নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

হাসান ইকবাল-এর লেখালেখির অন্তর্জাল।

হাসান ইকবাল

.... ছেলেবেলার দুরন্ত শৈশব কেটেছে নেত্রকোনায়। আর সবচেয়ে মধুর সময় ছিল সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার দিনগুলি। আর এখন কাজ করছি সুবিধাবন্চিত শিশুদের জন্য একটি স্পানিশ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায়।

হাসান ইকবাল › বিস্তারিত পোস্টঃ

ভাষিক নিপীড়ন ও নারী

০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ১০:১৩

সমাজের কাছে শৃঙ্খলিত নারী। পদে পদে বাধা নিষেধ আর বন্ধ দরোজার মুখোমুখি হতে হতে বেড়ে ওঠা নারীর জীবনে কখনো কখনো নেমে আসে গভীর অন্ধকার। অনাকাঙ্খিত, অমানবিক যেসব ঘটনার তীব্র ঝড়ঝাপটা নারীর জীবনে আসে তা অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক দুটোই। নারীর একাকীত্ব, অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম, বিশ্রামের ও নিভৃতির অভাবের মতো মনোজাগতিক আরেকটি যে নিপীড়ন তা হলো ভাষাগত নিপীড়ন। যে নিপীড়ন নারীর নারী শরীরে নারকীয় আক্রমন না করলেও মনোজগতের সমস্ত সৃজনশীলতাই ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলে। এ সময়ের নারীরা ঘোমটার আড়াল সরিয়ে সামনে এগিয়ে আসলেও সংসারের সংকীর্ণ পরিসরে নারী কলটেপা পুতুলের মতো নিয়ম মাফিক যাপিত জীবন। নারীর ব্যক্তিত্বহীন, মর্যাদাহীন সংকুচিত জীবনে পুরুষতন্ত্র ভর করে তার আধিপত্যবাদ নিয়ে। নারীকে পুরুষের প্রতি আনুগত্যের ভূমিকা বজায় রেখে চলতে হয় সামঞ্জস্যহীনভাবে ‘স্বামী যেখানে ঝাঁঝালো সোডা ওয়াটার চায়, স্ত্রী সেখানে সুশীতল ডাবের জল এনে উপস্থিত করে।’ পারিবারিক, সামাজিক বাঁধা ছাড়াও নারীর পেশিশক্তির অপেক্ষাকৃত কম ভূমিকার প্রতি সম্যক উপলব্ধি ও সচেতনতা এবং ন্যায়ের শাসনের সুদূর পরাহত অবস্থা সমাজের দানবদের প্ররোচিত করে নারীর ওপর জুলুম চালিয়ে যেতে, আর নারীকে প্রায়শই তা উদ্বুদ্ধ করে মুখ বুঁজে সয়ে যাবার জন্য। নারী: এক কলটেপা পুতুল!

পুরুষের ভাষিক অবরোধ:
ভাষার মাধ্যমে মানুষ শুধু তার মনের ভাব প্রকাশই করে না, অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। নিজস্ব সংস্কৃতির নানান অনুষঙ্গ আদান-প্রদান করে। এই ভাষার দ্বারাই সৃজনশীল ক্ষমতার প্রকাশ ঘটায়। দেশে দেশে-সমাজে, ভাষার যেমন পার্থক্য বিদ্যমান। এই ভাষাই মানুষের সমাজ অর্থনীতি-বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটায়।

সমাজে আমরা নারীকে যেভাবে মূল্যায়ন করে থাকি, আমাদের ভাষাতেও তার প্রতিচ্ছবি পরিলক্ষিত হয়। নারীর জন্য অবলা, কোমল, নরম, লজ্জাবতী এসব শব্দ তৈরি করা হয়। অন্যদিকে পুরুষকে পৌরুষত্বের বীর গাঁথায় বীর বা শক্তিমানের সারিতে রেখে নারীকে রাঁধুনি, গৃহিনী, মায়াবতী, আখ্যা দিয়ে চার দেয়ালের অতন্ত্র প্রহরী করে রাখে। আর ভাষাগত অদৃশ্য দেয়ালের অবরোধে নারী হয়ে পড়ে অসহায়। যুক্ত হয় পুরুষতান্ত্রিক ভাষা, গালি ও নেতিবাচক শব্দের উৎপীড়ন, নিপীড়ন।

আমাদের ভাষার ভাব, শব্দ, ধ্বনি, অর্থ প্রভৃতি গড়ে উঠেছে সমাজ, রাষ্ট্র ও পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা দ্বারা। সমাজের প্রধান নিয়ন্ত্রক হচ্ছে পুরুষ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে পুরুষ, আধিপত্য বিস্তার করে পুরুষ, উপভোগ করে পুরুষ, মালিকানা ক্ষমতায়নকেই মর্যাদা দেয়। নারী পায় অবহেলা, অমর্যাদা, অপমান, লাঞ্ছনা, বঞ্জনা আর নিগ্রহ। তাই নারীর জন্য এ সমাজ যেন পৃথক ও দুর্বল ভাষাভঙ্গি তৈরি করে দিয়েছে। আমাদের সমাজে নারীর পারিবারিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নেই বলেই তার ধ্বনিগত বা বাকস্বাধীনতাও নেই। শিক্ষার অভাব, কুপমণ্ডুকতা, কুসংস্কার এবং পুরুষতান্ত্রিক কারণে নারী পিছিয়ে আছে। ভাষা যেমন ভাব প্রকাশের মাধ্যম, তেমনি কখনো নির্যাতনের মাধ্যম হয়েও দাঁড়ায়। পুরুষ নারীকে শারীরিক নির্যাতন যেমন করে, ঠিক তেমনি করে থাকে ভাষা দিয়ে নির্যাতন। কাব্যকথায় তাই বলা যায়-
হাতে যদি না মারিত,
শত মারিত ঠোঁটে।


হাতে শারীরিকভাবে নির্যাতন না করতে পারলেও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়- ঠোঁটে-মানে- অশ্লীল ভাষার মাধ্যমে। অশ্লীল, অকথ্য, গালিশব্দের মাধ্যমে কিভাবে নারীকে অবদমন, হেয় প্রতিপন্ন, তুচ্ছ, খাটো, নিন্দা বা অপমান করা যায় তার জন্যই পুরুষ তৈরি করে নিয়েছে আলাদা ভাষা যে ভাষায় চালায় নারীর প্রতি ভাষিক নিপীড়ন। গালিশব্দের ভাষা দিয়েই পুরুষ গড়ে তোলে নারীর প্রতি ভাষিক অবরোধ।

তাই এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে অনুমেয় যে, আজ নারীকে কেবল পেশিশক্তি দিয়েই নয়, ভাষাশক্তি দিয়েও অসম্মানিত এমনকি লাঞ্ছিতও করা হয়। পুরুষ তার পৌরুষত্বের প্রকাশ কেবল শারীরিক নির্যাতন দিয়েই নয়, ভাষাকে আশ্রয় করে মানসিক নির্যাতন করে যা Verbal abuse বা মৌখিক নির্যাতন। ইভটিজিং নামে নারীকে ‘উত্ত্যক্ত’ করার এবং বিরক্ত করার পারিভাষিক শব্দ পর্যন্ত তৈরি হয়েছে। খাদ্যদ্রব্য, ফল, বাদ্যযন্ত্র, অস্ত্র, এ সব বিষয়কে বিকৃত অর্থে ব্যবহার করা হয় নারীকে ভাষিক নিপীড়ন করার জন্য। যেমন- রসে ভরা কমলা, টাইট মাল, কচি ডাব, এটম বোম, মিষ্টি তেঁতল, তানপুরা, গাড়ির চেসিস, ডবল ডেকার, গোলাপ জাম, কোম্পানির মাল, মাগির গ্যারেজ বড়, কালনাগিনী, কাশবন, কচিমাল, ইন্ডিয়া গেট, জাম্বুরা, গোলাপী আপেল ইত্যাদি।

উপরোক্ত শব্দগুলো নারীকে উত্ত্যক্ত করার জন্য ব্যবহৃত হলেও নারীর দেহের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সাথে সাদৃশ্য করে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে। সে উপস্থাপনটা যৌনতা, কামুকতা ও নোংরামিতে ভরপুর। নারীর জন্য এ বিষয়গুলো অপমানসূচক। বাংলা ভাষায় এসব শব্দের সাথে যুক্ত হয়েছে কিছু বিদেশী ইংরেজি শব্দ। এ শব্দগুলোর বাড়ছে প্রতিনিয়ত। বাংলা ভাষায় নারী কর্তৃক পুরুষকে বিরক্ত করার কোনো শব্দ নেই। কিন্তু পুরুষ যে নারীকে বিরক্ত করে তার জন্য সমাজ তৈরি করেছে অসংখ্য শব্দ। এই শব্দগুলো দিয়ে পুরুষ সূচনা করে নারীর প্রতি ভাষিক অবরোধ।

