উন্নতিতে খুব একটা অবদান রাখতে পারবো এমন দুরাশা আমার কখনই ছিল না। কোনমতে পাশ করে দেশে ফিরে বাবার কাপড়ের ব্যবসার হাল ধরবো - এই হচ্ছে পরিকল্পনা।

আমরা একসাথে ঘুরতাম। কখনও ধানমন্ডি লেক। কখনও বা টি,এস,সি। আবার কখনও বা রমনা পার্ক। শোয়েব গিটারে আঙুল নাড়িয়ে গান ধরতো। আমি কোরাস ধরতাম। হেনা মুগ্ধ নয়নে তাকে দেখতো। আমি হিংসেয় জ্বলতাম।

একদিন হঠাৎ শোয়েব আমাকে বললো ও হেনাকে নিয়ে ঘুরতে যাচ্ছে। গাজীপুর। আমি না আসলে ভাল হয়। কিছুটা সময় একা থাকতে চায় তারা। শোয়েবের চোখে লজ্জার হাসি।

সেদিন সারাদিন আমি ছেচল্লিশটা গোল্ড লিফ পুড়িয়েছিলাম। তাও বুকের ভেতরের যন্ত্রণাটা, দাউ দাউ করে জ্বলা আগুনটা, নেভানো যায়নি।

---------------

(৩)

জীবনে জিতে সুখ আছে। কখনও কখনও হেরেও সুখ আছে।

আমি হেরে গেলাম। আমাদের তিনজনের দলটা দু’টো দু’জনের দলে পরিণত হল। শোয়েব দু’দলেই আছে। হেনাকে দেখি না প্রায় তিনমাস।
হেনার বিয়ের প্রস্তাব আসা শুরু করেছে। রশিদ চাচা সকলকে কথা দিয়েছেন এই বছর হেনা পাশ করে বের হবে। এবছরই বিয়ে দিয়ে দেবেন। যথেষ্ট পড়াশোনা হয়েছে।

শোয়েবের ফাইনাল পরীক্ষাও শেষের দিকে। ততদিনে সে একটা টেক-ফার্মে চাকরির প্রস্তাব পেয়েছে। পরীক্ষা শেষ করেই যোগ দিবে।

গ্রাম থেকে হামিদ চাচা কী একটা কাজে ঢাকা এসেছেন। শোয়েব আমাকে ধরলো। হেনার সাথে তার সম্পর্কটা ততদিনে প্রতিষ্ঠিত। বাবাকে সরাসরি জানানোর সাহস হচ্ছে না। নির্ভিক বীরপুরুষদেরও কখনও কখনও সাহসের অভাব হয়। ঘটনা ঘটানোর জন্য ঘটকের দরকার পরে। আমার মতন কাপুরুষদের মাঝে মাঝে সেই ঘটকের চরিত্র নিতে হয়।

চাচাকে বললাম। উনি মহাখুশি। ‘বাবা কাশেম, এ কী শুনাইলা। এতো খুশির খবর তো কুনুদিন শুনি নাই।’

আমার মেসের ঘরে আমার খাটে বসে আমার ফোন থেকেই উনি রশিদ চাচাকে ফোন দিলেন। হামিদ চাচার এগাল ওগাল জোড়া হাসি দেখে ওপারের কথা বার্তা আন্দাজ করে নিলাম। নির্লিপ্ত নির্বাক আমি খাটের কোণে বসে ছিলাম। পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় তৈরী হওয়া প্রিয় দু’জনের ছায়া থেকে সেদিনও আমি বের হতে পারিনি।

হামিদ চাচা তড়িঘরি করে গাঁয়ে ফিরে গেলেন। আমাদের তিনজনের তলব পড়ল।

এর পরের ঘটনা খুব দ্রুত ঘটল। হেনার সাথে শোয়েবের পানচিনি হয়ে গেল। শুভ সময় দেখে বিয়ের দিনও ধার্য হল।

সে’দিন বুঝলাম আমি হার মেনে নেই নি। হার আমি মানতে পারিনি।

---------------

(৪)

বিয়ের দিন দূপুরের মাঝে সব আয়োজন শেষ। ঘরোয়া আয়োজন।

শোয়েবকে বসানো হল উঠোনের এক কোণে, চৌকিতে। আর হেনাকে ভেতর বাড়ির বৈঠকখানায়। চাচী, মামী, ফুপু, খালারা হেনাকে ঘিরে বসে গ্রামের মহিলাদের সাথে হেঁড়ে গলায় গান ধরলেন। বিয়ের গান। প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা গানগুলোয় জীবনের আনন্দ আছে, প্রেমের গল্প আছে। বিচ্ছেদ নেই। বিচ্ছেদের গান অন্য কারো বুকে বাজছিল। গ্রামের মহিলারা সে সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন না।

