নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

জীবন কিন্তু একটাই

জীবন কিন্তু একটাই

হাতপা

কিছু বলার নাই

হাতপা › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্পঃ তারপর

০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ৮:৪৬

গল্পঃ তারপর

----------------------------------

আমি মাহমুদ।পুরো নাম মাহমুদুল হাসান।



আমার পরিচয় আমি বর্তমানে একজন বেসরকারি চাকরীজীবি।ফ্যামিলিতে কেউ কখনো ব্যবসা করেনি,কিন্তু আমার ইচ্ছে আছে ব্যবসাশুরু করার,লাইন ঘাট,লোকজনের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছি।আমার পেশা নিয়ে কথা বলতে আসি নি।বরং এসেছি কষ্টের কথা বলতে।



কত রকম কষ্টই তো আছে জীবনে।খেতে না পারার কষ্ট,পরতে না পারার কষ্ট,পড়তে মানে লিখাপড়া করতে না পারার কষ্ট।আমার টা মোটেই সেরকম কষ্ট না।ছোট থেকে বড় হয়েছি বেশ আদরেই।পড়ালেখায় মোটামুটি ভালো ছিলাম। স্কুল-কলেজে ফার্স্ট-সেকেন্ড না হলেও বরাবর ভালো রেজাল্ট করতাম।



নিছক ভদ্র ছেলে,ভালো স্টুডেন্ট ছিলাম আমি।কোনদিন কোন মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকাইনি। একদিন তাকিয়েছিলাম,তাকিয়েছিলাম বলতে তাকাতে হয়েছিল। মেয়েটা আমাদের ভার্সিটিতেই পড়ত। সে তাকানোই কাল হয়েছিল।এরপর থেকে দিনরাত আমি তার কথা ভাবতাম।



মেয়েটিকে আমার ভালো লাগার কথা বলতে অনেক সময় নিলাম। জানিনা,আমাকে মেয়েটা করুণা করেছিল কিনা,অবিশ্বাস্য ভাবে মেয়েটি আমাকে গ্রহণ করল,মানে আমার ভালোবাসাকে। এখানেই আমার কষ্ট।আপনারা ভাবছেন কষ্ট কোথায়?বলছি।সেই মেয়ের সাথে তিন বছর তিন মাস প্রেমের প্রতিদান হিসেবে পেলাম তার বিয়ে হয়ে যাবার খবর। অবশ্য মেয়েটা আমাকে আগেই বলেছিল- সময় থাকতে সচেতন হতে,আমি হতে পারিনি,সেটা আমার ব্যররথতা,একটা বেকার ছেলের সাথে বিয়ে দেয়ার কথা না মোটেই।



তবু,জীবনের প্রথম প্রেম। এভাবে তার পরিণতি হবে সেটা কাম্য ছিল না কখনো। বিয়ের পরপর বুঝতে পারি কষ্ট জিনিস টা কি,রাত আসলেই বুকের মাঝে তীব্র ব্যাথা জেগে উঠে।মেয়েটিকে দোষ দিই না। কি আর হবে...সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আর বিয়ে করব না।একটা ভালো চাকরিতে ঢুকে গেলাম পাস করে। সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম। তামান্নার জায়গায় কাউকে বসাতে পারবো না।তামান্না আমার প্রথম প্রেম।সেই শেষ।



কিন্ত,পরিবার-আত্নীয়স্বজন কে মানাতে পারলাম না। এই করব,সেই করব করতে করতে অবশেষে আমি মত বদলালাম।করেই ফেলব বিয়ে।কি আছে কপালে।বিয়ে তো একটা সামাজিক রীতি বৈ কিছু নয়।মানসিক-শারীরিক সম্পর্ক তো নিজের কাছে কেবল। সেখানে জোরজবরদস্তি করার কিছু নেই।



কথাবার্তা চলছে।মেয়ের নাম কি যেন। উচ্চারণের অযোগ্য।কঠিন নাম আমি মনে রাখতে পারি না।আর রাখবই বা কেন?আমার তো তামান্না আছে,আছে মানে ছিল আর কি।আচ্ছা,তামান্না এখন কেমন আছে?মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে তামান্নার কাছে যাই,ওকে হাত ধরে টেনে বের করে আনি।ও কি করবে? বাধা দিবে?অসহায় হুয়ে চেয়ে থাকবে?নাকি আমার হাত শক্ত করে ধরে বলবে,চল মাহমুদ,যেখানেই নিয়ে যাবে,আমি যাবো তোমার সাথে।

আপনারা ভাবছেন,এখন আর কি কষ্ট? কষ্ট কোথায়?কষ্ট তো আছেই,কষ্ট হলো এখন আমাকে অভিনয়ের প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে,সুখে থাকার অভিনয়।কাল বিয়ে। অভিনয়ের শুরু।

####



কাল আমার বিয়ে।ঠিক এইসময়ে আমি একজনের হয়ে যাবো চিরকালের জন্য,ভাবতে কেমন লাগছে জানেন?



জঘন্য।কারণ,আমি যাকে মনেপ্রাণে ভালোবাসি তার জন্য আমি অপেক্ষা করব।অনন্তকাল।সে আমাকে যেদিন একরাশ গোলাপ হাতে দিয়ে বলেছিল, ‘অরিত্রিকা,তোমার জন্য’-সেদিন থেকেই মনে জেনেছিলাম,সেই আমার জীবনে সবকিছু।



কিন্তু,যা ভাবা তা আর হল না।নিয়তির লেখন না যায় খন্ডন।আমাকে রাশি রাশি গোলাপ দিলেও সময়মত ও আমার বিয়ের যোগ্য হয়ে উঠতে পারে নি।বাবা-মার সাথে প্রতিবাদ এর পর প্রতিবাদ করে,আর নানারকম কৌশল খাটিয়ে আমি শেষমেশ আত্নসমর্পণ করতে বাধ্য হলাম নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে।কিন্তু এই আত্নসমর্পণ সাময়িক,সময়ের প্রয়োজনে।



অরিত্রিকা অনামিকা কখনো হাল ছেড়ে দেবার মত মেয়ে না।

বিয়ে হচ্ছে,হবে।কিন্তু আমার মনে কি আছে সেটা কাউকে বুঝতে দিবো না।প্রতিশোধ নেব আমি।বুঝবে তখন সবাই। আমার প্রিন্স একদিন আমার কাছে ছুটে আসবে,তখন আমি এই সাজানো সংসার ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ছুটে যাবো...



