নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি কবিতা লিখি আনন্দ পাওয়ার জন্যে এবং আনন্দ দেয়ার জন্যে। মানুষের জীবনে আনন্দের খুব অভাব। তাই কবিতার মাঝে আনন্দ খুঁজার চেষ্ট। এ চেষ্টায় আমি কখনো ব্যর্থ হইনি, আপনারাও হবেন না। বেঁচে থাকার জন্যে একটু আনন্দ কুঁড়িয়ে নিন, যেমনটি আমি নেই ॥

কামরুল হাসান জনি

কবিতার মাঝে আনন্দ খুঁজে বেড়াই...

কামরুল হাসান জনি › বিস্তারিত পোস্টঃ

ডোনার রহমত (গল্প)

২৯ শে জুন, ২০১৬ দুপুর ২:২৭

এই বাদাম বাদাম। বিট লবণ দিয়া হান বাদাম।
আফা বাদাম হাইবেন? পাঁচ টেহার বাদাম দেই? বিট লবণ দিয়া বাদাম হান, দেকবেন কোন সম ট্রেন আইয়া পড়ব টেরই পাইতেন না।
রহমত মিয়া একজন বাদাম বিক্রেতা। বয়স আনুমানিক ৩২ বছর। সে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেল ষ্টেশনে এবং শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে বাদাম বিক্রি করে থাকে। ইতোমধ্যে বাদাম বিক্রি করে সে বেশ সুনাম অর্জন করেছে। কেউ একবার তার বাদাম খেয়ে দ্বিতীয় বার খাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে নাই এমন ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া বিরল। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞাতায় বাদাম ভাঁজার এক শৈল্পিক পদ্ধতি আয়ত্ত করেছে সে। যা অতি মাত্রায় গোপন। কারো কাছে প্রকাশযোগ্য নয়। তার রয়েছে কিছু নিয়মিত ক্রেতা যারা রহমত মিয়ার বাদাম ছাড়া কারো বাদাম ছুঁয়েও দেখে না। তেমনি একজন নিয়মিত কাষ্টমার ফাহিম। ফাহিম ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজের ১ম বর্ষের ছাত্র। সে প্রতিদিন বিকেলে তার বন্ধুদের নিয়ে রেল ষ্টেশনে আড্ডা দেয়। রহমত মিয়ার বাদাম ছাড়া তাদের আড্ডা জমেই না। প্রতিদিনের মতো আজো তারা রহমত মিয়ার জন্য অপেক্ষা করছে।
ধুর রহমত মামা এখনো কেন আসছে না বুঝতে পারছি না। রফিক বলল, ওইতো ওখানে বাদাম বিক্রি করছে চল ওখান থেকে বাদাম কিনে খাই। ফাহিম বলল, নারে রহমত মামার বাদাম ছাড়া আমি কারো বাদাম খাই না। তোর ইচ্ছা হলে তুই কিনে খা।
এই মুহুর্তে রফিকের মোবাইল বেজে উঠলো, হ্যালো ভাইয়া বল। কি? বাবা এক্সিডেন্ট করেছে? কোন হাসপাতালে আছে? আমি এক্ষুণি আসছি।
ফোন রাখার পর সবাই একই সাথে জিজ্ঞেস করলাম, কিরে কি হয়েছে? রফিক কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, বাবা এক্সিডেন্ট করেছে। ও নেগেটিভ রক্ত লাগবে কিন্তু রক্ত পাওয়া যাচ্ছে না। ডাক্তার বলেছে আধ ঘন্টার মধ্যে রক্ত পাওয়া না গেলে তাকে আর বাঁচানো সম্ভব হবে না।
ফাহিম বলল, আমারতো ও পজেটিভ তোর রক্তের গ্রুপ কি? রফিক বলল, আমি তো রক্তের গ্রুপই পরীক্ষা করি নাই। বলিস কি! এই রিফাত তোর রক্তের গ্রুপ কিরে? রিফাত বলল, আমিও জানি না। চল হাসপাতালে যাই তোদের রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করতে হবে।
