নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি কবিতা লিখি আনন্দ পাওয়ার জন্যে এবং আনন্দ দেয়ার জন্যে। মানুষের জীবনে আনন্দের খুব অভাব। তাই কবিতার মাঝে আনন্দ খুঁজার চেষ্ট। এ চেষ্টায় আমি কখনো ব্যর্থ হইনি, আপনারাও হবেন না। বেঁচে থাকার জন্যে একটু আনন্দ কুঁড়িয়ে নিন, যেমনটি আমি নেই ॥

কামরুল হাসান জনি

কবিতার মাঝে আনন্দ খুঁজে বেড়াই...

কামরুল হাসান জনি › বিস্তারিত পোস্টঃ

নতুন স্কুলে চাঁদনী (গল্প)

২৪ শে জুলাই, ২০১৬ রাত ৩:০৬

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে আজ চাঁদনীর প্রথম দিন। সে সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। চাঁদ যেমন পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরে, চাঁদনীও তেমনি বিভিন্ন স্কুলে ঘুরে বেড়ায়। কেননা তার বাবা সরকারি চাকরিজীবী। মাঝে মাঝেই তাকে বিভিন্ন জেলায় ট্রান্সফার হতে হয়। এবার তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় ট্রান্সফার হওয়ার কারণে আজই চাঁদনী এই স্কুলে ভর্তি হয়েছে। স্কুলের সবাই তার অপরিচিত। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে বন্ধুত্ব তৈরি করার এক অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে তার। প্রধান শিক্ষক চাঁদনীকে তার ক্লাসের সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। স্যার চলে যেতেই রতন এক বোতল পানি চাঁদনীর মুখে ছুড়ে দিয়ে বলল, ‘ওয়েলকাম টু আওয়ার ক্লাস’। বলেই সবাই উচ্চস্বরে হেসে উঠল।
চাঁদনী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, এটা কি হলো?
রতন জবাব দিল, নতুন স্টুডেন্টকে আমরা এভাবেই স্বাগত জানিয়ে থাকি। এ কথা বলে বিশ্বজয়ের হাসি হাসতে লাগল রতন।
আদিত্য বাঁধা দিয়ে বলল, কাজটা মোটেও ঠিক করিসনি রতন। তোর ওর কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত।
রতন বলে উঠল, ওরে বাবা! হিরো চলে এসেছে দেখছি- হিরোইনকে বাঁচাতে। পরক্ষণেই হাত উচিয়ে বলল, আমার কাজে নাক গলাতে আসলে থাপ্পর দিয়ে জানালা দিয়ে ফেলে দিব (ডায়ালগটা মুস্তাফিজ স্যারের কাছ থেকে নকল করা। এটা স্যারের প্রিয় ডায়ালগ)।
ইতোমধ্যে ফারিহা এসে চাঁদনীকে নিয়ে তার পাশের সিটে বসাল। চাঁদনী তার মুখ মুছতে মুছতে বলল, এই ক্লাসের ছেলেরা এতো অদ্ভূত কেন?
ফারিহা বলল, সবাই না। শুধু রতনটাই এমন। কেউ তাকে কিছু বলারও সাহস পায় না। কারণ সে স্কুলের সভাপতির ছেলে।
আর যে ছেলেটা রতনকে বাঁধা দিচ্ছিল ওর নাম কি?
ওর নাম আদিত্য। সে ক্লাসের ফার্স্ট বয়। অনেক ভাল ছেলে। কিন্তু সে সবসময় ফার্স্ট হওয়াতে সবাই তাকে ঈর্ষার চোখে দেখে। কেউ তাকে খেলায় নেয় না। এমনকি ফার্স্ট বেঞ্চে বসতেও দেয় না।
চাঁদনী বলল, আহারে! বেচারা ফার্স্ট হয়ে বিপদে পড়ল। ঠিক আছে, এবার আমি ফার্স্ট হয়ে ওকে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিব।
ফারিহা হেসে বলল, তাই নাকি! চেষ্টা করে যাও। তবে আদিত্যের সাথে কমপিট করা এতো সহজ কাজ না।
ঠিক ঐ মুহুর্তে ক্লাস লিডার তুষার সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে বলল, ‘এভরিবডি প্লিজ কিপ সাইলেন্ট। টাকলো ইজ কামিং’।
চাঁদনী কৌতুহলের সাথে জিজ্ঞেস করল, এই টাকলোটা আবার কে?