আমি মোটেই সহজ মেয়ে না। যার সাথে বিয়ে হতে যাচ্ছে সে নিতান্তই গোবেচারা নিরীহ।ছবিতে দেখেছি,সামনাসামনি চোখ তুলেও তাকাবার প্রয়োজন মনে করি নি।



এইসব নিরীহ ছেলেগুলিই স্বভাবে আবার উলটো হয় মাঝেমাঝে।বাসর রাতে যদি একটু কাছে আসার চেষ্টা করে আমি ওর ঠ্যাং ভেঙ্গে ফেলব।

মাহমুদ না কি যেন নাম। বড্ড শখ,সুন্দরী মেয়ে দেখেছে আর রাজি হয়ে গেছে অমনি বিয়ে করতে।তোমার কোন আশা পূরণ হবে না বলে দিলাম।ভেবেছে,সুন্দরী মেয়ে বিয়ে করে বলে বেড়াবে।আমি ওর লাইফ হেল করে দিব। অবাক হচ্ছেন?আমার নিজের রাগ ওর উপর ঝাড়ছি বলে।কি আর করব,কারো না কারো উপর তো ঝাড়তে হবেই। তাছাড়া,সে রাজি না হলে বিয়েটাও তো হত না।রাগ ঝাড়ার যথেষ্ট কারণ আছে বই কি।



আমার চেহারা বেশ নজরকাড়া।একজন বলেছিল আমি নাকি দেখতে অদ্রে হেপবার্ণের মত। জানতাম না এই ভদ্রমহিলা কে।পরে নেটে সার্চ মেরে ভদ্রমহিলাকে দেখলাম।দেখে খুশিই হলাম।মহিলা আসলেই দারুণ সুন্দরী। তো,যে অদ্রে হেপবার্ণের মত দেখতে তার সাথে কি একটা সাধারণ গোবেচারা মাহমুদ-ফাহমুদের সাথে বিয়ে হওয়া সাজে? সাজে না। সে কি পারবে তন্ময়ের মতে কথায় কথায় কবিতা বানাতে?একটানে আমার মুখের ছবি আঁকতে? এসব সবাই পারে না।



###



ঘুমের মাঝে এপাশ থেকে ওপাশ সরতেই জানালা দিয়ে কড়া রোদের আলো এসে ঝটকা মারলো মুখে।চোখ মুখ কুঁচকে আলস্য ঝেড়ে সিলিং এর ঘূর্ণায়মান ফ্যানের দিকে চেয়ে রইল মাহমুদ।কিছু মুহুর্ত পর তড়াক করে উঠে বসল বিছানায়।



বালিশের পাশে থেকে মোবাইল টা বের করল।সাড়ে দশটা বেজে গেছে! বুধবার আজকে।বিয়ের জন্য টানা পাঁচদিনের ছুটি মঞ্জুর করা আছে তার। হাই তুলে আড়মোড়া ভেঙ্গে নিজের ঘরটা দেখল।এতক্ষণ কেন ঘুমিয়ে ছিল,একটুও টের পায়নি।গতকাল রাতেই ঘুমোতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল।শুয়ে পড়ার পরও জেগে ছিল অনেকক্ষণ, মন মেজাজ অতটা ভালো ছিল না।



মাথাব্যথাটা ছিল,এখন চলে গেছে।কপাল টা দু আংগুল দিয়ে চেপে আস্তে আস্তে উঠে ফ্রেশরুমের দিকে গেল।



দরজা বন্ধ ভেতর থেকে।কেউ আছে।অনেকদিনের একা থাকার অভ্যাস। আরেকজনের সাথে জড়িয়ে গেছে সে এখন।একজন ইন্ট্রুডার।ঘুম থেকে উঠে সরাসরি ফ্রেশরুমে না ঢুকলে অস্থির হয়ে পড়ে।দরজা টোকা দেয়া টা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছে না। ভেতরে শাওয়ারের জোরালো শব্দ হচ্ছে। বিরক্তি প্রকাশ করে মনে মনে আবার বিছানায় গিয়ে বসল মাহমুদ।



একটা প্ল্যান ছিল মাথায় গতকাল রাতে,যেভাবে মেয়েটাকে কিছুকথা বলে বিব্রত করে দিবে ভেবেছিল উলটে মেয়েটির কথাতেই নিজে বিব্রত হয়ে গিয়েছিল। মেয়েটার প্রথম কথাই ছিল- ‘ভালো ব্রান্ডের বডি স্প্রে ইউজ করবেন’। এইজাতীয় কথা জীবনের প্রথম বিয়ের রাতে,বিয়ে করা বউ,হোক সে মাহমুদের কাছে অপাংক্তেয় শুনে মাহমুদ একেবারেই দমে গিয়েছিল।

মাথা টা চট করে গরম হয়ে গিয়েছিল।কোথাকার কে,তাকে এইসব বলছে।পরক্ষণেই নিজেকে শান্ত করে ফেলল। কোনমাত্র বিরূপ ভাব প্রকাশ না করে,সে মেয়েটির কেমন লাগছে,অসুবিধা হচ্ছে কি না,কিছু লাগলে যেন মাহমুদ কে জানায় ইত্যাদি প্রসঙ্গে চলে গেল।



ভেবেছিল,মেয়েটি হয়ত তার সম্পর্কে কিছু জানতে চাইবে,টুকটাক কিছু কথা বলবে।সেই মুহুর্তেই মাহমুদ একটু একটু করে বুঝিয়ে দেবে সবকিছু। যে মেয়েটিকে তার মোটে পছন্দ নয়। দীর্ঘ রাত মাহমুদ সেই সুযোগের আশায় দমবন্ধ করে বসে ছিল,অথচ কি আশ্চর্য্য মেয়েটি তার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র আগ্রহ প্রকাশ করল না।



একটা সময় মেয়েটার প্রতি মায়াবোধ হতে লাগল,হয়ত মন খারাপ,তাই কিছু বলছে না।তাই মাহমুদ নিজেই অগ্রবর্তী হয়ে জানতে চাইল-‘কি ব্যাপার?মন ভালো নেই’



মেয়েটি এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ল।নেই।



‘ও,বাসার কথা মনে পড়ছে ,ঠিক না?’