পুরুষ তাহলে কিভাবে করে সেই ভাষিক অবরোধ। পুরুষ যে অকথ্য, অশ্লীল শব্দ ভান্ডার তৈরি করেছে তাতে নারীর কোন প্রবেশাধিকার নেই। ভাষার দখলদারি, ভাষার আধিপত্য পুরোটাই পুরুষের। সেজন্য এসব শব্দভান্ডারকে লিঙ্গান্তর করা হয়েছে, যাতে করে তা কেবলমাত্র নারীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হয়। নারী এখনও অর্ধেক মানুষ। নারীকে পরিপূর্ণ সত্ত্বা হিসেবে পরিস্ফুটিত হতে দেয় না পুরুষ শাসিত সমাজ। নারীকে আলাদা সত্ত্বা হিসাবে রাখতে পারাটাই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কৃতিত্ব, তাদের আধিপত্যবাদ বজায় রাখার জন্য। কাজেই নারীকে নিয়ে তৈরি হয়েছে ভাষাগত লৈঙ্গিক রাজনীতি। বাংলাভাষায় নেতিবাচক শব্দগুলো তৈরি করা হয়েছে নারীকে ঘিরেই। গালি শব্দ (slang word) থেকে শুরু করে নিত্যস্ত্রীবাচক শব্দগুলোর অধিকাংশই নারীকে অধস্তন করার মানসে চয়ন করা। নারীর প্রতি ভাষাগত এই বিভাজন, ভাষাগত এই অবরোধ লিঙ্গবৈষম্য তৈরি করেছে।

বাংলা ভাষার গবেষক সুকুমার সেন তার বাংলায় নারীর ভাষা প্রবন্ধে কিছু শব্দের কথা উল্লেখ করেছেন- যা থেকে পুরুষ ও নারীর সামাজিক অবস্থান স্পষ্ট হয়, যেমন- অনাদিষ্টি, লক্ষীছাড়া, আঁটকুড়ো, আড়ি, আদিখ্যেতা, কুটনী, খোঁটা, গাদী, গুমর, গা, ছিরি, ঠমক, ঢঙ, দেমাক, ন্যাকা, পোয়াতি, বিয়েন, কুট্টি, মিনসে, রাঁড়, রাঁড়ী, সেয়ানা, সোমত্ত, সোহাগ, সই ইত্যাদি। নারীর ক্ষেত্রে বাংলায় বিশেষ্য বাক্যাংশ এবং ক্রিয়া বাক্যাংশ প্রয়োগ কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে। যেমন- বিশেষ বাক্যাংশ-কাঁচা বয়েস, কচি খুকি, কোলের ছেলে, চোখের বালি, দাঁতে বিষ, ননীর পুতুল, নাড়ির টান, পেটের ছেলে, মাথার দিব্যি, রাঙা বৌ, হাঁড়ির খবর, পাতা কুড়নী, ঝগড়াটে, সাতে পাঁচে না থাকা, সাত পাঁচভারা ইত্যাদি। ক্রিয়া বাক্যাংশ-ঝেঁটিয়ে বিদেয় করা, বানের জলে ভাসা, বিয়ের ফুল ফোটা, মুখে খই ফোটা, হাঁড়িতে স্থান দেয়া, কেঁদে হাট বসানো, সই পাতানো, পাকা চুলে সিঁদুর পরা, হাঁড়ি ঠেলা, পরের মুখে ঝাল খাওয়া, মাথা কোটা ইত্যাদি।

বাংলা ভাষার শব্দ প্রয়োগে ও সম্বোধন নারীকে সম্মানিত তো নয়ই বরং হেয় করা হয়েছে। বাংলা ভাষায় অজস্র শব্দ আছে, বা আবহমান কাল থেকে খুব অন্যায়ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। অভিধান খুললেই দেখা যাবে সেখানে পুরুষবাচক অথবা স্ত্রীবাচক শব্দের অর্থ উপস্থাপনার মধ্যে মত পার্থক্য। নারীর প্রতি মানবিক সম্মানবোধের ধারণাটি পর্যন্ত আমরা সমাজে স্থাপন করতে পারিনি। তাই জেন্ডার সমতার ভিত্তিতে বাংলা ভাষাকে ব্যবহার করার মানসিকতাও আমাদের তৈরি হয়নি। তবে ক্ষীণ ধারায় হলেও চেষ্টা চলছে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের একটা বড় ভূমিকা আছে। তারা যদি বিষয়টিকে সচেতনভাবে আমাদের দেশের মানুষের সামনে নিয়ে আসে তবে পরিবর্তন দ্রুত হওয়া সম্ভব।

আমাদের সমাজ সৃষ্টি করেছে এমন কিছু শব্দ যা নারীকে বেঁধে দিয়েছে লজ্জা আর অসম্মানের কালো তিলক। পুরুষনিয়ন্ত্রিত সমাজে পুরুষ নারীর জন্য শুধু শব্দই তৈরি করে না তাকে মানবিক মর্যাদা থেকে বঞ্চিতও করে। পুরুষ শুধুমাত্র যে নারীকেই নিয়ন্ত্রণ করছে তা নয়, তার ভাষাকেও নিয়ন্ত্রণ করছে। ভাষার এই অবরোধ নারীর স্বাভাবিক বিকাশ, মত প্রকাশের অধিকারকে হরণ করছে পুরোপুরিভাবে। সুকুমার সেন একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন,
‘নারীর শব্দভান্ডার পুরুষের শব্দ ভান্ডার থেকে আলাদা। নারী পুরুষের তুলনায় অনেক কম শব্দ ব্যবহার করে।’

শ্রেণীবিভক্ত সমাজে নারীকে ঘরে পুরুষের সেবায় আবদ্ধ রাখলে সেটাই স্বাভাবিক। তার কর্মগজগত যেমন বৃদ্ধিতে পুরুষের উদ্যোগ-উৎসাহ কম, তেমনি নারীর শব্দের সীমানাও হয়ে পড়ে অনেক ছোট। নারীর যত ক্ষমতায়ন ঘটবে, উৎপাদন ও অর্থ উপার্জনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হবে, পুরুষের মতো পাবলিক ডোমেইনে এসে বাইরের জগতকে ঘিরে নিজের মতো করে ভাবতে পারবে, আমাদের ভাষায় তত দ্রুত নারী-পুরুষের বৈষম্য কমবে।

একটি বিষয়ের এখানে অবতারণা করা যেতে পারে। শুধু ভাষিক নিপীড়নই নয়- দেহভাষা, অঙ্গভঙ্গি করেও পুরুষ কিছু একটা প্রকাশ করতে চায়। যে সব gesture- এ নারীকে ভাবা হয় ভিন্ন একটা প্রাণী। সমমনা নয় সম আদর্শের মানুষ নয়। যাদেরকে দমন-পীড়ন করা যায় নেতিবাচক দেহভাষা প্রয়োগ করা যায়।

আমাদের সমাজে যেসব পুরুষ স্ত্রীর কথামতো চলে, তাদের বলা হয় ‘স্ত্রৈণ’। এই শব্দটি প্রয়োগ হয় পুরুষের জন্য নেতিবাচক বা অসম্মানজনক হিসেবে। বিষয়টি এরকম, যেন-নারীর কথা পুরুষের শুনতে মানা। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহৃত বেশ কিছু শব্দ আলোচনা করলে দেখতে পাবো চেয়ারম্যান, সভাপতি, রাষ্ট্রপতি, মেম্বার, লিডার, ক্যাডার এ শব্দগুলো পুরুষবাচক। এর কোনো স্ত্রীবাচক শব্দ নেই। জেন্ডার বৈষম্য নিরোধকল্পে এসময়ে আমরা চেয়ারপারসন, সভাপ্রধান শব্দ প্রয়োগ করে থাকি। এভাবেই একটি সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এসব শব্দাবলি বদলে দেয়া সম্ভব। সম্ভব নারীকে সম্মানিত করা।

ভাষিক নিপীড়ন- নারী যেখানে ভাষাহীন:
সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান ভাষা। এই ভাষায় অনেক সময় দেখা যায় ভিন্নতা ও বৈচিত্র, যার বিদ্যমান পরিস্থিতির প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে ভাষায়। প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত নারী ও পুরুষের মধ্যে যে সামাজিক পার্থক্য রয়েছে তা ভাষার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে পুরুষের শক্তিশালী অবস্থানের মতই তার ভাষাও শক্তিশালী, পেশল, দৃঢ় ও দম্ভ প্রকাশক। অন্যদিকে নারীর ভাষা কোমল, দুর্বল, নমনীয় অধস্তন। এর কারণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থান, পুরুষ নারীকে কেবল পেশিশক্তি দিয়ে নির্যাতন করে তা নয়, বরং ভাষাশক্তি দিয়েও নির্যাতন করে। নারী হয়ে পড়ে মূঢ়, মুক ভাষাহীন। আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে আমাদের সমাজব্যবস্থা এমনই এক পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে যেখানে প্রায় সব বয়সের সব শ্রেণির পরিচিত-অপরিচিত সকল পুরুষই নারীকে ভাষাশক্তি দিয়ে নির্যাতনের ক্ষমতা রাখে।

