নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

একজন গাধামানব

মোহাম্মদ মাহবুব হোসেন

ডাল দিয়ে ভাত খাই, রাস্তা দিয়ে হাঁটি, মানুষ আমি ভেজাল হলে'ও আমার লেখাগুলো খাঁটি ।

মোহাম্মদ মাহবুব হোসেন › বিস্তারিত পোস্টঃ

বৃক্ষমানব

০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:১১

জামালের নাম কিভাবে 'জামাই' হল, সেটার একটা ইতিহাস আছে।

যে বছর জামাল চাকরিটা পেল, সে বছরের শেষের দিকে এসিসট্যান্ট ম্যানেজার আফজাল সাহেবের বিয়ে হল। সেই বিয়েতে সিনিয়রদের সাথে জামাল, শরীফ, মুশফিকসহ জুনিয়র অফিসাররা সবাই দাওয়াত পেয়েছিল। হলুদের রাতে আফজাল সাহেবের পৈত্রিক বাড়িতে বিশাল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হল। সে জমকালো অনুষ্ঠানে তরুণের চেয়ে তরুণীর সংখ্যা বেশি ছিল, বোতলের চেয়ে গ্লাস ছিল বেশি এবং এসবের সাথে মিল রাখতে গিয়ে মিনিটের চেয়ে ঘণ্টার কাটা বেরসিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল। রাত বাড়লে মেয়েরা চলে গেল, শুধু ছেলে-বুড়োরা রয়ে গেল। একাউন্টসের করিম সাহেব প্রসঙ্গ তুললেন, আফজাল সাহেবের জবাই উপলক্ষ্যে একটা টোস্ট হয়ে যাক। আজ পর্যন্ত জামাল 'টোস্ট' বলতে বুঝত 'টোস্টবিস্কুট'। পুরান ঢাকার এক প্রাচীন বাড়ির আলিশান ছাদে দাঁড়িয়ে সে আবিষ্কার করল, এখানে বিস্কুট কোন বিষয় না। তরুণীদের প্রস্থানের পরপরই বড় শরবতের গ্লাসগুলো প্রায় হাওয়া হয়ে গিয়েছে, ক্ষুদ্রাকৃতির কাঁচের গ্লাস নিয়ে কাড়াকাড়ি চলছে। শরবতের বোতলের জায়গা করে নিয়েছে সুদৃশ্য বিদেশী বোতল। কেউ বলে না দিলেও সবার হুমড়ি খেয়ে পড়া দেখে জামাল বুঝল সে বোতলের তাৎপর্য। সেলস ম্যানেজার শরীফ উৎফুল্ল গলায় জামালকে বলল,'কি রে ব্যাটা, দাঁড়িয়ে আছিস কেন? শুরু কর!'
জামাল দুর্বল গলায় বলল, 'আমি ওসব খাই না।'
'কেন?' শরীফ গ্লাসের তরল পেটে চালান করে দিয়ে জিজ্ঞেস করল।
'ভালো লাগে না।'
'আরে বেকুব, ভালো লাগানোর জন্যই তো মানুষ ওসব খায়। যদি কারো এমনিতেই ভালো লাগে, তাহলে ধরে নিতে হবে ও ব্যাটা আগেই কয়েক পেগ মেরে এসেছে।'
'থাক, তোরা খা।'
'সেটা তুই না বললেও খাবো। তুই এক কাজ কর, চেয়ে চেয়ে আমাদের খাওয়া দেখ। কোন গল্পে যেন পড়েছিলাম- ক্ষুধার্ত কালেভদ্রে অন্যের খাওয়া দেখেও শান্তি পায়।' শরীফের কণ্ঠ আগের চেয়ে ভারী। গলার স্বর বদলানোতে তরল বস্তুর কি কোন ভূমিকা আছে? কেউ যদি নিয়মিত এই বস্তু খায়, তাহলে কি কণ্ঠস্বর বদলে যাবার সম্ভাবনা আছে? জামালের জানতে ইচ্ছে হল। হয়তো গণিকে জিজ্ঞেস করলে জানা যাবে। গণি জামালের স্কুলজীবনের বন্ধু, এখন সরকারী ডাক্তার।
'তুই এক কাজ করতে পারিস, বোতল না খেলেও চিকেন ফ্রাই খা' মুরগীর রানে কামড় বসাতে বসাতে শরীফ বলতে লাগল,'শুধু দেখে যাবি কেন, কিছু তো খা। শোন, আফজাল ভাইয়ের বিয়ে দেখে যদি তোর বিয়ের সাধও পূর্ণ হয়ে যেত, তাহলে তো কাজই হত। আসলে বইপত্রের কথা ভুয়া, অন্যের খাওয়া দেখে তোর ক্ষুধা বড়োজোর মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে, কিন্তু তোর পেট ভরার কোন চান্স নেই।'