মেয়েটি মাথা নাড়ল।

‘তাহলে?’ –মাহমুদ একটু বিস্মিত হল।

‘আছে একজন’-মেয়েটা নিচুস্বরে বলল।



মাহমুদের সমস্ত শরীরে যেন এসিডের ছেঁকা লাগল। পরক্ষণেই নিজেকে ধাতস্থ করে নিল।আমার কি!-মনে মনে নিজেকে শান্ত করল মাহমুদ।তারপর,চুপ করে বসে রইল।



ব্রাশে পেস্ট লাগাতে যাবে,খেয়াল হল আরেকটি নতুন অতিথির সংযোগ হয়েছে ব্রাশের কৌটয়। মেয়েটিরই।তারপর নিজের ব্রাশ খানা দাঁত থেকে বের করে পরখ করে দেখল,তারটাই কিনা।

গুনগুন গানের শব্দ আসছে ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে’- তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বারান্দায় এলো মাহমুদ।মাহমুদের উপস্থিতিতে মেয়েটির কোন পরিবর্তন দেখা গেল না।রোদে চুলগুলো মেলে ধরে সে গুনগুন করে যাচ্ছে-‘চেনাশোনার কোন বাইরে...’

মেয়েটার মাথায় কি গন্ডগোল আছে?নাকি মাহমুদেরকে অগ্রাহ্য করার কৌশল এসব- ভাবতে ভাবতে মাহমুদের ঘরের ভিতরে আসে।ছুটির দিনগুলো অনর্থক।আরো তিনদিন পরে অফিস। ছুটি বাড়ানো যায়,কমানোও যায়।আগেভাগেই অফিসে জয়েন করবে নাকি?লোকে আবার কি বলবে?থাক... কোনরকমে কাটিয়ে দেয়া যাক কয়টা দিন।

####



ছেলেটাকে প্রথম যেমন অসহ্যবোধ হচ্ছিল,এখন তেমন আর অসহ্যবোধ হচ্ছে না।আবার ঠিক করে বলাও যায় না,কার মনে যে কি আছে কে জানে।তবে আর যাইহোক,অরিত্রিকার মনে হচ্ছে,এই ছেলেটির দ্বারা তার কোনপ্রকার ক্ষতির সম্ভাবনা নেই,ক্ষতি বলতে শুরুতে ভেবেছিল ছেলেটি যদি অভিযোগ করে বসে নতুন বউ হিসেবে তার আচরণ নিয়ে।ইচ্ছে করেই সে একটি শীতল-রূঢ় ভাব পোষণ করে আসছে গতকাল থেকে।কিন্তু,ছেলেটাকে আজ পর্যন্ত যা দেখল, দেখে মনে হয়নি,সে তেমন কিছু করবে বা বলবে,না করলেই ভাল।আর করলেও বা,অত কিছু ধার ধরার ইচ্ছা নেই।



আপাতত বিয়ে যখন হয়েই গেছে,অরিত্রিকা কয়টা দিন কিছুই বলবে না।খুব বাজে আচরণও করবে না।আবার,অতটা ভাবও দেখানো যাবে না।সময় আসুক,নিজে থেকেই ছেলেটি বুঝতে পারবে। আর যদি নূন্যতম আত্নসম্মানবোধ আর ব্যক্তিত্ব থেকে থাকে ছেলেটি মোটেই অত ঘাঁটাবে না অরিত্রিকা কে।



চুল শুকিয়ে গেছে।অরিত্রিকা আগে সবসময় কাঁধ পর্যন্ত চুল রাখত।এখন যে তার এত বিশাল চুল,এই চুল তার নয়।তন্ময়ের।তন্ময় ওকে ডাকত সুকেশিনী।এই চুলের গন্ধ নিতে কি যে ভালোবাসত ও!



তোয়ালে টা বারান্দায় টানানো রশি তে ঝুলিয়ে দিয়ে দরজার চৌকাঠে এসে দাঁড়ালো অরিত্রিকা।



মাহমুদ চোখের সামনে পত্রিকা ধরে আছে। মনে হয়না তার মনোযোগ ঐ পত্রিকার পাতায় আছে।মনে মনে হাসে অরিত্রিকা। হায়রে পুরুষমানুষ,কম ঢং জানে না।



‘চা খাবেন?’



মনে হয় কিছু শুনতে পায় নি ,এমনভাবে পত্রিকার পেছন থেকে আস্তে করে মুখের একটা অংশ বের করল মাহমুদ। চোখে আগের মত বিরক্তি ভাব নেই।



‘কিছু বললেন আমাকে?’



কথাটা শুনেও না শোনার ভান করল।মনে মনে হাসতে হাসতে বলল অরিত্রিকা- ‘হ্যাঁ,বলছি চা খান আপনি?এখন খাবেন?’

‘ওহ।হ্যাঁ,আপনি?’

‘খাই।রান্নাঘরে সবকিছু আছে তো?চা-পাতা,চিনি,চামচ টামচ?পাতিল’

মেয়েটা কি রাগাতে চাইছে নাকি মাহমুদ কে?বুঝতে পারল না মাহমুদ । -‘সবই আছে।আপনি বানাবেন?’



সে কথার উত্তর না দিয়ে অরিত্রিকা তাকে দেখিয়ে দিতে বলল কোথায় কী আছে।



মেয়েটাকে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। কখনো মনে হচ্ছে তার সাথে রূঢ় আচরণ করছে,কখনো মনে হচ্ছে স্বাভাবিক-এত ভেবে কাজ কী? মাথার পেছনে দুহাত রেখে বালিশে হেলান দিয়ে আগের কথা ভাবতে থাকে মাহমুদ-‘চা চাই চা?’বলে সবার মাঝে মাহমুদকে একটু আলাদা করে ডেকেছিল সেদিন তামান্না পিকনিকে।চায়ের কাপে চামচের টুংটাং বাড়ি দিয়ে।মনে হচ্ছে এই তো সেদিন,অথচ অনেকদিন আগের কথাই। কিছু কিছু স্মৃতি এত স্বচ্ছভাবে মনে গেঁথে যায়,আপনিই মনে এসে পড়ে।চা চাই চা?-সাথে টুংটাং চামচের শব্দ।



ভাবতে ভাবতে টুংটাং শব্দে চমকে উঠল।একটা ছোট ট্রেতে চায়ের কাপ আর পানিভর্তি গ্লাস নিয়ে মেয়েটি পাশে দাঁড়িয়ে।ওর চুড়িগুলোই গ্লাসে লেগে শব্দ করছিল।



কি যেন নাম?বারবার চেষ্টা করেও মনে করতে পারেনা মাহমুদ-রাত্রি,না কি যেন কঠিন নাম...ধন্যবাদ দেয়া উচিত মেয়েটিকে।



‘চিনি দিলাম না, আপনার সুবিধামত নিয়ে নিন। আর, দুপুরে কি খাবেন?বলেন।হালকা পাতলা কিছু।বেশি ঝামেলায় যেতে পারবো না’