ফারিহা উত্তরে বলল, আমাদের ক্লাস টিচার মুস্তাফিজ স্যার। তার মাথায় রয়েছে ক্রিকেট স্টেডিয়ামের মতো বিশাল বড় একটি টাক। যা সূর্যের আলোয় মুক্তার মতো ঝকঝক করে। টাকের চারপাশের চুলগুলোকে দেখে মনে হয় দর্শক গ্যালারী। যে গ্যালারীতে পঞ্চাশ হাজার দর্শকের ধারণ ক্ষমতা রয়েছে। আর এজন্যই সবাই তাকে টাকলো স্যার বলে ডাকে। তবে তাকে সবাই তেলাপোকার মতো ভয় করে। একবার এক ছাত্র স্যারের জন্মদিনে একটি স্পেশাল গিফ্ট দিয়েছিল। সেই গিফ্টের প্যাকেট খুলে পরদিন ঐ ছেলেকে স্যার তার শিক্ষকতা পেশার সবচেয়ে কঠিনতম শাস্তি দিয়েছিল। এবার বলতো সেই গিফ্টটা কী ছিল?
চাঁদনী কিছুক্ষণ ভেবে বলল, না বুঝতে পারছি না। তুমিই বল।
ফারিহা বলল, একটি তেলের বোতল। যে বোতলের গায়ে লিখা ছিল, ‘সাত দিন ব্যবহারে টাক মাথায় চুল গজায়’। শুনে চঁদনী হাসি ধরে রাখতে পারল না। দু’জনেই খিলখিল করে হাসতে আরম্ভ করল।

পরদিন টিফিন পিরিয়ডে চাঁদনী টিফিন খেতে খেতে লক্ষ্য করল, আদিত্য স্কুল মাঠের কোণে অবস্থিত কৃষ্ণচূড়া গাছটির নিচে একা একা বসে আছে। সে আকাশের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে দিনের বেলায় আকাশে চাঁদ খুঁজার চেষ্টা করছে। তবে আকাশে চাঁদ খুঁজে না পেলেও জমিনে দেখা দিয়েছে এক অন্যরকম চাঁদ।
আদিত্য কি করছ একা একা?
আকাশ দেখছি। আকাশের সাদা মেঘগুলো দেখতে আমার খুব ভাল লাগে।
তাই! সাদা মেঘ আমারও ভাল লাগে। তবে তোমার মতো করে আকাশ দেখা হয় না কখনো।
তোমার তো আকাশ দেখার প্রয়োজনই হয় না। কেননা তুমি আকাশেই থাকো।
হুম। আর আদিত্য মানে তো সূর্য। তুমিও তো আকাশে থাকো। তাহলে তুমি কেন আকাশ দেখো?
কারণ আমি আকাশে চাঁদ খুজার চেষ্টা করি। আর অদ্ভূত ব্যাপার হলো আমার দেখা পেলেই চাঁদটা লুকিয়ে যায়।
গাছের শিকড়ে বসতে বসতে চাঁদনী বলল, তুমি অনেক সুন্দর করে কথা বলো। বাই দ্যা ওয়ে, তুমি আজ টিফিন আনো নাই?
না। আমি টিফিন আনি না। ঠান্ডা খাবার ক্ষেতে আমার ভাল লাগে না। তাছাড়া বাসা কাছাকাছি তাই বাসায় গিয়ে মায়ের হাতে গরম গরম খাবার খাই খুব ভাল লাগে। কথাগুলো বলার সময় আদিত্যের চোখে এক ধরনের শূন্যতা পরিলক্ষিত হয়।
আজ যাওনি?