তরল বস্তু অতি বিচিত্র জিনিস, এর প্রভাবে সেলস ম্যানেজার থেকে মহান দার্শনিক হয়ে ওঠা শরীফকে দেখে জামাল হাসল, একটা চিকেন ফ্রাই তুলে নিল জামাল। খেতে খেতে শরীফকে বলল, 'তাহলে তুইও বিয়ে করে ফেল, এভাবে আর কতদিন অন্যের বিয়ে খেয়ে বেড়াবি?'

শরীফ সহাস্যে উত্তর দিল,'বন্ধু, মদ খেয়েছি বটে, কিন্তু আমায় মাতাল ভাবলে ভুল করবে। সামনে এখন কোন রমনী এলে এই শরীফের মতো জেন্টেলম্যান তুমি পার্টিতে তৃতীয়টি খুঁজে পাবে না। বলো তো ভায়া, তাহলে আরেকজন জেন্টেলম্যান কে তাহলে? সেটা হচ্ছ তুমি। হা হা হা... ফ্রি মাল পেয়ে যে শালা মুরগী চাবায়, তার মতো জেন্টেলম্যান পূর্ব পাকিস্তানে আর কোথায় আছে?'

রাত বাড়ছে, একেক চালান তরলের সাথে সাথে শরীফের আচরণও বদলাচ্ছে। 'তুই' থেকে 'তুমি'তে উন্নতি, এটা কোন স্বাভাবিক ব্যাপার না। বান্ধবী যখন প্রেমিকায় রূপান্তরিত হয়, তখন এই ভাষাগত বিবর্তন দেখা যায়। শরীফের ক্ষেত্রে তো তেমন কিছু ঘটেনি। এছাড়া শরীফ সম্ভবত মানসিকভাবে সত্তরের দশকে অবস্থান করছে, দেশ স্বাধীন হয়েছে বছর দশেক হয়ে এল, অথচ শরীফের কথাবার্তায় এখনো পূর্ব পাকিস্তানের ছায়া। তরল বস্তু কি সময়ের চেতনাও বদলে দেয়ার ক্ষমতা রাখে?

আরও দু'পেগ শেষে শরীফ প্লেয়ারে বেজে চলা গানের তালে তালে নাচতে লাগলো। দুয়েকজন সহকর্মী ওর সাথে যোগ দিল। হাসিমুখে শরীফ ঘোষণা দিল, তার মেয়ের সাথে সে জামালকে বিয়ে দেবে, কারন জামালের মতো ভালো ছেলে সে জীবনে দেখেনি, আজ থেকে জামাল তার কাছে 'জামাই'। শরীফের মেয়ে কবে জন্মাবে, জামাল তখন আদৌ দুনিয়ায় থাকবে কিনা- এসব নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলল না। রসপিপাসুরা এ উপলক্ষ্যে যার যার গ্লাস ভরে নিল।

উপস্থিত অনেকেই অবশ্য তরল খাচ্ছিলেন না, স্রেফ আনন্দের খাতিরে বসে ছিলেন। তারা বাড়ি ফেরার তাগিদ দিলেন। প্রথম থেকে বেশি করে তরল গ্রহণ করা দুয়েকজনের পেট ধর্মীয় উদ্দীপনায় জাগ্রত হয়ে সবকিছু উগড়ে দিল। শরীফ আসর ছাড়ার আগে এক পেগ গলায় চালান করে দিয়ে বলল,'দুদিনের ছেলেপেলে, যা সহ্য হয় না তাও জোর করে গিলতে চায়। বুঝলি জামাই, সব হচ্ছে বয়সের দোষ।' জামাল নরম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,'তুই যে খাচ্ছিস, এটা কিসের দোষ?' শরীফ ধরা গলায় বলল,'এটা বয়সের না, আমার নিজের দোষ। জীবনের হাজার দোষের উপর চাদর হয়ে এই দোষটি নিখাদ আনন্দ দেয় বলেই খাই। সব দোষে জগতের ক্ষতি, কিন্তু এই দোষের দায় একান্তই আমার। আমার মাইনে কতো সে তুই জানিস, কিন্তু আমার একাউন্টে কয় টাকা থাকে সেটা কেউ জানে না। কারো জন্য কিছু রাখি না বুঝলি। সব টাকা উড়িয়ে দিই, ঠিক শিমুল গাছের মতো। শিমুল তুলা দেখেছিস, গাছ থেকে কেমন উড়ে উড়ে চারদিকে ছড়িয়ে যায়? আমি মানুষ না হলে শিমুল গাছ হতাম। বসন্তে লাল টকতকে ফুল ফোটাতাম, গ্রীষ্মে তুলা ছড়িয়ে দিতাম দিগন্তে।'