পুরুষ সে ক্ষমতার ধারক হয়ে নিজের সৃষ্টিকে নিজেই স্তর করে নিজেকে মনে করে সদর্থক বা ইতিবাচক গুণের সমষ্টি পিতৃতন্ত্র বা পুরুষ যে সাহিত্য, সংস্কৃতি তৈরি করেছে সাহিত্যের সে ব্যাকরণে নারী সর্বদাই কদর্থক বা নঞর্থক, ম্রিয়মাণ, নিরুত্তেজ, নির্বীজ অমেধাবী এবং ব্যক্তিত্বহীন। হেলেন সেক্সাস বা সিজো পুরুষ নারী চরিত্রের তুলনামূলক দ্বিমুখি বৈপরীত্যের ছক রচনা করে দেখিয়েছেন পুরুষের সৃষ্টি ভাষার সুচতুর দ্বিমাত্রিক কৌশল।
পুরুষ : নারী
সূর্য - চন্দ্র
সংস্কৃতি - প্রকৃতি
দিবস - যামিনী
মেধা - আবেগ
বুদ্ধিসত্ত্বা - অনুভূতিশীলতা
প্রজ্ঞা - বেদনা
সক্রিয় - নিস্ক্রিয়
পিতা - মাতা।

পুরুষতন্ত্রের ভাষিক কৌশলে তার সাহিত্যে নারী পরিণত হয় নিষ্ক্রিয় নিচু শ্রেণী গোত্রের, পুরুষ সক্রিয় এবং সবসময় নিয়ন্ত্রক। নারী অবলা অপ্রত্যক্ষ নেতিবাচক আবেগ সর্বস্ব নির্ভরশীল চরিত্র হিসেবেই সাহিত্যে নিয়ত বর্তমান। এবং বাস্তব সমাজের নারী ওই সাহিত্যের নারীরই প্রতিরূপ। পুরুষের এই লক্ষ্য এবং আজীবন কাম্য।

ভাষিক নিপীড়ন গালি শব্দের রকম ফের:
এতটুকু নিশ্চয়ই আমরা স্পষ্টভাবে বুঝে গেছি মনস্তাত্ত্বিকভাবে নারীকে অবদমন করা, নিপীড়ন করার প্রধান যে হাতিয়ার পুরুষ ব্যবহার করে তা হলো ভাষা। যে ভাষা মূল ভাষার স্রোত থেকে একটু আলাদা। যে ভাষায় অশ্লীলতা, যৌনতা, কামুকতা, অকথ্য শব্দ ভান্ডারে ঠাসা কুরুচিপূর্ণ ও অশোভন বিষয়গুলো স্থান পেয়েছে। ভাষাগত নিপীড়নের গালিশব্দের এই ভান্ডার ব্যাকরণের কোন নিয়মনীতি ছাড়াই চলে করে ফেলা হয় স্ত্রীবাচক শব্দ নারীকে সংশ্লিষ্ট করে, নারীকে কেন্দ্র করে। এসব শব্দ নারীর মনোজগতকে মারাত্মক ভাবে নাড়া দেয়, সামাজিক ভাবে অপমানিত, অপদস্ত ও হেয় প্রতিপন্ন হয়। নারীকে অপদস্ত করার অনেক শব্দই প্রচলিত আছে, যেমন- বেশ্যা, পতিতা, রক্ষিতা, কুটনী, ছিনাল, খানকী, মাগী, অসতী, বাইজী, বন্ধ্যা, ঢেমনী মাগী প্রভৃতি। পুরুষবাচক এমন শব্দ খুঁজে পাওয়া বোধ হয় কঠিন হবে যতটা পাওয়া যায় স্ত্রীবাচক শব্দ। বাংলাদেশে প্রচলিত গালিগুলো খেয়াল করলে দেখা যায়, তা নারী বা পুরুষ যার উদ্দেশ্যেই নিক্ষিপ্ত হোক না কেন, গালির মাধ্যমে যাকে আক্রমণ করা হয় সে একজন নারী, হতে পারে সে মা, বোন বা স্ত্রী। কোন পুরুষকেও অপদস্ত করার সবচেয়ে কার্যকরী পথ হচ্ছে তার মা, বোন, কন্যা বা স্ত্রীর সতীত্ব নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন বা তাদের সাথে কারও যৌন সম্পর্ক স্থাপনের ইঙ্গিত।

বাংলা ভাষায় পুরুষের কামুক দৃষ্টির কাছে নারীকে সম্বোধন করার জন্য প্রতিনিয়ত সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন শব্দ। মাল, ফাটাফাটি, জিনিস, চিজ, কোকাকোলা, মাখন, ডালিম, কমলা, কচি ডাব আরো বহু শব্দ। আমাদের সমাজে কলঙ্কিনী হয় শুধু নারীরাই যেনো কলঙ্ক শুধু নারীর জন্যই। সতী হয় শুধু নারীই, কেননা আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সতীত্ব থাকবে কেবল নারীর, পুরুষের নয়। সৎ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ সতী। সৎ হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যে সত্যবাদী, বিশ্বস্ত, ভালোমানুষ। আর সতীর বিচারে সত্যবাদিতা, বিশ্বস্ততা, ভালোমানুষী কোন মানদন্ড নয়, বরং সতী হচ্ছে সেই যে তার শরীর প্রতিনিয়ত পবিত্র রাখে তার স্বামী দেবতার জন্য, পুরুষদের জন্য।

আমাদের বাংলা ভাষায় রোমান্টিক কবিদের একটি প্রিয় শব্দ হচ্ছে রমণী অর্থাৎ যাকে রমণ করা যায়। এই শব্দটির কোনো পুরুষবাচক শব্দ নেই। এই জাতীয় কতগুলো শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে নারী প্রতিনিয়ত শিকার হয় নির্যাতনের। নারী হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছে সমাজের সকল স্তরে এবং এক পর্যায়ে নারী নিজের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে এবং মেনে নিতে বাধ্য হয় নারী শোষণ এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে।

ইদানীং নারীর উপর যৌন নিপীড়নকে সংজ্ঞায়িত করা হচ্ছে ‘ইভটিজিং’ হিসেবে। আর উত্ত্যক্তকারীকে বলা হচ্ছে ‘রোমিও’। যখন বখাটেদের প্রচন্ড উৎপাতে তথা ভাষিক নির্যাতনের শিকার হয়ে নারীরা বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার পথ তখন তাদেরকে যৌন নিপীড়ক না বলে জামাই আদর করে রোমান্টিক ‘রোমিও’ উপাধি আখ্যা দেয়া হয়। এবং নারীর যৌনতাকে ইঙ্গিত করে অশালীন ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে নারীকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়াকে যৌন নিপীড়ন না বলে ‘ইভটিজিং’ বলাটা আমার বোধগম্য নয়। বরং অপরাধ অপরাধীর পক্ষেই যায় যা নারীর প্রতি ভাষিক নিপীড়নের আরেকটি দৃষ্টান্ত। নারীবাদী চর্চায় দেখা গেছে, ভাষা একটা এজেন্সী, যার দ্বারা নারীকে দমন করা হয়। দীর্ঘ সময় ধরে নারী উন্নয়ন ডিসকোর্স ভাষা দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে নারীকে অধস্তন রাখার পাটাতন।

ভাষিক নিপীড়ন প্রচলিত ডিসকোর্স :
নারীর ভাষাগত নিপীড়নের প্রথম জায়গাটি হলো তার পরিবার, তাছাড়া কর্মক্ষেত্রতো আছেই। ভাষার শালীনতার ক্ষেত্রে আমরা ইন্টেরিয়র মনোলগে যে সীমানা থাকা উচিত তা অতিক্রম করে ফেলি, আর বিপত্তিটা সেখানেই। ভার্জিনিয়া উল্ফ নারী-পুরুষের ভাষা ও লেখার ধরনে যে পার্থক্য রয়েছে সে বিষয়ে আলোকপাত করেন। ডর্থি রিচার্ডসন এর উপন্যাস ‘রিভলভিং লাইট্স’ (১৯২৩) রিভিউ করে নারীদের শব্দগুলো আলাদা করে ব্যাখ্যা করেন- যা কিনা পুরুষদের ভাষা থেকে আলাদা। আমাদের প্রচলিত সমাজব্যবস্থার এখনো ভাষাগত কিছু পার্থক্য খুঁজে পাই। গ্রামাঞ্চলে এখনো নারীরা তাদের স্বামীদের ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করে থাকে। ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করলে বেয়াদপ, আদব-কায়দাহীন নারী বলে ভৎসনা করা হয়।