না। আজ যেতে ইচ্ছে করছে না।
ঘন্টাধ্বনি শুনতে পেয়ে তারা দু’জনেই ক্লাসের দিকে রওয়ানা হলো।

আজ বৃহস্পতিবার। মুস্তাফিজ স্যার ক্লাসে এসেই বোর্ডে একটি অংক তুলে দিয়ে সেটি সলভ করতে বলল। ২০ মিনিট ধরে চেষ্টা করেও চাঁদনী সেটা সলভ করতে পারছে না। কিন্তু স্যারের মাথায় চুল না থাকার রহস্য অনুধাবন করতে পারল। পরক্ষণেই চাঁদনী তার মাথার তালুর কয়েকটা চুল টেনে দেখল, ঠিক আছে কিনা। না ঠিকই আছে। হঠাৎ চাঁদনী লক্ষ্য করল, আজ আদিত্য স্কুলে আসেনি। ফারিহা জানাল, ও প্রায়ই দেরি করে আসে। এজন্য অবশ্য তাকে শাস্তিও ভোগ করতে হয়।
কিন্তু এত ইন্ডিসিপ্লিন্ড হওয়ার পরও সে ক্লাসে ফার্স্ট হয় কি করে?
সেটাই অনেক বড় রহস্য। যা আমরা আজও আবিষ্কার করতে পারিনি। এ কথা বলা মাত্রই আদিত্য চুপি চুপি ক্লাসে প্রবেশ করল। কিন্তু টাকলো স্যারের চোখকে ফাঁকি দেওয়া এতো সহজ কাজ না। শাস্তি তাকে ভোগ করতেই হলো।
আজ স্কুল হাফ হওয়ায়। দুপুর ১ টায় স্কুল ছুটি হয়ে গেল। আদিত্য ও চাঁদনী স্কুল গেইট দিয়ে একসাথে রেরুচ্ছে। আদিত্য চাঁদনীকে জিজ্ঞেস করল, তোমার কি নদী ভাল লাগে?
হ্যাঁ। অনেক ভাল লাগে। সবচেয়ে ভাল লাগে নৌকায় করে ঘুরে বেড়াতে।
তাহলে চল, আজ নৌকায় ঘুরব।
কিন্তু বাসায় ফিরতে তো দেরি হয়ে যাবে। তখন মা আবার চিন্তুা করবে।
দেরি হবে না। আমি নৌকায় করে তোমাকে বাসার কাছে পৌছে দেব।
ঠিক আছে, চল তাহলে।
আজ তিতাস নদীতে প্রচন্ড বাতাস বইছে। এরকম বাতাসে মুহুর্তেই যে কারো মন ভাল হয়ে যাওয়ার কথা। আর মন ভাল থাকাটা একজন সুস্থ্য মানুষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আদিত্য নৌকা চালাতে খুব পছন্দ করে। প্রায়ই সে তিতাস পাড়ে বেড়াতে আসে। এখানে এসে করিম চাচার সাথে তার বেশ ভাল সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। প্রায়ই সে করিম চাচার নৌকায় করে ঘুরে বেড়ায়। আজও তার নৌকাটি পেতে কোন সমস্যা হলো না। নৌকায় উঠে চাঁদনী শিশুর মত উল্লাস করতে আরম্ভ করল। পাখির ডানার মত দু’হাত প্রসারিত করে তিতাসের শীতল বাতাসের ঝাপটা অনুভব করছে সে।
আদিত্য, তুমি কি এই নদীতে প্রায়ই আস?
হ্যাঁ। এই নদীই আমার সবচেয়ে ভাল বন্ধু। যার সাথে আমি সবকিছু শেয়ার করি। আর সেও খুব ভাল শ্রোতা। ধৈর্যের সাথে আমার সব কথা শুনে।
এখন যেহেতু আমি এসে গেছি। তুমি চাইলে আমার সাথেও শেয়ার করতে পার। নাকি আমাকে বন্ধু ভাবতে পারছ না?
না, তা হবে কেন? বলো কি জানতে চাও?
আগে বলো, তোমার পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়ার রহস্যটা কি?
