নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

একজন গাধামানব

মোহাম্মদ মাহবুব হোসেন

ডাল দিয়ে ভাত খাই, রাস্তা দিয়ে হাঁটি, মানুষ আমি ভেজাল হলে'ও আমার লেখাগুলো খাঁটি ।

মোহাম্মদ মাহবুব হোসেন › বিস্তারিত পোস্টঃ

সন্ধ্যা

০৫ ই জুন, ২০১৬ রাত ৯:০৮

- এই রিকশা, যাবা?
: না।

রিকশাওয়ালার হাতে সিগারেট জ্বলছে। বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হওয়াতে নানারকম পরিবর্তন চোখে পড়ছে, মধ্যবিত্তরা রিকশা-ট্যাক্সিতে চড়তে চায় না, পারলে হেঁটে যায়। 'খরচ কমাচ্ছেন কিনা' জিজ্ঞেস করলে বলে 'গায়ে চর্বি জমে গেছে তো, তাই হেঁটে কমিয়ে নিচ্ছি...হে হে হে...।' আগে রিকশাওয়ালারা বিড়ি টানতো, এখন খায় সিগারেট। সিগারেট সস্তা জিনিস না, সরকার বিলাসী পণ্যের উপর ট্যাক্স বাড়িয়েছে, সিগারেট সেই লিস্টে আছে। আমি সিগারেটের প্রতি সম্মান দেখিয়ে আরও বিনীত গলায় বললাম-

- তাহলে কোথায় যাবা?
: কোথাও যামু না।

আমি গলার স্বর পাল্টে ফেললাম, শান্তিনিকেতনী ভাষায় কাজ হচ্ছে না। মহাপুরুষরাও ক্ষিপ্ত হলে উল্টাপাল্টা কথা বলে বসেন, শ্রীচৈতন্য একবার ক্ষেপে গিয়ে বলে বসেছিলেন 'আমি তোরে মাইরা ফালামু', উনার তুলনায় আমি নাদান মানুষ। নিজের সামর্থ্যের মধ্যে গলার স্বর যথাসম্ভব উঁচুতে তুলে বললাম-

- ওই শুয়োরের বাচ্চা, যাবি না মানে? তুই যাবি না তোর বাপ যাবে। হারামজাদা চিনিস আমারে? জানিস কার নামে এই রাস্তা?
উচ্চবাচ্যে কাজ হল। রিকশাওয়ালা সিগারেট ফেলে দিল। ভীত গলায় বলল, কই যাইবেন?

আমি রিকশায় চড়ে বসলাম। এই মুহূর্তে আমার চোখেমুখে দার্শনিকসুলভ উদাসীনতা, সক্রেটিস সাহেবের ছবি আছে কিনা জানিনা, থাকলে সেটাকে অনুকরণ করতাম। ভালো জিনিস অনুকরণে দোষ নেই।

'স্যার, কই যাইবেন?' রিকশাওয়ালা ফের জিজ্ঞেস করল।

'যেদিক খুশি যাও, বারবার প্রশ্ন করে বিরক্ত করবা না' বলে আমি পূর্ববৎ গম্ভীর হয়ে গেলাম। রিকশা চলতে লাগল।

কোথায় যাওয়া যায়? কণার ফুপুর বাসায়? আমি গেলে ভদ্রমহিলা খুব খুশি হন। উনার রান্না করা নানা প্রকার খাদ্য আমাকে খাইয়ে তৃপ্তি পান। আমার ধারনা স্বাভাবিক মানুষ উনার খাদ্য খেলে পাগল হয়ে যাবে। খাদ্যের সুস্বাদে নয়, বিস্বাদে। কুখাদ্য রান্নায় কোন আন্তর্জাতিক পুরষ্কার থাকলে তিনি নির্ঘাত বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়ে যেতেন। উনাকে দেখা যেত বিশিষ্টজনদের সাথে সংবর্ধনায় ছবি তুলতে, সেই ছবি পত্রিকায় ছাপা হত, ক্যাপশন হত- 'কুখাদ্য রান্নায় বিশ্বসেরা বাংলার গর্ব' , খাদ্যবিষয়ক টিভি অনুষ্ঠানে সঞ্চালক হিসেবে উনাকে দেখা যেত হাসিমুখে খাবারের রেসিপি বলে যাচ্ছেন। কনজিউমারিজমের যুগে এই এক সুবিধা, জিনিস ভালো হোক আর খারাপ, একবার জাতে উঠতে পারলে এর গ্রাহক বাড়বেই।

