নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

একজন গাধামানব

মোহাম্মদ মাহবুব হোসেন

ডাল দিয়ে ভাত খাই, রাস্তা দিয়ে হাঁটি, মানুষ আমি ভেজাল হলে'ও আমার লেখাগুলো খাঁটি ।

মোহাম্মদ মাহবুব হোসেন › বিস্তারিত পোস্টঃ

সুরপিপাসা

০৭ ই জুন, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:৩৩

ডাক্তার হিসেবে মাঝেমধ্যে আমি এমন ক’জন রোগী দেখতে পাই, যারা অস্বাভাবিক সুর শুনতে পান কিংবা শিল্পকলার প্রতি আগ্রহ অনুভব করেন। এমনই একজন ছিলেন সালিমা, পেশায় রসায়নের গবেষক। ল্যাবে মনোযোগ দিয়ে কাজ করতেন, কোথাও উল্টাপাল্টা কিছু হলে বিরক্ত হতেন, বাড়িতেও সবকিছু গোছানো রাখার পক্ষপাতী ছিলেন। অসামাজিক ছিলেন না, কিন্তু কথা কম বলতেন, বিখ্যাত বিজ্ঞানী মাদাম কুরির সাথে উনার আচরণের খানিকটা মিল দেখা যায়। এই গবেষকের জীবনে তেমন ব্যতিক্রমী কোন বৈশিষ্ট্য ছিল না, শুধু একটি ছাড়া। তিনি মাঝেমধ্যে কল্পনায় হারিয়ে যেতেন, সেখানে একটি সমুদ্র সৈকতে তিনি বসে আছেন, অলৌকিক একটা সুর অবিরত বেজে চলেছে- এমন একটা দৃশ্যে নিজেকে আবিষ্কার করতেন। পুরো ব্যাপারটি তার স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডকে অক্ষুণ্ণ রেখেই ঘটতো, হয়তো তিনি কথা বলছেন বা গাড়ি চালাচ্ছেন, কিন্তু মনে মনে সেই ভুবনে নিজের অস্তিত্ব সমানভাবে অনুভব করছেন।

অন্য কোন মানসিক বা স্নায়বিক সমস্যা সালিমার হয়নি, সবকিছু ভালোই চলছিল। কিন্তু ২০০৩ সালে প্রথম যখন তিনি খিঁচুনি দিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়লেন, তখন তাকে স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নেয়া হল। মস্তিষ্কের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে ডান টেম্পোরাল লোবে বেশ বড়সড় একটা টিউমার পাওয়া গেল। চিকিৎসকেরা তার পূর্ববর্তী অস্বাভাবিক কল্পনাগুলোকে ‘temporal lobe seizure’ আখ্যা দিলেন, টিউমারটি ক্যান্সারকোষ বহন করছে- এমন সন্দেহে অপারেশনের পরামর্শও দিলেন। এই অপারেশনে ঝুঁকি রয়েছে, এমনকি অপারেশনের পর উনার আচরণের পরিবর্তনও হতে পারে- এসব শুনে সালিমা খুবই ঘাবড়ে গিয়েছিলেন, তবু শেষ পর্যন্ত তিনি অপারেশন করালেন।

কোন জটিলতা ছাড়াই অপারেশন সম্পন্ন হল, কয়েক সপ্তাহ পরে সালিমা কর্মস্থলে ফিরে এলেন।

আগে সালিমা একজন রক্ষণশীল মহিলা ছিলেন, নিজের বাসাতেও সবকিছু গোছগাছ না থাকলে খুব অস্বস্তিতে ভুগতেন। কিন্তু উনার স্বামী লক্ষ্য করলেন, অপারেশনের পর থেকে সালিমা আর আগের মতো খুঁতখুঁতে আচরণ করছেন না। তিনি যেন অনেক বেশি প্রাণবন্ত ও উদার আচরণ করছেন। এই পরিবর্তনে তার স্বামীও বেশ খুশি হলেন।

পনেরো বছর ধরে একই ল্যাবে মেধা ও দক্ষতার সাথে সালিমা কাজ করে এসেছেন, কিন্তু সব সময় খানিকটা নিজের ভেতর গুটিয়ে থাকতে ভালোবাসতেন। সেই মানুষটি অপারেশনের পর থেকে ল্যাবের সবার সাথে হাসিখুশিভাবে মেলামেশা শুরু করলেন, নিজের পেশাগত দক্ষতায় কোন পরিবর্তন ছাড়াই তিনি যেন অন্য এক মানুষে পরিণত হয়ে গিয়েছিলেন। সহকর্মীদের সুখে-দুঃখে সালিমাকে নির্দ্বিধায় পাশে পাওয়া যেত, তিনি হয়ে উঠলেন ল্যাবের সামাজিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু।

একই সাথে তার নতুন আরেকটি স্বভাব দেখা গেল যেটা আগে ছিল না, তা হচ্ছে প্রচুর গান শোনা। শৈশবে অল্পস্বল্প পিয়ানো বাজানোর অভিজ্ঞতা থাকলেও পরে কখনো গানের প্রতি তার ঝোঁক দেখা যায়নি। সেই মানুষটি গানের কনসার্টগুলোতে নিয়মিত যাওয়া শুরু করলেন, নতুন নতুন সিডি কিনে ঘোর ভরিয়ে ফেলতে লাগলেন, বাসা থেকে অফিসে যাবার পথে তার কনভার্টিবল গাড়ির রেডিওতে উচ্চস্বরে গান বাজতো। একই পথ ধরে অফিসে আসা সালিমার এক সহকর্মীর ভাষায়, ‘আমি আধ মাইল দূর থেকেই ওর গাড়িতে বেজে চলা গানের শব্দ শুনতে পেতাম।‘

জীবনে আবেগের এই অভাবনীয় পরিবর্তন ও সুরের প্রেমে আচ্ছন্ন হওয়া সম্পর্কে সালিমার নিজের বক্তব্য, ‘অপারেশনের পর মনে হল আমার যেন পুনর্জন্ম হয়েছে। জীবনটা যেন আমার সামনে নতুন করে আবির্ভূত হয়েছে, প্রতি মুহূর্তে যার সৌন্দর্য আমাকে ক্রমেই মুগ্ধ থেকে মুগ্ধতর করে চলেছে।‘

(অলিভার স্যাক্সের ‘মিউজিকোফিলিয়া’ গ্রন্থের ভাবানুবাদ- ২)

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.