একটু অবাকই হল মাহমুদ।মেয়েটির আচরণ আসলেই বিচিত্র।কখনো রোদ,কখনো যেন শ্রাবণের বৃষ্টি।



‘থ্যাংক ইউ’ বলে ট্রে থেকে কাপ নিল। মেপে মেপে দুইচামচ চিনি নিল তাতে।



‘এত চিনি!’-মেয়েটি বিস্ময় প্রকাশ করল-‘এত মিষ্টি খেলে আমি নির্ঘাৎ বমি করে দেব’

‘আচ্ছা,আমি একটু বেশিই খাই’-মাহমুদ বলে।



মেয়েটা বেশ শব্দ করে চা খাচ্ছে,মনে মনে হেসে ফেলল মাহমুদ। বাসার একমাত্র সন্তান শুনেছে।সেজন্য মেয়েটির স্বভাবে-চরিত্রে হাল্কা আদুরে ভাব ,এক সন্তানরা একটু আহ্লাদী হয়ে থাকে।চা খাবার ফাঁকে ফাঁকে দেখছিল,তখনি মেয়েটা তাকালো মাহমুদের দিকে।চোখ চোখ পড়ায় একটু লজ্জা পেল মাহমুদ।



গলা খাঁকারি দিয়ে সেই ভাবটা কাটানোর চেষ্টা করল,তারপর বলল- ‘চা টা ভালো লাগছে’।

‘আপনি মনে হয় সিগারেট খান না?না?’

বিষম খেলো মাহমুদ-‘না।তবে খেতাম একসময়’



‘আচ্ছা,তন্ময় প্রচুর সিগারেট খেত।ঘনঘন’-কথাটা বলতে বলতে মেয়েটার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

‘তন্ময় কে?’

‘ওহ স্যরি!আই ডিডনট ইন্ট্রোডিউস হিম’-চায়ের কাপটা প্লেটে রেখে মেয়েটা উঠল চেয়ার ছেড়ে। তারপর টেনে টেনে একটু নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল-‘তন্ময়,অসাধারণ চমৎকার এক মানুষ।ইনকম্পেয়ারেবল পার্সন হি ইজ’ বলে মাহমুদের দিকে চাইল।



‘সেটা না। জানতে চাইছি তন্ময় কী হয় আপনার?মানে রিলেশান’

একটু গম্ভীর হয়ে গেল অরিত্রিকা।সময় নিল,ভাবল।তারপর বলল-‘ওকে,ওকে আমি পছন্দ করি... ’

বলতে বলতে খেয়াল করল,ছেলেটা হাসছে।অরিত্রিকা প্রথম টা বুঝতে পারছিল না কেন হাসছে,পরে দেখল ছেলেটি আসলেই হেসে যাচ্ছে। আর কিছু বলল না। ভীষণ রাগ হল অরিত্রিকার। কথা বলাই উচিত হয় নি। ধুর।



####



‘তোমার চোখ’

‘আর?’

‘তোমার ঠোঁট’

‘আর?’

‘আর তোমার ...’ ঘুম ভেঙ্গে গেল।কতক্ষণ ঘুমালো? স্বপ্ন দেখছিল অরিত্রিকা। মন টা খুব খারাপ হয়ে গেল। তন্ময় যেন একটু আগেই ওর সাথে ছিল।ঠিক এভাবেই বলছিল,যেন কথা নয়,কোন কবিতা... চুপচাপ বিছানায় মন ভার করা বিকেল বেলায় বসে রইল অরিত্রিকা।বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠছে।



দুপুরে খেয়েদেয়ে একটু শুয়েছিল অরিত্রিকা। এক ফাঁকে বাসায় কথা বলে নিয়েছে। মার সাথে কথা বলার পরপরই ঘুমিয়ে গিয়েছিল।



মাহমুদ বেরিয়েছে,কোথায় যাচ্ছে জানার প্রয়োজন বোধ করেনি অরিত্রিকা।যাবার সময় ওকে বলে গিয়েছে কেউ বেল টিপলে বা দরোজা নক করলে ভালো করে কীহোল এ দেখে নিতে,আর কাজের মহিলা আসলে কাজ করতে মানা করে দিতে।



উঠে ফ্রেশ হয়ে নিল। মাহমুদ আসেনি। বাসাটা ঘুরে ফিরে দেখল অরিত্রিকা, একটা বেডরুম।যেটায় ওরা ছিল।আরেকটা বাড়তি রুম আছে।যেটা দুইভাগ করে দুটো রুমের মত করা হয়েছে। খুব একটা অগোছালো নয়।



ফাঁকা বাসায় একা একা কিছুক্ষণ হেঁটে বেড়াল। মন ভার ভাবটা কমছে একটু একটু। একটা বই পেলে পড়া যেত।কোন বই চোখে পড়ল না এপর্যন্ত, কয়েকটা ম্যাগাজিন ছাড়া।সেখান থেকেই একটা নিয়ে বারান্দায় চলে গেল অরিত্রিকা।জায়গাটা সামনে একটা ছোটখাট মাঠের মত আছে।বাচ্চারা ক্রিকেট খেলছে। খেলা দেখতে লাগল অরিত্রিকা।



লোকটা কখন আসবে?সন্ধ্যা পার হয়ে গেল। ফোন দিতে ইচ্ছে করছে না। আবার,একটু চিন্তা হচ্ছে।কেন চিন্তা হচ্ছে?ওকে নিয়ে তোমার কোন চিন্তা হতে নেই অরিত্রিকা,মনে মনে নিজেকে শাসায়।তুমি শুধু তন্ময়ের,শুধুই।আর কারো নও।



দুইঠোঁটে সিগারেট চেপে ধরে দেশলাই ঠুকে সিগারেট ধরাল মাহমুদ।জ্বলতে থাকা দেশলাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকল।শেষ হয়ে আসলে পর নিভিয়ে টেবিলে রাখা ছাইদানীতে গুজে দিল।তারপর,লম্বা করে একটা টান দিল সিগারেটে।



অনেকদিন পর।ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে হালকা হালকা ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ভদকার গ্লাস টা টেবিল থেকে নিয়ে নাকের সামনে ধরল।এলকোহলের ঝাঁঝালো গন্ধ আর নিকোটিনের কড়া গন্ধ দুই মিলেমিশে মাহমুদের চেতনাকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছিল।এক ফোটাও পান করেনি সে।অথচ,নিজেকে এলোমেলো লাগছে খুব। মনে হচ্ছে তার শরীর টা কেউ যেন হাওয়ায় ভাসিয়ে নিচ্ছে।খুব ভালো লাগছে। এভাবে কতক্ষণ থাকা যায়?