রফিক বলল আমারতো ভয় লাগে। বালিস কি! তোর বাবা মরতে বসেছে আর তুই বলছিস তোর ভয় লাগে? চল তাড়াতাড়ি! বলে ওরা হন্তদন্ত হয়ে সদর হাসপাতালের দিকে ছুটতে লাগল। পথে রহমত মিয়ার সাথে দেখা। রহমত তাদের দেখে দাঁত বের করে হেসে বলল, মামারা কই যান? আইজ বাদাম খাইতেন না?
না মামা, রফিকের বাবা এক্সিডেন্ট করেছে। আমরা যাচ্ছি হাসপাতালে।
আহারে কেমনে অইলো।
তা পরে বলা যাবে আমরা যাচ্ছি রক্তের খুঁজে। আধ ঘন্টার মধ্যে রক্তের ব্যবস্থা করতে না পারলে...
রহমত বলল কি লক্ত? (রহমত র এর উচ্চারণ ল করে)
রফিক বলে উঠল, তা তুমি বুঝবা না। ফাহিম, চল তাড়াতাড়ি যেতে হবে।
রহমত আবার বলল, মামা কন না কি লক্ত আমি লক্ত দিমু। ফাহিম বলল ও নেগেটিভ।
রহমত আবার দাঁত বের করে সেই পরিচিত হাসি দিয়ে বলল, আমারও এই লক্ত, লন যাই আমি লক্ত দিমু। তুমি তোমার রক্তের গ্রুপ জানো?
কন কি মামা আমি কয়দিন পর পর লক্ত দেই। আমি জানতাম না কেরে?
রিফাত বলল, কিন্তু এই শরীর নিয়া তুমি রক্ত দিবা কেমনে? তোমার শরীরে তো হাড় ছাড়া কিছু দেখি না।
কন কি মামা! লক্তের লাইগ্গা মানুষ মইরা গেলে, আমি এই শইল দিয়া কিতা করমু? গরিবের শইল হগল বালা অই ইমুন থাহে।
বলতে বলতে রহমত মামার চোখ পানিতে ছলছল করে উঠলো। আর কথা না বাড়িয়ে রহমত মামাকে নিয়ে দ্রুত হাসপাতালে রওয়ানা হলাম।
রহমতের সাথে রক্ত ম্যাচিং হলে রহমতই রফিকের বাবাকে রক্তদান করে। ডাক্তার অপারেশন থিয়েটার থেকে বের না হওয়া পর্যন্ত রহমত হাসপাতালেই বসে থাকে।
কিছুক্ষণ পর ডাক্তার জানাল, রোগী এখন বিপদমুক্ত। যথাসময়ে রক্ত না পাওয়া গেলে রোগীকে বাঁচানো অনেক কঠিন হয়ে যেত। একথা শুনে রোগীর আত্মীয় স্বজন রহমতকে আগলে ধরল। বলল, রহমত তুমি যে উপকার করেছো তা আমরা কোনদিনও ভুলব না।
রহমতের চোখ দিয়ে নিজের অজান্তেই দু’ফোটা অশ্রু ঝরে পড়ল। একজন বলে উঠল, রহমত বল তুমি কি চাও? আজ তুমি যা চাও আমরা তোমাকে তাই দিব।
রহমত কিছুই বলল না, সে ডুকরে কেঁদে উঠল। সে আর এখানে দাঁড়াতে পারল না। দৌড়ে হাসপাতাল থেকে বেড়িয়ে গেল। ফাহিম ও রফিক তাকে ডেকে আনতে গেল কিন্তু তাকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না।
রহমতের আচরণে সবাই খুব অবাক হলো। তারপর কয়েকদিন আর রহমতের দেখা পাওয়া গেল না। একদিন ফাহিম কলেজ থেকে বাড়ি ফিরছিল হঠাৎ সাবেরা সোবহান স্কুলের সামনে একটি ভীর দেখে থামল। জানতে পারল একজন ছেলেধরা ধরা পড়েছে। তাকে সবাই মিলে ধোলাই করছে। সবচেয়ে দুর্বল লোকটাও আজ সুযোগ পেয়ে পাছায় দুইটা লাত্থি দিতে দ্বিধা বোধ করল না। ভীরের ভেতর থেকে ভেসে আসছে লোকটার আর্ত চিৎকার। আমারে আর মাইরেন না। আমি ছেলেধারা না। আমারে ছাইরা দেন।
ভীর ঠেলে ভেতরে ঢোকে দেখলাম রোগা একটি লোক মার খেয়ে মাটিতে পড়ে আছে। রক্তে তার জামাকাপড় ভিজে গেছে। নাক মুখ দিয়ে এখনো রক্ত ঝরছে। হঠাৎ লোকটিকে চিনতে পারলাম। সে আর কেউ নয় রহমত মামা।