সেদিন যার যার মতো বাড়ি ফিরে গিয়েছিল সবাই। কেন শরীফের শিমুল গাছ হতে ইচ্ছে হয়, সে কথা আর জামালের জানা হয়নি।


বছর বিশেক পরের কথা।
ঢাকা মেডিকেলের ৩০৪ নম্বর কেবিন।

'কিরে জামাই, তুই একাই এসেছিস? আমার মেয়ে কোথায়?' জামালের বউ ফারিয়াকে মেয়ে ডাকে শরীফ। ফারিয়াও এতে বেশ মজা পায়।
'আজ ওর স্কুল থেকে ফিরতে দেরি হবে, হেডমিস্ট্রেস হবার পর কাজের চাপ অনেক বেড়ে গেছে।'
'কাজের চাপ নিতে বলিস না। দুদিনের জীবন, অযথা কাজের পেছনে ছুটে কি হবে।' অন্য সময় হলে শরীফের এই কথার উত্তর দিত জামাল। কিন্তু লিভার ক্যান্সারে মৃত্যুর সামনে দাঁড়ানো শরীফকে সে কথা বলার শক্তি জামালের নেই। দিনে বেঘোরে পরিশ্রম করে রাতে দুহাতে উড়িয়েছে জীবনটা। নামীদামী প্রাইভেট হাসপাতালে যাবার সঙ্গতি শরীফের নেই, জামাল নিয়ে যেতে চাইলে ধমক দিয়ে নিষেধ করেছে সে। গতকাল গণিকে রিপোর্টগুলো দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল জামাল। গণি বলেছিল- বোধহয় খুব বেশিদিন সময় নেই।

খুব নরম কণ্ঠে শরীফ বলল, 'একটা কথা রাখবি?'
জামাল হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
'এখন শিমুল গাছ কোথায় পাওয়া যাবে জানি না। নার্সারিগুলোতে পাবি না এটা নিশ্চিত। খুঁজে খুঁজে একটা শিমুল গাছ যোগাড় করবি। আমার কবরের উপর শিমুল গাছটা লাগিয়ে দিবি। আমি দিনের বেলায় অনেক শিমুল গাছ দেখেছি, কিন্তু রাতের বেলায় কখনো দেখা হয়নি। ছেলেবেলায় শুনেছিলাম শিমুল গাছে ভূত থাকে, বড় হবার পর ভূতের ভয় ছিল না বটে; কিন্তু রাতে শিমুল গাছ দেখিনি অন্য কারনে। দিনে লালরঙ্গা ফুল কিংবা শাখাভর্তি তুলা নিয়ে শিমুল গাছকে দেখে মুগ্ধ হয়েছি, রাতে জোছনায় শিমুল গাছকে দেখতে কেমন লাগবে- সেটা অনেকবার কল্পনা করেছি।এজন্য বাস্তবের শিমুল গাছ রাতে দেখা হয়নি। আমার ধারণা মৃত্যুর পরের পৃথিবীটা কল্পনার সাথে মিলে যাবে। সেই ভুবনে আমি ঠিক শিমুল গাছ হয়ে গায়ে জোছনা মাখবো, ফুল কিংবা তুলা ছড়িয়ে দেব জোছনার বুকে। এখন বল, পারবি না শিমুল গাছ এনে দিতে?'

জামাল উত্তর দিল না।
রুগ্ন দেহের মাঝেও প্রচণ্ড আশা জ্বলছে শরীফের দু'চোখে।

দেহের মৃত্যু আছে, কিন্তু স্বপ্নের মৃত্যু নেই।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৩৬

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: দারুন গল্প!

মজা থেকে একেবারে সিরিয়াস কষ্টে নিয়ে গেলেন একটানে..

রুগ্ন দেহের মাঝেও প্রচণ্ড আশা জ্বলছে শরীফের দু'চোখে।
দেহের মৃত্যু আছে, কিন্তু স্বপ্নের মৃত্যু নেই।

দারুন কথা। +++++++++++++++++++++++++

২| ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ৮:০৯

মোহাম্মদ মাহবুব হোসেন বলেছেন: ধন্যবাদ

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.