নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

একজন গাধামানব

মোহাম্মদ মাহবুব হোসেন

ডাল দিয়ে ভাত খাই, রাস্তা দিয়ে হাঁটি, মানুষ আমি ভেজাল হলে'ও আমার লেখাগুলো খাঁটি ।

মোহাম্মদ মাহবুব হোসেন › বিস্তারিত পোস্টঃ

বইমেলায় পায়চারি

০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ৯:২২

বইমেলা শুরু হয়েছে। আমরা বইমেলা বললে বড় ভাইয়েরা শুধরে দিয়ে বলতেন 'বউমেলা', অজস্র তরুণীর বর্ণাঢ্য সমারোহ, তরুণদের দৃষ্টিতে সেটা 'বউমেলা' হলে যদি মুরুব্বীরা বলেন 'বেয়াদব ছেলেপেলে', তাহলে আমি স্মরণ করিয়ে দেব, সময়টা আরও এক যুগ আগের। সেসময়ে ইভ-টিজিং কি সেটা সবার জানা ছিল না। শৈশবে 'বাকের ভাই'কে দেখে বড় হওয়া শিশুরা তারুণ্যে সানগ্লাস পড়লেও মুনাদের দেখে অশ্রাব্য কিছু করার কথা ভাবতো না। নারীর প্রতি সহজাত অনুরাগ যেন সম্মানের দূরত্বটি ঠিক রাখে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি থাকতো সবার। কোন তরুণীকে বিপদে ফেলা নয়, বরং বিপদগ্রস্ত তরুণীকে উদ্ধারের নির্বোধ প্রচেষ্টার মাঝে যৌবনধর্মের আরাধনা খুঁজে পেত সেকালের তরুণেরা, মনের গভীরে 'হাওয়া মে উরতা যায়ে তেরা লাল দোপাট্টা...' এই গান বাজলেও আচরণে কোন অসংলগ্নতা থাকত না। তরুণ-তরুণী ছাড়াও শিশুদের জন্য বইমেলাটা আসলেই একটা মেলা ছিল। গল্পের বই কিংবা রূপকথা- নানা সমারোহের অবসরে বাবার হাত ধরে চটপটির দোকানে টেনে নিয়ে যেত ছোট্ট মেয়েটা। বৃদ্ধদের জন্য মেলাটি ছিল চোখের সামনে বিকশিত হওয়া একটা বটবৃক্ষ, ভাষার পাখিগুলো বাসা বেঁধে আছে সে গাছের ডালে ডালে।


বাংলা একাডেমী চত্বরে উদীয়মান থেকে শুরু করে সুপ্রতিষ্ঠিত লেখকদের দেখা মিলত হররোজ, সে এক দেখার মতো দৃশ্য ছিল বটে। ফটোগ্রাফ তোলার সুব্যবস্থা সেকালে অপ্রতুল ছিল বলেই অটোগ্রাফেই সন্তুষ্ট থাকতে হত। চিন্তা-বুদ্ধি-বিবেকের বিকাশের বাৎসরিক এ আয়োজন কেউ মিস করতে চাইতেন না, দূর-দূরান্ত থেকে চলে আসতেন অনেকে। কারো কারো দৃষ্টিতে এই মেলাটা ছিল বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের নদীটির একটি স্রোত, কেউ ভাবতেন একাত্তরের রক্তস্নাত দেশটির বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধের ময়দান, যা আজও জাগ্রত।