এ কথা শুনে আদিত্য হাসতে আরম্ভ করল। আজ প্রথম বারের মতো আদিত্যের মুখে হাসি দেখলাম। হাসলে ওকে অনেক সুন্দর দেখায়। আদিত্য বলল, পড়তে আমার একদম ভাল লাগে না। তবে যখনই পড়তে ইচ্ছে করে না তখনই আমার স্বপ্নটা চোখের সামনে ভেসে উঠে। তখন পড়তে থাকি, প্রচুর পড়তে থাকি। পড়তে পড়তে মনে হয়, আমি যেন স্বপ্নটার দিকে এক পা দু’পা করে এগিয়ে যাচ্ছি। তখন পড়তে ভাল লাগে। আর এই ভাল লাগাটাই আমাকে ফার্স্ট হতে সহযোগিতা করে।
তুমি তখন থেকে স্বপ্নের কথা বলে যাচ্ছ। কিন্তু স্বপ্নটা কি সেটাই তো বললে না।
আদিত্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি বড় হয়ে ডাক্তার হতে চাই। এটাই আমার একমাত্র স্বপ্ন।
হুম। অনেকেই ডাক্তার হতে চায়। কিন্তু তুমি কেন ডাক্তার হতে চাও বলবে কি?
আদিত্য হেসে বলল, তুমি এতটা ঘনিষ্ঠ হয়ে যাওনি যে, তোমাকে সব বলে দিব।
চাঁদনী বলল বুঝেছি। ডাক্তার হয়ে অনেক টাকা উপার্জন করতে চাও। আর সেই টাকায় ছোট একটি ঘর বানাতে চাও। যে ঘরে সুন্দরী গৃহবধু কারো অপেক্ষায় পথ চেয়ে থাকবে। তাইতো?
এ কথা শুনে আদিত্য হাসতে আরম্ভ করল। চাঁদনী মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে আদিত্যের দিকে। কি সুন্দর করেই না হাসে ছেলেটা। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই আদিত্যের হাসি মলিন হয়ে গেল। চাঁদনী তা লক্ষ্য করল না।

আজ মুস্তাফিজ স্যারকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে তার মেজাজের বারোটা বেজে আছে। নিশ্চয়ই বউয়ের প্যাদানি খেয়েছে আজ। স্যার কোন কথা বলল না। রোল কল করতেও ভুলে গেছে আজ। বোর্ডে একটি সরল অংক তুলে দিয়ে আদিত্যকে ডেকে সেটি সলভ করতে বলল। আদিত্য অংকটি সলভ করে তাকিয়ে দেখল, ইতোমধ্যে স্যার চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। নিশ্চয়ই রাতে ভাল ঘুম হয়নি। আদিত্য স্যারকে না ডেকে নিজ আসনে এসে বসল। স্যারকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে রতনের মাথায় একটি দুষ্ট বুদ্ধি খেল গেল। সে বোর্ডে গিয়ে অংকটির নিচে লিখে দিল-
“টাক্কু বেল, টাক্কু বেল
বাড়ি তোমার কই?
জলদি আমার কাছে এসো
খাওয়াব টক দই।”
কিছুক্ষণ পর জেগে উঠে লেখাটি দেখেই স্যারের মাথা গরম হয়ে গেল। এতটাই গরম হল যে, কোন প্রকার আগুনের ব্যবহার ছাড়াই স্যারের টাক মাথায় অনায়াসে রুটি সেঁকা যেত। এতে করে দেশের সম্পদ তিতাস গ্যাস কিছুটা হলেও বেঁচে যেত।
স্যার রেগে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কে লিখেছে?
কেউ রতনের ভয়ে কিছু বলল না। স্যার বললেন, কথা না বললে সবাইকেই শাস্তি ভোগ করতে হবে।
তখন তুষার বলে উঠল, স্যার নজরুল লিখেছে।
নজরুল কে?