হাতড়ে হাতড়ে নিজের মোবাইলটা শার্টের বুকপকেট থেকে বের করে আনল।তারপর, ফোনবুক এ গিয়ে এলোমেলো হাতের আংগুল দিয়ে খুঁজতে লাগল।



অনেকদিন পর বিধায় অল্পপরিমাণেই অনেক ধরে গেছে ওকে।তামান্নার নাম্বার টা মোবাইলে আজো সেইভ করা আছে।নাম্বারটা বের করে সেদিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইল সে।



কি করছে তামান্না এখন,কেমন দেখতে হয়েছে এতদিনে?তামান্না আজকে আর ছটফটে উচ্ছল আর প্রাণবন্ত তরুণীটি আছে কি?ওর হাসিতে কি চারপাশ এখন আর আগের মত কেঁপে কেঁপে ওঠে?



তামান্নার সাথে কথা বলার সাহস হয় না।তবু,প্রায় এমনভাবে মোবাইল টা বের করে ওর নাম্বারটার দিকে তাকিয়ে থাকে,মাহমুদ।কথা বলে কল্পনায়-

‘হ্যালো’

‘মাহমুদ?’

‘হ্যাঁ,ভালো আছ ময়না পাখি?’ মাহমুদ মাঝে মাঝে এই নামে ডাকত তামান্নাকে।ডাকটা শুনে লজ্জা পেত আর হাসত-ও তামান্না।

‘না,মন ভালো নেই’

কেন মন ভালো নেই তামান্নার?উৎকন্ঠিত হয়ে পড়ে মাহমুদ। ছুটে যেতে ইচ্ছে করে তামান্নার কাছে।ওর মুখটা নিজের বুকে জড়িয়ে চেপে ধরতে চায়।হু-হু করে কেঁদে উঠে।



একি! সত্যি সত্যি কাঁদছে মাহমুদ।চোখের পানি ওর মুখ বেয়ে ঝরছে।সংযত করার চেষ্টা করল না।এখানে কেউ কারোকে দেখে না। সবাই যার যার টেবিলে বসে নিজ নিজ সুখ-দুঃখের অনুভূতি নিজমত উদযাপন করছে। তাছাড়া আবছায়া অন্ধকারে স্পষ্টভাবে কিছু দেখা যায় না।



তারপর হাত দিয়ে চোখটা-মুখটা মুছে ফেলল-



"পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যাদের মতো সে যে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে;

আবার তাহারে কেন ডেকে আনো? কে হায় হৃদয় খুঁড়ে

বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!"



দরজা খুলে দিয়েছিল অরিত্রিকা।বেল না বাজিয়ে দরজা ধাক্কাচ্ছিল মাহমুদ। মাহমুদকে দেখেই একটু আতঙ্কিত হয়ে চিৎকার দিয়ে উঠছিল সে,পরে,চিৎকার টা গিলে নিল।এ কি অবস্থা? দেখে মনে হচ্ছে মারপিট করে এসেছে,চোখমুখ বেশ লাল আর সারা গায়ে তীব্র গন্ধ।



মাহমুদ কিছু না বলে চুপচাপ বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল।অরিত্রিকা হতভম্ব হয়ে দেখছিল।লোকটার চোখের দিকে তাকানো যায় না। অরিত্রিকার মনে হয়েছে লোকটা যেন একটা বিশাল কষ্টের সমুদ্র থেকে ডুব দিয়ে এসেছে। কি এত বেদনা তার?থাকতেই পারে। সে বেদনা কি তার নিজের কষ্টের চেয়েও বেশি?



###



আজকে বেশ সকালেই ঘুম থেকে উঠে গেল অরিত্রিকা।গোসল সেরে নিল।

মাহমুদ ঘুমাচ্ছে। পা টা গুটিয়ে শিশুর মত ঘুম।রাতে খায়নি।জাগানো কি উচিত হবে?থাক।ঘুম থেকে জাগলে গতরাতের কথা বলে একটু লজ্জায় ফেলা যাবে।



দশটার সময় ঘুম ভাঙ্গল মাহমুদ।মেয়েটা চেয়ারে বসে আছে।চোখবন্ধ করে ফেলল মাহমুদ।



হলুদ রঙের পোশাক পরে আছে অরিত্রিকা। লম্বা চুলটা বেণী করা,কোন ঘরের কার এই সুন্দর মেয়েটি তার ঘরে বসে আছে।কী সম্পর্ক তার সাথে? বউ? মনে মনে হাসল মাহমুদ।



‘উঠুন,সময় কম হয় নি।চা করছি আমি’-বলে অরিত্রিকা উঠে দাঁড়ালো-

‘ আর শুনুন। আজকে কাজের মহিলার হাতের রান্না খাবো না ,যা বিস্বাদ,আপনি তো ভালই খেতে পারেন’



মাহমুদ চোখ পিটপিট করে চেয়ে রইল।

‘চাল-ডাল-ডিম মিশিয়ে খিচুড়ি রেঁধে ফেলব ভাবছি,কি খাবেন তো?’

মাহমুদ হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ল।



অরিত্রিকা বেরিয়ে গেল।



গতরাতের কথা মনে পড়ে গেল মাহমুদের।কি বিশ্রী অবস্থা না হয়েছিল !ঘরে ঢুকেই শুয়ে পড়েছিল।তারপর আর কিছু মনে নেই। মেয়েটি কি ভাবছে?



চা-বিস্কিট নিয়ে আসল অরিত্রিকা।



'চিনি ঠিক আছে?'

'হ্যাঁ' -বলল মাহমুদ।



‘আচ্ছা, আপনার কাছে মুভি কালেকশান কেমন আছে?’

অরিত্রিকার দিকে তাকালো মাহমুদ।ও ভেবেছিল কালকে রাতের প্রসঙ্গ তুলবে মেয়েটি।

'আছে কিছু। পিসিতে'

‘আচ্ছা,দেখতে হবে’-বলল অরিত্রিকা।

‘সময় কাটছেনা?’-মাহমুদ জানতে চায়।

‘সেটা না। ইচ্ছে হল।তাছাড়া, ভাবছিলাম দেখলে মনটাও ভালো লাগতে পারে’-বলে নিজের আঙ্গুলগুলো দেখতে থাকে অরিত্রিকা।

‘মনের কি হল?’-মাহমুদ প্রশ্ন করে।

‘মন?’ বলে থামল অরিত্রিকা।তারপর,জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল-‘সেটা শুনে আর কাজ নেই আপনার।চা ভালো হয়েছিল?’