সময়ের বিবর্তনে অনেক কিছু বদলেছে। যশস্বী লেখক হুমায়ূন আহমেদ মারা গিয়েছেন, কিন্তু অন্যপ্রকাশের ব্যবসাটি অমর হয়েছে তাঁর সেসব লেখার বদৌলতে। ক্ষমতাসীনদের গুণকীর্তনের বই বের হয়েছে পর্যাপ্ত। একটা সময় প্রবাদ ছিল 'দেশে দাঁড়কাকের চেয়ে কবির সংখ্যা বেশি', কালক্রমে সেটি 'কবি'র বদলে 'ফটোগ্রাফার' দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়। বইমেলায় আপনার চোখে পড়বে এরকম বেশকিছু কবিতার বই, সেগুলোর মান নিয়ে প্রশ্ন তোলার ঔদ্ধত্য কিংবা যোগ্যতা আমার নেই বলেই কিছু লিখলাম না। তবে যেদেশে জনাব সাইয়েদ জামিলের কবিতা পুরস্কৃত, সেদেশে বইমেলার মৌসুমি কবিদের তিরস্কার করবার ভাষা আমার নেই। আরেক শ্রেণীর সাহিত্য পাওয়া যাবে, যারা ব্যবসাবাণিজ্য করে দু'পয়সা কামিয়ে আধ পয়সা দিয়ে নিজ খরচে বই বের করছেন, সাহিত্য এদের পেশা তো নয়ই, নেশাও নয়। সম্ভবত এক প্রকারের শখ। শখের প্রেমিক লাম্পট্যের বাইরে কিছু করতে পারে না, তেমনি শখের সাহিত্যিক সাহিত্যের ওড়না ধরে টানাটানি করা ছাড়া আর কোন কাজটা করে, সেটা মূলধারার সাহিত্যিকরা হয়তো জেনে থাকবেন। এতসব সর্বনাশা কর্মকাণ্ডের আয়োজনের ঠিক প্রবেশদ্বারেই লেখা যায় আরেক ভয়াবহ বিপর্যয়, একজন নমস্য অগ্রজ ছবিটি ফেসবুকে দিয়েছেন, দেখে চমকে উঠতে হয় । একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে শহীদ হন অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, তাঁর নামে ফেস্টুন টানানো হয়েছে, সেখানে 'শহীদ' এর বদলে 'শহিদ' এবং নামের বানান 'গুহঠাকুনতা' লেখা হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, এটি অনিচ্ছাকৃত ভুল, অবশ্য এজন্য আয়োজকদের ক্ষমা চাইতে হবে না। আয়োজকরা মানী লোক, এরকম 'সামান্য' ভুলের জন্য যদি তাঁরা ক্ষমা চান, তাহলে অজস্র বড় বড় ভুলের জন্য তাদের কি করণীয়?