উনার এই খাদ্য একাধিকবার খেয়েও যে আমি পাগল হচ্ছি না, তার কারন আমার হজমশক্তি। নিম্নশ্রেণীর প্রাণীদের হজমশক্তি ভালো হয়, যেমন কুকুরের। শুধু হজমশক্তি নয়, তাদের অন্যান্য ইন্দ্রিয়জাত ক্ষমতাও মানুষের চেয়ে প্রবল। আমার খুব ইচ্ছে ছিল একটা কুকুর পোষার, সমমনা ও সমমানের প্রাণীর সাথে বসবাস, কিন্তু মেসে থাকার কারনে হয়ে ওঠেনি। আচ্ছা, একটা কুকুরের দাম কেমন? কাঁটাবন গেলে জানা যাবে। থাক, আরেকদিন যাবো। তারচেয়ে জব্বারের মেসে যাওয়া যাক।

রিকশা দাঁড় করিয়ে জব্বারের মেসে গেলাম। জানা গেল, জব্বার পলাতক, তিনমাসের ভাড়া বাকি পড়ায় ম্যানেজার তাকে হারিকেন জ্বালিয়ে খুঁজছে। নিতান্ত শহর এলাকা বলে হারিকেনটা লোকসমক্ষে বের করা হচ্ছে না। মেসের ম্যানেজার গলা নামিয়ে বললেন, 'আপনার আত্মীয় নাকি উনি?' আমি গলা আরও খাদে নামিয়ে বললাম, 'নাহ ভাই, আমিও পাওনাদার, ওর কাছে দেড় লাখ টাকা পাই, কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারি না। আসলে ও গোয়েন্দা পুলিশের এজেন্ট তো, যদি পাওনা চাইলে রেগে গিয়ে কিছু করে বসে, তাই হাই-হ্যালো রেখে চলি, এই আর কী!' কথা শুনে মেসের ম্যানেজারের মুখের ভূগোল বদলে গেল, জব্বার নিজে থাকলে তারও একই প্রতিক্রিয়া হত। ম্যানেজার নরম গলায় বলল, 'জব্বার ভাই তো খুবই ভালো মানুষ, টাকা পয়সা তো দুদিনের জিনিস, আজ আছে কাল নাই। আপনার সাথে দেখা হলে আমার সালাম দিবেন, এটা তো উনারই মেস। আপনিও আসবেন ভাই।' বিদায়কালে মেসের ম্যানেজার এককাপ চা খাওয়ালো, রিকশাওয়ালাও চা খেলো, চায়ের সাথে 'একটা ছিরকেট দিলে ভালা হয়' বলামাত্র সেটাও চলে এলো। ছদ্মবেশী পুলিশের বন্ধুর ড্রাইভার বলে কথা, না এসে উপায় আছে!

জব্বারের মেস থেকে বেড়িয়ে রমনার দিকে রওনা হলাম। হঠাৎ দেখি, রাস্তার ধারে কদম কাছে ফুল ফুটেছে। এখনো বৃষ্টি সেভাবে শুরু হয়নি, অথচ কদম ফুটে গেছে! কী আশ্চর্য! আমি রিকশা থামাতে বললাম। কদম গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ালাম। এক টুকরো মাটিতে পা রেখে নিজেকে আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছে গাছটা। রিকশাওয়ালা সাগ্রহে বলল, 'স্যার, ফুল পাইড়া দিমু নি?'

আমি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়তেই সে তরতর করে গাছে উঠে গেল। এক গোছা ফুল পেড়ে এনে আমার হাতে দিল। কাউকে কিছু দেয়ার আনন্দ তার চোখেমুখে স্পষ্ট। রিকশা ফের চলতে লাগল, আমি জিজ্ঞেস করলাম-

'তোমার নাম তো জানা হল না।'
চা-সিগারেট খেয়ে রিকশাওয়ালার মনোভাব আগের চেয়ে প্রফুল্ল। সে হাসিমুখে উত্তর দিল-
'রহিজ মিয়া।'
'তোমার বাসায় কে কে আছে?'
'বউ আর একটা মাইয়া।'
'মেয়ের বয়স কতো?'
'সাত বচ্ছর।'
'পড়াশোনা করে?'
'হ স্যার। ইস্কুলে ভর্তি কইরা দিছি, একটা মাষ্টার আফা বাইত আইয়া পড়ায়। মাইয়াডা পরালেহায় ভালা।'
'বড় হলে মেয়েকে কি বানাবে?'
'আল্লার যা হুকুম, আর ওর যেইডা ভালা লাগে। পরালেহা যতদূর করতে চায় আর আমার সামর্থ্যে কুলায় আমি চালায়া যামু।'