ফাহিম তাকে সেখান থেকে ছাড়িয়ে হাসপাতলে নিয়ে গেল। ঘন্টাখানেক পর তার জ্ঞান ফিরল। কিন্তু সে খুব দুর্বল ছিল ঠিকভাবে কথা বলতে পারছিল না। তাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম তার বাড়িতে আছে তার একমাত্র স্ত্রী। তার কাছ থেকে নাম্বার নিয়ে তার স্ত্রীকে ফোন দিলাম। শুনেই সে কাদতে আরম্ভ করল। তাকে দ্রুত হাসপাতালে আসতে বললাম। এই ফাকে রহমত মামার কাছে পুরো ঘটনাটি শুনতে চাইলাম।
রহমত দুর্বল স্বরে বলতে আরম্ভ করল, ইশকুলের সামনে বাদাম বেচতাছি। হঠাৎ ইশকুল ড্রেস পড়া ছুডু একটা মাইয়া গেইট দিয়া বাইর অইল। ওরে দেইখ্খা আমার কইলজাটা ছ্যাৎ কইরা উটল। দেখতে পুরা আমার মাইয়ার লাহান। ওরে কুলে নিয়া আদর কইরা বাদাম খাইতে দিলাম। কিছুক্ষণের লাইগ্গা মনে অইল আল্লাহ আমার মাইয়ারে আবার ফিরাইয়া দিছে।
রহমতের জলে ভেজা চোখগুলো আনন্দে জ্বলজ্বল করে উঠল। কিছুক্ষণের জন্য সে আর কিছু বলতে পারল না।
তারপর কি হলো?
ওরে আমার ময়নার মতন আদুর করতে লাগলাম। কিন্তু ওর মা আমারে ছেলেধরা মনে কইরা চিক্কাইর মারছে। পরে মানুষ আইস্সা আমারে মারতে আরম্ভ করল।
বলতে বলতে রহমত কাতর স্বরে কাদতে আরম্ভ করল। তার দু’চোখ বেয়ে পড়ছে অশ্রুধারা।
কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছিল আপনার মেয়ের?
রহমত মামা আবারো বলতে শুরু করল, আমার মাইয়ার নাম আছিল ময়না। বয়স পাঁচ বছর। যহন সারে দিন পরিশ্রম কইরা বাইত যাইতাম। তহন মাইয়াডা আমার দৌড়াইয়া আইয়া কোলে উঠত। গলা জড়াইয়া দইরা কইত আব্বা আমার লাইগ্গা চকলেট আনছ? যহন ওর হাতে চকলেট দিতাম, ময়না আমার খুশিতে লাফাইতে আরম্ভ করত। ওর হাসি মুখটা দেইখ্খা সব কষ্ট ভুইল্লা যাইতাম।
যহন ইশকুলের সামনে বাদাম বেচতাম, তহন ইশকুল ড্রেস পড়া ছাত্রছাত্রীদের দেইখ্খা আমিও স্বপ্ন দেখতাম, আমার মাইয়াও একদিন ইশকুলে যাইব। লেহাপড়া শিখব। কিন্তু হেই স্বপ্ন আর পূরণ অইল না।
কেন পূরণ হলো না? কি হয়েছিল আপনার মেয়ের?
টর্নেডো আমার সব স্বপ্ন বাইঙ্গা চুরমার কইরা দিল। হেদিন আছিল শুক্কুরবার। রাস্তায় রাস্তায় বাদাম বেচতাছি। আত্কা বড় বড় হিল পড়তে আরম্ভ করল। আশের ডিমের লাহান একেকটা হিল। দৌড়াইয়া একটা দোহানে গিয়া ডুকলাম। কিছুক্ষণ পরে হুনলাম গেরামে নাকি টর্নেডো আইছে। দৌড়াইয়া বাইত গেলাম। গিয়া দেহি কারো বাড়ির চাল নাই, কারো বিল্ডিংয়ের ছাদ উড়াইয়া লইয়া গেছে, বড় বড় গাছ উপরাইয়া ফালাইছে। দৌড়াইয়া আমার ছুডু কুড়েঘরটার কাছে গেলাম। গিয়া দেহি আমার ঘরের কোন চিহ্নও নাই। আত্কা দেহি ময়নারে জড়াইয়া দইয়া আমার বউ চিৎকার কইরা কানতাছে। ময়না আমার অজ্ঞান হইয়া পইড়া আছে। তার মাতা দিয়া গাঙ্গের পানির লাহান লক্ত পড়তাছে। তাড়াতাড়ি কইরা ওরে লইয়া হাসপাতালে গেলাম। ডাক্তার কইল তাড়াতাড়ি বি নেগেটিভ লক্তের ব্যবস্থা করতাম। আমি কইলাম, ডাক্তার সাব যত লক্ত