নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

একজন গাধামানব

মোহাম্মদ মাহবুব হোসেন

ডাল দিয়ে ভাত খাই, রাস্তা দিয়ে হাঁটি, মানুষ আমি ভেজাল হলে'ও আমার লেখাগুলো খাঁটি ।

মোহাম্মদ মাহবুব হোসেন › বিস্তারিত পোস্টঃ

র‍্যাগিং

০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৩:১২

'এই ছেলে, এদিকে আসো... ফার্স্ট ইয়ার?'
'জি...' ছেলেটা ইতস্তত করে উত্তর দেয়। ক্যাম্পাসে সবে দুইদিন, কাউকে ভালোমতো চেনে না।
'এই আপুকে দেখসো? আপু দেখতে সুন্দর না?' সিনিয়র ভাইয়া প্রশ্ন করেন।

নবাগত ছাত্রটি দ্বিধায় পড়ে যায়। কি উত্তর দেবে সে? সিনিয়র আপুকে সুন্দর বললে যদি বেয়াদবি হয়ে যায়? আবার সুন্দর না বললে যদি কোন সমস্যা হয়? আপুর দিকে তাকানো দূরে থাক, দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগে মাথা নিচু করে থাকে ছেলেটা। বারো বছরের শিক্ষাজীবন এবং তারপর তিনমাসের কঠোর সাধনা শেষে স্বপ্নের ক্যাম্পাসে এসেছে সে। উচ্চশিক্ষার দুয়ারে এসেই এ কোন পরীক্ষা?

ছেলেটা দরদর করে ঘামতে থাকে।
বসে থাকা সিনিয়রদের কেউ কেউ গলা চড়িয়ে বলেন, ' এই পুলা খাম্বার মতো খাড়ায়া আছে ক্যান? বেদ্দপ নাকি...'

'তোমার বাড়িতে কে কে আছে?'
'জি আপু... আব্বু, আম্মু, ছোটভাই...' সিনিয়র আপুর কাছে আনন্দে বলতে থাকে মেয়েটা।
'বড় ভাইবোন কেউ নাই?' আপু প্রশ্ন করেন।
'জি না আপু...' মেয়েটা উত্তর দেয়।
আপু এরপর চিবিয়ে চিবিয়ে বলেন 'ও তাই তো বলি, আদব কায়দা নাই ক্যান! বাবা-মাও শিক্ষাটা ঠিকমতো দেয় নাই দেখছি... সিনিয়র আপুদের টেবিলে এসে ধুপ করে বসে পড়েছে, এই দেখেছিস এই বেয়াদবের কাণ্ড?"
মেয়েটার খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। রুমে ফিরে দরজা লাগিয়ে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে। আঠারো বছরের জীবনে তার বাবা-মা'কে অসম্মান করে একম কথা সে কারো কাছে শোনেনি।

বড় বড় ক্যাম্পাসে সিনিয়রদের সাময়িক আনন্দের খোরাক হিসেবে কাজ করে এই র‍্যাগিং । হয়তো সিনিয়র একজন জুনিয়রদের ডেকে পাঠালেন তার রুমে, সেখানে যাওয়ার পর বাংলা সিনেমার গান শুরু হল এবং সিনিয়র শিক্ষার্থী জুনিয়রকে নির্দেশ দিলেন গানের তালে নাচার জন্য। সমস্যা প্রকট হয়, যখন কয়েকজন সিনিয়র মিলে একজন জুনিয়রকে নাস্তানাবুদ কিংবা অপমান করেন। অকথ্য ভাষায় গালাগাল তো আছেই, নানা রকম শারীরিক নির্যাতনও এদেশে র্যা গ সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এমন ক্যাম্পাসও আছে, যেখানে সিনিয়র ভাইদের সিগারেটের প্যাকেট কিংবা খাবারদাবার এনে দিতে হয় জুনিয়রকে। প্র্যাকটিক্যাল খাতা লেখা কিংবা আঁকার অলিখিত টেন্ডার চাপিয়ে দেয়া হয় ফার্স্ট ইয়ারের ঘাড়ে। অনেকেই এগুলো পাশ কাটিয়ে নিজের জীবন গুছিয়ে নেয়। কেউ কেউ সেটা পারে না,মানসিক সক্ষমতা তো সবার এক না । পরিবার থেকে দূরে এসে এরকম বিরূপ পরিবেশে ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্সে ভোগা জুনিয়র ছেলে কিংবা মেয়েটা আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে নিজের প্রতি, দূর থেকে আকর্ষণীয় মনে হওয়া ক্যাম্পাসের প্রতি সৃষ্টি হয় বিতৃষ্ণা। কেউ কেউ পিছিয়ে যায় পড়াশোনায়, কেউ বেছে নেয় ড্রাগ। অনেকেই হয়তো বলবেন, এ সংখ্যা একেবারেই কম; যদি সেটা শতকরা একজনও হয়, এই ভয়াবহ অন্ধকার পরবর্তীতে ক'জনকে কিভাবে গিলে খাবে, সেই হিসেব কেউ রেখেছে? ক্যাম্পাসগুলোতে ফার্স্ট ইয়ারের ড্রপ-আউটের হিসেব করুন, স্নাতক পর্যায়ে নতুন করে মাদকাসক্ত হবার রেকর্ড যোগাড় করুন, আত্মহত্যা কিংবা হত্যাচেষ্টার হিসেবগুলো পেলে আরও ভালো হয়। জানি, এসবের কোন খতিয়ান নেই, সরকার এ হিসেব দিয়ে কোন পুরষ্কার পাবে না বলেই এসব খতিয়ান নথিপত্রের বাইরে। কিন্তু এ যে বাস্তব সত্য দেশের অধিকাংশ ক্যাম্পাসে! চোখ বুজলেই তো অস্বীকার করা যায় না!