গ্রামাঞ্চলে এখনো বয়স্ক মহিলারা তাদের স্বামীর নাম মুখে নেয়না। ইশারায় ডাক হয় ‘ওগো শুনছেন, অমুকের বাবা।’ স্বামীর নাম মুখে নিলে পাপ হয় স্ত্রী কখনো স্বামীর সমকক্ষ নয়। তাই নাম ধরে ডাকতে পারে না। এটা মহিলাদের জন্য আস্পর্ধা। অথচ পুরুষরা নাম ধরে ডাকার পাশাপাশি তাদের মনের কুপমন্ডুকতা জাহির করার জন্য খানকী, মাগী, ছিনাল এই শব্দগুলো বলতে সামাজিক কোন বিধি-নিষেধের মধ্যে পড়তে হয় না।
এবার কিছু উদাহরণ দেয়া যেতে পারে-
‘নিলুর বয়স ত্রিশ অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। গ্রামে তার বেড়ে ওঠা। দিন মজুর বাবা লেখাপড়া শেখাতে পারেনি দারিদ্রতার কারণে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সীমানা পেরিয়েছিল এটুকুই। গত পাঁচ বছর ধরে নিলুকে বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে তার বাবা। কোন পাত্রই আসছেনা অভাবের সংসার দেখে। সবচে বড় কথা হলো, পাত্র পক্ষের বিশাল দাবী দাওয়া মেটানোর সামর্থ নিলুর বাবার নেই। নিলু তার জীবন সম্পর্কে সচেতন স্বাক্ষর জানা মেয়ে। সে নিজে ছোট ছেলে মেয়েদের পড়িয়ে মাসে হাজার টাকা রোজগার করলেও সংসারের খরচে তাকে সামিল হতে হয়। তবে নিলু কারো মুখাপেক্ষী নয়। অন্যের ঘাড়ে বসে খায়না, কারো বোঝাও নয়। তবু প্রতিবেশী নারীদের কথায় তার কান জ্বালাপালা করে
‘আইব্যা মাইয়া, বিয়া অয়নাই এহনো- পরেতো মাগিবাজি কইরাও ভাত পাইবনা।’
ভাষাগত নিপীড়নের এরকম সমাজচিত্র বিরল নয়। এটি গ্রাম-বাংলার চিরায়ত প্রপঞ্চ। সেখানে পুরুষাধিপত্যের প্লাটফরমে এসে দাঁড়িয়েছে নারীরাও। সমাজের কিছু নারীও পুরুষাধিপত্যকে মেনে নিয়ে অন্য নারীদের সে বশ্যতা স্বীকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করে।

সে ক্ষেত্রে আরেকটি মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপারও কাজ করে। একজন নারী বিয়ে হয়ে স্বামীর সংসারে এসে তার শ্বাশুড়ী দ্বারা নির্যাতিত হন। সে নির্যাতনের রেশ থেকে যায় সারাজীবনের পরতে পরতে। এই নারীর পুত্রবধূ যখন এই পরিবারে নববধু হয়ে আসেন তিনি তখন শ্বাশুড়ীর ভূমিকায় দায়িত্ব পালন করেন। নববধূর উপরও চলে ভাষাগত নানান নিপীড়ন। অনেক সময় যৌতুকের টাকা চাওয়ার জন্য নববধূকে মারধোরও করা হয়। নারীর মনস্তাত্ত্বিক এই বিষয়টি বংশ পরম্পরায় চলতে তাকে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীর এই ভূমিকাকে সাধুবাদ জানায় কারণ তাদের কাজগুলোই নারী বাস্তবায়ন করছে। যৌতুকের বলি হয়ে যে কত নারীর জীবন বিপন্ন হচ্ছে তা সংবাদপত্রগুলোতে প্রকাশিত রিপোর্টগুলো পড়লে সহজেই অনুধাবন করা যায়। যৌতুকের বলি নারী শারীরিকভাবে নির্যাতিত হবার পাশাপাশি মানসিকভাবে ভাষাগত নিপাড়নেরও শিকার হন। ভাষাগত নিপীড়ন চূড়ান্ত মাত্রায় পৌঁছালে তারপর চলে শারীরিক নির্যাতন।
‘মাগী, তুই বিয়া বই্ছলে কেরে। তর বাপের ক্ষেমতা সামর্থ নাই কামলা দিয়া গাই কিন্যা দিতে ক।’
স্বামী যখন স্ত্রীকে এই কথা বলে তখন এই গ্রামীণ গৃহস্থ নারীর নির্ভরতার জায়গা আর কোথায় থাকলো। সাথে শ্বশুর কিংবা শ্বাশুড়ী কম যায়না
‘মাগিবাজি করবার ইচ্ছে যখন হইছিল তখন মনে আছিল না। রাইত পুরাইলেই যে পেট ফুলাইছস পেট ফুলাউরির গরে পেট ফুলাউরি এই খরচ কি আমার পুত দিব তর বাপরে ক হাঙ্গা যখন দিছে টেহাও দিত অইব- গাইও কিন্যা দিতে অইব।’

এই কথোপকথন তরজমা করার প্রয়োজন পড়বে না বোধ হয়। সচেতন পাঠক এতটুকু বুঝতে নিশ্চয়ই কষ্ট হবার কথা নয় এসব অকথ্য ভাষায় যখন শোনানো হয় একজন নারীর আত্মসম্মানবোধ নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকারটুকু তারা কেড়ে নেয়।
‘মধ্যবিত্ত পরিবারের কাজল (ছদ্মনাম)-এর বিয়ে হয় ষোলো বছর আগে ব্যবসায়ী এক স্বামীর সাথে। বছর দুয়েক যাবার পর কোলে আসে ফুটফুটে শিশু। শিশুটি মারা যায়। তারপর দু’দুবার গর্ভপাত ঘটে । ইতিমধ্যে এই দম্পতির কোলে সন্তান না আসায় শুরু হয় মানসিকভাবে নির্যাতন। পরিবারের প্রধান কর্তা শ্বশুর মহাশয় বলেন
‘এই মাইয়ারে তালাক দে। এই মাইয়ারে ভাত কাপড় দেওনের চাই আত্তি পোষণ অনেক ভালা।’
তারপর শুরু হয় খাবারের উপর হস্তক্ষেপ। একটির বেশি তরকারী খাওয়া যাবে না। অসুখ-বিসুখে ডাক্তার চিকিৎসা বন্ধ। সাথে অকথ্য ভাষার গালি। ভাষিক এই নিপীড়নের মুখে মেয়েটি বাধ্য হয় চলে আসতে।’

আমাদের সমাজেরই চিত্র এটি। আমাদের সমাজে মেয়েরা দুর্বিষহ জীবন যাপন করলে চেয়ে চেয়ে দেখে শুধু। এগিয়ে এসে তার দুঃসময়ে কেউ একটু ভালো কথা বলেনা। বরং জ্বালাময়ী কথায় কান ভারী করে তোলে দুঃখী মেয়েটির জীবন। তিলে তিলে ক্ষয়ে যায় জীবনী শক্তি কখনো বেছে নেয় আত্মহননের পথ।
গ্রামের উচ্চ মাধ্যমিক পাশ মেয়ে শরীফা (ছদ্মনাম)-র বিয়ে হয়েছে তার পাশের থানায় একটি গ্রামে। স্বামী বিএ পাশ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। সমাজে উনার ডাকনাম ভদ্র মানুষ হিসেবে। শরীফা যে পরিবার থেকে গেছেতার বাবা কৃষক হলেও মধ্যবিত্ত, কখনো ঘুটে কুড়ায়নি, কখনো মেপে মেপে চুলোয় লাকরী ধরায়নি। তরকারী দুটোর জায়গায় কেন তিনটে রান্না হলো সেজন্য প্রশ্নের সম্মুখীন হয়নি, এক কেজি সয়াবিনে কেন দেড়মাস চললোনা শরীর খারাপ বলে কেনো প্রাত্যহিক প্রার্থনায় যোগ দিতে পারেনি, গ্রীষ্মকালে প্রচণ্ড গরমে কেনো স্বামী না ঘুমানো পর্যন্ত হাতপাখা দিয়ে বাতাস করেনি ক্ষিধে লেগে গেলে কেনো স্বামীর আগে খেয়ে ফেললো, মুঠোফোন দিয়ে কেনো বাবার বাড়ি কথা বলতে হবে এরকম হাজার অনুযোগের সম্মুখীন শরীফা এর আগে কখনো হয়নি ।
এই অভিযোগ শুধু শরীফার জীবনেই নয় এ রকম হাজার শরীফা তাদের নিত্যদিনের যাপিত জীবনে ঘটে যায়। শরীফারা মুখবুজে সহ্য করে দেবদূত পুরুষ স্বামী ও তাদের শ্বশুর শ্বাশুড়ীদের ভাষিক বঞ্চনা।

বিষয়টির উপস্থাপন পাঠকের কাছে একপেশে মনে হলেও এগুলো আমাদের সমাজের নারীদের যাপিত জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। তবে এর বিপরীত চিত্রও যে দেখা যায় না, তা কিন্তু নয়। অনেক নারী স্বামীর সংসারে শ্বাশুর-শ্বাশুড়ী দেবর, ননদ নিয়ে সুখে স্বাচ্ছন্দে ইতিবাচক পরিবেশে তাদের দিন কাটাচ্ছে। এবং এ বিষয়টির উল্লেখ করা হয়তো দ্বৈততার মুখোমুখী হতে হবে আমাদের সমাজে অনেক নারীও নারীর শত্র“ হয়ে দাঁড়ায়। একজন নারী হয়তো তার জীবনে বঞ্চনার শিকার হলেন তার নিজের জীবনের বঞ্চনার প্রতিবাদ করতে পারলেননা কিন্তু অন্য আরেকজন নারী সুখে স্বাচ্ছন্দে থাকুক সেটাও চাননা। ভাষ্যটা এরকম ‘আমার জীবনে সুখ নাই তরে সুখে থাকতে দিমুনা।’ এ রকম সমাজচিত্র আমাদের সমাজে বিরল নয় প্রতিনিয়ত অহরহ নিশিদিন দেখি যাপিত জীবনের জলছবি।