স্যার, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
আমার সাথে ফাইজলামি করিস? থাপ্পর দিয়ে জানালা দিয়ে ফেলে দিব।
রতন বলল, স্যার বোর্ডে তো আদিত্যই অংক করতে গিয়েছে। আদিত্যই লিখেছে স্যার।
এবার স্যার আদিত্যকে কান ধরে টেনে নিয়ে আসল। তোর এত বড় সাহস! তুই ক্লাসের ফার্স্ট বয় বলে যা খুশি তাই করবি? আর আমি সেটা মেনে নিব? তুই কি করে এই স্কুলে পড়িস আমি দেখে ছাড়ব। আদিত্য যতই বলল যে, স্যার আমি ওটা লিখিনি। আমাকে ছেড়ে দেন। স্যার তার কোন কথা শুনল না। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে গুণে গুণে তাকে দশটা বেত্রাঘাত করল। আদিত্যের এই করুণ অবস্থা দেখে রতন খুব মজা পাচ্ছে। সে মুখ চেপে হাসতে লাগল।

পরদিন আদিত্যের গায়ে প্রচন্ড জ্বর এল। ফলে সে দু’দিন স্কুলে আসতে পারেনি। দু’দিন পর আদিত্যকে স্কুল ক্যাম্পাসে দেখতে পেয়ে সকলেই তার কুশল জানতে এল। আদিত্য এখনো পুরোপুরি সেরে উঠেনি। তবু স্কুলে না আসলে ভালো লাগে না বলে চলে এসেছে।
রতন বলল, কিরে আদিত্য তোর নাকি জ্বর এসে গিয়েছিল? যার এতটুকুতেই জ্বর এসে যায়, সে আবার ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখে! হা হা হা... কেউ আমার মুখ চেপে ধর। আমি হাসি আটকাতে পারছি না।
চাঁদনী ডেকে বলল, এই আদিত্য! এদিকে এসো।
কেমন আছো আদিত্য?
হ্যাঁ ভাল।
রতন তোমার সাথে ফাজলামু করেই যাচ্ছে। তুমি কিছু বলছ না কেন?
এখন বলে আর কি হবে? যা হবার তা তো হয়েই গেছে। আর সে এটা করে মজা পায়। তাই এখন বললেও কোন কাজ হবে না। যেদিন সে উপলদ্ধি করতে পারবে যে তার মজার কারণে অন্যরা কতটা কষ্ট পাচ্ছে, সেদিন সে নিজেই এটা থেকে সরে আসবে।
না আদিত্য। ওর একটা শিক্ষা হওয়া উচিত। না হলে সে কখনোই শুধরোবে না। আজ টিফিন পিরিয়ডে আমরা সবাই মিলে প্ল্যান করব রতনকে কিভাবে শিক্ষা দেয়া যায় সে ব্যাপারে। তুমি থেকো।
ঠিক আছে থাকব।
টিফিন পিরিয়ডে রতন যথারীতি বন্ধুদের সাথে স্কুল মাঠে ক্রিকেট খেলছে। এদিকে চাঁদনী, আদিত্য ও ফারিহা কমনরুমে বসে টিফিন খাচ্ছে। আজ চাঁদনী আদিত্যের সাথে টিফিন শেয়ার করছে। কিন্তু আদিত্য খাবার খেতে গিয়ে হঠাৎ কি ভেবে থেমে গেল। তার চোখ দু’টো পানিতে ছলছল করে উঠল। সে খাবার নামিয়ে রাখল। চাঁদনী জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে তোমার? খাচ্ছ না কেন?
আদিত্য নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, কিছু না। গ্যাস্ট্রিকের প্রবলেম হচ্ছে। আজ খেতে পারব না।
চাঁদনী আদিত্যের আচরণে খুব অবাক হল। জিজ্ঞেস করল, আদিত্য কি হয়েছে তোমার সত্যি করে বল তো।
আমি সত্যিই বলছি। তোমরা খাও আমি খেতে পারব না। আর কি যেন প্ল্যান করবে বলেছিলে?
ও হ্যাঁ। চাঁদনী আরো কয়েকজন বন্ধুকে ডেকে বলল, তোমরা তো জানো রতন আমাদের সবাইকে খুব জ্বালাচ্ছে। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি সবাই মিলে ওকে একটা শিক্ষা দেব। তোমরা কি বল?
আরিফ বলে উঠল, ওরে বাবা! রতনকে কে শিক্ষা দিতে যাবে? আমি এতে নেই।
ভয় পেয়ো না আরিফ। প্ল্যান করে কাজ করব যাতে রতন বুঝতেই না পারে কাজটা কে করেছে।
প্ল্যানটা কি?
প্ল্যানটা এখনো তৈরি হয়নি। আগে জানতে হবে রতনের দুর্বল জায়গাটা কোথায়। কারো কি এ ব্যাপারে কিছু জানা আছে?