নিম্নবিত্ত এই মানুষটার কথা শুনে ভালো লাগল, মধ্যবিত্তের ভণ্ডামি ওর মধ্যে নেই। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার নয়, বরং ও যা চায় তাই হবে- এই সুন্দর অনুভূতি মধ্যবিত্ত শিক্ষিত পিতাদের মধ্যে বিরল।

আকাশে মেঘ জমছে। বোধহয় বৃষ্টি নামবে। কণা থাকলে বেশ হত, একত্রে ভিজে বেড়ানো যেত ঝুম বৃষ্টিতে। এখন ফোন করে এ কথা বললে অনুযোগ শুনতে হবে, 'বেকার মানুষ, চাকরির চেষ্টা বাদ দিয়ে বৃষ্টিবিলাস করতে ইচ্ছে করছে?' তবু ফোন করলাম। ফোন বন্ধ পাওয়া গেল। ততক্ষণে রিকশা রমনার গেটে এসে পড়েছে। মানিব্যাগ খুলে দেখি দুটো পাঁচশ টাকার নোট। নোটদুটোর সাথে ফুলগুলোও রহিজ মিয়ার হাতে তুলে দিলাম, শুধু একটা কদম ফুল রেখে দিলাম। সেটা হাতে নিয়ে রমনায় ঢুকে পড়লাম। পেছনে রহিজ মিয়া অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

আকাশে গুরুগুরু শব্দ হচ্ছে, মেঘেরা নিজেদের উপস্থিতি জানিয়ে মানুষকে সাবধান করছে, 'হে মানুষ, বাইরে এসো না।' সে নিষেধাজ্ঞাকে উপেক্ষা করে আমি কদম হাতে নিয়ে হাঁটছি। মেঘের কালো সন্ধ্যের সাথে মিশে যাচ্ছে, ডানা মেলে সন্ধ্যা নেমে আসছে নীরবে।

নিঃসঙ্গ বাদলঘন সন্ধ্যা।

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ০৫ ই জুন, ২০১৬ রাত ৯:৫৭

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: হিমুর ছায়ায় সান্ধ্য ভ্রমন ভাল লাগল :)

২| ০৬ ই জুন, ২০১৬ রাত ১:২৬

টুথব্রাস বলেছেন:





বন্ধ হতে যাচ্ছে ফেসবুক !

বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় সর্ববৃহ‍ৎ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক। ২০০৪ সালে প্রাইভেট নেটওয়‍ার্ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবার তিনবছর পর ২০০৭ সালে বিশ্বব্যাপী ফেসবুক তাদের সার্ভিসটি উন্মক্ত করে।

একের পর এক নতুন ও আকর্ষণীয় ফিচার এনে ফেসবুক কর্পোরেশন ইতিমধ্যে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং জগতের ধার‍াই বদলে দিয়েছে।

সম্প্রতি ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকারবার্গ জানিয়েছেন, ২০৭৩ সালে তারা ফেসবুক স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দিয়ে গোয়াবুক নামে নতুন একটি সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সাইট চালু করবেন। ফেসবুকের কোনো ডাটাই সেখানে থাকবেনা। নতুন করে সবকিছূ শুরু করা হবে। এখবরটি শুনে বিশ্বব্যাপী তুম‍ুল হইচই শুরু হয়ে গেছে। বিশ্বের নানাপ্রান্তের ফেসবুক ইউজাররা ইতিমধ্যেই জুকারবার্গের স্ত্রী প্রিসিলা চ্যান কে নিয়ে গালাগ‍ালি শুরু করে দিয়েছে।

প্রিসিলা খুব শীঘ্রই আইডি ডিএকটিভেট করে দিবে বলেও জানিয়েছেন মার্ক জুকারবার্গ। ঘটনাটিতে তিনি খুবই ব্যথিত ও মর্মাহত। – প্রথম আলু ডেস্ক

৩| ০৬ ই জুন, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:৫৪

ফেরদৌসা রুহী বলেছেন: ভালো লেগেছে লেখাটা। একদম সাবলিল লেখা, একটানে পড়ার মত।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.