লাগে আমাত্তে নেন তবু আমার মাইডারে বাঁচান। কিন্তু ডাক্তার সাব আমার লক্ত পরীক্ষা কইরা কইল, আমার লক্ত নাকি ময়নার লক্তের লগে মিলে না। পাগলের মতো এদিক ওদিক ছুটতে লাগলাম। যারে দেহি তারেই লক্তের কতা কইলাম। আমার মাইয়ার বি নেগেটিভ লক্ত লাগব, কেউ আমার মাইয়াডারে বাঁচান- কেউ আমার মাইয়াডারে বাঁচান। কিন্তু কেউ আগ্গাইয়া আইলো না। মাইয়াডারে আর বাচাইতে পারলাম না। বলতে বলতে রহমতের চোখের জলে বালিশ ভিজে উঠল।
তারপর শপথ নিলাম, আর কারো মাইয়ারে লক্তের লাইগ্গা মরতে দিমু না। এরপর থাইক্কা আমি নিয়মিত লক্ত দেই।
শুনতে শুনতে কখন যে দু’চোখ বেয়ে পানি পড়তে আরম্ভ করল টেরই পেলাম না। রহমত মামাকে শান্তনা দেবার মতো কোন ভাষা খুঁজে পেলাম না। ওই মুহুর্তে পৃথিবীটা আমার কাছে ভাষাহীন অসহায় মনে হলো। ইতোমধ্যে ডাক্তার এসে জানাল রোগীর অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে। কয়েক ঘন্টার মধ্যে ২ ব্যাগ রক্ত দিতে হবে। তখনই শপথ নিলাম, যে মানুষটা সবাইকে রক্ত দিয়ে বেড়াচ্ছে। যে মানুষটার মেয়ে একবার রক্তের অভাবে মারা গিয়েছে। এখন সময় এসেছে সে মানুষটার জন্য কিছু করার। এই মানুষটাকে আর রক্তের অভাবে চলে যেতে দিব না। যেভাবেই হোক রক্তের ব্যবস্থা করব।
দেরি না করে কাজে নেমে পড়লাম। একে একে সব বন্ধুদের ফোন দিলাম। ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিলাম। কয়েকটা ব্লাড ব্যাংকে যোগাযোগ করলাম। কিন্তু রক্ত খুঁজে পেলাম না। অবশেষে একটি ওয়েবসাইট থেকে একজন ও নেগেটিভ ডোনারের নাম্বার সংগ্রহ করে ফোন দিলাম। কিন্তু সে এখন ঢাকায় আছে। এত দূরে এসে রক্ত দিতে চাইল না। তবু তাকে বুঝিয়ে রাজি করালাম। সে রওয়ানা হয়েছে ঢাকা থেকে একটি দুঃখি মানুষের দিকে সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দিতে। এতক্ষণে একটি স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেললাম।
দৌড়ে গেলাম হাসপাতালে। ইতোমধ্যে রহমত মামার স্ত্রী এসে কান্না জুড়ে দিয়েছে। মৃত বাড়ির কান্নার মতো কিছুক্ষণ পর পর কাঁদছে।
রহমত মামার অবস্থারও ধীরে ধীরে অবনতি হচ্ছে। আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে পড়ছে। ইতোমধ্যে ২ ঘন্টা ৩০ মিনিট পার হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো ডোনার আসে নাই। ফোন দিলাম বলল জ্যামে আটকে গেছি।
রহমত মামার চোখ ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে আসছে। তার চোখের কোণ দিয়ে ঝরে পড়ছে এক ফোটা অশ্রু। আমরা কি পারব রহমত মামাকে বাঁচাতে?
২৫.০৬.২০১৬

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৯ শে জুন, ২০১৬ বিকাল ৪:২০

উদরপূর্তি বলেছেন: তারপর কি হইসে রহমত মামার???

২| ২৯ শে জুন, ২০১৬ বিকাল ৫:৩৪

কামরুল হাসান জনি বলেছেন: তার পরেরটা কল্পনা করে নিন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.