সবাই ভাবতে লাগল। কিছুক্ষণ পর জুয়েল বলল, পেয়েছি। রতনের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো সাপ। সে সাপকে খুব ভয় পায়।
ফারিহা বলল, কিন্তু সাপ পাব কোথায়? আর পেলেও সাপ ধরতে যাবে কে? আমরাও তো সাপকে অনেক ভয় পাই।
জুয়েল বলল, পুরো ব্যাপারটা আমার উপর ছেড়ে দাও। আমার পরিচিত এক বেদে আছে। যে সাপের খেলা দেখায়। তার কাছ থেকে সাপ নিয়ে আসব।
কিন্তু যদি তোমাকে কাঁমড়ে দেয়?
আরে বোকা! সাপের তো বিষ দাঁত খুলে ফেলেছে। কাঁমড়ে দিলেও কিছু হবে না।
চাঁদনী বলল, ঠিক আছে জুয়েল। তাহলে এক্ষুণি কাজে নেমে পড়। রতন মাঠ থেকে ফেরার আগেই কাজটা সারতে হবে।
ঠিক আছে এক্ষুণি যাচ্ছি বলে জুয়েল দৌড়ে চলে গেল।
ক্লাসরুমে বসে সবাই উত্তেজনার সাথে জুয়েলের জন্য অপেক্ষা করছে। কিছুক্ষণ পর জুয়েলকে দেখা গেল একটি কাপড়ের থলির মত ব্যাগ নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। চাঁদনী এগিয়ে গিয়ে ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করল, এনেছ?
হ্যাঁ এনেছি। কিন্তু কোথায় রাখব?
রতনের ব্যাগের ভেতর রেখে দাও।
জুয়েল রতনের ব্যাগের চেইন খুলে সাপটি ভেতরে ঢুকিয়ে আবার চেইন বন্ধ করে দিল।
এবার সবাই সেই কাক্সিক্ষত মুহুর্তটির জন্য অপেক্ষা করছে। ঘড়ির কাটা যেন হঠাৎ করে থেমে গেছে। প্রতিটা সেকেন্ডকে খুব দীর্ঘ মনে হচ্ছে। অবশেষে পানি পান করার জন্য রতন ক্লাসে প্রবেশ করল। উত্তেজনায় কেউ সেদিকে তাকাতে পারছে না। সবাই আগ্রহের সাথে অপেক্ষা করছে কি ঘটে দেখার জন্য। কয়েক মুহুর্ত পার হয়ে গেল কিন্তু কিছুই ঘটল না।
হঠাৎ রতনের প্রচন্ড চিৎকারে ক্লাসরুম কেঁপে উঠল। তার চেহারা ভয়ে নীল হয়ে গেছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে অত্যন্ত ভয় পেয়েছে সে। সাপ! বাচাও! বাচাও! বলে চিৎকার করতে করতে দৌড়ে বেরিয়ে গেল রতন।
রতনের এই করুণ অবস্থা দেখে সবাই খুশিতে নেচে উঠল। সবার মাঝে যেন ঈদের আনন্দ নেমে এল।
তারপর কয়েকদিন রতনের দেখা পাওয়া গেল না। তিনদিন পর রতন স্কুলে আসল। রতনকে দেখে সবাই জিজ্ঞেস করল, কিরে রতন স্কুলে আসিসনি কেন এতদিন? শরীর খারাপ ছিল নাকি?
রতন কোন উত্তর দিল না।
সবাই আড়ালে মুচকি হাসছে আর ভাবছে, বেটার উচিত শিক্ষা হয়েছে।

গ্রীষ্মকালীন ছুটির কারণে স্কুল ১৫ দিনের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। চাঁদনী তার মায়ের সাথে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হল। দীর্ঘদিন পর বাড়ি ফিরছে ভেবে চাঁদনীর যতটা আনন্দ হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে অনেকদিন বন্ধুদের সাথে দেখা হবে না বলে। যদিও এই স্কুলের বন্ধুদের সাথে তার অল্পদিনের পরিচয় তবুও তারা অনেকটা আপন হয়ে উঠেছে তার কাছে। বাস স্টেশনের কাছাকাছি একটি ফার্মেসী দেখতেই চাঁদনী রিকশা থামিয়ে নেমে পড়ল। বাসে চড়তে চাঁদনীর একটু প্রবলেম হয়। তাই পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে কিছু ঔষধ কিনে নেয় সে। আজও তার ব্যতিক্রম হল না। কিন্তু ফার্মেসীতে হঠাৎ আদিত্যকে দেখতে পেয়ে খুব হবাক হল চাঁদনী।
আদিত্য তুমি এখানে!