কর্মক্ষেত্রে নারী বদলাতে হবে ভাষাটাও:
দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই চিত্রটা অনেক সংস্থা, অফিসে অর্থাৎ কর্মক্ষেত্রে সহজে চোখে না পড়লেও তার অস্তিত্ব বিদ্যমান। নারীর প্রতি মনস্তাত্বিক আগ্রাসন অনেক সময় প্রতিশোধ পরায়ন আচরণ ও অপরাদের জন্ম দেয়। নারী তার কর্মক্ষেত্রে হয়তো তার সহকর্মী কিংবা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ দ্বারা ভাষিক নিপীড়নের শিকার হন। বিষয়টা খোলা চোখে দেখে অনুধাবন করার মতো বিষয় নয় পুরোটাই মনস্তাত্ত্বিক। সেটা অনেক সময় হতে পারে শত্র“তা, আগ্রাসন, দ্বন্দ্ব এবং হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য। তবে কর্মজীবী নারী বেশিরভাগ সময় নিপীড়নের শিকার হন বিপরীত লিঙ্গের সহকর্মী অথবা তার বস কর্তৃক। যারা পুরুষতন্ত্রের লালন করেন যারা নারীকে খাটো করে দেখেন। নারী প্রতিনিয়ত ভাষিক ও মানসিক নিপীড়নের শিকার হন তাদের চেনাজানা মানুষগুলো দ্বারা। কর্মক্ষেত্রে কাজের পরিবেশে যেখানে কর্মমুখর সৃষ্টিশীল ও উৎপানদশীল থাকার কথা, সেখানে কর্মস্থলে অবস্থানকালীন সময়টুকু হয়ে ওঠে অবরোধকালীন সময়ের মতো। কিংবা নারীকে অপদস্ত করার জন্য কাজের ধকল বাড়িয়ে দেয়া হয়, অযোগ্য ঘোষণা করা হয়, এমনকি যৌন আবেদনও জানানো হয়। অনেক সময় কর্মস্থলে কাজের সময় দীর্ঘায়িত করা হয় স্বাভাবিক কর্মঘন্টার চেয়ে এবং নারীর ‘বডি বাউন্ডারী’ অতিক্রম করা হয়।

কাজের এমনতর পরিবেশ নারীর উদ্বিগ্নতা বাড়িয়ে দেয়, স্বাভাবিক কর্মপন্থা কমে গিয়ে শূন্যের কোটায় পৌঁছে। নিপীড়নের এই প্রক্রিয়াটি দীর্ঘায়িত হতে থাকলে নারী মানসিকভাবে ভারসাম্যও হতে পারে। কর্মক্ষেত্রে অধীনস্তদের দ্বারা ভাষিক নিপীড়ন এমন কিছু ঘটলে কর্মক্ষেত্রের কর্মী নীতিমালা, জেন্ডার নীতিমালা সবকিছুর তোয়াক্কা করা হয়। অনেক সময় এমনটিও হতে পারে যিনি নারীকে ভাষাগত ভাবে নিপীড়ন করছেন তিনিও একজন নারী।

কর্মক্ষেত্রে ভাষিক নিপীড়নের ধরণগুলো এমন হতে পারে সরাসরি কিংবা পরোক্ষভাবে।
লুনা একটি বেসরকারী সংস্থায় কাজ করে। লুনার কাজটি হলো ডাটা এনালাইসিস। মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের ডাটা সফটওয়্যারে ইনপুট দিয়ে সে রিপোর্ট তার বসকে দেখাতে হয়। কাজেই অফিসিয়াল যোগাযোগ ই-মেইলে সারা গেলেও প্রায়শই তাকে বসের কক্ষে এসে রিপোর্ট করতে হতো। বস একদিন বলে বসলেন অফিসে কাজ কর আরো ফ্যামিলিয়ার হও- ফ্যামিলির মতো আচরণ করো। তাহলে তোমার ক্যারিয়ারের ভাল হবে। লুনা ফ্যামিলির মতো আচরণের বিষয়টি বুঝতে পারে অফিস কখনো ফ্যামিলি হতে পারেনা। বসের দৃষ্টিভঙ্গি ভাল না দেখে লুনা জব থেকে রিজাইন দেয়। রিজাইন লেটার হাতে নিয়ে যখন বসের টেবিলে সাবমিট করে তখন শিক্ষিত আধুনিক রুচিশীল পি এইচ ডি করা বসের মুখের শব্দশৈলী
‘তোমাকে আরো আগে খাওয়া উচিত ছিল। আমিই ভুল করে ফেলছি।’
লুনার এ জবটি আর করা হয়নি।

ভাষিক নিপীড়নের এরকম গল্প হাজারটা বলেও শেষ করা যাবে না। কিছু গল্প আমরা জানি না আরো কতশত গল্প আমরা জানি না নারী মননে পুষে রেখে নীরবে অশ্র“ বিসর্জন দেয় কিংবা কখনোও শিকার হয় ভাষিক প্রতারণায়। নীরব জীবনের সে খবর আমরা রাখিনা অনেকে রাখার প্রয়োজন অনুভব করে না।
শারমিন একটি ফ্যাশন হাউজে চাকুরী নিল বছর কয়েক হলো। ফ্যাশন ডিজাইনে উচ্চশিক্ষা শেষ করে নিজে নিজে কিছু করার আগে জয়েন করলো প্রাতিষ্ঠানিক কিছু অভিজ্ঞতা নেয়ার জন্য। তার অভিজ্ঞতার ঝুড়িতে যা যুক্ত হলো তা তিক্ততায়, বঞ্চনায় ভরপুর। রোববার অফিসে কোনো কাজ নেই বায়াররা কোনো মেইল করেনা তাই ইন্টারন্যাশনাল কোনো করোসপনন্ডেন্ট থাকেনা। তার জি.এম প্রস্তাব করে বসে আমরা আমাদের নতুন স্পিনিং মিলের প্লান্টটা দেখে আসতে পারি। রাজী না হয়ে পারা যায় না অফিসিয়াল কাজ। গাড়িতে চড়ে চায়না অবাক হয়ে যায় সে বসের আচরণ অফিস সুলভ নয়
‘আপনি আমার বউয়ের মত কেন হতে পারেন না। স্বাভাবিক হোন ফ্রি হোন
শিক্ষিত মেয়ে, এতো সংকোচ থাকা সাজে গ্রামের মেয়েদের।’
এ দিনের পর শারমিন আর সে অফিসে পা রাখেনি কোনোদিন।

নারী কর্মজীবনে বিড়ম্বিত সময়ের দিনলিপি শুধু এটুকুনই নয় নারী যেমন নিগৃহীত হয় ঘরে তেমনি কর্মক্ষেত্রে তেমনি ঘরের বাইরেও। বাসা থেকে বের হয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি কর্মক্ষেত্রে জীবনের যে সংগ্রাম চলে তা অবর্ণনীয়। যারা কর্মজীবী নারী এবং সেই সাথে মা তাদের জীবনের ফর্দটা অন্যরকম। হাজারটা সমস্যা সমাধান করে বুঝে শোনে পথ দেখে এগুতে হয়। নগর জীবনে আমরা যেটাকে বলছি মর্ডান আরবান সিটি লাইফ। আমাদের সিটি লাইফ কি সেরকম আধুনিক ও সুশীল হতে পেরেছে?
‘লায়লা’ একটি বেসরকারী স্কুলের শিক্ষক। সকাল সাড়ে ছ’টায় বাসা থেকে বের হতে হয়। উত্তরা থেকে ধানমন্ডি আসতে অনেক কাঠখড় পোহাতে হয় পাবলিক বাসে। ভীড় ঠেলাঠেলি সিট না পাওয়া, শরীরের সীমানায় অবাঞ্চিত হস্তক্ষেপ ইত্যাদি ইত্যাদি। সাথে আছে আধিপত্যশীল ভাষার ব্যবহার। কোন প্রতিবাদ করলে প্রত্যুত্তর মিলে
‘পাবলিক বাসে একটু ঠেলাধাক্কা লাগবই। সমস্যা অইলে প্রাইভেট কার কিইন্যা লন। ফস্কারী করতে করতে যাইবেন কোন সমস্যা নাই।’
মহিলাদের সংরক্ষিত আসনের সিট খালি করে দিতে বললে উত্তর শোনা যায়
‘মাইয়া-পুরুষের সমান অধিকার। অনেক পুরুষ মানুষই খাড়াইয়া যাইতাছে
আপনেও খাড়াইয়া যান সমস্যা কি !’