‘হুম।ভাল হয়েছে’



‘এখানে সব মুভি আছে।দেখে নিন’- পিসিতে অরিত্রিকাকে দেখিয়ে দিল মাহমুদ।

‘অরণ্যের দিনরাত্রি আছে?’

‘সেটা আবার কি?’-মাহমুদ প্রশ্ন করে।

‘সত্যজিত রায়ের মুভি।আপনি দেখেন নি!’-বিস্মিত হল অরিত্রিকা-‘চমৎকার মুভি’

‘নেই।আমি দেখিনি।আপনি ডাউনলোড করে নিন তাহলে ’

‘ঠিক আছে।করছি।আপনি দেখবেন তো?’



অরিত্রিকার প্রশ্ন করার ধরণে অবাক হল মাহমুদ।মেয়েটি কতদিন ধরে চেনে ওকে,এভাবে বলছে।



‘আচ্ছা।দেখব’-মাহমুদ বলে।



অনেকদিন পর ঘরোয়া রান্নার স্বাদ পেল মাহমুদ।খিচুড়ি আহামরি স্বাদ না হলেও ভালই খেয়েছে।কাজের মহিলার রান্না তো নিয়মিত একরকম বাধ্য হয়েই খায়।ভালো খেতে পেলে মনটাও কেমন যেন ফূর্তি ফূর্তি লাগে-মনে মনে ভাবলো মাহমুদ।খাওয়াদাওয়া সেরে দুইজন মিলে বসল।মাহমুদ চেয়ার টা টেনে নিল।অরিত্রিকা বিছানায় বালিশ কোলে নিয়ে আয়েশ করে বসে পড়ল।



‘আপনি এখানেই আসুন না ,বিছানায়।আরাম করে দেখুন’-মাহমুদ কে ডাকল।

‘না,না,আমি এখানেই ঠিক আছি’



‘ঠিক থাকলে তো ভাল।দেখেছেন সত্যজিত রায়ের এক্টর রা মিনিটে মিনিটে সিগারেট খায়।ঠিক তন্ময়ের মত।’



সামান্য মুভি দেখবার জন্য কত আয়োজন। চা-ও বানিয়ে এনেছে মেয়েটি।বিচিত্র কান্ড-কারখানা এই মেয়ের। মাহমুদ মুভি না দেখে মেয়েটিকেই খেয়াল করছে।



ডাক শুনে মাহমুদের ঘুম ভাঙল। অরিত্রিকা ওর পাশে।ঘুমিয়ে পড়েছিল চেয়ারেই।সাদাকালো মুভিটি দেখতে দেখতে ঘুম এসে গিয়েছিল,



‘শুনছেন? কেউ এসেছে!বেল বাজছে’

‘ও আচ্ছা।আমি দেখছি’-বলে মাহমুদ উঠে গেল।



কিছুক্ষণ পর মাহমুদ বেডরুমের দরজায় এসে দাঁড়ালো।

‘আচ্ছা,শুনুন। একটা ব্যাপার হয়েছে’

‘হ্যাঁ,কি?’-অরিত্রিকার মনোযোগ মুভিতে।

‘আমাদের বাড়িওয়ালা আন্টি এসেছিলেন।আপনাকে দেখতে চাইছে’

‘তাই?’-উঠে গিয়ে মুভিটা পজ করে দিয়ে মাহমুদের দিকে চাইল অরিত্রিকা।দুজনেই যেন জানে দুজনের মনের কথা।ওদের মাঝে যে একটা সূক্ষ্ণ দূরত্ব নিজেরা বজায় রেখে চলছে সেটা ওরা জানে।এখন সেটাকে কনসিল করতে হবে এই হচ্ছে ব্যাপার।দুজনের চোখাচুখিতেই সব কথা বলা হয়ে গেল যেন।

অরিত্রিকা মিষ্টি হেসে বলল-‘টেনশান নেই।সমস্যা হবে না’



ড্রেসিং টেবিলটার সামনে গিয়ে আয়নায় এক ঝলক নিজেকে দেখে নিল অরিত্রিকা,মেয়েদের চিরন্তন স্বভাব।



তারপর মাহমুদের কাছে এসে বলল, ‘চলুন।মানে চলো’-বলে অরিত্রিকা হেসে ফেলল।মাহমুদও।



‘ভদ্রমহিলা তো দাওয়াত করে গেলেন আগামীকালের ’-মাহমুদ অরিত্রিকার দিকে চেয়ে বলল।অরিত্রিকা হাসছে। শব্দ করে হাসি না।মৃদু হাসি।



‘আপনি কি ভাবছেন?আমি যেতে চাইব না?’-অরিত্রিকা প্রশ্ন করল।–‘দেখুন,আমি না বললেও আপনি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন এই বিয়েতে আমার মত ছিল না,এবং সত্য কথাটি হল এখনো নেই।তবে,এতে হয়ত আপনার কোন দোষ নেই।চিন্তা করবেন না;আপনাকে আমি ছোট করব না’-একটানে কথাগুলো বলে চাইল মাহমুদের দিকে।



মাহমুদ কিছু যেন বলতে গিয়ে আবার থেমে গেল। তারপর, চুপচাপ উঠে গেল।



অরিত্রিকা একটু ভাবল। তার কথাগুলো কি বেশি কঠিন হয়ে গেছে?রাগ করল নাকি? এমনিতেই নিজে নিজে কষ্টে আছে,তার উপর এই মানুষটা তার কথাগুলো শুনে রাগ করে যদি এটা ভেবে একটু খারাপ লাগতে থাকে। আর কিছু না হোক,এই ঘরে একই ছাদের নিচে আছে দুজন।অহেতুক তার উপর মানুষটা বিরূপভাব নিয়ে থাকুক এটা কাম্য নয় অরিত্রিকার।



কি হচ্ছে এসব? আমি কেন এই মানুষটার ভালোমন্দ নিয়ে ভাবতে শুরু করেছি? নিজেকে ঘৃণা হতে থাকে আবার অরিত্রিকার। ভুল অরিত্রিকা,এইসব ভুল।এইসব ভেবো না।অরিত্রিকা তুমিই ঠিক।



###



‘আচ্ছা,দাওয়াতে গেলে তো আমাদের কিছু নেয়া উচিত, তাই না?’

‘আমারো তো তাই মনে হয়’

‘কি নেয়া যায়?’