তবু মানুষ বইমেলায় যেত। আর যাবার জায়গা নেই বলেই হয়তো, কিংবা মানুষের কাছে এর 'দৃশ্যমান' অবস্থার চেয়ে 'কল্পিত আবেদন' অনেক বেশি ছিল। বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতির এই মৌলিক জায়গাটিতে খুব সুকৌশলে এমন কাজ করা হল, যাতে বইমেলার জনসমাগম থেকে শুরু করে শিল্প-সাহিত্যের চর্চা নিভৃতেই কমে যায়। বিগত বছরগুলোতে বুদ্ধির জাগরণের সে মেলাকে কেন্দ্র করে মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারী একাধিক লেখক-প্রকাশককে হত্যা করা হয়েছে। যারা এটিকে 'নাস্তিক লেখক হত্যা করিয়া ধর্মের সুবাতাস ছড়ানো হইল' ভাবছেন, তাদের জন্য কষ্ট হয়। সস্তা জীবনদর্শনের কারনে গভীরভাবে ভাবার ব্যর্থতা এজন্য দায়ী। একটু গভীরভাবে ভাবলে শঙ্কা জাগা স্বাভাবিক। ঐতিহ্যগতভাবে সবার মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল একটি জাতি ক্রমান্বয়ে শুধুমাত্র নিজের মত নিয়ে গোঁয়ার্তুমি করার অভ্যেস রপ্ত করছে, যা সভ্যতার জন্য অবশ্যই আশংকাজনক। প্রাচীন ভারতের বৌদ্ধ সম্রাট অশোক নিয়ম করেছিলেন- সবার মতের প্রতি শ্রদ্ধা রাখা আবশ্যক, সেটা ভুল হোক আর ঠিক হোক, কেউ কোন মত গ্রহণ করুক বা না করুক, কারো চিন্তাধারাকে অসম্মান করা যাবে না। মোগল সম্রাট আকবরও অনুরূপ নিয়মের উপর জোর দিয়েছিলেন- সবার মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করাটা শক্তিমানের কর্তব্য, কোন দুর্বল মানুষও যেন মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে বাধা না পায় সেদিকে দৃষ্টি রাখার আদেশ দিয়েছিলেন তিনি। এই আধুনিক যুগে এসে প্রাচীন রাজেন্যবর্গের উদ্ধৃতি দিতে লজ্জা লাগছে, কারন আধুনিককালে আমরা তাদের চেয়ে সভ্য না হয়ে আরও অসভ্য হয়েছি। ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষ হত্যার কোন সঙ্গত কারন থাকতে পারে না, তবে ধর্মান্ধের পক্ষে সবই সম্ভব এবং এই ধর্মান্ধদের কারনে সভ্যতার সুকুমার পথটি যেন রুদ্ধ হয়ে না যায়, সেটা দেখার দায় রাষ্ট্রের। এদেশে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা বলার স্বাধীনতাও লুপ্তপ্রায়, বরং রাষ্ট্রচালকের পদচুম্বনের প্রক্রিয়াটিই যেন অধিকতর শোভনীয়। দীর্ঘদিনের পুরনো সভ্যতা-সাহিত্যের শত্রুর দ্বারা যত ক্ষতি হয়েছে, তারচেয়ে বেশি হয়েছে রক্ষকের উদাসীনতার কারনে। বইমেলা রক্তাক্ত হয়েছে বলে এক সুহৃদ চিকিৎসক ফেসবুকে লিখেছেন, এটা আজ প্রাণের মেলা নয়, খুনের মেলা। স্বাভাবিক দৃষ্টি থাকলে সেটি অবশ্যই সচেতন মানুষ অনুধাবন করবেন, আমি বলছি বলেই এসব সঠিক হতে হবে- এমন কোন কথা নেই। ইতিহাস যা বলে, সেটা বুদ্ধি ও বিবেক দিয়ে বিচার করা জরুরী।


দীর্ঘ লেখা ফেঁদে বসায় আমার পোস্টের পাঠকদের বিরক্তি সৃষ্টি হয় বলে আমি ক্ষমাপ্রার্থী হতে চাই, কিন্তু যা সত্য বলে দেখি তা প্রকাশ না করার কষ্ট ক্ষমা চাইতে নিষেধ করে। আমাদের মতো ক্ষুদ্র মানুষের চাওয়া-না চাওয়া দিয়ে বইমেলা চলে না, দেশ চলে না। যাদের চাওয়া দিয়ে এসব চলে, তাদের প্রতি সবিনয় আহ্বান, একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতির সম্ভ্রমহানির কাজটি না করেও বোধহয় বেঁচে থাকা যায়, টিকে থাকা যায়। একটি পরমাণু বোমা স্রেফ ধ্বংস করতে জানে, কিন্তু আক্রান্ত এবং আক্রমনকারী- উভয়েরই পরের প্রজন্মের জন্য বিষয়টি বেদনা ছাড়া কিছুই এনে দেয় না। জনতার জাগরণেই প্রকৃত শক্তি নিহিত- এটা রাষ্ট্রের ভাগ্যবিধায়কেরা যত দ্রুত বোঝেন সবার জন্য ততই মঙ্গল। যারা এই শক্তির জাগরণ ঠেকাতে চাইবে- তাদের প্রয়াস সাময়িকভাবে সাফল্য পেলেও দীর্ঘমেয়াদে সত্যের দিগন্তে মাথা তুলে দাঁড়াতে ব্যর্থ হবেই।

ইতিহাসে এর ব্যতিক্রম আজও পাইনি।


মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:০৩

মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন বলেছেন:
পোস্টে এ+

২| ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:২৬

মোহাম্মদ মাহবুব হোসেন বলেছেন: ধন্যবাদ

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.