নারীর পরিসর বিস্তৃত হলেও এভাবে সংকীর্ণ করে তোলে চারপাশের বাস্তবতা। মানসিক ও ভাষিক নিপীড়নের ধরন ও এর প্রভাব সম্পর্কিত স্টেব হার্ভে এবং লরাল কিসলে-এর গবেষণাকৃত একটি ছক আমরা এখানে উল্লেখ করতে পারি।

ধরণ প্রভাব
প্রত্যক্ষভাবে (ডিরেক্ট) রাগ, বিরক্তিভাব।
নেতিবাচক ক্রিয়াভাব (নেগেটিভ মুড) দুশ্চিন্তা
চিন্তাশীলতার বাঁধা/ চিন্তার বিচ্ছিন্নতা। স্বাভাবিক কর্মকান্ডে বিষণœ মনোভাব চলে আসা।

পরোক্ষভাবে
মনস্তাত্ত্বিক সৃজনশীলতা বিনষ্টতা -আত্মসম্মানবোধে হীনতায় ভোগে; অবসাদগ্রস্থ হয়ে নেশার প্রবনতা।
-উদ্যমহীনতা।
-মানসিক/আবেগীয় স্বাস্থ্যের অবনতি।
-ব্যক্তি স্বাতন্ত্রীকতায় সৃজনশীলতার অবনতি।
-আত্মতৃপ্তিবোধের অভাব।
সৃজনশীল মনস্তাত্বিক বিষয়গুলোর অবনতি
-শারীরিক অসুস্থতা
-পেশাগত দায়িত্ব পালনে আগ্রহ কমে যাওয়া
-পেশা নিয়ে উদ্বিগ্নতা
-চাকুরিচ্যুতির হার বেড়ে যাওয়া
-কাজ না করার প্রবনতা বৃদ্ধি
-কর্মস্থল ছেড়ে দেয়ার প্রবনতা বৃদ্ধি
-কর্মস্থলে ঘন ঘন ছুটি নেয়া/অনুপস্থিত থাকার প্রবনতা বৃদ্ধি
-কাজের গতিশীলতা কমে যাওয়া
-প্রতিষ্ঠানের প্রতি দায়বদ্ধতা কমে যাওয়া
-পেশাগত ও পারিবারিক জীবনে সমতা রাখতে না পারা
-নেতৃত্বদানে অনীহা
-কর্মঘন্টায় সামজঞ্জস্যহীনতা
-প্রতিষ্ঠানের প্রতি নেতিবাচক আচরণ

কর্মক্ষেত্রে ভাষিক-যৌন নিপীড়ন:
ভাষিক নিপীড়নের সাথে আমরা ইদানীং দেখছি কর্মক্ষেত্রে যৌন নিপীড়ন। যৌন নিপীড়ন অন্যান্য দেশগুলোর মত বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে এবং আশঙ্কাজনক ভাবে বাড়ছে দিনের পর দিন। মেয়েরা এখন কেবল রাস্তায় নয়, ঝুঁকির সম্মুখীন বাসায়,ক্যাম্পাসে, অফিসে বা যে কোনও জায়গায়। আর তাই এই নীরব অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার সময় এসেছে সবার।

বেশ কিছুদিন আগে খবরের কাগজে একটা উপ-শিরোনাম দেখে চোখ আটকে যায় আমার। একটি বেসরকারী কোম্পানীর সর্বোচ্চ কর্মকর্তা- ব্যবস্থাপনা পরিচালক তার ব্যক্তিগত সহকারীর সাথে যে মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। তা দেখে আমরা বিস্ময় না হয়ে পারিনা। আমরা কোন সমাজে বড় হচ্ছি। আমাদের বিবেক কেন জাগ্রত হয়না!

নারী তাদের প্রতিকূলতাকে জয় করার জন্য যখন প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে যাচ্ছে তখন পুরুষাধিপত্যের ভূত ঝেঁকে বসেছে, প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে উঠেছে নারীর অস্তিত্ব ও স্বাধীনতা নিয়ে। আমাদের অফিস, আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, বীমা, কর্পোরেট অফিস কোনটাই নিরাপদ নয়। কাগুজে দলিলে, আইনে নিয়ম কানুন ঠাসা থাকলেও বাস্তবে এর কোন প্রতিফলন দেখা যায়না।

ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও)-এর কন্ডিশনস অব ওয়ার্ক এন্ড এমপ্লয়মেন্ট সিরিজ-২ তে সেক্সুয়াল হ্যারেসমেন্ট এ্যাট ওয়ার্ক: ন্যাশনাল এন্ড ইন্টারন্যাশনাল রেসপন্স শীর্ষক ওয়ার্কিং পেপারে এ সম্পর্কিত যে নির্দেশনা রয়েছে আমরা সভ্য সমাজের প্রতিনিধিরা শুধু চোখ বুলিয়ে পড়ছি, মানছিনা কিছুই। বিষয়টি এমন হবে কেন, কিংবা হচ্ছে কেন। একটি প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা যখন যৌন নিপীড়নের মতো ঘটনার সূত্রপাত ঘটায় তখন জাতির বিবেক স্তব্দ হয়ে যায়। আইএলও-এর ওয়ার্কিং পেপারে তিন ধরনের যৌন নিপীড়নের কথা বলা হয়েছে।
Physical conduct
• Physical violence
• Physical contact, e.g. touching, pinching
• The use of job-related threats or rewards to solicit sexual favours

Verbal conduct
• Comments on a workerÕs appearance, age, private life, etc.
• Sexual comments, stories and jokes
• Sexual advances
• Repeated social invitations
• Insults based on the sex of the worker
• Condescending or paternalistic remarks

Non-verbal conduct
• Display of sexually explicit or suggestive material
• Sexually-suggestive gestures
• Whistling

আপনার অফিসে যে নারী সহকর্মীটি আপনার সাথে কাজ করছেন, তার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন নিয়ে হেয় সূচক কথা বার্তা বলছেন প্রতিদিন। কেনো বিয়ে হচ্ছেনা, কেন বিয়ে করছেনা, বিয়ে হলেও কেন বাচ্চা হচ্ছেনা, আপনি এতো কালো কেন, আপনি দেখতে .. একবারে...। অফিসের খাবার টেবিল থেকে ডেস্ক পর্যন্ত গড়ায় কথার গুঞ্জন। এসব কথা প্রায়শই শুনে থাকেন কর্মজীবী নারী। কথার ছলে এমন সব জোকস, গল্প, কিংবা ওয়েবের টেক্সট, ছবি মুঠোফোনে দেখালেন, কিংবা সামাজিক যোগাযাগের অনলাইন মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার, ব্লগ, ইউটিউব, ইন্সটাগ্রাম, লিন্কডইন,স্কাইপিতে বারবার বিরক্ত করলেন, মন্তব্য ছুড়লেন এগুলোও তো নারীর প্রতি ভাষিক যৌন নিপীড়নের সমান অপরাধ করা হলো। আমাদের শুধরাতে হবে। নারী পুরুষ নির্বিশেষে একসাথে কাজ করার মানসিকতা আজ খুবই জরুরী।

মেয়ে মানুষের আবার ভাষা হয় নাকি:
মেয়েমানুষ। ভিন্ন একটি সত্ত্বা-আলাদা প্রাণী। তাদের ভাষা, মতামত, রুচিবোধ থাকতে হয় না। এমনটিই ধারণা পোষণ করেন আমাদের সমাজের সুশীল পুরুষতন্ত্রের যুগ প্রতিনিধিরা। পুরুষের ধার করা ভাষায়, তাদের পছন্দে, তাদের প্ররোচনায় ফাঁদে পা দিয়ে প্রতিনিয়ত চলতে হয় নারীকে। মেয়েদের কোন শৈশব নেই, সাধ-আহ্লাদ নেই। পুতুল কুড়ানী মেয়ের শৈশব থাকাটা অন্যায়, তাদের খেলা অনুষঙ্গ, স্কুল কলেজ সহপাঠী, এসব বেমানান এই আধুনিক সমাজেও। যে মেয়েটি সকালবেলা বাসা থেকে বের হয়ে স্কুলে কিংবা কোচিংয়ে গেলো, তার জন্য সারাক্ষণ উদ্বিগ্ন থাকতে হয়, কখন পাড়ায় বখাটে শিশ্নওয়ালার দল শিশ বাজাবে, পথ আগলে রুখে দাঁড়াবে !