‘মিষ্টি-ফিষ্টি,ছোট বাচ্চা থাকলে আইসক্রিম’

মাহমুদ অরিত্রিকার বুদ্ধির প্রশংসা করল। তারপর,হঠাত চিন্তিত হয়ে পরল।-‘কি পরে যাওয়া যায় ভাবছি’

অরিত্রিকা এক মুহুর্ত ভাবল-‘আজ তো জুমাবার।দুপুরে দাওয়াত,পাঞ্জাবি পরুন না’

মাহমুদ চুপ মেরে গেল।মাহমুদের নীরবতা দেখে অরিত্রিকা জিজ্ঞেস করল-‘কি ব্যাপার?পাঞ্জাবি কি নেই?নাকি ধোয়া নেই?নাকি ছেঁড়া?কোনটা বলে ফেলুন।’

‘না ঠিকই আছে’-তারপর মাহমুদ খুঁজেপেতে বের করল।সেই পাঞ্জাবিটা হাতে নিয়ে অরিত্রিকার সামনে আসলে অরিত্রিকা হাসতে হাসতে শেষ-‘কতদিন পরেন না?দিন,দিন,আয়রন করে দিই’

শেষ করলাম গল্পটি।অনুভূতি ভালো,ভাবছিলাম শেষ করতে পারবো না। যারা সময় ব্যয় করে পড়েছেন,আর ভাল-মন্দ মন্তব্য করেছেন তাদেরকে ধন্যবাদ।

গল্পঃতারপর (শেষাংশ)

=======================

দাওয়াত সেরে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে এল ওরা।বাড়িওলা থাকেন নিচের ফ্লাটে।চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকল মাহমুদ।পেছনে অরিত্রিকা।



ঘরে ঢুকেই অরিত্রিকা বলে উঠল-কেমন জানি দমবন্ধ লাগছে,গত দুদিন ধরে,চলুন না একটু না হয় ঘুরে আসি বাইরে থেকে’

মাহমুদ ঘুরে দাঁড়ালো।



‘আমার আপত্তি নেই।দাঁড়ান পাঞ্জাবি টা চেঞ্জ করে আসি’

‘চেঞ্জ করবেন?ভালই তো লাগছিল’-মন্তব্যটা ফট করে মুখ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ায় একটু বিব্রতবোধ করল যেন অরিত্রিকা-‘মানে?খারাপ কি!শুক্রবার তো মানুষ পাঞ্জাবি পরেই থাকে’

মাহমুদ নিজের দিকে তাকালো তারপর অরিত্রিকার দিকে।তারপর,বলল-‘ঠিক আছে,চলুন।এখনি যাবেন?নাকি রেস্ট নেবেন?’

মাথা ঝাঁকিয়ে উঠল অরিত্রিকা-‘না,না,এখন একবার বসে গেলে আর বেরুতে ইচ্ছা হবে না।তাছাড়া আপনারা যেমন তেমন ভাবে পোশাক পরে বের হতে পারেন।আমাদের অনেক ঝামেলা’

মাহমুদ মেয়েটির কথার প্রতিবাদ করার প্রয়োজন মনে করল না।



সিএনজি না নিয়ে রিকশায় চড়ল ওরা।অরিত্রিকার ইচ্ছে।খোলা বাতাস খেতে খেতে যাবে।এই প্রথম মেয়েটির এত কাছাকাছি বসা।রাতে শোবার সময় একই রুমেই মাহমুদ ফোল্ডিংখাটে শোয়।

রিকশায় বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বসল দুজনে।রিকশা চলছে। রিকশার ঝাকুনিতে দুজন দুজনের সাথে হালকা যা একটু স্পর্শ হচ্ছে,তা আমলে নেয়ার চেষ্টা করছে না দুজনেই।দুজনেই খানিকটা যেন সতর্ক।একে অপরের উপস্থিতিকে অস্বীকার করতে চাইছে।অথচ,নিয়তি প্রতি মুহুর্তে ওদের কে একটু একটু করে অন্যের কাছে উন্মোচন করে চলছে।

কাটাবনের ভিতরে দিয়ে যাবার সময় পশু-পাখি মার্কেটের দিকে আংগুল তুলল অরিত্রিকা, বলল-‘দেখেন দেখেন।কুকুর গুলো কি কিউট না?’

মাহমুদ তাকালো।সায় দিল।

‘ইস!আমার কত শখ,একটা কুকুর পালবার।কিন্তু বাসায় পছন্দ করত না মোটেই’-মেয়েটি বলে যায়।

শাহবাগমোড়ে রিকশা থামিয়ে ফুটপাত ঘেঁষে হাঁটতে লাগলো ওরা।অরিত্রিকা হঠাৎ থেমে পড়ল।রাস্তার পাশেই দাঁড়িয়ে পড়েছে।মাহমুদ একটু পিছন ফিরে দেখল।তারপর ওর দিকে এগিয়ে গেল।বইয়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে একটা বই বের করে মনোযোগ দিয়ে পাতা উল্টাচ্ছিল অরিত্রিকা,তারপর,বন্ধ করে জায়গাতে রেখে দিয়ে মাহমুদের দিকে তাকিয়ে হাসল।

‘পড়বেন?ঐটা’

‘ভাবছিলাম’-অরিত্রিকা বলল।

মাহমুদ বইটা কিনে দিল ওকে।তারপর আবার হাঁটতে লাগল।

ওরা দুজন ফুচকা খেতে বসল।মুখোমুখি চেয়ার।জায়গাটা খোলামেলা।

মেয়েটা কি পাগল?প্যাকেট খুলে বইটা পড়া শুরু করেছে।চারপাশে কিছু গ্রাহ্য করছে না।

বইয়ের আড়ালে অরিত্রিকার চেহারাটা ঢাকা পড়েছে।মাহমুদের এমন লাগছে কেন?দুইদিনের পরিচিত এই মুখ দেখার প্রতি কি আকর্ষণ জন্মাবার কথা ছিল তার?মানুষের অনুভূতির কত রকমফের।গলা খাঁকারি দিল মাহমুদ।

-ওহ,ফুচকা দিয়ে গেছে!-হাসিমুখে মাহমুদের দিকে তাকালো অরিত্রিকা।

ফুচকা খেতে খেতে বইয়ে চোখ বুলাচ্ছে।মাহমুদ বলল-তামান্নাও পড়ত।

অরিত্রিকা মোটেই অবাক হল না,যেন আগে থেকেই জানত। অথচ এই নামটি আগে ওকে বলেনি মাহমুদ।