লাল সবুজ প্যান্ডেলের নিচের আড্ডায় হামিদ চাচা, রশিদ চাচা, গণি চাচা, সুলতান চাচা সবাই ছিলেন। ছিল আমাদের পাড়াতো বন্ধু বান্ধব। হামিদ চাচা বলছিলেন সেই ছোট্ট বেলা থেকে শোয়েব আর হেনার সখ্যতা নিয়ে।

‘বুঝলি রশিদ, কথায় আছে বিবাহের জোড়া খোদা নিজের হাতে বানান। এদের কপালেই ছিল।’

রশিদ চাচা দ্বিমত পোষন করেননি। আনন্দের এই সময়ে দ্বিমত পোষন করা মানায় না। ভেতর বাড়িতে নাটকটার যে অঙ্ক এখন অভিনীত হতে যাচ্ছে তা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই কেউ পুর্বাভাস পান নি।

আমি উঠে ভেতরবাড়ির দিকে গেলাম। যা ঘটছে তা নিজের চোখে দেখা দরকার।

ভেতর বাড়িতে গানের ফাঁকে ফাঁকে আলাপ চলছে। গিয়ে দেখি পূর্বপরিকল্পনামত সুফিয়া বানু তার অবস্থান নিয়েছেন আফিয়া চাচী আর হেনার মা কুসুম চাচীর মাঝখানে। আলোচনার বিষয় সেই একই। শোয়েব আর হেনার জোড়া তৈরি হয়েছে সাত আসমানের ওপরে। তারা আগেই জানতেন, ইত্যাদি।

গ্রামের দিকে অবস্থাসম্পন্ন বাড়ির কাজের লোকেদের মাঝে দু’টো শ্রেণী আছে। এর মধ্যে প্রথম শ্রেণীর কাজের মহিলারা ঘরের স্ত্রীদের সাথে থাকেন। অনেকটা সহচরীর মত। বিশেষ করে সন্তান জন্ম এবং প্রাথমিক লালন পালনের সময়। সুফিয়া বানু এই প্রথম শ্রেণীর।

আমি দরজার আড়ালে দাঁড়ালাম। তিনিই প্রথম কথাটা পাড়লেন। ‘হ তা ত ঠিক অই। হ্যারা গ্যাঁদাকাল থেইকাই একডা আরেকডারে ছাড়া চলবার পারে না। আর তোমরাও যেমন ছিলা! দুই জায়ের মইদ্যে এত মিল আমি আর কোন বাড়িত দেহি নাই। দুইজনাই দুই বাচ্চার মা।’

কথায় কথায় গল্প বাড়ে। সুফিয়া বানু আবার কক্ষ নেন। ‘হেনা যহন অইলো, তহন তো শোয়েবের বয়স এক মাস। দুধ খাওয়া বাচ্চা। একবার অইলো কি আফিয়া ভাবীর বেজায় জ্বর। তাপে উথালি পাথালি করতেসে। আমার কাছে তহন তিনডাই বাচ্চা। আমগো শোয়েব আর হেনার লগে পাশের বাড়ির কাশু। তো অইলো কি, শোয়েবে ধরলো কান্দন। থামাইবার পারি না। অইসুম আঁতুর ঘরের তে কুসুম ভাবী সবে বাইরে আইসে। হ্যারে কইলাম - ভাবী, শোয়েবরে এট্টু কোলে নেও। বাচ্চা মানুষ, মা মা গন্ধ না পাইলে থামবো না। কুসুম ভাবী করলো কি, শোয়েবরে মুখে নিয়া দুধ দিল। আর বাচ্চাটা চুপ। এই না অইলে দু’জনার…।’

এর পরের কথাগুলো আর শুনিনি। শোনার দরকারও ছিল না। শেষবার উঁকি মেরে দেখলাম কুসুম চাচীর মুখ অন্ধকার। তার মনে পরেছে।

কথা এক কান দু’কান পাঁচকান হয়ে যখন উঠোনে পৌঁছুল তখন আমি আর এই বাড়িতে নেই। আমি গিয়েছি গনিচাচাকে খুঁজতে।