নারী তার নিজের জীবনের না বলা কথা লিখতে শুরু করে বাংলা অন্তর্জালে। এই সময়ের একটি সাহসী পদক্ষেপ, ছোট্ট মালালার মতোই। অন্তর্জালের কিংদয়শ উদ্ধৃতি করছি। অকথ্য ভাষার বিপরীত চিত্রও খুঁজে পাব আমরা।
ক্লাশ ওয়ান থেকে টুয়েলভ পর্যন্ত মেয়েদের স্কুলে কাটাবার পর যখন কো-এড কলেজে পড়তে যেতে হচ্ছে, মা পই পই করে সাবধান করে দিয়েছিলেন। নাহ্ কলেজের ছেলেদের সঙ্গে প্রেম করায় নিষেধাজ্ঞা নয়, ভীষণ সিরিয়াস মুখ করে বলেছিলেন,
‘এতদিন মেয়েদের সঙ্গে মিশেছ নিশ্চিন্ত ছিলাম।’
এখন কলেজে গিয়ে ছেলেদের থেকে গালাগালি শিখে এসে যেন বাড়িতে বোলো না।
মেয়েদের ওসব মানায় না।’
মায়ের ওই সিরিয়াস মুখ-র ভাবসম্প্রসারণ তখন করা হয়নি, তাই মেয়েদের ওসব কেন মানায় না তা আর বুঝিনি, তাই বিপত্তি বাধালাম। একটা নাটকের দলের তখন নিয়মিত সদস্য, সেখানকারই এক দাদার অভ্যেস ছিল সবাইকে হেতু নির্বিশেষে ‘গান্ডু’ বলে সম্বোধন করার, তো বিশাল অনুপ্রাণিত হয়ে একদিন বাড়িতে বোনকে বলে ফেললাম ‘আরে গান্ডু’! এইটাই বুঝিস না?’

বোন শুনে কি বুঝল জানিনা, কিন্তু মা পাশেই ছিলেন সেটা আমি বুঝিনি, তাই মা শুনে বুঝলেন এবং বললেন- ‘ছেলেদের এইসব নোংরা কথা মেয়েদের মুখে মানায় না।’ ঠিক এইকথা মনে পড়ে গেল একটি বাংলা ছবিতে একটি সংলাপ ছিল- একটি কিশোরী মেয়ের মুখে ‘পোয়া’ শব্দটি শুনে খুব শিউরে টিউরে উঠে বলেছেন।
‘ছিঃ মা, খারাপ কথা বলতে নেই- তুমি না মেয়ে মানুষ।’

‘মেয়েমানুষের খারাপ কথা বলতে নেই’ ধারনাটি কিন্তু একদমই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে বেড়ে ওঠা। আপনি ক্যানিং লোকাল বা বনগাঁ লোকালের তথাকথিত ‘বিখ্যাত’ ট্রেনগুলির মহিলা কামরায় উঠে নিত্যযাত্রী মহিলাদের কথাবার্তা রেকর্ড করে আনুন, যেকোনো চ্যানেলে লম্বা বিপ্ এমনভাবে বাজাবে যে শুধু ওই বিপদসঙ্কেতটুকুই শোনা যাবে’ বাকিসব কথাবার্তা তার আড়ালে। গালাগালি বা ¯−স্ল্যাং বা নোংরা কথা কিন্তু তাই পুরুষ বা ক্ষমতাবানের ভাষা নয়।

কারণ লক আউট হওয়া কারখানার শ্রমিক আর মালিকে গাড়ির কাঁচে থুতু ছিটিয়ে নোংরা কথা বলতে পারে পুজোয় বকশিস না দিলে মিত্রর বাড়ির কাজের মাসি, পাশের বাড়ির সেন বাড়ির লোক পল্টুর মাকে মিত্র বৌদির নামে ‘নোংরা কথা’ বলতে পারে। তাহলে এই ধারণার মূল কোথায়! মূল এই মধ্যবিত্ত ভদ্দরলোক সমাজের মনে, যেখানে এখনও পাত্রীর বিশেষণ ঘরোয়া, গৃহকর্মনিপূনা, ভা....লো গান জানে..।

নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে খুব গম্ভীর গম্ভীর ইংরাজিতে (কখনও সখনও অবশ্য বাংলাতেও) ততোধিক গম্ভীর সেমিনার হয়ে যায়। কিন্তু মেয়েদের ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে যে মেয়েদের মুখের ভাষাগত ‘ট্যাবু’ একটা বড় জায়গা দখল করে রেখেছে, তার কথা কোথায়?

আসলে আমাদের সমাজ শেখায় আদর্শ নারী হবে নম্র-ভদ্র, কোনো অবস্থাতেই কখনো কোনো খারাপ কথা বলবে না, আর ছেলেরা? আরে ওদের কথা বাদ দাও, পুরুষমানুষের বাইরে কত চাপ! মেয়েরা মায়ের জাত, অত মাথা গরম করলে চলে? মোটামুটি এই মানসিকতা থেকেই মেয়েদের স্কুলে ইভটিজিং প্রতিরোধে কর্মশালা, সচেতনতা শিবির এইসবের আয়োজন করা হয়, আর ছেলেদের স্কুলে কিস্সু না। কি হবে করে?

ঘরের মেয়েরা ঠিক থাকলেই সব ঠিক থাকে! কে না জানে নারী নরকের দ্বার ইত্যাদি প্রভৃতি। তাই ঘরের মেয়েরা যখন কলির ফেরে আজকাল ঘরের বাইরে বেরোচ্ছেই, কী আর করা যাবে, তাই বলে ব্যাটাছেলেদের মতো মুখ খারাপ করবে? ছিঃ আমাদের একটা কালচারাল হেরিটেজ নেই?
যেন এইসব ‘নোংরা কথা’ বা ‘স্ল্যাং’ বা অশিষ্ট শব্দ ও বাক্য প্রয়োগ সংস্কৃতির মানচিত্রের বাইরের ব্যাপার। তাই বলে নিশ্চই সবাই সর্বত্র সব জায়গায় ¯−স্ল্যাঙার না বা পুনরায় খ্যামটা খেউড়ের আড্ডায় ফিরে যাবনা ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে, কিন্তু যখনই সেটা মেয়েদের মুখে শুনতে পাব তখনই ‘তওবা তওবা’ কেন?
নিজেকে প্রগতিশীল বলে পরিচয় দেয়া এক বন্ধুকে শুনলাম কোনো একটি মেয়ের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন,
‘মেয়েটার মুখে কিছুই বাধে না।’
কিন্তু অনুরূপ একটি ‘কিছুই বাধে না’ ছেলেটির পরিচয় দিতে গেলে কি তিনি এই কম্পলসারি বাণীটি দিতেন?

ভাষার সঙ্গে এইদিক থেকে ক্ষমতার অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক। নিম্নবিত্ত শ্রেণিতে উপার্জনকারীর ভূমিকা নারী ও পুরুষ উভয়েরই প্রায় সমান, তাই বলে যে মেয়েদের পুরুষের সমান সামাজিক বা পারিবারিক মর্যাদা আছে তা নয়, তবুও সেখানে ‘মেয়েমানুষের ভাষা’ , ‘পুরুষমানুষের ভাষা’ বিভাজন প্রায় নেই। কিন্তু আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির ধারক ও বাহক এই মধ্যবিত্ত সমাজ। তারা চাইলেই রেঁনেসা হয়ে যায়, চিন্তা করলেই বিপ্লব, তাদের কাছে নারীকন্ঠে অশ্লীল ভাষা নৈব নৈব চ। অথচ খেয়াল করে দেখুন যেসব অশিষ্ট শব্দের ধার বা তীব্রতা বেশি তাদের অধিকাংশই কিন্তু নারীসম্পর্কিত। আমরা অনায়াসেই সেইসব স্ত্রীলিঙ্গবাচক অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করি, এমনকি কোনো পুরুষের উদ্দেশ্যেও তা প্রয়োগ করা যায়, শুধু শব্দটির পাশে ‘...র বাচ্চা’ শব্দটি জুড়ে দিতে হবে এভিটিভের সময়, তাহলেই চলবে। অতএব, এইবার নাক মুখ কুঁচকে বলতেই পারেন, উফ্ আরোও একটা ফেমিনিস্ট লেখা।

কিন্তু এইবার বোধহয় এই কথাগুলো বলার সময় হয়েছে। আজ যখন প্রতিমিনিটে ধর্ষণের ব্যবধানটা ক্রমেই কমছে, আর তারমধ্যে বেশিরভাগ ধর্ষণের ঘটনাই নথিভূক্তির অভাবে থেকে যাচ্ছে, তখন বোধহয় দরকার আছে মেয়েদের শিষ্ট শান্ত শ্লীল মিউ মিউ করে পুরুষতন্ত্রের শেখানো বুলি থেকে সরে গর্জে উঠে ‘ভালো মেয়ে’র ভালো ভাষা’র গন্ডির বাইরে গিয়ে হুঙ্কার দেবার।

মেয়েরা জন্মাবার আগে ভ্রুণ অবস্থা থেকেই চাঁদমারি, তারপর শ্লীলতাহানি, ধর্ষণ, পণের জন্য হত্যা, প্রেমে প্রত্যাখান করলে মুখে এসিড এইসব শানানো অস্ত্র ছোঁড়া হতে থাকে সেই নির্বাক চাঁদমারিতে। নির্বাক, কারণ মুখ খুললেই সবাই জেনে যাবে আর ধর্ষিতাকে বলবে ‘এইসব করে (ধর্ষিতা হয়ে) এ পাড়ায় থাকা যাবে না।’

নির্বাক, কারণ এত ভদ্র, শান্ত ‘মেয়েমানুষের যুগ্যি’ ভাষায় বশ্যতা স্বীকার ছাড়া গর্জে ওঠা যায়? যায় না। তাই মেয়েদের খারাপ কথা বলতে দেয়া হয় না।