আরে চাঁদনী! কোথায় যাচ্ছ তুমি?
বাড়ি যাচ্ছি। বলে মায়ের সাথে আদিত্যকে পরিচয় করিয়ে দেয় চাঁদনী।
চল তোমাদের স্টেশন পর্যন্ত এগিয়ে দেই। বলে ওদের সাথে হাঁটতে থাকে আদিত্য। হাঁটতে হাঁটতে চাঁদনী জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা আদিত্য। তুমি ঐ ফার্মেসীতে কি করছিলে?
আদিত্য ইতস্তত করে বলল, ওখানে পারটাইম জব করি।
জব কর! কিন্তু কেন?
তুমি তো জান আমার ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নটার কথা। সে থেকেই ফার্মেসীর সাথে সম্পৃক্ততা। তাছাড়া এখানে জব করি বলেই তো এখনো টিকে আছি।
মানে কি? একটু খুলে বলতো।
আদিত্য একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে আরম্ভ করল। আমি যখন ৪র্থ শ্রেণিতে পড়ি তখন আমার বাবা ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। বাবাই ছিল আমাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার অকাল মৃত্যুতে আম্মু একেবারেই ভেঙ্গে পড়ে। কিছুদিনের মধ্যেই সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। আর আমি একই সাথে বাবা ও মা দু’জনকেই হারাই। যে মা আমাকে সবসময় আগলে রাখত, চোখের আড়াল হতে দিত না সে আজ আমাকে চিনতেই পারে না। আমার সাথে আর আগের মত কথা বলে না, গল্প শোনায় না, নিজ হাতে খাইয়ে দেয় না। ঘরে খাবার নেই। খাবারের তাগিদে রেল স্টেশনে পানির বোতল বিক্রি করতে থাকি। এতে যে সামান্য টাকা উপার্জন হতো তা দিয়ে খাবার কিনে খেতাম। উপার্জন না হলে উপোস থাকতাম। সবকিছুই মেনে নিয়েছিলাম কিন্তু মায়ের নির্লিপ্ততা আমাকে কষ্ট দিত। মায়ের ভালবাসা পেতে ইচ্ছে করতো। মায়ের ভালো চিকিৎসা করার মতো টাকাও ছিল না। তখন শপথ নেই বড় হয়ে ডাক্তার হব। মায়ের চিকিৎসা করব। মাকে সুস্থ্য করে তুলব। তারপর থেকে নিয়মিত স্কুলে যেতে থাকি। আর বিকেল বেলা বিভিন্ন কাজ করে স্কুলের ফি জোগার করতে আরম্ভ করলাম।
শুনতে শুনতে নিজের অজান্তেই চাঁদনীর চোখ দিয়ে পানি ঝরতে আরম্ভ করল। সে চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল, তোমার অনেক কষ্ট হতো তাই না?
হ্যাঁ, তাতো হতোই। কিন্তু যখন আমার স্বপ্নটা চোখের সামনে ভেসে উঠত তখন আর কষ্ট লাগত না। কষ্টগুলোকে মধুর মনে হতো। যতই কষ্ট করতাম মনে হতো আমি আমার স্বপ্নটার দিকে ততই এগিয়ে যাচ্ছি। এই স্বপ্নটা আজও আমাকে একইভাবে শক্তি যোগিয়ে যাচ্ছে। এই স্বপ্নটাই আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন।
বাসে বসে চাঁদনী আদিত্যের কথা ভাবতে থাকে। আদিত্য জীবনে কত স্ট্রাগল করে যাচ্ছে অথচ তাকে দেখে কখনো সেটা বুঝাই যায় না। আজ চাঁদনী বুঝতে পারে কেন আদিত্য স্কুলে টিফিন নিয়ে আসে না। কেন ঐদিন তার দেয়া টিফিন খেতে গিয়ে ইমোশনাল হয়ে পড়ে। আর কেনই বা সে স্কুলে দেরি করে আসে।
২৩/০৭/২০১৬

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.