বইয়ের পাতা বন্ধ করে অরিত্রিকা মাহমুদের দিকে চাইল- দেখতে কেমন ছিল?তামান্না।

মাহমুদ কিছু বলল না।হাসল।

‘আচ্ছা,আমাকে কেমন লাগে?’-অরিত্রিকা বলল।

ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল মাহমুদ। কি উত্তর দিবে? তারপর বলল-‘ভালো’

‘মিথ্যে বলার প্রয়োজন নেই,আমি মাইন্ড করব না।’

ব্যাপারটা মিথ্যে।আবার,কেন জানি মনে হচ্ছে পুরোপুরি মিথ্যেও নয়।সত্য আর মিথ্যার মাঝামাঝি যদি কিছু থাকে তেমন।না হলে,মেয়েটির উপস্থিতি ,কথা,হাসি এগুলো কেন মাহমুদের চিন্তায়-ভাবনায় প্রভাব ফেলতে শুরু করছে।প্রথম দিনগুলোর মাহমুদ আর আজকের এখনের মাহমুদের মধ্যে কিছুটা তফাত আছে বই কি।

খাওয়া শেষ করে উঠে গেল ওরা।বাসায় ফিরবে। মাহমুদ অরিত্রিকা কে বলল-‘এখন সিএনজি করেই যাই,কেমন?’।অরিত্রিকা সায় দিল।

এদিকটায় খালি সিএনজি পাওয়া যাচ্ছে না।রাস্তায় ওই মাথায় আছে কিছু।

‘আপনি একটু দাঁড়ান’-আমি ওইপাশে যাচ্ছি,বলে মাহমুদ হাঁটা দিল।

মাহমুদ হাত দিয়ে গাড়ি থামিয়ে রাস্তা পার হচ্ছিল।কিন্তু বাম দিক থেকে আসা একটা প্রাইভেট কার খুব জোরে এসে পড়ল। সামলাতে পারল না মাহমুদ।উলটে পড়ে গেল। স্বচক্ষে সব দেখছিল অরিত্রিকা-‘এই!এই!’

বইয়ের প্যাকেট হাতে নিয়ে দৌড় দিল।রাস্তার মাঝখানে পড়ে গেছে মাহমুদ। হতভম্ব অরিত্রিকা কি করবে বুঝতে পারছে না।আশেপাশে লোকজন মাহমুদকে উঠিয়ে নিচ্ছে।সারা শরীর অবশ হয়ে আসছে অরিত্রিকার।এমন লাগছে কেন ওর?মানুষটা কি মরে গেল? মনে হয় মাথা ঘুরে পড়ে যাবে এক্ষুণি।



####



ছুটির দিনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিকেল টা উপভোগ করছে মাহমুদ। আগের চাকরি টা ছেড়ে দিয়ে নতুন চাকরিতে ঢুকেছে।বেতন আগের মতই,কিন্তু সুযোগ সুবিধা বেশি।

চায়ের কাপ হাতে নিয়ে অরিত্রিকা পাশে এসে দাঁড়ালো।

‘নাও’

ওর হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে ফুঁ দিতে লাগল।তারপর একটা চুমুক দিল মাহমুদ।

‘ইস!চিনি একদম নেই’-বলে চোখমুখ কুঁচকে অরিত্রিকার দিকে করুণ চোখে চাইল মাহমুদ।আরেকটু চিনি চায়।

‘এই,তোমার ডায়বেটিস না সেদিন মাপিয়ে আসলে,এটুকু চিনিই অনেক।এরপর থেকে চিনিছাড়া চলবে’- অরিত্রিকা বলল।

হঠাৎ বাচ্চার কান্না শুনে ভিতরে ছুটে গেল অরিত্রিকা।কিছুক্ষণ পর বাচ্চাকে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে বারান্দায় এসে উৎকন্ঠিত স্বরে বলল-‘এই!আরেকবার ডাক্তারের কাছে চল যাই আজকে। গা কেমন গরম গরম থাকে সবসময়,দেখোনা’

গায়ে হাত দিয়ে দেখল বাচ্চার-‘আচ্ছা’-বলে মাহমুদ।

তারপর,মা আর বাচ্চার দিকে তাকিয়ে দুইজনকে মনভরে দেখতে লাগল।

ভীষণ ব্যস্ত সময় কাটছে অরিত্রিকার;মাহমুদের ডায়াবেটিস,বাচ্চাকে নিয়ে চিন্তা-কত কাজ। তন্ময়কে নিয়ে ভাবার সময় নেই এখন।

মাহমুদ অরিত্রিকার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায়। তামান্নার স্মৃতি ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছে।অনাগত ভবিষ্যতের দিনগুলিতে তারা তিনজন –সে নিজে,অরিত্রিকা আর তাদের সন্তান এরাই তার ভাবনা জুড়ে আছে।

একটি সুখী পরিবার দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়।

(সমাপ্ত)

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ৮:৫৪

চাঁদগাজী বলেছেন:


বলেছিলেন গল্প, এখন দেখছি মহাভারত

২| ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ৯:২৩

নাজমুল হাসান মজুমদার বলেছেন: পর্ব আকারে দিলে ভালো হতো ।

৩| ০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ সকাল ৮:১৬

রামন বলেছেন:

চাঁদগাজী বলেছেন: বলেছিলেন গল্প, এখন দেখছি মহাভারত :P

৪| ০৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ১১:০৫

আমি সৈকত বলছি বলেছেন: সত্যি বলতে কি একটুও ক্লান্ত হইনি।

পুরোটা পড়েছি খুব ভালো লাগলো।

মাঝখানে একটি চরিত্র এসেছে যা দেখে অবাক হয়েছি।

"তানভীর" কে????

ঐ একজায়গাতেই নামটা ব্যাবহার করা হয়েছে।


এইখানে,

→ ভেতরে শাওয়ারের জোরালো শব্দ হচ্ছে।
বিরক্তি প্রকাশ করে মনে মনে আবার
বিছানায় গিয়ে বসল তানভীর।

০৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ১১:১১

হাতপা বলেছেন: আপনি আমার দারুণ উপকার করলেন।তানভীরকে মাহমুদ কল্পনা করে নিন। এই গল্পের আগে আরেকটি গল্পের কাজ শেষ করেছিলাম যার মূল চরিত্রের নাম ছিল 'তানভীর' :)

৫| ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ সকাল ১০:৫৩

আমি সৈকত বলছি বলেছেন: ওক্কে,

আশা করি আরো অনেক অনেক গল্প পাবো আমি আবার প্রচন্ড গল্প প্রেমী।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.