আমি বলতে চাইছিনা যে নারী আন্দোলনের হাতিয়ার হয়ে উঠুক অশিষ্ট ভাষা, বা ঐ পথেই মেয়েদের ক্রমমুক্তি হবে ইত্যাদি প্রভৃতি। কিংবা আসুন সবাই থিস্তোই। যেটা বলতে চাইছি সেটা হল, ‘ছিঃ মা, খারাপ কথা বলতে নেই, তুমি না মেয়েমানুষ’
এই সংলাপ যেন আর রচিত না হয়, না পর্দায় না জীবনে।
[মেয়েমানুষের ভাষা/কিঙ্কিনী বন্দ্যোপাধ্যায়]

আমাদের সমাজব্যবস্থায় নারীর প্রতি ভাষিক নিপীড়ন নিরবিচ্ছিন্ন পুনরাবৃত্তির ফলে আমরা সময়ের এমন একটা পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি যে, এখন এগুলোকে খুব বেশি অস্বাভাবিক বলে প্রতিভাত হয় না, নারীর প্রতি অধিকাংশ সহিংস ঘটনা অন্যান্য আট-দশটা প্রাত্যহিক ঘটনার মতো স্বাভাবিক ভাবে মেনে নেয় মানুষ। আমাদের সমাজে বহু পূর্ব থেকেই নারীর প্রতি নানা ধরনের সহিংসতা চলে আসছে। নারীর প্রতি ভাষিক নিপীড়নের মধ্য দিয়ে সহিংসতার উদ্ভব ঘটে সাধারণত আমাদের সমাজে বিদ্যমান বিভিন্ন ধরনের নারী-পুরুষ বৈষম্য এবং ফলত সমাজের ভেতরে জায়গা করে নেয়া শক্তিশালী পুরুষতান্ত্রিকতার উপর ভর করে। এই পুরুষতান্ত্রিকতার অবস্থান শুধুমাত্র পুরুষের ভেতরে বললে পুরো সত্য উন্মোচিত হয় না, নারী-পুরুষ সকলের ভেতরেই পুরুষতান্ত্রিকতা কম বেশি বিদ্যামান। কারণ হিসেবে দেখানো যায় নারীর প্রতি ঘটে যাওয়া এমন অনেক সহিংসতা যেখানে অপর কোনো নারী পুরুষটিকে ভিন্ন রকমভাবে সাহায্য সহযোগিতা করে। সমাজে নারী-পুরুষ বৈষম্য ও পুরুষতন্ত্রের জোরালো অবস্থানের কারণে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, আইন এই ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আশ্রয়-প্রশয়ে নারীর প্রতি সহিংসতা ঘটে বিধায়, নির্যাতিত নারী তার প্রতি সহিংসতা বন্ধের আবেদন জানিয়ে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে দাঁড়াতে সাহাস পায়না।

আমাদের সমাজের অভ্যন্তরে প্রতিনিয়ত, অবিরতভাবে নারীর প্রতি সহিংসতা সংগঠিত হয়ে আসছে যা অধিকাংশ সময় সমাজের উপরের স্তরে ভেসে উঠতে পারে না। যে নারীটি সহিংসতার শিকার হয় সে যেমন পরিবারে ও সমাজে অপাংক্তের হয়ে পড়ে তেমন নারীটির পরিবারও সমাজে মুখ দেখানোর জায়গা পায়না। চিরাচরিত সমাজব্যবস্থা মেয়েটিকে তার পরিবারসহ এক ঘরে করে রাখে। আর তখনি চলে অকথ্য ভাষায় ভাষিক ও মানসিক নিপীড়ন।
‘খানকীর পুরি, পেট বাজাইছস, মানসম্মানের মাথা খাইছস, এইবার বাড়িত বাইর অইয়া যা। বেশ্যাবাজি কইর্যাে ভাত খা। তর বাপ-মা খানকি, তুইও একটা খানকি নডী।’
এই অবস্থায় পরিবারের অন্য সদস্যদের রাগও গিয়ে পড়ে নির্যাতিত মেয়েটির উপর। ফলে নির্যাতিত মেয়েটির জন্য অপেক্ষা করে থাকে আরেক দফা নির্যাতন, যা মুখ বুজে সহ্য করা ছাড়া মেয়েটির আর কোন গত্যন্তর থাকে না। সমাজের অন্যান্য পরিবারগুলো নির্যাতিত মেয়েটির সাথে এমনকি তার পরিবারের অন্য কোন ছেলে-মেয়ের সাথে বৈবাহিক বা অন্যান্য সকল ধরণের সম্বন্ধ পাতানো থেকে বিরত থাকে। ঐ পরিবারের আত্মীয় সম্বন্ধীয় পরিবার এবং বন্ধুত্বপূর্ণ মানুষগুলোও ক্রমান্বয়ে নানা অজুহাতের ধোঁয়া তুলে ঐ আপদকালীন সময়ে দূরে সরে যায়।

বিপদে দূরে চলে যাওয়ার এই সংস্কৃতি সত্যিই অমানবিক, অনাকাংখিত, অপ্রত্যাশিত। আমরা সেই দিনের প্রত্যাশায় মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে,নিপীড়ন নয়, সৌহার্দতা ফিরে আসুক মানুষের মননে ও চিন্তায় জ্ঞানের উৎকর্ষে নাড়া দিক পারস্পরিক দৃঢ় বন্ধনের বন্ধুত্বের সংস্কৃতি। ভাষাগত নিপীড়ন মরণব্যধি ক্যান্সারের মতোই শেষ করে দেয় নারীর কর্ম, সৃজনশীলতা- ব্যক্তিত্ব, মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকার। ভাষা হয়ে উঠুক সংস্কৃতি বিনিময়ে, সৌহার্দ্য সম্পীতির মেল বন্ধনের বাহন, নিপীড়নের বাহন নয় ।

সহায়ক গ্রন্থাবলী :
০১। মঞ্জু, মেহেদী হাসান, নারীর প্রতি সহিংসতা: একটি নির্মোহ সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ (প্রবন্ধ),http://blog.bdnews24.com/mehedi1952/143867
০২। সিকদার, সৌরভ, ভাষা ও নারী : পুরুষের ভাষিক অবরোধ (প্রবন্ধ), দৈনিক প্রথম আলো, ১৬ ফেব্র“য়ারি ২০১০.
০৩। রাফিন, ইরফানুর রহমান, নারীর ওপর ভাষিক নিপীড়ন (প্রবন্ধ), সমাজ পুনর্পাঠ, প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা।
০৪। ইকবাল, হাসান, ভাষা, নারী ও পুরুষপুরাণ (প্রবন্ধ), ১০ জুলাই ২০১৩, প্রিয়ডট কম।
০৫। বন্দোপাধ্যায়, কিঙ্কিনী, মেয়েমানুষের ভাষা (প্রবন্ধ), আদরের নৌকা ব্লগ, ২০১৪, কলকাতা।
০৬। ইকবাল, হাসান, নারীর রূপকথা ও আমাদের কন্যাশিশুরা (প্রবন্ধ), শিল্প সাহিত্যের কাগজ- ঘুংঘুর, ২য় বর্ষ, ১ম সংখ্যা।
০৭। সৌরজগৎ, রোকেয়া রচনাবলী, ১৯৯৯, বাংলা একাডেমী, ঢাকা।
০৮। চক্রবর্তী, সুস্মিতা, ফোকলোর ও জেন্ডার, লোকঐতিহ্যে পিতৃতন্ত্র ও নারীর স্বতন্ত্র স্বর, ২০১৪, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা।
০৯। কামালী,সাদ, নারীপুরাতনীর সৃষ্টিপুরাণ, ২০১০, বৃক্ষ, ঢাকা।
10| Social norms: Patriarchy's newest weopen against woman (Article), http:/ww/w.angelfire.com/ok/4equity/mymark.html
11| Ali, Gulam & Khan, Lubna Akhlaq, Language and Construction of Gender, British journal of Arts and Social Science. Vol- 4, No- 2. 2012.
12|Anderson, Kerby, Verbal Abuse (Article), http:/ww/w.leaderu.com/orgs/probe/docs/verbalabuse.html
13| Toomey, Michele, Women as victims of verbal abuse (Article) , http:/ww/w.mtoomey.com/womenasvictims.html
14| Toomey, Michele, The emotional toll of abuse on woman (Article), http:/ww/w.mtoomey.com/emotionaltoll.html
15| Keashly, Loraleigh and Harvey, Steve, Workplace Emotional Abuse (Article), Sage publication. Page-99.
16| Haas, Adelaide, Male and female spoken language difference: steneotypes and evidence: (Article) by: American Psychological Association Bulletin, 1979, Vol-86, No-3 (page 616-626)
17| Holmes, Janet & Meyerhalf, Mirian - Editors, The Handbook of Language and gender, 2003, Blackwell publishing Ltd, USA.
18| Livia, Anna, Lingustic Approaches to Gender in Literacy Texts, 2003, The hand book of language and gender, Blackwell publishing Ltd. USA.


মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.