একেকটা ক্যাম্পাস একেকটা পরিবার। নবাগত সন্তান পরিবারে যেটুকু আদর কিংবা শাসন পায়- সেটুকু নতুন শিক্ষার্থীকে করা যেতেই পারে, সেটা অবশ্যই সীমার মধ্যে। পরিবারে প্রবীণের প্রজ্ঞা নবীনের প্রাণোচ্ছল পথচলাকে সমৃদ্ধ করতে পারে, পরিশীলিত করতে পারে, কিন্তু রুখে দিতে পারে না। র‍্যাগিং এর নামে চলে আসা অসভ্যতা ভারতবর্ষের হাজার বছর পুরনো শিক্ষাঙ্গনের চিরায়ত সংস্কৃতির অংশ নয়। 'বিদ্যা বিনয় আনে, বিনয়ে জগত বশীভূত হয়'- এই মহান শিক্ষা সিনিয়রই জুনিয়রকে দেবেন, গান ছেড়ে নাচার আদেশ দেয়া তার অধিকার বহির্ভূত। অসুস্থ সিনিয়রকে চিকিৎসালয়ে নিয়ে যাবার নীরব কর্তব্য জুনিয়র শিক্ষার্থী বিনা আদেশেই পালন করবেন, কিন্তু সিনিয়রের সিগারেটের হালকা প্যাকেট বহনের আদেশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের আচার্যের পদে অধিষ্ঠিত হয়ে রাষ্ট্রপতিও কাউকে দিতে পারেন না।

অন্যকে সম্মান দেয়াই হোক নিজে সম্মান পাওয়ার শর্ত, ভয়ে দেয়া সম্মান আসলে এক ধরনের ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ। ভ্রাতাভগ্নিতুল্য জুনিয়রের চোখে সশ্রদ্ধ ভালোবাসার পরিবর্তে এই ঘৃণা দেখে যদি কেউ তৃপ্তি পায়, তাহলে সেটা তার নিজের মানসিক সমস্যা। সিনিয়রদের ক্ষুদ্রতা নয়, মাহাত্ম্য সঞ্চারিত হোক নবীনের মাঝে। দেশের প্রতিটি শিক্ষাঙ্গন হোক এমন জায়গা, যেখানে রবিঠাকুরের লেখনী মূর্ত হয়ে উঠবে-

''চিত্ত যেথা ভয়শূন্য,উচ্চ যেথা শির,
জ্ঞান যেথা মুক্ত,যেথা গৃহের প্রাচীর
আপন প্রাঙ্গনতলে দিবসশর্বরী
বসুধারে রাখে নাই খণ্ড ক্ষুদ্র করি''

ইতোমধ্যেই স্নাতক প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হয়েছে উচ্চ শিক্ষাঙ্গনগুলোতে। দেশের আলোকিত ক্যাম্পাসগুলোর আনাচে কানাচে ঘাপটি মেরে থাকা র‍্যাগিং নামক sociopsychiatric disorder এর অবসান হোক। হালকা কুয়াশায় ঢাকা সকালের মিষ্টি রোদে সীমাহীন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দৃপ্ত পদক্ষেপে নিজের শিক্ষাঙ্গনে বিচরণ করুক আগামীর জ্ঞান-অন্বেষী প্রাণগুলো।

শুভ হোক সবার ক্যাম্পাসজীবন।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৩:২৬

কাউন্টার নিশাচর বলেছেন: র‍্যাগ তো আমরাও দেই, তবে সব কিছুর একটা লিমিট আছে। পরের বছরগুলোতে সেই স্টুদেন্ট এর সাথে চমৎকার সম্পর্ক থাকে। ফিজিক্যাল হ্যারাজমেন্ট বা মেন্টাল টর্চার না করে হাসি মুখেও র‍্যাগ দেয়া যায়।

২| ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ৮:২৯

মোহাম্মদ মাহবুব হোসেন বলেছেন: যে প্রথাটির অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খারাপ কিছু বয়ে আনে এবং কখনোই ভালো কিছু ডেকে আনে না- সেটা লালন করার কোন যৌক্তিকতা আমি দুর্বল দৃষ্টিতে দেখতে পাই না।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.