দাবা খেলায় ঘুঁটির মধ্যে সবচে’ বিপজ্জনক কোনটা জানেন? ঘোড়া। কারণ ঘোড়ার চাল আড়াই ঘর। গণি চাচা আমার ঘোড়া। এই খেলায় জিততে হলে আড়াই চালের বিকল্প নেই।

গণি চাচা সময় মতো এসে পড়লেন। সাথে স্থানীয় মসজিদের ইমাম। ততক্ষণে উপস্থিতদের মধ্যে তুমুল আলোচনা চলছে। সব শুনে ইমাম সাহেব ঘোষণা দিলেন এই বিয়ে শরীয়ত বহির্ভুত। দুধমাতার কন্যার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া নাজায়েজ। হারাম।

কাচ্চি বিরিয়ানীর গন্ধে এলাকাটা মৌ মৌ করছে। আমার ক্ষুধা নেই।

---------------

(৫)

আমি দরজাটার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। সানাই বাজছে না, সানাই ওয়ালারা অনেক আগেই চলে গিয়েছে। অতিথিদের কেউও নেই। এই বিয়ে নিয়ম রক্ষার বিয়ে। এতে কবুল শোনার কোন আনন্দ নেই।

আমার মাথায় শোয়েবের পাগড়ি। দরজার ভেতরে অপেক্ষা করছে শোয়েবের প্রেয়সী। শোয়েবের ভালবাসা।

গণি চাচা যা করেছেন নিজ দায়িত্বে করেছেন। আমি শুধু তাকে এনে ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় উপস্থিত করেছি। এরপর ঘটনার স্বাভাবিক প্রবাহকে বাধা দেই নি।

সুফিয়া বানুর ব্যাপারটা আলাদা। তার ছেলের চাকুরি হয়েছে। হাজার দশেক টাকা বেতন। পঞ্চাশ হাজার টাকার জামানর হলেই যোগ দিতে পারবে। তার অভাব অনটনের সংসারে বহুদিন পর অল্প একটু স্বস্তির বাতাস। ঢাকা থেকে ফিরেই আমি বাবার ক্যাশবাক্স থেকে কিছু কিছু করে টাকা সরিয়ে রাখছিলাম। কাজে লেগেছে।

‘বাবা কাশেম, আমারে দিয়া তুমি যে পাপ করাইলা’, টাকা হাতে ভাঙা গলায় বললো সুফিয়া বানু, ‘আল্লায় আমারে কোনদিন মাপ করবো না।’
পেছনে থেকে তাকে মাথা নিচু করে চলে যেতে দেখলাম। আর মনে মনে বললাম – ‘আমাকেও কেউ ক্ষমা করবে না। আমি কারুর কাছে ক্ষমা চাইবো না।’

বিকেল বেলায় নাটকটার শেষ অঙ্ক অভিনীত হয়েছে। রশিদ চাচা ততক্ষণে পাগলপ্রায়। তার মেয়েকে তা’হলে কে বিয়ে করবে? কানাকানি শুরু হয়ে গিয়েছে। এত আয়োজন করে গ্রামের মানুষের সামনে আজ কি মাথাটা হেঁট হয়েই যাবে? এ বিপদ! মহা বিপদ!

আমি এগিয়ে গেলাম। আমি তো আছি। আমি দু’জনেরই বন্ধু। এসময়ে আমি সামনে না এগিয়ে গেলে কে যাবে?

হেনা কবুল বলার সময় কেঁদেছিল কিনা তা আমার জানা নেই।

বাসর ঘরের দরজা খুলে ভেতরে পা বাড়ালাম। ঘরে উজ্জ্বল আলো। হেনা বসে আছে বিছানার মাঝে। আজ থেকে তার স্পর্শ নেবার অধিকার শুধু আমারই।

দরজা বন্ধ করে আমি এগিয়ে গেলাম। সুফিয়া বানুর কথাগুলো আমার কানে বাজছে। ‘বাবা ঐটা শোয়েব ছিল না। তুমি ছিলা। তুমি এই পাপ কামডা আমারে দিয়া করাইয়ো না।’

আমি করিয়েছি। এই স্পর্শের লোভে। জিতে যাবার লোভে।

আমি তো বার বার হেরে যাই। এবার না হয় জিতলাম!

-----

(সমাপ্ত)

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৫:২১

গিয়াস উদ্দিন লিটন বলেছেন: আপনার লিখার হাত বেশ !!!
চালিয়ে যান । +++++++++++++++++

২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৫:২৯

গেন্দু মিয়া বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই। :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.